#আরোও_একবার_বসন্ত,২২,২৩
#২২তম_পর্ব
হুট করে আরাফাতের প্রশ্নটি শুনে হতচকিত হয়ে উঠেন রাফিজা বেগম। কিছু বলতে যাবেন তখনই সেখানে প্রিয়ন্তী এসে হাজির হয়। প্রিয়ন্তীকে দেখেই রাফিজা বেগম তার মুখের কথাটা গিলে ফেলেন। চোখ মুখ কুচকে হিনহিনে কন্ঠে বলে উঠলেন,
– এসে পড়েছে মহারানী। জিজ্ঞেস কর তোর বউকে কেনো আমাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিতে বলেছিলো। জিজ্ঞেস কর।
রাফিজা বেগমের কথাটা শুনামাত্র পাশে তাকায় আরাফাত। প্রিয়ন্তীর দিকে তাকাতেই মনটা দমে যায় আরাফাতের। চোখ মুখ ফুলে রয়েছে তার। হয়তো কান্নাকাটি করেছিলো। চোখের কাজল লেপ্টে চোখের নিচটা আরোও কালো লাগছে। মুখটা শুকিয়ে ছোট হয়ে আছে। দুপুরে কিছু পেটে পড়েছে কিনা সন্দেহ আছে। খুবই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত লাগছে তাকে। এমনিতেও তিনদিন যাবত ঘন্টাখানেকের বেশি বাড়িমুখো হওয়া হচ্ছে না তার। আরাফাত এবং আরশাদ যাতে চিন্তা না করে সেজন্য টানা ডিউটি করে যাচ্ছে। মানুষ তো রোবট তো না, মানুষের শরীরে রেস্টের প্রয়োজন হয়। খাওয়া দাওয়া, ঘুম হলো এই হাড় মাংসের জ্বালানী। কিন্তু সেই জ্বালানী শরীরে পড়েছে কিনা সন্দেহ আরাফাতের। মার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,
– আচ্ছা ওকে যদি বাসায় নিয়ে যাই তাহলে তো তোমার কোনো অভিযোগ থাকবে না, তাই না?
– বাসায় নিয়ে যাবি?
– হ্যা, ও তোমাকে শুধু শুধু ঔষধ দেয়। ঘুমের ইঞ্জেকশন দেয়। এর থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়াটা ভালো নয়?
আরাফাতের কথায় বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন রাফিজা বেগম। না স্বীকার করলেও প্রিয়ন্তী আছে বলে একটু নিশ্চিন্ত তিনি। প্রিয়ন্তীকে সে চিনে। বাকি সবাই অপরিচিত। এই অপরিচিত পরিবেশে থাকতে বেশ ভয় হয় তার। হাসপাতাল এমন এক জায়গা যেখানে মৃত্যু ভয়টা পাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। তাও হয়তো তার ভয় লাগতো না, আজ দুপুরের দিকে তার পাশের বেডের মহিলাটি মারা গেছেন। বেশ খাতির হয়ে গিয়েছিলো বুড়ো মানুষটির সাথে। আজ বিকেলে তার রিলিজ হবার কথাও ছিলো। কিন্তু আজরাইল (আঃ) ঠিকই তার জান কবয করে ফেললেন। উনি কি কখনো ভেবেছিলেন যে আজ তার আর বাড়ি ফেরা হবে না। রাফিজা বেগম ঘুম থেকে উঠে পাশের বেড ফাঁকা দেখলে নার্সকে জিজ্ঞেস করেন। তখন এই কথাটা জানতে পারেন। প্রিয়ন্তীকে তার অপছন্দ, খুব অপছন্দ। কারণ নিজের বাবুর জন্য একটা পরীর মতো কচি রাজকন্যাকে বউ করে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যে একটা শ্যাম বর্ণের ত্রিশ বছরের ডিভোর্সী মেয়ে জুটলো। তাও যদি মেয়েটা একটু শান্ত, ভদ্র হতো। একটু দাপট খাটানো যেতো। কিন্তু কিসের কি! সারাক্ষণ ঝাড়ির উপরে রাখে। একটা দজ্জাল মেয়ে। মনের মতো বউ মা পাওয়া সকল শ্বাশুড়ির জন্মগত অধিকার। এটা ছেলে হবার পর ই তারা অর্জন করে। কিন্তু রাফিজা বেগম সেদিকে নিতান্ত দূর্ভাগা। এতোকিছুর পর ও এই সংকটের সময় তিনি প্রিয়ন্তীকে কাছে চান। কারণ মেয়ে যত যাই হোক, মাত্র এক দিনের শ্বাশুড়ির জন্য এই টানা তিনদিন তার দেখভাল করছে। রাতের বেলায় যখন ঘুম ভেঙ্গে যায় তখনই মেয়েটাকে আশেপাশে দেখেন রাফিজা বেগম। এও কম কিসের। আমতা আমতা করে কিছু বলার আগেই প্রিয়ন্তী বলে,
– আমি আন্টির সাথে একেবারেই বাসায় যাবো।
– কেনো? যাতে আমার মাকে আরোও বেশি ঘুমের ইঞ্জেকশন দিতে পারো?
– আরাফাত? আপনি আমাকে দোষ দিচ্ছেন? আমি কি ইচ্ছে করে আন্টিকে ইঞ্জেকশন দিচ্ছি নাকি? উনি যত রিলাক্স থাকবেন তার হার্ট তত ভাল থাকবে।
– হয়েছে হয়েছে।
আরাফাতের কাঠখোট্টা কথায় প্রিয়ন্তীর মনটা খারাপ হয়ে যায়। বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হয় প্রিয়ন্তীর। সে কি ইচ্ছে করে কাজটা করেছিলো নাকি! রাফিজা বেগম বেশ উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলেন, হার্টবিট ও বেড়ে গিয়েছিলো। তাই সে এই কাজটা করেছিলো। অথচ আরাফাত তাকে দোষ দিচ্ছে৷ রাফিজা বেগম আমতা আমতা করে বললেন,
– ওকে বকিস না বাবু!
– কেনো? তুমি না বলছিলে বকতে
– না না থাক, ও তো জেনে বুঝেই দিয়েছিলো। বেচারি এই তিনটা দিন এখানেই পড়ে রয়েছে। ওকে বাসায় নিয়ে যা। কিন্তু রাতে আবার নিয়ে আসিস। আমার একা থাকতে ভয় লাগে।
– শিওর?
– হু শিওর।
রাফিজা বেগমের কথায় অবাক চোখে তাকায় প্রিয়ন্তী। এ যেনো ভুতের মুখে রাম নাম। আরাফাতের দিকে তাকাতেই সে একটা চোখ টিপ্পনী কেটে বাকা হাসি দেয়। এতোক্ষণের তার বকাঝকা নিছক অভিনয় ছিলো মাত্র। যাতে মায়ের কাছে “বউ ঘেষা” ট্যাগ না পেতে হয়। প্রিয়ন্তীর হাসি পাচ্ছে, কিন্তু হাসি আটকে রাখলো। কারণ তাকে হাসতে দেখলেই রাফিজা বেগম আরাফাতের মনের চোরটাকেধরে ফেলবেন। আরাফাত নামক ব্যাক্তিটি সত্যি সবার থেকে আলাদা। লোকটাকে যত দেখছে ততই যেনো মুগ্ধ হচ্ছে প্রিয়ন্তী। কিছু একটা আছে এই লোকটার মাঝে যা এই চারমাস পরেও লোকটাকে জানার জন্য আগ্রহ তৈরি করে প্রিয়ন্তীর মনে____________
রাত আটটা,
ড্রেস ইস্ত্রী করছে প্রিয়ন্তী। নয়টার ডিউটিতে জয়েন করবে। বিকেলে বাসায় এসে টানা ঘুমিয়েছে। এই টানা চারঘন্টার ঘুমটা খুবই দরকার ছিলো। এই তিনদিনের ক্লান্তি তাকে হাপিয়ে তুলেছিলো। তারপর আবার ইরফানকে দেখার পর থেকেই মাথাটা ধরে ছিলো। খুব হাসফাস লাগছিলো। একটু রেস্ট না নিলে হয়তো মাথাটা ফেটে যেতো। আরাফাত যদি জোর করে বাসায় না আনতো তাহলে হয়তো এই রেস্টটা নেওয়াটা হতো না। বাসায় আসতে কাপড় না বদলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে। আরাফাত ও একবার যন্ত্রণা করে নি। টানা চারঘন্টার ঘুমে মাথাটা খালি হয়ে গেছে, মনটা ফুরফুরে। এখন আবার ডিউটি করতে পারবে। এই রকম টানা ম্যারাথন ডিউটি হয়তো তার কখনোই হয় নি। কাপড় আয়রণ করতে ব্যাস্ত ছিলো প্রিয়ন্তী। হঠাৎ কানে এলো,
– তাকে একবার নিজের কথাগুলো বয়ার সুযোগটা দিতেন। তার চোখে অনুতাপ ছিলো।
কথাটা শুনতেই পেছনে ফিরে তাকায় প্রিয়ন্তী। আরাফাত দরজার কাছে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। কালো টিশার্ট এবং কালো থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে রয়েছে। লোকটাকে মন্দ লাগছে না। মাত্র গোসল সেরে এসেছে। চুল থেকে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে। মিনিট বিশেক হয়েছে ডিউটি থেকে ফিরেছে। আজ রাতে কোনো ডিউটি নেই তার। প্রিয়ন্তীর বুঝতে বাকি রইলো না সে কি বলতে চাইছে। তবুও না বুঝার ভান করে৷ আয়রণ করতে করতে বললো,
– কার কথা বলছেন?
– আপনি বুঝছেন না? নাকি বুঝতে চাচ্ছেন না? আমি মিস্টার ইরফানের কথা বলছি।
ইরফানের নামটা শুনতেই হাত থেমে যায় প্রিয়ন্তীর। ইরফানের কথা আজ প্রিয়ন্তী সেভাবে আরাফাতকে বলে নি। তাহলে সে কিভাবে জানলো ইরফানের সাথে আজ তার দেখা হয়েছে। তবে কি আরাফাত তাকে ভুল বুঝছে? ধীর কন্ঠে প্রিয়ন্তী বললো,
– আপনি কি বলছেন আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না।
প্রিয়ন্তীর কথাটা শুনে একটু শব্দ করেই আরাফাত হাসে। এরপর ঠান্ডা কন্ঠে বলে,
…………………….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#আরোও_একবার_বসন্ত
#২৩তম_পর্ব
ইরফানের নামটা শুনতেই হাত থেমে যায় প্রিয়ন্তীর। ইরফানের কথা আজ প্রিয়ন্তী সেভাবে আরাফাতকে বলে নি। তাহলে সে কিভাবে জানলো ইরফানের সাথে আজ তার দেখা হয়েছে। তবে কি আরাফাত তাকে ভুল বুঝছে? ধীর কন্ঠে প্রিয়ন্তী বললো,
– আপনি কি বলছেন আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না।
প্রিয়ন্তীর কথাটা শুনে একটু শব্দ করেই আরাফাত হাসে। এরপর ঠান্ডা কন্ঠে বলে,
– প্রিয়ন্তী আমার কাছে লুকানোর প্রয়োজন নেই। লোকটা যখন এতো অনুতাপের সাথে কিছু বলতে চেয়েছিলো….
– আমার এই নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
প্রিয়ন্তীর শক্তভাবে বিরোধে চুপে মেরে যায় আরাফাত। তারপর ধীর কন্ঠে বলে সে,
– বেশ, আপনি কথা না বলতে চাইলে থাক। তবে আমি আপনাকে সেদিন ও বলেছি আজও বলছি। আপনি যেমন আমি আপনাকে যেভাবে ভালোবাসি৷ আমার কাছে আপনার কিছু লুকাবার প্রয়োজন নেই। স্বামী নয়, একজন বন্ধুর মতো আমাকে ট্রিট করাই যায়। যাক গে, ডিনার রেডি খাবেন চলুন।
বলেই চলে যেতে নিলে প্রিয়ন্তী টিটকারির স্বরে বলে,
– বন্ধু? বন্ধু বুঝি তার বন্ধুকে লুকিয়ে লুকিয়ে ফলো করে?
প্রিয়ন্তীর কথাটা শোনামাত্র চোয়ালজোড়া শক্ত হয়ে আসে আরাফাতের। চোখজোড়া রক্তিম রুপ নেয়। মুখের রঙ পালটে যায়। তাকে প্রিয়ন্তী স্টকার ভাবছে। এতোটা নিচ কিভাবে ভাবতে পারলো তাকে। রাগ লাগছে কিন্তু রাগ দেখাতে পারবে না সে। কারণ এই নারীটির তার অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে যাচ্ছে নারীটি। হাত শক্ত করে রাগ সামলে বরফ শীতল কন্ঠে বলে,
– আমি আপনাকে লুকিয়ে লুকিয়ে ফলো করি? এতোটা নিচ ভেবে নিলেন আমাকে! যদি বলেন আমি কি করে জানলাম ঘটনাটা তবে বলবো ওই সময় আমি মাকে দেখতে হসপিটালে গিয়েছিলাম৷ এবং আমার সামমেই ঘটনাটা ঘটে। এখন যদি বলেন সেই মানুষটি ইরফান সেটা কিভাবে বুঝলাম তবে বলবো এটা আইন্ড অফ ইন্সটিনক্ট, এতো বছরে পুলিশের চাকরি করে আমার এই অনুমান করার সত্ত্বাটি তৈরি হয়েছে। আমি এতোটা নিচ নই প্রিয়ন্তী যে আপনাকে সন্দেহ করবো কিংবা আপনাকে লুকিয়ে লুকিয়ে ফলো করবো। আপনি যতদিননা আপনার দুনিয়াতে আমাকে আমন্ত্রণ করবেন ততদিন আমি আপনার দুনিয়াতে ঢুকতে যাবো না। আর যদি বলেন এতো কৈফিয়ত আমি আপনাকে কেনো দিচ্ছি, তাহলে শুনে রাখুন আমার দুনিয়ার গোটা কয়েকটি মানুষের মধ্যে আপনি একজন। ডিনার ঠান্ডা হচ্ছে খেয়ে যাবেন।
কথাটা বলেই বাইকের চাবিটা নিয়ে গটগট করে বেড়িয়ে গেলো আরাফাত। প্রিয়ন্তীর দিকে ফিরে তাকালো না সে। দম বন্ধ লাগছে, রাগ হচ্ছে। আজ হয়তো বাড়ি ফেরা হবে না। কোথায় নিরিবিলি গিয়ে সিগারেট খাওয়াটাই হয়তো উত্তম হবে। প্রিয়ন্তী ঠায় বসে রয়েছে। আরাফাতকে সে আটকালো ও না। চোখের কোনে নোনাজলের স্রোত ভিড় করেছে। আরাফতলে এভাবে বলতে চায় নি সে। কিন্তু ইরফান নামক অধ্যায়টা সে আরাফাতের সামনে তুলে ধরতে চায় না। ভয় হয়, খুব ভয় হয়। শুন্য দৃষ্টিতে জানালার বাহিরে তাকালো প্রিয়ন্তী৷ মনে মনে ভাবলো, সবাই নিজেদের জায়গায় ঠিক। শুধু ভুলের মাত্রাটা প্রিয়ন্তীর উপর ই বর্তায়___________________
বিকেল ৪টা,
রাফিজা বেগমের কন্সাল্টেন্ট ডাক্তার ডা. শিহাবের চেম্বারে বসে রয়েছে আরাফাত, আরশাদ এবং প্রিয়ন্তী। এনজিওগ্রাম কেবল শেষ হয়েছে। স্ক্রিনে দেখতে দেখতে ডা.শিহাব বললেন,
– উনার এটেন্ট্যান্ডস কি আপনারা?
– জ্বী, আমি উনার বড় ছেলে
– আচ্ছা, দেখুন আমি ভনিতা করবো না। আম্পনারা একটু মানসিক ভাবে শক্ত হোন।
– খুব সিরিয়াস কি ডক্টর?
– জ্বী, তাতো বটেই। উনার হার্টে ব্লক ধরা পড়েছে। তিনটি, একটি মেইন আর্টেরিওতে। এজন্য ব্যাথার উদ্ভব।
ডা. শিহাবের কথাটা শুনেই আরাফাতের মাথাটা শূন্য হয়ে যায়। আরশাদের মনে হচ্ছিলো তার দুনিয়াটা ভেংগে চুরমার হয়ে গেছে। আরাফাত ধীর কন্ঠে বলে,
– এখন ট্রিটমেন্ট?
– ট্রিটমেন্ট দুটো, এক. রিং পড়াতে হবে। দুই. অপারেশন করতে হবে। অন্য প্যাশেন্ট হলে আমি বলতাম রিং পড়াতে। কিন্তু যেহেতু তুমি প্রিয়ন্তীর প্যাশেন্ট আমি বলবো, রিং পড়ানো টা ঠিক হবে না। এটা টিকবে না। কারণ তার ব্লকের পজিশনগুলো বেশ জটিল। তাই রিং এর থেকে অপারেশনটাই বেশি ভালো হবে।
– কবে করাতে চাচ্ছেন অপারেশন?
– এটা আপনারা ডিসাইড করবেন। আসলে টাকার ব্যাপার আছে। এতোগুলো টাকা যোগাড় করা, ব্লাড যোগাড় করা। এটা লেন্দি প্রসেস৷ আপনারা ঠিক করে প্রিয়ন্তীকে জানিয়ে দেন। আমি তাহলে সেভাবে সময় বের করে নিবো।
ডা. শিহাবের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে পাশে থাকা বেঞ্চে ধপ করে বসে পড়ে আরাফাত। টাকার পরিমাণটা কম নয়, এতোগুলো টাকা কিভাবে জোগাড় করবে সে! মাকে কষ্ট পেতেও দেখিতে পারছে না। কিছু মাস আগে রাসেলের জন্য লোন করেছিলো। সেই লোন চুকিয়ে দিতে কম ঝামেলা পোহাতে হয় নি। এখনো একই কাজ করতে হবে, কিন্তু এখন লোনের সীমা থেকে চাহিদা অনেক বেশি। আরশাদের নতুন চাকরি ওর উপর খুব চাপ পড়ে যাবে কিছু বললেই, হয়তো মাসের বেতনটা চোখ বন্ধ করে হাতে দিয়ে দিবে। কিন্তু তাতে কি কিছু হবে! আচ্ছা বড় মামাকে বললে কেমন হয়? খালাদের সাথে গত বার যা ব্যবহার করেছে তাতে তাদের কিছু বলার মুখ নেই। আরাফাতের করুণ মুখখানা দেখতে একেবারেই ভালো লাগছে না প্রিয়ন্তীর। আরাফাতের মনে অবস্থা খুব ভালো করেই বুঝছে সে। শাহাদাত সাহেব যখন অসুস্থ ছিলেন ঠিক এভাবেই টাকার জন্য হন্যে হয়েছিলো সে। আরাফাতের পাশে বসে ধীর কন্ঠে বললো,
– আমার কিছু গোল্ড আছে, তাতে দেড়-দু লাখ খুব ইজিলি হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না
– লাগবে না।
– কেনো?
– আমি বা আমার মা আপনার আপন কেউ নই, সুতরাং আমাদের জন্য এতোটা করার দরকার দেখছি না। এমনিতে যা করেছেন যথেষ্ট। আর আপনার দয়ার আমার প্রয়োজন নেই। আমাকে ঋনী করবেন না প্লিজ।
আরাফাতের কথাটা বেশ গায়ে লাগলো প্রিয়ন্তীর। কাল রাতের পর থেকে এখন অবধি একটা কথাও সেধে বলে নি লোকটা। এতো কিসের ভাব তার। হ্যা, কাল রাতে তাকে ওভাবে বলাটা উচিত হয় নি। কিন্তু সারাদিনের ক্লান্তি, মানসিক যন্ত্রণায় জর্জরিত ছিলো প্রিয়ন্তী। অভিমানী কন্ঠে বললো,
– আমার কোন কাজে মনে হলো যে আমি আপনাকে কিংবা আন্টিকে আপন ভাবি না?
– হাসালেন? কালকের ব্যাবহার টা কি যথেষ্ট ছিলো না। আমার তর্ক করতে ইচ্ছে হচ্ছে না প্রিয়ন্তী। প্লিজ বাদ দেন না৷
– না বাদ দিতে পারছি না। কারণ আপনি আমার হাসবেন্ড, একজন হাসবেন্ড যদি বিপদে পড়ে থাকে তবে ওয়াইফ হিসেবে তাকে সাহায্য করাটা আমার দায়িত্ব। আমার সাহায্য আপনি নিতে নাই চাইতে পারে। তবে এটা আমাকে কবুল বলে বিয়ে করেছিলেন তখন আপনার ভাবা উচিত ছিলো। আন্টির জায়গায় আমার নিজের মা হলেও হয়তো আপনিও এই কাজটাই করতেন। তখন তো আমি সেটাকে দয়া বলতাম না। আমি আপনাকে দয়া দেখানোর কেউ না। কিংবা আমার টাকার গরম দেখানোর জন্য এই সেন্সিটিভ সময়টাই আমি বেঁছে নেবার মনমানসিকতা রাখি না। আসলে কি আপনি আমাকে বুঝেন ই না। বুঝলে হয়তো গতকাল ইরফানের কথাটাও তুলতেন না। হ্যা আমি আপনাকে বাজে ভাবে অপমান করেছি, সেটার জন্য সরি। কিন্তু আই ওয়াজ মেসড আপ। আমার প্রতিদিন ভাঙ্গতে ভালো লাগে না আরাফাত। ইরফান নামক অধ্যায়টা আমি আপনাকে বলতে চাই, কিন্তু আমার সময় লাগবে। আমাকে একটু সময় দিন। প্লিজ
কাঁপা স্বরে কথাগুলো বললো প্রিয়ন্তী৷ ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তাও গালটা ভিজে গেছে। আর বসে থাকাটা সম্ভব হচ্ছে না। তাই আরফাতের উত্তরের অপেক্ষা না করেই উঠে দাঁড়ালো সে। গটগট করে হাটা দিলো। আরাফাত সেখানে ঠায় বসে রইলো। প্রিয়ন্তী ছলছল চোখ তার ভেতরটাকে দুমড়ে মুছড়ে ফেলছে। খুব তাড়াহুড়ো করে ফেলেছে সে। কেনো প্রিয়ন্তীকে একটু সময় দিলো না। তাহলে হয়তো এমনটা হতো না। বেঞ্চে একটা কিল নিয়ে নিজের রাগ কমানোর চেষ্টা করলো। হাতে ব্যাথা পেলেও না অনুভব হচ্ছে না। কারণ মনের ব্যাথাটা এর চেয়ে লাখ বেশি।
পার্কে বসে রয়েছে আরশাদ। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সূর্য অস্ত যাবে যাবে করছে। আকাশ টা টকটকে লাল হয়ে আছে। পাখিরা নিজ নিজ গৃহে যাচ্ছে। কিন্তু তার গৃহের খোঁজ নেই। হাঁফাতে হাঁফাতে সেখানে এসে উপস্থিত হয় রুপন্তী। ল্যাব শেষ হতে আজ দেরি হয়ে গেছে। আর ঢাকা শহরের জ্যামের কথা আর নাই বলি৷ আরশাদের সাথে আজ চারদিন পরে দেখা হয়েছে। তার মুখখানা দেখেই বুকে ছ্যাত করতো রুপন্তীর। লোকটাকে এতোটা বিধ্বস্ত সে কোনো কালে দেখে নি। চুল এলোমেলো, চোখ লাল হয়ে রয়েছে। মুখটা শুকনো। দাড়ি শেভ করে না কত বছর কে জানে। খাওয়া-দাওয়া কিংবা ঘুমের ঠিক আছে কি না সন্দেহ। শুধু সিগারেটের উপর হয়তো চলছে। এই চারটা দিন কোনো যোগাযোগ হয় নি তার সাথে। হুট করেই ফোন আসা বন্ধ, জোর জবরদস্তি করা বন্ধ। মাঝে মাঝে রুপন্তীর মনে হতো এই ওভারবেয়ারিং মানুষটা জীবনে না থাকল মন্দ হতো না। কিন্তু এই চারটা দিন যেনো হাঁপিয়ে গেছে সে। ব্যাগের থেকে টিফিনের বক্স বের করে আরশাদের হাতে দিতে দিতে বললো,
– খেয়ে নাও।
মাথা তুলে তাকালো আরশাদ। সত্যি বেশ ক্ষুধা পেয়েছিলো তার। কোনো মতে অফিস থেকে হাফ ডে করে হাসপাতালে ছুটেছিলো সে। খাওয়ার সময় পায় নি। আর পরে মার শরীরের অবস্থা শুনে খেতে ইচ্ছে হয় নি। এখন পেটে কিছু না পড়লে সত্যি বমি হয়ে যেতো তার। ভদ্র বাচ্চার মতো খেতে লাগলো আরশাদ। তখন রুপন্তী বলে,
– আজ চারদিন পর কি মনে করে ফোন দিলে?
– মার হার্টে ব্লক ধরা পড়েছে। অপারেশন করতে হবে। অনেক টাকার প্রয়োজন। ভাইয়ার উপর বেশ চাপ পড়ে গেছে। আমি সত্যি একটা অপদার্থ। না তোমাকে সুখ দিতে পারছি না অন্য কাউকে। আমার চাকরিতে এতো লোন ও পাবো না। কি করবো বুঝছিলাম না। দম বন্ধ লাগছিলো।
কাঁপা স্বরে গড়গড় করে বলতে লাগলো আরশাদ। খুব অসহায় লাগছে তাকে। রুপন্তীর মাথায় হুট করেই একটা বুদ্ধি এলো। কিন্তু আরশাদকে সেটা বললে ঝাড়ি ছাড়া কিছুই নসিবে ঝুটবে না। উপায় একটাই সেটা হলো বুবু। খাওয়া শেষে রুপন্তীর কোলে মুখ গুজে শুয়ে রইলো আরশাদ। খুব ঘুম আসছে তার। একটু ঘুমোতে পারলে হয়তো ভালো লাগবে। রুপন্তী তার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।।সূর্য অস্ত যাচ্ছে, পার্ক জনশূন্য হচ্ছে। কিন্তু এই মানব মানবীর তাড়া নেই। তারা বসে রয়েছে। নিজেদের অশান্ত মনকে শান্ত করছে।
হাসপাতালের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়ন্তী। চোখজোড়া ক্লান্ত। অশ্রুপাত করে ক্লান্ত চোখজোড়া। দৃষ্টি বাহিরের দিকে। বুকে চিনচিন ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু সেটা কাউকে দেখাতে পারছে না সে। তাই একা থাকতে বেশ স্বাচ্ছন্দ বোধ হচ্ছে তার। হঠাৎ অনুভূত হলো কেউ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। হুট করে এমন অনুভূতি হতেই বুকটা ভয়ে শিটিয়ে গেলো। বারবার ছাড়ানোর চেষ্টা করে ক্লান্ত সে। বিরক্ত হয়ে পেছনে ফিরতেই দেখে…………….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি