আমি_তোমাতে_বিলীন #পর্ব_১৪,১৫

0
819

#আমি_তোমাতে_বিলীন
#পর্ব_১৪,১৫
#সুমাইয়া মনি
১৪

সূর্যের আলোয় শীতের রেশ অনেকটা কেঁটে গিয়েছে। তবে চারদিকে এখনো উষ্ণতায় মাখোমাখো। কেউ কেউ ছাদে এসে রৌদ্দপোয়াতে ব্যস্ত। আবার কেউ ছুঁটে চলেছে কর্মস্থলের গন্তব্যে। কারেন্টের তাড়ে বিভিন্ন পাখি রৌদ্দ পোয়াতে দেখা যায়। সকাল দশটার কাছাকাছি বাজতে চলল। গাড়িতে বসে মনি তাড়ের পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পাশে জায়ান ফোন ঘাঁটতে ব্যস্ত। ঘন্টাখানিক আগেই তারা বাড়ি থেকে রওয়ানা হয়েছে মনিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। রেড সিগনালের জন্য গাড়ি থেমে আছে। এই সুযোগে মনি রাস্তাঘাটের খোলামেলা দৃশ্য সহজে দেখতে পাচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদেই গ্রীন সিগনাল পড়ে। গাড়ি চলতে আরম্ভ করে গন্তব্যের পথে। শীতল বাতাস মনির বেশ ভালো লাগছে। জায়ান মনির দিকে একবার তাকিয়ে নজর সরিয়ে নেয়। মনিদের বাড়িতে তারা একা নয়। নাজমুলও যাবে। সে গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে বসেছে। মনির সঙ্গে দেখা হবার পর কয়েক বার জায়ানের আড়ালে ‘মুলা ভাইয়া’ বলে ডেকেছে। নাজমুল বেচারা নিজেকে সংযত করেছে বহু কষ্টে। নয়তো উল্টোপাল্টা মুখ থেকে বেরিয়ে যেত। এখন আবার সেখানে গেলে কি না কি হয় সেটা ভেবে তার শরীর থেকে ঘাম ছুঁটার উপক্রম। না জানি সবার সামনে অপমানিত হতে হয় তাকে। তার যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। জায়ানের কথা ফেলতে না পারায় যেতে হচ্ছে তাকেও।
বেশ কিছুক্ষণ পর তারা পৌঁছে যায়। তাদের রেখে মনি একা একা ভেতরে আসে। সবার সঙ্গে কথায় মেতে উঠে। মোফাজ্জল হোসেন জামাইকে ভেতরে এসে ড্রইংরুমে বসায়। তাদের সঙ্গে টুকটাক কথপোকথন হয়। মিনিট বাদে কাজের বুয়া নাস্তা নিয়ে হাজির হয়। মনি হাতে আপেল নিয়ে খেতে খেতে জাহানুর বেগমের সঙ্গে উপস্থিত হয়। জায়ানের অগোচরে নাজমুলকে চোখের ইশারায় খেতে বলে। জায়ান প্রথমে কফি পান করে। মিদুলের হাতে খাবার তুলে দেয় জায়ান। মিদুল খেতে আরম্ভ করে। মনিকে সঙ্গে নিয়ে জাহানুর বেগম উপরে এলেন। নানাভাবে প্রশ্ন ছুঁড়তে থাকেন তিনি।
মনি উত্তর দিতে দিতে শেষ পর্যায়ে বলল,
‘শোনো! তোমার জামাই বেশি কথা বলা পছন্দ করে না। আর তার সামনে উল্টাপাল্টা কাজ তো মোটেও করবে না। মাথায় রেখো।’ বলে বের হতে নিলে তিনি বললেন।
‘এগুলো আমাকে বলছিস কেন?’
মনি দরজার সামনে থেমে গিয়ে বলল,
‘কারণ তুমি বকবকানি মাদার বাংলাদেশ তাই!’
‘কিহ! দাঁড়া।’ রেগে ধরতে গেলে মনি দৌঁড়ে বেরিয়ে যায়।
এক ছুটে নিজের রুমে চলে আসে। এসেই ধুপ করে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। সবে তিন-চারদিন হলো জায়ানদের বাড়িতে থেকেছে। কিন্তু তার কাছে মাস মনে হচ্ছে। এক প্রকার গড়াগড়ি খেতে আরম্ভ করে। এমতাবস্থায় জায়ান সেই রুমে প্রবেশ করে গলা খাঁকারি দেয়। আওয়াজ শুনে মনি তড়াক করে দাঁড়িয়ে যায়। চোয়াল কিছুটা শক্ত করে বলে,
‘কারো রুমে প্রবেশ করতে হলে নক করতে হয় জানেন না সেটা!’
‘ও রিয়েলি?’ গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো জায়ান।
‘তা নয়তো কি!’
‘এটা তোমার রুম?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ!’ মাথা ঝাকিয়ে বলল।
‘তো এখন কি করতে হবে?’ স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করে।
‘ফিরামিয়া নক করে আসেন।’ শাহাদাত আঙুল দিয়ে দরজার দিকে ইশারা করে বলে।
জায়ানের রাগে কপাল ঘুচে আসে। মনির হাতের কব্জি জোরে টেনে কাছে এসে দু হাত কোমড় শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে। মনি আকস্মিক ঘটনায় আহাম্মক হয়ে যায়। জায়ান দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো আমি তোমার হাসবেন্ড! এ রুমে তোমার যেমন অধিকার আছে, তার চেয়ে দ্বিগুণ অধিকার আমার আছে। আমি ডিসিশন নিবো কে কীভাবে রুমে প্রবেশ করবে। নাউ গেট আউট! এন্ড নেক্সট টাইম আমার পারমিশন নিয়ে রুমে প্রবেশ করবে। মাইন্ড ইট!’ বলেই মনির হাত ধরে টেনে বাহিরে বের করে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দেয়।
মনি রাগে লাল মরিচের ন্যায় রূপ ধারণ করেছে। নিজের রুম থেকে তাকেই বের করে দিয়েছে। রাগ তো লাগবেই! দিকবিদিক হয়ে রেগে পায়ের স্লিপার খুলে দরজার দিকে সজোরে ছুঁড়ে মেরে জোরেজোরে নিশ্বাস নিতে থাকে। খট করে দরজা খুলে দেয় জায়ান। মনি সেটা দেখে স্লিপার সেখানে ফেলেই ভয়তে বো দৌঁড় লাগায়! জায়ান স্লিপারের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে এটা দরজায় ছুঁড়ে দিয়েছিল।

মনি নাকমুখ রাগে ফুলিয়ে মোফাজ্জলের পাশে এসে বসেন। তিনি তখন নাজমুলের সঙ্গে কথা বলছিল। মেয়েকে লাল টমেটো দেখে কথার মাঝপথে জিজ্ঞেস করল,
‘কিছু হয়েছে কি মা?’
‘তোমার বদ জামাই আমাকে আমার রুম থেকে বের করে দিয়েছে।’
‘কোনো দুষ্টুমি করেছিস নাকি?’
‘নাহ!’
‘তাহলে?’
‘হুদাই!’
‘এহেম, এহেম! এক হাতে তালি বাজে না।’ হালকা কেঁশে মৃদুস্বরে বলল নাজমুল।
‘হ বলছে আপনাকে।’ ঝাড়ি দিয়ে বলল।
‘বলেনি, শুনেছি!’
‘বলব আপনার নাম আব্বুকে?’
‘এই না, না! এক হাতেই তালি বাজে। বাজালেই বাজে হুহ্!’ গড়গড় করে বলল।
‘এইতো লাইনে এসেছে ট্রেন।’ মনি ঠোঁট কামড়ে বলল।
উপর থেকে খেঁকিয়ে জায়ান বলল,
‘কি বললে নাজমুল?’
বাতাসের বেগে দাঁড়িয়ে যায় নাজমুল। দু’হাত নাচিয়ে বলল,
‘আমি কিচ্ছু বলিনি স্যার, কিচ্ছু বলিনি।’
‘গুড!’ বলে জায়ান চলে যায়।
মনি কটমট চোখে তাকায় নাজমুলের দিকে। নাজমুল বেচারা পড়ে যায় দ্বিধাদ্বন্দে। একদিকে বাঘ, আরেকদিকে বাঘিনী! মাঝখানে বসে মাইনকার চিপায় ঝুলছেন তিনি।
__
মাহিদ পরিকল্পনা করছে কীভাবে জায়ানের নিকট পৌঁছানো যায়। তার ছক অনুযায়ী সেগুলোর প্রচেষ্টা করছেন। কিন্তু বার বার বাধাবিপত্তি সামনে এসে বিক্ষিপ্তভাবে নাচছে। প্রথম টার্গেট মনিকে দিয়ে আরম্ভ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাতে একটা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তাই মনিকে আপাতত প্লানের বাহিরে রেখেছে মাহিদ। তবে কিছুতেই জায়ানের নিকট পৌঁছাতে পারছে না। সব রাস্তা এক প্রকার স্থগিত!
হাল ছেড়ে দিবেন না তিনি। কঠিনতম প্লান আঁকবেন। যে প্লানে তার বন্ধকেও সামিল করবে।
.
.
দুপুরের আহারের শেষে আকলিমা বেগম মনির কাছে ফোন দেয়। আলাপ হয় বৌ-শ্বাশড়ির মধ্যে।
‘যে জন্য কল দিয়েছি তোমাকে। কাল জায়ানের জন্মদিন। ওঁকে না জানিয়ে সারপ্রাইজ দিও।’
‘অবশ্যই! আম্মু। ‘
‘এবারের জন্মদিন যেন একদম মনে রাখার মতো হয়, এমন কিছু সারপ্রাইজ দিও মনি।’
‘ঠিক আছে আম্মু। আপনি আমাকে বলেছেন এই জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ!’
‘স্বাগতম! আচ্ছা রাখি। জন্মদিনের কথা ভুলে যেও না কিন্তু।’
‘না আম্মু, মনে থাকবে।’
‘আচ্ছা রাখি।’
‘জি!’
উভয় ফোন রেখে দিলেন। মনি থুতনির সঙ্গে ফোন ঠেকিয়ে ভাবছে জন্মদিনে জায়ানকে কি সারপ্রাইজ দেওয়া যায়।
এমন কিছু গিফট করতে চায় যেটা তার আজীবন স্মরণীয় থাকবে। ভাবতে ভাবতে চট করে আইডিয়া পেয়ে যায়।
বাঁকা হেসে বিড়বিড় করে বলে,
‘আমাকে আমার রুম থেকে বের করেছেন। মনি কিছুতেই এটা মেনে নিবে না। এবার আমার খেলা দেখবেন। এমন গিফট আপনাকে দেবো। মনে রাখবেন চিরজীবন হু!’ ভাব নিয়ে নাকে আঙুল ঘষে লাস্টের কথাটুকু শেষ করল।
_
রাত কেঁটে সকাল হলো। রাতে মনি ওর আম্মুর সঙ্গে ঘুমেছিল। মিদুলকে সঙ্গে নিয়ে জায়ান মনির রুমে ঘুমিয়েছে। নাজমুলকে আলাদা গেস্ট রুম দেওয়া হয়েছে। নাস্তা করে জায়ান ও নাজমুল বের হয়। মনি জায়ানের জন্য কেনাকাটা করতে শপিং মনে আসে। সঙ্গে ছিল তিন বান্ধবী। নিলমকে খবর দেয়নি৷ ওদের নিয়ে মনি জায়ানের জন্য গিফট কিনে।
সব কিছু কিনার পর ক্যাফেতে বসে সুন্দর করে প্যাকেট করছিল। তারানা, তমা, মিনা মনির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কীভাবে কি প্যাকেট করছে সেটা দেখছে তারা। তমা এক প্রকার নিরবচ্ছিন্ন করে মনিকে বলল,
‘শনিরদশা আছে আজ তোর কপালে মনি।’
‘শনিরদশা না, বল কপালে করল্লা ভাঁজা আছে আজ।’ মেকি রাগ নিয়ে বলল তারানা।
‘বেশি কথা বলিস ন..’
‘এই কিছু বলিস না তোরা থাম। ওর যা মন চায় করুক।’
কেউ কিছু বলল না। মনির কর্মকাণ্ড দেখে তারা এক প্রকার বিরক্ত। মনির প্যাকেট করা শেষ হলে নাজমুলের নাম্বারে কল দেয়। প্রথমে নাজমুল মনির নাম্বার দেখে রিসিভ করতে চায় নি। কিন্তু পরক্ষণে ভাবে যদি হিতে বিপরীত বিষয়ে নিয়ে চার-পাঁচ করে বসে এই ভেবে ফোন রিসিভ করে।
‘বলুন ভাবি।’
‘প্রথমত, আমি আপনার ভাবি না। মনি বলে ডাকবেন।’
‘কেন?’
‘আজিব! তাকে যদি স্যার বলে সম্মোধন করেন, তবে আমি আপনার ভাবি কি করে হই?’ মেকি রাগ নিয়ে বলল মনি।
‘তাহলে মেডাম বা ম্যাম চলবে?’
‘নট এলাউ! কল মি মনি, আন্ডারস্ট্যান্ড?’
‘আচ্ছা। এবার বলো কল কেন দিছো?’
‘আপনারা কোথায়?’
‘সংসদ ভবনের পাশে বঙ্গবন্ধুর ক্লাবে আছি।’
‘আমি আসছি।’
‘কেন?’
‘কে জানে..।’ বলতে বলতে ফোন কেঁটে দেয় মনি। নাজমুল ফোন কান থেকে সরিয়ে কনফিউজড হয়ে তাকায়। এ মেয়ের মতিগতি বোঝার ক্ষমতা আদৌও কারো আছে কি-না জানা নেই। আপাতত মনির আসার খবরটি জায়ানকে জানাতে চায় সে। এগিয়ে যায় কেবিনের ভেতরে। যেখানে জায়ান কিছু লোকদের সঙ্গে কথোপকথনে ব্যস্ত ছিল। সবার আড়ালে জায়ানের কানে কানে মনি আসছে ব্যাপারটি জানায়। জায়ান কিছুটা অবাক হয়। তবে তেমন পাত্তা দেয় না।
কিছুক্ষণ বাদে মনি ওর বান্ধবীদের নিয়ে সেখানে পৌঁছে যায়।
কিন্তু ভেতরে যায় না। দারোয়ানকে দিয়ে গিফটটি পাঠিয়ে দেয়। রিকশায় উঠে টেক্সট পাঠিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। টেক্সট এসেছে দেখে জায়ান ভ্রূক্ষেপ করে না। কিন্তু যখন দারোয়ান রুমের বাহিরে এসে দাঁড়িয়ে নক করে এবং হাতে বক্স জাতীয় কিছু নজরে আসে তখন কিছুটা অবাক হয়। নাজমুল এগিয়ে গিয়ে সেটি নিয়ে আসে। জায়ানের হাতে দিতে দিতে বলল,
‘মনি পাঠিয়েছে আপনার জন্য।’
জায়ান নাজমুলের দিকে কুর্নিশ করে তাকায়। নাজমুল জায়ানের চাহনি দেখে আমতা আমতা কেটে পুনোরায় বলল,
‘মনি ম্যাম পাঠিয়েছেন।’
জায়ান নজর সরিয়ে নিল কথাটি শুনে। পাশে রেখে কথোপকথনে ব্যস্ত হয়ে যায়। গিফট দেওয়ার মূল উৎস জানে জায়ান। মনে মনে মনির প্রতি জায়ান ইমপ্রেস হয়। কাল রাতের রাগ যেন নিমিষেই মিলে যায়। কথোপকথনের মধ্যে আড়চোখে কয়েক বার উপহারের দিকে তাকিয়েছে জায়ান তার হিসাব নেই। কিছুক্ষণ বাদে তারা চলে যাওয়ার পর জায়ান আগে ফোন হাতে নেয়। সেখানে ওর বাবা-মা সহ মনিরও টেক্সট ছিল। তারা দু’জন ও মনি ওঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। মনি টেক্সটে আরো লিখেছে, ‘আপনার জন্মদিন উপলক্ষে আমার তরফ থেকে ছোট্ট উপহার। আশা করি আপনার ভালো লাগবে। আর হ্যাঁ! গিফটটি একা একা দেখবেন। ধন্যবাদ জানানোর প্রয়োজন নেই। পরিশেষে আবারও জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই!’
মনির টেক্সট পড়ে জায়ানের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুঁটে উঠে। ফোন পাশে রেখে উপহারটি হাতে নিতে নিতে নাজমুলকে বলল,
‘আজ আমার জন্মদিন। এজন্য মনি গিফট পাঠিয়েছে।’
‘ওহ! শুভ জন্মদিন স্যার!’ মুচকি হেসে চটপট বলে উঠে নাজমুল।
‘থ্যাংক’স!’ জানাল জায়ান তাকে।
জায়ান ছোট ছুরি দিয়ে গিফট পেপারটি খুলে ফেলে। নাজমুল উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে নিজেও দেখতে চায় মনি তাকে কি উপহার দিয়েছে। জায়ান মনে মনে আনন্দে বিমোহিত। চেহারায় সেটা প্রকাশ না করলেও, ভেতরে ঠিকই সে প্রচুর খুশি! পুরো প্যাকেটটি খুলে ফেলে। লম্বাচওড়া মাজারি বাক্স বেরিয়ে আসে। সেটা ওপেন করতেই জায়ানের আনন্দ নিমিষেই মিলে যায়। আদলে রোষাগ্নির আভা ফুটে উঠে। চোয়াল শক্ত করে হাত মুঠোবন্দী করে নেয়। নাজমুল দ্রুত নজর সরিয়ে নেয়। মুখে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। আড়চোখে জায়ানের আদলের দিকে তাকাচ্ছে বার বার। আসলে সে জায়ানের রিয়াকশন দেখছে। কেননা মনি তার জন্য তিনটা জা/ঙ্গি/য়া পাঠিয়েছে। তাও এত সুন্দরভাবে প্যাকেটে করে। আর কেনই বা পাঠিয়েছে জায়ান ও নাজমুলের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। কারণ তার নামের সঙ্গে মিলছিল তাই। তার এতটাই হাসি পাচ্ছে যে দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল হয়ে গেছে। তাই একটু ঝুঁকে ওয়াশরুমের বাহানায় কেনি আঙুল জাগিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুটা দূর গিয়েই সে হাসতে হাসতে ফ্লোরে বসে পড়ে। আশেপাশের কিছু লোকজন তাকে এভাবে হাসতে দেখে অলরেডি পাগল উপাধি দিয়ে ফেলেছে।
এতে তার ভ্রূক্ষেপ নেই। সে তো হেসেই চলেছে।
এদিকে জায়ান চেয়ারে হেলান দিয়ে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করছে। নাজমুলের সামনে ইজ্জতভ্রষ্ট হয়েছে তার ভেবেই ক্রোধ ক্রমশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু আপাতত জায়ান নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। জানে সে মনি এটা ফাজলামো করে দিয়েছে। তবুও তার আদলে ক্রোধরূপ তীব্রভাবে দেখা যাচ্ছে।
.
.
.
#চলবে?

#আমি_তোমাতে_বিলীন
#পর্ব_১৫
#সুমাইয়া মনি

ড্রইংরুমে টিভি ছেড়ে আরাম করে চিপসের মজা নিতে ব্যস্ত মনি। তার মোটেও ভাবান্তর নেই যে সে কয়েক ঘন্টা আগে জায়ানকে কি গিফট দিয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সব স্বাভাবিকই আছে। শ্বাশুড়ি কল দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল জায়ানের গিফটের ব্যাপারে। মনি বলেছে এখনো দেয়নি। দিবে সময় মতো। শুনে তেমন কিছু বলেনি। ফোন রেখে দিয়েছেন। টম এন্ড জেরি কার্টুন বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। হঠাৎ তার পাশে ঘা ঘেঁষে কেউ বসায় মনি নড়েচড়ে উঠল। মনি চিপস মুখে নেওয়া অবস্থায় ঘুরে তাকাতেই জায়ানকে দেখতে পায়। তার নজর ছিল সামনের দিকে। আদলে ছিল না রাগবিরাগ! মনি তৎক্ষনাৎ কপাল কুঁচকে ফেলে। এভাবে পাশে বসার কারণ ঠাওর করছে। বাড়িতে বাবা-মা ভাই রয়েছে। তারা যদি বিষয়টি দেখে মনি লজ্জায় পড়ে যাবে নিশ্চিত। আচমকা জায়ান মনির পানে ঘুরে তাকায়। মুখের চিপসটুকু ঠোঁট স্পর্শ না করেই অর্ধেক কামড়ে নেয়। চিবোনোর ফাঁকে ফাঁকে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘গিফট পছন্দ হয়েছে। জাস্ট ওয়েট! তোমার বার্থ ডে-তে আমি কি উপহার দেই দেখো!’ বলেই জায়ান উঠে উপরে চলে যায়। মনির চোখ এখনো ছানাবড়া হয়ে আছে। জায়ানের কথায় নয়, কাজে! তাড়াতাড়ি মাথা এদিক সেদিন ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করে কেউ আছে নাকি। তখনই নজরে আসে সদর গেটের সামনে নাজমুল দাঁড়িয়ে আছে। মনির নজর পড়তেই মুচকি হেসে চোখ হাত দিয়ে ডেকে এগিয়ে এসে মনির সামনে থেমে গিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘আমি কিচ্ছু দেখিনি কিন্তু!’ বলেই দ্রুত জায়গা প্রস্থান করল।
মনির গাল লাল হয়ে যায় লজ্জায়। মুখের চিপসটুকু ফ্লোরে ছুঁড়ে দেয়। মনি জানে জায়ান এটা ইচ্ছে করে করেছে। কেউ দেখুক বা না দেখুক তাতে তার কিচ্ছু যায় আসে না। মূলত তার ওপর জমান চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র! ভাগ্যিস, নাজমুল ব্যতীত আর কারো নজরে পড়ে নি। নয়তো একদম কেলেঙ্কারির হয়ে যেতো।

দরজা লাগিয়ে কোট বিছানার উপর ছুঁড়ে দিতেই জায়ান কিছুটা অবাক হয়। সেখানে গোলাপ ফুল সহ আরেকটি গিফটের বাক্স ছিল। কপাল কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে তাকায় জায়ান।
হাতে নিয়ে তাজা গোলাপের দিকে মিনিট কয়েক তাকিয়ে লাল রঙের ফিতা খুলে ফেলে। সেখানে ব্লু রঙের একটি গড়ি ও ছোট বাক্সে কালো রঙের একটি ওয়াচ ছিল। সঙ্গে ছিল ছোট্ট একটি চিরকুট। সেখানে লিখা ছিল,’বার্থডে উপলক্ষে আমার তরফ থেকে আপনার জন্য ছোট্ট উপহার।…মনি।’ লাস্টে স্পেস দিয়ে মনি নামটি লিখা ছিল। যার দরুণ জায়ান বুঝতে পারে এই গিফটটিও মনি দিয়েছে। নিমিষেই জায়ানের ক্ষুব্ধ রাগ উবে যায়। যে রাগ এতক্ষণ বয়ে নিয়ে এসেছিল বাহির থেকে তা এখন বিন্দুমাত্র আদলে দেখা যাচ্ছে না। স্মিত হেসে বিছানায় বসে। ভেবেছিল মনিকে নিজেও এমন কিছু সারপ্রাইজ দিবে ওর জন্মদিনে যেটা দেখা বা পাওয়ার জন্য মনি নিজেও প্রস্তুত থাকবে না। তবে, তার মত পরিবর্তন করবে না। সত্যি সত্যি এমন উপহার মনি ডিজার্ভ করে। পরে না হয় অন্যরকম সারপ্রাইজ থাকবে। সেটা পেয়ে আগের সারপ্রাইজটির কথা ভুলে যাবে। ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে তার ফোনের রিংটোনে। পকেট হাতিয়ে ফোন বের করে দ্রুত রিসিভ করে। ওপর পাশে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কথা জায়ান স্থির হয়ে শুনছে। কিছুক্ষণ আগে যে রাগ-ক্ষোভ মুছে গিয়েছিল তা পুনোরায় জাগ্রত হলো আদলে। তাও বিক্ষিপ্তভাবে!

বিকালের দিকে জায়ান ওর আর মনির পরিবারকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট -ব্লু স্কাই বার্থডে সেলিবেট করতে আসে। বাইরের সাজসজ্জা দেখে অনুমান করা যায় রেস্টুরেন্টটি বেশ নামি-দামি। নিয়ম বাতির নরম আলোয় স্নিগ্ধ আভা ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। বাহিরের কোলাহলময় শহরের সাথে এই পরিবেশের সঙ্গে যেন কোনো সংযোগ নেই।
বেশ বড়ো চেয়ার-টেবিল জুড়ে খাওয়ার বৈঠক পেতেছেন পুরো পরিবার। সেখানে নাজমুলও ছিল। তাকে জায়ান কোনো অংশে বাহিরের লোক হিসেবে গন্য করে না। পরিবারের সদস্য হিসেবেই দেখে তাকে। বেশ কিছুক্ষণ আগে খাবার সার্ভ করা হয়েছে। কথোপকথনের সঙ্গে আরাম করে খাবার খাচ্ছেন তারা। মনিও টুকটাক কথা বলছে। কিন্তু জায়ান একদম চুপ আছে। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এমনটা নয়। সে অন্যকিছু ভাবছে। তার সুক্ষ্ম নজর চারদিক বাজপাখির মতো খেয়াল রাখছে। অবশ্য জায়ান দু তিন জন লোক ছদ্মবেশে রেস্টুরেন্টে আগেই পাহাড়া দেওয়ায় জন্য নিয়জিত করে রেখেছে। কিন্তু তবুও সে সব দিক নজর রাখছে। জায়ানকে এমন বিচলিত গুরুগম্ভীর দেখে মাজিদ এহসান চোখের ইশারায় ‘কি হয়েছে’ জিজ্ঞেস করতেই জায়ান হাতের ইশারায় সব ‘ওকে’ জায়ান। কিন্তু সে জানে জায়ান কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত। বাসায় ফিরলে আলাপ করবে ভেবে ব্যাপারটি চেপে যান তিনি।
জায়ান মনির দেওয়া পাঞ্জাবি ও ওয়াচ পড়েছে। ব্লু রঙটি জায়ানকে বেশ মানিয়েছে। সোজাভাবে তাকাতে না পারলেও আড়চোখে কয়েকবার জায়ানকে দেখতে ভুলেনি সে। তবে মনি লক্ষ্য করেছে জায়ান বার-বার আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে। নজর অনুসরণ করে মনি কয়েকবার তাকিয়েছিল। কিন্তু তেমন কিছু নজরে পড়েনি। তবে জায়ান কি দেখার চেষ্টা করছে বা খুঁজছে? বিষয়টি মনির মনে প্রশ্ন হয়ে রয়ে যায়।

ডিনার শেষে জায়ান ও মনি এখান থেকেই বনানীতে ফিরে। কাল মাজিদ এহসান ও আকলিমা বেগম রাজশাহী ফিরবেন। তাই রাতেই ফিরতে চান বাড়িতে। জায়ান মনিদের বাবা-মা ও মিদুলকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে যায়। নাজমুল ও সেই তিনজন গার্ডকে সঙ্গে নিয়ে বনানীতে ফিরেন। তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে বনানীতে ফিরতে এগারোটা বেজে যায় জায়ানের। ফ্রেশ হয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতেই মনি রুমে এসে হাজির হয়। মনিকে দেখে জায়ান সরু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘এনি প্রবলেম?’
‘ঘুমাবো?’ মিনমিন কণ্ঠে বলল।
‘কে ধরে রেখেছে?’
‘আপনি?’
‘কীভাবে?’ কিছুটা বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘বিছানার কাছ থেকে সরুন।’
‘তোমার সাত দিনের উপাস শেষ হয়েছে?’
মনি মেকি রাগ নিয়ে তাকায়। জায়ান আঙুল তুলে কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলল,
‘চোখ নিচে। যাও সোফায় গিয়ে ঘুমাও।’
মনি এটা শুনে সোফার দিকে তাকিয়েই তড়াক করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। যখন ফিরে তখন আকলিমা বেগম ও মাজিদ এহসান সঙ্গে ছিল। আকলিমা বেগম চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলল,
‘সাহস তো কম না তোর। বৌমা’কে বলছিস বিছানায় জায়গা পাবে না, সোফায় গিয়ে ঘুমাতে।’
‘আম্মু আমি এভাবে বলিনি কথাটা।’ কাঠিন্য কণ্ঠে শুধালো।
‘তুই কীভাবে বলেছিস সেটা আমাকে ভনিতা করে বলতে হবে না। সাহস কি করে হয় ওঁকে সোফায় ঘুমানোর কথা বলার।’
‘আশ্চর্য! বলার জন্য সাহস লাগে নাকি?’
‘বললি কীভাবে? তুই গিয়ে সোফায় ঘুমা। মনি তুমি বিছানায় ঘুমাও।’
বলতে দেরি মনির বিছানায় উঠে গা এলিয়ে দিতে সময় লাগল না। বিছানায় ঘুমাতে পেরে সে মহা খুশি। জায়ান রাগ নিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। আকলিমা বেগম বললেন,
‘বাড়ির বৌয়ের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হয় তোর বাবার কাছ থেকে শিখ কিছু।’
জায়ান কিছুটা অসহায় চোখে বাবার দিকে তাকায়। তিনি তাকে ইশারায় চুপ থেকে ছাদের দিকে ইশারা করেন। জায়ান বুঝতে পারে তাকে ছাদে যেতে বলছেন তিনি। আকলিমা বেগম ছেলেকে আরো কিছুক্ষণ ভাল-মন্দ বলে বেরিয়ে গেলেন। সঙ্গে মাজিদ এহসানও চলে গেলেন। জায়ান মনির দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় তার ঠোঁটে বিজয়ী হাসি। জায়ান বিরক্ত নিয়ে মনে মনে বলল,
‘ব্যস! আর একটা দিন। হাসি এমনেতেই কমে যাবে জায়ানের পাল্লায় পড়লে।’ বলে বেরোলো জায়ান। ছাদে এদে বাবাকে পেয়ে যায়।
‘এবার খুলে বলো কি হয়েছে?’
‘মাহিদ ঢাকাতে আছে।’
‘রজত আলি পাঠিয়েছেন নিশ্চয়?’
‘সঠিক বলতে পারছি না। কারণ সে নাকি জানেন না মাহিদ ঢাকাতে আছে।’
‘কোথায় জানে?’
‘কক্সবাজার।’
‘এমনটা কেন?’
‘রাতুল বলল মাহিদ ঢাকাতে এসেছে। কিন্তু তার বাবাকে বলেছে সে বন্ধুদের সঙ্গে কক্সবাজার গেছে পিকনিকে।’
‘মিথ্যে বলার কারণ নিশ্চয় আছে?’
‘আছে! হয়তো আমাদের ক্ষতি করতে এসেছে।’
‘কিন্তু সেটা রজত আলিকে না জানানোর কারণ কি?’
‘কারণ, মাহিদ সাজেক গিয়েছিল। সেখানে নাকি রজত আলি পাঠিয়েছেন আমাকে মেরে ফেলতে। কাজ সম্পূর্ণ করতে পারেনি। তাই হয়তো আড়ালে লুকিয়ে অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করার চেষ্টা।’
‘রাতুলকে নজর রাখতে বলো রজত আলির ওপর। সব খবরা-খবর যেন দেয় তোমাকে।’
‘ওকে! আর ক’দিন থেকে যাও তোমরা।’
‘নাহ! আমাকে ইমিডিয়েটলি যেতে হবে। সভা শুরু হবে দু দিন পর। সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে।’
‘তোমরা রাজশাহী। আমি এখানে, যদি…’
বাকিটা বলার আগেই মাজিদ এহসান জায়ানের কাঁদে হাত রেখে থামিয়ে দেয়। তিনি বললেন,
‘ভয় পেলে জয় হাসিল হয় না জায়ান। তুমি জানো আমি মোটেও ভীতু নই। কিচ্ছু হবে না ইনশাআল্লাহ।’
জায়ান প্রতিত্তোরে নিবর থাকে। বাবার আশ্বাস পেয়েও মনটা শান্ত করতে পারছে না।
বেশ কিছুক্ষণ আলোচনার পর নিচে ফিরেন তারা। মনি তখন ঘুমিয়েগেছে। গায়ের কম্বল ঠিকঠাকমতো টেনে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ে।
সকাল সকাল রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় তারা। শীতের বেলা তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। তাই সকালেই রওয়ানা করেছেন। ফিরতে সন্ধ্যা হলেও, রাত তো আর হবে না এই ভেবে। যাওয়ার আগে মনিকে কোনোপ্রকার রাগারাগি যেন না করে বার বার বলে গেলেন আকলিমা বেগম তার ছেলেকে। জায়ান মায়ের কথা পালন করার সম্মতি তো জানিয়েছেন। পরে কি করবে জায়ানই ভালো জানেন।
.
.
.
#চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here