#আমি_তোমাতে_বিলীন
#পর্ব_১৮,১৯
#সুমাইয়া মনি
১৮
সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলের সাহায্যে গুলি ছুঁড়া হয়েছে। তাই কোনো প্রকার আওয়াজ কেউ শুনতে পায়নি। আর গুলি করা ব্যক্তি রেস্টুরেন্টে বসেই করেছে। মানুষের ছুটাছুটির ফলে সে-ও সুযোগ বুঝে সেখান থেকে পালিয়ে গেছে। ফুটেজে একজন লোকের মুখে মাস্ক ছিল। এবং তাকে পুলিশ খোঁজার চেষ্টা করছে। সারারাত জায়ান পুরো বনানীর এগলি ওগলি ঘুরেছে। হাসপাতালেও গিয়েছিল ছেলেটিকে দেখতে।
ছেলেটি এখন কিছুটা সুস্থ আছে। নিজ বাড়ির সামনেও কয়েক বার রাউন্ড দিয়েছে। তেমন কিছু নজরে আসেনি। আটটার দিকে জগিং করেই বাড়িতে ফিরে। সচারাচর সে জগিং করে না। আজ করেছে। যাতে তার ওপর সন্দেহের সৃষ্টি না পড়ে। রুমে এসে পায়ের মুজা খোলার পরপরই মনির আগমন ঘটে। রাতে জায়ানের টেনশন এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়েছে ঠিকিই। কিন্তু সাতটা নাগাদ আবার ঘুম পাতলা হয়ে আসে। অপেক্ষা করে জায়ানের জন্য। কাল রাতে জায়ান ইচ্ছে করেই ফোন সাইলেন্টে রেখেছিল। যাতে তাকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে না হয়। মনি জায়ানের পানে চেয়ে মৃদুস্বরে বলল,
‘রাতে কোথায় ছিলেন?’
জায়ান সোফা থেকে উঠে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘কাজ ছিল।’
মনি বাকি প্রশ্ন করতে পারে না। তার আগেই জায়ান বাথরুমেরর ভেতরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে ফেলে। মনি জায়ানের ফোন হাতে তুলে নেয়। লক করা দেখে হতাশ হয়। কারণ সে জানে না জায়ানের ফোনের লক।
ঝর্ণা ছেলে জায়ান চোখ বন্ধ করে ঘটনা গুলো পুনরাবৃত্তি ভাবছে। সে যেটা ধারণা করছে, সেটা সঠিক হলে হিসাব মিলে যাবে।
ডাইনিং টেবিলে বসে রয় মনি ও নাজমুল। জায়া এসে খেতে আরম্ভ করে। জায়ানের চোখেমুখে ক্লান্তি ছাপ দেখা যাচ্ছে। খাওয়ায় মনযোগ ছিল বিধায় মনির পানে সে তাকায় নি। কিন্তু মনি কয়েক বার তাকিয়েছে। তার কাছে জায়ানকে রহস্যময় লাগছে। জায়ান দ্রুত খাবার খেয়ে নাজমুলকে সঙ্গে নিয়ে বেরোয়। যাওয়ার সময়ও মনির সঙ্গে কথা বলেনি তেমন। এতে মনির মনঃক্ষুণ্ন হয় কিছুটা। কলেজে যেতেও নিষেধ করেছে আজ। সারাদিন ঘরে একা একা বোর হয়ে যাচ্ছে মনি।
দু দিন মনিকে ইগনোর করে চলেছে জায়ান। অবশ্য এটাকে ইগনোর বললে ভুল হবে। বিভিন্ন পরিকল্পনার মধ্যমে জায়ান মাহিদকে খুঁজছে। কিন্তু এমন কোনো ক্লু তাদের নজরে আসেনি। মনি জায়ানের ইগনোরে অসহ্য হয়ে উঠেছে। না ঠিক করে কথা বলছে, না কারণ বলছে। রাগ তার মধ্যেও সীমাবদ্ধ। বৃহস্পতিবারের এক সন্ধ্যায় জায়ান ও নাজমুল হল রুমে বসে কথা বলছিল। মনি তাদের অপর পাশের সোফায় বসে টিভি চালায়। সাউন্ড কমিয়ে টিভি দেখছিল সে। কিছুক্ষণ পর তাদের জন্য স্যুপ নিয়ে আসে সার্ভেন্ট। নাজমুল হাতের ফাইলগুলো রুমে রাখতে যায়। জায়ান উঠে বাহিরের দিকে আসে। সম্ভবত সে ফোনে কথা বলার জন্য গিয়েছে। মনি হাতের কাছেই সুযোগ পেয়ে যায়। রান্নাঘর থেকে মচিরের গুড়ো এনে দু’জনার স্যুপের বাটির মধ্যে দিয়ে দেয়। যেহেতু স্যুপটি লাল রঙের ছিল তাই ধরার কায়দা নেই যে তাতে মরিচ দেওয়া হয়েছে। এটা করার মূল কারণ জায়ানের মুখ থেকে কথা বের করা। যেটা দু, তিন আগে বন্ধ হয়ে গেছে কোনো কারণে। তারপর নিজের বাটি হাতে নিয়ে খেতে থাকে।
মিনিট কয়েক বাদে তারা ফিরে এসে স্যুপ পরিবেশন করেন।
এক দু চামিচ খাওয়ার পর পরই বুঝতে পারে স্যুপের মধ্যে ঝালের পরিমাণ একটুর তুলনায় অনেক বেশি। জায়ান চোখ রাঙিয়ে মনির পানে তাকায়। নাজমুল জায়ানের নজর অনুসরণ করে তাকানোর পর বুঝতে পারে ঝালের কারণ। কেননা প্রথমের তুলনায় এখন স্যুপের রং বেশিই লাল দেখাচ্ছে। জায়ান দাঁত কিড়মিড় করে জোরে ‘মনি’ বলে হাঁকায়। মনি লাফিয়ে উঠে। বাটিতে ধাক্কা লেগে কিছু স্যুপ হাতের উপর পড়ে। ভীতিকর চোখে জায়ানের দিকে তাকিয়েই বাটি রেখে উপরের দিক দৌঁড় লাগায়। নাজমুল ফিক করে হেসে দেয়। শব্দ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে নাজমুলের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই হাসি বন্ধ হয়ে যায় তার। চুপচাপ ঝাল স্যুপ খেতে আরম্ভ করে। ঠোঁট, জিব্বা জ্বলে যাচ্ছে ঝালে। তবুও জায়ানের ভয়তে কিছুই বলছে না।
জায়ান নাজমুলের হাত থেকে বাটিটা ছোঁ মেরে নিয়ে টেবিলের ওপর রেখে চেঁচিয়ে বলল,
‘আর খেতে হবে না।’
নাজমুল পানি খেয়ে আস্তেধীরে রুমের দিকে এগোয়। জায়ান স্মিত হাসে। মনি ও নাজমুল দু’জনই তাকে ভয় পায়, সম্মান করে যেটা ভেবে তার ভালো লাগে। তখন অবশ্য সে নিজেও জানত না মনি স্যুপের সঙ্গে মরিচের গুঁড়ো মিলিয়েছে। মনির দৌঁড় দেওয়ার ফলে এটাই প্রমাণিত হয় এটা মনিরই কাণ্ড। জায়ান মনির বাটির স্যুপটুকু খেয়ে নেয়।
সেটা মনি ওপর থেকে সরু চোখে দেখছিল। তার কাছে বিষয়টি ভালো লাগে।
__
পরেরদিন জায়ান ও নাজমুলকে সভার জন্য রাজশাহী যেতে হয়। মনিকে লালবাগ রেখে যেতে চেয়েছিল জায়ান। কিন্তু মোফাজ্জল হোসেন তার পরিবারকে নিয়ে বিক্রমপুরে গিয়েছে কাল। ফিরবে পরশু। তাই মনি বাড়িতেই থাকে। জায়ান ওর বান্ধবীদের বাড়িতে একদিনের জন্য আসতে বলে। সঙ্গে নিলমকেও। জায়ানের ফিরতে দু দিন লাগবে। তাই বাহিরে আরো দু তিনজন লোক রেখে যায়। নিলম আছে দেখে এতও চিন্তিত হয় না জায়ান। তবুও তার মনে ক্ষুদ্র ভয় মনিকে নিয়ে। বন্ধুদের পেয়ে ঈদের দিনের মতো খুশি হয়ে যায় মনি।
নিলম ওদের সবার পরে বাড়িতে আসে। এখন সবাই হলরুমে বসে আছে। নিলম মাথার দু পাশে হাত রেখে মনির উদ্দেশ্য করে বলল,
‘মনি মাথাটা একটি টিপে দে ব্যথা করছে।’
মনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেও পরক্ষণেই নিলমের পাশে বসে মাথা টিপতে আরম্ভ করে। নিলম চোখ বন্ধ করে রাখে। মনি কখনোই সহজভাবে কোনো কাজ করতে রাজি হয়নি। আজ হঠাৎ এক কথায় কাজ হয়েছে দেখে চোখ বন্ধ রেখে বলল,
‘কি ব্যাপার মনা, আজ এক কথায় কাজ হলো কীভাবে?’
‘শুধু শুধু না, রাতে আমাদের নিয়ে আইসক্রিম খাওয়াতে যাবি।’
‘যাব!’ মনি চট করে হাত সরিয়ে অবাক হয়ে তাকায় নিলমের দিকে। তমা, তারানা, মিনা তাদের নজরও কিছুটা বিস্মিত!
নিলম নিজেও কখনো এক কথায় রাজি হয়নি। আজ ওঁকেও রাজি হতে দেখে তারাও অবাক। মনি টেরা চোখে তাকিয়ে বলল,
‘সত্যি?’
‘একদম!’
মনি খুশি হয়ে নিলমের দু গাল জোরে টেনে দেয়। নিলম মনির হাত ধরে বলে,
‘তোর হাসবেন্ড বাহিরে লোক রেখে গেছে। কীভাবে যাবি সেটা আগে ভাব।’
‘চুরি করে যাব না। তোকে যখন আমাদের দায়িত্ব দিয়ে গেছে তখন তুই ব্যবস্থা করবি সব।’
‘কীভাবে?’ নিলম বলল।
মনি ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘তুই জানিস সেটা।’
‘বুঝছি, কি করতে হবে।’
‘কী করবি?’
‘যাওয়ার সময় দেখবি।’
রাজশাহী পৌঁছে জায়ান মনিকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দেয়। তখন রাত নয়টা বাজে। এগারোটার দিকে তমা সব গার্ড ও দারোয়ানদের ভেতরে ডাকে। সবাইকে নিলম নিজের হাতে চা বানিয়ে খাওয়ায়। রাত জাগতে হবে দেখে সবাই খুশিমতো চা খায় ঠিকিই, কিন্তু একেক জনে চা খেয়ে চিৎ-কাত হয়ে ঢলে পড়ে সোফাতেই। ওপর থেকে তারা এই দৃশ্য দেখে বুঝতে পারে চায়ে কিছু মিশিয়েছে নিলম। নিচে নেমে জিজ্ঞেস করতেই একটি ঘুমের লিকুইড মেডিসিন বের করে দেখায়। সবাইকে গাড়িতে উঠে বসতে বলে নিলম। নিলম সদর দরজা লাগিয়ে বাহিরে গাড়ি নিয়ে বের হতেই আয়না দ্বারা সিসি ক্যামেরার দিকে তাকায়। কারণ সেটা বন্ধ করে দিয়েছে নিলম। গাড়ি দ্রুত গতিতে চালায়। এক টানে একটি বড়ো দোকানের সামনে এসে গাড়ি থামায়। ওদের গাড়িতে বসিয়ে নিলম দু বক্স আইসক্রিম নিয়ে আসে। তারপর আবার গাড়ি ছুটিয়ে একটি ফাঁকা ব্রীজের ওপর এসে থামল। সবাইকে নামিয়ে গাড়ির ওপর উঠে বসতে বলে। এক বক্স মনির হাতে দিয়ে আরেকটি তিন বান্ধবীদের দিকে এগিয়ে দেয় নিলম।
‘কতবড় শয়তান দেখ নিলমইম্মা!’ তমা চেঁচিয়ে বলল।
‘আসলেই কু*ত্তা। এক বক্স ওরে দিলি কেন?’ তারানা বলল।
‘চুপ! ও খেতে চেয়েছে আইসক্রিম। মন ভরে খা!’ নিলম ধকমিয়ে বলল।
‘শুধু মনির বিয়ে হয়েছে দেখে চুপ আছি হুহ্!’ মিনা বলল।
‘গুড! এবার গিল।’
মনি হাসে। দু হাতে দুটি আইসক্রিম নিয়ে খাচ্ছে। ব্রীজের ওপরের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সকলের চেহারা হলদেটে দেখাচ্ছে। গাড়ি চলাচল তেমন একটা নেই। তাই ধুলোবালি উড়ার সম্ভাবনা খুব কম। সবাই মনোযোগ সহকারে খাচ্ছে।
নিলম মনির দিকে তাকিয়ে আছে। কতটা শান্তি লাগছে মনে সেটা কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না সে। প্রিয় মানুষটির সঙ্গে থাকলে দুনিয়ার সব দুঃখ যেন এক মুহূর্তে কোথাও হারিয়ে যায়। লাস্ট পর্যায়ে মনি একটি কোণ আইসক্রিম নিয়ে রাস্তার ওপর পাশের দিকে হাঁটে। তমাকে কাছে ডেকে ফোন বের করে কয়েকটি ছবি তুলতে বলে। নিলমের ফোনে সেই সময় কল আসে। তাই ওদের থেকে একটু দূরে সরে যায়।
এক সঙ্গে চার বান্ধবী মিলে ছবি তুলছে। সে কি পোজ!
মনি ভিডিও করার সুবাদে ওদের থেকে অনেকটা দূরে এগিয়ে যায়। আকাশে ছিল পূর্নাঙ্গ চাঁদ। রাস্তার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে চাঁদকে অনুসরণ করে ভিডিও শুরু করে।
ভিডিওয়ের শেষ পযার্য় হঠাৎ পিছন থেকে একটি দ্রুতগামী ট্রাককে ছুঁটে আসতে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় মনি।
নিলম দূর থেকে আগেই লক্ষ্য করে ফোন পকেটে রেখে ছুঁটতে আরম্ভ করে। ট্রাক কাছে আসার আগেই নিলম মনির বাহুতে হাত রেখে পাশে সরিয়ে নেয়।
ততক্ষণে ওর বান্ধবীরা বিষয়টি লক্ষ্য করেছে। ওদের নিকট ছুটে আসে। নিলম ট্রাকের যাওয়ার দিকে তাকাতেই মাস্ক পরিধান একজন লোকের সঙ্গে চোখাচোখি হয়।
সে দ্রুত নজর সরিয়ে নেয়। নিলমের বুঝতে অসুবিধা হয় না এটা পরিকল্পিত ঘটনা। নজর সরিয়ে মনির দু বাহুতে হাত রেখে চিল্লিয়ে বলল,
‘ভিডিও করার এত শখ কেন তোর? ট্রাকে চাপা পড়লে এখন কোথায় থাকতি জানিস?’
নিলমের ক্রোধাগ্নি কথা মনির কানে কর্নপাত হতেই ঈষৎ কেঁপে উঠল। এই প্রথম এতটা রাগতে দেখলো নিলমকে সবাই। বাকি’রাও কথা বলার সাহস করছে না।
পুনোরায় ধমক দিয়ে বলল,
‘গাড়িতে গিয়ে বোস।’
তমা মনিকে টেনে গাড়ির দিকে অগ্রসর হয়। পিছনে পিছনে তারানা ও মিনা হেঁটে চলে। নিলম উল্টোদিকে ফিরে হাত মুঠোবন্দী করে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
মনি নিলমকে দূর থেকে লক্ষ্য করছে, সঙ্গে ওর বান্ধবীরাও। মিনিট কয়েক বাদে নিলম গাড়িতে উঠে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে স্ট্রার্ট তুলে। দ্রুতবেগে গাড়ি ছুঁটায়।
মনি পাশে বসেই নিলমকে দেখছে। নিলম একবারের জন্যও মনির দিকে তাকাচ্ছে না। বেশ রাগ নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে সে। বাড়ির সামনে এসে থামে। ওরা নেমে যায়। মনি নামার পরও নিলমের পানে তাকিয়েছিল। কিন্তু নিলমের ক্রোধান্বিত নজর সামনের দিকে নিবদ্ধ।
মনি জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। মিনমিন কণ্ঠে বলে,
‘স্যরি নিলম।’
বলতে দেরি নিলমের গাড়ি চলাতে দেরি হয় না। উত্তর না দিয়েই চলে যায় সে। কোথায় গিয়েছে জানে না। নিলমের গাড়ির পানে মলিন মুখে তাকিয়ে থাকে মনি।
ঘন্টাখানিক পর…
কম্বল গা থেকে সরিয়ে টি-শার্টের কলার ধরে বিছানা থেকে মাহিদকে টেনে নামায় নিলম। ক্রোধ কণ্ঠে বলে,
‘তোকে বলেছিলাম না, মনির যাতে কোনো ক্ষতি না হয়। তবে কেন ট্রাকেচালকে পাঠালি?’
মাহিদ কিছু অবাক হয়। সে ট্রাক ভাড়া করেছিল ঠিকিই। কিন্তু সেটা জায়ানের জন্য মনির জন্য না। আগে থেকে মনির ক্ষতি করার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছেন তিনি, শুধু মাত্র নিলমের জন্য। নয়তো মনির ক্ষতি সে অনেক আগেই করত। কিন্তু এখন নিলমের মুখে এরূপ কথা শুনে সে বিস্মিত! নিলমের হাত থেকে কলার ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘পাগলের মতো কথা বলিস না অপুন। আমি তোকে কথা দিয়েছি মনির কোনো ক্ষতি করব না। তবে কেন আমি ট্রাকচালকে পাঠাব।’
‘মিথ্যে বলিস না মাহিদ!’
মাহিদ নিলমের বাহুতে হাত রেখে শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘আমি সত্যি বলছি অপুন। বিশ্বাস কর আমায়। আমি তাকে পাঠায় নি। এটা অন্যকারো কাজ হবে হয়তো।’ জোর গলায় বলল মাহিদ।
নিলম চুপ করে রয় কিছুক্ষণ। পরক্ষণেই বলে,
‘কার কাজ হবে?’
‘কীভাবে বলব? তুই যদি আমাকে এখনো সন্দেহ করিস তো আমি যাকে ঠিক করেছি তার সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারিস।’
‘নাম্বার দে!’
__
‘স্যার, মনিকে নিলম বাঁচিয়ে নিয়েছে।’ নাজমুল কান থেকে ফোন সরিয়ে জায়ানের উদ্দেশ্যে কথাটা বলল।
জায়ান ঘাড় হলকা কাত করে বলল,
‘তারা এখন কোথায়?’
‘অজয় বলল বাড়িতে চলে গেছে তারা। কিন্তু নিলম বাড়িতে যায় নি। ওর বাড়িতে গেছে।’
জায়ান এবার সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় নাজমুলের দিকে।
দু কদম পায়চারি বলে বলল,
‘নিশ্চয়! কারণ আছে বাড়িতে আসার। নজর রাখতে বলো ওর বাড়ির ওপর।’
‘জি বলছি।’
জায়ান জানালার দিকে পুনরাবৃত্তিতে তাকায়। জ্যাকেটের পকেটে এক হাত পুরে নিলেন। জায়ান বাড়িতে এক্সট্রা বডিগার্ড রেখে গিয়েছিল। তারা বাড়ির বাহিরে সবার অগোচরে পাহারা দিচ্ছে। তাই খুব সহজেই তাদের বাহিরের যাওয়ার ব্যাপারটি জানতে পারে সে। সাথে নিলমের সিসি ক্যামেরা বন্ধের ব্যাপারটিও জেনে যায়।
.
.
.
#চলবে?
#আমি_তোমাতে_বিলীন
#পর্ব_১৯
#সুমাইয়া_মনি
নিলম অনেক রাত করে মনিদের বাড়িতে আসে। তখনো গার্ডদের ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পায়। তাদের অপর পাশের সোফায় গা এলিয়ে দেয়। মাথা বিক্ষিপ্তভাবে যন্ত্রণা করছে। আর এই যন্ত্রণার মূল উৎস মনি। কিছুতেই ভুলতে পারছে না সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি। যেটা ঘটতে ঘটতেও রক্ষা পেল।
মাহিদের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে কল দিয়ে জানতে পারে তারা ট্রাক নিয়ে বের হয়নি। মাহিদের ওপর তার বিশ্বাস আসে। সেই বিশ্বাস অনুযায়ী তার দ্বারনা এটা অন্যকারো কাজ। কে বা কার? সেটা তাদের অজানা। এমন কিছু তাদের চোখের অগোচরে হচ্ছে সেটা তারা দেখতে পাচ্ছে না। জায়ানকে গুলি করার কথা সে জানে। এটা মাহিদেরই কাজ ছিল। একটুর জন্য মিস হয়েছে। নয়তো আজ জায়ান পরপারের বাসিন্দা হতো। মাহিদ ও নিলম ছোট বেলার বন্ধ।
নানাবাড়ির পাশেই তাদের বাড়ি ছিল। প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত তারা এক সঙ্গে পড়াশোনা করেছে। তারপর নিলমকে ওর মা-বাবা ঢাকায় নিয়ে এসে ভর্তি করিয়ে দেয়। এতে তাদের বন্ধুত্ব ছিন্ন হয়না। বরঞ্চ যখন যখন নানাবাড়ি বেড়াতে যায় সারাক্ষণ নিলম মাহিদের সঙ্গেই সময় অতিবাহিত করত। অপু বিন নিলম ছিল ওর পুরো না। মাহিদ দুটো নাম যুক্ত করে অপুন বলে ডাকে। এতে নিলমের কোনো আপত্তি ছিল না। তাদের এত বছরের বন্ধুত্ব কিছুক্ষণ আগেই ভুলবোঝাবুঝি জন্য নষ্ট হতে হয়ে যেত। নিলম মাথা ঠান্ডা রেখেছে। তাদের বিরুদ্ধে কেউ গোপনে চক্রান্ত চালাচ্ছে। এটা শিওর সে।
‘নিলম!’ মনির ডাক শুনে নিলম মাথা কাত করে তাকায়। পরক্ষণে সরিয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘এখনো ঘুমাস নি কেন?’
নিলমের কথার জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে মনি,
‘কোথায় গিয়েছিলি?’
নিলমের এতে কিঞ্চিৎ রাগ হয়। সে চুপ থাকে। মনি বুঝতে পেরে মৃদুস্বরে বলল,
‘তুই না বলে চলে গিয়েছিলি এই টেনশনে…’
‘ঘুমাতে পারিস নি?’ বাকিটা নিলম বলে।
‘হুম।’ ছোট করে জবাব দেয় মনি।
নিলম মনির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ওর হাত ধরে নাজমুলের পাশের গেস্টরুমে নিয়ে আসে। মনি অবাক হয়। কিন্তু কিছু বলে না। নিলম বিছানায় শুয়ে পাশে মনিকে বসিয়ে বলে,
‘এতই যখন আমাকে নিয়ে তোর টেনশন হচ্ছিলো। এখন মাথা টিপে দে আমি ঘুমাব।’
মনি সরস চোখে তাকিয়ে নিলমের মাথা টিপে দিতে থাকে। মনির নরম হাতের ছোঁয়া পেয়ে নিলম এখন অনেকটা স্বস্তি পাচ্ছে। নিলম চোখ বন্ধ রেখে বলল,
‘আমি ঘুমালে পরে চলে যাস।’
‘বলতে হবে না। তুই ঘুমা তাড়াতাড়ি।’ মেকি রাগ নিয়ে বলল।
নিলমের ভালো লাগে কথাটি শুনে। কিছুক্ষণ বাদেই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। মনি আধাঘন্টা পর ঘুম থেকে বেরিয়ে আসে। রুমে এসে সে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে তমা সবার জন্য কফি নিয়ে ড্রইংরুমে হাজির হয়।
নিলম তখনো ঘুমাচ্ছিল। কফির মগ এগিয়ে দিয়ে তমা বসতে বসতে বলল,
‘কাল রাতে তুই নিলমের রুম থেকে বের হয়েছিলি মনি।’
‘হ্যাঁ!’ স্বাভাবিক ভাবে বলল মনি।
‘কী করছিলি ওর রুমে?’ তারানা প্রশ্নটা করেও বিব্রত বোধ করছে।
মনি সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
‘তোর প্রশ্নটা কঠিন মনে হলো। জানিস তুই আমরা জাস্ট ফ্রেন্ড। তাহলে এমন প্রশ্ন করা বেমানান তারানা।’
‘জানি। তবুও জিজ্ঞেস করলাম।’
‘ওর মাথা ব্যথা করছিল। তাই আমাকে নিয়ে পাশে বসিয়ে মাথা টিপিয়েছে।’
‘ওহ!’ উচ্চারণ করে তারানা মগে চুমুক দিল।
‘তোরা কি আমাদের সন্দেহ করছিস? মানে আমরা অবৈধ সম্পর্কে… ‘
‘ফালতু কথা বলিস কেন? এটা আমরা কখনোই ভাবী না।’ তমা বলল।
‘তবে কেন বললি?’
‘জিজ্ঞেস করতে পারি না?’
‘আর এমনেতেও। তোর বিয়ের পর নিলম কেমন পাল্টে গেছে। তোর ওপর এক্সট্রা যত্ন ওর বেড়ে গেছে। বিষয়টি খেয়াল করেছিস তুই?’ তমা বলল।
মনির মুখশ্রী স্তম্ভিত হয়ে আসে। বলে,
‘মানে? কি বোঝাতে চাইছিস তোরা?’
‘নিলম তোকে ভালোবাসে এমন কিছু।’ মিনা বলল।
‘চুপ! এটা একদম ফালতু কথা। ওর তো নিজেরই গার্লফ্রেন্ড ছিল। তবে ও আমাকে কেন ভালোবাসতে যাবে।’
‘তবে এত কেয়ার করার কারণ কি?’ তমা বলল।
‘আমরা সবাই ফ্রেন্ড, শুধু ফ্রেন্ড নই বেস্ট ফ্রেন্ড। একে অপরের যত্ন নিবো এটাই স্বাভাবিক।’
মনির কথা শুনেও ওদের মধ্যে সন্দেহটা রয়েই যায়। আরো কিছুক্ষণ এই বিষয় নিয়ে আলোচনা হবার পর নিলম ওদের নিকট আসে। ও আসার আগেই সবাই থেমে যায়। এ টপিক এখানেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে নাস্তা করে সকলে।মনি বার বার নিলমকে দেখছে। ওর তিন বান্ধবীর কথা অন্যমনস্ক হয়ে ভেবে চলেছে।
.
কাল রাত থেকে জায়ানকে রহস্যময় লাগছে নাজমুলের কাছে। অবশ্য লাগার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। সব চেয়ে মূল কারণ হলো ট্রাক ভাড়া করে মনিকে খুন করার পরিকল্পনা করা। প্রথমে শুনে সে নিজেও হতভম্ব হয়েছে। কিন্তু সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারেনি জায়ানকে। সারারাত ভেবেছে। সকাল হলে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছে না। রাজশাহীতে আসার এমন কোনো কাজ নেই। যাতে করে এমারজেন্সি আসতে হলো তাদের। তবুও মনিকে মিথ্যা বলে এসেছে। এটাও নাজমুলের মনে সন্দেহর দাগ কাটছে।
নিজের বাড়িতে এসেছে সকালে। বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে বারোটার দিকে নাজমুল জায়ানের বাড়িতে আসে। রুমে এসে জায়ানকে ল্যাপটপ ঘাঁটতে দেখে। জায়ান না তাকিয়ে ভেতরে আসতে বলে তাকে। নাজমুল ভেতরে এসে সোফায় বসার পর জায়ান ল্যাপটপ বন্ধ করে কফির মগ হাতে উঠিয়ে চুমুক দেয়। তারপর নাজমুলের দিকে তাকিয়ে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘আই নো, আমাকে নিয়ে তোমার মনে প্রশ্নের বীজ রোপণ হয়েছে।’
মনের কথা বুঝতে পেরেছে দেখে নাজমুল বিব্রতবোধ করে কিছুটা। অনিচ্ছুক হাসি প্রদান করার কারণে জায়ান মুচকি হেসে বলল,
‘মনি জায়ানের জান। তাকে মারার কথা তো দূর, তিল পরিমাণ ফুলের টোকা দেওয়ার কথাও আমি ভাবী না।’
‘তবে কাল..’ বলতে বলতে থেমে যায় নাজমুল।
জায়ান কফির মগ রেখে নড়েচড়ে বসে বলে,
‘আমার সন্দেহ হচ্ছিল নিলমের মনে মনির প্রতি ফিলিংস বা ভালোবাসে রয়েছে কি-না। সেটা প্রমাণ করার জন্যই এটা করতে হয়েছে। রাতুলের কাছে জানতে পেরেছি অপুন মাহিদের বন্ধু।’
অপুন নামটি শুনে নাজমুল কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
‘অপুন কে?’
‘নিলম। পুরো না অপু বিন নিলম। মাহিদ ওঁকে অপুন করে ডাকে।’
‘তবে কি মাহিদ অপুন মানে নিলমের বাড়িতে আছে?’
‘সেটা তুমি বের করবে।’
‘কীভাবে?’
জায়ান কফির মগ তুলে পুনোরায় চুমুক বসায়। নাজমুল জায়ানের জবাবের আশায় তাদিকে আছে মুখের পানে।
__
আজ বাড়ি থেকে আর কেউ বের হয়নি। কালকের গার্ডদের নিলম সব ঘটনা খুলে বলে। তাদের এটাও বলতে নিষেধ করে বিষয়টি যেন জায়ানের কাছে না বলা হয়। সে শুধু তাদের বন্ধুদের খাতিরে এটা করেছে৷ গার্ডরাও ব্যাপারটা চেপে রাখতে চায়। শুনে নিলম তাদের ওপর খুশি হয়। সিসি ক্যামেরাও চালু করে দেয়। তবে সে এটা জানে না জায়ানের পুরো ঘটনাটিই জানা।
মনি ওর বান্ধবীদের বলা কথা গুলো পুনরাবৃত্তিতে ভাবছে। হতে পারে নিলম ওঁকে ভালোবাসে বা পছন্দ করে। তবে ওর যে গার্লফ্রেন্ড ছিল, সেটা কি মিথ্যা ছিল? প্রশ্নটা মনির মনে ঘোরাঘুরি করার পূর্বেই নিলমের নিকট আসে। রুমেই ওঁকে পেয়ে যায় একা। মনিকে দেখে ফোন রেখে দেয় পাশে। মনি এগিয়ে এসে তড়িঘড়ি জিজ্ঞেস করল,
‘তোর গার্লফ্রেন্ড মনিকার সঙ্গে কি তোর ব্রেকআপ হয়েছে?’
হঠাৎ এরূপ প্রশ্ন শুনে নিলম হকচকিয়ে উঠে। তবে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে মৃদু হেসে বলল,
‘তার বিয়ে হয়ে গেছে।’
‘কবে?’
‘হলো এক সপ্তাহ!’
‘আগে বলিস নি কেন?’
‘গার্লফ্রেন্ড আমার ছিল। তোকে বলে কি হবে?’
‘তো এই জন্যই এ ক’দিন দেবদাস হয়ে ঘুরেছিলি।’
‘হপ!’
‘তমা, তারানা, মিনা কই তোরা এখানে আয়।’ ওদের নাম ধরে চিল্লিয়ে ডাকতে লাগল মনি।
‘চুপ কর। ওদের ডাকছিস কেন।’ কাঠিন্যে কণ্ঠে বলল নিলম।
‘আরে কই তোরা।’
‘হলো কি?’ তমা রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল।
‘নিলম ছ্যাঁকা খেয়েছে জানিস?’
‘কে দিলো?’ তারানা জিজ্ঞেস করল।
‘মনিকা।’
‘মনিকা।’ বলে মিনা ভ্রু কুঁচকে ফেলে।
‘হ্যাঁ! এই জন্যই দোস্ত আমার স্যাড মুডে থাকত।’
‘সত্যি নাকি নিলম?’ মিনা বলল।
‘ওর বিয়েছে হয়েছে মানছি। তাতে আমি ছ্যাঁকা খাব কেন বলতো। ও আমার জীবনে ছিল, আছে, সব সময়ই থাকবে।’ কথাটা আড়চোখে মনির দিকে তাকিয়ে বলল। কিন্তু সেটা ওদের বুঝতে দেয় না।
‘হাইরে ভালোবাসা।’ তমা সুর তুলে বলল।
‘দেখ! কিছু ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশ করা যায় না। বোঝানো যায় না তার গভীরতা কতখানি।’ নিলম নরম স্বরে বলল।
‘হাহ! এসব আমাদের মাথায় ঢুকবে না।’ হাত বগলদাবা করে বলল তমা।
‘তা ঢুকবে কেন? তোদের মাথায় তো জিলাপির প্যাঁচ রয়েছে।’ রাশভারী কণ্ঠে বলল নিলম।
‘সর!’ তারানা খেঁকিয়ে বলল।
মনি চুপ করে আছে। নিলম মাথায় গুঁতো দিয়ে বলে,
‘তুইও বল!’
‘সর হেন্তে!’ বলে রুম থেকে বের হয়। জায়ানকে কল দেয়।
এক বার রিংটোন বাজতেই ফোন পীক করে।
‘বলো জানেমান।’
‘উফফ!’ আস্তেধীরে বলে বুকে হাত রাখল মনি। জানেমান বাক্যটি জায়ানের মুখে শুনতে মনির বেশ লাগে। বেশিক্ষণ নিরব থাকে না। বলে,
‘কি করছেন?’
‘কাজ, তুমি?’
‘কিছু না।’
‘ভুল বললে।’
‘কি ভুল বললাম?’
‘তুমি এখন আমার সঙ্গে কথা বলছো।’
‘তো?’
‘মিস করছো আমায়?’
‘বলেছি এটা?’
‘তাহলে কল কেন দিয়েছো?’
‘আম্মুকে ফোনে পাইনি তাই আপনাকে কল দিয়েছে জানার জন্য।’
‘মিথ্যা কীভাবে বলতে হয়, সেটাও শিখো নি।’
‘বেশি বুঝবেন না।’ মেকি রাগ নিয়ে জোরে বলল।
‘কী?’
‘কিছু না।’ বলে ফোন রেখে দেয় মনি৷ ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। অপরপ্রান্তে জায়ান মনির সুপ্ত অনুভূতি বুঝতে পারে। মৃদু হাসি তার ঠোঁটেও দেখা যায়।
.
.
.
.
#চলবে?