#আমি_ফাইসা_গেছি(৪০)
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ
কুশান তোড়াকে নিয়ে শশুড় বাড়ি এসেছে।রাত তিনটা বাজে তবুও আজ আর এই দুইজন প্রেমিক যুগলের চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই।গভীর রাতের নিঃস্তব্ধতায় তারা আজ তাদের মনের ভাব আদান প্রদান করছে।কুশান তোড়াকে কোলের মধ্যে নিয়ে তার চুলগুলো আলতো করে বুলিয়ে দিচ্ছে আর বলছে,
জীবন টা বড়ই আজব।এই জীবনে কখন কি ঘটছে কেউ বলতে পারে না।একবার সুখের সময় আসছে তো আরেকবার দুঃখের সময়।মানুষের জীবনে আসলে পরিপূর্ণ ভাবে কখনোই সুখ ধরা দেয় না। সুখের পাশাপাশি দুঃখও বিরাজ করে।
“হুম,সুখ দুঃখের সমন্বয়েই মানুষের জীবন পরিচালিত হয়।কত বাধা বিপত্তি পেড়িয়ে আজ আমরা এ পর্যন্ত এসেছি।সত্যি আমার না এখনো কেনো জানি সব কিছু স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
কুশান এবার তোড়াকে আরো ভালোভাবে তার বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।আর বললো,
তোমায় প্রথম যেদিন আমি সামনাসামনি দেখেছিলাম সেদিন থেকেই পুরোপুরি ভাবে আসক্ত হয়ে গিয়েছিলাম তোমাতে।আর মনে মনে সেদিনই ঠিক করেছিলাম এই মেয়েটাকেই আমার বউ হিসেবে লাগবে।তোমাকে কখনোই আমি আমার প্রেমিকার চোখে দেখতাম না।বিশ্বাস করো তোড়া,তুমি যখন শাড়ি পড়ে সাজগোছ করে আমার সাথে দেখা করতে এসেছো আমি কখনো খেয়াল করি নি, তোমার শরীরের মাঝে কয়টা ভাজ পড়েছে।শাড়ির ফাঁকে তোমার কতোটুকু পেট বেরিয়ে আছে, তোমাকে কতোটা লাস্যময়ী লাগছে!আমি তখন অন্যকিছু ভেবেছি।
তোড়া তখন বেশ কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,কি ভেবেছো?
” তোমার কথা পরিবারের লোকদের কাছে বলবো কিভাবে?কিভাবে নিজের মুখে বলবো আমি এই পরীটাকে বিয়ে করতে চাই।এই চিন্তায় আমি শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম একদম।তোমার প্রতি আসক্তি যত বাড়তে লাগলো ততো আমাদের সম্পর্কের পরিনতি নিয়ে শঙ্কায় ছিলাম আমি।না জানি তোমায় বুঝি হারিয়েই ফেলি?
তোড়া কুশানের কথা শুনে মনে মনে হাসতে লাগলো,আর মিনমিনিয়ে বললো,তুমি যে কত বেশি বোকা আর হাদারাম ছিলে তা আমার থেকে কে বেশি জানতো?বিয়ে করার চিন্তা ছিলো নাকি তোমার মাথায়?
“এই তুমি কি কিছু বললা?
“” না তো।
“” না বলেছো।
তোড়া তখন বললো, আমাদের বিয়ে টা সত্যি এভাবে হয়ে যাবে আমি কল্পনাও করতে পারি নি।এটাই ভাবছিলাম।
কুশান তখন নিজের গাল তোড়ার গালে আলতো করে স্পর্শ করে বললো,
আসলেই, তোমাকে বউ করে কাছে পাওয়া এটা আমার সম্পূর্ণ কল্পনার বাহিরে ছিলো।আমি কখনো ভাবতেই পারি নি এইভাবে তোমাকে আমি সারাজীবনের জন্য এতো কাছে পাবো।কিন্তু তোমাকে নিজের করে পাওয়ার পরও আমার দুশ্চিন্তা একটুও কমে নি।একদিকে তুমি অন্যদিকে আমার ফ্যামিলির লোকজন।কি একটা পারিবারিক অশান্তির সৃষ্টি হয়েছিলো,আমার একেক টা দিন একেক টা বছরের মতো কেটে যেতে লাগলো।কি এক মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে দিন গুলো পার করেছি তা নিজেও জানি না।
অনেক কষ্টে পরিবারের সবাইকে মানিয়ে নিলাম।সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে এগোতে লাগলো,আমার পরিবারের লোকজনও এখন খুশি,আর আমরা দুইজন আবার নতুন করে প্রেম শুরু করে দিলাম,আগের সবকিছু ভুলে যাওয়ার ট্রাই করলাম আমি,সবকিছু যেনো স্বর্গের সুখের মতো মনে হচ্ছিলো।মনে হচ্ছিলো আমি যেনো দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সুখি ব্যক্তি।
কিন্তু এই সুখ আমার আর বেশি দিন রইলো না।আমার জীবনে আবার নতুন আরেক ঝড়ের আগমন শুরু হলো।এই ঝড় বাকি সকল ঝড় থেকে সম্পূর্ণভাবেই আলাদা।এখন তো আমার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে,কি আমার পরিচয়?কে আমার আসল বাবা মা?আদৌ কি তারা বেঁচে আছে?
কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস দেখো,আমার এই অন্ধকার অশান্তিতে ভরা জীবনে এক ফালি চাঁদের আলোর মতো আমার সন্তান এসে উপস্থিত হলো।যার আগমনের কথা শুনে মুহুর্তের মধ্যে যেনো আমার সব দুঃখ কষ্ট একদম মন থেকে উধাও হয়ে গেলো।আমার তো এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমি বাবা হচ্ছি?আমারও সুন্দর ফুটফুটে একটা বাচ্চা হবে।সে সারাক্ষন শুধু আমায় আব্বু আব্বু বলে ডাকবে।আর আমিও সারাক্ষন শুধু তার সাথেই খেলবো।আমার তো ভাবতেই যেনো কেমন কেমন লাগছে?কবে যে আসবে সে দিন?আমার তো আর মোটেও দেরি সহ্য হচ্ছে না।
কুশান যখন দেখলো সে শুধু একাই কথা বলে যাচ্ছে তখন সে ডাক দিলো তোড়াকে।
“তোড়া?কি হলো তোমার?তুমি কিছু বলছো না কেনো?তোমার অনুভূতি টা তো শেয়ার করলে না?কেমন লাগছে তোমার মা হওয়ার কথা শুনে?”
এদিকে তোড়া কুশানের গল্প শুনতে শুনতে ওর কোলের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে।কুশান যখন দেখলো কোনো উত্তর আসছে না,তখন সে তোড়ার মুখ টা উপর করে ধরে দেখে তোড়া ঘুম পাড়তেছে।ঘুমন্ত তোড়াকে দেখে কুশান খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলো।আর বললো,
আমার তো আনন্দে ঘুমই আসছে না চোখে।আর তুমি ঘুম পাড়তেছো?
আচ্ছা ঘুমাও।তোমার এখন রাত জাগা মোটেও ঠিক না।পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন এখন তোমার।তোমার কাছে এখন আমার আরেক টা জানপাখি আছে।
এই বলে কুশান তোড়ার মাথার নিচে একটা বালিশ দিয়ে দিলো।আর গায়ে একটা কাঁথা দিয়ে দিলো।তবে কুশানের এখনো চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই।এতো বড় একটা সুখবর পেয়েই হয় তো তার এমন অস্থির অস্থির লাগছে।যার কারণে চোখের ঘুম পর্যন্ত উধাও হয়ে গেছে তার।
ঘুমন্ত তোড়ার দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে রইলো কুশান।আর তার মুখ মন্ডল স্পর্শ করতে করতে বললো,
তুমি আমার কাছে একদম ফুলের মতো যাকে ভালোবেসে আমি সারাজীবন আগলে রাখতে চাই নিজের বুকপকেটে। আমার জন্য তুমি ব্যবহারিক কোনো আসবাবপত্র নও তোড়া, নও কোনো কামনা পূরণের সামগ্রী।তুমি হলে আমার সবচেয়ে প্রিয় যাকে আমি নিজের শেষনিঃশ্বাস অবধি আগলে রাখতে চাই ভালোবাসা দিয়ে।এই বলে কুশান নিজেও তোড়াকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
?
সেলিনা বেগমকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।অন্যদিকে সেলিনা বেগম কে খুনের চেষ্টা করায় জামিলা বেগমকে পুলিশের হাতে তুলে দিলো সেলিনার মেয়ে আর মেয়ের জামাই।পুরো এলাকা জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো।জামিলার যেহেতু নিজের বলতে শুধু মেয়ে জারাই আছে যার কারণে জামিলাকে উদ্ধার করার জন্য কেউ এগিয়ে আসলো না।এদিকে জারার কানে এখনো পৌঁছায় নি খবর টা।কারণ সে তো এখন তার শশুড় বাড়ি আছে।
রাতের বেলা জারা জামিলাকে কল দিয়েছিলো খোঁজখবর নেওয়ার জন্য।কিন্তু জামিলা কল রিসিভ করে নি।জারা ভাবলো হয়তো ব্যস্ত আছে তার মা সেজন্য কিছু মনে করে নি সে।নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে একা একা।
জারা রাতে একা একাই থাকে।কারণ শ্রাবণ প্রায় সময়ই বাহিরে রাত কাটায়।যেদিন বাসায় আসে সেদিন তার সাথে তেমন একটা কথাও বলে না।আবার একই রুমেই আলাদা ভাবে থাকে সে।কারণ শ্রাবণ মন থেকে মেনে নেয় নি জারাকে।সে এক প্রকার চাপে পরে বিয়ে টা করতে বাধ্য হয়েছিলো।যার কারণে ভীষণ ভাবে ক্ষুব্ধ সে জারার উপর।জারা যদি শ্রাবন কে জিজ্ঞেস করে কেনো সে রাতে বাহিরে থাকে তার জন্য শ্রাবণ অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে।জারা তার শাশুড়ী কে নালিশ দিলে তিনি উলটো তার উপরই রাগ দেখায়।লাবুনি বেগম বলেন,
নিজের স্বামীকে যদি বউ এর কন্ট্রোল করার ক্ষমতা না থাকে তাহলে দুনিয়ার আর কেউই সেই ছেলেকে ভালো করতে পারবে না।জারা এখন কাকে বলবে তার এই কষ্টের কথা?সেজন্য সে একা একা কাঁদে আর নিজের আগত সন্তানের কাছে নালিশ করে।এই সন্তানই এখন তার সুখ দুঃখের সাথী।
?
সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠার পরই কুশান আর তোড়ার কানে পৌঁছলো জামিলা বেগমের জেলে যাওয়ার কথাটা।তোড়া আর কুশানও ভীষণ অবাক হলো।কারণ সেলিনা বেগমের সাথে তো জামিলার বেশ ভালোই সম্পর্ক তারা দেখেছিলো।তাহলে কি এমন হয়েছিলো যে জামিলা বেগম সেলিনা কে মারার জন্য আঘাত করে।
কুশান আর দেরি না করে সাথে সাথে জারিফ চৌধুরীকে কল দেয়।আর তাকে জানিয়ে দেয় কথাটা।জারিফ চৌধুরী নিজেও ভীষণ আশ্চর্য হয়ে যায়।কারণ জামিলা তো কাল রাতে তাদের বাসাতেও এসেছিলো সেলিনার ব্যাপারে কথা বলার জন্য।তাহলে নিশ্চয় সেলিনা এমন কিছু বলেছে যার কারণে জামিলা রাগান্বিত হয়ে এই কাজটা করেছে।
জারিফ চৌধুরী কুশানকে আর এ ব্যাপারে কিছু বললো না।তিনি শুধু জামিলার জন্য আফসোস প্রকাশ করেই কল কেটে দিলেন।
জামিলার কথা শুনে সবাই ভীষণ আপসেট হয়ে গেলো।আর কুশান নিজেও ভীষণ টেনশন করতে লাগলো।এই রকম একটা ভালো মানুষের সাথে এটা কি হলো?কুশান ঠিক করলো সে জামিলার সাথে দেখা করতে যাবে।এজন্য কুশান তোড়াকে বললো,
আমি একটু থানায় যাচ্ছি তোড়া।জামিলা আন্টির তো নিজের বলতে কেউই নাই।আমার মনে হয় ওনার এই বিপদে আমাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
তোড়া সেই কথা শুনে বললো, একা একা যাবে তুমি?তার চেয়ে বরং সায়ক ভাইয়াকে সাথে করে নিয়ে যাও।উনি থাকলে ভালো হবে।
এদিকে জারিফ চৌধুরী ব্যাপার টা ক্লিয়ার হওয়ার জন্য শহিদুল সাহেব কে কল দিলো।আর জিজ্ঞেস করলো জামিলার কথা।কিন্তু শহিদুল সাহেব জামিলার জেলে যাওয়ার কথাটা এখনো শোনেন নি।তিনি তখন জারাকে গিয়ে বললেন,
জারা তোমার মায়ের খোঁজ জানো? খোঁজ নিয়েছিলে কি তিনি কোথায় আছেন এখন?
জারা তার শশুড়ের কথা শুনে ভীষণ আশ্চর্য হলো।তার শশুড় কেনো এভাবে জিজ্ঞেস করছে তাকে?
শহিদুল সাহেব তখন বললো,জারিফ চৌধুরী কল দিয়ে জানালো তোমার মা নাকি সেলিনা বেগমকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো।রাগ করে মাথায় কি দিয়ে যেনো আঘাত করে।যার কারণে সেলিনা বেগম হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে আর তোমার মাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
শহিদুল সাহেবের কথা শুনে জারা মুহুর্তের মধ্যে ভীষণ ভাবে শকড খেয়ে গেলো।তার শশুড় এসব কি বলছে?যে মামি তাদের আশ্রয় দিয়েছে সেই মামিকে কেনো মারতে যাবে তার মা।জারার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো তার মায়ের কথা শুনে।সে কোনো কিছু জিজ্ঞেস পর্যন্ত করতে পারলো না।সে শুধু ভাবতে লাগলো তার কপালে আর কত অশান্তি লেখা আছে?তার মা ছাড়া আর কে আছে তার?এখন কি হবে তার মায়ের?কে উদ্ধার করবে তার মাকে?
জারার মুখ চোখ দেখে শহিদুল সাহেব শান্ত্বনা দিয়ে বললো,
তুমি খবরদার কোনো চিন্তা করবা না মা।আমি দেখছি ব্যাপার টা।তুমি রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
জারা তখন কাঁদো কাঁদো গলায় বললো বাবা,আমি মার সাথে দেখা করতে চাই একটু।প্লিজ বাবা আমাকে একটু নিয়ে চলেন।
শহিদুল সাহেব সেই কথা শুনে বললো, এখন তো দেখা করতে পারবে না।এখন গিয়েও কোনো লাভ হবে না।তারচেয়ে বরং আমি জারিফ কে সাথে করে নিয়ে গিয়ে আগে একটু খোঁজখবর নিয়ে আসি।কেনো তোমার মা এমন কাজ করলো।এই বলেই শহিদুল সাহেব বের হয়ে গেলেন বাসা থেকে।
একদিকে সায়ক আর কুশান চলে গেলো,অন্যদিকে জারিফ চৌধুরী আর শহিদুল সাহেব একসাথে চলে গেলেন থানায়।থানায় গিয়ে চারজনের একসাথে দেখা হয়ে গেলো।তারা যখন ওসির কাছ থেকে অভিযোগ পেপার টা নিলেন,চারজনের মুখই শুকিয়ে গেলো।কারণ ঘটনা সত্য।জামিলা সত্যি সত্যি সেলিনাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো।তাছাড়া পুলিশেরা নিজেরাও এই ঘটনার সাক্ষী।কারন তারা যখন জামিলাকে টানতে টানতে থানায় নিয়ে যাচ্ছিলেন তখনো জামিলা চিৎকার করে করে বলছিলো ওকে আমি আজ মেরেই ফেলবো।ওকে আমি নিজের হাতে খুন করবো।
জামিলার এমন অদ্ভুত আচরণের কথা শুনে জারিফ চৌধুরী থানার ওসিকে বললো, স্যার আমি কি একটু ওনার সাথে কথা বলতে পারি?
“হ্যাঁ পারেন।কিন্তু পাঁচ মিনিটের বেশি নয়।আর অবশ্যই একাই যাবেন।
” ঠিক আছে।এই বলে জারিফ চৌধুরীকে জামিলার সাথে দেখা করানোর একজন কন্সটেবল সাথে করে নিয়ে গেলো।
জামিলা জারিফ চৌধুরী কে দেখে এগিয়ে এলো।কিন্তু কোনো কথা বললো না।
জারিফ চৌধুরী তখন নিজেই বললো, জামিলা তুমি কেনো এরকম করলে?কেনো সেলিনাকে মারতে চেয়েছো?
জামিলা কোনো উত্তর দিলো না।সে আগের মতোই চুপচাপ করে রইলো।
জারিফ চৌধুরী তখন বললো, আমি জানি না তোমাদের মধ্যে আসলে কি হয়েছিলো?বা কেনো তুমি এরকম একটা কাজ করলে কিন্তু তুমি তো জানোই একমাত্র সেলিনাই জানে আমাদের কুশানের বাবা মা কে?এখন সেলিনার সাথে যদি খারাপ কিছু হয় তাহলে কিভাবে খুঁজে পাবো আমরা কুশানের বাবা মাকে?
জামিলা এতোক্ষনে কথা বলে উঠলো।সে বললো,
তার আর প্রয়োজন নেই জারিফ সাহেব।আপনাদের কুশান আপনাদের কাছেই থাক।আর এখন জেনেই বা কি করবেন?আপনারা তো কুশানের আসল মায়ের বুক অনেক আগেই খালি করেছেন,এখন তিনি তার হারানো বাচ্চা নিয়ে কি করবেন?
“এভাবে বলছো কেনো জামিলা?তুমি কি তাহলে জানতে পেরেছো কিছু?”
জামিলা তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
নভেম্বরের ১৫ তারিখে আমি জমজ বাচ্চার জন্ম দিয়েছিলাম।আমার একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হয়েছিলো।কিন্তু ছেলেটাকে আমি আর পাই নি সেদিন।শুধুমাত্র মেয়ে টাকে নিয়ে বাড়ি ফিরি।
জারিফ চৌধুরী সেই কথা শুনে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
কেনো পাও নি ছেলেটাকে?কি হয়েছিলো ওর?
জামিলা তখন কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
কোনো একজন নির্দয়া অর্থলোভী মানুষ আমার সন্তানকে বিক্রি করেছে কোনো এক বড় লোক টাকাওয়ালা মানুষের কাছে।যাদের একবারের জন্য মনে হয় নি এই কাজটা করা ঠিক হচ্ছে না।কোনো এক দুঃখী মা কষ্ট করে ১০ মাস ১০ দিন এই বাচ্চাটাকে পেটে রেখেছিলো।তাদের একবারের জন্য মনে হয় নি এই বাচ্চাটাই হয় তো একদিন এই অভাগী মায়ের একমাত্র সম্বল হতে পারতো।
জারিফ চৌধুরী জামিলার কথা শুনে হা করে তাকিয়ে রইলো। কারণ তার আর বুঝতে বাকি রইলো না কিছু।তিনি আর কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করলেন না।
জামিলা এবার তার চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো, আপনিই বলেন,এখন আমি কোন মুখ নিয়ে সেই ছেলের দাবি করতে যাইবো?যে ছেলেকে আমি রক্ষা করতে পারি নি তাকে কিভাবে বললো বাবা,আমি তোর সেই মা হই।
জারিফ চৌধুরী তখন বললো,আপনি আগেই কুশান কে কিছু বলেন না।ও শুনলে ভীষণ কষ্ট পাবে।এমনিতেই ছেলেটা অনেক বেশি মানসিক যন্ত্রনার মধ্যে আছে।শুধু কুশান না,আপনার কাউকেই কিছু বলার দরকার নাই।।আমি আপনাকে জেল থেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করবো।যখন জেল থেকে ছাড়া পাবেন তখন আপনি আপনার ছেলেকে পেয়ে যাবেন।
জারিফ চৌধুরীর চোখের কোনায় জল দেখে জামিলা বললো, খুব সহজেই তো বলে দিলেন আমার ছেলেকে আমাকে দিয়ে দেবেন।কিন্তু আমি তো আপনার মনের খবর দেখতে পাচ্ছি জারিফ সাহেব।অনেক কষ্টে আর দুঃখে কথাটা বললেন আপনি।আমি এতো টা স্বার্থপর নই জারিফ সাহেব।ওই ছেলের অধিকার নিয়ে কখনোই আমি যাবো না আপনাদের কাছে।কারণ পুরো দুনিয়ার লোক কুশানকে আপনাদের ছেলে বলেই জানে। আপনারা যেহেতু ওকে ছোটো থেকে লালনপালন করেছেন সেহেতু ও এখন আপনাদেরই সন্তান।আর আমার মতো এমন অভাগা মায়ের পরিচয় দিয়ে কুশান কে ছোটো করবেন না প্লিজ।আর হ্যাঁ,আমাকে ছাড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই।বাকি টা জীবন আমি এখানেই কাটাতে চাই।
এদিকে কন্সটেবল টি এসে বললো, স্যার আপনার সময় অনেক আগে পার হয়ে গেছে।আপনি আসুন প্লিজ এখন।
জারিফ চৌধুরী সেই কথা শুনে চলে এলো সবার মাঝে।
জারিফ কে দেখামাত্র সবাই এগিয়ে এলো।আর জিজ্ঞেস করলো , জামিলা কি কিছু বললো?কেনো তিনি এমন করলেন?
জারিফ চৌধুরী বললো, না বলে নি কিছু।
কুশান তা শুনে বললো, তাহলে তুমি এতোক্ষণ ধরে কি কথা বললে আব্বু?
“কিছু না।”
এই বলে জারিফ সাহেব শহিদুল সাহেব কে বললো, জারার এখন কি অবস্থা?ও সুস্থ আছে তো?
“হ্যাঁ আছে,তবে মায়ের কথা শুনে ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছে।”
“ওর খোঁজখবর রাখিও বন্ধু।আর আমিও মাঝেমধ্যে গিয়ে দেখে আসবো জারাকে।”
কুশান তখন জারিফ চৌধুরী কে আবার জিজ্ঞেস করলো,আব্বু জামিলা আন্টিকে বের করার একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে।ভালো একজন এডভোকেটের সাথে কথা বলো তুমি।যে করেই হোক সেলিনা বেগমের এই ঘটনাকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে হবে।তাহলেই হয় তো বেঁচে যেতে পারেন উনি।
জারিফ চৌধুরী অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো কুশানের দিকে।কারণ কুশান তো এখনো জানে না জামিলাই তার নিজের আম্মু,তবুও ছেলেটার কত দরদ জামিলার জন্য?আর যখন শুনবে এই জামিলাই তার নিজের আম্মু তখন না জানি আরো কত পাগলামি করবে?না,একে কিছুতেই জানতে দেওয়া যাবে না এখন।যা করার তাকেই করতে হবে।
জারিফ চৌধুরী তখন কুশানকে বললো, বাবা তুই এ নিয়ে এতো বেশি চিন্তা করিস না।আমি তো আছি?আমরা জামিলাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য চেষ্টা করবো।তুই বরং তোড়ার কাছে যা।ওকে খবরদার কোনো টেনশনের মধ্যে রাখবি না।ওর ভালোভাবে খেয়াল রাখিস।যা এখন চলে যা তুই।এই বলে জারিফ চৌধুরী সায়ক কে বললো,
বাবা ওকে নিয়ে যাও তুমি।
কুশান তখন বললো আব্বু, আমি এক্ষুনি যাবো না বাসায়।আমি একটু সেলিনা বেগমকে দেখতে যেতে চাই।সেলিনা বেগমের অবস্থা তো খুবই শোচনীয়।
জারিফ চৌধুরী তখন অবাক হয়ে বললো, সেলিনা বেগমকে দেখতে যাবি?কেনো?
কুশান এবার আর কোনো উত্তর দিলো না।
জারিফ চৌধুরী তখন বললো, বাবা উনি তো এখন কথা বলতে পারবে না।ওনার কাছে গিয়ে কোনো লাভ নাই।
কুশান তখন জারিফ চৌধুরীর কথা শুনে বললো,
তাহলে আব্বু আমি কিভাবে জানতে পারবো আমার আসল বাবা মা কে?আর কিভাবেই বা চিনতে পারবো আমার পরিবারকে।এই সেলিনা বেগমের কিছু হলে তো আমি কোনোদিনই খুঁজে পাবো না তাদের।
জারিফ চৌধুরী কুশানের কথা শুনে আর একটা উত্তর ও দিলো না।তিনি বুঝতে পারলেন কুশান মুখে মুখে যতই তাদের আব্বু আম্মু ডাকুক না কেনো এখন সে সত্যি তার নিজের মা বাবার জন্যই ব্যাকুল।কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তো তাকে সত্য টা বলাও যাবে না।সেজন্য জারিফ চৌধুরী বললো,
বাবা তোর যেটা ভালো মনে হয় সেটাই কর।এই বলে জারিফ চৌধুরী শহিদুল সাহেব কে নিয়ে চলে গেলেন।
অন্য দিকে কুশান সায়ককে সাথে করে নিয়ে সেলিনা বেগমকে দেখতে গেলেন হাসপাতালে।
জারিফ চৌধুরী বাসায় গিয়েই আগে সোলেমান চৌধুরীর সাথে শেয়ার করলো জামিলার ব্যাপার টা।সোলেমান চৌধুরীও সেম কথাই বললো।যে এখনি কুশানকে জানানো যাবে না জামিলাই তার আসল আম্মু।যতদিন পর্যন্ত জামিলাকে তারা জেল থেকে মুক্তি করে না আনতে পারবে ততোদিন ব্যাপার টা গোপনই রাখতে হবে।তা না হলে কুশান শুধু শুধু টেনশন করবে।
সোলেমান চৌধুরী আর জারিফ চৌধুরী দুইজন মিলে ভালো একজন উকিল ধরলেন জামিলার কেসটা সলভ করার জন্য।যে করেই হোক তাদের জামিলাকে নির্দোষ প্রমাণ করতেই হবে।
এদিকে কুশানরা হাসপাতালে গিয়ে দেখে সেলিনা বেগম মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে।মাথায় আঘাত পাওয়ায় মাথার এক পাশের রক্ত জমাট বেঁধে আছে।বাঁচার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে,যদিও বেঁচে থাকে তখন সে কাউকে চিনতে পারবে না।কারণ তখন তার ব্রেন কোনো কাজ করবে না।
চলবে,