#আমি_তোমাতে_বিলীন
#পর্ব_০৮,০৯
#সুমাইয়া মনি
০৮
ঝিম মেরে নিরুত্তর হয়ে বসে আছে সকলে। হঠাৎ করেই প্লানে পরিবর্তন আসবে কে-ই বা জানতো? ভুলটা ছিল তমার। তমার মনে ছিল না মনির ফেসবুক আইডি এখন জায়ানের কাছে। সে মনিকে একটিভ দেখে তাড়াহুড়োয় সেখানে টেক্সট করে বসে। লিখেছিল ‘প্লান শুরু মনি। নিলম সাদা শার্ট পড়ে তোর জন্য ওয়েট করছে সেখানে। তুই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বের হয়। আমি নিচে ওয়েট করছি।’ এসএমএস সিন করে জায়ান। ওদের প্লানের ব্যাপারে সব জেনে ফেলে। এবং বুঝে যায় এসব মিথ্যে অভিনয় মাত্র!
নিলম যখন সেখানে উপস্থিত হয়। তখন নাজমুল পিছন থেকে মুখ চেপে ধরে নিয়ে আসে অন্ধকার জনশূন্য স্থানে।তারপরই ঘটে অঘটন। নিলমের জায়গায় জায়ানকে প্রপোজ করে বসে মনি।
নিলম যখন নাজমুলের হাত সরাতে সক্ষম হয়, তখন সে নাজমুলকে দেখে চিনতে পারে। নাজমুল মনিকে জায়ান ভালোবাসা সেই বার্তাটি জানায়। এবং তাদের মিথ্যা প্লানের সম্পর্কেও বলে। নিলম কিছু বলতে পারে না। নিরুত্তর থেকে প্রস্থান করে। বাহিরে এসে জানতে পারে সব ঘটনা।
মনি কোনোমতে সেখান থেকে ভয়তে পালিয়ে এসেছে।
এখন তারা রুমে বসে রয়েছে। কি করবে, কি বলবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ নিরবতা কাঁটিয়ে তারানা বলে উঠে,
‘সব দোষ তমার। ও যদি ফেসবুকে না টেক্সট দিতো, তাহলে এমন হতো না।’
‘স্যরি! আমার ভুল হয়েছে মনি।’ করুণ স্বরে বলল তমা।
‘তমাকে দোষারোপ করিস না। জায়ানকে মনি প্রপোজ করে একদিন থেকে ভালো হয়েছে, আবার খারাপও হয়েছে।’
‘যেমন?’ মিনা জিজ্ঞেস করে।
‘মনি আমাকে প্রপোজ করলে জায়ান মনিকে হার্ট করত যে কোনো উপায়ে। খারাপ দিক হলো, এখন ভুলে প্রপোজ করেছে এতে পিছুও ছাড়বে না। জায়ান মনিকে ভালোবাসে এটা যেমন সত্যি, তেমন মনিকে পাবার জন্য সে যে কোনো কিছু করতেও প্রস্তুত আছে। আমি তার সম্পর্কে সবই জানি। যেহেতু গ্রাম একই ছিল। সবার ভালোবাসার ধরন এক নয়। কেউ কেঁড়ে নিতে চায়, কেউ বিসর্জন দেয়। জায়ান বিসর্জন দিবে না। ও সেই ধরনের লোক না।’
‘তাহলে এখন কি করব?’ তারানা কথাটা বলতে বলতেই দরজায় করাঘাত হয়। সকলের নজর দরজার দিকে পড়ে। মনির বুক হালকা কেঁপে উঠে। কেন যেন মনে হচ্ছে জায়ান এসেছে। তমা উঠতে উঠতে বলল,
‘আমি দেখছি..’
মনি অবশিষ্ট কথা শেষ করতে না দিয়ে তমার হাত ধরে বলল,
‘যাবি না। আমি জানি এটা হয়তো জায়ান হবে।’ ভীতু গলায় বলল মনি।
বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে মনির পানে। মনিকে এভাবে ভয় পেতে এই প্রথম দেখলো সবাই। তমা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘ভয় পাস না মনি। আমরা তো আছি তোর পাশে। দেখতে দে কে এসেছে।’ বলে হাত ছাড়িয়ে নিলো তমা। এগিয়ে গেল দরজার দিকে। খুলে দিতেই আশ্চর্য হলো। কেননা জায়ান ও নাজমুল গাম্ভীর্য মুখে দাঁড়িয়ে আছে। পিছন থেকে তারাও দেখে নিল দু’জনকে। জায়ান চোখের ইশারায় তমাকে সরে যেতে বলল। তমা পাশে সরে দাঁড়াল। ভেতরে প্রবেশ করে জায়ান। তারা দাঁড়িয়ে যায় সকলে। মনি নিলমের পিছনে এসে দাঁড়ায়।
জায়ান নিলমের দিকে একবার তাকিয়ে মনির পানে তাকায়।
মনি জায়ানের চাহনি দেখে আরেকটু পিছনে এগিয়ে গেল। জায়ান মনির হাত ধরে টেনে বাহিরে বের করে সামনে দাঁড় করালো। বলল,
‘আমাকে এত ভয় না পেলেও চলবে। ভালোবাসার মানুষকে ভয় পেতে নেই।’
কথাটা শুনে নিলম এক কদম এগিয়ে এসে বলল,
‘মিসআন্ডারেস্টিংয়ে মনি আপনাকে প্রপোজ করেছে। ও জানতো না সেটা আপনি ছিলেন। এখন কিন্তু আপনি একটু বেশিই করছেন জায়ান ভাইয়া।’
জায়ান ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ফেলে। পরক্ষণে নজর স্বাভাবিক এনে বলল,
‘তুমি আমাকে চিনো। এটাও জানো আমি কেমন। মনি আমাকে প্রপোজ করেছে। হোক ভুল! আই ডোন্ট কেয়ার। আমি আমার ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে কথা বলছি। সো, মাঝখানে ডিস্টার্ব একদম পছন্দ করব না।’
পুরো বাক্য শেষ করে জায়ান মনির পানে দৃষ্টি ফেলে। নিলম স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়৷ ক্ষুদ্র রাগ এসে মনে জড়ো হয়। কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না। মনি দৃষ্টি নত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। জায়ান পকেট থেকে একটি ব্লু রঙের বাক্স বের করে। ভেতর থেকে স্বর্ণের চেইনটি বের করে মনির গলায় পড়িয়ে দেয়। মনি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চুল গুলো বাঁধা থাকায় জায়ানের চেইন পড়াতে সমস্যা হয় না। জায়ানের হাতের স্পর্শে মনির সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠছে। এক অজানা অনুভুতি তাকে চার দিক থেকে ঘিরে ধরেছে। পরিশেষে সবাইকে অবাক করে দিয়ে জায়ান মনির দু গালে হাত রেখে কপালে আলতো চুমু এঁকে দেয়। মনি যেন বরফে পরিনত হয়েছে। রীতিমতো হাঁত-পা ক্রমশে অসাড় আসছে। গাল থেকে হাত সরিয়ে কণ্ঠে গম্ভীরতা ভাব এনে বলল,
‘মনি জায়ানের জান। কথাটা সকলে মাথায় রেখো।’ বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়। নাজমুলও পিছনে পিছনে বেরিয়ে যায়। তমা দ্রুত দরজা লাগিয়ে দেয়।
মনি ধীরগতিতে বিছানায় বসে পড়ে। বুকে হাত রাখতেই অনুভব করে ধড়ফড় শব্দ। মিনা এগিয়ে এসে মনির গলার চেইন দেখে বলল,
‘এখানে কয় ভরি?’
মনি হাত সরিয়ে রাগ নিয়ে বলল,
‘সর এখান থেকে।’
‘মজা করিস না মিনা। এমনেতেই মনি টেনশনে আছে।’ তমা এগিয়ে আসতে আসতে বলল।
‘দোস্ত! কি করা যায় বল? আর যাই হোক। এই ভিলেনকে ভালোবাসা যায় না। যে করেই হোক তাকে আমার জীবন থেকে সরাতে হবে।’ মনি করুণ স্বরে বলল নিলমের দিকে তাকিয়ে।
‘একদম টেনশন করিস না মনি। আমি আছি তোর সঙ্গে।’
‘আমি মানে। আমরাও আছি।’ তারানা বলল।
‘এক কাজ করি। চল আমরা আজ রাতেই ঢাকা চলে যাই।’
‘হ্যাঁ! চল নিলম।’ মিনা বলল।
‘তাহলে কি জায়ান আমার পিছু ছেড়ে দিবে?’
‘তোর তো পরিচয় জানে না।’ নিলম বলল।
‘আমার ফেসবুক আইডি তার কাছে।’
‘পাসওয়ার্ড তো তুই জানিস?’
‘হ্যাঁ!’
‘বল তাড়াতাড়ি।’ নিলম তড়িঘড়ি করে পকেট থেকে ফোন বের করে। মনি পাসওয়ার্ড মনে করে বলে দেয়। নিলম লগইন করে প্রথমে আইডির পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে। পরক্ষণে আইডি ডিয়েকটিভ করতে গিয়েও থেমে যায়। সবার উদ্দেশ্যে বলল,
‘এখন আইডি ডিয়েকটিভ করব না৷ আমরা যখন এখান থেকে বের হবো মাঝপথে আইডি ডিয়েকটিভ করব। তাড়াতাড়ি কাপড়চোপড় গুছিয়ে নে তোরা জলদি!’
নিলমের কথা অনুযায়ী সবাই কাপড়চোপড় গুছাতে আরম্ভ করে। নিলম নিজেও রুমে ফিরে কাপড় গুছাতে শুরু করে।
তারপর ওয়েট করে কখন বারোটা বাজবে। বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে তারা রওয়ানা দিবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। তখন হয়তো জায়ান জানতেও পারবে না। ডিনার সেরে তারা সকলে এক সঙ্গে বসে থাকে। পিকনিকে এসে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়তে হবে তা কে-ই বা জানতো। তাই তো এখন পালিয়ে যেতে হচ্ছে।
মনি তমার ঘারের ওপর মাথা রেখে চুপ করে বসে আছে। বাসায় গেলে কি হবে সেটাই ভাবছে সে। তার চেয়েও বড়ো কথা, যদি জায়ান যদি জানতে পারে তারা পালিয়ে গেছে। কী হবে সেটা ভেবেই মনির হাত-পা পুনোরায় ঠান্ডা হয়ে আসছে।
দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটা বারোটার দিকে এসে থামে।
তারা হোটেলের পুরো ভাড়া মিটিয়ে রওয়ানা হয় ঢাকার উদ্দেশ্যে। মনের প্রাণ কাঁপছে। বার বার মনে হচ্ছে এই বুঝি জায়ান পথ আঁটকে সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ নিলম মনির অবস্থা দেখে কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
‘ঘুমা! টেনশন কমে যাবে। আর আঙ্কেল কিচ্ছু বলবে না দেখিস!’
মনি কৃতজ্ঞতা দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিলমের হাতের ওপর হাত রাখে৷ তারপর সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে যায়। অনেকটা পথ পাড়ি দেয়। নিলমের চোখে আজ ঘুম নেই। দায়িত্ব নিয়েছে সে। মনিকে জায়ানের কাছ থেকে দূরে সরাবেই। সময় যেতে থাকে। ফজরের আজান দিয়ে দেয়। নিলম লোকেশন দেখে দ্রুত গাড়ি চালায়।
সকাল হয়ে গেছে। রৌদ্রেরঝাঁজ চোখে এসে পড়তেই মনির ঘুম ভাঙে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে দেখে গায়ে নিলমের জ্যাকেট দেওয়া। নিলমের দিকে তাকাতেই নিলম মৃদু হেসে বলল,
‘গুম মর্নিং দোস্ত!’
‘মর্নিং!’ মৃদুস্বরে বলল মনি।
‘পিছনের চুন্নি গুলোরে ডাক দে।’
মনি ঘুরে পিছনে তাকায়। তারপর নিলমের দিকে নজর ফেলে বলল,
‘আমরা এখন কোথায় আছি দোস্ত?’
‘তোর বাড়ির কাছাকাছি।’
‘কি বলিস?’ কিছুরা অবাক হয়ে।
‘ঠিকিই বলছি। দশটা বাজতে চলল।’
‘এত দেরি হলো কেন?’
‘মাঝপথে গাড়ির তেল শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর ইঞ্জিনেও একটু সমস্যা দিচ্ছিল। তেল গাড়িতে ছিল বিধাই গাড়ি চালিয়ে গ্যারেজে আসতে পেরেছিলাম। কল দিয়ে দোকানের লোককে ডেকে তারপর গাড়ি ঠিক করাই।’
‘এতকিছু করলি, আর আমি কিচ্ছু টের পেলাম না।’
‘মরার মতো ঘুমালে কি শুনবি নাকি কিচ্ছু।’
‘আর আইডি?’ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘ডিয়েকটিভ করে রেখেছি।’
মনি কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে পিছনের তমা, মিনা, তারানাকে ডেকে তুলে। প্রথমে মনিকে বাসায় নামিয়ে দেয় নিলম। মনি ভয় নিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করতেই অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছে যায়। পুরো বাড়ি সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। চারদিক মেহমানদের উপস্থিতিতে গিজগিজ করছে। সবাই মনিকে দেখে জিজ্ঞেস করে পিকনিক কেমন হলো? এত দেরি হলো কেন আসতে? আরো অনেক কিছু। কোনোরকম উত্তর দিয়ে জাহানুর বেগমকে খুঁজতে থাকে মনি। তার মনে হাজারটা প্রশ্ন উদয় হয়েছে। মিদুলের সুন্নাতেখাৎনা অনেক আগেই হয়ে গেছে। বাবা-মায়ের বিবাহ বার্ষিক জানুয়ারীতে গেছে। তাদের সবার জন্মদিনের তারিখও মনির মনে আছে। আজ কারো জন্মদিনও নয়। তবে বাড়িতে কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে বুঝতে পারছে না। খুঁজতে খু্ঁজতে আম্মুকে পেয়ে যায়। একজন লোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখে এগিয়ে যায় মনি৷ মাঝপথে দেখা হয় মোফাজ্জলের সঙ্গে। তিনি ফোনে কথা বলছিলেন। তখন মনির মাথায় হাত রেখে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,
‘তুই এসেছিল মা? তোর আম্মুর সঙ্গে দেখা কর গিয়ে।’
মনি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি চলে গেলেন। এগিয়ে এলেন আম্মুর কাছে। মনিকে দেখেই কথা থামিয়ে বললেন,
‘এতক্ষণ আসার সময় হলো তোর। পার্লারের মেয়েরা কখন এসে বসে রয়েছে জানিস তুই।’
‘পার্লার মানে? বাড়িতে কি হচ্ছে এসব আম্মু?’ উৎকণ্ঠে বলল।
‘পরে জানতে পারবি। রুবিয়া, রেহানা, জামিয়া কই তোরা? মনিকে ওর রুমে নিয়ে যাহ! তাড়াতাড়ি রেডি করিয়ে নিয়ে আয় ওঁকে।’
মনির তিন কাজিন এগিয়ে আসে। মনিকে জোর করে নিয়ে যেতে থাকে৷ কথা বলার সুযোগটুকুও দেয় না ওঁকে। এক প্রকার মনিকে জোর করে নিয়ে আসে রুমে। বসিয়ে দেওয়া হয় সাজাতে। কাজিনদের কাছেও জিজ্ঞেস করে উত্তর পায়নি মনি। লেহেঙ্গা পড়তে বললে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিল্লিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কেন আমাকে বলছো না তোমরা? কেন আমি এই লেহেঙ্গা পড়বো? কি হচ্ছে বাড়িতে?’
রুবিয়া খেঁকিয়ে বলল,
‘উত্তর মামা-মামির কাছ থেকে জেনে নিবি। এখন চুপচাপ রেডি হয়ে নে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ভালো হবে না মনি।’
‘আপু!’
‘কোনো কথা হবে না। একদম চুপ!’ বলেই মনির হাতে লেহেঙ্গা উঠিয়ে দিয়ে পড়তে বলে। মনি জিজ্ঞেস করার সাহস করে না৷ মনে ক্ষোভ নিয়ে লেহেঙ্গা পড়তে যায়।
আধাঘন্টা পর তমা, তারান, নিলম, মিনা মনিদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছে। তাদেরকে মোফাজ্জল হোসেন আসতে বলেছে। ওরাও অবাক হয় তোড়জোড় দেখে। নিজেরাও জানে না হঠাৎ কেন আঙ্কেল তাদের আসতে বলল। কারণটিও জানায় নি। মনিকে ফোন দিয়েছিল। কিন্তু বরাবরই ফোন বন্ধ পয়েছে। ড্রইংরুমে এসে বসতেই মনিকে উপর থেকে নামতে দেখতে পায়। মনিকে বউ সাজে দেখে তারা বিস্ময়াভিভূত! মনি ওর বন্ধুদের উপস্থিত দেখে অবাক হয়। তাদের মনে একটাই প্রশ্ন। কি হচ্ছে এসব? আর কেমনই বা হচ্ছে?
মনিকে সোফায় এনে বসানো হয়। সবাই মনিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ ছবি তুলছে, আবার কেউ কথা বলার চেষ্টা করছে। মনি সবাইকে উপেক্ষা করে শুধু বন্ধুদের দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখেমুখে এক রাশ প্রশ্ন? তখনই সেখানে কাজি সাহেব উপস্থিত হয়। কাজি সাহেবকে দেখে মনি ও তার বন্ধুদের এখন আর বুঝতে অসুবিধা হয় না বিয়ে হচ্ছে তার। মনির চোখে পানি চলে আসে। বাবা-মায়ের ওপর অভিমান এসে জড়ো হয়। কিছু বাচ্চার চিল্লিয়ে বলে জামাই এসেছে। রুবিয়া মনির মাথার কাপড় টেনে দেয়। মনি যেন পাথর হয়ে গেছে। নড়াচড়া, কথা বলার ভাষা যেন সীমিত আকারে হারিয়ে ফেলেছে। বরকে দেখেই নিলম, তমা, তারানা, মিনা ওদের অবস্থা আশংকাজনক। এ যে তাদের পূর্ব পরিচিত, জায়ান এহসান। কালো রঙের শেরওয়ানি ও পায়জামা, কালো নাগরা জুতো। মাথার পাগড়িও কালো রঙের। ড্যাশিং লুকে হেঁটে এসে জায়ান আয়েশ করে মনির পাশে বসে। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে চোখ টিপ দেয়।
.
.
#চলবে?
#আমি_তোমাতে_বিলীন
#পর্ব_০৯
#সুমাইয়া মনি
বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। মনি এখনো জানে না সদ্য বিয়ে করা বর জায়ান। সে তো ঘোরের মধ্যে ডুবে আছে। কোনো মতে কবুল বলে আনমনে সাইন করে দিয়েছে। এক ধ্যানে ভাবছে বাবা-মায়ের কথা। এমনটা না করলে কি হতো না। সামান্য ভুলের জন্য ডিরেক্ট বিয়ে! কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। যতক্ষণে মনির ঘোর ভাঙে ততক্ষণে প্রস্থান করেছে জায়ান।
মিনিট কয়েক বাদে নাজমুল এসে মনির বন্ধুদের ডেকে বাহিরে নিয়ে আসে। আপাতত বাহিরে তেমন কেউ ছিল না। জায়ান গাড়ির দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। নাজমুল ওদের নিয়ে জায়ানের নিকট উপস্থিত হয়ে বার্তাটি তাকে জানাল। সানগ্লাস খুলে ফিরে তাকাল। তাদের আগাগোড়া একবার দেখে নিয়ে বাঁকা হাসলো। এ হাসিতে জায়ানকে রহস্যময় লাগছে। তারা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জায়ান নিলমের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। মৃদুহেসে বলল,
‘কাল কি যেন বলেছিলে, হ্যাঁ! আমি একটু বেশি করছি..।’ বলে জায়ান তার ঠোঁটের হাসি চওড়া করল। ফের বলল,
‘একটু নয়, অনেক বেশি করে ফেলেছি। তোমরা কি মনে করেছো আমার কাছ থেকে মনিকে সরিয়ে নিবে। এতই সহজ!’ লাস্টের কথা গম্ভীর কণ্ঠে বলল জায়ান।
নিরুত্তর তারা। চোখেমুখে এখনো প্রশ্নসূচক ভাব ফুটে রয়েছে। জায়ান একটু পিছনে এগিয়ে পকেটে এক হাত পুরে বলল,
‘আমার আব্বু ও মনির আব্বু একে অপরের বন্ধু। অনেক আগে থেকেই আমাদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু সেটা মনি জানতো না। দু’সপ্তাহ আগে আঙ্কেল আমাকে মনির ছবি হোয়াটসঅ্যাপে দিয়েছে। মনিকে শুধু ছবিতে দেখেছি।কোইন্সিডেন্টাললি আমরা সাজেকে একই রিসোর্টে উঠি। এবং আমাদের ভিন্নভাবে দেখাও হয়ে যায়। তখন আমি মনিকে এতটা খেয়াল করিনি। তবে চেনাচেনা লাগার কারণে মনির ছবি দেখে নেই হোয়াটসঅ্যাপ থেকে। সন্দেহ রয়ে যাওয়ায় বাবার নাম জিজ্ঞেস করে। মনি ও তোমাদের ছবি তুলে আঙ্কেলকে সেন্ড করি। ব্যস! জানতে পারি তোমাদের ও মনির বিষয়। এই ব্যাপারটা আমাদের পরিবাবের সকলে জানলেও মনি কিছুই জানত না। ফাস্ট মিটে মনিকে পছন্দ হয়। তারপর ওর দুষ্টুমি গুলো ভালোলাগে আমার। আস্তেধীরে মনের কোঠরে জায়গা করে নেয়।’
মনোযোগ সহকারে জায়ানের কথা শুনছিল তারা। জায়ান বিরতির পর পুনোরায় বলল,
‘আঙ্কেলের সঙ্গে আমার কথা হতো। মনি তো কল ধরত না। আমার কাছ থেকে মনির খবরা-খবর জানত। মনির আইডির পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করার সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যাই কিছু একটা তালগোল পাকাচ্ছো তোমরা। নাজমুল তোমাদের ওপর নজর রাখে। জানতে পারি তোমরা ঢাকায় ফিরে যাচ্ছো। আঙ্কেলকে তৎক্ষনাৎ ঘরোয়া ভাবে বিয়ের ব্যবস্থা করতে বলি। এখন মনি আমার।’ কথাটা বলে ঘাড়ে হাত রাখে।
তারপর আবার কণ্ঠে কাঠিন্য ভাব ফুটিয়ে বলে,
‘তোমরা মনির ফ্রেন্ড! জানি ওর ভালোই চাইবে। কিন্তু এমন কোনো কাজ কোরো না, যাতে মনি কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়৷ নেক্সট টাইম, মনিকে আমার কাছ থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করলে, পরিনতি কতটা ভয়াবহ হবে সেটা নিশ্চয়ই বলতে হবে না তোমাদের। মাইন্ড ইট!’ লাস্টের বাক্যটুকু এক ভ্রু উঁচু করে বলল। গাড়িতে উঠে বসে। নাজমুল পাশের সিটে বসল। গাড়ি চালানোর আগে কাঁচ নামিয়ে ওদের উদ্দেশ্যে বলে,
‘কাল আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান বড়ো করে করা হবে। তোমাদের দাওয়াত রইলো। আর হ্যাঁ! চাইলে এসব তোমাদের ফ্রেন্ড মনিকে জানাতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই। মনি হয়তো জানেও না আমার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। জানিয়ে দিও তোমরা।’ কথাটা বলে নজর সরিয়ে নিয়ে হাতের ইশারায় গাড়ি চালাতে বলে নাজমুলকে। জায়ানের গাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
তারা এখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জায়ানের কঠিক বাক্য গুলো তাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। এটাও বুঝেছে জায়ান ওদের ইন্ডাইরেক্টলি ওয়ার্ন করেছে। নিলম রেগে হাত মুঠ করে শুধালো,
‘এরকম একটা লোকের সঙ্গে মনির বিয়ে হয়েছে, ভেবেই.. রাগ হচ্ছে প্রচুর!’
‘আমাদের কাছ থেকে মনিকে সরিয়ে নিতে চাইছেন তিনি।’ তমা বলল রাগী কন্ঠে।
‘যা হয়ে গেছে, গেছে! এসব না ভেবে মনিকে গিয়ে সব খুলে বলি চল। বেচারি প্রচুর কষ্ট পেয়েছে।’ মিনা বলল বিরস মুখে।
‘পাবেই না কেন? আঙ্কেল এটা ঠিক করেনি। এট লিস্ট মনিকে জানাতে পারত বিয়ের কথা।’ তারানা রাগী নিশ্বাস ফেলে বলল।
‘মনির কাছে চল সময় নষ্ট না করে।’ তমা তাড়া দিয়ে বলল।
দেরি না করে ভেতরে এলো। এসে মনিকে ড্রইংরুমে দেখতে পায়নি। তারা মনির রুমের দিকে ছুঁটে আসে। দেখে মনি সব গহনা, সাজসজ্জা নষ্ট করে ফেলেছে। জাহানুর বেগম মনিকে থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পেরে উঠছে না। চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলছে ‘কেন তাকে না জানিয়ে বিয়ে দেওয়া হলো’।
রীতিমতো সেখানে কিছু মেহমানও উপস্থিত হয়েছে। মোফাজ্জল হোসেন বন্ধুদের সেখানে রেখে মেহমানদের চলে যেতে বললেন। ওদের সামনেই তিনি বললেন,
‘এভাবে চেঁচিয়ে আমার বাকি মানসম্মানটুকু ক্ষয় কোরো না। যা হয়েছে তোমার ভালোর জন্য হয়েছে। অনেক আগে থেকেই জায়ানের সঙ্গে তোমার বিয়ে ঠিক করা ছিল। তুমি জাতে আর কোনো প্রকার পাগলামি করতে না পারো তার জন্যই বিয়ে হয়েছে তোমাদের।’
জায়ান নাম শুনে মনি আগেই থমকে গেছে। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় সে। চারদিক থেকে বিস্ময়বিহ্বলতা ঘিরে ধরেছে। অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করল,
‘জা..জায়ান?’
‘হ্যাঁ! জায়ান। যাকে কাল প্রপোজ করেছো। সেই জায়ান।’
মনি যেন দমে গেল। শরীর প্রচণ্ড হালকা অনুভব হচ্ছে। চোখের সামনে জায়ানের রাগী মুখশ্রী ভেসে উঠে। আস্তেধীরে বিছানার নিকটে গিয়ে বসে পড়ে। মোফাজ্জল হোসেন মেয়েকে এমন হতভম্ব হতে দেখে নিলমদের উদ্দেশ্যে বলল,
‘সামলাও তোমার বন্ধুকে। জাহানুর চলে এসো।’ বলেই তিনি বেরিয়ে গেলেন। জাহানুর বেগম মেয়ের দিকে করুণ নজরে তাকিয়ে রুম ত্যাগ করলেন।
তারা এগিয়ে আসে মনির দিকে। দু’পাশে তিনজন বসে। নিলম মনির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। হাতদুটো নিজের হাতের মাঝে নিয়ে নরম স্বরে বলল,
‘তোকে কিছু বলার আছে দোস্ত!’
মনি প্রতিত্তোরে নিরব। নিলম জায়ানের বলা সব কথা জানায়। মনি চুপ করে শুনে। শেষে নিলম মনিকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
‘জায়ান ভাইয়া কেমন তুই জানিস মনি। এখন যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে, তাই কোনোপ্রকার পাগলামি করিস না প্লিজ! নিজের কথা না হলে একবার আঙ্কেলের কথা মাথায় রাখিস।’
তমা মনির কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘জায়ান ভাইয়া রাগী মানুষ হলেও, সে তোকে ভালোবাসে এটা সত্যি!’
‘তুই ভাইয়াকে ভালোবেসে তোর মতো বানিয়ে নিবি। তাহলেই হবে।’ মিনা বলল।
‘আমি একটু একা থাকতে চাই..’ চৈতন্য ভেঙে বলল মনি।
‘আচ্ছা!’ বলে নিলম মনির হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। একে একে বেরিয়ে যায় তারা। মনি দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। পরপরই ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে।
মনে পড়ে জায়ানের ফাস্ট চুম্বন! তার রাগান্বিত আদল। ঠোঁটের বাঁকা হাসি। রাগে দু’হাতের মুঠোয় লেহেঙ্গার ওড়না খাঁমচে ধরে মনি। দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে আওড়ায়,
‘দেখবো আপনি আমাকে কীভাবে সহ্য করেন।’
_
‘জায়ান বিয়ে করেছে ড্যাড।’ মাহিদ রাশভারি কণ্ঠে বলল।
‘জানি, বলে বলে তোমাকে ঢোল পিটাতে হবে না।’ খেঁকিয়ে বললেন রজত আলি।
‘এখন কি করব ড্যাড?’
‘ওদের রাজশাহী আসার অপেক্ষা করতে হবে। ঐখানে গিয়ে তো কিছু করতে পারলে না।’
‘সময় পেলাম কই? এর আগেই তো চলে গেল। কখন গিয়েছে দেখিনি।’
‘গাধা কোথাকার। তোমাকে বেড়াতে পাঠাইনি সেখানে।’
‘ঝাড়ি দিচ্ছো কেন ড্যাড। এখানে আমার ভুল কোথায়?’
‘তোমাকে পাঠানোই ভুল হয়েছে। বাকি কাজ আমি লোক দিয়ে করাবো। তোমাকে প্রয়োজন হবে না।’ বলে তিনি ড্রইংরুম ত্যাগ করলেন।
মাহিদ রাগে ফোঁসফোঁস করছে। বাবার কাছ থেকে অপমানসূচক কথা তার ইগোতে লেগেছে।
___
দুপুর-বিকেল, বিকেল থেকে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে এলো। জায়ান মনির সঙ্গে দেখা করতে আসে নি। সে আগেই জানিয়ে দিয়েছে কাল সেন্টারে দেখা করবে। কিছুক্ষণ আগে জায়ানের বাবা-মা এসেছে। মনিকে দেখে তারা ভীষণ খুশি। তাদের বন্ধুত্ব শক্তপোক্ত হয়েছে। নতুন সম্পর্ক তৈরী হলো। এত সুখের মাঝে মনি শুধু নিরব স্রোতার ভূমিকা পালন করেছে। বিনিময় মিথ্যে হাসি প্রদান করেছে। সকলের চোখে এটা এড়ালেও জাহানুর বেগমের চোখে বিষয়টি তীরের মতো বিঁধেছে। আসলে সে নিজেও চাই নি তার মেয়ের এত দ্রুত বিয়ে হোক। এই বাড়িতে শুধু একদিনের মেহমান হয়ে আছে তার মেয়ে। ভাবতেই বুক ভার অনুভব করেন তিনি। মিদুল বোনের পাশে বসে রয়েছে। সেও বোনের বিয়েতে মহা খুশি। এত কোলাহল মনির সহ্য হচ্ছে না দেখে উঠে রুমে চলে আসে। টানা তিন ঘন্টা যাবত সেখানে পুতুলের ন্যায় বসেছিল। দরজা লাগিয়ে শাড়ি টেনে খুলে, কেঁদে ফেলে। বিছানার সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। রাগ-কষ্ট গুলো তাকে চেপে ধরেছে। তার জীবনের স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলতে বসেছে। মনে হচ্ছে যেন কোনো পাখির খাঁচায় অতি দ্রুত বন্দী হতে যাচ্ছে। হঠাৎ পরাপর ফোনের টোন দু’বার বেজে উঠে। বিছানার ওপরে হাতড়িয়ে ফোন নিয়ে দেখে জায়ানের মেসেজ এসেছে। সেখানে লিখা ছিল ‘আজ তোমার সঙ্গে দেখা করব না। যত পারো রাগ – জেদ কেঁদে বিসর্জন দেও। আমার কাছে আসলে কাঁদার সুযোগ টুকু পাবে না। কেননা, অতি দ্রুতই তোমাতে বিলীন হতে যাচ্ছে জায়ান।’ লাস্টের টেক্সটে লিখা ছিল ‘গুড নাইট জানেমান।’
সজোরে ফোন ছুঁড়ে দেয় বিছানায়। রাগে-দুঃখে হাউমাউ করে কাঁদে মনি।
.
.
.
#চলবে?