#আমি_তোমাতে_বিলীন
#পর্ব_০২,০৩
#সুমাইয়া মনি
০২
চার বান্ধবী দু পথ থেকে ছুঁটে আসার দরুন সংঘর্ষে ছিটকে ধুপাশ করে পড়ে যায়। মনির চোখমুখ রাগে শক্ত হয়ে আসে। তমা, তারানা, মিনা মনিকে টেনে উঠাতে নিলে চেঁচিয়ে উঠে দাঁড়ায় একা,
‘সর!’ বলে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে এক দৌঁড়ে রুমে ঢুকে । ওর বান্ধবী’রাও পিছু পিছু রুমে এসে দেখে মনি জগিং করার মতো এদিক, সেদিক দৌঁড়াতে লাগলো। তমা, মিনা, তারানা মনির রাগ দেখে কিছু বলার সাহস দেখাচ্ছে না। তবুও না বলে উপায় নেই দেখে তমা জিজ্ঞেস করে বসল,
‘কিছু হয়েছে কি মনি? ঐভাবে দৌঁড়ালি যে..’
বাঘিনীর মতো হিংস্র নজর নিক্ষেপ করে মনি। থেমে গিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যায়। আধা বালতি পানি ভর্তি তিনটা বালতি একে একে বিছানার নিকটে রাখে। তার মধ্যে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে মিশায়। ক্ষুব্ধ নজরে তাকিয়ে তিন বান্ধবীর উদ্দেশ্যে চিল্লিয়ে বলল,
‘পা চুবা…!’
তিনজনের চেহারার রং ফ্যাকাসে হয়ে আসে। এই শীতের মধ্যে ঠান্ডা পানিতে পা ভেজানো মানে মরিমরি অবস্থা। মনি এত বড়ো শাস্তি দিবে জানা ছিল না তাদের। খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনি পুনোরায় চিল্লিয়ে উঠলো,
‘গেলি!’
‘আমরা কিছু করিনি তো। সব তারানার দোষ। ও তোকে ভুল নাম্বার বলেছে।’
‘তোরা এক পুকুরে মাছ। যাহ..!’
তিন বান্ধবী নিরুত্তর থেকে পায়জানা ওপরে তুলে বালতিতে পা চুবিয়ে খাটের ওপর বসে রয়। রীতিমতো কাঁপতে আরম্ভ করেছে ঠান্ডায়। মনি রাগী নিশ্বাস ফেলে তিন বান্ধবীর পানে তাকিয়ে আছে। তমা করুণ স্বরে বলল,
‘মনি রে, প্রচুর ঠান্ডা।’
‘মাফ কর বোইন।’ তারানা বলল।
‘দয়া কর একটু!’ মিনা বলে কান্না ফেইস বানিয়ে।
‘চুপ! মোটেও ন…’ আঙুল তুলে বলল মনি।
আচমকা নিলমের আগমন ঘটে। ‘কিরে..’ উচ্চারণ শেষ করার পূর্বে বাক্য পাল্টে বলল,
‘ভুল সময়ে এসে পড়েছি, গেলাম।’ বলেই রুম ত্যাগ করতে নিলে মনি পিছন থেকে কলার ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে আসে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘কোথায় যাচ্ছিস আধা*মরা।’
‘আমি কিন্তু কিচ্ছু করিনি মনি।’
‘কে বলল তুই কিছু ক…’
‘করিসনি তাই তো? হ্যাঁ! এটাই তো বলছি। আমি কিছু করিনি।’ অকপটে বলে।
‘তোর ফ্রেন্ড’রা তো করেছে।’
মনির দিকে একটু ঝুঁকে বলল,
‘কি করেছে দোস্ত?’
ছোট্ট করে সংক্ষিপ্ত আকারে ঘটনাটি খুলে বলে মনি। যেটা শুনে তিন বান্ধবী সহ নিলম মুখ টিপে হাসে। মনি রেগে চোখ ছোট ছোট করে তাকাতেই হাসি থেমে যায়। আঙুল নিক্ষেপ করে বলল,
‘সারাদিন এখানেই বসিয়ে র(রাখব)..।’
‘তুই না আমাগো প্রিয় বান্ধপী(বান্ধবী), এমন করে না রে মনি। ক্ষমা কর।’ তারানা চোখের পলক ঘনঘন ফেলে বলল।
‘ঢং নট এলাউ চ…!’
‘ইয়ে মানে বলছিলাম মনি ঘুরতে যাবি না। তাহলে ওদের আপাতত ছেড়ে দে।’
‘ন..’ মুখ ঘুরিয়ে বলল।
‘ধুর! এটা তো একটা মিস্টেক ছিল। ভুলে 69 জায়গায় 96 বলে ফেলেছে। মানুষ মাত্রই তো ভুল। ছেড়ে দে না।’
‘আমি সেই ছেলেটিকে কি বলব? সে তো আমার ওপর ক্ষেপে আ…’
‘ক্ষেপে আছে বুঝেছি। তাই বলে ওদের শাস্তি দিলে কি হবে? তার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইলেই তো হয়।’
‘ওকালতি তো ভালো পারিস। উকিল হ..’ মনি ভেংচি দিয়ে বলল।
‘সেটা পরে দেখা যাবে। আগে ওদের ছাড়। অসুস্থ হয়ে গেলে পরে আরেক ঝামেলা।’
মনি দু হাত বগলদাবা করে মুখ ফিরিয়ে বলল,
‘আচ্ছা যা ছাড়…’
‘ছাড়লি?’
‘হ…’
‘তো পুরা কথা বললে কি হয়। যত্তসব! এই উঠ তোরা।’ বিরক্তি নিয়ে বলল নিলম।
‘ওরে মা আমার পা!’ তারানা বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে বলল।
‘গেছে গেছে ঠান্ডায় জমে।’ তমা বলল পায়ে হাত রেখে।
‘আরে নিলম সাহায্য কর দোস্ত।’
‘করে খা।’ নিলম বিরক্ত মুখে বলে সোফায় বসল।
মনি দাঁত দিয়ে নখ কাঁটতে আরম্ভ করেছে। আসলে সে একটু আগের ঘটনা পুনরপি ভাবছে। মারাত্মক একটা কাণ্ড বাধিয়েছে। এখন সে কি হালে আছে কে জানে?
___
‘স্যার শাওয়ার নিন।’ কথাটা বিছানায় বসা জায়ানের উদ্দেশ্যে বলল তার এ্যাসিস্ট্যান্ট নাজমুল হক।
জায়ানের চোখেমুখে রূঢ় ভাব। প্রচুর রাগ জমে আছে মাথায়। সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না ঘটনাটি। সকল কাজকর্মের মধ্যে ঘুম তার প্রিয় একটি জিনিস। আর সেটা যদি ঠিক মতো না হয় বা কেউ ভাঙিয়ে দেয় রাগ চড়ে বসে মাথায়। ছয়টার দিকে রাজশাহী থেকে এ রিসোর্টে উঠেছে জায়ান ও নাজমুল। চোখে প্রচুর ঘুম থাকায় দরজা খোলা রেখেই খালি গায়ে ঘুমিয়ে যায়। তার পাশের রুমটিতে ছিল নাজমুল। জায়ানের চিৎকার শুনে তৎক্ষনাৎ পাশের রুম থেকে ছুটে আসে। তখন মনি বেরিয়েছি গিয়েছিল। তাই নাজমুল ওঁকে দেখতে পায় নি। ঘটনাটি তাকে জানায়। শুনে সেও বেশ অবাক হয়।
জায়ান তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যাওয়ার আগে নাজমুলকে বলল,
‘মেয়েটিকে খোঁজো।’
‘কিন্তু…কীভাবে?’
জায়ান এক কদম আগে যাওয়ার পূর্বে থেমে যায় নাজমুলের প্রশ্ন শুনে। ঘাড় একটু ডান দিকে ফিরিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘বাহিরে সিসিটিভির ক্যামেরা আছে। কি করতে হবে এটা নিশ্চয় বলতে হবে না?’
নাজমুল মাথা এদিক, সেদিক নাড়িয়ে না সম্মতি দেয়। জায়ান ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যায়। নামজুল রুম ত্যাগ করে।
.
দুইটার দিকে পাঁচ বন্ধু এক সঙ্গে ঘুরতে বেয় হওয়ার জন্য রিসোর্টের নিচে এসে জড়ো হয়। তখনই নাজমুল তাদের পথরোধ করে। মনির দিকে নজর বুলিয়ে বলল,
‘আপনাকে স্যার ডেকেছেন।’
কপালে ভাঁজ পড়ে কয়জনার। মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিলম বলল,
‘কোন স্যার?’
‘জয়ান এহসান।’
‘তিনি, আপনি ক?’ মনি জিজ্ঞেস করল।
‘মানে কী?’ নাজমুল কপাল কিঞ্চিৎ বাকিয়ে বলল।
‘ও বলতে চাইছে আপনি কে? আপনার স্যার কে?’ তমা বলল।
‘এভাবে কেউ জিজ্ঞেস করে?’
‘মনি এভাবে কথা বলে।’
নাজমুল কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে তাকায়। পরক্ষণেই বলল,
‘আজ সকালের ঘটনার মালিক জায়ান স্যার। আমি তার এ্যাসিস্ট্যান্ট।’
মনি যেন কিছুটা দমে গেল। রাগী দৃষ্টি বান্ধবীদের দিকে নিক্ষেপ করতেই তারানা নাজমুলের উদ্দেশ্য করে বলল,
‘আসলে ভাইয়া আমাদের মিস্টেক হয়েছে। মনির কোনো দোষ নেই। আমি ওঁকে 69 এর জায়গান ভুলে 96 বলে ফেলেছি।’
’69 কার রুম ছিল?’
‘আমার ছিল। আমরা পাঁচ বন্ধু। সাজেক পিকনিকে এসেছি। মনি আমাকে ডাকতে গিয়েছিল তখন…’
‘এভাবে কাউকে ঘুম থেকে ডাকে, আজ প্রথম জানলাম।’ নাজমুল কিছুটা বিরক্ত কণ্ঠে বলল।
‘মনি একটু দুষ্টু স্বভাবের মেয়ে…’
মনি মিনাকে অবশিষ্ট কথা বলতে না দিয়ে বলল,
‘থাম! মিস্টেক ছিল বলেছি না। আপনার স্যারকে গিয়ে বলুন এটা।’
‘আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।’
‘ঠেকা!’ রাগ নিয়ে বলে এক কদম আগে এলো মনি।
তমা মনিকে পিছনে টেনে বলল,
‘চুপ কর তুই। আসলে…’ সুন্দরভাবে গুছিয়ে সকালের ঘটনা উপস্থাপন করল তমা। নাজমুল সব শুনল। পরিশেষে তমা ফের বলল,
‘মনির সঙ্গে আমরাও যাব। তাকে বুঝিয়ে বললে ঠিক বুঝবে, চলুন।’
‘না..ক..।’ মনিকে বাকি কথা বলতে না দিয়ে মুখ চেপে ধরে তমা। হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘আপনি চলুন। আয় তোরাও সঙ্গে চল।’
নাজমুল আগে আগে হাঁটছে। নিলম আস্তে করে ওদের উদ্দেশ্যে বলল,
‘আমি যাব না, তোরা যাহ!’
‘ভিডিও!’ মনি টেরা চোখে তাকিয়ে বলল।
নিলম তড়িঘড়ি করে আবার বলল,
‘আরে যাব তো। মজা করে বললাম আর কি।’
মনি বাদে সরু চোখে তাকায় ওরা নিলমের দিকে। মিনা বলল,
‘এমন মজা আর কতবার করবি?’
নিলম রাগী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাকায়। পরপরই মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
নাজমুলের পিছু পিছু হাঁটছে তারা। রিসোর্টের পিছন দিকে পর্যটকদের বসার জন্য খুব সুন্দর একটি জায়গা তৈরী করা হয়েছে। এখান থেকে দূরদূরান্ত পাহাড় দেখা যায় খুব সহজেই। জায়গায়টা বেশ চমৎকার মনোমুগ্ধকর। একটি ছাওনির নিচে পায়ের উপর পা তুলে মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপ ঘাঁটছে জায়ান। তাদের উপস্থিতি টের পেয়েও তাকায়নি পর্যন্ত! মনি বাদে তমা, মিনা, তারানা জায়ানকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। কালো প্যান্ট, কালো রঙের সিল্কের শার্ট পড়েছেন তিনি। হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা। লম্বা কালো সিল্কি চুলগুলো বাতাসে এলোমেলো হয়ে কপাল ছুঁয়েছে। ফর্সা মানুষদের কালো রং পড়তে নেই। কেননা এতে তাদের সৌন্দর্য ভীষণ ভাবে উজ্জ্বলতা ছড়ায়। জায়ানকে সকালের চেয়ে এখন আলাদা সুন্দর এবং বেশ সুদর্শন দেখাচ্ছে। মনি সেটা স্বাভাবিক ভাবে লক্ষ্য করে। তারানা মনিকে আলতো গুঁতো দিয়ে বলল,
‘ক্রাশ খেয়েছি বোধহয়।’
‘গিলে ফ..’ আস্তে করে বলল মনি।
‘গিলে ফেলব না, মন ভরে দেখবো।’ কথাটা বলে তারানা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়।
তারা সকলে রীতিমতো জায়ানের থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। নাজমুল জায়ানের নিকটে এসে কানেকানে ওদের বলা তখনকার বার্তাগুলো জানাল। জায়ান ল্যাপটপের ওপর থেকে নজর সরিয়ে পাঁচজনকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখেনিল।
গুরুগম্ভীর কণ্ঠে ওদের উদ্দেশ্যে শুধায়,
‘তাহলে আপনারা বলতে চাইছেন এটা মিস্টেক ছিল?’
ক’জনে ইতিবাচক মাথা নাড়ালো। জায়ান নজর সরিয়ে নিয়ে ফোন আনলক করে সকলের ও মনির একটি ছবি জুম কর তুলে নেয়। ছবি তোলার বিষয় তারা কিচ্ছু বলল না। ফোন ল্যাপটপের পাশে রেখে নম্রতার স্বরে বলল,
‘আপনাদের নাম?’
নিলম একে একে সকলের নাম বলল। সঙ্গে তারা একত্রে পিকনিক এসেছে সেটাও জানাল। জায়ান মনির পানে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘মিস.মনি, আপনার বাবার নাম কি?’
‘মোফাজ্জল হোসেন।’ কোমল গলায় উত্তর দিলো।
‘তোমরা যেতে পারো।’
মনি তাদের আগে হাঁটা শুরু করে। জায়ান এটা দেখে স্বাভাবিক ভাবে নেয়। ফোন আনলক করে ছবি দু’টো হোয়াটসঅ্যাপ কারো আইডিতে সেন্ড করে দেয় জায়ান।জায়ানের ঠোঁটে মৃদু হাসি প্রতিফলিত হয়। যা নাজমুলও দেখতে পাচ্ছে।
____
‘ঐ দাঁড়া তোরা। আমরা কি আসামি? সে আমাদের ছবি তুলে নিলো, আর গাঁধা তুই কিছু বললি না কেন নিলম্মা।’ মনি গড়গড় করে কথা গুলো বলল।
‘তুই জানিস সে কে?’ নিলম বলল।
‘তোর চৌদ্দগ্রামের ক..’
‘চৌদ্দগ্রামের কেউ না। তবে তাকে আমি চিনি।’
‘কে সে?’ তারানা জিজ্ঞেস করল।
‘রাজশাহী জেলার এম.পি মাজিন এহসানের একমাত্র ছেলে জায়ান এহসান। এখন নিশ্চয় প্রশ্ন করবি আমি জানলাম কি করে?’
‘করব না। কারণ রাজশাহী তোর নানাবাড়ি।’ মিনা বলল।
‘ঠিক বুঝেছিস।’ নিলম বাহবা সহিত বলল।
‘সে এম.পি কেন? মিনিস্টারের ছেলে হলেও তাতে কি? ভুল তো ভুলই। ক্ষমা করা মহৎকর্ম!’ তমা বলল।
‘ঠ..’ মনি বলল।
‘কখনো তো পুরো কথা বল মনি। বিরক্ত হই মাঝেমধ্যে তোর ওপরে।’ মিনা বলল মেকি রাগ নিয়ে।
‘প..ন..’
‘ঐ চল তো। ওর সঙ্গে মুখ টৌলাইস না।’ তমা বলল।
‘আমারে নিস কিন্তু। নে পুরো কথা বললাম।’ হেসে বলল মনি।
‘আয়। ঝগড়া করিস না তোরা বা*ল।’ নিলম বলে।
‘চল।’
এক সঙ্গে ঘুরেফিরে পাঁচটার দিকে রিসোর্টে ফিরে। কালকে সকাল সকাল বের হবে দেখে আজ তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে।
.
#চলবে?
#আমি_তোমাতে_বিলীন
#পর্ব_০৩
#সুমাইয়া মনি
ভোর পাঁচটার দিকে বান্ধবীদের তাড়া দিয়ে ঘুম থেকে ডাকতে লাগল মনি। তমা উঠছে তো তারানা শুয়ে পড়ছে। চোখে ঘুম টইটম্বুর তাদের। মিনার নড়াচড়া নেই কোনো। এক নাগাতে ডাকতে ডাকতে ছয়টা বাজতে চলল। শেষে মনি বিরক্ত হয়ে গা থেকে কম্বল সরিয়ে এসি ছেড়ে দেয়। একেকজনে লাফিয়ে উঠে জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে নেয়।
ঠান্ডায় ঘুম বাপ বাপ বলে পালিয়েছে। মিনা সোফায় জড়োসড়ো হয়ে বসে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,
‘এত সকালে ডাকছিস কেন?’
‘ওয়াক করতে য..’ ক্ষেপে আঙুল তুলে বলল মনি।
তিন বান্ধবী ভ্রু কুঁচকে এক সঙ্গে বলে উঠে,
‘কি ওয়াক?’
‘ইয়াহ!’
‘ইউ মিন ওয়ার্ক রাইট?’ তমা ভ্রু উঁচু করে বলল।
‘হু..!’
‘মাবুদ!’ বলে তমা মিনার গায়ে ঠলে পড়ে। মিনা রাগী দৃষ্টিতে চেয়ে রয়। তারানা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ওয়ার্ক কে ওয়াক না বলে জগিং বললেও তো হয়।’
‘এই তুই ওর সঙ্গে খামোখা মুখ নাড়ছিস। অর্ধেক কথা বলা অভ্যাস ওর, ভুলে যাস কেন।’ মিনা বলল।
‘কথা কম, ওয়াকে চ…’
রাগী মুখশ্রী নিয়ে মনির দিকে তিন বান্ধবী তাকিয়ে জগিংয়ের জন্য তৈরী হয়ে নেয়। এক সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নিলমকে ডেকে নেয়। কনকনে শীতের মধ্যে রিসোর্টের বাহিরে হেঁটে চলেছে তারা। মনি বাদে বাকিরা কাঁপছে। বার বার জোরে দৌঁড়ানোর নির্দেশনা দিচ্ছি মনি। কিন্তু কেউ ওর কথা কানে নিচ্ছে না।
___
জাহানুর বেগম অনলাইনে লাল বেনারসি শাড়ি দেখছেন। যেটা পছন্দ হচ্ছে পাশে বসা মোফাজ্জল হোসেনকে জিজ্ঞেস করছে।
‘আরে দেখো না এটা কেমন দেখায়। সুন্দর না। এটা নিবো?’
নরমাল রিয়াকশনে তিনি জাহানুর বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আমি ক’দিন পর পাগল হয়ে পাগলা গারদে ভর্তি হবো।’
‘তা হও, এখন বলো শাড়িটা কেমন?’
‘তুমি আর তোমার শাড়ি দু’টোই এক।’ দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল।
‘ধন্যবাদ, ধন্যবাদ!’ খুশি হয়ে বললেন।
‘এদিকে মেয়ের খবর নেই। অন্যদিকে মা বিয়ের বেনারসি শাড়ি চয়েস করছে। যত্তসব পাগল-ছাগল আমার কপালে জুটল।’
‘কি বললে?’
‘কানে কি যক্ষা হয়েছে নাকি?’
‘যক্ষা কানে কেন? মুখে হবে। পাগল কে সেটা তো প্রমাণই দিলে এখন।’ চেঁচিয়ে বলল।
তিনি কিছুটা লজ্জাবোধ করলেন। মিদুল বাবা-মায়ের ঝগড়া শুনে বলল,
‘আজকের ঝগড়ায় আম্মু জিতেছে।’
‘চুপ! মা, মেয়ে, ছেলে সবই এক হয়েছে।’
‘আর তুমি তো রোহিঙ্গা।’
‘সেটাও ভালো, অন্তত পাগল-ছাগল তো না।’
‘এত বড়ো অপমান।’ রুদ্ধ শ্বাস টেনে বলল।
‘কমই হলো। অফিস থেকে ফিরে আরো অপমান করব ওয়েটিংয়ে থাকো।’ বলে তিনি কোট হাতে হনহনিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। জাহানুর বেগম গাল ফুলিয়ে বসে রইলেন। পরিশেষে মেয়ের নাম্বারে কল দিলেন। সবে মাত্র জগিং শেষে রিসোর্টে প্রবেশ করবে তারা। ফোন বেজে উঠায় থেমে পকেট থেকে ফোন বের করে মায়ের নাম্বার দেখে কিছুটা বিরক্ত বোধ করলেন। শেষে ফোন রিসিভ করে তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন,
‘আপনি এখন যে নাম্বারে কল করেছেন, তিনি মাত্র জগিং থেকে ফিরেছে। দয়া করে ওয়েটিংয়ে থাকুন, ধ(ধন্যবাদ)..’ বলেই ফোন কেঁটে সাইলেন্ট করে রাখল মনি। জাহানুর বেগম আরো ক্ষেপে গেলেন। স্বামী বলে গেছে ওয়েটিংয়ে থাকতে, এখন মেয়েও সেই একই ওয়েটিংয়ে থাকার কথা বলছে। রাগে মুখ ভার করে রইলেন।
মনিকে রেখে সকলে চলে গেছে। হেঁটে উপরে উঠতে যাবে তখন নজরে আসে সিঁড়ির বাঁ দিকের বড়ো রুমটি। পরিপাটি করে রুমটি সাজানো গুছানো। মনি এগিয়ে যায়। একজন মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, জায়ান এখানে গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ের জন্য রুমটি নিয়েছেন । মনি উঁকি মেরে এক নজরে পুরো রুমটি পর্যবেক্ষণ করে নিলো। তারপর পিছনে ফিরে একবার তাকিয়ে ঢুকে পড়লো। বড়ো বড়ো ফুলদানি, দামি আসবাবপত্র রয়েছে। মনিকে সব চেয়ে আকর্ষণ করছে মাছের একুরিয়ামটি। সে কাছে এসে স্পর্শ করে দেখতে লাগলো। কয়েকটা ছবিও তুলে নিলো। লাস্টের একটি মাছের ছবি তোলার সময় কারো কণ্ঠ শুনতে পায়, সঙ্গে পায়ের আওয়াজ। কেউ এ রুমের দিকে আসছে। মনি দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যায়। পালাবে নাকি লুকাবে বুঝবে পারছে না। শেষে উপায় না পেয়ে ফোন পকেটে পুরে জানালার পর্দার পিছনে লুকিয়ে পড়ে। রুমে প্রবেশ করে জায়ান ও নাজমুল।
নাজমুল জায়ানের উদ্দেশ্য করে বলল,
‘স্যার, রুম পুরো রেডি।’
‘দেখতে পাচ্ছি।’ চারদিকে নজর বুলিয়ে বলল জায়ান।
হঠাৎ জানালার কাছে নজর আটকে যায়। সাদা কেডস জুতো পড়া দু’টি পা দেখতে পায় জায়ান। নাজমুল বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছিল। জায়ানের মন সেদিকে নেই। সে তো পর্দার আড়ালে লুকানো মানুষটির জুতোর দিকে তাকিয়ে আছে।
নাজমুলের কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘বাহিরে যাও!’
‘জি..?’ নাজমুল না বুঝায় পুনোরায় ‘জি’ উচ্চারণ করল।
‘বাহিরে যেতে বলেছি।’ ক্ষীণ নজরে তাকিয়ে বলল।
নাজমুল দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগ করল। জায়ান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে মনি মুখ দু’হাত দিয়ে ডেকে নিলো। মুখ ডাকার আগেই জায়ান মনিকে দেখেছে। এক কদম পিছনে সরে পকেটে এক পুরে বলল,
‘বেরিয়ে এসো।’
মনি আঙুলের ফাঁকে জায়ানকে দেখে ধীরেধীরে বের হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। জায়ান একটু জোরে বলে উঠল,
‘হাত সরাও।’
চট করে হাত সরিয়ে নিলো। দৃষ্টি এদিক সেদিন নিক্ষেপ করে কিছুটা কাচুমাচু দাঁড়াল। জায়ান মনির আগাগোড়া দেখে নিলো। সাদা প্যান্ট, সাদা রঙের সোয়েটার পড়া। কানে একটি ব্লুটুথ। খোলা চুলগুলো পিঠে লেপ্টে রয়েছে। সামনের ছোট ছোট কয়েকটা চুল কপালে গালে পড়ে আছে। দেখতে ছোট বাচ্চাদের মতো লাগছে মনিকে। গম্ভীর গলায় আওড়াল,
‘জগিংয়ে গিয়েছিলে?’
মনি হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়।
‘তো এই রুমে কি করছো?’
‘মাছ গুলো দেখতে..।’ কোমল স্বরে বলল।
‘লুকালে কেন?’
‘ভয় প..’
‘প বলতে?’ দু-চোখ কিছুটা চোখ করে জিজ্ঞেস করে জায়ান।
‘পেয়েছি ত..’
‘ত?’
‘তাই।’
জায়ান মৃদু ধমকের স্বরে বলল,
‘পুরো বাক্য শেষ করো?’
‘ভয় পেয়েছি তাই লুকিয়েছি। আমি য..’ মৃদুস্বরে দরজার দিকে ইশারা করে বলল মনি।
‘আমি য, মানে?’ ভ্রু কুঁচকে বলল।
‘যাব?’
বিরক্তিতে চোখ বুঁজে এলো জায়ানের। চেখের মাঝখান বরাবর আঙুল রেখে চোখ খুলে কাঠ কণ্ঠে শুধাল,
‘আমার সামনে কক্ষণো অর্ধেক কথা বলবে না।’
‘বলব ন..মানে না না, বলব না।’ তড়িঘড়ি করে বলে উঠে মনি।
‘আউট!’ আঙুল দরজার দিকে তাক করে বলল।
মনি এক দু পা হেঁটে জোরে দৌঁড় দেয়। বাহিরে বের হয়ে নাজমুলের মুখোমুখি পড়ে। ভূত দেখার মতো বিস্মিত চোখে তাকায় নাজমুল। মনি পাত্তা না দিয়ে পাশ কাঁটিয়ে চলে যায়।
মনির যাওয়ার পানে তাকাতে তাকাতে রুমে প্রবেশ করল সে।
মনির কথা জিজ্ঞেস করার পূর্বেই জায়ান কাঠিন্য কণ্ঠে বলল,
‘জানালার আড়ালে লুকিয়ে ছিল।’
‘কেন স্যার?’
‘একুরিয়ামের জন্য। আমাদের দেখে ভয়ে লুকিয়েছে।’
‘ওহ!’
‘শোনো?’
‘জি, বলুন স্যার?’
‘একুরিয়ামটি বাহিরে রাখার ব্যবস্থা করতে বলো ম্যানেজারকে।’
‘কিন্তু কেন?’
নাজমুলের পাল্টা প্রশ্ন শুনে জায়ান তির্যক দৃষ্টি ফেলে। সে মিনমিন কণ্ঠে বলে,
‘বলছি স্যার।’ বলে বেরিয়ে গেলেন।
জায়ান একুরিয়াম দিকে অনাড়ম্বর নজরে তাকাল।
_
রুমে প্রবেশ করার পূর্বে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিলো মনি। কেন জানি জায়ানকে তার ভীষণ ভয় লাগে। সব সময় আদলে উগ্রভাবে, চওড়া মেজাজ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। জীবনে এই প্রথম কাউকে সে এত বেশি ভয় পাচ্ছে। সেকেন্ড কয়েক পর ভেতরে ঢুকে। দেরিতে আসায় কোথায় ছিলো বার্তাটি তাদের মুখে শুনতে হয়। কোনোমতে অর্ধেক কথা বলে বুঝায় একুরিয়ামের বিষয়টি। নাস্তার চাপ্টার সেরে ঘুরতে বের হয় তারা। যাওয়ার সময় একুরিয়ামটি গেটের সামনে সুন্দর ভাবে রাখা দেখে অবাক হয় মনি। তবে তেমন গুরুত্ব দেয় না।
পাহাড় আবেষ্টিত নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাজেক। রাঙ্গামাটির একেবারে উত্তরে সাজেক অবস্থিত।প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি এটি। তবে, রাঙ্গামাটির তুলনায় খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের দূরত্ব অনেক কম। এখানকার বিজিবি’র ক্যাম্প ও এর আশেপাশের এলাকা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। এখান থেকে ভারত দৃষ্টিগোচর হয়।
প্রথমে তারা রুইলুই পাড়ায় নামে। সড়কদিয়ে হেঁটে যাওয়ার পথে বিশাল সব পাহাড়ের উপর দিয়ে মেঘের ভেলা ভেসে যেতে দেখা যায়। সামনে যেতে যেতে চোখে পড়ে সাজেকের নয়নাভিরাম অপার সৌন্দর্য। সেখানের টং দোকানে বসে চা পান করে তারা। ছোট ঝর্ণার প্রবাহিত বয়ে যাওয়া পানিতে গোসল করে। সারাদিন হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে সময় অতিবাহিত হয়। সন্ধ্যার পর রিসোর্টে ফিরে আসে। শরীর প্রচুর ক্লান্ত থাকায় ডিনার সেরে ঘুমিয়ে যায়।
মধ্যরাতে মনি ওয়াশরুম যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠে। ঢুলুঢুলু চোখে ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে শুতে যাবে তখন জানালার দিকে নজর পড়ে। বাহিরে চাঁদের আলোয় ঝলমলে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। দেখতে প্রচণ্ড মনোমুগ্ধকর। মনি জানালার পর্দা সরাতেই হুড়মুড়িয়ে চাঁদের আলো রুমে প্রবেশ করে। চোখের ঘুম উড়ে যায়। রিসোর্টের পিছনের জায়গাটার কথা মনে উঠে। মনি বান্ধবীদের না ডেকে একা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সোয়েটার গায়ে জড়িয়ে চুপিচুপি বেড়িয়ে পড়ে। নিরব, নিস্তব্ধ চারদিক। নেই কোলাহল, নেই মানুষকে হাঁটাচলা। এখন সবাই গভীর ঘুমে বিভোর। নিচে এসে দেখে কাউন্টারে একটি ছেলে বসে আছে। তার নিকট এগিয়ে এসে বলল,
‘এখন কি চা পাওয়া যা…’ বলেও পরবর্তী ‘যাবে’ বলল। কেননা নিজের কাছের লোক ব্যাতীত বাকিদের সামনে অর্ধেক কথা বললে নাও বুঝতে পারে। তাই মাঝেমধ্যে ঠেকে পুরো কথা বলতে হয় তাকে। ছেলেটি বিনয়ী কণ্ঠে বলল,
‘জি, ম্যাম। আপনি রুমে গিয়ে বসুন। চা দিয়ে আসবে।’
‘এখানে দেন।’
‘আচ্ছা।’ বলে ছেলেটি ল্যান্ডলাইনে কাউকে কল দিতে লাগলো। মনি এই সুযোগে ছেলেটির অগোচরে রিসোর্ট ত্যাক করে। ছেলেটি কথা শেষে মনির দাঁড়ান স্থানের দিকে তাকাতেই শূন্যস্থান নজরে আসে। ‘ম্যাম, ম্যাম’ বলে কয়েক বার আওয়াজ তুলে। সাড়াশব্দ না পেয়ে ছেলেটি খুঁজতে বের হয়। ততক্ষণে মনি পিছনে এসে আকাশের পানে চেয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে ব্যস্ত! চারদিকের পরিবেশ মনিকে আনন্দিত, উৎসাহিত করছে। তবে মারাত্মক ঠান্ডাও লাগছে। বসার সিট গুলোতে হাত রেখে দেখে কুয়াশার ভিজে গেছে। তাই বসতে পারে না। দাঁড়িয়ে থাকে মিনিট কয়েক। পেছন থেকে যে জায়ান ক্ষুভিত নজরে দেখছে সেটা তার অজানা। তেড়েমেরে নিকটে এসে কাঠখোট্টা কণ্ঠে বলল,
‘এখানে কি করছো?’
নিরব পূর্ণাঙ্গ স্থানে হঠাৎ শব্দে বা ডাকে যে কেউ ভয় পেয়ে কেঁপে উঠবে। মনিও ঠিক এরূপ কাঠখোট্টা বাক্য শুনে ঈষৎ কেঁপে উঠে ঘুরে তাকায়। সোনালী চন্দ্রাতপে জায়ানের রাগী মুখশ্রী মনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। যেন সে তার ওপর কোনো কারণে ক্ষেপে আছে।
.
.
.
#চলবে?
Sumaiya Moni