#আমি_ফাইসা_গেছি(৩৯)
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ
তোড়াকে অজ্ঞান অবস্থায় সোনিয়ার ঘাড়ে মাথা দেওয়া দেখে কুশান আর এক মুহুর্ত স্থির থাকতে পারলো না।দৌঁড়ে গাড়িতে চলে গেলো আর সোনিয়ার ঘাড় থেকে তাড়াতাড়ি করে তোড়ার মাথাটা সরিয়ে নিয়ে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে চিল্লায়ে ডাকতে লাগলো,
“তোড়া?তোড়া?কথা বলো জান।কি হয়েছে তোমার?”
তোড়ার এমন নিশ্চুপতায় কুশানের মনে হচ্ছিলো পুরো দুনিয়া যেনো তার থেমে আছে।এতো কথা বলা মেয়েটার হঠাৎ কি হলো?সব তার জন্যই হয়েছে।এই কয় দিন ধরে সে মোটেও তোড়ার দিকে একটু নজর দিতে পারছে না।আজ এতো করে বললো তার শরীর ভালো লাগছে না সেটা শুনেও কুশান তাকে বাসায় রেস্ট করার জন্য নিজে নিয়ে গেলো না।এতো বেখেয়ালি সে কি করে হতে পারলো?যে মানুষ টাই তার এখন বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, যে মানুষ টাই তার মানসিক শান্তির উৎসদাতা।আজ সেই মানুষটির দিকে কুশান তাকানো তো দূরের কথা তাকে একটিবার জড়িয়ে ধরে তার ভালোমন্দ কথা শোনার পর্যন্ত সময় পাচ্ছে না।মা,মা করতে করতে একদম নিজেকে নিজেই মানসিক চাপের মধ্যে রেখেছে কুশান।মা ছাড়াও তার যে আরেকটা প্রাণপাখি আছে সেটা কুশান সত্যি ভুলে গিয়েছিলো।
কুশান আর সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি করে তোড়াকে কোলে করে নেমে এলো গাড়ি থেকে।আর সোজা হসপিটালের মধ্যে প্রবেশ করে ডাক্তার ম্যাডাম,ডাক্তার ম্যাডাম বলে চিল্লাতে লাগলো।
কুশানের এমন অস্থিরতা দেখে বাড়ির সকল লোকজন ও কুশানের পিছু পিছু চলে এলো।
এদিকে কুশান তোড়াকে বেডে শুইয়ে দিয়ে নিজেই ডাক্তার ম্যাডাম কে ডেকে আনলো।
ডাক্তার ম্যাডাম চেক না করতেই কুশান জিজ্ঞেস করলো,
“ম্যাডাম কি হইছে আমার ওয়াইফের?”
ডাক্তার ম্যাডাম তখন কুশানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“চেক তো করতে দিন।”
“ওকে।ভালো করে চেক করুন।”
“আপনি প্লিজ একটু বাহিরে যান।আমি চেক করে জানাচ্ছি।”
“ম্যাডাম!কোনো মারাত্মক সমস্যা না তো?”
ডাক্তার ম্যাডাম তখন বললো, চেক তো করি নি স্যার।একটু সময় তো দিবেন।
জারিফ চৌধুরী তখন বললো,
“কুশান এবার একটু শান্ত হয়ে যা।তোড়া ঠিকই আছে।এমনিতেই মাথা টা ঘুরে গেছে হয় তো।কিছুক্ষন পরে ঠিক হয়ে যাবে।তুই এতো বেশি উত্তেজিত হয়ে নিজের ক্ষতি করিস না।এমনিতেই তুই নানা রকম মানসিক টেনশনের মধ্যে আছিস।”
“মানসিক শান্তি দেওয়া মানুষটাই যখন নিশ্চুপ হয়ে আছে,তখন আমি ভালো থাকি কি করে?ওর কিছু হলে আমি একদম অচল হয়ে যাবো।ও কথা কেনো বলতেছে না বাবা?ওকে তাড়াতাড়ি কথা বলতে বলো।এই বলে কুশান কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো।
জারিফ চৌধুরী ছেলের কথা শুনে নিজেও অনেক বেশি ইমোশনাল হয়ে গেলেন।তিনি আজ দিয়ে ভালোভাবে বুঝতে পারলেন কুশানকে।তার কাছে মনে হলো কুশান এমন একজন ছেলে, যে যাকে একবার মন থেকে ভালোবাসে তাকে এতো টাই আপন করে নেয় যে, নিজের জীবনের ভালো থাকা সম্পূর্ণ টা সেই মানুষের উপর ছেড়ে দেয়।যার কারণে তার সেই পছন্দের মানুষের বিন্দুমাত্র ক্ষতিতে সে নিজেও পুরোপুরি ভাবে ভেঙে পড়ে।
পরীক্ষা নীরিক্ষা শেষে কিছুক্ষন পর ডাক্তার ম্যাডাম নিজে ডেকে নিলেন কুশানকে।কুশানের বাড়ির লোকেরা অনেক আগেই প্রবেশ করেছে কেবিনে।
কুশান কেবিনে প্রবেশ করতেই দেখে তোড়ার জ্ঞান ফিরেছে।সোনিয়া তোড়ার পাশে বসে আছে।
এদিকে ডাক্তার ম্যাডামের ডাক শুনেই কুশানের মুখচোখ একদম শুকিয়ে গেছে।কোনো মারাত্মক কিছু হয় নি তো আবার।তবে বাড়ির লোকদের মুখ চোখ দেখে মনে হচ্ছে না খারাপ কিছু হয়েছে।সবার মুখে কেমন যেনো হাসি ফুটে উঠেছে।সোনিয়া হাসছে,তার নানু হাসছে।এদিকে আবার তোড়ার দিকে কুশানের চোখ পড়তেই দেখে তোড়াও মুচকি একটা হাসি দিয়ে অন্য মুখ হলো।কুশান তোড়ার মুখে এরকম হাসি দেখে ওর কাছে ছুটে যেতেই ডাক্তার ম্যাডাম বললেন,
“না,আগেই না।ওয়াইফের সাথে পরে কথা বলবেন।আগে আমার কথা শুনুন মনোযোগ দিয়ে।”
কুশান ভয়ে ভয়ে বললো,”জ্বি বলুন ম্যাডাম।”
কুশানের মুখ চোখ দেখে জারিফ চৌধুরী না হেসে আর থাকতে পারলেন না।তিনি হাসতে হাসতে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।
কুশান জারিফ চৌধুরীর হাসি দেখে ওই দিকে তাকাতেই ডাক্তার ম্যাডাম বললেন,
“এই যে স্যার?এই দিকে তাকান। এখন থেকে ভালো করে দেখভালো করবেন আপনার ওয়াইফের।আর মাসে মাসে চেকাপ করার জন্য হসপিটালে আসবেন।বুঝেছেন?”
কুশান ধীরে ধীরে বললো,
“জ্বি।”কিন্তু হয়েছে টা কি ওর?”
ডাক্তার ম্যাডাম এবার নিজেও হেসে উঠলেন।আর বললেন,
আপনি তো নিজেই একজন বাচ্চা ছেলে।এখন নিজেকে সামলাবেন? না স্ত্রীকে সামলাবেন?না নিজের বাচ্চাকে সামলাবেন?
কুশান ডাক্তার ম্যাডামের কথা শুনে হা হয়ে গেলো।কারণ সে এখনো বোঝে নি আসল কাহিনি।
সোলেমান চৌধুরী তখন কুশানের কান টেনে ধরে বললো,
তুই কি বড় হবি না কুশান?কবে বড় হবি তুই?তোড়া প্রেগন্যান্ট। তুই বাবা হতে যাচ্ছিস।বুঝেছিস?না এখনো বুঝিস নি?
কুশান তার নানুর মুখে তোড়ার মা হওয়ার কথা শোনামাত্র মেয়েদের মতো লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।তার কানে বার বার তার নানুর কথাটা প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো,
তুই বাবা হতে যাচ্ছিস কুশান।তুই বাবা হবি।
কুশান এখন হাসবে না কাঁদবে সত্যি বুঝতে পারছিলো না।তার চোখের কোনায় জল চিকচিক করতে লাগলো আর মুখে হাসি ফুটে উঠলো।সে তখন এক দৌঁড়ে তোড়ার কাছে ছুটে সবার সামনেই তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কুশানের মুখ দিয়ে আজ কোনো শব্দই বের হচ্ছে না।কেমন যেনো এক অন্য রকম অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে তার মনে প্রাণে।যে অনুভূতির কথা কাউকে বলে বা লিখে বোঝানো যাবে না।
এবার একদম ধমকানির সুরে কুশান তোড়ার নাকটা টেনে ধরে বললো,
এই মেয়ে?এই কথা আগে বলো নি কেনো আমায়?কেনো বলো নি?এই বিচার পরে করবো।এই বলে কুশান ছেড়ে দিলো তোড়াকে।আর এক দৌঁড়ে তোড়ার কেবিন থেকে বের হয়ে কামিনীর কেবিনের দিকে চলে গেলো।তার আম্মুকে নিজের মুখে বলবে বলে।কিন্তু কুশান বলার আগেই জারিফ চৌধুরী অনেক আগেই কামিনী কে খবর দিয়েছে।তবুও কামিনী নিজেও কুশানের আসার অপেক্ষায় আছে,কখন তার ছেলে নিজের মুখে বলবে কথাটা।
কুশান ধীরে ধীরে কামিনীর বেডের দিকে এগোতে লাগলো।আর কামিনী কুশানকে দেখে উঠে বসলো বেডে।কুশান তার মায়ের পাশে বসে হাত দুটি ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
আম্মু তোমার একজন খেলার সাথি আসতিছে।যার সাথে এখন থেকে তুমি রোজ রোজ খেলতে পারবে।
কামিনী যদিও বুঝতে পেরেছে কথাটা তবুও বললো, খেলার সাথি মানে?কে খেলবে আমার সাথে?
“না,মানে তোমার নাত,,,,না মানে তোড়া মা,,আমি বাবা,,,
কামিনী তখন ধমক দিয়ে বললো,
তোতলাচ্ছিস কেনো তুই?কি হইছে?
কুশান তখন তার দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়িয়ে ধরে মিটমিটিয়ে হাসতে লাগলো,কারণ সে কেনো জানি আজ ভীষণ ইতস্তত বোধ করতে লাগলো তার বাবা হওয়ার কথাটা বলতে।অথচ এই মায়ের সাথে আজ পর্যন্ত সে কত কথা শেয়ার করেছে?কিন্তু শরম করলে তো হবে না।তার মাকে যে করেই হোক বলতেই হবে।তখন কুশান তার আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
তুমি যেভাবে আমাকে ছোটো থেকে আদর দিয়ে দিয়ে এতো বড় করেছো ঠিক তেমনি ভাবে আমাকেও কোন এক পিচ্চিকে ছোটো থেকে বড় করতে হবে।তুমি যেমন ভাবে আমাকে একজন আদর্শবান ছেলে হিসেবে গড়ে তুলেছে ঠিক তেমন ভাবেই আমাকেও আমার সন্তান কে গড়ে তুলতে হবে।আম্মু!ডাক্তার ম্যাডাম বললো,
আমি নাকি বাবা হতে যাচ্ছি।এই টা কোনো কথা?ডাক্তার ম্যাডামের কথা শুনে আমার এতো হাসি পাচ্ছে কেনো আম্মু?আমি আবার পাগল টাগল হয়ে গেলাম না তো?
” হ্যাঁ পাগলই হয়ে গেছিস।এই পাগলের কোনো চিকিৎসা নাই।আমি ভাবতেই পারছি না আমার সেই ছোট্ট কুশান এতো বড় হয়ে গেছে।আমি তো এখনো তোকে সেই পিচ্চি কুশানই ভাবি।পিচ্চি ভেবে তোকে কত বকাঝকা করি,শাসন করি,কত কিছু করতে নিষেধ করি।আমি সত্যি বুঝতে পারি নি যে কুশান এখন নিজেই নিজের ভালোমন্দ বোঝার মতো যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেছে।এই বলে কামিনী হো হো করে হেসে উঠলো।কামিনী আজ কুশানের এমন খুশি দেখে হাসতে হাসতে একদম কেঁদেই ফেললো।
কুশান তার আম্মুর হাসা দেখে নিজেও হাসতে লাগলো।
মা আর ছেলের মধ্যকার যতো রাগ অভিমান ছিলো মুহুর্তের মধ্যে যেনো সব দূর হয়ে গেলো।কুশান তো ভুলেই গেলো কামিনী তার নিজের মা নয়,অন্যদিকে কামিনী নিজেও ভুলে গেলো কুশান তার নিজের ছেলে নয়।এই ছেলের অন্য কেউ ভাগীদার আছে।
জারিফ চৌধুরী হঠাৎ কাবারের মধ্যে হাড্ডি হয়ে মা ছেলের মাঝখানে ঢুকে পড়লো।আর এসেই বললো,
তোমাদের কান্নাকাটি,হাসাহাসি, মান, অভিমান যদি শেষ হয়ে থাকে তাহলে এবার চলো বাসায় চলে যাই।নতুন অতিথি আসতেছে,এই খবর টা চারদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে না?তাছাড়া তোড়ার বাবা মাকেও তো জানাতে হবে কথাটা।ওনারা শুনলে নিশ্চয় অনেক খুশি হবেন।
কুশান তখন জারিফ চৌধুরীর কাছে গিয়ে বললো,
আব্বু আমি তোড়াকে কাল ওর বাড়িতে একটু রেখে আসি?পরে তো ও যেতে পারবে না।সেজন্য এখন গিয়ে কয়েকটা দিন থেকে আসুক।এতে ওর মন টা অনেক ভালো থাকবে।
কামিনী সেই কথা শুনে বললো, হ্যাঁ বাবা। ভালো বুদ্ধি এটা।ওকে নিয়ে কয়েকটা দিন থেকে আয়।
কুশান কামিনীর কথা শোনামাত্র তোড়ার কেবিনের দিকে চলে গেলো।
কুশান চলে যাওয়ার পর জারিফ চৌধুরী বললো, আজকে আমাদের পরিবারের সবাই কতো খুশি হয়েছে।তারপরেও কেমন যেনো শূন্য শূন্য লাগছে।আজ যদি কুশান সত্যি আমাদের নিজেদের সন্তান হতো তাহলে কখনোই এই শূন্যতা বিরাজ করতো না মনে।বা যদি সত্য টা প্রকাশ নাই পেতো তাহলেই বোধ হয় বেশি ভালো হতো।সেজন্য এতো আনন্দের মাঝে আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।বার বার শুধু সৃষ্টিকর্তাকে বলতে ইচ্ছে করছে কেনো কুশান আমার নিজের সন্তান হলো না?আর সে যখন আমাদের নিজের সন্তানই না তাহলে তার প্রতি এতো মায়া,মহব্বতের কেনো জন্ম নিলো?
কামিনী জারিফ চৌধুরীর কথা শুনেও একটা টু শব্দ করলো না।সে চুপচাপ থাকলো।কারণ সবার মনের এই আক্ষেপের জন্য সে নিজে দায়ি।সে যদি সেদিনই সবাইকে সত্য টা জানিয়ে দিতো তাহলে আজ আর এতো কষ্ট পেতো না কেউ।
?
সেলিনা বেগম আজ আর সারাদিন বাড়ি আসলো না।জামিলা বেগমের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে সে তার মেয়ের বাড়ি গিয়ে থাকলো।এদিকে সারাদিন অপেক্ষা করার পরও যখন জামিলা সেলিনা বেগমের দেখা পেলো না তখন জামিলা বুদ্ধি করে নিজেও সেলিনার মেয়ের বাড়িতে চলে গেলো।জামিলাকে দেখামাত্র সেলিনা বললো,
তুই?তুই এখানে?
“হ্যাঁ মামি।আমি এখানে।আমাকে আসতে হলো।”
সেলিনা বেগম তা শুনে বললো, খুব ভালো করেছিস।আমাকেও কেনো জানি একা একা ভালো লাগছে না।
জামিলা বেগম তখন সেলিনা বেগমের কাছে গিয়ে বললো,
মামী এবার একটু নাটক করা বাদ দাও।আগে বলো তুমি নাকি কুশানকে কামিনী বেগমের কাছে বিক্রি করেছিলি?কথাটা কি সত্যি?
সেলিনা থতমত খেয়ে বললো,
তোকে কে বলেছে?
“কে আবার বলবে?জারিফ চৌধুরী আর সোলেমান চৌধুরী নিজের মুখে বলেছে।আর তারা এটাও বলেছে তাড়াতাড়ি করে যেনো তুমি কুশানের আসল বাবা মার পরিচয় টা দিয়ে দাও।তা না হলে হসপিটাল থেকে বাচ্চা চুরির অপরাধে তোমাকে জেলে দেবেন ওনারা।
সেলিনা বেগম সেই কথা শুনে বললো, কোনো প্রমাণ আছে যে আমি নিজে ওই বাচ্চা চুরি করে ওদের কাছে বিক্রি করেছি।আজাইরে ভয় দেখালেই হলো নাকি?
জামিলা বেগম তখন সেলিনা বেগমের হাত ধরে বললো,
মামী,এখন তোমার বয়স হয়ে গেছে।তারপরেও কেনো এতো পাপ কাজ করছো?কেনো এভাবে অন্যজনের সন্তান চুরি করে বিক্রি করো?একবার ধরা পড়লে কি হবে বুঝতে পারছো?
সেলিনা তা শুনে বললো, কি সব বলছিস জামিলা?আমি জীবনে ওই একটা বাচ্চায় বিক্রি করেছি।আর কোনো বাচ্চা বিক্রি করি নি আমি।হসপিটাল থেকে বাচ্চা চুরি করা এতো সহজ কাজ নাকি?বাচ্চার পরিবারের লোকেরা আমাকে ধরতে পেলে না একদম মেরেই ফেলবে।
জামিলা তা শুনে বললো, তাহলে কেনো বলছো না কুশানের আসল পরিচয়।কার বাচ্চা কুশান?এই কথাটা বললে তোমার প্রবলেম টা কোথায়?
সেলিনা তখন বললো, তুই কি এই জন্য এসেছিস এখানে?যদি ভেবে থাকিস আমার মুখ থেকে সত্য কথা টা বের করবি তাহলে ভুল ভেবেছিস।আমি কখনোই বলবো না কুশান কার বাচ্চা।মরে গেলেও না।তুই যেভাবে পারিস খুঁজে বের কর।এই বলে সেলিনা তার মেয়ের বেড রুমে দরজা বন্ধ করে চুপটি করে বসে থাকলো।
জামিলা কোনো উপাই না দেখে সেলিনা যে ঘরে ঢুকেছে সেই ঘরে তালা লাগিয়ে চাবি হাতে নিয়ে বের হলো বাড়ি থেকে।কারণ জামিলার কেনো জানি সন্দেহ বেড়েই চলছে।এক,তার মামি কেনো সত্য কথাটা বলছে না,দুই,তার মামি কেনো বললো জীবনে শুধু ওই একটা বাচ্চায় বিক্রি করেছে সে।যদি তার মামি প্রফেশনাল চোর হতো তাহলে আরো অনেক বাচ্চাই বিক্রি করতে পারতো।জামিলার কেমন যেনো এলোমেলো লাগছে সবকিছু।সেজন্য জামিলা ওই রাতের বেলায় সেলিনার মেয়ের বাড়ি থেকে ডাইরেক্ট কুশানদের বাড়ি চলে গেলো।সে এখনি তার সন্দেহের কথা প্রকাশ করলো না।
জামিলা শুধু জারিফ চৌধুরী আর সোলেমান চৌধুরী কে বলার জন্য গেলো যে সেলিনা বেগম প্রকাশ করতে চাইছে না সত্য টা।সে প্রানপন চেষ্টা করেও সেলিনার মুখ থেকে সত্য কথাটা প্রকাশ করতে পারে নি।
জামিলা হঠাৎ জারিফ চৌধুরী কে জিজ্ঞেস করলো কুশানের জন্মসাল আর জন্ম তারিখ।এতে যদি সে কোনো ক্লু খুঁজে পায়।
জারিফ চৌধুরী কুশানের জন্ম সাল আর তারিখ বলতেই জামিলা বললো,
আপনি সিওর মিঃ জারিফ চৌধুরী?ভেবেচিন্তে বলুন।
জারিফ চৌধুরী অবাক হয়ে বললো,সিওর মানে?ওই দিনই তো কামিনীর বাচ্চা হয়।যখন সে মরা সন্তানের জন্ম দেয় তখন ওই দিনই তো সেলিনা বাচ্চা বিক্রির প্রস্তাব দেয়।এখানে ভাবাভাবির কি আছে?আমরা তো প্রতিবছর ওই তারিখেই কুশানের বার্থ ডে পালন করি।
জামিলা আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করলো না জারিফ চৌধুরী কে।সে চুপচাপ চলে এলো কুশানদের বাড়ি থেকে।কারণ ঐ একই ডেটে জারারও জন্ম হয়েছে।তাহলে কি জামিলার ধারণাই ঠিক?
জামিলা আবার সেলিনার মেয়ের বাড়ি চলে গেলো।
আজ জামিলা কত টা হয়রানির মধ্যে আছে তা সে ছাড়া কেউ জানে না।কারণ সে মনে মনে ভেবেই বসে আছে কুশানই তার নিজের সন্তান।এই ভাবনা টা কতখানি সত্য এটা যে করেই হোক সেলিনার মুখ থেকে বের করতেই হবে।
এজন্য জামিলা তালা খুলে সেলিনার রুমের ভিতরে ঢুকেই আবার দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো।
এদিকে সেলিনা জামিলাকে দেখামাত্র দৌঁড়ে এসে বললো,
ঘরে তালা লাগাইছিলি কোন শাসনে?তোর সাহস দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি জামিলা।এই মামি আর মামা না থাকলে আজ ভিক্ষা করেও ভাত পাইতি না সেই মামীকে তুই ঘরে বন্দি করে রাখিস?তোর বিপদের সময়ে কে পাশে দাঁড়িয়েছিলো?এই আমি দাঁড়িয়েছি।আজ তুই নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিস,মেয়েকে ভালো করে বিয়ে দিয়েছিস,সব আমাদের জন্যই হয়েছে।
জামিলা সেলিনার কথা শুনে বললো,
মামি আমি কি কখনো অস্বীকার করেছি তোমাদের অবদান?যখন আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিলো না তখন নানার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি।তোমরা না থাকলে কে দেখতো আমাদের মা মেয়েকে?কিন্তু কথা হচ্ছে তুমি কি জন্য আমার ছেলেকে বিক্রি করে দিয়েছো?কি জন্য কামীনির মরা বাচ্চাটাকে আমার বাচ্চা বলে চালিয়ে দিয়েছিলে?কি জন্য?আমার খোঁজখবর নেওয়ার কেউ ছিলো না বলে?না তোমাকে বিশ্বাস করেছি বলে?
সেলিনা বেগম জামিলার কথা শুনে একদম আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে গেলো।এ কোন আশ্চর্যের কথা শুনালো জামিলা।এই জামিলা এসব জানলো কি করে?ওকে তো আমি কিছু বলিই নি।সেলিনা একদম বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।সে আর কোনো কথা বলার সাহস পেলো না।
জামিলা তখন সেলিনার গা টেলা দিয়ে বললো, মামি কথা বলো।সত্য বলতে এতো ভয় পাচ্ছো কেনো?আমি তো ভয় পেলাম না।একদম নির্ধিদ্বায় বলে দিলাম।তুমি কথা বলো মামি।
সেলিনা একদম চুপ হয়েই থাকলো।
জামিলা তখন কাঁদতে কাঁদতে বললো, কি ক্ষতি করেছিলাম আমি?আর কি ক্ষতি করেছিলো আমার সন্তান?যার কারণে আমাদের মা ছেলের সাক্ষাৎ হওয়ার আগেই তাকে অন্য জায়গায় বিক্রি করে দিলে? আমার স্বামী নাই,মেয়েকে বিয়ে দিয়ে একদম একা হয়ে গেছি,আজ ছেলেটা আমার কাছে থাকলে কত টা শান্তি পাইতাম তুমি বুঝতে পারছো?আমার মতো অভাগীর সাথে এই প্রতারণা টা কেনো করলে তুমি?
সেলিনা বেগম এবার মুখ খুললো।সে জামিলার কাছে এগিয়ে এসে বললো,
ছেলে তোর কাছে থাকলে এইভাবে মানুষের মতো মানুষ করতে পারতি কখনো?আজ তোর ছেলে কত বড় লোক ঘরের সন্তান?শুনলাম তার নামে সবকিছু লিখেও দিয়েছে কামিনীর বাপে।কত সুখ আর ঐশ্বর্যের মাঝে বড় হয়েছে তোর ছেলে।আর তোর কাছে থাকলে তো বাসি পঁচা ভাত খেয়ে বড় হতে হতো তাকে।এরকম শিক্ষিতও করতে পারতি না।
জামিলা সেলিনার কথা শুনে রেগে গিয়ে উচ্চস্বরে ধমক দিয়ে বললো, মামি চুপ করো এবার।একটু তো অনুশোচনা করো।তুমি কি মানুষ না অন্যকিছু?এতো বড় একটা অপরাধ করেও কিভাবে বড় বড় কথা বলছো?ছিঃ!তোমার কি একটুও মায়া লাগে নি এই ভাবে আমার বাচ্চাটাকে অন্যজনের হাতে তুলে দিতে?
সেলিনা তখন বললো,তোর স্বামী ডিভোর্স দিলে তুই যে মেয়েকে সাথে করে নিয়ে আমাদের ঘরে উঠেছিলি তখন মনে ছিলো না এই ঘর টা মামীরা কোন টাকায় দিয়েছে?যখন পেট ভরে ভরে ভাত খেয়েছিলি তখন মনে ছিলো না এই খাবার টা কোথা থেকে আসতেছে?ছেলে বিক্রির টাকা তোর পেটেও গিয়েছে,তুই নিজেও সেই টাকার ঘরে থেকেছিস,সেই টাকা দিয়ে কেনা খাবার খেয়েছিস?আর এখন বড় বড় নীতি বাক্য শোনাচ্ছিস?
সেলিনার এমন কথা শুনে জামিলার রাগ একদম সীমা ছাড়িয়ে গেলো।সে হঠাৎ রাগ করে কাঠের পিঁড়ি দিয়ে সেলিনার মাথায় জোরে করে একটা আঘাত করলো।আর সেই আঘাতে সেলিনা সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
চলবে,