আমি আসবই পর্ব-৩
লেখিকাঃ সাইবা চৌধুরী
সামনের দিকে তাকিয়ে সবাই দেখতে পেলো,ছিনতাইকারীদের বাইকটা ব্লাস্ট হয়ে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছে। টাকার ব্যাগটি ছিটকে দূরে পড়ে আছে।
ওদের শরীরেও আগুন লেগেছে।
জ্বলন্ত শরীর নিয়ে তারা রাস্তার উপরে দিগবিদিক ছুটতে শুরু করছে।
তাদের ভয়ানক চিৎকারে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে সবার। অর্পিতা সময় নষ্ট না করে দৌড়ে টাকার ব্যাগটি তুলে নিয়ে ট্যাক্সিতে বসে পরে।
.
.
অপারেশনের জন্য রিসিপশনে টাকা জমা দিয়ে বাকি সব ফর্মালিটি শেষ করে ফেলে অর্পিতা।
ডাক্তার জানিয়েছেন বিকাল ৪ টায় হাসিবকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হবে।
মনে হাজার সংশয় নিয়ে অর্পিতা কাঙ্ক্ষিত সময়ের অপেক্ষা করতে থাকে।
.
.
.
৪ টা বেজে ৩০ মিনিট।
হাসিবকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আরো কিছুক্ষন আগেই। অস্থির হয়ে গেছে অর্পিতার মন।
ইতালি থেকে ফোনের পর ফোন দিয়ে যাচ্ছে হাসিবের মা বাবা।
কিন্তু এই মুহূর্তে কারও সাথে কথা বলার মতো মুড নেই অর্পিতার।
হাসিবের অপারেশন চলছে, সবাই ওর জন্য দোয়া করুন।
একটা স্টাটাস দিয়ে ফোন অফ করে রেখে দেয়। এরপর একান্ত মনে
আল্লাহর কাছে হাসিবের জন্য প্রার্থনা করতে থাকে অর্পিতা।
কান্না করতে করতে চোখদুটো ফুলে গেছে তার।
এমন সময়ে নিজেকে সামলানো খুবই মুশকিল।
স্বান্তনা দেওয়ার মতো বা এই বিপদে পাশে দাঁড়ানোর মতো অর্পির একটা মানুষের যে খুব প্রয়োজন।
.
.
টানা ১ ঘন্টা পরে অপারেশন শেষ হয়।
ডাক্তার বের হতেই অর্পিতা ছুটে যায় তার কাছে।
ডাক্তার জানান,
অপারেশন সম্পূর্ণ হয়েছে তবে ২৪ ঘন্টার আগে তারা বলতে পারবে না অপারেশন কতোটা সাকসেসফুল হয়েছে।
একজন বলল,
“দোয়া করুন শীঘ্রই যেন তার জ্ঞান ফিরে আসে। ”
২৪ ঘন্টার ভেতরে যদি জ্ঞান না ফেরে তাহলে কি হাসিবকে আর ফিরে পাবো না!
মনে মনে কথাটা ভেবেই শিউরে ওঠে অর্পিতা।
নিজেকে নিজে বকা দিয়ে বলে, না না কি সব আজেবাজে চিন্তা করছি!
হাসিব একদম সুস্থ হয়ে যাবে।
ওকে যে সুস্থ হতেই হবে।
অনবরত চোখের পানি পড়তে থাকে তার।
.
.
.
রাত ১১ টা বেজে গেলো।
এখন পর্যন্ত হাসিবের জ্ঞান ফেরেনি।
হাসিবের মাথার কাছে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে অর্পিতা।
.
..
.
.
আচমকা
বিরাট এক শব্দ হয় হাসিবের বেডের পাশ থেকে।
বিশাল গর্ত হয়ে ফ্লোর নিচের দিকে ভেঙে পরে।
গর্তের ভেতর থেকে কলকল কলকল শব্দ আসছে।
অর্পিতা হঠাৎ করেই এমন পরিস্থিতিতে পরে খুব ঘাবড়ে যায়।
ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে গর্তের ভেতর উঁকি দেয় সে।
অর্পিতা দেখতে পায়, গর্তের ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে রক্তের স্রোত। এতো রক্ত দেখে ভয়ে বুকটা ধুক করে কেঁপে ওঠে তার।
অর্পিতা উঁকি দেয়ার কিছুক্ষন পরেই ধীরে ধীরে রক্তের স্রোত থেমে যায়। একদম স্থীর হয়ে যায় প্রবাহমান গর্তটি।
গর্তের ভেতরের রক্তে ভেসে ওঠে ডাক্তার মনিরার রক্তাক্ত মাথা।
অর্পিতা চিৎকার করে কয়েক পা পিছিয়ে যায়।
ডাক্তার মনিরার রক্তাক্ত মাথাটি আস্তে আস্তে ডুবে যায় গর্তের অতলে।
কিছুক্ষণ পরে আবার অনেক শব্দ করে রক্তের স্রোত বইতে থাকে।
অর্পিতা দেখতে পায় স্রোতের ভেতরে ভেসে উঠেছে তাদের গাড়ির ড্রাইভারের মৃতদেহ।
তার সাথে সাথেই একটা মিষ্টি হাসির শব্দ ভেসে আসে অর্পিতার কানে।সবকিছু দেখে
ভয়ে একদম কুঁকড়ে যায় অর্পিতা।
কি হচ্ছে, না হচ্ছে কিছু বুঝে আসে না তার।
হঠাৎ গর্ত থেকে একটা উজ্জ্বল আলোর রশ্মি বের হয়ে হাসিবের দেহের উপরে পরে।
কয়েক সেকেন্ড পরে আলোটি আবার গর্তের ভেতর মিলিয়ে যায়।
.
-ঠক ঠক ঠক!
দরজায় নক করার শব্দে অর্পিতা কেঁপে ওঠে।
চোখ মেলে দেখতে পায় সে হাসিবের পাশেই বসে আছে।
বেডের আশেপাশে কোনোপ্রকার গর্ত টর্ত নেই।
তাহলে এতক্ষম আমি স্বপ্ন দেখছিলাম! নিজে নিজেই বলে অর্পিতা।
ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের কথা পুনরায় মনে করে ভয়ে অর্পিতার লোমগুল দাঁড়িয়ে গেলো।
এদিকে দরজায় বার বার কেউ নক করেই যাচ্ছে।
অর্পিতা গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে দেখে নার্স এসেছে।
নার্স ভেতরে এসে হাসিবের প্রেশার মাপতে যান।
হাসিবের কাছে গিয়ে তিনি দেখতে পান, হাসিব সামান্য নড়াচড়া করছে।
নার্স খুশি হয়ে অর্পিতাকে বলে,
-অভিনন্দন। আপনার হাসবেন্ডের জ্ঞান ফিরেছে।
আপনি তার কাছে বসুন, আমি এখনই ডাক্তারকে ডেকে আনছি।
নার্সের কথা শুনে অর্পিতা খুশিতে দৌড়ে যায় হাসিবের কাছে।
হাসিবের বুকে মাথা রেখে বলে,
-আমি জানতাম তুমি আমাকে এতোটা কষ্ট দিতে পারো না।
.
.
.
সাতদিন পরে হাসিবের ডিসচার্জ হয়।
অর্পিতা হাসিবকে নিয়ে তার বাসায় চলে আসে।
এই ক’দিনে অর্পিতার চেহারার একদম নাজেহাল অবস্থা।
সব ঝড় একা সামলাতে হয়েছে। আজ সকালে ইতালি থেকে হাসিবের মা বাবা এসেছেন।
যদিও তাদের প্রথমদিনই আসার প্রবল ইচ্ছে ছিলো কিন্তু ইমার্জেন্সি টিকিট না পেলে যা হয়।
হাসিব আগের থেকে এখন মোটামুটি সুস্থ।
মাথার ব্যান্ডেজ এখনও খোলা হয়নি। ডাক্তার জানিয়েছেন, তাকে সবসময় প্রেশার মুক্ত রাখতে।
যতটা সম্ভব হাসিখুশি রাখতে,এসময়ে দুশ্চিন্তা তার জন্য অনেক ক্ষতিকর।
ডাক্তারের কথানুযায়ী সবাই সাধ্যমত চেষ্টা করছে সবকিছু মেইনটেইন করে চলতে।
এ’কদিনে এতো ঝামেলার মধ্যে অর্পিতা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলো তার পেটের সন্তানের কথা।
এবরশনের কথা একবারও তার মাথায় আসেনি।
কিন্তু আজ বিকালে, শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে বসে নাস্তার সময় তাদের কথায় অর্পিতা চিন্তায় পরে যায়।
তারা যদিও চাচ্ছে তাদের ছোট্ট সংসারে একটা ফুটফুটে বাচ্চা আসুক কিন্তু এই কথাটিই অর্পিতার চিন্তাকে ঘুরিয়ে দিলো।
সে আবারও ফিরে গেলো পুরনো সিদ্ধান্তে।
মনে মনে ঠিক করলো, হাসিবের কাছে তার মা বাবা থাকতেই গোপনে কাজটা সেড়ে আসবে সে।
.
.
.
নিজের রুমে আধশোয়া হয়ে চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে অর্পিতা।
কয়দিনে কতকিছু ঘটে গেলো তার জীবনে।
নিজেকে কেন যেন খুব এলোমেলো লাগছে।
সবটা আগের মতো করে নিতে যে খুব ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু নিয়তি বলেও তো একটা কথা আছে!
নিয়তি তো শত চেষ্টা করেও পাল্টানো সম্ভব না।
চিন্তার মাঝেই হঠাৎ করে পুরো রুমে কালো অন্ধকারে ছেয়ে যায়।
রুম জুড়ে শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে।
মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে দমকা বাতাস এসে পর্দাগুলো নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
সবমিলিয়ে অদ্ভুত এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।
অর্পিতা বুঝতে পারে, হয়ত সে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনার সম্মুখীন হতে চলেছে।
হাত বাড়িয়ে বেড সাইড টেবিলে রাখা বাতিটি জ্বালাবে ঠিক তখনই একটা বাচ্চার খিলখিলিয়ে হাসির শব্দ শুনে থমকে যায় অর্পিতা।
ভয়ের শীতল এক অনুভূতি নেমে যায় মেরুদন্ড বেয়ে।
হাসির শব্দের সাথে উজ্জ্বল আলোর ছটা এসে চোখে পরে অর্পিতার। হাত দিয়ে আলো ঠেকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে সে।
কিন্তু অবাক হয় এটা ভেবে যে, হঠাৎ করে আলোটা আসলো কোথা থেকে!
তখনই হাসির শব্দটা আরও বেড়ে যায়।
আলো অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকাতেই বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে যায় অর্পিতার।
সে দেখতে পায় ছোট্ট একটা বাচ্চা মেয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হাসছে।
অদ্ভুত মায়াবী চেহারা মেয়েটির। কিন্তু এতো ছোট বাচ্চা এখানে এলো কি করে!
অর্পিতা কম্পিত গলায় বাচ্চাটিকে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই বাচ্চাটি ধীরে ধীরে রুমের ভেতর প্রবেশ করে।
অর্পিতার কাছাকাছি গিয়ে বলে,
-আমাকে তুমি কেন মারতে চাও আম্মু?
তুমি বোঝো না আমার এতে অনেক কষ্ট হয়!
আমি তোমার কাছে যেতে চাই। তোমার আদর পেতে চাই কিন্তু তুমি আমাকে কেন আসতে দিতে চাও না!
আমাকে মারার চেষ্টা করো না আম্মু।
শত চেষ্টা করেও আমাকে আটকাতে পারবে না বরং এতে সবার ক্ষতিই হবে।
যত কিছুই হয়ে যাক না কেন,
আমি আসবই!
আধো আধো বুলিতে কথাগুলো বলে বাচ্চাটি আবারও হেঁটে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
বাচ্চাটি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে অর্পিতার ঘোর কেটে যায়।
তখন রুম অন্ধকারাচ্ছন্ন।
তাড়াতাড়ি লাইট জ্বালিয়ে অর্পিতা ভয়ে কাঁপতে থাকে।
কি হয়ে গেলো মাত্র কয়েক সেকেন্ডে!
এটা কি আমার ভ্রম?
না না এটা কোনোভাবেই ভ্রম হতে পারে না।
এটা সত্যি কিন্তু কিভাবে সম্ভব।
তাছাড়া বাচ্চাটিই বা কে?
মনে মনে প্রশ্নগুলো করে দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়ে অর্পিতা।
সে লক্ষ্য করে তার শরীর ঘামে ভিজে চুপেচুপে হয়ে গেছে।
দেরি না করে সে বিছানা থেকে বের হয়ে বাহিরে দৌড় দেয়।
যে করেই বাচ্চাটিকে তার খুঁজে বের করতেই হবে।
.
.
.
বাসার সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো বাচ্চার সন্ধান পায় না অর্পিতা।
হন্নে হয়ে এখনও খুঁজে চলেছে সবখানে।
ছোফার নিচ, র্যাক ফ্রিজ কোনোকিছুই বাদ রাখে না সে।
তার এমন আচরণে হাসিবের মা বাবা বেশ অবাক হন।
কি খুঁজছে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেও অর্পিতার থেকে কোনো উত্তর মেলে না।
অগত্যা হাসিবের মা, জোহরা বেগম উঠে গিয়ে অর্পিতার কাঁধে হাত রাখেন।
কিন্তু অর্পিতার সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই।
জোহরা বেগম অর্পিতাকে কয়েকবার ডাক দেয়।
তার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে অর্পিতাকে ধরে জোরে একটা ঝাকি দেয়।
ঝাকি দেওয়ার সাথে সাথে অর্পিতা দাঁড়িয়ে পরে।
জোহরা বেগমের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে তাকে।
কিছুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে ঢলে পরে যায় জোহরা বেগমের গায়ের উপর।
.
.
.
চলবে