-আমার এক বছরের একটা মেয়ে আছে এটা ও জেনে কেন আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলেন জানতে পারি?
– আপনার মেয়ের বাবা হবো বলে ।
– বাহ , আপনি তো দেখছি ভিষন উদার মনের মানুষ । যেখানে একটা বিধোবাকে আজ কালের সমাজ ঘৃণার চোখে দেখে সেখানে আপনি একটা মেয়ের বাবা হতে চাইলেন ।
– দেখুন পৃথিবীর সবাই এক হয়না। আমার চোখ আমার বিবেগ ঠিক আমার হাতে এটা যে সবার হতে হবে এমন কোনও কথা নেই।
– হুমমম ! আপনি কি জানেন আমার স্বামী রোড এক্সসিডেনট করে মারা যায় ?
– জী আমি সবই জানি। আচ্ছা বলুন তো বাসর ঘরটা সাজানো কেমন হয়েছে । এটা কিন্তু আমি নিজের হাতে সাজিয়েছি। আমার খুব ইচ্ছে ছিল নিজের বাসর ঘরটা তাজা গোলাপ আর রজনীগন্ধা দিয়ে সাজাবো।
,
এবার আমি ওর দিকে ভাল করে তাকালাম । ওর নাম আরিন আমার দ্বিতীয় স্বামী । একটা বাঙালি মেয়ের জন্য এই শব্দ টা উচ্চারণ করা খুবই লজ্জার । কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। আমার প্রথম স্বামী জয়। আমাদের রিলেশন করে বিয়েটা হয়েছিল । দুই পরিবারের লোকজন খুব সহজেই মেনে নিয়েছিল আমাদের । অনেক সুখী ছিলাম আমি । এতোই সুখী যে কপালে সইলো না। বিধাতা হয়তো উপরে বসে আমার সুখ দেখে মুচকি হেসে বলেছিল ভাগ্যের নিয়তি আমার হাতে যতই তুমি বলো আমি সুখী কিন্তু শেষ খেলায় দেখবে তুমি বড্ড অসুখী ।
,
হ্যা ! আমার সাথে ও ঠিক এরকম হয়েছিল । বিয়ের কিছুদিন পর জানতে পারলাম আমি মা হতে চলেছি। কি যে খুশি জয়। ওর খুশি দেখলে বড্ড ভয় কাজ করতো মনে যদি কিছু হয়ে যায় তখন কিভাবে বাঁচবে ছেলেটা । কিন্তু না নিয়তি আমাকে বাঁচিয়ে রেখে দিলো কঠিন পৃথিবীর মাঝে একা একা আর ওকে নিয়ে গেল খুব নিষ্ঠুর ভাবে ।
জয় অফিস থেকে এসেই বাকিটা সময় আমার পেটে কান রেখে কথা বলতো ।ওর অনাগত বাচ্চার সাথে । আমি এসব দেখে ভিষন হেসে ফেলতাম। ও মিষ্টি একটা ধমক দিয়ে বলতো ,
– তুমি হাসছো কেন অরিত্রা ? আমি আমার বাচ্চার সাথে কথা বলছি তোমার কি ?
আমি আরো হেসে দিয়ে বললাম ,
– তোমার পাগলামি দেখে হাসছি।
– হাসো হাসো যতো পারো। যেদিন আমি থাকবো না সেদিন আমার কথা মনে পরবে ।
– তুমি থাকবে না মানে কোথায় যাবে ? আবার নতুন লাইন করছো নাতো।
– করতে ও তো পারি। মন্দ কি বলো ?
– খুন করে ফেলবো তাহলে ।
এই কথায় দুজনেই হেসে উঠতাম । এভাবে দিন যেতে লাগলো। হঠাত্ একদিন ডেলিভারির সময় হয়ে গেল । আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করলো। ভিষন পেইন উঠেছে । জয়কে ডক্টর বললো তাড়াতাড়ি ঔষধ গুলি নিয়ে আসুন । জয়ের হাত আমার হাতের মুঠোয় আমি শক্ত করে ধরে আছি। ওকে বললাম জয় তুমি যেও না। আমার ভয় করছে । তুমি আমার কাছে থাকো। জয় আলতো আমার কপালে চুমু খেয়ে বললো – আরে পাগলি ভয়ের কিছু নেই। আমি ঔষধ নিয়ে এখনই চলে আসছি।
,
না জয় ওর কথা রাখেনি। আর ফিরে এসে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলেনি – তোমার ভয় নেই অরিত্রা আমি আছি।
আমার যখন জ্ঞান ফিরলো জানতে পারলাম আমার মেয়ে হয়েছে । কিন্তু সবার মুখটা একটা কষ্টের ছাপ জলজল করছে । সবাই আছে কিন্তু জয় নেই। আমি মা কে জিজ্ঞাসা করলাম ,
– মা , ও কোথায় ?
আমার কথা শুনে মা রুম থেকে বাইরে চলে গেল । আমি আরো অবাক হয়ে গেলাম । কেউ কিছু বলছে না। সবাই দুরে দুরে থাকছে আর এড়িয়ে যাচ্ছে ।
,
আমি বাসায় চলে এলাম। মেয়েটা একদম ওর বাবার মতো হয়েছে । একদিন জয় আমার পাশে শুয়ে শুয়ে চুল নিয়ে খেলছিল হঠাত্ করে চেঁচিয়ে উঠলো বললো ,
– পেয়েছি পেয়েছি ?
আমি হঠাত্ করে এমন চিৎকার শুনে লাফ দিয়ে উঠে বসে বললাম কি পেয়েছো ?
– নাম পেয়েছি ।ছেলে হলে নাম রাখবে জিসান আর মেয়ে হলে জয়ন্তী ।
আমি হেসে দিয়ে বললাম ,
– বাবারে তুমি যেভাবে চিৎকার করলে আমি ভেবেছি হয়তো কি না কি পেয়েছো ।
– আমার ছেলে মেয়ের নাম পেয়েছি এটা আমার কাছে সাত রাজার ধন।
,
ঠিক আছে বাবা এই নাম রেখো। এবার খুশিতো।
,
সেদিন আমার মেয়ের নাম ঠিক করলাম জয়ন্তী । বাসায় আসার পর আমাকে আমার শ্বাশুরি জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পরে বলেছিল,
– মারে তুই আগে নিজেকে শান্ত কর। শক্ত হ তুই। তুই ও যদি ভেঙে পড়িস আমাদের কি হবে ।
শ্বাশুরির এমন কান্না দেখে খুব অবাক লাগছে । একেতো জয়ের কোনও খবর নেই। মনে মনে ওর উপরে রেগে আছি কারণ ও যে কাজের পাগল হয়তো অফিস থেকে স্যার কোনও কাজে পাঠিয়েছে। হয়তো আমার কথা ভুলে সেই কাজে চলে গেছে । এবার আসলে কোনও কথা নেই ওর সাথে ।
,
আমার কথা বিধাতা রেখেছে ।আমি আর জয়ের সাথে কথা বলতে পারবো না কোনও দিন । করতে পারবো না অভিমান অভিযোগ । শ্বাশুরি কেঁদে কেঁদে বললো ,
– মারে জয় রোড এক্সসিডেনট করে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে । তোর জন্য ঔষধ নিয়ে ফেরার পথ ও এক্সসিডেনট করে । মা হয়ে আমি ধৈর্য যদি ধরতে পারি তুই কেন পারবি না।
,
শ্বাশুরির কথা শুনে মনে হচ্ছিল কেউ আমার কলিজা ধরে জোরে টান মেরেছে । কষ্টের অনুভূতি আমার থেকে মুছে গেছে । চোখ থেকে পানি পড়ছে না কান্না আসছে না। শুধু মনে হচ্ছে এখনই আমি মরে যাবো। পৃথিবীর সব থেকে কঠিন সত্যি হচ্ছে প্রিয় মানুষের মৃত্যুর খবর । যেটা মেনে নিতে হয় হাজারো কষ্টের সাথে মিতালি করে ।
,
একটার পর একটা দিন আমার জীবন থেকে সরে যেতে লাগলো। জয়ের মৃত্যুর পর শ্বাশুরি মারা গেলেন মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে । আমার জন্য এটা ছিল আরেকটা শোক। পৃথিবীটা মনে হতে লাগলো ভিষন কঠিন । শ্বাস প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো। ভেঙে পড়লাম খুব ।
,
ঠিক এমন সময় পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নিলো আমাকে আবার বিয়ে দিবে। শ্বশুর ও সাথে একমত । সবাই মিলে ছেলে খোঁজ করতে লাগলো। আমি বহুবার সবাই কে বুঝালাম বাকিটা জীবন এভাবে থাকবো কিন্তু না শ্বশুর কঠিন ভাবে বলে দিলেন তিনি বেঁচে থাকতে আমাকে সুখী দেখতে চান।
,
এই যাহ আপনাদের কথা বলতে বলতে কোথায় নিয়ে এলাম। আসলে কি জানেন অতিত রোজ আমাকে এভাবে তাড়া করে বেড়ায় । আমি একটা মুহূর্ত ভুলতে পারি না অতিতকে।
রাত প্রায় শেষ হতে চলেছে । আমার নতুন স্বামী আরিন ঘুমিয়ে আছে জয়ন্তী কে বুকের ভিতরে নিয়ে । আমি সেই থেকে বাইরে বারান্দায় বসে বসে অতিত ভাবছি জয়কে নিয়ে ভাবছি । আচ্ছা আরিন কি পারবে জয়ন্তী কে ওর বাবার মতো ভালোবাসতে ? পারবে আমাকে আমার অতিত ভুলিয়ে ভাল রাখতে ?
,
,
চলবে,
আমি ও সে
পর্ব এক
লেখা অধরা জেরিন
( আগামী পর্বে জানতে পারবেন জয়ের মৃত্যুর রহস্য ।সবাই সাথেই থাকুন )