#আমি_তোমাতে_বিলীন
#পর্ব_০৪,০৫
#সুমাইয়া মনি
০৪
আকাশের বুক চিঁড়ে সূয্যিমামার দেখা মিলল। শিশির ভেজা উষ্ণ ঘাসের ফোঁটা ফোঁটা জলকণা সূর্যের আলোয় চকচক করে উঠে। গাছের ডালে বসে পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। জানালার গ্লাসের উপর হাত রেখে তীক্ষ্ণ নজরে বাহিরের পরিবেশ দেখছিল তমা। ভেতর থেকে তারানা ও মিনার বিরক্ত মাখা কণ্ঠে স্বর শুনে এগিয়ে এলো। দশটা বাজতে চলল। এখনো মনি বিছানা ছেড়ে উঠেনি। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আধাঘন্টা ধরে ডাকাডাকি চলছে তাদের। মনির কোনো হেলদোল নেই বললেই চলে। শেষে তমা মনির গায়ের কম্বল সরিয়ে চিল্লিয়ে বলল,
‘এত ঘুমাচ্ছিস যে, রাতে কি খেয়েছিস?’
মনি চোখ বন্ধ অবস্থায় ঘুম জড়িত কণ্ঠে বলল,
‘ঝ..’
কপাল কুঁচকে আসে তিন বান্ধবীর। তারানা একটু ঝুঁকে বলল,
‘ঝ বলতে, ঝালমুড়ি খেয়েছিস?’
‘উঁহু!’ জবাব দিলো মনি।
‘ঝাল চানাচুর?’ তমা বলল।
‘উঁহু!’
‘জিলাপি?’ মিনা বলে।
‘ঝাঁড়ি!’ বলে উঠে বসল মনি। চোখ কচলানো শুরু করার পূর্বে হাত সরিয়ে নিয়ে মিনা বলল,
‘কার ঝাড়ি খেয়েছিস?’
মনি হাই তুলে বলল,
‘আন্ডারওয়্যার!’
‘আন্ডারওয়্যার বলতে?’ তারানা ভ্রু কুঁচকে বলল।
‘জা*ই*ঙ্গা।’ মনি মাথা চুলকে বলল।
‘জা*ই*ঙ্গা বলতে?’ তমা পাশে বসে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘জায়ান!’
তিন বান্ধবী মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ঠাস করে কপালে হাত রাখে। বিরক্ত তিন বান্ধবী! রাগবে নাকি কিছু বলবে বুঝতে পারছে না। মনি বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমের দিকে এগোতে নিলে তমা প্রশ্ন করে,
‘কি করেছিস রাতে? ঝাঁড়ি কেন দিয়েছে?’
‘হুদাই! আমি চাঁদনি রাত উপভোগ করার জন্য রিসোর্টের পিছনে জায়গাটায় লুকিয়ে যাই। জা*ই*ঙ্গা বেডা সেখানে গিয়ে পিছন থেকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। এত রাতে এখানে কেন এসেছি বলে ঝাঁড়ি দিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে।’
‘ঠিকিই তো আছে। এত রাতে একা সেখানে গিয়েছিলি। ঝাঁড়ি দিয়েছে ভালে করেছে।’ তমা আঙুল নাচিয়ে নাচিয়ে বলল।
‘ঢং করতে গেছিলো। ঝাঁড়ি দিয়ে উচিত কাজ করেছে।’ তারানা বলল।
‘এর শোধ ন…’ মনি বলল।
‘হ শোধ নিবো। ন্যাকানো বন্ধ করো। সামনে এলেই হাঁটু কাঁপে। শোধ নিবে হুহ্!’ মুখ ভেংচি দিয়ে বলল মিনা।
মনি রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ওয়াশরুমের ভেতরে এসে ঠাস করে দরজা লাগায়। পরক্ষণে ফের দরজা খুলে কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলল,
‘জরুরী মিটিং আছে দেখে তোকে কিচ্ছু বললাম ন…’ বলে আবার দরজা জোরে লাগিয়ে দেয়।
মিনা হেসে দেয়। তমা, তারানাও হেসে ফেলে। মনির কিছু কাজেকর্মে তারা প্রচুর বিনোদন পায়। সিরিয়াস বিষয়টিকেও মনি জোক বানিয়ে দেয়। এক প্রকার মন ভালো করার মেডিসিন মনি, বলা যায়।
__
জায়ান একজন লোকের সঙ্গে কথপোকথনে ব্যস্ত ছিল। তখন মাজিন এহসান কল দেয় তার ছেলেকে। জায়ান কথার মাঝে ‘জাস্ট এ মিনিট’ বলে ফোন পীক করল,
‘আসসালামু আলাইকুম!’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কি করছো?’
‘মাসুদ আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলছিলাম।’
‘কালকের মিটিং ঠিক আছে তো?’
‘আছে আব্বু। মিন্টু আঙ্কেল চেয়ারম্যানের পদ ফিরে পেতে চায়।’
‘তুমি কি বললে?’
‘সৎ ভাবে অর্জিত ধন-দৌলত, মানসম্মান কক্ষণো ক্ষয় হয় না। সে যদি সৎ ভাবে অর্জন করে তবেই পাবে। কোনো চোরাকারবারি চলবে না।’
‘তুমি ঠিক বলেছো। এভাবেই সততার সঙ্গে এগিয়ে যাও। পরবর্তীতে তোমাকেই আমার পদ নিতে হবে।’ গর্বিত কণ্ঠে বললেন তিনি।
‘প্রে ফর মি!’
‘অফকোর্স মাই সান! আসছো কবে? আর ঐদিকের খবর কি?’
‘আসতে লেট হবে। ঐদিকের খবর আমি তোমাকে পরে বলব।’
‘আচ্ছা! ক্যারি অন, বাই।’
‘ইয়াপ! বাই।’ ফোন রেখে দেয় জায়ান। তার সঙ্গে পুনোরায় কথোপকথন শুরু করে।
.
মোফাজ্জল হোসেন ড্রইংরুমে বসে মেয়ের নাম্বারে তিন-চার বার কল দেয়। কিন্তু মনি ফোন রিসিভ করে না। শেষে তিনি বিরক্ত হয়ে ফোন পাশে রেখে দিয়ে পেপার পড়ায় মনোযোগী হয়। চোখেমুখে তার স্পষ্ট রাগ। ঠিক সেই মুহূর্তে জাহানুর বেগম তাকে তার পাশে বসেন। আরো রাগানোর জন্য পিঞ্চ মেরে বললেন,
‘মেয়ে কল ধরছে না? ধরবে না তো। এক অসভ্য মেয়ে পয়দা হয়েছে। আগেই বলেছিলাম আমার বোনের ছেলে রাহাতের সঙ্গে মনির বিয়ে দিয়ে দেও। শুনলে না আমার কথা। এখন ভোগো মেয়েকে নিয়ে।’
মোফাজ্জল হোসেন মনোযোগ সরিয়ে কিছুটা রাগী কন্ঠে বললেন,
‘মেয়েকে চিরকুমারী রাখব, তবুও ঐ গাঁধার সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দেবো না।’
জাহানুর বেগম তেলেবেগুনে ক্ষেপে উঠে বললেন,
‘তুমি ওঁকে গাঁধা বললে।’
‘সম্মানটা একটু বেশি দিয়েছি বুঝি। অদম বলা উচিত!’
‘আর একটা বকাও তুমি রাহাতকে দিবে না।’
‘সামনে থেকে না গেলে আরো শুনতে হবে।’
জাহানুর বেগম রাগী দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চলে যাওয়া ধরল। কিন্তু মাঝপথে ফিরে এসে ছোঁ মেরে পেপার কেঁড়ে নিয়ে মুচড়িয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যায়। মোফাজ্জল হোসেন স্ত্রীর এমন কাণ্ডে হেসে দেয়। তার মেয়েও ঠিক এমনই। একদম মায়ের মতোই হয়েছে মেয়ে। ফোন হাতে নিয়ে ওয়ালপেপারে থাকা তাদের ফ্যামিলি ছবিটির দিকে তাকায়।
_
মনি কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনতে শুনতে করিডোরে হাঁটছিল। দেরিতে উঠার ফলে আজ আর ঘুরতে বের হতে পারেনি। বিকালে বের হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তাই পুরো রিসোর্ট ঘুরে দেখার সময় পেয়ে যায় মনি। নিলম গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত। তমা, তারানা, মিনা রুমে ফোন টিপছে। মনি ওদের থেকে বিরক্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। আসলে মনি চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে হওয়ায় এক স্থানে বেশিক্ষণ স্থির হয়ে থাকতে পারে না। করিডোর থেকে উঁকি দিতেই একুরিয়ামের ওপর নজর পড়ে। জায়ানের কথা মনে উঠে, সঙ্গে শোধ নেওয়ার বিষয়টিও মাথায় আসে। কিন্তু কীভাবে নিবে সেটা জানে না। মাঝখানে দুই সারি, এক পাশের শেষ মাথায় জায়ানের রুম, অপর পাশের মাঝখানে তাদের রুম। এখানে দাঁড়িয়ে জায়ানের রুম তার নজরে আসে। রুমের দিকে তাকিয়ে ভাবতে ভাবতে মনি আইডিয়া পেয়ে যায়। এক দৌঁড়ে রুমে এসে তমার ব্যাক ঘেটেঘুটে নারিকেল তেলের বোতল নিয়ে জায়ানের রুমে কাছে দৌঁড়ে আসে। ডানে-বামে তাকিয়ে হাঁটুগেড়ে বসে খুব যত্ন করে তেল ফ্লোরে মাখছে।
ঠোঁটে লেগে আছে দুষ্টু হাসি। যে হাসি বলে দিচ্ছে জায়ানের খেল খতম! পাঁচ মিনিট ধরে হাত দিয়ে লেপ্টে পুরো ফ্লোরে তেল মাখল। এতটাই মনোযোগ দিয়ে করছিল যে জায়ান ও নাজমুল হেঁটে ওর নিকটে এসে দাঁড়িয়েছে টেরও পায়নি।
জায়ান চোখ ছোট ছোট করে মনির কাণ্ড দেখে নাজমুলকে চুপ থাকতে বলল হাতের ইশারায়। পরক্ষণে নৈঃশব্দে হেসে মনির দিকে ঝুঁকে নরম স্বরে বলল,
‘কি করছো?’
‘তেল ম(মাখছি)..!’
‘কেন?’
‘জা*ই*ঙ্গা বেটাকে শায়েস্তা ক(করতে)।’
জায়ান কপাল কুঁচকে ফেলে জা*ই*ঙ্গা শব্দটি শুনে। পরমুহূর্তে রাগে নিজের কপালে হাত বুলাতে থাকে। নাজমুল অন্যদিকে ফিরে মুখ টিপে হাসে। মনে মনে বলে,
‘জব্বর নাম দিয়েছে স্যারের। জায়ান থেকে জা*ই*ঙ্গা।’
মনি কাজ সম্পূর্ণ করে উঠে দাঁড়িয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,
‘দিবো জা*ই*ঙ্গা পা, যাবে ভাইঙ্গা পা…’ বলে হাসতে লাগলো মনি।
‘হোয়াট এ আইডিয়া…’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল জায়ান।
কথাটা শুনে মনির হাসি মিলে যায়। স্মরণে আসে একটু আগে সে কারো সঙ্গে কথা বলেছে। ছোট্ট ঢোক গিলে নেয়। পিছনে ফিরার সাহস হচ্ছে না। তবুও বুকে সাহস সঞ্চয় করে ঘুরে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে তেলের বোতল ফেলে মুখ ডেকে নেয়। চোখ কোঠায় থেকে বেরিয়ে আসার জোগাড়।
অগ্নিমূর্তির ন্যায় জায়ান দাঁড়িয়ে আছে। আদলে জড়িয়ে রয়েছে রাগের আভা। নাজমুলের মুখ থমথমে। জায়ান, মনির চেহারার রিয়াকশন দেখছেন তিনি। মনি নিজেকে একশো একটা গালিগালাজ করছে। প্লান সাকসেস করার উত্তেজনায় ভুলেই গিয়েছিল জায়ান রুমে আছে কি-নেই সেই বিষয়টি । আর তার সামনেই তাকে ‘জা*ই*ঙ্গা’ বলে সম্মোধন করা! এই মুহূর্তে নিজেকে মাথামোটা বলে সম্মোধন করছে মনি। জায়ান চোয়াল শক্ত করে বলল,
‘আমাকে ফেলে দেওয়ার জন্য চমৎকার প্লান এঁকেছো।’
মনি চোরের মতো চোখ একবার ওপর নিচে নামিয়ে কোমল স্বরে বলল,
‘ন..নন, আ…আমি!
‘সেটআপ!’ জোরে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়।
মনির বদনখানি কেঁপে উঠে জায়ানের ধমকে। দৃষ্টি নত তার।
মনির মানসিক অনুভূতি এখন ভীতিকর!
জায়ানের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে তার নামকে চরম ভাবে অপমানিত করেছে দেখে। রাগে মাথার রগ দপদপ করছে যেন। পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। মনি সুযোগে আছে পালানোর। তবে মনে হচ্ছে না সে এখান থেকে পালাতে পারবে। আজ তার রক্ষে নেই শিওর!
জায়ান নাজমুলের উদ্দেশ্যে ক্ষীণস্বরে বলল,
‘গান প্লে করো!’
নাজমুল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়। সে জায়ানের বার্তাটি বুঝে উঠতে পারছে না। জায়ান নাজমুলের প্রশ্নবোধক চাহনি দেখে চেঁচিয়ে বলল,
‘গান প্লে করো নাজমুল। মনি জুতো খুলে তেল ফেলার স্থানে দাঁড়াও।’
ভয়চকিত দৃষ্টিতে মনি জায়ানের পানে তাকাল। নাজমুল ফোন বের করে ফটাফট একটি গান প্লে করে দেয়। মনি এখনো বুঝতে পারছে না জায়ান আসলে কি বলতে বা করতে চাইছে। ঠাঁই প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
জায়ান গুরুগম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
‘কথা কানে যাচ্ছে না ফাজিল মেয়ে।’
মনি জায়ানের কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে তড়িঘড়ি করে জুতো খুলে তেলের ওপরে কোনোমতে পা রেখে দাঁড়ায়।
‘ডান্স করো!’
জায়ানের আকস্মিক কথায় মনি হতভম্ব। তেলের ওপর দাঁড়ানোই মুশকিল, তার ওপর নাচা অসম্ভব! একেই বলে, অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে, সে গর্তে নিজেকেই পড়তে হয়। আজ সেটা মনি হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে। নাজমুল থ হয়ে গেছে স্যারের কথা শুনে। মনিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জায়ান পুনোরায় খেঁকিয়ে উঠে,
‘নাচো!’
.
.
.
#চলবে?
#আমি_তোমাতে_বিলীন
#পর্ব_০৫
#সুমাইয়া মনি
থমথমে পরিবেশ ও থমথমে মুখশ্রী নিয়ে পাঁচ বন্ধু বসে রয়েছে। ইতিমধ্যে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা তাদের খুলে বলেছে মনি। সব শুনে আহাম্মক হয়ে গেছে একেকজন। বড়ো একটা কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলেছে মনি। সেটা ভেবে মনি লজ্জায় মাথা নুইয়ে নেয়।
জায়ানের ধমকে মনি কান্না ফেইস বানিয়ে কোনোমনে হাত এদিক-সেদিক ঘুরিয়ে নাচার চেষ্টা করেছে। ভীষণ ভয় লাগছে। এক পড়ে যাওয়ার ভয়, দ্বিতীয় জায়ানের ভয়। এ নাচ দেখে নাজমুল মুখ ঘুরিয়ে প্রচুর হেসেছে। জায়ান গম্ভীর চোখেমুখে মনিকে দেখছিল। তেলের ওপরে নাচা মোটেও সহজ কাজ নয়। তবে মনি সেটা সম্ভব করে দেখিয়েছে। পা খিটিমিটি দিয়ে কোনোমনে নাচার ট্রাই করছে। সঙ্গে গান বাজছিল কমলা সুন্দরী! মনির সে-কি কাঁপা-কাঁপি নাচ।
এক পর্যায়ে ঘুরতে নিলে পা পিছন থেকে স্লিপ কেটে সামনে জায়ানের গায়ের ওপরে পড়ে যায়। জায়ান ওঁকে দু’হাত দিয়ে ধরে ফেলে। ভয়ের চোটে চোখ খিঁচে বন্ধ করে রাখে। চোখ বন্ধ অবস্থায় সে অনুভব করল তার ঠোঁট নরম মাংসপেশি সুললিত কিছু একটা স্পর্শ করেছে। আঁখিযুগল মেলতেই সে চমকে উঠে সরে যায়। তার ঠোঁট জায়ানের বাঁ দিকের ঘাড় স্পর্শ করেছে। জায়ান কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে আছে। নাজমুল পুরো ঘটনাটি বিস্মিত চোখে দেখেছে। মনি দ্রুত জুতো পড়ে পিছলা খেতে খেতে কোনোমনে রুমে এসে দম নেয়।
ওয়াশরুমে ঢুকে সাবান দিয়ে পা ধুঁয়ে বিছানার মাঝ বরাবর বসে রয়। লজ্জায় তার মরিমরি অবস্থা। তিন বান্ধবী উৎসুক দৃষ্টি ফেলে। ঠিক বুঝেছে কোনো কাণ্ড ঘটিয়ে এসেছে মনি। তমা নিরবতা কাঁটিয়ে টেরা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘হলো কি?’
‘এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন?’ মিনা ভ্রু বাঁকিয়ে বলল।
‘এমন হিজরাদের মতো করছিস কেন?’ তারানা বলল।
‘তোর গালে থ..’ দাঁত কিড়মিড় করে বলল মনি।
‘থাপ্পড় কেন? কি করল তেরেনা?’ নিলম কথাটা বলতে বলতে এগিয়ে এলো। আয়েশ করে সোফায় বসে তাদের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাল। মনি তারানার ওপর থেকে নজর সরিয়ে লজ্জামিশ্রিত হেসে ঘটনা খুলে বলে। এতক্ষণ তিন বান্ধবী বিরক্ত হলেও এখন তাদের চেহারায় বিস্ময়চিহ্ন ভাব দেখা যাচ্ছে। ছোটখাটো নয়, বড়ো কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলেছে অথচ তারা কিচ্ছু টের পেলো না। বড্ড ভাববার বিষয়!
থমথমে কাটিয়ে মিনা ঠেস মেরে বলল,
‘যেমন কর্ম, তেমন ফল কথায় আছে কিন্তু।’
‘তোর অজান্তেই ফাস্ট কি*স হয়ে গেছে মনি।’ তারানা অবাক কণ্ঠে বলল।
‘সেটা আর বলতে।’ বলেই তমা হেসে দেয়। তারানা, মিনাও হেসে উঠে। নিলম কিছুটা ধমকের গলায় বলল,
‘থাম গাঁধার দল! সব কয়টা এক। মনি একটা আকাম করে এসেছে, তারা সেটা শুনে দাঁত কেলিয়ে হাসছে।’
‘তো কি মনির মতো কমলা সুন্দরী গানে নাচবো?’ রাগ ঝেঁড়ে বলল তমা।
‘চুপ! আর মনি তুই এত বোকা কেন? কক্ষণো বোধবুদ্ধি হবে না, আজীবন গাঁধাই থাকবি।’ নিলম রেগে কথাটা বলে উঠে দাঁড়ায়।
মনি দৃঢ় স্বরে বলল,
‘জানিসই তো আমি মিস্টেকের ক..’
‘মোটেও কাজিন না। তুই ইচ্ছে করে করেছিস এসব। না তেল ফেলতে যেতি, না এমন কাণ্ড ঘটত।’ বাকি অবশিষ্ট কথা নিলম বলে।
‘স্যরি!’ মনি কণ্ঠ খাদে ফেলে বলল।
নিলম মনির ঠিক সামনে এসে বসে। কণ্ঠে কোমলতা এনে বলে,
‘তোর পাগলামির জন্য আমরা পিকনিকে এসেছি। আন্টি-আঙ্কেল ফোন দিলে কথা বলছিস না। আমরা সুষ্ঠু ভাবে এসেছি, সুষ্ঠু ভাবে ফিরে যেতে চাই। এর মধ্যে আর কোনো গন্ডগোল করিস না মনি।’
‘করব ন…’ নরম স্বরে বলল।
‘জায়ান ভাইয়ার সঙ্গে কোনো ঝামেলায় জড়াস না। হোক সে ডিসেন্ট, মার্জিন সামাজিক লোক। কিন্তু তিনি প্রচণ্ড একঘেয়ে, রগচটা স্বভাবের। যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে তখন কিন্তু ঝামেলায় পড়ে যাব আমরা। কাজেই চুপচাপ থাক।’
‘আ..’
‘পুরো বাক্য বল হা*রা*মি।’ নিলম রাগ নিয়ে বলল।
মনি হেসে দিয়ে বলে,
‘বলব ন..’
তমা মনে মনে বলল,
‘কাকে কি বুঝালো, একটু পরেই দেখবো রোশনের মাথা এক স্থানে।’
__
বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে ইজি চেয়ারে বসে কপালে আঙুল বুলাচ্ছেন রজত আলি। তার সামনেই দু’জন লোক বসে আছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার এ্যাসিস্ট্যান্ট শান্ত।
তাকে এমন চিন্তিত দেখে চুন্নু নামের লোকটি বললেন,
‘আপনি এত চিন্তা করছেন কেন? আমরা আছি তো আপনার সঙ্গে।’
রজত আলি জোরে বলে উঠলেন,
‘ছিলে, আছো কি করতে পারলে তোমরা? একটা চুলও বাঁকা করতে পারলে না মাজিন ও তার ছেলের জায়ানের।’
‘রাজনীতিতে এমনই হয়। একজন আসবে, আরেকজন যাবে…’ মানিক মিয়া বললেন।
‘গেলো কোথায়? আজ কত বছর ধরে রাজশাহীর এম,পি মাজিন । এখন পর্যন্ত কেউ তাকে সরাতে পারেনি।’
‘মাজিনের সততা তাকে এই পদ থেকে সরাতে পারেনি।’
‘রাখো তোমার সততা। পরের বছর জায়ানকে এম,পি বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমার আর এম,পি হবার স্বপ্ন পূরণ হবে না।’
‘আমরা কি করতে পারি বলুন?’ চুন্নু সাহেব বললেন।
‘জায়ান যাতে পরের বছর এম,পি হতে না পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে শুধালেন রজত আলি।
‘কীভাবে?’
‘এক ঢিলে দু পাখি মরে বলে একটা প্রবাদ আছে। জায়ানকে যদি মেরে ফেলি তবেই এম,পি হতে পারব। আর জায়ান মরে গেলে মাজিন দমে যাবে। বুঝেছো?’
‘হ্যাঁ! বুঝেছি আপনার কথা।’ মানিক মিয়া বললেন।
‘আপনার ছেলেকে এই দায়িত্ব দিন।’ চুন্নু মিয়া সহাস্য স্বরে বলল।
‘মাহিদকে এই কাজ দেবো। ঐ পারবে জায়ানকে পথ থেকে সরাতে।’ গাম্ভীর্য স্বরে বললেন।
‘মাহিদ কোথায়?’
‘ঢাকায় আছে। শান্ত মাহিদকে রাজশাহী আসতে বলো।’
‘জি, স্যার বলে দিচ্ছি।’
_
জায়ান গোসল সেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে জেল দিচ্ছে। চুলের ফাঁকে হাত বুলানোর সময় হঠাৎ উন্মুক্ত ঘাড়ের দিকে নজর পড়ে। থেমে যায় সে। মনির সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা মনে পড়ে। পুনরায় সম্প্রচারিত হতে থাকে চোখের সামনে। মনির উষ্ণ নরম ঠোঁট জোড়া যখন ঘাড়ে স্পর্শ করে, তৎক্ষনাৎ ওঁকে ধরে রাখা অবস্থায় এক হাত মুঠোবন্দী করে নেয়। অপ্রত্যাশিত এক অনুভূতি তাকে জেঁকে ধরে। বুকের মধ্যখানে এক নতুন প্রণয়ের সূচনা ঘটে। প্রথম কোনো রমণীর স্পর্শে জায়ানের অজানা অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। আনমনে হাত চলে আসে বাঁ দিকের ঘাড়ের কাছে।
মুচকি হাসি প্রতিফলিত হয় তার ওষ্ঠদ্বয়! যে হাসি মনির প্রতি দূর্বলতা জানান দিচ্ছে।
.
মনি দাঁত দিয়ে নখ খুঁটে যাচ্ছে। হাতে ভাইব্রেশনে থাকা ফোনটি বারংবার কেঁপে উঠছে। স্ক্রিনে নাম ভাসছে ‘মাই পাপা’। মোফাজ্জল হোসেন মেয়েকে অনেকক্ষণ যাবত কল দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার মেয়ে ফোন তুলছে না। তুলবে বলে মনে ঠেকছে না দেখে এবার আর দেয় না কল। সে অন্য নাম্বারে কল দিলেন। তিনি ঠিক ফোন পীক করেছেন।
‘কিরে? আঙ্কেলের কল ধরছিস না কেন?’ মিনা মনির বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলল।
‘যদি ব…’ মাথা চুলকিয়ে বলল মনি৷
‘বকবে ভেবে ধরছিস না। জানিস সে কত টেনশনে আছে। তুই যে কবে বুঝবি একটু।’
‘হ, শুধু আমিই বুঝি ন..’ বিরক্ত নিয়ে বলল।
‘বুঝিসই তো না। গাঁধা কোথাকার!’ লাস্টের টুকু বিড়বিড় করে বলল৷
মনি সরু চোখে তাকায়। মিনা এক রাশ বিরক্ত নিয়ে সরে যায়৷ মনি নখ কামড়াতে আরম্ভ করে পুনোরায়। এখন আবার জাহানুর বেগম কল দিতে আরম্ভ করেছে। মনি তাকেও ইগনোর করছে।
.
‘হ্যাঁগো! শুনছো।’ বলতে বলতে মোফাজ্জল হোসেনের নিকট এগিয়ে এলেন তিনি।
‘বললে না শুনবো।’ তার দিকে ফিরে বললেন।
‘মনি কল রিসিভ করেছে?’
‘নাহ!’
‘আমারটাও করছে না। কেন রিসিভ করছে না বলো তো?’
‘আমি কীভাবে জানবো তোমার মেয়ে কেন কল রিসিভ করছে না।’
‘তুমি বাবা হয়ে জানো না।’
‘তা তুমি মা হয়ে জেনেছো কোন কচু শুনি?’ চেঁচিয়ে বললেন।
‘ওমা! কথা বললেই চেঁচিয়ে উঠে। কোনো কথা ছোঁয়ানো যায় না দেখছি।’
‘ছোঁবে কীভাবে? অলরেডি মা-মেয়ের প্যারা আমাকে ছুঁয়ে নিয়েছে যে।’
‘হ্যাঁ! এখন তো আমরা প্যারা তোমার কাছে।’ নাক টেনে বললেন।
‘নেও! নাকে কান্না শুরু।’ বিড়বিড় করে বললেন।
‘আমরা তো এখন প্যারাময় হয়ে গেছি। ভালো লাগে না আমাদের।’ কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বললেন।
‘শুনে রাখো। তোমাদের দুই মা-মেয়েকে ঠিক করার ব্যবস্থা আমি করব, তাও খুব শীগ্রই!’
‘কি বললে?’ কোমড়ে হাত রেখে চিল্লিয়ে বললেন।
‘কানের ডাক্তারের কাছে যাও। নতুনে কানে না শোনার রোগটা সেরে যাবে।’ বলে তিনি হনহনিয়ে চলে গেলেন।
জাহানুর বেগম ক্ষেপে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন। তার এমন অপমানসূচক কথা সে কিছুতেই শুনতে পারছেন না। ধৈর্যহারা হয়ে যাচ্ছেন তিনি।
.
.
.
#চলবে?