আমি_তোমাতে_বিলীন #পর্ব_১০,১১

0
812

#আমি_তোমাতে_বিলীন
#পর্ব_১০,১১
#সুমাইয়া মনি
১০

বেশ ধুমধাম করে বৌ-ভাতের আয়োজন করা হয়েছে। দু পরিবারের সকলে খুশি। চারদিকে মেহমান গিজগিজ করছে।
তমা, নিলম, তারানা, মিনা কিছুক্ষণ আগেই সেখানে উপস্থিত হয়েছে। মনি স্ট্রেজের উপর বসে ছিল। মনির হাসিখুশি মুখখানা দেখে তারা একটু কনফিউজড! অতি বন্ধুসুলভ আচরণ করছে সবার সঙ্গে। ওর বন্ধুরা এগিয়ে গিয়ে সাক্ষাৎ করে। তখন আশেপাশে সকলে চলে যায়। মনি স্বাভাবিক ভাবে হেসে জিজ্ঞেস করে,
‘কেমন আছিস তোরা?’
একে একে সবাই ভালো, আলহামদুলিল্লাহ! বলে উত্তর দেয়।
মনিকে জিজ্ঞেস করার আগেই সে চটপট হেসে উত্তর দেয়,
‘আমি ভালো আছি। দেখতেই তো পাচ্ছিস।’
‘সত্যি?’
‘সব ভালো ভালো নয়, কিছু ভালো অজান্তেই পীড়া দেয়।’ মনি হাসিখুশি মুখেই বলল।
কথাটা শুনে ওদের চেহারার রং ফ্যাকাসে হয়ে আসে। মুখ খুলে কিছু বলাল আগ্রহ দেখায় না। জায়ান দূর থেকে তাদের লক্ষ্য করে। নাজমুলকে বাকি দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসে তাদের নিকট। ওদের উদ্দেশ্যে ‘হাই’ বলে মনির পাশে বসে। জায়ানকে দেখে ওদের কথা বলার ইচ্ছে মরে যায়। নিলম বিয়ের জন্য ‘শুভকামনা’ জানিয়ে নেমে যায়। ওরা তিনজনও নিলমের সঙ্গে নামে। মনি নিরব হয়ে বসে রয়। জায়ান মনির কানে কাছে মুখ নিয়ে কিছু বলার আগেই ওর কাজিনরা চলে আসে ছবি তুলতে। জায়ান থেমে যায়। সন্ধ্যার দিকে বিদায় দেওয়া হয় ওদের। মাজিদ এহসানের আলাদা একটি ফ্ল্যাট রয়েছে বনানীতে। মাঝেমধ্যে তারা এখানে এসে থাকেন তারা। সেই বাড়িতে মনিকে নিয়ে আসা হয়। আকলিমা বেগম ছেলের বউকে বরন করে নেয়। যেহেতু তার কোনো মেয়ে নেই, তাই তাকেই বউকে বাসর ঘরে দিয়ে আসতে হয়। বিছানায় বসিয়ে মনির হাত ধরে তিনি বলেন,
‘আমার একটি মাত্র ছেলে। তুমি ওর অর্ধাঙ্গিনী। আমার পর তুমিই ওঁকে দেখে রাখবে। তোমাকে আমার ছেলের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিলাম। কখনো জায়ানকে কষ্ট দিও না। ও তোমাকে মন থেকে অনেক বেশি ভালোবাসে।’ এখানেও নিরব স্রোতার ভূমিকা পালন করে মনি। তিনি আরো অনেক কিছু বলেন। তাদের পরিবারের সকল বিষয়ে খুটিনাটি জানায়। তারপর ফ্রেশ হবার জন্য মনিকে একা রেখে চলে যায়।
মনি তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘বাবা-মা কত্ত ভালো। আর ছেলে হয়েছে একটা পা*ডা, খা*টা*শ।’ বলেই রাগে মাথার ঘোনটা ফেলে দেয়। টলির ভেতর থেকে সব কাপড়চোপড় বের করতে শুরু করে। সেগুলো সব ফ্লোরে খাটের ওপর ছড়িয়ে রাখে। জায়ানকে জ্বালাতন করার জন্য মনির নতুন ছক বলা যায়। আকাশি রঙের একটি ড্রেস নিয়ে ফ্রেশ হতে চলল। জায়ান ফোনে কথা বলতে বলতে রুমে প্রবেশ করে। রুমের অবস্থা বারোটা থেকে তেরোটা দেখে মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায়। তবুও নিজেকে শান্ত করে। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ শুনতে পেয়ে বুঝতে পারে মনি শাওয়ার নিচ্ছে। ফোন রেখে বিছানায় বসে মনির জন্য অপেক্ষা করে৷ বের হবার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘এসব কি?’
মনি কিছুটা হকচকিয়ে উঠে মৃদুস্বরে বলল,
‘আসলে একটা জিনিস খুঁজতে খু্ঁজতে কাপড়চোপড় এলোমেলো হয়ে গেছে।’
‘সব ঠিকঠাক করো।’ ঝাড়ি দিয়ে বলল।
‘আমি প্রচুর টায়ার্ড..’
‘নো টক, গুছাও!’ চেঁচিয়ে বলল।
মনি মৃদু ভয় পেয়ে যায়। গাল ফুলিয়ে কাপড়চোপড় গুছাতে আরম্ভ করে। জায়ান দু হাত বগলদাবা করে দাঁড়ায়। মনির মাথায় টাওয়াল পেঁচানো ছিল। সেটা খুলে বিছানায় ছুঁড়ে দেয়। জায়ান টাওয়াল তুলে মনির কাছে এগিয়ে আসতে নিলে মনি দূরে সরে বাঁধা দিয়ে বলল,
‘আসবেন না।’
‘হোয়াই?’ ভ্রু কুঁচকে।
‘ইয়ে, আছে আমার।’ গলা খাঁকারি দিয়ে নজর সরিয়ে বলল।
‘কি?’ ভ্রু আরো বাঁকিয়ে বলল জায়ান।
মনি লজ্জায় ঘুরে দাঁড়ায়। ফোন টেবিলের ওপর থেকে নিয়ে জায়ানের নাম্বারে টেক্সট পাঠায়।
জায়ান টেক্সটটি পড়ে। লিখা ছিল,
‘আমার পি*রি*য়*ড হয়েছে।’
ফোনের স্ক্রিন থেকে নজর সরিয়ে মনির পিঠের দিকে বিরক্ত নিয়ে তাকায়। ফোন বিছানায় রেখে সজোরে মনির দিকে এগিয়ে যায়। সমনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
‘আমি কিছু করতে চাইছি না। জাস্ট তোমার চুল মুছাতে চেয়েছি।’
মনি টাওয়াল হাতে নিয়ে কোমল স্বরে বলল,
‘আমি করে নিবো দেন।’
জায়ান কিছু বলতে গিয়েও বলল না। চলে যেতে নিলে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
‘রেস্ট নেও! আম্মুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এক মিনিট, তোমার কি পেটে ব্যথা করছে?’
মনি জোরে জোরে মাথা উপর, নিচ দুলায়। যার উত্তর হ্যাঁ! জায়ান কিছু না বলে প্রস্থান করল। মনি বাঁকা হেসে মুখ ভেংচি দেয়। আসলে এগুলো তার বাহানা মাত্র। কাল জায়ানের বলা ‘তোমাতে বিলীন’ কথাটা মনির এখনো মনে আছে। সেই জন্য মিথ্যে বলা। তবে সে দমে যায়। এভাবে কতদিন মিথ্যে বলবে সেটা তার জানা নেই।
কিছুক্ষণ পর আকলিমা বেগম মনির জন্য খাবার নিয়ে আসে। নিজের হাতে ওঁকে খাইয়ে দিয়ে ঘুমানোর নির্দেশ দেয়। মনিও শুয়ে পড়ে। সারাদিনের ক্লান্তিভাব থাকায় ঘুম চলে আসে চোখে। দ্রুই ঘুমিয়ে যায় মনি।

আটটার দিকে মনির ঘুম ভাঙে। ঘুম জড়িত চোখে জায়ানকে সোফায় বসে কিছু পেপার ঘাটাঘাটি করতে দেখে। উঠে বসে গায়ে সুয়েটার পড়ে নেয়। জায়ানের দিকে না তাকিয়ে বলল,
‘ফ্রেশ হয়ে নেও জলদি!’
নিরুত্তর থেকে মনি বিছানায় থেকে নামে। ওয়াশরুমে থেকে বের হবার পর আকলিমা বেগম মনিকে নিয়ে নিচে আসে।
জায়ানও উপস্থিত হয়। দু’জন পাশাপাশি বসেছে। আপাতত মেহমান কেউ নেই। তারা চারজন উপস্থিত আছে ডাইনিং টেবিলে। আর কিছু সার্জেন্ট। মাজিদ এহসান খাবার খেতে খেতে বললেন,
‘হানিমুনে কোথায় যেতে চাও জায়ান?’
কথাটা শুনেই সঙ্গে সঙ্গে মনি বিষম খাই। মাজিদ এহসান, জায়ান মনির দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়। আকলিমা বেগম উঠে এসে মনির পিঠে হাত বুলিয়ে পানি এগিয়ে দেয়।
জায়ান কিছুটা বিরক্ত বোধ করে। মাজিদ এহসান তাড়া দিয়ে বলল,
‘আহা! পানি দেও বেশি করে।’
‘দিচ্ছি তো। খাওয়ার সময় কথা না বললে কি হয় শুনি?’ রেগে বললেন তিনি।
‘আমি বললামই বা কি? বকছো যে?’
‘কোথায় যাবে হানিমুনে সেটা ওরা ঠিক করবে। তোমাকে বলতে হবে কেন?’
‘আমাদেরও তো একটা মতামত আছে নাকি?’
‘সব বিষয়ে মতামত খুঁজতে যেও না। কিছু তো শরমভরম রাখো।’
তিনি আর কিছু বললেন না। মনি একটু স্বাভাবিক হলো। জায়ান কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। মনি স্বাভাবিক হবার পর বলল,
‘আব্বু, হানিমুনে বাহিরের দেশে গেলে কেমন হয়?’ কথাটা বলতে বলতে জায়ান মনির এক হাত শক্ত করে চেপে ধরে। যাতে এবার আর বিষম যেতে না পারে। মনি আড়চোখে জায়ানকে দেখে নেয়। মুখ চুপসে গেছে তার। লজ্জা এসে জড়ো হয়েছে আদলে।
‘যেতে পারো? তবে মনির পাসপোর্ট করতে সময় লাগতে পারে। তার চেয়ে বরং দেশের কোথাও যাও।’
‘কোথায় যাওয়া যায় বলো?’
‘আমি বলি কি তোরা রাঙামাটি যা!’ আকলিমা বেগম বললেন। শ্বাশুড়ির কথা শুনে মনি যেন কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন। একটু আগে তিনি নিজেই শরমভরমের কথা জানিয়ে এখন নিজেই বলা শুরু করেছে। অবাক বিষয়! মনি হাত ছাড়ানোর জন্য মুচড়াতে থাকে। জায়ান আরো শক্ত করে ধরে রেখে বলল,
‘রাঙামাটি ডান! তোমরা চলো আমাদের সঙ্গে।’
মাজিদ এহসান স্ত্রীর উদ্দেশ্যে মৃদু হেসে বললেন,
‘চলো? এই সুযোগে ছেলের সঙ্গে দ্বিতীয় হানিমুন সেরে আসি।’
‘ধুর! কি বলো এসব।’ লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বললেন তিনি।
মনির লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। মনে মনে বলছে,
‘আল্লাহ উঠায় নেও! এদের লজ্জাশরম কিচ্ছু দেও নি কেন?’
‘যাবে কি-না?’ জায়ান জিজ্ঞেস করে।
‘আরে নাহ! তোরা যাহ!’
‘তাহলে আমরা সামনের সপ্তাহে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই কি বলো?’
‘নেও! তার আগে বাকি কাজ গুলো গুছিয়ে নিও।’
‘ওকে।’
__
‘তুমি আমায় ইগনোর করছো কেন সিমরান?’ নিলম কিছুটা উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল তার গার্লফ্রেন্ড সিমরানকে।
সিমরান কপট রাগ নিয়ে বলল,
‘জানো না কেন?’
‘নাহ! জানতে চাই।’
‘তুমি তোমার মেয়ে বন্ধুদের সময় দেও। ঘুরতে যাও। আর আমাকে মিথ্যে বলো। কেন? মিথ্যে বলার প্রয়োজন কি নিলম?’
‘তুমি রাগ করবে দেখেই বলি না।’
‘আমার রাগে তোমার কি আশে যায়ে। তুমি তো তোমার মন মতোই চলছো। আমি যে তোমার গার্লফ্রেন্ড এটা তো মনেই হচ্ছে না।’
‘ভুল বুঝো না আমায় সিমরান। আমি সত্যি তোমাকে হার্ট করতে চাইছিলাম না। তাই..’
‘আমি ব্রেকআপ চাই!’ ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল।
‘হোয়াট? তুমি কি পাগল হয়েছো?’
‘সুস্থ মস্তিষ্কে বলছি আমি ব্রেকআপ চাই।’
‘এমন কোরো না সিমরান। আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি। ব্রেকআপ করতে চাই না।’ মিনতি করে বলল নিলম।
‘যে সম্পর্কে মিথ্যার বসবাস, সে সম্পর্কে টিকিয়ে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
‘সিম…’
বাকিটা বলার আগেই মনি নিলমকে সরিয়ে সিমরানের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। তেজী কণ্ঠে বলে,
‘তোর মতো ছোটমনের মেয়ের মুখে এটা মানায় না।’
‘হোয়াট?’ ক্ষেপে বলল।
‘ঠিকিই শুনেছিস। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে আগে বিশ্বাস দরকার। তুই তো নিলমকে বিশ্বাসই করিস না, ভালোবাসার কথায় পরে আসি। নিলম তোর জন্য আমাদের সঙ্গে কোথাও যেতে চায় না। আমরা ফোর্স করি। অবশ্য এতে ওর লাভ হয়েছে। ওর অন্ধ ভালোবাসার মানুষটির আসল রূপ ধরা পড়েছে।’
‘মনি! একটু বেশি বলছো কিন্তু।’ চেঁচিয়ে বলল।
‘রাখ তোর বেশিকম। আমি বলি শোন, তুই কি ব্রেকআপ করবি। আমি তোর সঙ্গে নিলমের ব্রেকআপ করালাম। যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে সম্পর্ক নেও। যা সর!’ কথাটা শেষ করে নিলমের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল মনি। সিমরান করুন চোখে তাকিয়ে আছে। নিলম মনিকে দেখছে, শুধুই অবাক হয়ে দেখছে। মনি আজ ভুল-ভ্রান্তি বুঝিয়ে দিলো। সম্পর্কের আসল কারণ দেখিয়ে দিলো।
চোখ খুলে তাকায় নিলম। এতক্ষণ সে অতীতের একটি ঘটনা মনে করেছে। সেদিনের পর থেকেই অজান্তে মনি নিলমের মনে জায়গা করে নিয়েছে। মনিকে মনে মনে পছন্দ করতে শুরু করেছে। মনিকে জ্বলানোর জন্য একটি মেয়ের সঙ্গে ফেইক রিলেশনে গিয়েছে। এতে করে মনি একটু হলেও বুঝতে পারে। কিন্তু মনির মনে নিলম এমন কোনো অনুভূতি অনুভব করেনি। মনি শুধু বন্ধু হিসেবে চেয়েছে ওঁকে। পিকনিকে যাওয়ার কথা শুনে সবার চেয়ে নিলম বেশি খুশি হয়েছিল। ভেবেছিল এ ক’দিন মনির কাছাকাছি থাকতে পারবে। নিজের ফিলিংসকে এমন ভাবে চাপিয়ে রেখেছিল কেউ কখনো টেরও পায়নি সেটি। সেদিন চেয়েছিল তার এই ফিলিংস মনির কাছে প্রকাশ করবে। ভালোবাসার কথা জানাবে। কিন্তু মাঝখানে জায়ান এতে বাঁধা সৃষ্টি করে। জায়ানের কাছ থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু হলো না। এখন মনি জায়ানের ওয়াইফ! কিছুতেই নিলম মেনে নিতে পারছে না। বুক যেন তার ভার হয়ে আসছে। গ্যালারিতে থাকা মনির ছবি গুলো জুম করে দেখতে থাকে। বন্ধুত্ব নষ্ট হবে ভেবে এতদিন যে ফিলিংস দমিয়ে রেখেছিল, আজ তাকে পরিপূর্ণ ভাবে হারিয়ে ফেলেছে। দুঃক্ষে বুক্ষের সঙ্গে ফোনটি চেপে ধরে সে।
.
.
.
#চলবে?

#আমি_তোমাতে_বিলীন
#পর্ব_১১
#সুমাইয়া মনি

‘তোমার কি যখন তখন বিষম যাওয়ার রোগ আছে নাকি মনি?’ কপট কণ্ঠে আওড়াল জায়ান।
মনি চটপট উত্তর দিলো,
‘নাহ!’
‘তবে কেন আব্বুর মুখে হানিমুনে যাওয়ার কথা শুনে বিষম গেলে?’
‘বিষম কি ইচ্ছে করে যায় মানুষ? হঠাৎ-ই বিষম গিয়েছি…।’ নজর এদিক সেদিন ফিরেয়ে বলল মনি।
‘রিয়েলি? একটা কথা বলো?’ বলতে বলতে এগিয়ে আসে মনির দিকে জায়ান। মনি পিছনে সরে গিয়ে চোখ পিটপিটিয়ে কোমল স্বরে বলল,
‘জি বলুন।’
জায়ান মনির দিকে একটু ঝুঁকে মৃদুস্বরে বলল,
‘তুমি আমাকে ভয় পাও?’
মনি জায়ানের থেকে সরে দাঁড়িয়ে কাঁপা স্বরে বলল,
‘না তো।’
‘সত্যি?’
মনি দ্রুত না সূচক মাথা ঝাকাল। জায়ান স্মিত হেসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
‘একদিন ঠিকিই বিলীন হবো তোমাতে। আটকাতে পারবে না তুমি।’ কথাটা শুনে মনির সর্বাঙ্গ দুলে ওঠল। শক্ত হয়ে খিটিমিটি দিয়ে দাঁড়ায়। জায়ান রুম ত্যাগ করে। মনির শরীর এখনো কাঁপছে। কোনো এক অজানা অনুভূতির রেশে!
পরপরই দীর্ঘশ্বাস টেনে বুকে হাত রাখল। ফোনের রিংটোন শুনতে পেলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে ‘আম্মু’ নামটি লিখা দেখে অভিমান এসে জড়ো হয় বুক্ষে। ফোন সেভাবে রেখে চলে আসে শ্বাশুড়ির কাছে। তিনি কাপড়চোপড় ভাজ করছিলেন। মনিকে দেখে খুশি হয়ে ভেতরে আসতে বললেন। তার পাশে বসিয়ে বললেন,
‘জায়ান চলে গেছে দেখে একাকী অনুভব করছো তাই তো। আমি আছি তো খোশগল্প করার জন্য।’
‘তেমন কিছু নয় আম্মু।’
‘আচ্ছা বুঝেছি। শোনো, জায়ানের পছন্দ, অপছন্দে কিছু কথা বলি তোমাকে।’
‘জি বলুন আম্মু।’
‘জায়ান বিরিয়ানির পছন্দ করে আর আলুর চিপস্। সব চাইতে অপছন্দের খাবার মুলা। এ ছাড়া টুকটাক সব কিছুই খায়৷’
‘কোনো কিছুতে ভয় পায় সে?’
‘হ্যাঁ! জায়ান টিকটিকিকে প্রচুর ভয় পায়।’
‘টিকটিকি?’ হেসে বলল মনি।
‘হ্যাঁ! প্রায় ঘরে টিকটিকিকে তাড়ানোর ঔষধ দেওয়া হয়।’
‘ওহ!’ বলে মনে মনে মনি বেশ খুশি হয়।
‘তুমি আবার এসব ভয় পাও নাকি?’
‘না আম্মু।’
‘জায়ান বলল তুমি নাকি অর্ধেক কথা বলো? কই এখন তো পুরো কথাই বলছো।’
‘আপনার জা*ই*ঙ্গা ছেলের জন্য অভ্যাস পরিবর্তন হচ্ছে আমার।’ মনে মনে বলল মনি।
‘এটা কি সত্যি?’
‘এখন আর বলি না আম্মু।’ ধ্যান ভেঙে বলল মনি।
‘ওহ!’
‘আব্বু কোথায় গিয়েছে?’
‘কোন সভায় যেন গিয়েছে।’
‘ওহ!’
বউ শ্বাশুড়ি অনেকক্ষণ গল্পগুজব করে। মনি আকলিমা বেগমের কথাবার্তায় বুঝতে পারে তিনি খুব ভালো মনের মানুষ। তাদের দু’জনকেই ভালো লাগে মনির। শুধু জায়ান ছাড়া। মনি জায়ানের দূর্বল পয়েন্ট জানতে পেরে প্রচুর হ্যাপি। এবার তাকে জব্দ করা যাবে ভাবছে সে।
_
‘কই গো শুনছো? মনি আমার ফোন ধরছে না।’ চিন্তিত হয়ে চিল্লিয়ে স্বামীর উদ্দেশ্যে বাক্যটি বললেন জাহানুর বেগম।
‘আমার ফোনও ধরছে না মনির মা।’
‘আবার কেন রাগ করল মেয়ে আমার।’
‘বুঝনি কেন?’
‘বিয়ের জন্য।’
‘যাক! গোবর মাথায় বুদ্ধি হলো তবে!’
‘কি বললে?’ এগিয়ে আসলেন তার নিকট।
‘বলেছি ওর শ্বাশুড়ির নাম্বারে কল দেও।’
‘তার নাম্বার তো নেই। জায়ানের নাম্বারটি দেও আমাকে।’
‘বলছি উঠাও।’
জায়ানের নাম্বার ফোনে তুলে কল দিলেন তিনি। জায়ান বক্তব্য দিচ্ছিল। ফোন বাজার ফলে নাজমুল ফোন পীক করে দূরে গিয়ে বার্তাটি বলেন। তিনি তৎক্ষনাৎ আকলিমার নাম্বারটি চাইলে তিনি পরে দিবে জানিয়ে ফোন রেখে দেয়।
কিছুটা হতাশ হয় জাহানুর বেগম। নতুন বাড়ি, নতুন সংসারে নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছে কি-না এটা ভেবে তিনি নিশ্চিত হয়ে আছেন।
‘পেলে কি?’
‘নাহ! জায়ানের এ্যাসিস্ট্যান্ট পরে দিবে বলে ফোন রেখে দিলো।’
‘তাহলে ওয়েট করো।’
‘হুম।’ হতাশজড়িত কণ্ঠে বলল।
__
২টার দিকে একজন ডেলিভারি বয় একটি পার্সেল দিয়ে যায়। মনি সেটি নিয়ে সবার আড়ালে রুমে ফিরে। পার্সেলটি দেখে মনি নিজেই হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।
জায়ান ও মাজিদ এহসান বাড়িতে পৌঁছায় এক সঙ্গে। রুমে প্রবেশ করে মনিকে শান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় বসে থাকতে দেখে জায়ান। নজর সরিয়ে শার্টের বোতাম খুলতে আরম্ভ করলে মনি বাহিরে যেতে নেয়। জায়ান পথরোধ করে। দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে মনির সামনে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মনি ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে তাকায়। জায়ান একটু কাছে এগিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
‘বোতাম খোলো।’
মনির বিরক্তিতে কপাল ঘুচে আসে। খুব বলতে ইচ্ছে করছে ‘হাত কুইরা রোগে ধরেছে?’ কিন্তু বলতে আর পারল কই। মুখের কথা ভেতরেই সীমাবদ্ধ! অনিচ্ছা শর্তে নজর সরিয়ে বোতাম খুলতে আরম্ভ করে। জায়ান মোহিত নজরে মনিকে পর্যবেক্ষণ করছে। মনি বিরক্ত নিয়ে মনে মনে বলে,
‘সেগুলো ড্রামায় দেখে এসেছি এখন সেটাই হচ্ছে আমার সঙ্গে। জীবনটা নাট্যমঞ্চ হয়ে গেল রে মনি তোর!’
সব বোতাম খুলে সরে যায় মনি। জায়ান মনির কোমড়ে হাত রেখে কাছে টেনে নেয়। নাক দিয়ে গালে স্লাইড করে বলল,
‘দূরে যত পালাবে, তত কাছে টেনে নিবো জান।’
মনি নিজেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করে বলছে,
‘দেখুন আমার কিন্তু..’ বলে থেমে যায়।
বাকি অবশিষ্ট কথা জায়ান পূর্ণ করে,
‘বলতে হবে না।’ গালে চুমু এঁকে ছেড়ে দেয়।
হাতার বোতাম খুলতে খুলতে বলল,
‘এখন তুমি ঠিক আছো? মানে পেটে ব্যথা এখনো আছে?’
‘নাহ!’ মনি ছোট্ট করে জবাব দেয়।
‘খেয়েছো?’
‘নাহ!’
‘নিচে যাও, আমি আসছি।’
মনি নিরুত্তর থেকে রুম ত্যাগ করল। জায়ান তোয়ালে গলায় পেঁচিয়ে ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হয়। ওড়না দিয়ে জায়ানের চুম্বন করা স্থান মুছে নিচ্ছে মনি। বিড়বিড় করে আওড়াতে আওড়াতে নিচে নামে।
___
নিমল মনমরা হয়ে বসে আছে তার কক্ষে। সালমা বেগম খাবার নিয়ে ছেলের রুমে এলেন। ছেলেকে এমন উদাস দেখে প্লেট পাশে রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘কি হয়েছে তোর?’
নিলম মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল,
‘আমি হারিয়ে ফেলেছি আম্মু!’
‘মনিকে?’
‘হ্যাঁ!’
‘ওর বিয়ে হবে, সেটা আগে জানতি না তুই?’
‘না আম্মু। যদি জানতাম কক্ষণো ঢাকা ফিরতাম না। ওঁকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যেতাম।’
‘জীবনে এমন কিছু মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। অনেক সময় তাদের ভুলে যেতে হয়।’
নিলম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘আমি ওঁকে এখনো চাই আম্মু!’
ছেলের পাগলের প্রলাপ শুনে তার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তিনি কোমল স্বরে বললেন,
‘খেয়ে নে।’
নিলম বুঝতে পারে তার মা প্রসংগ এড়িয়ে যাচ্ছে। তাই চুপ রয়ে যায়।
.
রাতে….

মনি বিছানায় শুনে ফোন টিপছে। ঘরিতে তখন এগোরোটা ছুঁই ছুঁই। জায়ান কিছু পেপারে লেখালিখি করছে। ডিনারের পর থেকে শুরু করেছে লেখালিখি। এখনো অব্ধি চলছে।
মনির তাতে মাথা ব্যথা নেই। শুধু এটা ভাবছে আজ কি এ রুমে ঘুমাবে, নাকি অন্য অন্য রুমে? শ্বাশুড়ির কাছে শুনেছে কাল নাকি পাশের কামরাতে শুয়েছিল। ঝগড়া হয়েছে কি-না সেটাও জিজ্ঞেস করে বসল। মনি উত্তরে ‘না’ সূচক জবাব দেয়। তৎক্ষনাৎ আর কিছু বলতে পারে না।
আড়চোখে কয়েকবার জায়ানের দিকে তাকিয়ে দেখে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে তো করেই যাচ্ছে!
মনি ফোন রেখে ঘুমের ভান ধরে। আধাঘন্টা পর জায়ানের কাজ শেষ হয়। মনির দিকে তাকিয়ে দেখে ঘুমিয়ে গেছে। সব কাগজগুলো গুছিয়ে রেখে নাইটি পড়ে ঘুমাতে আসে। কম্বল সরিয়ে বিছানায় বসতেই তড়াক করে দাঁড়িয়ে যায়। জলজ্যান্ত টিকটিকিকে বেডে দেখে চোখমুখ ঘুচে আসে জায়ানের। ভয়-রাগ চেপে ধরে তাকে। এক প্রকার চিল্লিয়ে মনিকে ডেকে তুলে। মনি হকচকিয়ে উঠে বসে পিটপিট করে জায়ানের দিকে তাকায়। জায়ান রাগ নিয়ে মনিকে বিছানার দিকে ইশারা করে। মনি অনুসরণ করে তাকিয়ে টিকটিকি দেখতে পায়, কপাল কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে জায়ানের দিকে তাকিয়ে মুখে হাত রেখে ফিক করে হেসে দেয়। হাসি আসেধীরে চওড়া হতে আরম্ভ করে। মনির হাসি দেখে জায়ান ক্ষোভিত চোখে তাকায়। মনি হেসে হেসে বলে,
‘টিকটিকি ভয় পায় হি হি।’ আরো জোরে জোরে হাসতে শুরু করে। জায়ানের নাকের পাটা ফুলে যায় রাগে। খেয়াল করে দেখে টিকটিকিটি আসলে নকল মানে প্লাস্টিকের। ক্ষেপে বলল,
‘তুমি জানলে কি করে? আর এই প্লাস্টিকের টিকটিকি এখানে আসলো কীভাবে?’
মনির হাসি যেন দমে আসে কিছুটা। স্বাভাবিক ভাব ভঙ্গি নিয়ে বলল,
‘আমি কি জানি?’
‘তুমি জানো না?’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল।
‘উঁহু!’ মাথা এদিক সেদিন দুলিয়ে বলল।
‘একজন সার্ভেন্ট বলল তুমি নাকি অনলাইনে কিছু এনেছো? সেটা কি এই প্লাস্টিকের টিকটিকি ছিল?’
‘নাহ! একদমই নাহ!’ অকপটে বলে ফেলে।
‘মিথ্যে বলছো?’ বলে মনির দিকে এগিয়ে আসতে নিলে মনি খাট থেকে নেমে দরজা খুলে দৌঁড়ে শ্বশুর-শ্বাশড়ির রুমের দিকে এগিয়ে যায়। জোরে জোরে করাঘাত করে ডাকতে থাকে তাদের। শব্দ শুনতে পেয়ে তারা তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে বের হয়। মনিকে উত্তেজিত হয়ে হাঁপাতে দেখে শ্বাশুড়ি কাছে টেনে জিজ্ঞেস করে,
‘কি হয়েছে মা তোমার? ভয় পেয়েছো নাকি?’
মাজিদ এহসান একই প্রশ্ন ছুঁড়ে মনির দিকে। তখন জায়ান উপস্থিত হয়। ক্রোধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই মনি আকলিমা বেগমের পিছনে গিয়ে লুকায়। আঙুল তুলে বলল,
‘আম্মু তুমি মনিকে বলেছো আমি টিকটিকি ভয় পাই?’
‘হ্যাঁ! বলেছিলাম। কিন্তু কি হয়েছে?’ আমতা আমতা কেটে জিজ্ঞেস করল।
‘মনি আমাকে ভয় দেখানোর জন্য অনলাইন থেকে প্লাস্টিকের টিকটিকি কিনে বিছানায় ছেড়ে দিয়েছে।’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল জায়ান।
তারা দু’জন মনির পানে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। জায়ানের রাগ যেন আরো চওড়া হলো। আকলিমা বেগম বুঝতে পেরে মনিকে জিজ্ঞেস করল,
‘এমনটা কেন করেছো বউমা?’
মনি ইতস্তত বোধ নিয়ে শ্বাশুড়ির কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু একটা বলল। তিনি সেটা শুনে জায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘মনি এক সপ্তাহ আমার সঙ্গে ঘুমাবে। শুনুন, আপনি গিয়ে নিচের রুমে ঘুমান বা জায়ানের সঙ্গে ঘুমান।’
জায়ানের রাগ যেন পানিতে পরিনত হলো মায়ের কথা শুনে। ভেবেছিল কি, আর হচ্ছে কি? লজ্জায় জায়ান মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। কিন্তু মাজিদ এহসান উৎকণ্ঠে বলল,
‘কিন্তু কেন?’
‘সেটা তোমার না জানলেও চলবে। এখন ঘুমাতে যাও। চলো মনি।’ কথাটা বলে আকলিমা বেগম তার স্বামীকে দরজার কাছ থেকে ঠেলে সরিয়ে দিলো। মনি জায়ানের পানে চেয়ে মুচকি হাসে। সেটা দেখে জায়ান রাগী নিশ্বাস ফেলে। দরজা লাগিয়ে দেন তিনি। মাজিদ এহসান ছেলের দিকে কিছুটা হতাশাজনক দৃষ্টিতে তাকাল। বলল,
‘বাপ! তুই তোর বউকে তো হারালি, সঙ্গে আমারও গেল। চল শোকসভা পালন করি।’ বলে জায়ানের কাঁধে হাত রেখে এগিয়ে গেল রুমের দিকে। জায়ান এতক্ষণে বুঝতে পারে মনির আসল প্লান। মনির উপর প্রচুর ক্ষোভ জন্ম নেয় তার হৃদয়ে।
.
.
.
#চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here