#আরোও_একবার_বসন্ত,০৪,০৫
#৪র্থ_পর্ব
বাসায় পৌছাতে পৌছাতে এগারোটা বেজে গেলো প্রিয়ন্তীর। চব্বিশ ঘন্টা টানা ডিউটি করে শরীরটা যেনো চলতেই চাচ্ছে না। কাল রাতে দু ঘন্টা ঘুম হয় নি প্রিয়ন্তীর। এখন নিজ রুমে যেয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিবে সে। কিন্তু বাসায় ঢুকেই দেখলো কিছু মানুষ ড্রয়িং রুমে জড় হয়ে বসে রয়েছেন। জাহানারা বেগম তাদের আপ্পায়নে ব্যাস্ত। শিপন হেসে হেসে কথা বলছে তাদের সাথে। প্রিয়ন্তী ঘরে ঢুকতেই জাহানারা বেগম তাকে দেখে বললেন,
– ওই তো আমার মেয়ে চলে এসেছে। প্রিয়ু এখানে আয় মা।
চব্বিশ ঘন্টা রামগাধার মতো টানা খাটার পর এখন চিড়িয়াখানার অবাককরা জন্তুর মতো মানুষের সামনে নিজেকে প্রদর্শন করতে হবে কথাটা ভাবতেই মাথার বা পাশের শিরাটা রাগে ফুলে উঠলো। মেজাজ এখন অত্যন্ত খারাপ, মোটামোটি সপ্তম আসমানে। দাঁতে দাঁত পিশছে। না জানি কি করে ফেলবে সে। কিন্তু এখানে সিন ক্রিয়েট করাটা বুদ্ধিমানের হবে না। তাই মুখে মেকি হাসি রেখেই তাদের সালাম দিলো প্রিয়ন্তী,
– আসসালামু আলাইকুম
– ওয়ালাইকুম সালাম, আসো আমার পাশে বসো।
সোফায় বসা আনুমানিক চল্লিশোর্ধ্ব বয়সী একজন ভদ্রমহিলা চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রিয়ন্তীর উদ্দেশ্যে কথাটা বললো। প্রিয়ন্তী মুখে মেকি হাসিটা এখনো বজায় রাখলো। তার বুঝতে বাকি নেই ইনারা কেনো বাসায় এসেছেন। কাল যাদের কথাটা তার মা ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছিলেন, ইনারা তারাই। জাহানারা বেগম পুনরায় নিজের মেয়ের বিয়ের জন্য তোড়জোড় করছেন। চার বছর আগের কথাটা যেনো তিনি ভুলেই গেছেন। প্রিয়ন্তী সেখানে বসতেই মহিলাটি বলে উঠলেন,
– তোমার কি ডিউটি ছিলো?
– জ্বী, টুয়েন্টি ফোর আওয়ার ডিউটি ছিলো কাল।
– কয় বছর হয়েছে চাকরির?
– পাঁচ বছর হতে চললো
– আমাদের আবার টাকার অভাব নেই, ভাইয়া দু হাতে টাকা টাকা কামাই করেছে। এখনো আমাদের প্রতিপত্তির অভাব নেই। সুতরাং বিয়ের পরে তোমার চাকরিটা করা লাগবে না। তুমি রিত্তর খেয়াল রাখবে, ভাইয়ার খেয়াল রাখিবে এটাই যথেষ্ট হবে৷ জানোই তো মানুষটি একা। তার এখন একজন সাথীর খুব প্রয়োজন। আর বাড়ির বউ কাজ করবে এটা তো ভালো দেখায় না। আমার ভাবীও গৃহিনী ই ছিলেন।
মহিলা স্পষ্ট কন্ঠে প্রিয়ন্তীকে জানিয়ে দিলেন তাদের বাড়ির বউ হিসেবে তারা কেমন মেয়ে পছন্দ করেন। প্রিয়ন্তীর হাসি পেলো৷ তারা একরকম ঘরে চব্বিশ ঘন্টা কামলা দিবে এমন মেয়ে চান, তাহলে একজন ডাক্তারকে কেনো বিয়ের জন্য প্রস্তাব দিতে এসেছেন! ঠোঁটের কোণায় বাঁকা হাসি ফুটিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো সে,
– আমি আপনাকে কি বলে সম্বোধন করবো বুঝছি না, আপুই বলি। একটা প্রশ্ন ছিলো করতে পারি?
– হ্যা করো?
– আমি পেশায় ডাক্তার, সেটা হয়তো মা আপনাদের জানায় নি
– না না তা হবে কেনো? আমরা তো জানি তুমি ডাক্তার। এজন্যই তো আরো আগ্রহী হলাম৷ তোমার মতো শিক্ষিত মেয়ে বাড়ির বউ হবে এটা তো আমাদের সৌভাগ্য
– ওহ, তাই বুঝি? আচ্ছা তাহলে কি আপনাদের বাড়ির হাউসকিপার হতেও সি.ভি তে এম.বি.বি.এস ডিগ্রিটা থাকতে হয়?
– বুঝলাম না ঠিক!
মহিলার মুখের রংটা খানিকটা বদলে গেলো। তার চোখজোড়া সরু হয়ে এলো, ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে এক বিন্দুতে মিললো। চোয়ালজোড়া শক্ত। কন্ঠে কৌতুহলতার সাথে খানিকটা ক্ষোভ। এসব কিছু অগ্রাহ্য করে প্রিয়ন্তী বলতে লাগলো,
– আপু, আমি একজন ডাক্তার। প্রফেশনটাকে প্রচন্ড সম্মান করি আমি। কাগজে সীমাবদ্ধ করে রাখবার জন্য আমি আমার এম.বি.বি.এস ডিগ্রিটি নেই নি। সুতরাং আপনারা চান বা না চান আমি আমার চাকরি ছাড়বো না। আর একটা কথা, আমার এই বিয়েটা প্রথম নয়। এটা আমার দ্বিতীয় বিয়ে। তাই আমার বিয়ে জনিত আগ্রহটি নেই বললেই চলে। তাই প্রথমবারের মতো এই বিয়েতে কোনো রকম ছাড় দিতে রাজী নই। না আমি নিজেকে বদলাবো, না সেটার চেষ্টা করবো। আমি যেমন তেমন ই আমাকে গ্রহণ করতে হবে। আমি আর বসে থাকতে পারছি। অত্যন্ত ক্লান্ত। আমি এখন ঘুমাতে যাবো। তাই আমি উঠছি। সিঙ্গারা ঠান্ডা হচ্ছে। মায়ের হাতের সিঙ্গারা অনেক মজা। খাবেন কিন্তু
বলেই উঠে দাঁড়ালো প্রিয়ন্তী। গটগট করে নিজের রুমের দিকে হাটা দিলো। এক মিনিট ও পিছনে ঘুরে দেখলো না। তাহলে হয়তো ভদ্রমহিলার কালো মেঘে ডাকা মুখটি তার নজরে পড়লো। মহিলা কোনো কথা বললেন না। তার ইগোতে বড়সড় একটা ধাক্কা লেগেছে। তাই সে এই বাড়িতে এক মূহুর্তের জন্য থাকবে না। এখনই বেড়িয়ে যাবেন। শিপন এবং স্নেহার মুখটা পাংশু হয়ে গেছে। জাহানারা বেগম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। মেয়ের কথায় প্রতিবাদ করার ফাঁক পাচ্ছেন না। মেয়ে তার দিক থেকে কোনো ভুল কথা বলে নি। প্রথমবার বাবা-মার সম্মান রক্ষার্থে যতটা ঝড় ঝাপটা সহ্য করেছে সেটা মুখে বলার মতো নয়। কিন্তু মেয়েটার বিয়েটা তো দিতে হবে। আর ছেলের সাথে তার আমরণ থাকতে হবে। যাতাকলের মাঝে একরকম পিশছেন তিনি। কেউ যদি এমন হতো যে প্রিয়ুকে ঠিক তার মতো করে ভালোবাসতো, তাহলে হয়তো মেয়েটার জীবনটা এমন ফ্যাকাশে থাকতো না__________
ব্যাগটা টেবিলে রেখে বিছানায় বসলো প্রিয়ন্তী। আবহাওয়া ঠান্ডা, এটা ঝড়ের পূর্বাভাস। ড্রয়িং রুমে যা করে এসেছে তারপর একটা শান্তির ঘুম সে দিতে পারবে সে গুড়েবালি। দরজায় কড়া নাড়লেই তার বুঝতে বাকি রইলো না কে এসেছে। ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
– ভেতরে আয়
– ওখানে ওটা কি হলো?
তীব্র গতিতে ঘরের ভেতরে এসেই শিপন ক্ষিপ্র কন্ঠে কথাটা বলে উঠলো। তার ক্ষিপ্রতা কে অগাহ্য করে বললো,
– কি করেছি?
– ওখানে বেয়াদবি না করলে হতো না
– আমি কোনো বেয়াদবি করি নি। আমার যেটা ঠিক মনে হয়েছে আমি সেটা করেছি।
– তুই রীতিমতো বেয়াদবি করেছিস। তুই আসলে বিয়েটা কিভাবে ভেস্তে দিবি সেটাই তোর মাথায় ছিলো। এই বিয়েটা যতই ভালো হোক না কেনো তুই করবি না। এটাই হলো সত্যি। আসলে এর মাধ্যমে আমার একটু প্রমোশন হতো। এটা তোর সহ্য হলো না। তোর সমস্যাটা কি আপু?
– তোদের সমস্যাটা কি?
একরকম চিৎকার করে উঠলো প্রিয়ন্তী৷ এতোক্ষণ সব চুপ করে সহ্য করছিলো। কিন্তু আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
– আমাকে একদন্ড শান্তি দিতে তোদের কি লাগে? কি লাগে? চার বছর আগে তুই কি বাচ্চা ছিলি? জানতিস না কিছু? আমি কতোটা ভঙ্গুর অবস্থায় এখানে এসেছিলাম তোর জানা ছিলো না। আমি একটু নিশ্চিন্তের শ্বাস নিতে চাই শিপন। তোদেরটা খাই না পড়ি না। নিজের শরীরের উপর দিয়ে কি যায় আমি জানি। তার মাঝে আমি ডিউটি করি। নিজেরটাও সাথে মানুষের টাও। যাতে কটা টাকা বেশি পাই। তাতেও তোদের কাছে আমি বোঝা হয়ে গেছি তাই না? কোথায় ছিলি তুই যখন দিনের পর দিন আমাকে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলে যেতো। কোথায় ছিলি তুই যখন টায়ফয়েডের মধ্যে আমাকে একটা ঘরে একা একা পড়ে থাকতে হতো? স্বামী থাকতেও না থাকার মতোই ছিলো। কোথায় ছিলি তুই যখন সব কিছু সহ্য করার পরও তাকে অন্য কারোর সাথে আমার দেখতে হয়েছে? কোথায় ছিলি তুই যখন আমি দিনের পর দিন এন্টিডিপ্রেশনের ঔষধ খেয়ে পড়ে থাকতাম। কোথায় ছিলি তুই? তুই না আমার ভাই? এখনই বেড়িয়ে যা আমার ঘর থেকে। যা বের হো
এক রকম ধাক্কা দিয়েই রুম থেকে বের করে দিলো প্রিয়ন্তী তাকে। চার বছরের ক্ষতগুলো যেনো জীবন্ত হয়ে উঠছে। ক্ষত থেকে টুপটুপ করে রক্ত পড়ছে। এই রক্ত কেউ দেখতে পারবে না। এটা শুধু অনুভব করার ব্যাপার। ইরফান নামক কালো অধ্যায়টা এখনো এমন একটা অধ্যায় যার ধার ঘেষতে ও ভয় লাগে এখনো প্রিয়ন্তীর। চোখটা বুঝতেই চার বছরের পুরোনো স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
সেদিন ছিলো এপ্রিলের ১৫ তারিখ। দিনটি প্রিয়ন্তী এবং ইরফানের পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী। হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়েছিলো প্রিয়ন্তী। পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী বলে কথা। ইরফান বলেছিলো আজ সারাটাদিন হবে শুধু তার এবং ইরফানের। কিন্তু অফিসের কাজের জন্য সকালেই বেড়িয়ে পড়েছিলো সে। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো কিন্তু ইরফানের ফেরার নাম নেই। তাই প্রিয়ন্তী ভেবেছিলো ইরফানকে একটা সারপ্রাইজ দিলে হয়তো মন্দ হয় না। যেমন ভাবা তেমন কাজ। তৈরি হয়ে রওনা দিলো ইরফানের অফিসে। সে তো জানতো না সেখানে তার সম্মুখীন হতে হবে বাস্তবতার সাথে। ইরফানের অফিস রুমের সামনে যেতেই………………..…
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#আরোও_একবার_বসন্ত
#৫ম_পর্ব
সে তো জানতো না সেখানে তার সম্মুখীন হতে হবে বাস্তবতার সাথে। ইরফানের অফিস রুমের সামনে যেতেই কিছু কথোপকথন কানে আসে প্রিয়ন্তীর। কন্ঠস্বর দুজনের ছিলো। একজন পুরুষ এবং একজন নারী। পুরুষটির কন্ঠটি তার চিরচেনা কন্ঠ। নারীটি আহ্লাদী কন্ঠে বললো,
– দেখতে দেখতে চার মাস কেটে গেলো। কবে ডিভোর্স আপিল করবে তুমি? এদিকে আমাকে ঝুলিয়ে রেখেছো। বাবা বিয়ের জন্য তোড়জোড় করছে। আমি কিন্তু আর অপেক্ষা করতে পারবো না। এই বলে রাখলাম
– সরি বাবু, কি করবো? এতো মারি তাও আটার মতো গায়ে লেগেই আছে। চেষ্টা তো করতেছি। একটু সময় দাও।
– আর কত সময়? তুমি যা করার তাড়াতাড়ি করো
– আমি নেশা করি জেনেও আমার সাথেই আছে, আমি ওকে যে মারাটা মারি তাও আমার সাথেই আছে। এমনকি বাসায় একটা কথাও বলে না। ডিভোর্স পেপারটাও রেডি হয়ে আছে কিন্তু কিভাবে দিবো বুঝতে পারছি না। আমি চেয়েছিলাম ও যাতে নিজ থেকে আমাকে ছেড়ে চলে যায়। মাঝে মাঝে মন চায় ওই মেয়েকে মেরেই ফেলি।
কথাটা শুনে প্রিয়ন্তীর মাথাটা এক মিনিটের জন্য বন্ধ হয়ে গেলো। এই মানুষটার শত অত্যাচার মুখ বুজে সে সহ্য করে এসেছে। তার গায়ের ক্ষতগুলো চিৎকার করে তার জানান দিচ্ছে। তবুও এতো কিছুর পর একটা জোর ছিলো মানুষটা অন্তত তার একান্ত। কিন্তু সেই চিন্তাটা কাঁচের আয়নার মতো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। চোখ থেকে মনের অজান্তেই পানি পড়ছে। আর দাঁড়িয়ে থাকার ইচ্ছে হলো না তার। কিন্তু পা টাও চলতে চাচ্ছে না। অনেক কষ্টে মনের বিরুদ্ধে কোনো মতে বাড়ি পৌঁছালো প্রিয়ন্তী। বাসায় পৌছাতে না পৌছাতেই ফোনটা বেজে উঠলো তার। ফোনের স্ক্রিনে “বাবা” নামটি ভেসে উঠলো। শাহাদাত সাহেব বড় মেয়ে বলতে পাগল। মেয়ের সাথে দিনে অন্তত পক্ষে পাঁচবার কথা না বললে তার হয় না। দুঘন্টা আগেও ফোন দিয়েছিলেনে। কাঁপা হাতে ফোনটি রিসিভ করে সে। নিজেকে আপ্রাণ চেষ্টায় স্বাভাবিক রেখে বলে,
– বাবা, আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছো?
– কি রে প্রিয়ু মা, ফোন ধরতে এতো দেরি করলি কেনো?
– ফোন কাছে ছিলো না বাবা, তাই? তুমি কেমন আছো? ঔষধ খাইছো?
– তোর মন খারাপ মা? কিছু হয়েছে?
শাহাদাত সাহেব মেয়ের কন্ঠ শুনেই কিছু একটা অনুমান করতে পারলেন। তার প্রশ্নে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো প্রিয়ন্তী। হাউমাউ করে কাঁদতে মন চাইছে কিন্তু কাঁদতে পারছে না। বাবা পাছে বুঝে ফেললে কষ্ট পাবেন। নিজেকে দমিয়ে রেখে ধীর কন্ঠে বললো,
– বাবা আমি ভালো আছি, একটু ক্লান্ত৷ আর আবহাওয়ার কারণে গলাটা বসে গেছে।
– জামাই কি আসে নি বাসায়?
– ওর মিটিং পড়ে গেছে তো তাই আসতে দেরি হবে। বাবা আমি তোমাকে রাতে ফোন করবো। এখন রাখছি।
বলেই ফোনটা কেটে দিলো প্রিয়ন্তী৷ ফোনটা কাটতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সে। চিৎকার করে কাঁদছে কিন্তু দেখার কেউ নেই। কান্নাটা ঘরের চার দেয়ালেই সীমাবদ্ধ। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো বুঝতে পারলো না।
রাত ৮টা,
প্রিয়ন্তীর যখন ঘুম ভাঙ্গলো সে দেখলো ইরফান তার পাশে বসে রয়েছে। মুখে চিন্তার চাপ। সে প্রিয়ন্তীকে ড্রয়িং রুমের মেঝেতে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকতে দেখতে পাজাকোল করে রুমে নিয়ে এসেছিলো। বিছানায় শুইয়ে তাকে নানা ভাবে জ্ঞান ফিরানোর চেষ্টায় লিপ্ত ছিলো। প্রিয়ন্তীকে উঠতে দেখে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– প্রিয়ু তুমি ঠিক আছো তো? তোমার শরীর খারাপ করছিলো? মেঝেতে তোমাকে পেয়েছি আমি
ইরফানের উদ্বিগ্ন মুখটা ঠিক আগের মতোই রয়েছে। বিয়ের প্রথম দিকে ঠিক যেমন থাকতো, যখন রান্না করতে যেয়ে ভুলে হাত পুড়িয়ে ফেলতো প্রিয়ন্তী তখন সে এভাবেই উদ্বিগ্ন হয়ে যেতো। প্রিয়ন্তীর এখনো মনে হলো লোকটা শুধু তারই আছে। ইরফানকে দেখেই তাকে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়ন্তী। হু হু করে কেঁদে উঠলো। অস্পষ্ট স্বরে বললো,
– খুব ভালোবাসি তোমায়, আমাকে মারো কাটো যাই করো আমাকে একা করে দিয়ো না প্লিজ৷ আমি পারবো না তোমাকে ছাড়া থাকতে। আমি তোমার ঘরে কাজের মানুষ হয়ে থাকবো। তাও আমাকে একা ছেড়ে যেও না
নিজের আত্নসম্মানের বলি দিয়ে শুধু তার ভালোবাসার মানুষটিকে কাছে পাবার আকুতি করতে লাগলো প্রিয়ন্তী। প্রিয়ন্তী কাঁদছে। হু হু করে কাঁদছে। তার চোখজোড়া ফুলে গিয়েছে। তার আকুতিতে হয়তো পাথর ও গলে যাবে। ইরফান তো একজন রক্ত মাংসের মানুষ। প্রিয়ন্তীকে খুব যত্নের সাথে জড়িয়ে ধরলো সে। বুকের কাছে আগলে ধরে বললো,
– আমাকে ক্ষমা করে দিও প্রিয়ু, আমি ভুল করে ফেলেছি। আমায় ক্ষমা করো। আর হবে না এই ভুল। আমি পাপ করছিলাম। আমাকে ক্ষমা করো।
কথাটা যেনো খরার মাঝে এক পশলা বৃষ্টির ন্যায় কাজ করলো। প্রিয়ন্তীর কাছে মনে হলো, তার মানুষটি আবারও তার কাছে ফিরে এসেছে। নিজের আত্নসম্মানের জ্বলাঞ্জলি দিয়ে হলেও সে টিকিয়ে রাখতে পারবে তার সম্পর্ক। কিন্তু সে জানতো এসব কিছুই তার নিছক কল্পনা মাত্র, বাস্তবতা খুব কঠিন এবং নির্মমতায় ঘেরা।
দু মাস সব কিছুই খুব ভালো চলছিলো। না ইরফান তাকে মারতো না বকতো। তাদের বৈবাহিক জীবন খুব শান্তিপূর্ণভাবে এগোচ্ছিলো। প্রিয়ন্তীও নিশ্চিন্তে তার বাবার বাড়ি ঘুরতে গিয়েছিলো। কিন্তু এক সকালে একটা কুরিয়ার তার জীবনটাকে ৩৬০ ডিগ্রি কোনে ঘুরিয়ে দিলো। ইরফান তাকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে। পেপারটা রিসিভ করার পর যেনো প্রিয়ন্তীর সাজানো দুনিয়াটা পুনরায় ভেঙ্গে গেলো। শাহাদাত সাহেব রেগে ইরফানকে ফোন দেন। তার ফুলের মতো মেয়েটির জীবনটা এভাবে শেষ করে ফেলবে এটা তিনি কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। ইরফানকে যখন প্রশ্নবিদ্ধ করেন তিনি তখন ইরফানের উত্তর ছিলো,
– আমি তাকে ভালোবাসি না
– কিহ? কি সমস্যা হয়েছে আমার মেয়ের? আমার মেয়ের কোনো তো খুদ থাকবে!
– আপনার মেয়েকে ভালো লাগে না।আর আপনার মেয়েকে তো মেরে ফেলি নি এটা আপনার ভাগ্য ভালো। আমি তো ওকে মেরেও ফেলতে পারতাম।
কথাটা শুনে একজন বাবার মাথার উপর যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। যে মেয়ের সাথে তিনি উচ্চ বাক্যে কথাও বলেন নি সে মেয়েটি দিনের পর দিন শুধু লাঞ্চনা, অত্যাচার পেয়েছে। ইরফানের বাবা-মার ও কোনো ভাবের পরিবর্তন হলো না। ছেলের ইচ্ছে তাদের ইচ্ছে। শাহাদাত সাহেব একবার চেয়েছিলেন ইরফানকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিবেন। নারী নির্যাতনের কেসে জেলে দিবেন তাকে। কিন্তু প্রিয়ন্তীর জন্য কিছুই পারলেন না। অনেকে তাকে বোকা বলেছে, অনেক তাকে আত্নসম্মানহীন বলেছে। কেউ কেউ তো তাকে নারী রুপে কলঙ্ক বলেছে কারণ সে প্রতিবাদ করে নি। অন্যায়কে মুখ বুঝে সহ্য করেছে। আবার কেউ কেউ তার চরিত্রে দাগ তুলেছে। বলেছে হয়তো তার চরিত্রেই ঝামেলা ছিলো। কিন্তু প্রিয়ন্তীর কাছে ইরফান তার প্রথম ভালোবাসা ছিলো৷ সেই মানুষটাকে কিভাবে ঝামেলায় ফেলবে সে! আর যতই হোক, কোর্ট কাচেরিতে মেয়েদের সম্মানহানিটাই বেশি হয়। বাবাকে এই বয়সে এতোটা যন্ত্রণা দেবার কথা সে ভাবতে পারছিলো না। তাই সব মেনে ডিভোর্স পেপারে সিগনেচার করে প্রিয়ন্তী। পাঁচ বছরের আঘাতটা মেনে নিতে তার দেড়টা বছর লেগেছে। প্রথমে মানুষের সামনে যেতেও তার ভয় হতো। সেই ভয়ে নিজেকে এক ঘরে আটকে রাখতো সে। যখন দম বন্ধ লাগতো ঘুমের ঔষধ খেয়ে পড়ে থাকতো। এই সময়টা শাহাদাত সাহেব তাকে মানষিক ভাবে সম্পূর্ন সাপোর্ট দিয়ে গেছেন। তবে কোথাও না কোথাও একটা ক্ষোভ জন্মাতোই। মেয়েটাকে না জানি কতোটা যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে এটা ভেবেই সকলের দৃষ্টির অগোচরে অশ্রুবিসর্জন করতেন। কিছুদিন পর জানতে পারে ইরফান আবার বিয়ে করেছে। প্রিয়ন্তী আরোও ভেঙ্গে পড়ে। এই কষ্টের জোয়ার থেকে বের হতে দু বছর লেগেছে প্রিয়ন্তীর। এখনো সেই বইটা খুলতে ভয় পায়। আজ আবারো সেই বইটা তার খুলতে হয়েছে। শুধু শিপনের জন্য। মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন বারবার নিজেকে করে প্রিয়ন্তী। এসব কিছু কেনো তার সাথেই হয়? কেনো? কিন্তু কোনো উত্তর নেই।
রাত ৮টা,
ক্যাফেতে বসে রয়েছে প্রিয়ন্তী। বাসায় দম আটকে আসছিলো তার। বান্ধবীদের সাথে আড্ডা মারলে হয়তো শান্তি লাগবে। তাই এখানে আসা। পাশে বসে রয়েছে নিশাত এবং আফসারা। এই দুজন প্রিয়ন্তীর খুব ভালো বন্ধু। একটু পাগল কিন্তু তাদের পাশে না পেলে হয়তো এই কঠিন সময়টা কখনোই সে পার করতে পারতো না।
– শুনলাম আন্টি আবার তোর বিয়ের কাজ শুরু করেছে, এবারের লোকটা কে?
নির্বিকার ভাবেই প্রশ্নটি করে নিশাত। নিশাতের প্রশ্নের অগাহ্য করেই আফসারা বলে উঠে,
– তুই বিয়েটা এবারো ভাগিয়ে দিয়েছিস নাকি?
– হ্যা,
– কেনো? এবারেরটাতে কি ঝামেলা?
– লোকটা বিধবা, সাথে একটা পনেরো বছরের একটা মেয়েও আছে। কিন্তু প্রব্লেম টা এটা নয়। সে একজন ন্যানী চাচ্ছে তার বাসার জন্য এবং সেই ন্যানী যাতে তার সেক্স পার্টনার হয়।
– দেখ আমাদের দুজনের দুবার করে বিয়ে হয়েছে। তুই ই একজন যার একটা বিয়ে, এটা আলাদা ব্যাপার যে আমাদের একই মানুষের সাথেই দুবার বিয়ে হয়েছে। বাট তাও।
নিশাতের এমন কথায় মুচকি হাসি দিয়ে প্রিয়ু বলে,
– দোস্ত আমিও চাই আমার একটা সংসার হোক, আমার বাচ্চাকাচ্চা হোক। ইরফানের সাথে আমার সংসারটা আমার নিজের হাতের ছিলো। আমি এখনো চোখ বন্ধ করলেই আমাদের বাড়িটা দেখি। আমি একটা টক্সিক রিলেশনে ছিলাম এটা যেমন ঠিক এটাও ঠিক দিন শেষে আমার মনে হতো আমার কেউ তো আছে। আমি একা নই। বাবা মারা যাবার পর থেকে এই একাকীত্ব যেনো আরো গাঢ় হয়েছে। তবে এর মানে এটাও না আমি ফেলনা, ব্যাপার টা সে আমার থেকে বয়সে বড় কিংবা আমার থেকে বয়সে ছোট নয়। আমি এমন একজনকে চাই যে আমাকে আমার খুদ সহ আমাকে ভালোবাসবে। আমি আর কমপ্রোমাইজ করবো না। আমি কারোর মনোরঞ্জনের খোরাক হতে চাই না।
প্রিয়ন্তীর কথার যুক্তি আছে। তাই নিশাত এবং আফসারা কিছুই বললো না। বরং টপিক ঘুরিয়ে অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথাবার্তা শুরু করলো। তারা তাদের আড্ডা শেষে যে যার বাসার দিকে রওনা দিলো। যতই হোক তাদের একটা হ্যাপি লাইফ আছে। একটা সংসার আছে। সবাই চলে গেলে প্রিয়ন্তী সেখানে একা দাঁড়িয়ে থাকে। আকাশের দিকে শুণ্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে যে। কতটা একা সে! ইশ কেউ যদি তার জীবনেও আসতো। আরোও একবার বসন্ত যদি তার জীবনেও আসতো। তখনই………….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি