#আরো_একটি_বসন্ত
#পর্ব_৫
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
-”এখানকার পথে-ঘাটে, চিপায়- চাপায়, নাকি সুন্দর সুন্দর
বউ পড়ে থাকে। যাই গিয়ে ডজন খানিক তুলে আনি।”
-”ডজন খানিক!”
-“কম হয়ে গেল নাকি আরো আনতে বলছিস?”
-”হাজারটাকে আনুন তবে একটা শর্ত’ই জারি থাকবে।”
-‘কি শর্ত?”
-”আমার শুদ্ধর ভাগ আমি কাউকে দিবো না মানে দিবো না। দিনেও তো নাই, রাতে কথা ভাবনাতেও আনতে চাচ্ছি না।”
-”কি আশ্চর্য, তোর শুদ্ধ কবে হলাম?”
-”আপনি হোন নি তবে আমি মনে মনে করে নিয়েছি।”
-”একটু তো লজ্জা কর আমি তোর ভাইয়ের বন্ধু।”
-”সেসব হিসাব কাটাকাটি। আমি শুধু জানি আপনি আমার মনের মানুষ, প্রাণের মানুষ। যার সঙ্গে হাসতে চাই, বাঁচতেও চাই। বুক ফুলিয়ে গর্বসমেত বলতেও চাই, ‘সে আমার।”
একথা শুনে শুদ্ধ নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তখন শীতল তার বেনুণিটা নাড়াচাড়া করে মুখভর্তি হাসল৷ যেনো একথা বলে পূর্ণের কাজ করে ফেলেছে। আর সেই পূর্ণের চোটে ওর জীবনখানাও ধন্য হয়ে গেছে।তবে শুদ্ধ নিরুত্তর থেকেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। কিছু কিছু উত্তর মুখে নয় কাজে করেই দেখানো উচিত। মুখে তো অনেক কিছুই বলা যায়। সে নাহয়
কাজে করে দেখাক। অতঃপর ঘন্টা দু’য়েকের মধ্যেই বিয়ের ব্যবস্থা করে শীতলের জন্য শাড়ি এবং গয়না নিয়ে সে ফ্ল্যাটে ফিরলো। শীতল ততক্ষণে জেনে গেছে কী ঘটতে যাচ্ছে। সে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে মায়ের হাত ধরে চুপ করে বসে আছে। আর তার মা তাকে কিছু উপদেশ দিচ্ছেন।
সেই উপদেশগুলেই সে মন দিয়ে শুনছে। একটুপরেই শিশির এসে শাড়ি গয়না দিয়ে তৈরি হয়ে ড্রয়িংরুমে আসতে বলল।
তারপর দ্রুত পায়েই প্রস্থান করল সে। শীতলের মা নিজেই
মেয়েকে তৈরি করে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন ড্রয়িংরুমে।
সেখানে শুদ্ধ, শিশির,শীতলের বাবাসহ মসজিদের ইমাম ও কাজি বসে আছেন। কাজি আপাতত লিখালিখিতে ব্যস্ত। শুদ্ধর মাও ভিডিও কলের মাধ্যমে উপস্থিত হয়েছেন। তখন
উনি শীতলকে নববধূর সাজে দেখে বিনয়ী হেসে বললেন,
-”মাশাল্লাহ, আমার আম্মাজানকে খুব মিষ্টি দেখাচ্ছে।”
উনার কথায় শীতল লাজুক হেসে সকলের উদ্দেশ্যে সালাম দিলো। উপস্থিত সকলেই সালামের উত্তর নিয়ে বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ করতে উদ্যত হলেন। কাজিও লেখালেখি পর্ব সমাপ্ত করে বিয়ের প্রক্রিয়া শুরু করলেন। অতঃপর দুই পরিবারের সদস্যের উপস্থিতিতে শুদ্ধর সঙ্গে শীতলের বিয়ে সম্পূর্ণ করা হলো। দোয়া করে মুখ মিষ্টি করে কাজির সঙ্গে ইমাম বিদায় নিলেন। শুদ্ধর আম্মুও টুকটাক কথা বলে কল কাটলেন।
হঠাৎ শুদ্ধর সঙ্গে শিশিরের চোখাচোখি হয়ে গেল। শিশিরের চোখে পানি দেখে শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বলল,
-” শীতল এখানেই থাক তবুও কাঁদিস না।”
শুদ্ধর কথা শুনে শিশির কনিষ্ঠ আঙুলে চোখের কোণা মুছে
হাসল। তবে বাবা মা সামনে কিছু বলল না। তখন শীতলের আম্মু শীতলকে নিয়ে পাশের রুমে গেলেন। একটুপরেই ওরা বের হয়ে যাবে কিছু জিনিস গোছগাছ করতে হবে। শীতলের বাবাও চোখ মুছে উঠে চলে গেলেন নিজের বরাদ্দকৃতরুমে।
উনার একমাত্র মেয়ের বিয়ে উনি এভাবে দিতে চান নি। কিন্তু
পরিস্থিতি বাধ্য করল। তাছাড়া শুদ্ধর সঙ্গে শীতলের বিয়ের কথা পাকাপাকি করা ছিলো। শিশির নিজে প্রস্তাব দিয়েছিল শীতলকে বিয়ের করার জন্য। তার মনে হয়েছে শুদ্ধ পারবে তার বোনকে ভালো রাখতে, সুখে রাখতে। পরে শুদ্ধও তার মাকে জানানোর পর উনিই বিয়ের কথা পাকাপোক্ত করেন।
এবং জানান সামনের বসন্তেই ওদের চারহাত এক করবেন।
এরপর থেকেই শুদ্ধ শীতলদের বাসাতে যাওয়া-আসা শুরু করেছিল। নতুবা সে ভুলেও শিশিরের বাসায় যেতো না। এর
কারণ তাদেরই এক বন্ধু অন্য এক বন্ধুর বোনকে পালিয়ে বিয়ে করেছিল। এতে ওদের বন্ধুত্বে ফাঁটল ধরেছিল। এখন তারা একে অপরের চোখের বিষ। তাদের মাঝে সম্পর্ক ছিল এটাও তারা মানতে নারাজ। কারো সঙ্গে কারো দেখা হলেও কথা তো দূরে দৃষ্টি মেলে তাকায় না। তাছাড়া শুদ্ধ শীতলের কথা শিশিরের মুখে অনেক শুনেছে। সেই সঙ্গে সর্তকও হয়ে গিয়েছিল। যাতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে তাদের বন্ধুত্বেও ফাটল ধরে। তবে শিশির ব্যাপারটা খেয়াল করে হঠাৎই বলে ফেলে়ছিল,
-”শীতলকে বিয়ে করবি?”
-”কিহ্, পাগল হয়েছিস তুই?”
-”মোটেও না।”
-”তা হয় না শিশির।”
-”আমার জন্য শীতলকে বোনের নজরে দেখতি এখন থেকে নাহয় বউয়ের নজরে দেখবি।”
-”হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের কারণ জানতে পারি?”
-”কারণ আমার বোন তোর কাছে ভালো থাকবে।”
-”এত বিশ্বাস?”
-”আমার কাছে বন্ধু মানে কলিজায় স্থান দেওয়া ব্যক্তি। তোকেও তাই দিয়েছি। তাছাড়া শীতলের জন্য ছেলের অভাব হবে না তারপরেও রিস্ক নিতে চাচ্ছি না।”
-”আমি শীতলকে সেভাবে ভাবতে পারব না। কারণ তোরই মতো আমিও তাকে ছোট বোন ভাবি, তুই সম্মোধন করি।
তাকে হঠাৎ বউ এর …।”
-”রেজিষ্ট্রিপেপারে সাইন করার সঙ্গে সঙ্গে তোদের সম্পর্কের ধারা বদলাবে, সম্মোধনেও পরিবর্তন আসবে। ততদিন মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে রাখ, তুই কে তুমি করার।”
-” এসব মজা আমার পছন্দ হচ্ছে না শিশির।”
-”আমার কলিজার বোনটা মজা করার জিনিস নয়। সেটা তোর থেকে ভালো কেউ জানে না। আমি যা বলছি ভেবেই বলছি। আর শোন, সমস্যা থাকলেও শুনছি না। বন্ধুত্বের দাবিতে আমি শীতলকে তোর জন্য চুজ করলাম। এখন তুই প্রমাণ দে, আমার কথা তোর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ!”
-“পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত বদলাবি নাতো? মনে হবে না তো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?”
-“কখনো না। তবে তোর থেকে যদি প্রতারিত হই তবে জীবত মুখে আর বোনের সামনে দাঁড়াব না, ওয়াদা করলাম।”
একথা শুনে শুদ্ধ জবাবে কিছু বলতে পারেনি। তাছাড়া কেউ তার জীবনেও নেই। বিয়ের আগে প্রেম জিনিসটা তার ভীষণ অপছন্দের। কারো কারো প্রেম পরিণতি স্বচক্ষে দেখেছেও।
তাছাড়া তার মা একটা কথা সবসময় মনে করিয়ে দেন,
-”আব্বাজান তুমি যেমন সঙ্গীও পাবে তেমন।”
ঠিক একথাটা সর্বদা তার কর্ণকুহরে বাজতে থাকে। শিশিরও সেদিন পর সেই কথা তুলেছিল না। সময় দিয়েছিল ভাবতে।পরে হঠাৎ শুদ্ধর মা ওদের বাসায় গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে পাকা কথা দিয়ে এসেছেন। তবে শিশিরই সবাইকে নিষেধ করেছিল শীতলকে ব্যাপারটা জানাতে। দায়িত্বও নিয়েছিল পরে শীতলকে সে নিজে বুঝিয়ে বলবে। যদিও তখন শীতল শুদ্ধকে তেমনভাবে চিনতো না, জানতো না। শিশিরের কাছে শুদ্ধর নামে শুধু নানান গল্প শুনতো। তারপর বিয়ে ঠিকঠাক হওয়ার পর সে শুদ্ধকে সরাসরি দেখেছে, অজান্তেই প্রেমেও পড়েছে। এমনকি নিজেই প্রেমে প্রস্তাবও দিয়েছে শুদ্ধকে।
ফলস্বরূপ শুদ্ধ তাকে কান ধরিয়েছে। এখন ড্রয়িংরুম ফাঁকা দেখে শিশির মুখ খুলল,
-”শীতলের সমস্ত দায়িত্ব তোকে দিয়ে নিজেকে ভীষণ হালকা লাগছে। বোনের চোখে ভাষা পড়তে পারি বিধায় আর দেরি করলাম না। তাছাড়া আমি জানি আমার বোন তোর কাছে নিরাপদে থাকবে।”
একথা বলে শিশির শুদ্ধকে বুকে জড়িয়ে ধরল। তারপর দুই বন্ধু বসে মিষ্টি খেতে খেতে কিছু নিয়ে আলোচনাও করল। খানিকক্ষন পরেই, শুদ্ধ সময় দেখে শিশিরকে জানাল ওদের এবার বের হওয়া উচিত। নয়তো মিঠাপুকুর পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে। একথা শুনে শিশির তার মাকে ডেকে শীতলকে বিদায় দেওয়ার কথা জানাল। তারপর চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে সকলে শীতলকে বিদায় দিলো। শুদ্ধও আর না দাঁড়িয়ে তাৎক্ষণিক শীতলকে নিয়ে রওনা দিলো মিঠা পুকুরের পথে।
বাসে পাশাপাশি সিটে বসে আছে দু’জন। শীতল বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আকাশপানে তাকিয়ে আছে। তার কেন জানি সুখী সুখী অনুভব করছে। মনে হচ্ছে, প্রিয় মানুষটাকে হঠাৎ করে নিজের করে পাওয়ার মতো সুখ আরো কোনোকিছুতে নেই। এই সুখ হৃদয়ে একগুচ্ছ প্রশান্তি এনে দিয়েছে।অসীম সুখে মনে খুশির বান ডেকেছে। এসব ভেবে সে শুদ্ধকে মৃদু স্বরে বলল,
-”এই যে শুদ্ধ পুরুষ এবার আপনার কী হবে, হুম, হুম?”
-“কী আর হবে বউ হয়েছে, বাসর হবে, তারপর বাচ্চাকাচ্চা।’
-” শুদ্ধ পুরুষ চিন্তা ভাবনাকেও এবার শুদ্ধ করুন।”
শুদ্ধ এবার ঠোঁটে কোণে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে শীতলের কানে কানে বলল,
-”পৃথিবীর কোনো পুরুষই তার বউকে কাছে শুদ্ধ থাকে না।
আমিও এর ব্যতিক্রম হবো না।”
To be continue……..!!