#আরো_একটি_বসন্ত
#পর্ব_৪
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
শীতলের বাবা শখ করে বাসার নাম রেখেছিলেন ‘স্বপ্নগাঁথা।’
অনেক কষ্টের পর স্বপ্নের বাসাটা গড়তে পেরেছিলেন বিধায় এমন নামকরণ করেছিলেন। কিন্তু স্বপ্নগাঁথার এমন পরিণতি হবে উনাদের কারো কল্পনাতেই ছিলো না। কে জানত, কেউ
এত নিষ্ঠুরভাবে ক্ষোভ মিটাবে স্বপ্নগাঁথার উপর। ইস, এখন সেদিকে তাকালেই বুকটা হুহ্হুহ্ করে উঠে। ক্ষণিকের মধ্যেই লন্ডভন্ড হয়ে গেছে উনাদের সুখপূর্ণ বাসাটা। সেই সঙ্গে কিছু
স্মৃতিকে পুড়ি/য়ে/ছে নির্মমভাবে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা এসে আগুন নিভালেও মানুষের চিহ্ন খুঁজে পায় নি। সবকিছু পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। বোঝার উপায়ও নেই এখানে মানুষ
বসবাস করতো। শীতলের মায়ের নিজে হাতে গড়া সাজানো সবকিছু কয়লাতে পরিণত হয়েছে। শখে গড়া কোনোকিছুই
আর অবশিষ্ট নেই। ধারণা করা যাচ্ছে বোম বাসার ভেতরে ছিলো। আর সেটা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ফাটানোও হয়েছে। নয়তো রিস্ক নিয়ে এসব বাসায় কেন রাখবে? মূখ্য কথা, কে রেখেছে? শীতল নাকি শিশির? নাকি শীতলের বাবা মা? এ ছাড়া ওদের বাসায় আনাগোনা বেশি সেই ছেলেটার কাজও হতে পারে। মনের ক্ষোভ মিটাতে সে করতেও পারে। তাছাড়া বন্ধুরুপী শুভাকাঙ্ক্ষীরাই ক্ষতি কারণ হয়। হতে পারে তারই কাজ এটা।আশপাশের চেনা অচেনা মানুষ ভিড় জমিয়েছে
পোড়া বাসার সামনে। দো’তলা বিশিষ্ট বাসা এখন ধ্বংসস্তুপ।
এখন পোড়া বাসার সামনে কেউ লাইভ করছে কেউ বা ছবি তুলে সোস্যাল মিডিয়াতে ছেড়ে মনমড়া ক্যাপশনও জুড়ে দিচ্ছে। অথবা কেউ আফসোস করছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এ ছাড়া কী বা করার আছে?
________________________________
শুদ্ধ শীতলের মাথাটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে। শাঁ শাঁ করে গাড়ি চলছে মিঠাপুকুরের বিপরীত পথে। তাদের গ্রামের যাওয়ার কথা থাকলেও এখন যাচ্ছে না। খুব ভেবে চিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে শুদ্ধ। কারণ এই পরিস্থিতিতে
গ্রামে যাওয়া মানেই ওর পরিবারকে বিপদে ফেলা। ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে শুদ্ধ গাড়ি থামিয়ে শীতলের মাথাটা আস্তে করে সিটে হেলিয়ে দিলো। তারপর আশেপাশে নজর বুলিয়ে বের হয়ে রাস্তা পার হতেই, মোটা বট গাছের পেছন থেকে শিশির ওর বাবা মাকে নিয়ে বেরিয়ে আসল। ওরা তিনজনে অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন। তবে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় অনেকটা মুষড়ে পড়েছেন। শুদ্ধকে দেখেই শীতলের মা ডুকরে কেঁদে ফেললেন। শুদ্ধ উনাকে জড়িয়ে ধরে মাথা চুমু এঁকে কাঁধ জড়িয়ে ধরে গাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসাল। সে ভীষণ ভালোবাসে, সন্মান করে, এই মানুষ মানুষগুলোকে। উনাদেরকে এমতাবস্থায় দেখে তারও প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। তবে কিছু করার নেই এই তিক্ত পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতেই হবে।
তখন শিশির তার বাবাকে ধরে বসিয়ে সেও বসল পেছনের সিটে। কারো মুখে রা শব্দ নেই। সকলেরই কিছুক্ষণ আগের ঘটনায় বাকশক্তি লোপ পেয়েছে। সেকেন্ডের ব্যবধানে আজ তিনটে জীবন নিঃশেষ হয়ে যেতো। যদি না শুদ্ধ ব্যাপারখানা ক্ষুণাক্ষরেও টের না পেতো। শিশির মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নীরবে অশ্রু ঝরাচ্ছে। যদি এদিক-ওদিক হতো তাহলে বাবা মাকে চিরতরের জন্য হারিয়েও ফেলতো। তখন শুদ্ধ বলল,
-”তোর ফোনটা ফেলে দে শিশির।”
-”কেন?”
-” ট্যাক করতে পারে।”
-”এতকিছুর পরেও সন্দেহ করবে কী?”
-”সাবধানের মার নেই। তাছাড়া আমাকেও ফলো করছিলো। মিঠু সব সামলে নিয়েছে।”
-”এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
-”চট্টগ্রামে। তোরা এখন থেকে সেখানেই থাকবি।”
-”তোর নানুর দেওয়া ফ্ল্যাটে?”
-”আলাদা করে তোর আর আমার বলে কখনো কিছু ছিলো না শিশির। তাই নখরা বন্ধ করে ভুলে যা ওটা কার ফ্ল্যাট।”
-” আর আমরা থাকব মানে? তুই থাকবি না?”
-”না, আমি কিছুদিন গ্রামে থেকে ঢাকাতে ফিরে যাবো। কার কার বুকের পাটা বেড়েছে দেখতে হবে না? তাছাড়া আমি থাকলে তোদের নিয়ে ডাউট করতে পারে।”
-”রিস্ক হয়ে যাবে না?”
-”হলে হোক তবুও এর শেষ দেখেই ছাড়ব।
-“আচ্ছা শীতল উঠছে না কেন?”
-” ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। নয়তো বকবক করে কান মাথা খেয়ে ফেলবে।”
-”তাও ঠিক।”
একথা বলে শিশির সত্যি সত্যি ওর হাতের ফোনটা জঙ্গলের দিকে ছুঁড়ে মারল। সে এখনো ঘোরের মধ্যেই আছে। মুখ্য কথা বিশ্বাসই হচ্ছে না তাদের সবুজ স্যার তাদের সঙ্গে এমন নোংরা গেম খেলবে। উনিই মিশনের নামে পাঠিয়ে ওদেরকে মারার পরিকল্পনা করে ছিলেন। হয়তো পূর্বের রাগের বশে।
কিন্তু সেই সমস্যা তো সমাধান হয়ে গেছে। তারপরেও উনি এ কাজ কেন করলেন?প্রায় ছয় মাস আগে শিশির একজনকে
মাদকসহ পুলিশের নিকট হস্তান্তর করেছিলো। ছেলেটা স্কুল ও কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে নেশাদ্রব্য বিক্রয় করতো। আর সেও ছিলো ড্যাস কলেজের ছাত্র। আর সম্পর্কে সবুজ স্যারের ভাইয়ের ছেলে। তাকে পুলিশ ধরাতে উনি বারংবার বলেছিল কেসটা সেখানেই নিষ্পত্তি করতে। কিন্তু সেই ছেলে
ছিলো প্রচুর বেয়া/দব। চাচার দাপটে পুলিশকেও যা নয় তা বলে অপমান করেছিল। পরে পুলিশ রেগে এমনভাবে কেস
সাজিয়েছিল যে তার কারাদণ্ড হয়েছে। সেই রাগেই গতরাতে
উনি লোডশেডিং করে শিশিরের বাসাতে লোক ঢুকিয়ে বোম
সেট করে রাখেন। নেহাৎ গোপন সূত্রে তাদের একজন লোক শুদ্ধকে আকার ইঙ্গিতে বোমের কথা আগেই জানিয়েছিল ।
নয়তো শিশির শুদ্ধরও করার কিছু থাকত না। তবে একথাটা জানার পরপরই শুদ্ধ ফোনে শীতলের বাবামাকে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বলে। ততক্ষণে শীতল ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের
গিয়েছিল। এবং এর আধা ঘন্টা পর ওরা হন্তদন্ত হয়ে বাসায় পৌঁছায়। কেউ যাতে সন্দেহ না করে তাই শিশির বাসায় ঢুকে সঙ্গে সঙ্গে বাগানের প্রাচীর টপকে বেরিয়ে যায়। আর শুদ্ধ ওর ফ্ল্যাটের যাওয়ার জন্য বিল্ডিংয়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে।
ঠিক তখনই পরপর দু’টো বোম ব্ল্যাস্ট হয়। সেই সঙ্গে চোখের পলকে ধ্বংস হয়ে যায় ‘স্বপ্নগাঁথা’ নামের খুব শখের বাসাটা।
তারপর পরিকল্পনা মাফিক শিশির তার বাবা- মাকে নিয়ে গা ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে পড়ে। আর শুদ্ধ প্রচন্ড ভয় পাওয়ার ভাণ
ধরে নিজে বিধস্ত অবস্থা করে শীতলকে নিতে বেরিয়ে পড়ে। যেনো ভয়ে শহরমুখো হবে না ভেবে পালাচ্ছে। তখন শীতল চোখ টিপটপ করে তাকিয়ে নিজের অবস্থানটা বোঝার চেষ্টা করল। চোখের পাতা ঝাঁপিয়ে শুদ্ধকে দেখে পেছনে তাকাল।
দেখে ওর বাবা মা ভাইসহ সবাই ঠিক আছেন, সুস্থ অবস্থায় বসে ঘুমাচ্ছেন। ওদের গাড়িটা চলছে হাইওয়ের উপর দিয়ে।
শীতল নিজের হাতে নিজে চিমটি কেটে ব্যথা পেয়ে মুখভর্তি হাসল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়ে সব চিন্তা ছুঁড়ে দিলো পিচঢালা রাস্তায়। তার বাবা মা ভাই ভালো আছেন, সুস্থ আছেন এই ঢের। শুদ্ধ তখন আড়চোখে তার কান্ডখানা দেখে পানি এগিয়ে দিয়ে বলল,
-”রায়হান তোর সঙ্গে প্রাঙ্ক করেছিল। তবে সত্যি সত্যিই বোম ব্ল্যাস্ট হয়েছে পাশের বাসায়। সেই আঁচে তোদের বাসার বেশ ক্ষতি হয়েছে। বাসাটা ঠিক না করা অবধি চট্টগ্রামেই থাকবি তোরা। আশেপাশের জায়গাগুলো ঘুরবি, মনও ভালো হবে।
তোর বাবা-মায়ের গড়া শখের বাসাটার ক্ষতি হয়েছে দেখে
উনারা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলেন। তাই আমি এ প্রস্তাব দিয়েছি। তুই যেনো বারবার এসব কথা বলে উনাদের মন খারাপ করে দিস না। তোর তো আবার মাথাতে ঘিলু বলে কিছুই নেই তাই আগেই জানিয়ে দিলাম।”
শীতল হাসি হাসি মুখে সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে শুদ্ধর পানে তাকিয়ে রইল। সেকেন্ড, মিনিট কেটে ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও তার দেখার শেষ হলো না। শুদ্ধও কিছু বলছে না। একমনে সামনে দৃষ্টি রেখে ড্রাইভ করছে সে। তখন শীতল শুদ্ধর বা হাত খোঁচা মেরে ইশারা ক্ষুধা পেয়েছে বোঝালো। শুদ্ধ তার ইশারা বুঝে জানাল সামনে থামাবে। কিছুদূর গিয়ে সকলেই নেমে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিলো। শিশির এবার ড্রাইভিং সিটে বসল আর শুদ্ধ তার পাশের সিটে। আর শীতল বাবা মায়ের মাঝের সিটে। এভাবে ঘন্টার ঘন্টা পেরিয়ে তারা গভীররাতে চট্টগ্রামে পৌঁছাল। তারপর সকলে যে যার পছন্দ মতো রুম বেছে কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। আজ খুব ধকল গেছে তাদের উপর দিয়ে। পরেরদিন সকালে শুদ্ধ
যতটুকু পারে সবকিছুর ব্যবস্থাও করে দিলো। যাতে উনাদের সমস্যা নাহয়। তারপর সকালের নাস্তা প্রস্তাব রাখল,
-” আঙ্কেল আমি শীতলকে আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই।”
একথার জবাবে শিশিরের বাবা কিছু বলার আগেই শিশির বলে উঠল,
-” আমি আমার বোনকে এভাবে ছাড়তে পারব না শুদ্ধ। তুই বন্ধুরুপী ভাই হলেও…!”
-”আম্মু ভিডিও কলে কথা বলবে, নে ফোন ধর।”
-”ফোন কোথাও পেলি?”
-”দারোয়ানকে দিয়ে ব্যবস্থা করেছি।”
একথা বলে শুদ্ধ উঠে রুমে চলে গেল। তখন শুদ্ধর মা মৃদু স্বরে সালাম দিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। শীতলের বাবা-মা সালামের জবাব দিয়ে বিনয়ীভাবে কুশল বিনিময় করলেন। ততক্ষণে শিশির শীতলকে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে।
মেয়েটা যাবে না তবুও জোর করে শিশির তাকে সরিয়েছে।
এদিকে বড়রা আলাপ আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলেন। শিশির তখন শুদ্ধকে ডেকে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে স্থান ত্যাগ করল। কারণ শুদ্ধর মা শুদ্ধর সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলেন। শুদ্ধ ফোন ধরতেই মমতাময়ী মায়ের
মুখখানা স্ক্রিনে ভাসতে দেখে হাসল। এই একজন নারীকে সে কখনো ফাঁকি দিতে পারে না, মিথ্যা বলতেও পারে না। না বলতেই উনি কীভাবে যেনো সব বুঝে যান। ঠিক একারণেই যে কোনো সমস্যায় পড়লে সর্বপ্রথম স্মরণ করে তার মাকে।
তখন আপনা-আপনিই একটা সমাধা খুঁজে পায় সে। যেমন গতরাতে পেয়েছে। ছেলের মুখে প্রশান্তির হাসি দেখে তখন মা বললেন,
-” বউকে নিয়ে এসো আমি অপেক্ষায় আছি, আব্বাজান।”
শুদ্ধ হেসে মাথা নাড়িয়ে নিঃশব্দে হাসল। তারপর বাসার সকলের খোঁজ নিয়ে ফোন রাখতেই কলারে টান পড়ল। সে ভ্র কুঁচকে তাকাতেই দেখে শীতল রাগী নেত্রে তাকিয়ে আছে। সমান সমান হতে না পেরে কলার ধরতে তার কষ্ট’ই হচ্ছে।
কলার থেকে শীতলে হাত সরাতে গেলে শীতল বলল,
-”আপনার মা কাকে নিয়ে যেতে বললেন?”
-”আমার বউকে।”
-”আপনি বিয়ে করতে পারেন না শুদ্ধ ভাই।”
-”কেন পারব না?”
-”কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসি।”
-”তো আমি কি করতে পারি?”
-”বিয়ে করলে আমাকে বিয়ে করবেন আপনি, অন্য কাউকে নয়।”
-”তোর মাথায় না আছে ঘিলু আর না বুদ্ধির ছিঁটেফোঁটা। এ ছাড়াও আমি আমার বউকে ভীষণ ভালোবাসব। আমি যত কাল বেঁচে থাকব তার জন্য ভালোবাসার কমতি রাখব না।
ভালোবাসা কাকে বলে প্রতিনিয়ত প্রতিটা ক্ষণে একটু একটু করে বোঝাব। তুই তো সাধারণ কথাও বুঝিস না, তাহলে বল তোকে ভালোবাসা কীভাবে বোঝাব? বুদ্ধিও তো নেই। এখন সর বউ খুঁজতে বের হতে হবে আমার।”
-”তা কোথায় বউ খুঁজতে যাবেন শুনি?”
-”এখানকার পথে-ঘাটে, চিপায়- চাপায়, নাকি সুন্দর সুন্দর
বউ পড়ে থাকে। যাই গিয়ে ডজন খানিক তুলে আনি।”
To be continue………!!