#আমি_তোমাতে_বিলীন
#পর্ব_২০,২১
#সুমাইয়া মনি
২০
কারেন্ট বিলের লোকেদের বেশভূষা নিয়ে নাজমুল নিলমদের বাড়িতে এসেছে। রাতেই রাজশাহী থেকে ঢাকায় ফিরেছে। জায়ান রাজশাহীতেই আছে। কালো মোটা চশমা, কালো পোশাক ও মাথায় ক্যাপ। নিলমের মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় বার বার আড়চোখে ভেতরের দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় নি সে। শেষে পানি খাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি পানি আনতে গেলে ভালো করে চারদিক লক্ষ্য করে। তখনই মাহিদকে রুম থেকে বেরিয়ে অন্যরুমে প্রবেশ করতে দেখতে পায়। নাজমুলের ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ফু্ঁটে। তাদের ধারণা একদম সঠিক হয়েছে। পানি খাওয়ার পর তাকে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে নাজমুল প্রস্থান করে। গলিপথ থেকে হেঁটে বের হবার সময় নিলমের সঙ্গে তার ধাক্কা লাগে। নাজমুল নিলমকে চিনতে পেরে নিজে থেকে ‘স্যরি’ বলে মুখ লুকিয়ে চলে যায়। নিলম বিষয়টি এত পাত্তা না দিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। গাড়ি গ্যারেজে দিয়েছে। তাই গলির মধ্যখানে রিকশা থেকে নেমে হেঁটে বাড়িতে আসতে হয়েছে তাকে। অবশ্য রিকশা এতদূর আসে, কিন্তু সে ইচ্ছে করেই মাঝপথে নেমেছে।
‘স্যার, মাহিদ নিলমের বাড়িতে।’
জায়ান বাঁকা হাসে। বলে,
‘ছেড়ে দেও তাদের। দেখি কি করে তারা!’
‘ওকে।’
ফোন পাশে রেখে জায়ান আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ায়। ঠোঁটে তার বাঁকা হাসি এখনো লেগে রয়েছে। তার মাথায় বড়সড় এক পরিকল্পনা চলছে। আর এই পরিকল্পনা তাদের দিয়েই ইতি ঘটাবেন।
__
‘নিলম কখন আসবে রে?’ মনি তমাকে জিজ্ঞেস করল।
‘কেন? ওর জন্য মন ছটফট করছে?’ বুকে হাত রেখে অভিনয় করে বলল।
মনিও কম কিসে। নিজেও অভিনয় করে বলে,
‘হ্যাঁ! আমি মরে যাচ্ছি ওর জন্য।’
তারানা, মিনা ওদের দিকে বিরক্ত নিয়ে তাকায়। তমা মুখ বাকিয়ে বলল,
‘জায়ানের কথা তো একবারও বলিস না।’
‘হপ! আমাকে আর নিলমকে নিয়ে সন্দেহ করা বন্ধ কর। আর জায়ান মনির জান। মনে করা না করার মধ্যে কিচ্ছু আসে যায় না।’ বলে অন্যদিকে ফিরে জিহ্বায় কামড় বসাল। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে কথাটা। বান্ধবীদের দিকে ফিরতেও লজ্জা বোধ করছে। ততক্ষণে ওরা তিনজন অবাক হয়ে ‘ও’ সাউন্ড উচ্চারণ করে হেসে দেয়। মনি ফিরে তাকিয়ে বলল,
‘ঢং!’
‘সেটা তো তুই দেখাচ্ছিস।’ আঙুল তুলে বলল তারানা।
‘সর তোরা।’ বলে ফোন নিয়ে উঠে যায় রান্নাঘরের দিকে। আজ কি রান্না হচ্ছে সেটা দেখার জন্য। এ দু দিন ওদের কলেজে যেতে নিষেধ করেছে জায়ান। তাই তারাও কলেজে যাচ্ছে না। একটার দিকে নিলম পিজ্জা নিয়ে বাড়ি ফিরে। মনির হাতে ধরিয়ে দিয়ে গোসল করতে চলে যায়।
পিজ্জা আনার কারণটি বুঝতে পারছে না মনি। পাত্তা না দিয়ে খেতে আরম্ভ করে।
সন্ধ্যার দিকে তারা এক সঙ্গে গল্পগুজব করছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে তমা কোনোকিছু না বলে রুমের দিকে অগ্রসর হয়। মনির কাছে বিষয়টি সন্দেহজনক লাগে। কেননা সে এতক্ষণ বার বার ফোন চেক করছিল। হঠাৎ করে উঠে যাওয়ায় সন্দেহটা আরো তীব্রতা পায়। পিছু পিছু রুমের দিকে এগোয়। কান পারতেই কারো সঙ্গে তমার ফোনালাপ শুনতে পায়। অপরপ্রান্তে কোনো ছেলে রয়েছে সেটা মনি তমার কথার ধরন দেখে বুঝতে পারে। সে আস্তেধীরে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে। উল্টোদিকে ফিরে তাকানো দেখে মনিকে তমা দেখতে পায় না। একদম কাছে এসে কান ফোনের পিছনে দিয়ে ছেলেটির ভয়েস শোনার চেষ্টা করে। শুনেও ফেলে। মনির চোখ চড়কগাছ। এক প্রকার বিস্ময় নিয়ে চিল্লিয়ে বলল,
‘এটা তো মুলা ভাইয়ার কণ্ঠ!’
তমা ফোন কেটে তড়াক করে দাঁড়িয়ে যায়। রেগেমেগে বলল,
‘তুই কান পেতে শুনছিলি কথা।’
তমার কথায় পাত্তা না দিয়ে মনি ছোঁ মেরে ফোনটি নিয়ে নেয়। নাম্বার দেখে চিনে ফেলে এবং সেখানে নামও লিখা ছিল ‘নাজমুল পাখিটা’।
তমা মনির কাছ থেকে ফোন কেঁড়ে নিতে আসতে নিলে মনি বাহিরে আসে। হেসে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলল,
‘তমার নতুন পাখি হয়েছে, পাখি।’
‘পাখি?’ তারানা ভ্রু বাঁকিয়ে বলল
‘হ্যাঁ! নাজমুল পাখি।’ বলে খিলখিল করে হাসতে লাগল মনি।
নিলম সহ তারানা, মিনা তমার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়। তমা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। তাদের নতুন সম্পর্কের এক সপ্তাহ হয়ে এলো। এখনো পর্যন্ত তাদের জানানো হয় নি। তমা জানাতে চেয়েছিল। কিন্তু নাজমুল বিষয়টি চাপিয়ে রাখতে বলেছে। আর সেই কারণটি নাজমুলই ভালো জানে।
‘কিরে? কবে থেকে চলছে এসব তমা?’ নিলম জিজ্ঞেস করল।
‘এক সপ্তাহ।’ মৃদুস্বরে বলল তমা।
‘আমাদের বলিস নি কেন?’ মিনা তমার বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলল।
‘সে বলতে নিষেধ করেছে।’
‘কারণ?’ মনি জিজ্ঞেস করল।
‘জানি না।’
‘আচ্ছা! আমিই মুলা ভাইয়ার কাছ থেকে জেনে নিবো।’
‘এই না, তাকে বলিস না যে তোরা জানিস।’
‘কেন?’
‘হয়তো সে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল সবাইকে।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। পরক্ষণেই মনি বলল,
‘আচ্ছা ঠিক আছে বলব না কাউকে।’
‘থ্যাংকস! এখন ফোন দে।’ বলে মনির দিকে এগিয়ে গেলে মনি সরে আসে। তমা কিছুটা রেগে ফোন কেঁড়ে নিয়ে ধাক্কা দেয়। মনি ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে। সোফা গিয়ে নিলমের বুকের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে। নিলম সোফায় চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল। মনিকে পড়তে দেখে সেভাবেই শুয়ে থাকে। যেন সে এমটাই চেয়েছিল মন থেকে। মনি কপাল হাত বুলাতে বুলাতে নিলমের দিকে ক্ষুব্ধ চোখ তাকায়। নিলম মনিকে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে হেসে দেয়। এদিয়ে মিনা, তারানা, তমা রীতিমতো হাসতে আরম্ভ করেছে। তারা বিয়ষটি স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে। মনি ওঠে দাঁড়িয়ে নিলমের বুক্ষে চিমটি দিয়ে বলল,
‘ইট নাকি পাথর এটা, এত শক্ত। আমার কপাল!’
‘একটা ধরে নে মনা!’ নিলম হেসে বলল।
‘চুপ! হাসবি না। আর চুন্নির বাচ্চা এত জোরে ধাক্কা দিলি কেন?’
‘কে জানত তুই ওর ওপরে পড়ে যাবি।’ হেসে হেসে বলল তমা।
‘কথা বলবি না সর!’ বলে ধাক্কা দিয়ে ওপরে আসে মনি। বিছানার ওপর বসে বুকে আলতো হাত রাখে। নিলমের ওপর যখন পড়ে গিয়েছিল তখন জায়ানের কথা খুব মনে পড়েছে।
এক প্রকার নিলমকে জায়ান ভেবে নিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি বুঝতে না দিয়ে সেখান থেকে সরে আসে। ইদানীং ধরে জায়ানের ভূত মাথায় চড়ে নাচছে। যা কিছুতেই থামতে চাইছে না। এমনটা হবার কারণ তার নিজেরও জানা নেই।
__
‘স্যার, আপনি কি সত্যি সেখানে থাকতে চান?’
‘হ্যাঁ!’ জায়ান গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল।
‘একা, কীভাবে…. ‘
‘সব ব্যবস্থা করা আছে। তুমি তাদের ব্যবস্থা করো।’
‘কখন আসবেন আপনি?’
‘রাতেই রওয়ানা হবো।’
‘সকালেই কাজ হয়ে যাবে।’
‘হুম!’ বলে ফোন রেখে দিলো জায়ান।
পাশেই বসেছিল তার বাবা। তিনি জায়ানকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কি করতে চাইছো তুমি জায়ান?’
‘খুব সহজ কাজ আব্বু।’
‘যেমন?’
জায়ান ঝুঁকে বলল,
‘আই এক্সপ্লেইন ইউ…’
‘বলো!’
__
সকাল সকালে নাজমুল বাড়িতে আসে। ঢাকাতে একদিন আগেই সে এসেছে। তবে সে হোটেলে উঠেছেন। যাতে কেউ জানতে না পারে তার ঢাকায় আসার ব্যাপারে। এবং-কি তমাও বিষয়টি জানে না। এক সঙ্গে নাস্তা করে তারা। মনি বাঁকা চোখে কয়েকবার তাকালে নাজমুল ইতস্তত বোধ করে। তমা কাল রাতে তাদের সম্পর্কের বিষয়টি বলে দিয়েছে। অবশ্য সে বলতে চায়নি। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। এই জন্যই সবার সামনে আসতে বিব্রতবোধ করছিলেন তিনি।
সবাইকে নন্দন পার্কে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার অফার রাখেন।
হঠাৎ করে ঘুরতে যাওয়ার বিষয়টি শুনে সবার ভালো লাগলেও নিলমের মনে ঘটকা লাগে। তবে সেটা কাউকে বুঝতে না দিয়ে চেপে যায়। নাস্তার পর্ব শেষে সবাই রেডি হচ্ছিল। তখন মনি নাজমুলের কাছে আসে। মনিকে দেখে নাজমুল জোর পূর্বক হাসি ঠোঁটে ঝুলায়। সেটা উপেক্ষা করে বলে,
‘থাক, থাক। আর হাসতে হবে না। এবার বলুন আপনার স্যার কবে আসবে?’
নাজমুল হাসি মিলিয়ে কোমল স্বরে বলল,
‘এক সপ্তাহ দেরি হতে পারে।’
‘আচ্ছা।’ বলে মনি রুম ত্যাগ করল।
কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলের তিনি।
বাড়ি থেকে বের হবার সময়কালীন মনি তমাকে একটু আড়ালে নিয়ে বলল,
‘জমিয়ে প্রেম করিস তোরা।’
‘সর চু*ন্নি।’ কথাটা বলে এগিয়ে যায় তমা। মনি হেসে ফেলে।
তৎক্ষনাৎ নিলম সেখানে আসে। মনির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
‘চল আমরাও প্রেম করি।’
মনি ঘুরেই নিলমের বুকে হাত রেখে ধাক্কা দিয়ে বলল,
‘জায়ান শুনলে..’
‘খুন করবে।’
‘হ!’
‘চুপচাপ আই মিন চুপিচুপি করব।’
‘মনেমনেও না, সর হা*রা*মি।’
‘মনে মনে ভালোবাসা যায়?’
‘হ, এই ধর আমি তোকে ভালোবাসি.. ‘
কথা শেষ করার আগেই নিলম বলে উঠে,
‘ওয়াও, কবে থেকে?’
‘কু*ত্তা! আমি উদাহরণ দিতেছি।’ চোয়াল শক্ত করে বলল।
‘ওহ! কন্টিনিউ কর।’
‘মনে মনে তোর প্রতি আমার যেই ফিলিংসটা আছে না। ওটাকেই ভালোবাসা বলে।’
‘তাই নি।’
‘একদম!’
‘মোটেও ফিলিংস আছে কি তোর মনে?’
‘মাইর খাবি।’
‘তুই খাওয়ালে খাব সব।’ হেসে হেসে বলল।
‘যাহ সর!’ বলে বিরক্ত হয়ে চলে যায় মনি।
নিলম মনির যাওয়ার দিকে তাকায়। ঠোঁটে স্মিত হাসি রেখে মনে মনে বলে,
‘যদি বুঝতি আমি তোকে কতটা ভালোবাসি। তবে এভাবে ইনগোর করতি না।’
.
.
.
#চলবে?
#আমি_তোমাতে_বিলীন
#পর্ব_২১
#সুমাইয়া মনি
সিসিটিভি ফুটেজ চেক করার পর জায়ানের মেজাজ চওড়া হয়ে যায়। মাথার রগ দপদপিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে ওঠানামা করছে। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া কোনো উপায় তার কাছে আপাতত নেই। চেয়ারের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে কপালে আঙুল বুলায়। বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হয়।
দেখতে দেখতে পুরো আটারো ঘন্টা পেরিয়ে গেলো। রাত দশটা নাগাদ তারা ফিরে আসে বাড়িতে। সারাদিনের হৈ-হুল্লোড়ে ক্লান্তির ছাপ ভেসে উঠেছে সবার চেহারায়। ডিনার সেরে এসেছে। ড্রইংরুম এসেই সবাই সোফাতে শরীর এলিয়ে দেয়। হেঁটে রুম অব্দি এগোতে ইচ্ছে করছে না। মনি পুরোপুরি শুয়ে পড়ে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
‘প্রচণ্ড টায়ার্ড! তমা আমাকে কোলে করে রুমে দিয়ে আয় বান্ধবী।’
‘তুই দিয়ে আয় আমাকে।’
‘নাজমুল ভাইয়াকে ব…’
তমা চোখ রাঙ্গিয়ে মনির পানে তাকায়। নাজমুল লজ্জায় পড়ে যায়। তারানা, মিনা হেসে দেয়। নাজমুল পরিস্থিতি স্বাভাবিক আনার জন্য হালকা কেশে বলল,
‘অহেতুক কথা-বার্তা না বলে যে যার রুমে গিয়ে রেস্ট নিলে ভালো হয়।’
‘একদম!’ বলেই নিলম এগিয়ে এসে মনিকে পাজরা কোলে তুলে নেয়। সকলে আহাম্মক হয়ে যায়। মনি খেঁকিয়ে বলে উঠে,
‘করছিস কি.. ‘
‘তুই না বললি তোকে কোলে করে রুমে দিয়ে আসতে, তাই তো করছি।’
‘তোকে বলেছি?’ ঝাঁড়ি দিয়ে বলল।
‘ফ্রেন্ড তো ফ্রেন্ডই হয়।’ হেসে বলল।
‘নামা..’
‘উঁহু! একবারে রুমে নিয়ে নামাব।’ বলেই হাঁটতে লাগলো নিলম। মনি চেঁচামেচি করে নামিয়ে দিতে বলছে তাকে। নিলম নাছোড়বান্দা। হেঁটেই চলেছে সামনের দিকে। তারানা, মিনা উঁচু স্বরে হাসছে। তমাও হেসে দেয়। তারা এই বিষয়টিকেও স্বাভাবিক ভাবে নেয়। কিন্তু নাজমুল ভীতিকর চোখে তাকায়। তার কেন জানি মনে হচ্ছে অতিদ্রুতই ঝড় আসতে চলেছে। তবে এটা প্রকৃতির ঝড় নয়, মানুষের ঝড়! ওপরে নিয়ে এসে মনিকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। মনি তড়াক করে উঠে যায়৷ উপরে আসতে আসতে মনির হাতে কিল, চিমটি খেয়েছে প্রচুর নিলম। আহত স্থানে হাত বুলিয়ে বলল,
‘এই জন্যই অন্যের উপকার করতে নেই।’
‘বলে কে করতে?’ তেজি কণ্ঠে বলল মনি।
‘না বললে করা যায় না বুঝি?’
‘একদম না! বের হ।’
‘যাচ্ছি!’ বলে ভাব নিয়ে রুম থেকে বের হতে নিলে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
‘অন্য কাজে লাগলে ডাক দিস..’
মনি রেগে ফুলের টপ হাতে নেওয়ার আগেই নিলম ছুঁটে পালায়। দরজা লাগিয়ে দেয় সে।
.
‘স্যার, আপনি…’
‘রুমেই আছি।’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল জায়ান।
রাগী ও গম্ভীর মিশ্রিত কণ্ঠ শুনে নাজমুল তৎক্ষনাৎ আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারল না। জায়ান নিজ থেকেই বলল,
‘রাতুলের সঙ্গে কাল তুমি দেখা করবে।’
‘কখন?’
‘বারোটার দিকে।’
‘ওকে।’
মধ্যরাত। সকলে গভীর ঘুমে কাতর। ড্রইংরুমের লাস্টের একটি কামরা থেকে একজন সুমানবদেহের আকৃতি লম্বা-চওড়া ব্যক্তি ধীর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। রুমের দরজা ভিড়িয়ে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হয়। ড্রইংরুমে ডিম লাইট জ্বালানো ছিল। সেইটুকু আলোতেই ছোট ছোট পা ফেলে ওপরে উঠছেন তিনি। মনির রুমের সামনে এসে থামল। দরজা খোলা ছিল। তাই ভেতরে প্রবেশ করতে তার অসুবিধা হলো না। মনির রুমেও সবুজ রঙের ডিম লাইট জ্বালানো ছিল। স্পষ্ট না দেখা গেলেও অনুমান করে সে বুঝতে পারে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মনি। বিছানার নিকট যেতেই জানালার বাহির থেকে ঝলমলে চাঁদের আলো তার চেহারায় পড়তেই আদল স্পষ্ট হলো। জায়ান!
সবার অগোচরে সে ড্রইংরুমের সেই সিক্রেট রুমে থাকার চিন্তাভাবনা করেছেন। বাড়ি তৈরীর সময় সেই রুমটি সুরক্ষিত সাউন্ড প্রুফ ভাবে তৈরী করা হয়। সেখানেই বাড়ির সব সিসিটিভির মনিটর রাখা ছিল। সিক্রেট ভাবে সে সেখানে থাকা শুরু করে। নিলমের প্রতিটা পদক্ষেপ জানার জন্য তার এই ব্যবস্থা। তবে মনির কাছ থেকে দূরে থেকে সে নিজেও ভালো ছিল না। তাকে দেখার তীব্র আবেগ সে ধরে রাখতে পারেনি। তাই ছুঁটে এসেছে তার অর্ধাঙ্গিনীর কামরাতে। লম্বা হয়ে ঘুমিয়ে আছে মনি। দেখেই বুঝা যাচ্ছে গভীর ঘুমে বিভোর। এই ঘুমে আপাতত হুঁশ-জ্ঞান থাকা একদম ভুল চিন্তাধারনা। পা থেকে বুক পর্যন্ত কম্বলে ডাকা। খোলা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে বালিশে ছড়িয়ে আছে। জায়ান বিছানায় বসলো। মনির ঘুমন্ত মুখ-মন্ডলের পানে নেশাতুর দৃষ্টিতে তাকায়। দেখতে-দেখতে মুখ নিচু করলো জায়ান। ডানহাতটা বালিশের উপর ভর ফেলে মনির দিকে ঝুঁকলো। বাঁ হাত এগিয়ে গাল স্পর্শ করলো। অদ্ভুত ভালোলাগায় শিউরে উঠে মৃদুহাসিযুক্ত হলো তার ঠোঁটে। ঘুমন্তাবস্থার সুযোগ লুফার জন্য মনটা আনচান করছি তার। একটু ছুঁয়ে দিলে কিছুই হবে না! অর্ধাঙ্গিনী তার। সম্পূর্ণ অধিকার আছে। তাকে দেওয়া কথাটা একটু খেলাফত করলে কি আর হবে? ভেবে চোখটা বন্ধ করলো জায়ান। গালে হাত রেখে কপালের ঠিক মধ্যখানটা প্রগাঢ়ভাবে চুমু খেলো। ক্লান্ত শরীর থাকায় মনি কিচ্ছু টের পায় নি। এবার দু গালে হাত রেখ দুটো গাল ভরিয়ে দিলো চুমুতে। এগিয়ে গেলো মনির কোমল ঠোঁটের দিকে। উষ্ণভাবে ওষ্ঠদ্বয় দিয়ে ছুঁয়ে দিলো মনির ওষ্ঠযুগল। সবটুকু ভর ছেড়ে দিয়ে তীব্র ছোঁয়ায় উন্মত্তের মতো ওষ্ঠযুগলের উপর অধিকার ফলালো সে।
মনি আধো-আধো ঘুমের ভেতর কিছু আঁকড়ে ধরার মতো অধরদুটো নিজের করে নিতে দ্বিধাবোধ করল না। জায়ানের বুক ফুলানো নিশ্বার ভারী হয়ে এলো। ঘুমন্ত অবস্থায় চওড়া পিঠের উপর দু’হাত রেখে দেহখানা বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো মনি। মিনিট কয়েক পর জায়ানের নিশ্বাস আস্তে-আস্তে শান্ত হয়ে গেল। পুরোপুরো স্বাভাবিক হয়ে আলতো করে ওষ্ঠজোড়া মুক্ত করে দিলো। পিঠ থেকে মনির দু’হাত সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে রুম ত্যাগ করল তৎক্ষনাৎ। একটুর জন্য নিজের নিয়ন্ত্রণ হারানো থেকে রক্ষে পেল।
.
সকালে খুশি মুডে গুনগুন গান গাইতে গাইতে নিচে নামছিল মনি। টেবিলে সার্ভেন্ট’রা খারাব সার্ভ করছিল। সবাই আসনে বসে খেতে আরম্ভ করে। কাল রাতে ঘুমের ঘোরে যা হয়েছে মনির কাছে সবটাই স্বপ্ন বলে মনে হয়েছে। তবে স্বপ্নের ব্যক্তিকে জায়ান ভাবতেই মনির মনে অনুভূতির জোয়ার বইতে আরম্ভ করে। পরক্ষণেই মনে কিঞ্চিৎ রাগও হয়। কাল সারাদিনে একবারও ফোন করেনি জায়ান। সে ব্যস্ত ছিল বিধায় কল দিতে পারেনি, তাই বলে তার তো কল দেওয়া উচিত ছিল! মনে মনে অভিযোগ এঁকে রাতে নিজেও কল দেয়নি। ভেতরের রুম থেকে সকলকে মনিটরে দেখছে জায়ান। তার সামনে একই ব্রেকফাস্ট রাখা। যেটা তারা বাহিরে বসে খাচ্ছে। ব্রেকফাস্ট তৈরী করার শেষে, নাজমুল আগে ভাগে তার রুমের ভেতরের গুপ্ত দরজা দিয়ে জায়ানের রুমে দিয়ে এসেছেন। এটা আগে থেকেই বানানো ছিল। সব সময় পর্দা দিয়ে ডাকা থাকত। তাই কারো নজরে পড়েনি। নাজমুলের রুম ও সেই রুমটি পাশাপাশি ছিল। তাই ফোনে কথা বলা ছাড়াও অনায়াসে সেই রুমে যেতে পারবেন তিনি।
মনি নাজমুলের দিকে চেয়ে ছোট গলায় বলল,
‘কাল যে আমরা পার্কে গিয়েছিলাম সেটা আপনার স্যার জানে?’
‘হ্যাঁ।’
‘ব্যস্ত থাকব বলে কল দেয় নি? কে জানে এই জা*ই*ঙ্গা*র মনে কি চলছে।’ মনে মনে বলল মনি। পরক্ষণে আবার বলে,
‘আমরা আজকে কলেজে যেতে চাই। আপনার স্যারকে বলে দিন।’
নাজমুল সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে মুখ খোলার পূর্বেই ফোনের মেসেজটোন বেজে উঠে। ওপেন করে দেখে বলল,
‘যে পারেন কলেজে।’
‘আপনি বললে হবে না। আপনার স্যারকে জিজ্ঞেস করে দেখুন কি বলে।’
‘সে-ই বলেছে যেতে।’ অকপটে বলে ফেলে নাজমুল।
তারা কিছুটা অবাক হয়। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতেই নাজমুল প্রসংগ পাল্টে বলল,
‘আমি বলতে চাইছি, সে এটাই বলবে।’ বিমর্ষ কণ্ঠে শুধালো।
‘তাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করুক ফালতু কথা না বলে।’
‘হুম।’
নাজমুল কথার বাহানা করে জায়ানকে জিজ্ঞেস করে। মনি তার দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসছে। কাল কল দেয়নি দেখে প্রচণ্ড রাগ কাজ করছে তার মনে। ফোন রেখে তাদের সবাইকে নাজমুলের বলা কথাটিই পুনোরায় জানাল। তারা সকলে কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হতে চলে যায়। রুমে আসতেই মনির ফোনে জায়ানের কল আসে। রেগে চোখ ছোট চুল করে তাকায়। ধরবে নাকি কেঁটে দিবে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভাবনাচিন্তা নিয়ে ফোন রিসিভ করল।
‘বলেন।’
‘হোয়াট?’
‘কিছুই নাহ।’
‘রেগে আছো নাকি?’
‘নাতো!’
‘মিথ্যাবাদী।’
‘আপনার তাতে কি আসে যায়?’
জায়ান হেসে দেয়। মনিটরে মনিকে দেখে কথা বলছে। চোখেমুখে রাগও ছিল কিছুটা তীব্র।
‘কালকের দিন কেমন কাটলো?’
‘ভালো।’
‘শুধু ভালো নাকি অনেক ভালো?’
‘সেটা জেনে আপনি কি করবেন?’
‘আসলে আমার মতে কালকের রাতটি খুব ভালো কেঁটেছে। বাই দ্যা ওয়ে, কলেজে যাও!’ বলে মনি কিছু বলার আগেই ফোন রেখে দেয়।
‘হ্যালো…পিডা জানি কোথাকার। ওয়েট! কি বলল? কাল রাত ভালো কেঁটেছে বলতে? কি জানি বাল।’ ফোন বিছানার ওপর রেখে আলমারি থেকে ড্রেস নিয়ে চেঞ্জ করতে থাকে। জায়ান এটা দেখা মাত্র সিসি ক্যামেরা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে রাখে।
স্মিত হেসে ঠোঁটে আঙুল বুলাতে বুলাতে বলল,
‘স্যরি জানেমান, তোমাকে দেওয়া কথা রাখতে পারিনি কাল।’
.
.
.
#চলবে?