আমি_তোমাতে_বিলীন #পর্ব_০৬,০৭

0
1004

#আমি_তোমাতে_বিলীন
#পর্ব_০৬,০৭
#সুমাইয়া মনি
০৬

দু’দিন কেঁটে পাঁচ দিন অতিবাহিত হলো তারা সাজেক এসেছে। আর দু’দিন পর বাড়িতে ফিরে যাবে। এতে কারো তেমন মাথা ব্যথা না থাকলেও মনির মাথায় পেশার আছে। কেননা বাড়িতে ঢুকতে দিবে কি-না তার জানা নেই। আর এখানে ইতিমধ্যে জায়ান তার ওপর হুকুমজারি, অধিকার খাটানো শুরু করেছি দিয়েছে। পুরো কথা বলার অভ্যাস করতে বলেছে। জায়ানের এসব কাজকর্মের পিছনের রহস্য মনির কাছে অজান। যে বুঝে না জায়ানের হঠাৎ করে এমন রিয়েক্ট করার কারণ। এসব বিষয় এখনো তার বন্ধুদের বলেনি। বলবে বলে ভাবছে।
‘মনিইই! যাবি নাকি থাকবি?’ মিনা চিল্লিয়ে ডাক দিলো মনিকে।
মনির ধ্যান ভেঙে যায়। এতক্ষণ সে এসব ভাবছিল। থমথম খেয়ে বলল,
‘যাবো!’
মিনা সরু দৃষ্টি ফেললো মনির পানে। বলল,
‘আয় বের হ।’
মনি ফোন হাতে রুম থেকে বের হয়। সবার পিছনে মনি হাঁটছে। হঠাৎ ওর ফোনের মেজেস টোন বাজে। গতি থামিয়ে মনি ফোন আনলক করে ফেসবুক ওপেন করে দেখে জায়ান ওঁকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছে। কিছুটা অবাক হয়ে থেমে যায় সেখানেই। আচমকাই কেউ ওর বাহু ধরে টেনে রুমে ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে ধরে। মনি যতক্ষণ সেটা বুঝতে পারে ততক্ষণে জায়ান দৃশ্যমান হয়। চোখ জোড়ায় অস্থিরতা, বিস্ময় এসে ভর করে। মনির থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়ায় জায়ান। হাত দুটো পিছনে নিয়ে ঝুঁকে এক ভ্রু উঁচু করে রাশভারী কণ্ঠে বলল,
‘কোথায় যাচ্ছো?’
মনি মাথাটা পিছনে নিয়ে চোখের পলক ফেলে কোমল স্বরে বলল,
‘ঘুরতে!’
‘আমাকে বলেছো?’
মনি মাথা এদিক, সেদিক দুলিয়ে না সূচক জবাব দেয়। জায়ান ভারী কণ্ঠে বলল,
‘কেন? ইউ নো, না বলে যাওয়ার পরিনতি খারাপ হতে পারে!’
মনি তোতলানো স্বরে সাহস নিয়ে বলল,
‘আপনাকে কেন বলতে যাব? আপনি আমার কেউ ন..না।’
জায়ানের চোখেমুখে যেন নিমিষেই কিঞ্চিৎ রাগ এসে ভর করল। যতটা স্বাভাবিক করা যায় নিজেকে, ততটা স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
‘আমার নাম যেন কী?’
মনি অস্ফুটস্বরে বলল,
‘জায়ান এহসান।’
জায়ান মাথা এদিক, সেদিক ফিরিয়ে বলল,
‘উঁহু! জান, তোমার জন্য জাস্ট জান। জায়ানের জান তুমি! কী?’ লাস্টের কথাটা রাগান্বিত কণ্ঠে বলল জায়ান। মনি কাঁপা কাঁপা স্বরে উত্তর দিলো,
‘জ..জান।’
‘কার?’
‘জায়ানের!’
‘পুরোটা বলো?’
‘জায়ানের জান!’
‘কে?’
‘আ..আমি!’
‘হুম..’ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে বলল জায়ান। ফের বলল,
‘মনে থাকবে?’
মনি দ্রুত মাথা দুলিয়ে ‘হ্যাঁ’ জবাব দেয়।
‘যাও! আর তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে ওকে!’
মনি এবারও মাথা ঝাকায়। জায়ান ফের চোখের ইশারায় যেতে বলল। মনি এক মুহূর্ত দেরি না করে দৌঁড়ে জায়গা প্রস্থান করল। জায়ান মনির শূন্যস্থানে তাকিয়ে মুচকি হাসল।

মনি দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে নিচে নামার সময় একটি যুবকের সঙ্গে ধাক্কা খায়। পড়ে যেতে নিলে নিজেকে সামলে নিয়ে ঘুরে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,
‘চোখ কোথায়?’
যুবকটি চট করে উত্তর দিলো,
‘জায়গা মতো, আপনারটা কোথায়?’
‘জায়গা মতো টু..! ধাক্কা দিলেন কেন?’
‘আজব! দৌঁড়ে আপনি এসে ধাক্কা দিলেন।’
‘ম..’
‘মানে?’
‘মাথা!’ বলে মনি দেরি না করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়।
যুবকি কিছুটা আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে রয় মনির যাওয়ার দিকে। মনি গাড়ির কাছে এসে হাঁপাতে লাগলো। বান্ধবী’রা মনির হাঁপিয়ে উঠা চেহারা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। তারানা জিজ্ঞেস করল,
‘কোথায় ছিলি? হাঁপাচ্ছিস যে?’
মনি দম নিয়ে বলল,
‘কিচ্ছু না। চল চ..’
কপাল আরো কুঁচকে গেল সবার। তবুও পাল্টা প্রশ্ন না করে গাড়িতে উঠে বসে। নিলম গাড়ি চালাতে শুরু করে। মনি গাড়িতে বসে নিজেকে স্বাভাবিক করে। তারপর ফেসবুকে ঢুকে জায়ানের প্রোফাইল ঘেঁটে দেখতে লাগলো। নিজের বিভিন্ন স্টাইলিশ ছবি দেওয়া আছে। দেখে যেন মনে হচ্ছে কোনো মডেল। একদম লাস্ট পর্যন্ত যায়। মনি জায়ানের প্রোফাইল ঘেঁটে বুঝতে পারে জায়ানের পড়াশোনা শেষ হয়েছে আরো এক বছর আগে। এখন রাজনীতিতে নেমেছে বাবার সঙ্গে। অকপটে নিলমকে প্রশ্ন করে,
‘দোস্ত, এই জায়ানের চরিত্র কেমন?’
নিলম বাঁকা চোখে মনিকে দেখে নেয়। পরক্ষণে বলে,
‘কেন? প্রেম করবি? ফেঁসে যাবি কিন্তু।’
‘অলরেডি ফেঁসে গেছি.. ‘ বিড়বিড় করে বলল মনি।
‘হুম, কি বললি?’
‘কিছু ন.। সেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বল।’
‘জায়ানের বাবা আমাদের গ্রামের লোকদের অনেক সাহায্য করে। মানুষের বিপদেআপদে সহযোগিতা করেন। ভালো লোক।’
মনি দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
‘আমি ছেলের কথা জিজ্ঞেস করেছি। বাপের ন..!’
‘গাছের শিকড় শক্তপোক্ত হলে, ফল ভালো হয়।’
‘সব সময় হয় না।’
‘জায়ান ভাইয়া তার বাবার মতোই সৎ চরিত্রবান লোক। তবে একটু রাগী, গম্ভীর স্বভাবের।’
‘জানি..’ মনে মনে বলল মনি।
‘জিজ্ঞেস করলি…’
নিলমকে থামিয়ে মনি বলে উঠে,
‘এমনি জিজ্ঞেস করেছি।’
‘কারণ ছাড়া তুই কিছু জিজ্ঞেস করিস না মনি সেটা জানি আমরা। বলে ফেল আসল কাহিনী কি?’ তমা পিছন থেকে বলে উঠল। মনি মুখ জানালার দিকে ফিরিয়ে সবার অগোচরে কান্না ফেইস বানিয়ে মনে মনে বলল,
‘নিজের গর্তে নিজেই পড়ে গেছি। আমি যে জায়ানের জান হয়ে গেছি, কীভাবে বলব তোদের।’
‘বলছিস না যে?’ মনিকে খোঁচা দিয়ে বলল মিনা।
‘কিছু ন..’ ঝাঁড়ি দিয়ে বলে কানে ইয়ারফোন গুঁজে নিলো।
ওরা কিছুটা বিরক্ত হলো। তবুও কিছু বলল না।
__
মোফাজ্জল হোসেন কিছুটা বিচলিত হয়ে বসে আছেন কেবিনে। কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না তিনি। মেয়ের সঙ্গে আজ পাঁচদিন হলো কথা হয় না। খুব ইচ্ছে করছে মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু কল দিয়ে কোনো লাভ হয় না। মনি ফোন রিসিভ করেনা। হয়তো তার ভয়তে, নয়তো বকাবকি দিবে এই ভেবে। মেয়েকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন তিনি। মিদুলের থেকেও মনির প্রতি তিনি একটু বেশিই দূর্বল। তবে এমন নয় যে মিদুলকে তিনি ভালোবাসেন না। ভালোবাসেন তবে মেয়ের প্রতি তার আলাদা টান অনুভব করেন। হয়তো কিছু বাবারা মেয়েদের একটু আলাদাভাবে যত্ন করে বেশি ভালোবাসেন। ফোন বেজে উঠলেন। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত ভাব ফেলে হেসে ফোন রিসিভ করলেন। কথায় মনোযোগী হলে পড়লে তিনি।
.
সন্ধ্যার আগে আগে ফিরে আসে তারা। দুপুরের খাবার বাহিরে খেয়ে নিয়েছে। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় চিৎ, কাত হয়ে একেকজনে শুয়ে আছে। মনি জায়ানের কথা ভুলে কার্টুন দেখছিল মনোযোগ সহকারে। হঠাৎ মেসেজ আসে। পরাপর তিনটা! লাস্টে জান লিখা দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না মনির। মেসেজ পড়ে মনি শটাং করে উঠে বসে। চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। বান্ধবী তিনজন উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়। এতে মনির ভ্রূক্ষেপ নেই। জায়ান লিখেছে,
‘কখন ফিরেছো বলোনি কেন? ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট এখনে এক্সেপ্ট করোনি? আইডি হ্যাক!’

মনি আইডি লগইন করতে গিয়ে দেখে পাসওয়ার্ড চাইছে। আৎখার ওপরে মাথায় হাত দিয়ে ফেলে। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। কিন্তু না পারছে কিছু করতে, না পারবে কিছু বলতে জায়ানকে। আবার ওর নাম্বারও জানা আছে। কীভাবে? ফোন বিছানার উপর রেখে, ওদের গা থেকে কম্বল টেনে ফেলে রেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তিনজনে বোকা বনে ঘাস খাচ্ছে। তিনদিন যাবত মনির অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করছে। জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যাচ্ছে। এখন আবার হঠাৎ করে কি হলো বুঝ উঠতে পারছে না তারা। তমা বিরক্ত জড়িত কণ্ঠে বলল,
‘পাগল হয়েছে নাকি মনি। এমন করতেছে কেন?’
‘গেছে তো গেছে, গরম কম্বল ফেলে দিয়ে গেছে। ইশ! কত্ত দুঃক্ষে গরম করেছিলাম।’ তারানা বিরক্ত নিয়ে বলল।
‘হুম।’ মিনা কথাটা বলে কম্বল উঠিয়ে গায়ে টেনে নেয়।

মনি তেড়েফুঁড়ে জায়ানের কক্ষে প্রবেশ করে। দরজা আগে থেকেই খোলা ছিল। ওর জন্যই জায়ান দরজা খুলে রেখেছে।
জায়ান সোফার ওপরে পায়ে পা উঠিয়ে ভারী মুখশ্রী নিয়ে বসে ফোন দেখছিল। মনি জায়ানকে বসে থাকতে দেখে রাগ যেন তিরতির করে বেড়ে যায়। রেগেমেগে জায়ানের সামনে দাঁড়িয়ে আঙুল তাক করে চিল্লিয়ে বলল,
‘আমার আইডি হ্যাক করার সাহস কোথায় পান? ফিরিয়ে দেন বলছি আমার আইডি।’
ক্রুদ্ধ দৃৃষ্টি ফেলে জায়ান। তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে মনির হাত টেনে কাছে আনে। ঘাড়ের ঠিক সেই স্থানে চুমু দেয় যেখানে মনি ভুলবশত ভাবে জায়ানকে দিয়েছিল। মনির সর্বাঙ্গ ঝাঁকি দিয়ে উঠলো জায়ানের ঠোঁটের স্পর্শে। রাগ যেন কোথায় মিলে গেল। হাত-পা রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে। বুকের ভেতরে হাতুড়ি পিটার অনুভব হচ্ছে। জায়ান মনির চোখে চোখ রেখে কাতর কণ্ঠে বলল,
‘পাসওয়ার্ড_মনির জান।’ বাক্য পূরণ করতেই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সোফায় আগের ন্যায় বসে ফোন টিপতে আরম্ভ করে। কম্পনজড়িত শরীর নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মনি। নড়াচড়া করার বলশক্তি ক্ষীণ কাজ করছে। জায়নাকে শান্ত-নির্বিরোধ হয়ে বসে থাকতে দেখে বোঝা মুশকিল, একটু আগের কাজটি তিনি করেছেন কি-না। পাথর অবস্থায় ছোট ছোট পা ফেলে ধীরেধীরে এগিয়ে যায় দরজার দিয়ে।
রুম থেকে বের হবার পরপরই জায়ান খোলা দরজার পানে তীর্যক চোখে তাকাল। বিড়বিড় করে আওড়ালো,
‘যে-ই অনুভূতি তুমি আমার হৃদয়ে সৃষ্টি করেছো। সেটা তোমার হৃদয়ে জাগানোর ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র প্রিয়তমা!’
.
.
.
#চলবে?

#আমি_তোমাতে_বিলীন
#পর্ব_০৭
#সুমাইয়া মনি

‘তোর বয়ফ্রেন্ড আছে মিথ্যে বলে দে মনি।’ তমা অকপটে কথাটা বলে।
‘জায়ান আমার জান বের করে নিবে হু..’ বুকে হাত রেখে বলল মনি।
‘তাহলে বিয়ে ঠিক হয়েছে বল।’ মিনা বলে।
‘হবু জামাইকেই মেরে ফেলবে।’
‘তুই প্রেগন্যান্ট এরা বলবি?’
মনি রাগান্বিত চোখে তাকার। চিল্লিয়ে বলল,
‘ভূতে আমায় প্রেগন্যান্ট করেছে?’
তমা মনিকে শান্ত করিয়ে বলল,
‘রাগছিস কেন, আমরা তো চাইছি তুই যাতে জায়ানের থেকে মুক্ত হতে পারিস।’
‘আমি বুঝতে পারছি না কি করব? জায়ান তখন আমার সঙ্গে যা করেছে। আমার আইডিও দখলে নিয়ে নিয়েছে। উফ!’ বিরক্ত নিয়ে বলল মনি।
সবাই চুপ হয়ে যায়। নিলম এতক্ষণ নিরুত্তর থেকে বান্ধবীদের কথা শুনছিল। সে প্রচণ্ড বিরক্ত বোধ করছে। মুখে ‘চ’ উচ্চারণ করে বলল,
‘তোরা থাম প্লিজ! আমি কিন্তু আগেই বলেছিলাম জায়ানের থেকে দূরে থাকতে। হলো তো!’
‘নুনের ছিটা দিস না। উপায় কি সেটা বল। সব তো বললাম তোদের।’ রেগে বলল মনি।
‘তুই আর আমি গালফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড এর নাটক করি।’ নিলম অকপটে বলল।
‘এতে কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে ন…।’
‘হবে হবে। চেষ্টা করতে সমস্যা কি।’
‘দেখতে পারিস মনি। আইডিয়া কিন্তু এত খারাপ না নিলমের।’ তমা সাহসা দিয়ে বলল।
মনি কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর বলে,
‘পরে কিছু হলে আমাকে বলিস না আবার।’
‘কিচ্ছু হবে না নিশ্চিত থাক।’ নিলম ভরসা দিয়ে বলল।
‘না হলে ভ..’ নরম স্বরে বলল।
‘আমার কাছে একটা প্লান আছে?’ তারানা বলল।
‘বলে ফেল।’ তমা বলে।
তারানা সুন্দর ভাবে বোঝাতে আরম্ভ করে প্লান। পুরো প্লান শুনে সকলের পছন্দ হয়।
নিলম পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলল,
‘তাহলে এটাই হবে। সন্ধ্যার দিকে কাজ শুরু করব। ততক্ষণ মনি তুই রুম থেকে বের হবি না। ফোন অফ করে রাখ, জায়ান যাতে তোকে কল না দিতে পারে।’
‘আ…’
পুরো রাত মনি ঘোরের মধ্যে কেঁটেছে। বহুবার জায়ানকে নিয়ে বাজে স্বপ্নও দেখেছে। আসলে বেশি ভেবে ফেলেছে তাই স্বপ্নে এসে জ্বালাতন করেছে। রাত কোনোমতে অতিবাহিত করে। সকালে উঠে বন্ধুদের নিকট সব খুলে বলে। সকলে শুনে অবাক হলেও ঐসব উদ্ভটে পরামর্শ দেয়। শেষে সঠিক বুদ্ধি বের করলেও মনে সংশয় রয়ে যায় মনির।
__
‘তুমি কি জানো মনি কবে ফিরবে?’
‘আমাকে বলেছে নাকি তোমার মেয়ে।’ মেকি রাগ নিয়ে বলল মোফাজ্জল হোসেন।
‘মনিকে ছাড়া বাড়িটা কেমন ফাঁকা, নিরব লাগছে। কবে যে আসবে মেয়েটা। ফোনও তুলছে না।’ কিছুটা করুণ স্বরে বললেন।
‘এখনই এমন করছো। যখন বিয়ে হয়ে যাবে তখন কি করবে?’
‘তখনকার মুহূর্ত আলাদা। নিজেকে বুঝ দিতে পারব মেয়ে এখন শ্বশুর বাড়িতে আছে।’
‘এখনো সেটাই বুঝ দেও তোমার অবাধ্য মন’কে।’
‘পারছি না যে।’
‘তুমি একটা কল দেও না।’
‘অযথা, ফোন বন্ধ তোমার মেয়ের। তমার কাছে দিয়েছিলাম। সে-ও ফোন তুলছে না।’
মুখ মলিন হয়ে গেল জাহানুর বেগমের। আজ ক’দিন যাবত মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন তাদের। মনটা খুব টানছে কথা বলার জন্য। আর এই অবুঝ মেয়ের, বাবা-মায়ের অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা নেই।
.
‘জায়ানকে দেখেছো?’ রজত আলি ফোনের ওপাশে তার ছেলেকে জিজ্ঞেস করল,
‘হ্যাঁ! পাশেই অবস্থান করছে সে।’
‘কাজ শুরু করো। যেভাবেই হোক জায়ানকে মারতে হবে।’
‘হুম। টার্গেট যখন নিয়েছি, পূরণ করবোই।’
‘ভালো করে জায়ানের ওপর নজর রেখো। আর আমাকে খবরা-খবর জানাবে।’
‘ঠিক আছে বাবা।’
‘রাখছি।’
‘ওকে।’ উভয়ে ফোন রেখে দেয়।
রজত আলি কিছুটা বিচলিত হলেন। তিনি ভাবছেন তার ছেলে মাহিদ জায়ানতে খু*ন করতে আদৌও পারবে কি-না। যদি জায়ান জানতে পারে তাকে মারার জন্য মাহিদ সে-ই রিসোর্টে উঠেছে। তৎক্ষনাৎ তাকেও খু*ন করতে পারে। এই ভেবে তিনি চিন্তিত হয়ে আছেন।
_____
সন্ধ্যার দিকে।

আজ সারাদিনে মনির ফোন সুইচড অফ ছিল। দেখাও হয়নি একবারের জন্য। এখন কল দিয়ে ফোনও বন্ধই পাচ্ছে। রাগ হয় জায়ানের। প্রচণ্ড রাগ লাগছে। ফোন বন্ধ করার পিছনের কারণ মনে করতে থাকে। চোয়াল শক্ত করে বিড়বিড় করে বলল,
‘আমার কাছ থেকে রেহাই পাবে না মনি। অলরেডি জায়ানের জান হয়ে গেছো। কাজেই এসব পালিয়ে বাঁচার ড্রামা বন্ধ করো। নয়তো আমি কি করতে পারি সেটা তোমার অজানা।’

তমা জায়ানের রুমের সামনে থেকে পায়চারী করতে করতে ফোনে কথা বলার অভিনয় করছে। ওর কথা গুলো ছিল মনি নিলমকে প্রপোজ করবে এমন। জায়ান তমার প্রত্যেকটা কথা রুমে বসে জায়ান শুনছে, সঙ্গে নাজমুলও। কোথায় বসে প্রপোজ করবে সেই লোকেশন, সময়ও বলে তমা। জায়ান ক্ষেপে যায়। কিন্তু নিজেকে শান্ত রাখে। তমার কথা শেষ হলে সেখান থেকে চলে যায়। নাজমুল জায়ানের নিকটে উপস্থিত হয়। সে যে তার রুমে বসে তমার কথা গুলো শুনেছে তা জানায়। চুপ থেকে জায়ান সব শুনে। রাগ হলেও সেটা প্রকাশ করছে না। জায়ানকে এমন শান্ত দেখে নাজমুলের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আসে।

নিলম সাদা শার্ট পড়ে রিসোর্টের পিছনের দিক টায় এলো। মনির জন্য অপেক্ষা করছে। তারা প্লান করেছে। মনি জায়ানকে দেখিয়ে নিলমকে প্রপোজ করবে। মনির প্রপোজাল এক্সেপ্ট করে নিবে এবং জায়ানকে বোঝাবে তারা সে নিলমকে ভালোবাসে মনি। এতে হয়তো জায়ান তার জীবন থেকে দূরে চলে যাবে। জায়ানের নিকট এসব বার্তা পৌঁছানোর জন্য তখন কথা বলার অভিনয় করতে হয় তমাকে। প্লান ভালো হলেও, কতটুকু সাকসেস হবে, এখন এটাই দেখার পালা।
নিলমের সঙ্গে মেচিং করে সাদা ড্রেস পড়েছে মনি। হালকা ভাবে সাজিয়ে দিয়েছে তার বান্ধবী’রা। কতগুলো কবিতা শিখিয়ে দিয়েছে। সেগুলো বলে যাতে নিলমকে প্রপোজ করতে পারে। পুরোপুরি ভাবে তৈরী করে মনিকে নিয়ে তারা গন্তব্য স্থানে পৌঁছায়। সেখানে গিয়ে দেখতে পায় নিলম উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে সাদা শার্ট। ওরা বুঝতে পারে এটা নিলম।
‘যাহ! নিলম দাঁড়িয়ে আছে।’ তমা মনিকে ধাক্কা দিয়ে বলল।
‘জায়ান?’ মনি বলল।
‘এসেছে বোধহয়, হয়তো লুকিয়ে আছে। তুই এই গোপাল ফুল দিয়ে প্রপোজ করে গিয়ো। আমরা সেটা এখানে দাঁড়িয়ে ভিডিও করব।’ ফুল এগিয়ে দিয়ে বলল মিনা।
‘আ…’ ফুল হাতে নিয়ে মনি এগিয়ে গেল।
তারানা চিল্লিয়ে বলল,
‘কবিতা গুলো বলিস কিন্তু।’
মনি হ্যাঁ সম্মতি জানায়। দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলল সে নিলমের নিকট। ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকিয়ে কবিতা গুলো মনে করতে লাগল। বান্ধবীদের দিকে তাকিয়ে দেখলো ওরা ক্যাফেরা তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। ইশারায় প্রপোজ করতে বলল তারা। মনি সামনে ঘুরে তাকায়। ঈষৎ ভয় করতে বুকে। কিন্তু কেন সেটা তার অজানা। সে ভালো করে বুঝতে পারছে কবিতার তালগোল পাকিয়ে গুলিয়ে ফেলেছে। তাই নিজ থেকে বলতে লাগল,
‘ভালোবাসা কীভাবে প্রকাশ করতে হয় সেটা আমার জানা নেই। তবে এতটুকু বুঝি, ভালোবাসা মানে প্রথমে বিশ্বাস করা।আমি তাকে ভালোবেসে প্রয়োজন অপ্রয়োজন সব কথা শুনবো। যত্ন নিবো, মাঝে মাঝে অভিমান ভাঙ্গাবো। কষ্ট যাতে না পায় সেদিকে খেয়াল রাখব। যখন প্রয়োজন হবে তখন ভালোবাসলাম। যখন ভালো লাগবে না দূরে ঠেলে দিলাম। এইটাকে ভালোবাসা বলে না। ভালোবাসতে হলে কোনো কারণ ছাড়ায় ভালোবাসতে হবে। ভালোবাসা সুন্দর! তাই আজ আমি আমার মনের কথা প্রকাশ করব। আই লাভ ইউ!’ বলে দৃষ্টি নত রেখে ফুল এগিয়ে দিলো মনি।
পিছনে ঘুরে হাত থেকে ফুল নিয়ে জায়ান মুচকি হাসি প্রদান করে বলল,
‘লাভ ইউ টু জানেমান!’

কণ্ঠের স্বর শুনেই চট করে মাথা তুলে তাকায়। আঁখিযুগল আকারের তুলনায় বড়ো হয়ে যায় মনির। বোধহয় কোঠা থেকে বেরিয়ে আসবে এখনোই। বিস্ময়ে বিহ্বল সে!
শুধু মনি নয় তার বান্ধবী’রা বিস্ময়বিমূঢ়! কি থেকে কি হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছে না। যেখানে নিলমের থাকার কথা সেখানে জায়ান কি করে এলো কেউ বুঝে উঠতে পারছে না।
জায়ানের ঠোঁটের হাসি তখনো চওড়া ছিল। মনির চোখের দিকে তাকিয়ে ফুলের সুভাষ নিচ্ছে।
.
.
.
#চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here