#আরোও_একবার_বসন্ত,০৬,০৭
#৬ষ্ঠ_পর্ব
আকাশের দিকে শুণ্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে প্রিয়ন্তী। কতটা একা সে! ইশ কেউ যদি তার জীবনেও আসতো। আরোও একবার বসন্ত যদি তার জীবনেও আসতো। তখনই একটা মটরসাইকেল তার ঠিক গা ঘেষে চলে যায়। এতোটা গা ঘেষে চলে যায় একটু সময়ের জন্য মনে হলো একটুর জন্য প্রাণপাখি খাঁচাছাড়া হয় নি। বুকটা কাঁপছে প্রিয়ন্তীর। সে একেবারে রাস্তার মাঝখানেও দাঁড়িয়ে নেই। হ্যা, ড্রেইনের কাজের জন্য ফুটপাত বাদ দিয়ে রাস্তার ধার ঘেষে হাটছে। লোকটাকে দু কথা শুনিয়ে দিলে মন্দ হবে না। বরং মনের কালো মেঘের কিছুটা বর্ষণও ঘটবে। সব বর্ষণ শুধু অশ্রুপাতেই হয় না, কিছু কিছু বর্ষণ মানুষকে ধাতানি দিয়েও ঘটানো যায়।
– যদি চোখ পকেটে নিয়েই বাইক চালাতে হয় তাহলে রাস্তায় না চালিয়ে সার্কাসে গিয়ে বাইক রাইড করেন। তাহলে দুটাকা বেশি কামাই হবে।
কথাটা এতোটা জোরে বললো যে বাইক ওয়ালা তার থেকে দশ মিটার সামনে যেয়েও বাইকে ব্রেক কষে। একটা কালো জ্যাকেট পরণে, কালো হেলমেট মাথায়। লোকটার মুখ দেখার কোনো উপায় নেই। লোকটা বাইক থামাতেই গটগট করে হেটে তার কাছে যায় প্রিয়ন্তী। প্রিয়ন্তীর চোখে আগুণ স্পষ্ট। কাছে যেতেই হিনহিনে কন্ঠে বলে,
– আরেকটু হলে তো আমার আর এ দুনিয়াতে থাকা লাগতো না। এটা তো মানুষের রাস্তা, গরু ছাগলের নয়। তাই একটু চোখ খুলে গাড়ি চালালে একটু উপকার হয়। চোখে না দেখলে চেম্বারে আসিয়েন, এপোয়েন্টমেন্ট দিয়ে দিবো।
প্রিয়ন্তীর চেচামেচিতে মোটামোটি বেশ লোক ই জড়ো হয়েছে। বিনা টিকিটে শুটিং দেখার মজা আমাদের দেশের মানুষ মোটেও হাতছাড়া করতে চায় না। কোথাও কিছু হোক বা না হোক, সেখানে যদি একটু চেঁচামেচির আভাষ পাওয়া যায় তবেই সকল কাজ বাদ দিয়ে জড়ো হয়ে যাবেন। তাতে আপনার লাভ হোক বা না হোক। অনেকে তো নিজের মোবাইল ফোনের ভিডিও ও অন করে ফেলবেন। প্রিয়ন্তীর আশেপাশেও বেশ লোক জড়ো হয়েছে। কেউ কেউ তো বলছে,
– আরে একটা ফটফটি পেয়েছে তাই আকাশে উড়ছে এরা। এদের কোনো কান্ডজ্ঞান আছে নাকি। সাপের মতো বাকায়ে বাকায়ে কিভাবে চালায় মোটরসাইকেল! এদের এটা দেখার সময় ও নেই রাস্তায় কেউ চলেও। পুলিশে ধরিয়ে দিলেই লাইসেন্স ক্যান্সেল হয়ে যাবে।
লোকজনের জড়ো হওয়াতে একটা লাভ ও হয়েছে প্রিয়ন্তীর। ইচ্ছে মতো মনের ক্ষোভ মেটাতে পারবে। জড়তাবিহীন গলায় বললো,
– একটু হলেই তো আমাকে উড়িয়েই দিচ্ছিলেন? তা বলি কোন ট্রেন টা ধরতে যাচ্ছিলেন? এখন কথা বলছেন না কেউ? পুলিশের কাছে যখন ধরিয়ে দিবো একদম কাঠির মতো সোজা হয়ে যাবেন। এই আজকালকার জেনারেশনের প্রবলেম বাবা-মা একটা বাইক কিনে দিতে না দিতেই সেটা নিয়ে স্টান্ট করা লাগবে। নিজের না এটলিষ্ট নিজের বাবা-মার কথাটা তো ভাববেন। আপনাদের কিছু হলে কি হবে তাদের? না সেটা ভাবার সময় কি আছে এই মহাশয় দের। তাদের তো বাইক নিয়ে সার্কাস দেখাতে হবে। এবার যদি একটা শিক্ষা না পাও কখনোই সোজা হবেন না। তাই আমার সাথে থানায় যাবেন। এখন মানে এখনই।
– তা কোন থানায় নিয়ে যাবেন? মিরপুর মডেল পুলিশ স্টেশন?
হেলমেটটা খুলতে খুলতে কথাটা বলে উঠলো লোকটা। হেলমেট খুলতেই প্রিয়ন্তীর মুখে কুলুপ এটে গেলো। লোকটা আর কেউ নয় আরাফাত। আরাফাত নামক লোকটার সাথে তার এই নিয়ে দু দু বার ঝগড়া বাধলো, এবং দুবার ই সে তাকে থানায় নিয়ে যাবার হুমকি দিয়েছে। লজ্জায় শ্যামলা মুখখানা একেবারে কমলা রঙ ধারণ করলো। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। আরাফাত মিটিমিটি হাসছে, প্রিয়ন্তীর এই মুখটা তার খুব ভালো লাগে। যেই স্পিডে চড়াও হয় ঠিক সেই স্পিডেই দমে যায়। হাসতে হাসতে ভিড়ে উপস্থিত মানুষদের বললো,
– কাকা, আমি নিজেই পুলিশের লোক। আমাকে থানায় দিয়ে লাভ নেই। আপনারা যে যার কাজে যান।
কথাটা শুনতেই ভিড় হালকা হতে লাগলো। প্রিয়ন্তী এখনো ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার এতোগুলো বাক্য শুধু করচ করেছে সে। হাত দিয়ে কপালের চুলগুলো সরাতে সরাতে আরাফাত বললো,
– উঠে পরুন বাসায় ড্রপ করে দিচ্ছি।
– না লাগবে না, আমি যেতে পারবো।
– সমস্যা নেই, মাঝে থানাতেও থামবো না হয়। আপনি একটা রিপোর্ট করেই ফেলুন। বলা তো যায় না আবার কোন কেসে থানায় নিয়ে যাবার হুমকি দেন।
– এটা মোটেও আমার দোষ নয়, জানেন কি ভয় পেয়েছিলাম।
– তাই লিফট দিচ্ছি, আসলে একটু তাড়ায় ছিলাম। আর এতো রাতে একা একজন মেয়ের চলাফেরা করাও ঠিক নয়। আর আমি বাচ্চা, বয়স্ক এবং সুন্দরীদের সাহায্যের জন্য সবসময় নিয়োজিত।
চোখ টিপ্পনী দিয়ে আরাফাত কথাটা বললো। প্রিয়ু অবাক নয়নে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কালকের এবং আজকের আচারণের মাঝে বেশ তফাৎ রয়েছে আরাফাতের। আজ লোকটাকে খুব অসহ্য লাগছে না তার। প্রিয়ন্তী মুচকি হেসে বললো,
– ওহ তাহলে আমি সেই ক্যাটাগরিতে পড়ি।
– বাহ বেশ সেলফ কনফিডেন্স আছে আপনার বলতে হবে। আমি তো আপনাকে সুন্দরী বলি নি
– আমিও নিজেকে সুন্দরী বলি নি
– তাহলে?
– বয়স্ক। আমি বয়স্কদের মধ্যে পড়ি। এখন ত্রিশ বছরের নারীকে আপনি কচি খুকিদের মাঝে তো ফেলবেন না নিশ্চয়ই।
প্রিয়ন্তী বেশ সাবলীল ভাবেই কথাটা বললো। আরাফাত এক মূহুর্তের জন্য একটু চুপ মেরে গেলো। চোখজোড়া সরু করে কিছুক্ষণ দেখে নিলো প্রিয়ন্তীকে। শ্যাম বর্ণের ছিপছিপে গড়ণের একজন নারী। উচ্চতা তার বুক পর্যন্ত। মুখে এখনো বয়েসের ছাপখানা পড়ে নি। খুব মায়াবী মুখখানা। তাই বয়সের আন্দাজটা করতে পারে নি আরাফাত। নিজের বোকামিতে নিজেই হেসে উঠলো সে। মুখে একটা অমায়িক হাসি টেনে বললো,
– উঠে পরুন, ডাক্তার সাহেবা। রাত নয়টা বাজে। রোডটা সেফ নয়।
আসলেই অনেক রাত হয়েছে। এখন সি.এন.জি পেতে আরোও দেরি হবে। তাই বেশি কথা না বলে রাজী হয়ে গেলো প্রিয়ন্তী। একটু দূরত্ব রেখে মোটরসাইকেলে বসলো সে। ব্যাপারটা বেশ খুতিয়ে লক্ষ্য করলো আরাফাত। ভাবলো হয়তো বিবাহিত, তাই হয়তো পরপুরুষের সাথে বসতে অস্বস্তিবোধ করছে।
– এড্রেসটা?
– মিরপুর এক
– আচ্ছা।
বলেই বাইকে স্টার্ট দেয় আরাফাত। ঠান্ডা বাতাস বইছে। নাক ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে প্রিয়ন্তীর। একেই এবার হাকাপুনি শীত পড়েছে ঢাকাতে। তার উপর বাইকের স্পিডও যে খুব কম তা নয়। বেশ রেকলেসভাবেই বাইক চালায় আরাফাত। একেই ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। উপরে এতো ওভারটেক করছে যে হৃৎপিন্ড হাতে এসে পড়ার জোগাড় প্রিয়ুর। কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো,
– আসতে চালান প্লিজ
– আমি এর নিচে চালালে আর বাইক চলবে না, এমনেই স্পিড কম
কথাটা শুনে যেনো আক্কেলগুরুম হবার জোগাড় প্রিয়ন্তীর, বলে কি লোক এটা নাকি কম স্পিড তাহলে সে যখন হাই স্পিডে চালায় না জানি কিভাবে চালায়। ভয়ে শক্ত করে আরাফাতের কাঁধ আঁকড়ে ধরে প্রিয়ন্তী। কাঁধে প্রিয়ন্তীর হাত অনুভব হতেই স্পিডটা আরোও বাড়িয়ে দিলো আরাফাত। মিনিট বিশেক পর, প্রিয়ন্তীর বাড়িতে পৌছালো তারা। প্রিয়ন্তী যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। বুক এখনো কাঁপছে। এই লোক নাকি আবার পুলিশে আছে মানা যায়! প্রিয়ন্তীর মনে হলো সে কোনো ঝড় পেরিয়ে এলো। নাকটা লাল হয়ে আছে ঠান্ডায়। পেটটা মোড়াচ্ছে প্রিয়ন্তীর। কোনো মতে বাইক থেকে নেমে শুকনো একটা ধন্যবাদ বলেই ভেতরে যেতে লাগলে আরাফাত পেছন থেকে ডেকে উঠলো,
– শুনুন……………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#আরোও_একবার_বসন্ত
#৭ম_পর্ব
কোনো মতে বাইক থেকে নেমে শুকনো একটা ধন্যবাদ বলেই ভেতরে যেতে লাগলে আরাফাত পেছন থেকে ডেকে উঠলো,
– শুনুন
আরাফাতের ডাকে পেছনে ফিরে তাকালো প্রিয়ন্তী। আরাফাতের দৃষ্টি পলকহীনভাবে তার দিকে রয়েছে। প্রিয়ুও আরাফাতের চোখে চোখ রাখলো। মূহুর্তটা যেনো থেমে গেছে। অচেনা দুটো মানুষ একে অপরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তারা একে অপরের চোখে কিছু একটা খুজছে। এ এক অজানা অনুভূতি যা দুটো মানুষের হৃদয়ের কোনায় দোলা দিয়ে যাচ্ছে। হয়তো একাকীত্বের হাহাকারের জন্য অথবা কাউকে মনের অজান্তেই ভালো লাগার জন্য। মনের অজান্তেই আরাফাত জিজ্ঞেস করে উঠলো,
– এটা কি আপনার শ্বশুরবাড়ি?
আরাফাতের প্রশ্নে ঘোর কাটলো প্রিয়ন্তীর। মুচকি হেসে বললো,
– নাহ, আমার মায়ের বাড়িওয়ালার বাড়ি।
– কিহ?
– বাড়িটা আমাদের না, বাসাটায় আমার মার। আমার কোনো শ্বশুরবাড়ি নেই।
কথাটা শুনতেই অজানা কারণে মনের ভেতরের খুতখুতটা বন্ধ হয়ে গেলো আরাফাতের। অস্বস্তিকর ভাবটা নিমিষেই যেনো হাওয়ার মিলিয়ে গেলো। এতোক্ষণ কোনো একটা কারণে খুব উদ্বিগ্নতা কাজ করছিলো যা একেবারেই মিলিয়ে গেলো। ভ্রুযুগল পুনরায় স্বাভাবিক হয়ে উঠলো৷ কপালের ভাঁজটা সটান হয়ে গেলো। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
– তাহলে অপারেশনের দিন দেখা হচ্ছে!
আরাফাতের কথায় নির্লিপ্ত কন্ঠে প্রিয়ন্তী বললো,
– ইনশাআল্লাহ সব ঠিক থাকলে আমাদের আর দেখা হবে না।
– মানে
– আমি মেডিসিন প্রাক্টিস করছি, তাই অপারেশনের সময় আমি থাকবো না। আর অপারেশনের পর ইনশাআল্লাহ সব ঠিক থাকলে দুদিন আই.সি.উ তে রাখা হবে৷ সেখানে আমার কাজ নেই৷ আমি সেখানের ডাক্তার নই। তারপর ওয়ার্ডে শিফট করবে। সেখানে আপনার সাথে আমার দেখা হতে পারতো। কিন্তু হবে না।
– কেনো?
– আমি আগামী এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকছি না। বান্দরবানে একটা মেডিক্যাল টিম যাচ্ছে। আমি সেটা লিড করছি। তাই ইনশাআল্লাহ সব ঠিক থাকলে আমাদের আর দেখা হবে না। আসলে আমাদের দুজনের প্রফেশনটাই এমন। আল্লাহ না চাইলে আমাদের দেখা হওয়া সম্ভব নয়। আর আমি চাইবো না আপনি অসুস্থ হয়ে আমার কাছে আসুন এবং আমি ক্রাইম করে আপনার থানায় যাই।
প্রিয়ন্তীর কথার যুক্তি আছে। মেয়েটার মাঝে কোনো জড়তা নেই। কি সুন্দর করে কথাটা বলে দিলো যুক্তি দিয়ে। তবুও আরাফাতের মনটা যুক্তি মানতে চাচ্ছে না। ঝগরুটে মেয়েটার না না মহিলাটার সাথে ঝগরা করতেও একটা আলাদা অনুভূতি। এই অনুভূতির উৎস কিংবা কারণ আরাফাতের জানা নেই। সে আপাতত জানতেও চায় না। ইনফ্যাচুয়েশন বলে একটা জিনিস আছে। এটা সেটা হবার সমূহ সম্ভবনা রয়েছে। আর এই সাতাশটা বছরে বোধ হবার পর থেকে এমন অকপটে মানুষ খুব কম দেখেছে সে। তাই হয়তো ক্ষণিকের আকর্ষণ। মুখের কোনায় হাসি অথচ চোখের কোনায় বিষাদের ছাপ এমন মানুষকে জানতে না চাবার কারণ বিজ্ঞান অন্তত দেয় না। প্রিয়ন্তী ছোট করে বললো,
– আসি, সাবধানে যাবেন
– আপনার ফোন নাম্বারটা দেওয়া যাবে?
আরাফাত এক মূহুর্ত দেরি না করেই প্রশ্নটা করলো। প্রিয়ন্তী অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। লোকটা এমন অকপটে প্রশ্ন করব্র এটা যেনো চিন্তার বাহিরে। তাই নিশ্চিত হবার জন্য আবার প্রশ্ন করলো,
– জ্বী?
– ইনশাআল্লাহ সব থাকলে নাম্বারটা লাগবে না। কিন্তু বলা তো যায় না সব কিছু ভালো নাও থাকতে পারে। তখন প্যারা খেতে হবে। তাই আগ থেকে নিয়ে রাখছি। আর ডাক্তারের নাম্বার নেয়া কোনো ক্রাইম নয়। আর পুলিশের নাম্বারটা রাখা ডাবল সেফটি।
আরাফাতের কথাটা শুনে খিলখিল করে হেসে দেয় প্রিয়ন্তী। কিছু মানুষ আছে যাদের উপর মেজাজ খারাপ হয়, যাদের কথা শুনে গায়ে জ্বালা ধরে; কিন্তু তাদের সাথে কথা বলে মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। অনেকটা থ্যারাপির মতো কাজ করে ব্যাপারটা। আজ সারাদিনের যত বিরক্তিছিলো এই বিগত আধাঘন্টায় দূর হয়ে গেছে প্রিয়ন্তীর। নিশাত কিংবা আফসারার সাথে আড্ডা মেরেও মনের মাঝের কালো মেঘগুলোর সুরাহা করতে পারছিলো না প্রিয়ন্তী। হয়তো আজকের মেঘগুলো খুব গাঢ় ছিলো। আরাফাত একনজরে প্রিয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে আছে। বইতে পড়েছিলো, যে নারীর হাসি সুন্দর, সে সত্যিই মায়াবতী। আজ প্রমাণ পাচ্ছে। এই নারীটিকে গতকাল খুব বিরক্ত লাগছিলো, কিন্তু এখন পৃথিবীর সবথেকে মায়াবতী লাগছে। ঘোরটা গাঢ় হচ্ছে। গন্তব্য অনিশ্চিত এটা তার মন জানে তবুও এই ঘোরে স্বইচ্ছায় ডুবে যাচ্ছে। মনকে শাসন করে দিতে হবে। এটাই তাদের শেষ দেখা জেনেও মায়ায় জড়াতে চাইছে। প্রিয়ন্তী হাসি থামিয়ে নিজের কার্ডটি দিলো আরাফাতকে। আরাফাতও মানিব্যাগ থেকে নিজের কার্ড বের করে প্রিয়ন্তীকে দিলো এবং স্বযত্নে প্রিয়ন্তীর কার্ডটি মানিব্যাগে রেখে দিলো। বলা তো যায় না ভাগ্যের মোড় মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়। – আপনি মানুষটা অন্যরকম। ভাগ্যে থাকলে ইনশাআল্লাহ দেখা হবে।
বলেই হাতটি বাড়িয়ে দিলো আরাফাত। প্রিয়ন্তী হাত মেলাতে মেলাতে বললো,
– আই উইশ আমাদের প্রফেশনালি মিটিংটা না হোক।
তাদের কাছে মনে হচ্ছিলো এটা তাদের শেষ দেখা। কিন্তু উপরওয়ালা মুচকি হাসি হাসছেন। কারণ কাহিনী মাত্র শুরু। এখনো অনেক পথচলা বাকি____________
মাস পেরিয়ে ফাল্গুনে মাঝ বরাবর এসে ঠেকেছে। কে বলবে এ বছর হাড়কাঁপুনি ঠান্ডা পড়েছিলো। গরমে ঘাম খড়িয়ে দিচ্ছে প্রকৃতি। বসন্ত নাকি প্রকৃতিকে সাজানোর ঋতু। এ ঋতুতে প্রকৃতি নতুন সাজে নিজেকে সাজায়৷ বাংলাদেশে তা একেবারেই উলটো। ফাল্গুনের পুড়িয়ে দেওয়া রোদ শীতের আমেজের উপর পুরোপুরি পানি ফেলিয়ে দিতে সক্ষম। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে কিন্তু তাতে লাভের লাভ কিছু হচ্ছে না রাফিজা বেগমের। বাইরের ঠাডা পড়া গরমের মতো তার মাথার আবহাওয়াও উত্তপ্ত। বড় ছেলে বিয়ে করছে না কারণ তার কোনো মেয়ে পছন্দ হয় না। বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন। আরে বাপ তুই সাতাশে বিয়ে করবি না তো কি চল্লিশে বিয়ে করবি। তোর বাপ তো এই বয়সে তোদের দু বাচ্চার বাবা ছিলো। আর এদিকে ছোট টার বয়স চব্বিশ ও পার হলো না সে কিনা বিয়ে করবে। কাল রাতে মেয়ের ছবি হাতে ধরিয়ে সুন্দর ঘোষণা করে দিলো সে বিয়ে করবে৷ কোনো মানে হয়! বসার ঘরে বসে রয়েছেন রাফিজা বেগম। সামনে মেয়েটির ছবি। মেয়েটির নাম নাকি “রুপন্তী”। আরশাদের সাথে রুপন্তী। নামটাকি যায়। মেয়েটার ছবিতে অবশ্য তাকে মন্দ লাগছে না। হলদেটে সাদা চেহারা। গোলগাল মুখ। বাচ্চা বাচ্চা চেহারার ধরণ। বয়স নাকি একুশে ঠেকেছে। বাবা সরকারি চাকুরিজীবি ছিলেন। মারা গেছেন বছরের বেশি হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা হয় ঘুষখোর নয় কিপটা। কিন্তু সমস্যা সেটাও নয়৷ সমস্যা একটাই তার ছেলে এখনো বেকার। আর এই মেয়ে ব্যতীত সে বিয়ে করবে না। সে নাকি মেয়েকে ভালোবাসে। এই ভালোবাসা কি রে! তাদের সময় তো এসব ভালোবাসা টালোবাসা ছিলো না। রাফিজা বেগমের মাথা দপদপ করছেন। ছেলে তার একরোখা দুইটাই। যা বলবে সেটাই সত্যবচন মানতে হবে। আরাফাত তাও কথা শুনে। আরশাদ দুই ডিগ্রী উপরে। সে মোটামোটি সময় দিয়ে দিয়েছে। আজ বিকেলেই মামলা ডিসমিশ করে আসামী খালাস দিতে হবে। চিন্তায় মগ্ন ছিলো রাফিজা বেগম তখন……….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি