আরোও_একবার_বসন্ত,০২,০৩

0
474

#আরোও_একবার_বসন্ত,০২,০৩

#২য়_পর্ব

চিকিৎসার মধ্যেই তাকে জিজ্ঞেস করে প্রিয়ন্তী,
– তোমার সাথে কি কেউ এসেছে?
– আমি এসেছি ওর সাথে

কথাটা কানে আসতেই পেছনে ঘুরে তাকায় প্রিয়ন্তী। পেছনে ফিরতেই দেখে একজন নেভি ব্লু কালারের শার্ট এবং কালো জিন্স পরিহিত একজন যুবক তার সামনে দাঁড়ানো। যুবকটির উচ্চতা কম করে হলেও ছ’ফুট হবে। দেখতে শ্যাম বর্নের, চুলগুলো বেশ কায়দা করে স্টাইল করা। চোখে চশমা, দেখলে একজন নিতান্ত সুদর্শন ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে। রাস্তায় তার চেহারা না দেখতে পারলেও এই ছেলেটাই যে চোরটাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো সেটা বুঝতে বাকি রইলো না প্রিয়ন্তীর। চোখজোড়া সরু করে ভ্রুযুগল কুচকে ধীর কন্ঠে বলে,
– আপনি ওর সাথে?
– জ্বী
– কি হন রোগীর?
– হুমমম….আমি ওর বড় ভাই
– ওহ, রোগীর টেস্ট করতে হবে, ইন্টার্নাল ব্লিডিং হচ্ছে কিনা একটু দেখা লাগবে। আর হাত হয়তো ফ্রাকচার হতে পারে। এক্স-রেতে বুঝা যাবে, না হলে একটা সিটি স্ক্যান করাতে হবে। নিচে গিয়ে ওকে এডমিট করিয়ে দিন।
– ঠিক আছে, আপনার নাম?
– জ্বী?
– রেফারেন্সের জন্য।
– ডা. প্রিয়ন্তী আহমদ

নামটি শোনামাত্র কোনো কথা না বলেই পেছনে ঘুরে হাটা দেয় ছেলেটি। এতে প্রিয়ন্তীর একটু আতে লাগে। একেই আজ সকাল থেকে মেজাজটা বিগড়ে আছে। উপরে ছেলেটার এমন ব্যাবহার যেনো কিছুতেই হজম হলো না প্রিয়ন্তীর। এতো অভদ্র মানুষ হয়! ভদ্রতার বালাই নেই। একে চোরের বড় ভাই, পোশাক আশাক দেখে বোঝার জো নেই লোকটা এতো ধুরন্দর৷ তাই আর সংযম না রাখতে পেরে পেছন থেকে বলে উঠে,
– শুনুন
– জ্বী, কিছু বললেন?

ছেলেটি পেছনে ফিরে একটু কর্কশ কন্ঠে কথাটা বলতেই প্রিয়ন্তী বলে উঠে,
– প্যাশেন্ট সবার আগে, তাই চোর ছ্যাচর না দেখেই আমি চিকিৎসা শুরু করেছি। চিকিৎসা হয়ে গেলে যথারীতি থানায় ফোন করবো আমি। আহত হলেও মানুষটির পেশা তার জীবনে প্রভাব ফেলে
– একটু আগেই না বললেন তাকে হাসপাতালে থাকতে হবে।
– হ্যা পুলিশের সাথে আমি সেভাবেই কথা বলে নিবো।
– আচ্ছা তবে আমি বলছি যতক্ষণ ও ঠিক না হচ্ছে ও এখানেই থাকুক।

লোকটার কথার ভঙ্গিমা এমন যেনো কোনো থানার ইন্সপেক্টর। প্রিয়ন্তীর মেজাজটা অত্যাধিক খারাপ হতে লাগলো। কিন্তু তার মাঝেই নিজেকে ঠান্ডা করে ধীর কন্ঠে বললো,
– আপনি কি নিজেকে পুলিশ ভাবছেন? আপনার পোশাক আশাক দেখে বোঝার উপায় নেই যে আপনি ওর ভাই। নিজের ভাইকে এভাবে চুরির শিক্ষা দেওয়াটা বোধহয় কোনো বড়ভাই এর দায়িত্ব নয়। আপনিও কি তবে এই লাইনের?
– দেখুন আপনি ভুল বুঝছেন!
– আমি ঠিক ই বুঝছি, আমার ধারণা আপনি নিজেই ওকে দিয়ে এই কাজ গুলো করান। সুমাইয়া, একটু থানায় ফোন দাও তো।
– আরে আজিব মহিলা তো আপনি। আমি নিজেই পুলিশ। আপনি কাকে ফোন দিয়াচ্ছেন?

ছেলেটার কথা শুনে তাচ্ছিল্যের স্বরে প্রিয়ন্তী বলে,
– ওহ তাই নাকি? এটা কি বাংলা সিনেমা? একভাই পুলিশ তো আরেক ভাই চোর? ফাজলামি করছেন আমার সাথে। আপনাকে তো সবার আগে জেলে ভরা উচিত। এই সুমাইয়া ফোন করো থানায়।

প্রিয়ন্তীর হুংকার কন্ঠের আদেশ পালন করতে বাধ্য হলো নার্স সুমাইয়া। প্রিয়ন্তীকে বুঝানোর অসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সামনের যুবক এবং চোর ছেলেটি। কিন্তু কে শুনে কার কথা, একেই হয়তো বলা হয় এক জায়গার রাগ অন্য জায়গায় মেটানো।
________________________

নিজের টেবিলে বসে রয়েছে প্রিয়ন্তী। মুখটা লজ্জায় নিচু হয়ে রয়েছে। তার ঠিক অপরপাশে বসে রয়েছে যুবকটি এবং দুজন পুলিশ অফিসার। যুবকটি বাঁকা হাসি হেসেই যাচ্ছে। যুবকটি সত্যি সত্যি একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। মুখে বাঁকা হাসি রেখেই ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
– কে যেনো বলছিলো আমাকে সবার আগে জেলে ভরা উচিত?
– আই এম সরি, আসলে আপনি যখন বলেছিলেন আপনি ওর ভাই তখন আমি ভেবেছিলাম
– এইজন্য মানুষের কথা শুনতে হয়, নিজের মুখটা একটু বন্ধ রাখতে হয়। আপনি তো ডাক্তার আপনার তো অভ্যেস থাকার কথা এসবের।
– আপনি কি আমাকে টন্ট করছেন?
– না ফ্রি এডভাইস দিচ্ছি। রাখলে রাখেন না রাখলে নেই। বাই দ্যা ওয়ে ওই রাসেল নামের ছেলেটার ট্রিটমেন্টটা ভালো করে করবেন। বেশ মার খেতে হয়েছে ওকে।
– আপনি কি আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন?
– হ্যা তুলছি, যা হেনস্তা করলেন আমাকে। আপনার টপ লেভেল নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে। এতো হট মেজাজের কি ডাক্তার হয়?

যুবকটির কথাগুলো শুনে গা যেনো জ্বলে উঠলো প্রিয়ন্তীর। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– দেখুন মিস্টার!
– আরাফাত, ইন্সপেক্টর ইয়াসির আরাফাত।
– ওয়াটএভার। আমার কোয়ালিফিকেশন নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে একটু চিন্তা করা উচিত আপনার। আগে আমার সম্পর্কে জেনে নিবেন তারপর কথা বলবেন
– আপনার মনে হয় না, আপনার ও কোনো মন্তব্য দেবার আগে দুবার চিন্তা করা উচিত! রাসেল নামক ছেলেটাকে চোর বলার আগে একটু চিন্তা করেছেন?

আরাফাতের কথাটি শোনার পর চুপ মেরে যায় প্রিয়ন্তী। সত্যি সেই কখন থেকে সে ওই ছেলেটাকে চোর বলেই উল্লেখ করে যাচ্ছে। ছেলেটির বয়স ষোল কি সতেরো হবে। কি মিষ্টি একটা চেহারা, গোল গাল, ফরসা একটা চেহারা! ছেলেটার এই বয়সে পড়াশোনা করার কথা। অথচ তার আজকাল রাস্তায় মার খেতে হচ্ছে। প্রিয়ন্তীকে চুপ থাকতে দেখে আরাফাত ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
– রাসেলের বয়স পনেরো। ছেলেটার মা-বাবা কে সেটা ওর জানা নেই। পেটের ক্ষুধা আর অভাব মানুষকে সব কিছু করায়। রাসেলের ব্যাপারটাও তাই। মুদির দোকানে একটা বাটারবান চুরি করতে যেয়ে ধরা খেয়েছে। তাই এই নাবালক ছেলেটাকে সামান্য দশ টাকার বাটারবান চুরির অপরাধে আটকে রাখার ইচ্ছে আমার হলো না। ওর চিকিৎসার কোনো ত্রুটি রাখবেন না। আমি বিল দিয়ে দিবো। এমনেই অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে আমার। আর সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না। উঠলাম৷

বলেই উঠে দাঁড়ালো আরাফাত। আরাফাতের কথাগুলো গা জ্বালানো কিন্তু লোকটা অন্য রকম। প্রিয়ন্তী চাইলেও তাকে ঘৃণা করতে পারছে না। হ্যা এটা ঠিক মাত্রাতিরিক্ত মেজাজ খারাপ হচ্ছে। লোকটার কথা বলার ধরণ অত্যন্ত বাজে। হয়তো পুলিশে আছে বলেই এতো ভাব। প্রিয়ন্তীও কম যায় না, নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
– আমার দায়িত্বজ্ঞানের হিসেব আমি আপনাকে দিবো না। সুতরাং আমাকে আমার মতো কাজ করতে দিবেন এটাই আশা করি। তবে নিশ্চিন্ত থাকুন আমি কখনো আমার দায়িত্বে কোনো ত্রুটি রাখি নি। আজ ও রাখবো৷ আসতে পারেন।

আরাফাত এক দৃষ্টিতে প্রিয়ন্তীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর পকেটে হাতখানা গুজে গটগট করে বেড়িয়ে গেলো প্রিয়ন্তীর রুম থেকে। আরাফাত বেড়িয়ে গেলে স্টেথোস্কোপটা গলা থেকে নামিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো প্রিয়ন্তী। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুই ছুই। এই লোকটা তার দুঘন্টা সময় নষ্ট করেছে। এরকম কখনোই হয় নি তার সাথে, একটা লোকের সাথে প্রথম দেখাতেই একেবারে ঝগড়া হয়ে যাওয়া এটা তার সাথে এই প্রথম হলো। তবে মনে শান্তি লাগছে, লোকটার মুখের উপর উচিত জবাব দিয়েছে সে। পাঁচ মিনিট রেস্ট করে আবার রাউন্ডে যেতে হবে। ব্যস্ততাই ভালো, অন্তত বুকের চাপা কষ্টগুলো চাপাই থাকে। মাথায় উপর চড়ে বসে না।

রাত ৮টা,
বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে আরাফাত, হাতে সিগারেট। উত্তরের বাতাস লোম খাড়া করে তুলছে। মাসটা পৌষের শেষের দিক। বাহিরে শুন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে সুখটান দিতে ব্যস্ত আরাফাত। ব্যস্ত শহরটাকে দেখতেও আলাদা মজা। প্রায় এই সময়টা উপভোগ করে সে। কিন্তু আজকে একটা অদ্ভুত ঘটনা লক্ষ্য করলো। তার ভালো লাগছে না ব্যস্ত শহর দেখতে। বারবার সকালে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনে হতে লাগলো। এই সাতাশ বছরের জীবনে এমনটা তার সাথে প্রথম হলো। তাকে কেউ অহেতুক কারণে জেলে ভরতে চাইলো। তার সাথে ঘন্টা ধরে ঝগড়া করলো। কিন্তু সেই নারীটি তার মস্তিষ্কে জেকে বসে রয়েছে। অনুভূতিটা বিরক্তিকর নয়। কিন্তু সুখময়ও নয়। আরাফাত বুঝতে পারছে না। তার কি করা উচিত! প্রিয়ন্তী আহমদের চেহারাটা কিছুতেই মাথা থেকে ঝাড়তে পারছে না। শীতের পরিমাণ বেড়েছে, এখনো ফাল্গুনের ছোঁয়া আসে নি ঢাকা শহরে। হয়তো একারণেই মাথাটা জমে রয়েছে। ঠান্ডার সাইড ইফেক্ট হয়তো। আরাফাতের দৃষ্টি বাহিরের দিকে। কিন্তু মাথায় একটি নাম ঘুরপাক খাচ্ছে “প্রিয়ন্তী আহমদ”। হঠাৎ রেলিং এর উপর থাকা মোবাইলটা বেজে উঠলো। ভাবনার সাগর থেকে বেড়িয়ে সিগারেটটা নিভিয়ে মোবাইলটা রিসিভ করলো সে। রিসিভ করতেই একটা মিষ্টি কন্ঠ কানে এলো তার,
– হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম আরাফাত সাহেব?
– ওয়ালাইকুম সালাম, জ্বী বলুন
– আমি এস.এ হসপিটাল থেকে ডা. প্রিয়ন্তী আহমদ বলছিলাম। আপনি কি একটু হাসপাতালে আসতে পারবেন?
– কেনো বলুন তো?
– একটু ইমার্জেন্সি, রাসেল ব্যাপারে। একটু আসতে পারবেন?

প্রিয়ন্তীর কন্ঠে উদ্বিগ্নতা ছিলো। তাই আরাফাত ও দেরি না করে সম্মতি জানিয়ে ফোনটা রেখে দিলো। রাসেলের কি কিছু হয়েছে? চিন্তার ঝুড়ি মাথায় জেকে বসলো। কোনো সময় নষ্ট না করেই ছুটলো হাসপাতালে। চিন্তায় মাথা বন্ধ বন্ধ লাগছে। হাসপাতালে যেতেই………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#আরোও_একবার_বসন্ত
#৩য়_পর্ব

কোনো সময় নষ্ট না করেই ছুটলো হাসপাতালে। চিন্তায় মাথা বন্ধ বন্ধ লাগছে। হাসপাতালে যেতেই প্রিয়ন্তীর সাথে ওয়ার্ডের বাহিরে দেখা হলো আরাফাতের। প্রিয়ন্তীকে দেখেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে তাকে জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে? আপনি বলেছিলেন ইটস ইমারজেন্সি।

আরাফাত রীতিমতো ঘামছে, পৌষের থরথর কাপুনিময় শীতে তার কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। গলার স্বর কাঁপছে, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে রয়েছে যেনো ঝড়ের বেগে ছুটে এসেছে সে। প্রিয়ন্তী একনজরে তাকে পর্যবেক্ষণ করে ধীর কন্ঠে বলে,
– আপনি আগে একটু শান্ত হোন।
– ও ঠিক আছে তো?
– ও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে, আমার সাথে আসুন কিছু ব্যাপারে আপনার সাথে কথা বলার আছে।

আরাফাত কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে শান্ত করে। রাসেল নামক ছেলেটির প্রতি একরকম মায়া সৃষ্টি হয়ে গেছে। লোককথিত আছে, আর্মি, পুলিশদের কোনো মায়া দয়া থাকতে নেই। কিন্তু না চাইতেও রাসেলের প্রতি একপ্রকার টান তৈরি হয়ে গেছে আরাফাতের। একটু শান্ত হবার পর, আরাফাত প্রিয়ন্তীর পিছু পিছু তার ডেস্কে যায়। সে চেয়ারে বসলে প্রিয়ন্তী ধীর কন্ঠে বলে,
– আমরা কিছু টেস্ট করেছি, ওর বা হাতে প্রচন্ড ব্যাথা। প্রথম ভেবেছিলাম হাড় ভেঙ্গেছে হয়তো। যেভাবে মার খেয়েছে এটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সিটিস্ক্যানের পর খেয়াল করলাম, ওর হাত ভাঙ্গে নি কিছু লিগামেন্ট ছিড়ে গেছে। এবং ওর হাড়ের কাছে একটা টিউমার আছে। সেটা বাড়ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আমি রিপোর্টস গুলো আমাদের কন্সাল্টেন্ট ডাক্তার শৌভিক চ্যাটার্জিকে দেখিয়েছি। উনি কিছু টেস্ট দিয়েছে। টেস্ট গুলোর উপর ভিত্তি করে আমরা ফারদার স্টেপ নিবো। যেহেতু ওর কোনো গার্ডিয়ান নেই। সেহেতু আপনার সাথে কথা বলাটা জরুরি ছিলো। যদি টিউমারটা অপারেট করা যায় তাহলে আমরা বলবো অপারেশন করাতে।
– অপারেশন করলে কি ও সুস্থ হয়ে যাবে?
– আশা রাখছি, আসলে টিউমার, ক্যান্সার ব্যাপারগুলো খুব সেন্সিটিভ। আর বয়সটাও ছোট। চিকিৎসাগুলো ব্যয়বহুল। একজন অচেনা মানুষের জন্য এতটা ব্যয়বহুল চিকিৎসা কি আপনি করাতে রাজী?
– আপনি প্লিজ টাকা নিয়ে চিন্তা করবেন না। বাচ্চাটা বেঁচে উঠুক আমি সেটাই চাই।

আরাফাত নির্লিপ্ত কন্ঠে অকপটে কথাটা বললো। প্রিয়ন্তী তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। আজকাল এমন মানুষ হয়? একাবিংশ শতাব্দীতে এসে এমন হাতেম তাই এর মতো মানুষ দেখতে পাওয়াটা কোনো মিউজিয়ামে সংরক্ষিত হাজার বছর পুরোনো ডাইনোসরের হাড়ের মত দূর্লভ ব্যাপার। প্রিয়ন্তীর কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই আবারো জিজ্ঞেস করলো,
– আপনি ওর চিকিৎসা করাতে চান? এটা কিন্তু ব্যয়বহুল চিকিৎসা
– আমি কানে কালা নই ডাক্তার সাহেবা, আমি তো বললাম টাকা নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি কোনো না কোনো ভাবে এরেঞ্জ করবো। ওর চিকিৎসার ত্রুটি রাখবেন না। এটা আমার রিকুয়েষ্ট।

আরাফাতের কথাগুলো নিতান্ত গা জ্বালানো। কিন্তু এখন ঝগড়া করাটা পরিস্থিতি অনুকুল নয়। তাই ছোট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে প্রিয়ন্তী বললো,
– ঠিক আছে, তাহলে কালকে সকাল ১০টার দিকে উপস্থিত থাকবেন। স্যার রাউন্ডের পর আপনার সাথে এই কেসটার ব্রিফিং দিবেন।
– আপনি থাকবেন না?
– জ্বী না, আমার ৯টায় ডিউটি শেষ। আমি এখান থেকে ৯.১৫তে বেড়িয়ে যাই।
– ওহ, রাসেলের সাথে কি একটু দেখা করা যাবে?
– কালকে সকালে করুন, এখন তো আসলে ভিজিটিং আওয়ার নয়। কিছু রুলস আমাদের ফলো করতে হয়
– বেশি না পাঁচ মিনিট নিবো, প্লিজ। পাঁচ মিনিট

আরাফাতের আকুতিভরা আবদারটি কেনো যেনো ফেলতে পারলো না প্রিয়ন্তী। তাই বাধা না দিয়েই রাসেলের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিলো আরাফাতকে। আরাফাত একটি কৃতজ্ঞতাময় হাসি দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। লোকটা হাসলে মন্দ লাগে না। একটু চ্যাটাং চ্যাটাং কথা ব্যাতীত লোকটাকে অপছন্দ করার কারণ খুজে পেলো না প্রিয়ন্তী।

আরাফাত যখন রাসেলের বেডের কাছে গেলো, তখন রাসেল বসে বসে সেলাইনের ক্যানোলা খোঁচাখোঁচি করছে। আরাফাত এসে পাশে বসতেই সে তার কাজ বন্ধ করে একেবারে ভদ্র ছেলের মতো মাথা নিচু করে বসে রইলো। রাসেলের এরুপ কাজ দেখে মুচকি হাসি দিয়ে আরাফাত বললো,
– কি রে? এখানে ভালো লাগছে না
– না সেইডা না। এইখানে সবাই খুব যত্ন নেয়, ওই সুন্দরী ডাক্তার আফাটা তো অনেক ভালো। আমারে চকলেট দিছে। আর এইখানে খাওনের চিন্তা নাই, ওরে খানা। শুধু একটা সমেস্যা বয়ে থাকোন লাগে।
– এতো সুবিধা পাচ্ছিস, একটু অসুবিধাতে কিছু যায় আসে না। এখন শরীরটা কেমন লাগছে?
– বেদনা আছে, তবে এহন কম। বিকাল বেলা সেই ঘুম দিছিলাম। তার আগে ওরে ব্যাথা, ঘুম থেইক্যা উঠার পর একটু কমছে।
– ওহ, ঠিক হয় যাবে। আর ওইরকম কাজ করবি না তাহলেই হবে। আমি আজকে উঠি, নয়তো তোর সুন্দরী ডাক্তার আফা আমাকে পিটাবে। কালকে আবার আসবো। এখন রেস্ট কর।

বলে উঠতে নিলে রাসেল আকুতিময় কন্ঠে ডেকে উঠে,
– ভাইজান?
– কিছু বলবি?
– আপনে খুব ভালা মানুষ। কতলা টাকা যাইতেছে আপনার। আমার কিছু নাই, তবে সাইরে উইঠা আমি আপনার নিকট কাম করাম। এই দেনা তো শোধ করন লাগবে।

রাসেলের কথাটা শুনে কেনো যেনো চোখের কোনটা ভরে এলো আরাফাতের। কিন্তু পুরুষের নাকি কাঁদতে নেই, আর পুলিশের তো একেবারেই বারণ। তাই ধমকের স্বরে বললো,
– সেইটা নিয়ে তোর ভাবতে হবে না, আমার পাওনা আমি আদায় করে নিতে পারবো। থাক তুই আসি।

বলেন এক মূহুর্ত দেরি না করে সেখান থেকে বেড়িয়ে গেলো আরাফাত। রাসেল এবং আরাফাতের কথোপকথন দূর থেকে অবলোকন করলো প্রিয়ন্তী। আজ পাঁচ বছর সে ডাক্তারি প্রাক্টিস করছে। সবসময় এক সিনিয়র ডাক্তারের উপদেশ সে মেনে এনেছে,
“কখনো রোগীর প্রতি মায়া জন্মাতে দিবে না। তাহলে চিকিৎসা করার সময় হাত কাঁপবে।”______
এতোদিন এই উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে সে, কিন্তু অযাচিত কারণে রাসেল নামক ছেলেটার প্রতি মায়া কাজ করছে তার। হয়তো তার বেদনাদায়ক ছেলেবেলাকে উপলদ্ধি করতে পারছে সে। হয়তো তার দূর্ভাগ্য প্রিয়ন্তীর মনের কোনায় দাগ কেটেছে। এই ছেলেটাকে সুস্থ দেখার একটি আশা মনের মাঝে জন্ম নিয়েছে। এখন সবকিছু ওই উপরওয়ালার উপর৷ যিনি সবার ভাগ্য লিখেন, তার ইশারা ব্যাতীত কিছুই সম্ভব নয়__________

সকাল ১০টা,
কন্সাল্টেন্ট ডাক্তার শৌভিক চ্যাটার্জির সাথে দেখা করবে বিধায় অপেক্ষা করছে আরাফাত। কম হলেও আধা ঘন্টা ধরে বসে রয়েছে। কাল সারারাত ঘুম হয় নি, চোখজোড়া লাল হয়ে আছে। মাথায় বিভিন্ন চিন্তা। বড় গলায় বলে তো দিয়েছে চিকিৎসার সকল খরচ বহন করবে কিন্ত এতো বড় টাকাটা জোগাড় করতে খবর হয়ে যাবে তার। একটা লোনের আর্জি দিতে হবে আজকে। সরকারি চাকরি, লোন নিলেই স্যালারি থেকে প্রতিমাসে কেটে নিবে। কিন্তু কিছুই করার নেই। মা জানতে পারলে খবর আছে। চিৎকার করে ঘর মাথায় তুলবেন। লাখ খানিক টাকা অচেনা একটা পথশিশুর জন্য খরচ করবে নিজের আহাম্মক ছেলে সেটা রাফিজা বেগম কিছুতেই মানবেন না। সবকিছু মিলিয়ে বেশ চাপে আছে আরাফাত। এসব চিন্তা করছে এবং নখ কাটছে। তার একটা খুব খারাপ স্বভাব আছে। চিন্তায় পড়লেই নখ কাটে।
– নখ কাঁটলে বুদ্ধি কমে যায়, এই কথাটা তো একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাও জানে। আপনি হয়তো ব্যতিক্রম

কন্ঠটা কানে আসতে মাথা তুলে তাকায় আরাফাত। তার সামনে প্রিয়ন্তী দাঁড়ানো। কিন্তু তার তো ডিউটি শেষ। তাহলে! অবাক কন্ঠে আরাফাত জিজ্ঞেস করে,
– আপনি? আপনার তো ৯টায় ডিউটি শেষ। তাহলে?
– রাসেলের ব্যাপারে শৌভিক স্যারের সাথে কথা বলতে থেকে গেছি।
– কথা হয়েছে?
– হুম, আগামী সোমবার স্যার অপারেশন করবেন। রবিবারের মধ্যে কিছু ব্লাড ডোনার যোগাড় করে ফেলতে হবে। যত তাড়াতাড়ি অপারেশন হবে ততটা ভালো হবে।
– ওহ, আচ্ছা অপারেশনের কস্টটা কত?
– আপনি হাজার চল্লিশ যোগাড় করুন
– এতো কম?
– হুম। টিউমারটি বেশি ক্রিটিক্যাল নয়৷
– ওহ, আমি কি ডাক্তারের সাথে কথা বলতে পারবেন?
– জ্বী, স্যার কেবিনে আছেন। থাকুন তাহলে আমি আসি।

বলেই প্রিয়ন্তী হাটা দিলো। প্রিয়ন্তীর যাবার পর আরফাত একদৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলো। প্রিয়ন্তী নামক মেয়েটির মাঝে কিছু একটা রয়েছে যা আরাফাতকে আকর্ষণ করতে যথেষ্ট। ঠোঁটের কোনায় অজান্তেই প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো আরাফাতের। এখন গন্তব্য ডা. শৌভিকের কেবিন।

বাসায় পৌছাতে পৌছাতে এগারোটা বেজে গেলো প্রিয়ন্তীর। চব্বিশ ঘন্টা টানা ডিউটি করে শরীরটা যেনো চলতেই চাচ্ছে না। কাল রাতে দু ঘন্টা ঘুম হয় নি প্রিয়ন্তীর। এখন নিজ রুমে যেয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিবে সে। কিন্তু বাসায় ঢুকেই……….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here