#আমি_মায়াবতী
পর্ব_৩৭
লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
মায়ার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। ইচ্ছে করছে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হাহা করে হাসতে। কিন্তু মায়া নিজের মুখটা বেশ গম্ভীর করে বলে,” আমাদের এইখানে একসাথে দেখে দূরে থেকে যে কেউ বুঝবে, আমরা এইখানে প্রেম করছি। কিন্তু আসলেই কি আমরা প্রেম করছি? নাকি আপনি আর আমি ঝগড়া করছি?”
“মায়া, মেজাজ গরম করো না আমার। কি বলেছে ও তোমাকে?”
মায়া চোখে কৌতুক নাচিয়ে বলে,” কেন? সে তো আপনার ছোট ভাই। তাকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করেন না, সে কি বলেছে আমাকে।”
কাব্য বিরক্ত হয়ে বলে,”সামনে হাঁটো। ঘুরবো চলো। গলির মুখে গাড়ি দাঁড় করানো আছে।”
“কিন্তু আমাকে তো এখন বাসায় যেতে হবে। পড়তে হবে।”
“রাগিও না আমাকে মায়া।”
মায়া আর কিছুই বলেনা। এই মানুষটার রাগ সম্পর্কে তার ভালোই ধারণা আছে। চুপচাপ কাব্যর পিছুপিছু হাঁটতে থাকে।
“তুমি একদম কবিতার সাথে মিশবে না বুঝলে?”
“কেন?”
“ও বেশি কথা বলে। ওর সাথে থাকতে থাকতে তুমিও বেশি কথা বলো। আমার ভালো লাগে না।”
“আমি মোটেও বেশি কথা বলি না। আপনিই ওর সাথে বেশি ঝগড়া করেন।”
“মায়া, তুমি কি বুঝতে পারছো না, আমি রেগে আছি। ”
“তা তো পারছিই। অন্যের রাগ আপনি কবিতার উপর ঝাড়ছেন।”
“তো? ওর উপর ঝাড়বোনা তো কার উপর ঝাড়বো? ঐ তো যতো নষ্টের গোড়া।”
“কেন? ও কি করলো?”
“ঐ তো সবকিছুর মূল। ও তো আগারও খাইছে আবার তলারও কুড়াইছে।”
“হাহাহা।”
“ও তোমার থেকেও খাইছে আমার থেকেও খাইছে। একবারও আমাকে বলেনাই যে তুমিও আমাকে ভালোবাসো। তোমাকেও বলে নাই যে আমি তোমাকে ভালোবাসি। সবদিক থেকেই ও লাভ করছে। ও যদি আগেই বলতো, তাহলে আর এইসব কিছুই হতো না।অনেক আগেই আমি সবকিছু সেটেল্ড করে ফেলতে পারতাম।”
“ওর দোষ দিচ্ছেন কেন? ও কি করেছে? ও তো শুধু আমাদের কথা দিয়ে কথা রেখেছে। আমিও বলেছিলাম আপনাকে না জানাতে আপনিও বলেছিলেন আমাকে না জানাতে। আপনি তো জানেনই ওয়াদা ভঙ্গ করা কতটা খারাপ। সে শুধু আমাদের কথা রেখেছে।”
“সেটাই আমার ভুল ছিল।”
“হুমম। ”
“পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন?”
“চলছে।”
“ভয় লাগছে? আমার কিন্তু অনেক ভয় লেগেছিল।”
“একটু একটু লাগছে।”
“ভালো ভাবে পরীক্ষা দিবে বুঝলে? কোনো আজেবাজে চিন্তা মাথায় রাখবে না। সোহাগ নামক কোনো প্যারা মাথায় রাখবে না। একদিনেরই তো ব্যাপার এই পরীক্ষা। কিন্তু তোমার বারো বছরের পরীক্ষা।”
“আপনি মেডিকেলে এক্সাম দেননি?”
“দিয়েছিলাম। হয়নি।”
“অহ।”
“তোমার মনে আছে, আমি তোমাকে অনেক বকাঝকা করেছিলাম?”
“মনে নেই আবার? আপনি না বললে আমার জিদও হতো না। ভালো রেজাল্টও হতো না।”
“হুমম। শুনেছি এই কাহিনি। কবিতার কাছে থেকে।”
“হুমম।”
“মায়া।”
“বলুন।”
“ও কি বলেছে তোমাকে?”
“প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে।”
“ওয়াও, গ্রেইট। তারপর? ”
“আমি মানা করলাম।”
“দ্যান?”
“বললো বাসায় জানাবে। ”
“নাইস।”
“হুমম। ভেরি নাইস।”
“এইবার আমি তোমার বাবার কাছে গিয়ে বিয়ের প্রোপোজাল দিব আগেই। আর তোমার সোহাগ ভাইকে কিক মেরে মাঠের বাইরে বের করে দিব।”
মায়া খিলখিল করে হেসে উঠে। কাব্য একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। মায়া ওর মুখের সামনে চুটকি বাজিয়ে বলে,”সামনের দিকে তাকান মাষ্টারমশাই। গাড়ি চালাচ্ছেন আপনি। একটা স্টেপ ভুল হলেই লাইফ শেষ আমাদের।”
“সামনে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। চলো লাঞ্চ করে নিই।”
“আপনি আমাকে বকা খাইয়েই ছাড়বেন। তাইনা?”
“একদিন বকা খেলে কিছুই হবে না।চলো।”
“সাবিহা আমাকে পাগল করে ফেলে আপনার সাথে কোথাও বের হলে। কি কি করলাম, কি খেলাম, কই কই ঘুরলাম সব ওকে বলতেই হবে।”
“তা তুমি কি কি বলো শুনি? আমরা তো কিছুই করিনা। ” বলেই চোখ টিপে হাসে সে।
“নির্লজ্জ বেডা।”
কাব্য হাহা করে হাসে। কিন্তু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলে,”রিজাকে কিছু জানিয়েছো?”
“নাহ।”
“কবে জানাবে ওকে? আমাদের ব্যাপারে?”
“জানিনা আমি। কিন্তু বাসায় আগে জানাতে হবে। আমি চাইনা আমি বা আপনি ছাড়া আমাদের সম্পর্কের কথা বাসায় তৃতীয় কেউ জানাক।”
“আমার বাসায় তো সবাই জানে।”
“আপনি তো বেডা মানুষ। ”
“আমি ব্যাডা মানুষ হইসি তো কি হইছে?”
“আপনার বাসার সবার জানারই কথ এটাই তো
স্বাভাবিক। ”
“জ্বি না ম্যাডাম। এতো সহজ না। আমি ছেলে বলেই আমার জন্য এটা সহজ হয়নি।”
“মানে?”
“মানে হচ্ছে যদি আমার আজ একটা জব না থাকতো, তাহলে বুঝতে পারতে কি সমস্যা। তখন কি আমার বাড়ি থেকেই এতো সহজে মেনে নিতো নাকি?মোটেও নিতো না। কি বলতো জানো? ভাত কাপড় দেওয়ার মুরোদ নেই, আবার প্রেম করে ছেলে।”
মায়া এবার হাহা করে হাসতে থাকে।
“অতো হেসো না, মায়া। বিপদে পড়ে যাবে।”
“মানে?”
“কিছুনা।”
“হুমম। ”
“আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি যে আমি আমার ছাত্রীর সাথে সম্পর্কে জড়াবো। আমি অনেক চেষ্টা করেছি অন্ততপক্ষে তুমি আমার ডিরেক্ট স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় কোনো সম্পর্কে জড়াবো না।কিন্তু এই সোহাগের বাচ্চা সোহাগের জন্য ঠিকই বলতে হলো। তখন তো ভালোই লেগেছিল। কিন্তু এখন এই সোহাগটাই তো দেখছি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
“হুমম। আমিও সেইম। কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি যে কোনো টিচারের প্রেমে পড়বো।”
“হুমম। সেটা কেউই কখনোই ভাবে না।”
“কবে জানাবেন আমাদের বাসায়?”
“তুমি বললে আজই জানালাম। সবই তোমার ইচ্ছে। ”
“আমি এক্সামটা দেই। তারপর জানান বাসায়।”
“ওকে। মায়া।”
“বলুন।”
“কিছুনা।”
“আহ, ঢং বাদ দিন তো। বলেন।”
“তোমার বাবা কি রাজি হবেন?”
“কেন হবেন না? আপনি তো ভালো মানুষ। ভালো চাকরি করেন। সমস্যা হওয়ার তো কথা না।”
“আমি তোমার থেকে বয়সে অনেক বড়। এইটাই সমস্যা। ”
“এটা কোনো সমস্যাই না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকেন।”
“হুমম।নামো, এসে গেছি আমরা।”
“হুমম। ”
★★★
“আমি তোমারটা ভুলেও নিতে পারবোনা মায়া। তুমি সবসময়ই এমন করো।”
“আপনার দোষ। আপনিই আমার জন্য ফুল প্লেট অর্ডার করছেন। আমি তো বলেছিলাম আপনাকে আমি এতোটা নিতে পারবো না।”
“উফফ, আচ্ছা দাও। আর কিছু নিবে তুমি? আইসক্রিম টাইপ?”
“আমার পেট এইটা কোনো গুদাম না।”
“অহ, আচ্ছা। তুমি তো আবার নিজেকে পাখি ভাবো। তুমিই না শুধু তোমার বন্ধু কবিতাও। তোমরা তো পাখির মতো উড়ো। আবার খাবারও খাও পাখির মতো।”
“আপনার সাথে কবিতা শুধুশুধু ঝগড়া করে না, কারণেই করে। আপনিও একেবারে দুধে ধোওয়া তুলসিপাতা নন। ওকে এইভাবে রাগিয়ে দেন বলেই ও এমন করে।”
“তোমরা মেয়েরা ভারি বজ্জাত। সুযোগ পেলেই কথা শুনাতে ছাড়ো না একটুও।”
“অবশ্যই করবো।”
“মায়া এদিকে এসো। মুখে খাবারের ঝোল লেগে আছে। মুছে দিচ্ছি।”
মায়া হতবিহ্বল হয়ে যায় এমন কথা শুনে। ৬ মাসেরও অধিক সময় ধরে তারা সম্পর্কে জড়িয়েছে। কিন্তু এইরকম কথা কাব্য এর আগে বলেনি কখনো কিংবা এতোটা অধিকারবোধ নিয়েও কথা বলেনি।তবে কি সোহাগের জন্যই এতোটা কাছাকাছি আসা? হারানোর ভয়ের জন্যই কি?
মায়া চুপ করে বসে থাকলে কাব্য নিজে এগিয়ে এসে ওর ঠোঁটের পাশে লেগে থাকা ঝোল মুছে দেয়। শিউরে উঠে মায়া। কাব্যর চোখের দিকে তাকায় সরাসরি। সেই চোখে তার জন্য শুধু ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে সে। সে কি এতোটাই ভাগ্যবতী? এতোটাই? নাহ, সে হারাতে দিবে না এই মানুষটাকে। খুব যত্ন করে রেখে দিবে তাকে। সেও অধিকার খাটাবে। যাতে তার আগে কেউ এসে আবার না নিজের করে নেয় মানুষটাকে। সে যে তার মায়ের মতো হতে চায় না। সে কারো মাঝখানে যেতে চায় না। কাব্য এখনো জানে না মায়ার মায়ের ব্যাপারে। জানলে কি কাব্য তাকে আর ভালোবাসবে না?
চলবে…..