আমি আসবই,পর্ব-৪,৫

0
1600

আমি আসবই,পর্ব-৪,৫
লেখিকা-সাইবা চৌধুরী
পর্ব-৪

বাসার সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো বাচ্চার সন্ধান পায় না অর্পিতা।
হন্নে হয়ে এখনও খুঁজে চলেছে সবখানে।
ছোফার নিচ, র্যাক ফ্রিজ কোনোকিছুই বাদ রাখে না সে।
তার এমন আচরণে হাসিবের মা বাবা বেশ অবাক হন।
কি খুঁজছে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেও অর্পিতার থেকে কোনো উত্তর মেলে না।
অগত্যা হাসিবের মা, জোহরা বেগম উঠে গিয়ে অর্পিতার কাঁধে হাত রাখেন।
কিন্তু অর্পিতার সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই।
জোহরা বেগম অর্পিতাকে কয়েকবার ডাক দেয়।
তার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে অর্পিতাকে ধরে জোরে একটা ঝাকি দেয়।
ঝাকি দেওয়ার সাথে সাথে অর্পিতার টনক নড়ে।
জোহরা বেগমের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে।
কিছুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে ঢলে পরে যায় জোহরা বেগমের গায়ের উপর।
.
.
.
প্রায় ১ ঘন্টা হয়ে গেছে অর্পিতার জ্ঞান ফিরছে না। জ্ঞান ফেরানোর জন্য অনেক ঘরোয়া চেষ্টা করেও ব্যর্থ তারা। অতঃপর জোহরা বেগম ডাক্তারকে খবর দেন।
২০ মিনিট পরে একজন মহিলা ডাক্তার বাসায় আসেন।
সবকিছু চেক করে তিনি জানান,
-ভয়ের কিছু নেই একসময়ে এমন একটুআধটু হয়েই থাকে।
আমি কিছু মেডিসিন লিখে দিচ্ছি ওনাকে নিয়মিত খেতে বলবেন।
ডাক্তারের কথা শুনে জোহরা বেগম প্রশ্ন করলেন,
-এসময়ে বলতে কি বুঝিয়েছেন ডাক্তার?
প্রতি উত্তরে ডাক্তার বললেন,
-সেকি আপনারা জানেন না!
সি ইজ প্রেগন্যান্ট।
বাচ্চার হার্টবিটও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
ডাক্তারের কথা শুনে জোহরা বেগম খুব খুশি হলেন। ডাক্তারকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এসে
খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন।
হাসিবের বাবা সাইফ খানকে খবরটা দিয়ে বললেন, বাজারে গিয়ে মিষ্টি কিনে আনতে।
.
.
.
অর্পিতার মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন জোহরা বেগম।
হঠাৎ দরজার কাছে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ আসে তার কানে।
দৌড়ে দরজা খুলে দেখেন মিষ্টিসহ সাইফ সাহেব পরে আছেন দরজার সামনে।
বয়স্ক মানুষ হয়ত লিফট বন্ধ থাকায় এতো উপরে উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছেন।
জোহরা বেগম তাড়াতাড়ি করে তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করেন।
কিন্তু কোমড়ে মাত্রাতিরিক্ত ব্যাথা পাওয়ায় উঠে দাঁড়াতে অক্ষম সাইফ সাহেব।
জোহরা বেগম কষ্ট করে টেনে তুলে কোনোরকমে সোফার উপরে নিয়ে বসান তাকে।
পেইন কিলার খাইয়ে দিয়ে কোমড়ে বরফ ডলতে থাকেন।এর মাঝে
অর্পিতার ডাক শুনে জোহরা বেগম সাইফ খানকে বসতে বলে অর্পিতার রুমের দিকে এগিয়ে যান।
রুমে গিয়ে তিনি দেখতে পান, অর্পিতার জ্ঞান ফিরেছে।
অর্পিতার কাছে গিয়ে মাথায় হাত রেখে বলেন,
-কোনো সমস্যা মা?
কিছু লাগলে বলো আমি এনে দেই।
অর্পিতা মাথা ধরে বলে,
-কিছু লাগবে না মা। কিন্তু মাথাটা ভিষণ ভারি হয়ে আছে।
জোহরা বেগম চেহারায় গম্ভীরতা এনে বলেন,
-সেতো একটু হবেই। তবে তোমার উপর আমরা খুব রাগ করেছি। অনেক বড় অপরাধ করেছো তুমি।
জোহরা বেগমের কথা শুনে অর্পিতা অবাক হয়ে বলে,
-অপরাধ! কিন্তু কি অপরাধ করেছি আমি মা?
-তোমাদের সংসারে যে একজন সদস্য আসতে চলেছে তা আমাকে জানাওনি। এটা কি অপরাধ নয়?
তবে যাই হোক আজ আমি খুব খুশি।
ডাক্তার এসেছিলেন, কিছু মেডিসিন লিখে দিয়ে গেছেন সেগুলো নিয়মিত খেতে হবে কিন্তু।
-ডাক্তার কেন এসেছিলো?
-কেন আবার! মাথা ঘুরে যে পরে গিয়েছিলে সেগুলো কি মনে নেই তোমার?
প্রায় ২ ঘন্টা ধরে তুমি অজ্ঞান।
অনেক কথা তো হলো এবার উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও।
আজ বুয়া আসেনি যাই দুপুরের খাবারটা প্রস্তুত করে ফেলি।
কথাগুলো বলে জোহরা বেগম অর্পিতার রুম থেকে চলে গেলেন।
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো অর্পিতা তার চলে যাওয়ার দিকে।
কি হচ্ছে তার সাথে কিছুই বুঝে আসছে না।
কিন্তু বাচ্চার কথা এখন সবাই জেনে গেছে।
তাছাড়া কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা বাস্তব নাকি তার ভ্রম এবিষয়ে সে পরিষ্কার না হলেও, ঘটনাটি তার মনে বাচ্চার জন্য বেশ মায়া সৃষ্টি করেছে।
অর্পিতা মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়,
সে বাচ্চাটিকে আর নষ্ট করার চেষ্টা করবে না।
“এতোকিছু করেও যখন কিছু হলো না তখন হয়ত আল্লাহ চান ও পৃথিবীতে আসুক।
তবে আমার সাথে এমন কেন হচ্ছে?
এমন যদি হয় তাহলে অতি শীঘ্রই আমি পাগল হয়ে যাবো।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আজই একবার সাইক্রিয়াটিকের কাছে যেতে হবে। ক’দিন পর আমার এক্সাম, আমি কোনোভাবেই রিস্ক নিতে পারবো না।
মনে মনে কথাগুলো বলে অর্পিতা উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়।
.
.
.
জোহরা বেগমকে কাজে সাহায্য করতে গেলে তিনি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন, এখন থেকে বাসার কোনো কাজ যেন অর্পিতা না করে।
নিজের ঠিকমতো যত্ন নিতে হবে এটাই এখন তার বড় কাজ।
জোহরা বেগমের কথা শুনে অর্পিতার মন জুড়িয়ে যায়। নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করে এমব একটা পরিবার পেয়ে।
জোহরা বেগমের অনিচ্ছা সত্ত্বেও অর্পিতা রান্না ঘরে তাকে টুকটাক সাহায্য করে হাসিবের কাছে যায়।
হাসিব এখনও পূর্ন ভাবে সুস্থ হয়ে ওঠেনি।
বিছানা ছেড়ে এখনও একা উঠতে পারে না সে।
তবে খুব শীঘ্রই সে সুস্থ হয়ে যাবে বলে সবাই আশাবাদী।
.
.
.
.
সময় বিকাল ৪ টা।
ইতিমধ্যে অর্পিতা একজন মনরোগ-বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলে ৫ টায় এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রেখেছিলো।
জোহরা বেগমকে ভার্সিটিতে একটা বিশেষ কাজ আছে, খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে বলে বেরিয়ে পরে।
ঘড়িতে ৫.৩০ বাজে।
ডাক্তারের সামনে বসে আছে অর্পিতা।
ডাক্তার তার সমস্যার বিস্তারিত শুনেছে।
অর্পিতাও তার সাথে ঘটে যাওয়া সব কথা জানিয়েছে তাকে।
সব শুনে ডাক্তার বললেন,
-প্রেগন্যান্সি নিয়ে দুশ্চিন্তাই এসবের মুল কারণ।
শুরু থেকেই বাচ্চা নিয়ে আপনি যেহেতু পেরেশানিতে ভুগছিলেন তাই নানাভাবে আপনার দুশ্চিন্তা আপনার সামনে ফুটে উঠতো।
এটা আপনার ভ্রম ছাড়া কিছুই না।
এখন আপনার করনীয়,
যতটা সম্ভব নিজেকে দুশ্চিন্তা থেকে দূরে রাখবেন।
বিনোদনমুলক শর্টফিল্ম দেখবেন এবং যথাসম্ভব অন্ধকারকে দূরে রাখবেন।
যেহেতু একজন নতুন সদস্য আসতে চলেছে নিজের যত্ন ও নিবেন।
আশা করি পরবর্তীতে এইধরনের কোনো সমস্যা হবে না।
.
.
.
ডাক্তারের থেকে বিদায় নিয়ে অর্পিতা বাসায় ফিরে আসে।
বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে যায়।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার কলিংবেল বাজাতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয় হাসিব।
হাসিবকে দরজা খুলে দিতে দেখে অর্পিতা অনেক অবাক হয়।
যেই হাসিব বের হওয়ার আগেও বিছানা থেকে একা উঠতে পারেনি,সে এখন সুস্থ সবল ভাবে তার সামনে দাঁড়ানো!
এতো অল্প সময়ে হাসিবের এমন পরিবর্তন দেখে খুশির সাথে সাথে বেশ অবাকও হয় অর্পিতা।
কিন্তু বাসার ভেতরে তাকিয়ে দেখে বাসা একদম অন্ধকার।
এমন অন্ধকারের কারণ জানতে চািলেও হাসিব কোনো উত্তর দেয় না।
ফোনের টর্চ অন করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই বাসার ভেতরে হরেকরকমের আলো জ্বলে ওঠে।
ভেতর থেকে জোহরা বেগম এবং সাইফ সাহেব সমস্বরে অর্পিতাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়।
অর্পিতা দেখতে পায় বড় একটা কেক ট্রেতে সুন্দর করে সাজানো তার চারপাশে অনেকগুলো মোমবাতি জ্বলছে।
এতো সমস্যার ভীড়ে নিজের জন্মদিনের কথা বেমালুম ভুলেই গেছিলো সে।
হুট করে এমন সারপ্রাইজ পেয়ে মনটা খুশিতে ভরে উঠলো তার।
কেক কাটা শেষে সবাই মিলে অনেক ভালো সময় কাটিয়ে যে যার রুমে চলে যায়।
জোহরা বেগম যাওয়ার সময় অর্পিতা ডাক দিয়ে কিছু ঔষধ হাতে দিয়ে বলে,
-এগুলো বাবার জন্য।
বিকালে যেভাবে ব্যাথায় কাতরাচ্ছিলেন, ঔষধ না খাইয়ে রাখাটা একদম উচিৎ হবে বলে মনে হলো।
এগুলো আমি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এনেছি।

অর্পিতার মাথায় হাত রেখে জোহরা বেগম বলল,
-তোমার শ্বশুর মশাই এখন একদম সুস্থ।
যদিও বিকালের বিষয়টা নিয়ে আমিও খুব চিন্তায় ছিলাম কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি বললেন ওনার নাকি সব ব্যাথা হুট করে কমে গেছে।
অর্পিতা ভেতরে ভেতরে ভাবনায় পড়ে গেলেও আর কোনো কথা বাড়ায় না।
হাসিবকে নিয়ে রুমে চলে যায়।
রুমে গিয়ে বাচ্চার বিষয়ে নিজের সিদ্ধান্ত জানালে হাসিবও দ্বিমত করেনি।
.
.
.
এভাবে কেটে যায় কয়েকমাস।
এরমাঝে কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি বরং অনেক ভালো সময় কেটেছে সবার।
অর্পিতার ভার্সিটির এক্সামও শেষ হয়েছে।
এবারের রেজাল্ট নিয়ে অর্পিতা খুব আশাবাদী।
এক্সপেকটেশনের থেকেও বেস্ট এক্সাম হয়েছে তার।
হাসিবের অফিসেও অনেক উপরের পোস্টে প্রমোশন হয়েছে।
সাইফ সাহেব ইতালি থেকে একবারে দেশে এসে যেই বিজনেস শুরু করেছিলো সেটাও ২-১ মাসের মধ্যে অনেক এগিয়ে গেছে। সবমিলিয়ে তাদের সবকিছু ম্যাজিকের মতো পাল্টে যায় কিছুদিনের মধ্যে।
এদিকে অর্পিতারও ডেলিভারির সময় ঘনিয়ে আসে।
আজ সকাল থেকেই প্রচুর পেইন হচ্ছে অর্পিতার।
গাড়িতে করে ১১ টার দিকে তাকে নিকটস্থ হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়।
দুপুর ১২ টার সময় অর্পিতাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়।
.
.
বেশ কিছুক্ষণ পরে টাওয়ালে পেঁচিয়ে একজন নার্স একটা বাচ্চা নিয়ে এসে জোহরা বেগমের কোলে দেয়।
জোহরা বেগমের দুচোখে খুশিতে পানি চলে আসে
-মা ও বাচ্চা উভয়েই সুস্থ আছেন।
কথাটা বলে
বাচ্চাটিকে দ্রুত জোহরা বেগমের কোলে দিয়ে নার্স কেবিন থেকে বের হয়ে যায়।
জোহরা বেগম শুনতে পান, কেবিনের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে নার্স কাউকে বলছে,
-এতো কুৎসিত বাচ্চা আমি জীবনেও দেখিনি।
কি উদ্ভট চেহারা। নাক, চোখ, গায়ের রঙ সব মিলিয়ে একদম বিশ্রী কদাকার চেহারা।
নার্সের কথা শুনে জোহরা বেগম বাচ্চার মুখ থেকে টাওয়েল টা সরায়।
বাচ্চাটিকে দেখে জোহরা বেগমের বুকটা ধুক করে কেঁপে ওঠে। নিমিষেই হাসিখুশি মুখটা কালো হয়ে যায়।
এতো কুৎসিত চেহারা কিভাবে হতে পারে!
বাচ্চাটির মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন তিনি।
কিছুক্ষণ আগেও এই বাচ্চাটা নিয়ে কতো কিছু ভেবে রেখেছিলেন তিনি অথচ এখন সব ইচ্ছে যেন মরে গেলো।
জোহরা বেগমের চিন্তায় ছেদ পড়ে আচমকা কোলের বাচ্চাটির মিষ্টি সুরে খিলখিলিয়ে হাসির শব্দে।
চোখে বিস্ময় নিয়ে বাচ্চাটির দিকে তাকান তিনি।
মনে মনে ভাবেন,
১ দিনও হয়নি বাচ্চার বয়স, এমন একটা বাচ্চা এভাবে কি করে হাসতে পারে?
এটা যে একদমই অবিশ্বাস্য।
.
.
.
চলবে।

আমি আসবই
পর্ব-৫
লেখিকা-সাইবা চৌধুরী

-এতো কুৎসিত বাচ্চা আমি জীবনেও দেখিনি।
কি উদ্ভট চেহারা। নাক, চোখ, গায়ের রঙ সব মিলিয়ে একদম বিশ্রী কদাকার চেহারা।
নার্সের কথা শুনে জোহরা বেগম বাচ্চার মুখ থেকে টাওয়েল টা সরায়।
বাচ্চাটিকে দেখে জোহরা বেগমের বুকটা ধুক করে কেঁপে ওঠে। নিমিষেই হাসিখুশি মুখটা কালো হয়ে যায়।
এতো কুৎসিত চেহারা কারো কিভাবে হতে পারে!
বাচ্চাটির মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন তিনি।
কিছুক্ষণ আগেও এই বাচ্চাটা নিয়ে কতো কিছু ভেবে রেখেছিলেন, অথচ এখন সব ইচ্ছেই যেন মরে গেলো।
জোহরা বেগমের চিন্তায় ছেদ পড়ে আচমকা কোলের বাচ্চাটির মিষ্টি সুরে খিলখিলিয়ে হাসির শব্দে।
চোখে বিস্ময় নিয়ে বাচ্চাটির দিকে তাকান তিনি।
মনে মনে ভাবেন,
১ দিনও হয়নি বাচ্চার বয়স, এমন একটা বাচ্চা এভাবে কি করে হাসতে পারে?
এটা যে একদমই অবিশ্বাস্য।
.
.
.
বাচ্চাটিকে জোহরা বেগমের কোল থেকে নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেন সাইফ সাহেব।
জোহরা বেগমের কোলের দিকে তাকিয়ে সাইফ সাহেবও চমকে ওঠেন।
তখনই হুড়মুড় করে প্রবেশ করে হাসিব।
জোহরা বেগমের কোল থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে সে।
দু’চোখে, মুখে চুমু দিতে শুরু করে।
হাসিব খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়।
তার আচরণ দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন জোহরা বেগম ও সাইফ সাহেব।
হাসিবের এসব কান্ড দেখে মনে হচ্ছে,
বাচ্চাটি যে এতো কুৎসিত এটা তার চোখেই পরছে না।
সাইফ সাহেবকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে,
হাসিব বাচ্চাটিকে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
-কোলে নিতে ইচ্ছে করছে তাই না বাবা! এই নাও আমার ছোট্ট সোনামনিকে।
বাচ্চাটির দিকে আরও একবার তাকিয়ে সাইফ সাহেব মুখ ফুটে বলে ফেলেন,
-এতো কুৎসিত চেহারা কিভাবে হতে পারে!
এমন বাচ্চা হওয়ার থেকে তো আজীবন নিঃসন্তান
থাকা ভালো ছিল তোর।
কথাগুলো বলে বাচ্চাটিকে কোলে না নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে যান তিনি।
সাইফ সাহেবের এমন ব্যবহার দেখে বেশ বিরক্ত হয় হাসিব।
জোহরা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,
-বাবা কিন্তু অনেক বেশি বেশি করছে। আমার মেয়েকে নিয়ে এধরণের কোনো কথা শুনতে আমি রাজি না।
জোহরা বেগম হাসিবের কথার কোনো উত্তর দিলেন না।
বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি একটা চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লেন।
এটা দেখে হাসিব আবারও বলল,
-দেখো আমার বাচ্চা নিয়ে তোমাদের কি মনোভাব সেটা জানার আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।
তবে অনুরোধ একটাই, অর্পিতার সামনে এমন আচরণ করা থেকে বিরত থাকবে।
কথাগুলো বলে হাসিব আবারও বাচ্চাটির মুখে চুমু খেতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে অর্পিতাকেও নিয়ে আসা হয়।
অর্পিতাকে বেডে শিফট করার পরে হাসিব তার পাশে গিয়ে বসে।
বাচ্চাটিকে অর্পিতার বুকের উপর রেখে বলে,
-দেখো অর্পি আমাদের একটা রাজকন্যা হয়েছে।
কি সুন্দর তোমার দিকে তাকিয়ে তোমাকে হাই বলছে।
অর্পিতা বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে দু’চোখের পানি ছেড়ে দেয়।
পরম মমতা নিয়ে এক নজরে তাকিয়ে থাকে বাচ্চাটির দিকে।
হাসিব আবারও বলে,
-আমাদের মেয়ের সুন্দর একটা নাম খুঁজেছি আমি।
ওর নাম রাখবো “নুরী”
নামটা তোমার পছন্দ হয়েছে তো অর্পি?
হাসিবের কথা শুনে অর্পিতা হ্যাসুচক মাথা নাড়ায়।
এনেস্থিসিয়ার প্রভাব থেকে যাওয়ার ফলে অর্পিতার মস্তিষ্ক তখন সম্পুর্নভাবে কাজ করছিলো না।
তাই ধীরে ধীরে আবারও ঘুমের কোলে ঢলে পরে সে।
.
.
জোহরা বেগম ভেবেছিলেন, বাচ্চাটিকে দেখে হয়ত অর্পিতা তাদের মতোই রিয়েক্ট করবে কিন্তু এমন কিছুই হলো না।
এমনকি এতো কুৎসিত চেহারা দেখে বিন্দুমাত্র খারাপ লাগার ছটাও দেখেন নি তাদের মাঝে।
বরং নুরীকে নিয়ে দু’জনই খুব খুশি। চেহারার বিষয়টি কোনো ইফেক্টই ফেলেনি তাদের মাঝে।
.
.
পরদিন বিকাল।
অর্পিতা হাঁটাচলা করতে না পারলেও এখন মোটামুটি সুস্থ।
নুরীকে তো সারাদিন কোলে করে বসে থাকে হাসিব।
বাবার চোখের মনি সে।
দরজায় নক করে ডেইলি চেকআপের জন্য ভেতরে প্রবেশ করে পূর্বের সেই নার্স।
জোহরা বেগম তার দিকে তাকিয়ে দেখতে পান,তার চোখের অনেকটা এড়িয়া জায়গা কালো হয়ে আছে, মুখের নানা জায়গায় মেছতার মতো কালো কালো ছোপ ছোপ দাগ, চোয়ালের মাংস অনেকখানি ঝুলে পড়েছে নিচ দিকে,নাকটাও আগের তুলনায় লম্বা মনে হচ্ছে সবমিলিয়ে খুবই অদ্ভুত ধরনের কুৎসিত লাগছে তাকে। কালকের চেহারা সাথে এই চেহারা পার্থক্য আকাশ পাতাল।
এমন অদ্ভুত চেহারা দেখে জোহরা বেগম অনেক আশ্চর্য হলেন।
অবাক হয়ে তাকে প্রশ্ন করলেন,
-তুমি কি কালকের সেই নার্স?
নার্স হ্যাসুচক জবাব দিলে জোহরা বেগম বলেন,
-তাহলে তোমার চেহারার এ কি হাল!
কিছু মনে করো না। গতকাল এমন দেখেছি বলে তো মনে হচ্ছে না।

নার্স একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-জানিনা মেম।
একরাতের ভেতরে আমার কিভাবে এই পরিবর্তন হলো। এই চেহারা নিয়ে মানুষের সামনে যেতেও লজ্জা লাগছে।
মনে হচ্ছে বাকি জীবনটা বাসায় বসেই কাটিয়ে দিতে হবে।

নার্সের কথার কোনো উত্তর দেন না জোহরা বেগম।
কিন্তু এমন একটা বিষয়ে তিনিও খুব চিন্তায় পরে যান।
.
.
এভাবে কেটে যায় আরও সাতদিন।
অর্পিতা এখন অনেকটাই সুস্থ।
এর মাঝে সেই নার্সকে আর দেখতে পাননি জোহরা বেগম।
সাইফ সাহেবও সেদিনের পর থেকে আর হসপিটালে আসেননি।
আজ হাসপাতালে অর্পিতার শেষ দিন।
সবকিছু গুছিয়ে হাসিব তাদের নিয়ে রওনা হয় বাসার উদ্দেশ্যে।
.
.
এরপর কেটে যায় আরও কয়েকদিন।
সবমিলিয়ে দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিল।
মা-বাবার পরম ভালোবাসা ও যত্নের সাথে বেড়ে উঠছিলো নুরী।
অদ্ভুত বিষয় হলো নুরী জন্মের পর থেকে কখনোই কান্না করেনি।
শুধু মিষ্টি হাসিতে মুখর করে রাখত পুরো বাসা।
কিন্তু জোহরা বেগম এবং সাইফ সাহেব দু’জনের কেউ ই এখনও মেনে নিতে পারেন নি নুরীকে।
অর্পিতা ও হাসিবের সামনে কিছু বলতেও পারতো না,তবে সর্বদাই নুরীর থেকে দূরে দূরে থাকতো।
এমনকি প্রতিবেশী কেউ নুরীকে দেখার উদ্দেশ্যে আসলেও তাকে দরজা থেকেই পাঠিয়ে দিতো মিথ্যা কোনো বাহানা দেখিয়ে।
এমন চেহারার মেয়েকে কেউ দেখুক আর সেটা নিয়ে মজা করুক এটা তিনি চাইতেন না।
এরমাঝেই সাইফ সাহেবের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায় অনেক বড় ধরণের লোকসান হয়ে যায়।
এক প্রকারে সবকিছু হারিয়ে যাওয়ার মতোই।
হঠাৎ ব্যবসায় এতো লস দেখে খুব দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকেন সাইফ সাহেব।
এসব বিষয় নিয়েই আজ বিকালে সাইফ সাহেবের সাথে বসে কথা বলছিলেন জোহরা বেগম।
হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠায় জোহরা বেগম এগিয়ে যান দরজা খুলতে।
দরজা খুলে তিনি দেখতে পান পাশের ফ্লাটের মহিলাটি আবারও এসেছেন নুরীকে দেখার জন্য।
জোহরা বেগম বিরক্তি নিয়ে তাকে জানান,
-বাচ্চা এখন ঘুমাচ্ছে।
জাগলে আমি আপনাকে ডাক দেবো।
তার সাথে কথা বলার মাঝে সাইফ সাহেবের রুম থেকে জোহরা বেগমের কানে একটা গোঙানির শব্দ ভেসে আসে।
দরজা দিয়ে তিনি দৌড়ে যান তার হাজবেন্ড এর কাছে।
সেখানে গিয়ে তিনি দেখতে পান,
ফ্লোরের উপর পড়ে গোঙাচ্ছেন সাইফ সাহেব।
মুখ থেকে সাদা সাদা ফেনা বের হচ্ছে।
এমন অবস্থা দেখে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন জোহরা বেগম।
চিৎকারের শব্দ শুনে নুরীকে কোলে নিয়ে ছুটে আসে অর্পিতা।
এসেই এমন পরিস্থিতি দেখে সে দ্রুত হাসিবকে কল দেয়। ডাক্তার নিয়ে আসার কথা বলে অর্পিতা ফোন কেটে দেয়ার পর, জোহরা বেগম কান্নারত কন্ঠে বলে ওঠেন,
-সব কিছু হচ্ছে তোমার এই কুৎসিত মেয়ের জন্য।
যবে থেকে পৃথিবীতে এসেছে তখন থেকেই একটার পর একটা অঘটন ঘটেই চলেছে।
যার চেহারার মাঝে এতো অন্ধকার সে সংসারে আলো আনবে কিভাবে!
এই অশুভ অলক্ষুণেকে সরাও আমার সামনে থেকে।

জোহরা বেগমের কথা শুনে অনেক কষ্ট পায় অর্পিতা।
তবুও কিছু না বলে চুপ করে থাকে,মনে মনে ভাবে,বাবার এমন অবস্থা দেখে হয়ত তিনি ভুলভাল বলছেন।
নুরীকে রুমে শুইয়ে দিয়ে এসে দু’জন মিলে ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দেয় সাইফ খানকে।
কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার নিয়ে হাসিবও চলে আসে।
ডাক্তার সবকিছু দেখে কিছু ঔষধ লিখে দিয়ে যান।
সাইফ সাহেব প্যারালাইসিসের মতো বিছানায় পড়ে আছেন।
ডাক্তার বলেছেন,প্রবল ব্যাথার কারণে এমনটা হচ্ছে, ব্যাথাটা কমলে কিছুদিনের মধ্যে তিনি আগের মতো হয়ে যাবেন।
হাসিব ডাক্তারকে এগিয়ে দিয়ে এসে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে, অর্পিতাও নুরীর কাছে চলে যায়।
জোহরা বেগম বসে থাকেন সাইফ সাহেবের পাশেই।
.
.
.
অর্পিতা জোহরা বেগমের কথাগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে প্রবেশ করে নিজের রুমে।
রুমে ঢুকতেই তার চোখ চলে যায় বিছানার পাশে একটা জানালার দিকে।
অর্পিতা দেখতে পায়, জানালার থাই গ্লাসের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা কালো অবয়ব।
অবয়বটার আকৃতি মানুষের থেকে বেশ বড়।
কাঁচের উপরে একটা হাত রেখে, টকটকে লাল জ্বলন্ত চোখে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে নুরীর দিকে।
অবয়বটির দিকে চোখ পড়ার পরে অর্পিতা ভয়ে পাথরের মতো নিশ্চুপ হয়ে যায়। নড়াচড়ার শক্তিটুকুও হ্রাস পায় তার। হঠাৎ করেই অর্পিতার চোখে চোখ পরে অদ্ভুত কালো শরীরের অবয়বটির।সাথে সাথেই জানালার কাঁচের সামনে থেকে দ্রুত কোথাও অদৃশ্য হয়ে যায় জিনিসটি।
.
.
.
.
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here