#আরোও_একবার_বসন্ত
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রয়েছে প্রিয়ন্তীর ক্ষত বিক্ষত শরীরটি। পিঠে মারার দাগগুলো স্পষ্ট। কিছু ক্ষত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। শরীরটাকে নিয়ে বিছানা অবধি যাবার শক্তিটুকু পাচ্ছে না সে। তাই নিথর শরীরটি সেখানেই পড়ে রয়েছে৷ ব্যাপারটা নতুন নয় প্রিয়ন্তীর কাছে। দুদিন পর পর তার এরকম আচারণের সাথে তার পরিচয় হয়। আজ প্রিয়ন্তীর দোষ হলো সে ইরফানের ড্রয়ারে হাত দিয়েছে। একজন স্ত্রী তার স্বামীর ড্রয়ারে হাত দিবে ব্যাপারটা খুব বেশি বেমানান নয়। কিন্তু মূলত সেই ড্রয়ারটাতে ইরফানের নেশার দ্রব্যগুলো ছিলো। আফসোস এই ব্যাপারটা প্রিয়ন্তীর জানা ছিলো না। প্রিয়ন্তী স্বাভাবিকভাবেই সেই ড্রয়ারটি পরিষ্কারের জন্য খুলেছিলো। যখন ড্রয়ারটি খুললো, দেখলো তাতে শুধু ইঞ্জেকশন এবং ঔষধের পাতা। প্রিয়ন্তীর বুঝতে বাকি রইলো না, এই ঔষধের পাতাগুলো কিসের! ইরফানের বাসায় আসতে আসতে সাধারণত রাত দশটার বেশি বাজে। সেদিনও সেটার ব্যাতিক্রম হলো না। বাসায় ঢুকতে ঢুকতে খিটখিটে গলায় বললো সে,
– শালার জীবনটা আর ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করে লাথি মেরে সব ফেলে দি। এই পানি দাও তো।
বলেই গলার টাইটা খুলতে খুলতে সোফায় গা এলিয়ে দিলো। পানির সাথে সাথে ইঞ্জেকশন এবং ঔষধের পাতাগুলোও টি টেবিলের উপর রাখলো প্রিয়ন্তী। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে প্রিয়ন্তী তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করলো,
– এগুলো কি ইরফান?
ইরফান এক নিঃশ্বাসে পানির গ্লাসটা ফাকা করে ফেললো। তারপর গ্লাসটি টি টেবিলে রেখে ভাবলেশহীন ভাবে বসে রইলো। ইরফানের এই ভাবলেশহীনতা যেনো একেবারেই মেনে নিতে পারলো না প্রিয়ন্তী। চড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– চুপ করে আছো কেনো? বলো এগুলো কি?
– বেশি ফ্যাসফ্যাস করো না তো। ভালো লাগছে না।
– ফ্যাসফ্যাসের কি আছে? এইগুলো ড্রাগ ইরফান। তুমি তো এমন ছিলে না। তুমি কবে থেকে ড্রাগ নেওয়া স্টার্ট করেছো?
– তুমি আমার ড্রয়ারে হাত দিয়েছিলে?
ভ্রু কুচকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলো ইরফান। প্রিয়ন্তীও দমে যাবার মানুষ নয়। অনঢ় কন্ঠে উত্তর দিলো,
– হ্যা দিয়েছি, স্ত্রী হয়ে এটা আমার অধিকার। তুমি কি ভেবেছিলে আমি জানবো না! তুমি আমার কাছ থেকে এগুলো লুকিয়ে যাবে? হয়তো আমি এ বাসায় বেশিদিন থাকি না। কিন্তু আমি তোমার স্ত্রী ইরফান।
– তো কি আমার মাথা কিনে নিয়েছিস তুই?
এবার নিজেকে আর সংযত করে রাখলো না ইরফান। টি টেবিলে একটা লাথি মেরে চিৎকার করে উঠলো ইরফান। ইরফানের চোখজোড়া লাল হয়ে এসেছে। রাগে মাথার রগ ফুলে উঠেছে। তেড়ে এসে মুখ চেপে ধরে ঠান্ডা গলায় বললো,
– বেশি বাড়িস না, এই বলে দিলাম
– কি কর…রবে তু..মি?
– দেখতে চাস?
বলেই মাটিতে ছুড়ে মারলো প্রিয়ন্তীকে। মাজার বেল্টটা খুলে ইচ্ছেমতো তার উপর প্রয়োগ করতে লাগলো। আধাঘন্টা পর যখন মেজাজটা ঠান্ডা হলো তখন ওভাবেই প্রিয়ন্তীকে সেখানে ফেলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো সে। কতক্ষণ এভাবে পড়ে রয়েছে তার ঠিক নেই প্রিয়ন্তীর______
ঘরে পিনপতন নীরবতা। ইরফানের হিংস্রতা আজ যেনো সীমা পার করে ফেলেছে। অবশ্য এই শরীরটার প্রায় ই এই মারের সাথে পরিচয় হয় তার। তবুও রুখে দাঁড়াবার অহেতুক চেষ্টা চালায় সে। শরীরটায় বল নেই, কোনোমতে ক্ষতশরীরটি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। পায়ে শক্তি নেই যে সে তাকে টেনে হাটবে। কোনো মতে সোফাতে গিয়ে বসলো সে। গলাটা শুকিয়ে আসছে, ঘড়ির টিকটিক শব্দ শোনা যাচ্ছে। চোখের সামনে আঁধার ছেয়ে গেছে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ কানে এলো প্রিয়ন্তীর। কেউ একজনের পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ইরফান কি ফিরে এলো! আবার তার উপর অমানবিক নির্যাতন করবে সে! প্রিয়ন্তীর মনে হচ্ছে সে আবারো দুঃস্বপ্নের ভেতর ডুবে যাচ্ছে। এগুলো দুঃস্বপ্ন, চোখ খুললেই কেটে যাবে। চোখ খুললেই সে কালো অতীত থেকে বেড়িয়ে যাবে। মানুষটা তার দিকে এগিয়ে আসছে। বেল্টের টানার শব্দ আরো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তখনই এলার্ম ঘড়িটা বেজে উঠে। ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে বসে প্রিয়ন্তী। তার সারা শরীর ঘেমে একসার। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো সে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো এখন সকাল পাঁচটা বাজে। আজানের সুর কানে আসছে। পাশের টেবিলে রাখা পানিটুকু এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেললো প্রিয়ন্তী। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে ঝরণার নিচে দাঁড়িয়ে গেলো। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। বুকটা এখনো কেঁপে উঠে প্রিয়ন্তীর। কি বিভীষিকাময় জীবন ছিলো তার। এই দুঃস্বপ্নময় জীবন বিগত চার বছর ধরে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে।।
___________________
সকাল ৮টা,
নাস্তার টেবিলে বসে রয়েছে প্রিয়ন্তী। ৯টার মধ্যে হাসপাতালে পৌছাতে হবে তার। আজ ২৪ঘন্টা ডিউটি। ঠিক তার পাশের চেয়ারে তার মা জাহানারা বেগম বসে রয়েছেন। মেয়েকে কোনো কথা বলার আগে তিনবার কমপক্ষে চিন্তা করা লাগে তার৷ প্রিয়ন্তীর ঠিক অপজিটে বসে রয়েছে তার ছোট ভাই শিপন এবং তার স্ত্রী স্নেহা। তারা বারবার জাহানারা বেগমকে ইশারা করছে যাতে প্রিয়ন্তীর সাথে তিনি কথা বলেন। পরোটার টুকরাটা মুখে তুলতে তুলতে প্রিয়ন্তী বললো,
– কিছু বলার থাকলে সরাসরি বলো, মানুষের মুখ চাওয়া চাওয়ির কি আছে?
– আসলে বলছিলাম কি, একটা ছেলে ছিলো
– আমি বিয়ে করবো না মা।
– বিয়ে করবি না বললেই তো হবে না। সারাজীবন আমাদের উপর থাকবি নাকি!
শিপনের ছন্নছাড়া কথায় প্রিয়ন্তী মুখের খাবার মুখ অবধি এসে থেমে গেলো। চোখ তুলে প্রিয়ন্তী তার দিকে তাকায়। ঠান্ডা গলায় বললো,
– তোদের উপর মানে? কি বলতে চাচ্ছিস
– দেখ আপু, আমার বসের ওয়াইফ মারা গেছে ছয়মাস। লোকটা বিয়ে করতে চাচ্ছে, একটা পনেরো বছরের মেয়েও আছে। একজন বিধবা কিংবা ডিভোর্সি মেয়ে খুঁজছিলেন। খুব পয়সাওয়ালা তিনি।তোকে প্রথম দেখাতে বেশ ভালো লাগে তার। তাকে বিয়ে করে তুই ঠকবি না।
শিপনের কথাটা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিয়ন্তী। সুক্ষ্ণভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুসময়। তারপর ধীর কন্ঠে বলে,
– তোর ইনকাম কত?
– কিহ?
– বললাম তোর ইনকাম কত?
– সাইত্রিশ হাজার টাকা।
– বাসায় দিস কতো?
– পনেরো হাজার টাকা
– আমি বাসায় দি কতো?
– পঁচিশ হাজার টাকা।
– তাহলে আমি কি তোর উপর খাই?
-……..
– তুই যতোটা ইনকাম করিস আমি তার চেয়ে বেশি ইনকাম করি। বাসায় একটা খরচ দেবার পাশাপাশি ছুটকির কলেজের ফিসহ নানা খরচ ও আমি বেয়ার করি। এই যে মিরপুরের একটা বাসায় তুমি ভাড়া থাকো সেটা এতোটা সহজ হতো না যদি আমি তোমার সাথে সংসারের ভারটা না নিতাম। তাই তোমাদের উপর আমি থাকি এইটা বলাটা তোমার ভুল।
– রুপন্তীর বিয়েটা কিন্তু তোর জন্যই বেঁধে আছে।
ক্ষিপ্ত কন্ঠে শিপন কথাটা বললো। এবার চেয়ার থেকে উঠে ব্যাগটা ঘাড়ে নিতে নিতে প্রিয়ন্তী বললো,
– আল্লাহ পাক যখন তার বিয়ে লিখে রেখেছেন তখন সেটা হবে। আমার বিয়েটাও তো ছোট বয়সে দেওয়া হয়েছিলো তাতে কি আমি সংসার করতে পেরেছি? তাই ছুটকি আগে বড় হোক। তার নিজের পায়ে দাঁড়াক। তখন না হয় আমি তার বিয়ের কথাটা ভাববো। আর একটা কথা, তুই এবাড়ির গার্ডিয়ান নস। মা আমি আসছি।
বলেই গটগট করে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ে প্রিয়ন্তী। স্নেহা ধীর কন্ঠে বলে,
– আপুর এই তেজটাই তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংসার তো আমরাও করি। এখন যখন একবার তার সংসার ভেঙ্গে গেছে তবুও সে এই তেজটাই ধরে রেখেছে। এই বিয়েটা কতো ভালো ছিলো। এতে করে আপনার ছেলের বেতনটাও বেড়ে যেতো। খোঁটাও দিবে অথচ সাহায্য ও করবে না। আমাদের ও তো ভবিষ্যত আছে
জাহানারা বেগম কিছু বললেন না। বছর খানিক হয়েছে তার স্বামী শাহাদাত সাহেব মারা গেছেন। স্বামী বেঁচে থাকতে মেয়েটাকে কখনোই কোনো কথা শুনতে হতো না। তখন এমন সম্বন্ধ আসতো না। কিন্তু শাহাদাত সাহেব ই রাজী হতেন না। মেয়েটার বয়স এখন ত্রিশে পড়েছে। বয়স বাড়তি তাই এখন নানা কথা শুনতে হচ্ছে। তিনি চাইলে হয়তো তার ছেলে এবং ছেলের বউ দুকথা শুনিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু তা তিনি করবেন না। কারণ তিনিও চান মেয়েটার বিয়ে হোক। তার জীবনে আরোও একবার বসন্ত আসুক। কতদিন একাকীত্ব জীবনে থাকবে সে!!
রিক্সায় বসে রয়েছে প্রিয়ন্তী। জ্যামের কারণে রিক্সা নড়ছে না এক সেন্টিমিটারও। ঘড়িতে সময় পার হচ্ছে। হসপিটালে সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসার সে। পেশাগত দিক থেকে একজন নিষ্ঠাবান ডাক্তার সে। আজ অবধি এক মিনিট লেটের খাতে নাম উঠে নি তার। কিন্তু আজ হয়তো দেরিটা হবেই। সামনে একটা বিস্তার গন্ডগোল হচ্ছে। একটা চোরকে ধুমা মার দেওয়া হচ্ছে। আজ সবাই তাদের কাজ ফেলে হয় তাকে মারছে নয় দাঁড়িয়ে মারার দৃশ্য উপভোগ করছে। হঠাৎ একজন যুবক বাইক থেকে নেমে গন্ডগোলের ভেতর ঢুকলো। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে সবাইকে শান্ত করলো। মিনিট দশেক পর গন্ডগোলটা থেমে গেলো। চোরটা ছেড়ে দিলো সবাই। আর সেই যুবকটা ছেলেটার কলার ধরে কোথাও নিয়ে গেলো। ধীরে ধীরে জ্যামটা খুললো। আজ এতোদিনের রেকর্ডটা ভেঙ্গেই গেলো প্রিয়ন্তীর। রিক্সা চলা শুরু করলো। গন্তব্য এ.এস হাসপাতাল।
ড্রেসটা চেঞ্জ করে নিজের ডেস্কে বসলো প্রিয়ন্তী। হঠাৎ একজন নার্স এসে তাকে জানালো,
– ম্যাডাম, একজন আহত রোগী এসেছেন
– এতো তাড়াতাড়ি? আচ্ছা চলেন
ওয়ার্ডে যেতেই চোখ ছানাবড়া প্রিয়ন্তীর। আহত রোগী আর কেউ না সেই মার খাওয়া চোরটি। নিজের কৌতুহলকে দমিয়ে রেখে প্রিয়ন্তী তার ট্রিটমেন্ট শুরু করে। চিকিৎসার মধ্যেই তাকে জিজ্ঞেস করে প্রিয়ন্তী,
– তোমার সাথে কি কেউ এসেছে?
– আমি এসেছি ওর সাথে
কথাটা কানে আসতেই পেছনে ঘুরে তাকায় প্রিয়ন্তী। পেছনে ফিরতেই দেখে…………….
চলবে