আরো_একটি_বসন্ত #পর্ব_৭ (অন্তিম পার্ট)

0
499

#আরো_একটি_বসন্ত
#পর্ব_৭ (অন্তিম পার্ট)
#নূরজাহান_আক্তার_আলো

শীতল উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইল। পায়ের ব্যথায় সে কাবু। পরনের কামিজটারও যাচ্ছে তাই অবস্থা। তখন শুদ্ধ আরেকটা ড্রেস এনে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-”আসছি আমি, তুমি ড্রেস বদলে নাও।”

একথা বলে কয়েক পা বাড়িয়েও পুনরায় পিছু ফিরে বলল,

-”ব্যথাযুক্ত পায়েই আমি বাসরটা সেরে ফেলব। এটাই হবে আমার কথা অমান্য করার শাস্তি।”

একথা বলে শুদ্ধ প্রস্থান করল। আর শুদ্ধর লাগামহীন কথা শুনে শীতল বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। এটা কী বলল শুদ্ধ! মানুষটার মুখে কী লাগাম বলে কিছু নেই? তারপর অনেক
কষ্ট উঠে পোশাক পরিবর্তন করে শুয়ে পড়ল। অদূরে একটা পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে। অদ্ভুত সেই ডাক। কেমন শরীরও ছমছম করছে। ক্ষণে ক্ষণে কুকুরও ডাকছে। শীতল ভয়ার্ত দৃষ্টিতে পুরো রুমে চোখ বুলালো। তখনই অন্ধকারের ছেঁয়ে গেল রুম। পায়ের ব্যথা অগ্রাহ্য করে উঠে বসতেই শুদ্ধ এসে রুমে হাজির হলো। হাতে ব্যথানাশক স্প্রে। অন্যহাতে জ্বলন্ত মোমবাতি। সে মোমবাতি টেবিলের উপর রেখে পানির গ্লাস সহ ওষুধ এগিয়ে দিলো শীতলের দিকে। শীতল ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল,

-”কিসের ওষুধ?”

-”যা ভাবছো তাই, নাও ঝটপট খাও।”

-”আপনার আম্মু যে বললো উনার নাতি প্রয়োজন।”

-”এটা পেইন কিলারগাধী। আর কেবল আজ বিয়ে হলো এরই মধ্যে বাচ্চার পরিকল্পনাও হয়ে গেছে, আশ্চর্য।”

-“না হওয়ার কী আছে? আমি কি আর ছোট আছি?”

শুদ্ধ শীতলের সঙ্গে অহেতুক বকবক না করে শুয়ে পড়ল। মেয়ে মানুষ দুই লাইন বেশি বুঝে। আর এই পাগলের মাথায়
এসব কথা ঢুকানোর মানে খুঁজে পেলো না সে। তখন শীতল আদুরে বিড়াল ছানার মতে শুদ্ধর শরীর ঘেষে শুতেই শুদ্ধর ফোনে কল আসল। সে রিসিভ করে জানতে পারল সবুজের বাসায় থেকে দু’জনকে আঁটক অবস্থায় পাওয়া গেছে। এরা মূলত পুলিশের হাত থেকে পালানো আসামি। এখন কতৃপক্ষ সবুজকে এরেস্ট করেছে সঙ্গে রিমান্ডের আদেশও এসেছে।
আর রিমান্ডে নিয়ে সত্য কথা বের করানোর দায়িত্ব পেয়েছে শিশির। কারণ শিশিরের বেঁচে থাকার কথা জানে অফিসার সাদ্দাম আর শুদ্ধ। তারাই ইচ্ছাকৃতভাবে দায়িত্বতা শিশিরকে দিয়েছে। যাতে শিশির মনের রাগ তুলতে পারে আর সবুজও
ঠিকঠিক শাস্তি ভোগ করে। এসবশুনে শুদ্ধ নিঃশব্দে হাসল।
তারপর কল কেটে শীতলকে শক্ত ধরে জড়িয়ে ধরে বলল,

-”ভাবতেও পারি নি এই কেসের সমাধান এত জলদি হবে।”

-”তার আগে বলেন আমাকে মিথ্যা বলেছেন কেন?”

-”কবে, কখন, মিথ্যা বলেছি”

-“ওই যে, আমাদের বাসায় বোম রাখার ঘটনাটা।”

-”টেনশন করবে তাই।”

-”টেনশনও তো এই মুহূর্তেও করছি।”

-”কেন?”

-”বুঝবেন না আপনি.. ।”

শুদ্ধ শীতলের কথা শেষ করতে না দিয়েই আঁকড়ে ধরেছে খুব শক্তভাবে। পরক্ষণেই শীতল অনুভব করলো তার ওষ্ঠে অন্য কারো বিচরণ। এক পুরুষালী হাতে বন্দি সে। সে প্রচন্ড
ছটছট করেও ব্যর্থ হলো। তার বলা কথাগুলো গোঁংড়ানিতে পরিণত হলো। তবুও শুদ্ধ তাকে ছাড়ল না। বরং সে ঘোরের মাঝে চলে গেছে। তখন দমকা বাতাস নিভিয়ে দিলো জ্বলন্ত মোমবাতি। পুরো রুমে আঁধারে ডুবে গেল। সেই সঙ্গে বাড়ল শুদ্ধর করা পাগলামি মাত্রা। কথা নেই, শব্দ নেই, চারদিকে স্তব্ধতা। শীতলও ততক্ষণে শান্ত হয়ে গেছে। প্রিয় মানুষটার স্পর্শে সে এখন পরাজিত, পরাস্ত।
_____________________________

পরেরদিন সকালে নাস্তা সেরে শীতল ব্যথামুক্ত পায়ে শখের সঙ্গে ঘুরতে বের হলো। শুদ্ধ এখনো ঘুমাচ্ছে। তাকে খুঁচিয়েও তুলতে পারে নি। তাই শুদ্ধর আম্মুও ডাকতে নিষেধ করেছে। এখন হাতে আপাতত কাজ নেই। তাই শখের সঙ্গে সে পাশের
শান বাঁধানো পুকুর পাড়ে এসেছে। আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তখন শীতল শেষের সিঁড়িতে পানিতে পা ডুবিয়ে বসল। ঠান্ডা পানিতে শরীর শিরশির করে উঠল সারা শরীর।
ঢাকার যানজটের শহর ছেড়ে অনেকদিন পর গ্রামে এসেছে। আর গ্রামের দৃশ্য মন শীতল করে দিচ্ছে। এই যেমন যতদূর চোখ যাচ্ছে সবুজ আর সবুজ। সব জমিতে ভিন্ন ভিন্ন ফসল লাগানো। ততক্ষণে শখও বসেছে তার পাশে, হাতে কামরাঙা আর কাঁচা লবণ। শীতলের দিকে অন্য একটা এগিয়ে দিলে শীতল নিয়ে কামড় দিতেই মুখ কুঁচকে ফেললো। ভীষণ টক খেতে। তবুও তারা কিছু খাওয়া থামাল না। বরং গল্পে গল্পে
খেয়ে ফেললো বেশ কয়েকটা কামরাঙা।

একটু পরে একজন বুয়া এসে জানাল শুদ্ধ ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। শীতল যেনো নিজে গিয়ে দেখে তার কী লাগবে, না লাগবে। এই আদেশ করেছে শুদ্ধর মা। একথা শুনেই শীতল উঠে বাসার দিকে হাঁটা ধরল। ওর যাওয়া দেখে শখ হাসছে।
একদৌড়ে শীতল বাড়ির উঠানে গিয়ে থামল। তাকে হুড়মুড় ঢুকতে দেখে শুদ্ধ ভ্রুজোড়া কুঁচকে বলল,

-”কোথায় গিয়েছিল তুমি?”

-”পুকুর পাড়ে।”

-”কেন?”

-”এমনিতেই।”

-”আর যাবে না। আর ঘুম থেকে উঠে যেনো চোখের সামনে দেখতে পাই। নয়তো খবর আছে। খাবার নিয়ে সোজা রুমে যাও, আমি আসছি।”

শীতল মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেল। শুদ্ধও ফ্রেশ হয়ে খেতে বসল। তখন প্রথম লোকমা মুখে দিয়ে গিয়ে শীতল ওর হাত টেনে নিজের মুখে নিলো। পরপর একই ঘটনা ঘটনাতে কিছু বলতে গেলে শীতলই বলল,

-”আমি স্বশরীরে উপস্থিত থাকাকালীন আপনার প্লেটের সর্বপ্রথম লোকমা আমার নামে বরাদ্দকৃত থাকবে, থাকতেই হবে।

-”কেন, থাকতেই হবে কেন?”

-”এটা আমার বউ রুপী অধিকার তাই।”

-”বুঝলাম, তা আমার পেটের উপর পা তুলে ঘুমানোও বুঝি আপনার বউ রুপী অধিকার?”

-”আসলে হয়ে..ছে কী।”

-”থাক আর বলতে হবে না বুঝেছি।”

এভাবে গল্পের ছলে শুদ্ধ নিজে খেলো শীতলকেও খাইয়ে দিলো। তারপর গ্রামের বেশ মজা করেই শীতলের দিনগুলো কাটতে লাগল। এই যেমন, শাশুড়ীর সঙ্গে সঙ্গে থাকা, নানান কাজর্কর্মে সাহায্য করা। শখের সঙ্গে বাজি ধরে কাঁচা তেঁতুল চিবিয়ে খেয়ে ভাত খেতে না পারাতে শাশুড়ীর বকা খাওয়া।
সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে শুদ্ধর সঙ্গে হাঁটতে বের হওয়া, গল্প করা, সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে তার আঙুল স্পর্শ করা। এভাবেই কেটে গেছে একমাস। শীতলের বাবা মা ঢাকায় শুদ্ধর ফ্ল্যাটে থেকে স্বপ্নগাঁথার পুনরায় নতুন করে তৈরি করছেন। পুনরায় সেখানে পূর্বের মতোই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে ‘স্বপ্নগাঁথা’ নামক সুখপূর্ণ বাড়িটি। দু’একের মধ্যেই উনারা সেখানে চলে যাবে। আবার গড়ে উঠবে শীতলের মায়ের সোনার সংসার।
ওদিকে শিশির সবুজকে রিমান্ডে নিয়েছিল মনমতো করেই।
সবুজের যাবৎ জীবন কারাদন্ড হয়েছে। সেই সঙ্গে উন্মোচন হয়েছে সবুজ নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তার স্ত্রীকে মেরেছে। কারণ তার স্ত্রী তাকে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলতো। বার বার ঘ্যান ঘ্যান করত নামাজ আদায়ের জন্য। হ্যান্ডসাম লুক ছেড়ে বলতো গাঁইয়াদের মতোন দাঁড়ি রাখতে, মার্জিত হতে।
আসলেই কী এসব হাই-সোসাইটির সঙ্গে যায়? মোটেও না।
আর উনার স্ত্রী ছিলেন পরহেজগার মানুষ। স্বামীর পাপ উনি মানতে পারতেন না। এত মার খেয়েও উনি হার মানতেন না।
বরং হাদীস শুনাতে যেতেন, ভালো ও মন্দের পার্থক্য বুঝাতে গালাগালি শুনতেন। এছাড়াও প্রতিদিন স্বামীর আনা ঘুষের টাকা দেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলতেন, মোনাজাতে বসে কান্না কাটি করতেন। মুত্যুকে স্মরণ করার কথাও বলতেন। কিন্তু সবুজ এসবে বিরক্ত হতেন, ভীষণ বিরক্ত। অবশেষে নেশা করে মেরেই ফেললেন উনার স্ত্রীকে। হয়তো একদিন বুঝবেনও, উনি ভুলকে ফুল ভেবে কত বড় ক্ষতি করেছেন।

দেখতে দেখতে দিন গেল, মাস গেল, গতবছরের বসন্তকে পার করে নতুন বসন্তের আগমনও ঘটল। আজকে পহেলা
বসন্ত। শুদ্ধ এখনো বাসায় ফেরে নি। অথচ আজকে তাদের ঘুরতে যাওয়া কথা। শীতল এত সুন্দর করে সেজেগুজে মন ভার করে বসে আছে। মানুষটা কাজ ছাড়া কিছু বোঝে না।
সে কাজে চাপে হয়তো ভুলেই গেছে তার বউ আছে। আর আজ বউকে সময় দেওয়ার কথাও দিয়েছিল। পুরুষ মানুষ আসলেই মেয়েদের মন বুঝে না। এসব ভেবে সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। তখন নিচে চোখ যেতেই দেখে শুদ্ধর গাড়ি থেকে ভেতরে প্রবেশ করছে। শীতলের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। পরক্ষণেই হাসিমুখ আড়াল করে দৃশ্যমান করল মলিন অভিমান মুখ। সে দ্রুত পায়ে গিয়ে আগে দরজা খুলে সরে গেল। রান্নাঘরে গিয়ে টুকটাক কাজও করতে লাগল।
তার এখন নিজস্ব সংসার হয়েছে। শুদ্ধর সুবিধার কথা ভেবে অফিসের কাছে বাসাও নিয়েছে। শুদ্ধর মা আর শখ গ্রামেই থাকেন। উনাদের এই শহর ভালো লাগে না, দমমবন্ধ লাগে।
মূখ্য কথা শুদ্ধর বাবার কবর বাসার পাশেই। শুদ্ধর আম্মুর রুমের জানালা খুললেই দেখা যায়। সময় অসময়ে চুপ করে স্বামীর কবরের দিকে তাকিয়ে থাকেন উনি। মনে মনে গল্পও সাজান, বলেন প্রিয় মানুষটাকে। তাই শুদ্ধ আর জোর করে
নি। সে জানে মৃত্যুর আগে তার আম্মা বাসা ছেড়ে একরাতও
বাইরে কোথাও থাকবে না। কারণ শুদ্ধর বাবা কোথাও যেতে
দিতেন না উনার সহধর্মিণীকে। যেখানেই যেতেন সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন, সঙ্গে করে ফিরতেন। খুব ভালোবাসতেন উনার সহধর্মিণীকে।তাই শুদ্ধও জোর করে নি। আর আগামী মাসে শখের বিয়ে। শখ চলে গেলে উনার দেখভালের জন্য আরো দু’জনকে রেখে দিবে। এমনিতেও শীতল প্রতি সপ্তাহে দুইদিন উনার কাছে গিয়ে থাকে তাতে শুদ্ধ খুশিই হয়। শুদ্ধ সিঁড়ি বেয়ে উপরে এসে দেখে দরজা হাট করে খোল। তার বুঝতে বাকি নেই মূল ঘটনা। সব দোষ ওই শিশিরের। গাধাটা প্রেম করবে অথচ প্রিয় মানুষটাকে ভয়ো বলতে পারছিল না। সে মেয়ে আবার তাদেরই কলিগ। আজ বিশেষ দিনে প্রেম রচনা করার ভীষণ শখ শিশিরের।তাই বন্ধুকে সাহায্য করতে গিয়ে
দেরি করে ফেলেছে। এখন বউদের মান ভাঙতে হবে। এসব ভেঙে সে সাড়াশব্দ না করে গটগটিয়ে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। ভাবখানা এমন যেনো কিচ্ছু করে নি সে। তার এহেন আচরণে শীতল আরো রেগে গেল। রাগে দুঃখে একপর্যায়ে অঝরে কেঁদেও দিলো। হঠাৎ দুটো বলিষ্ঠ হাতের বাহুডোর নিজেকে আবিষ্কার করলো সে। কারো নিঃশ্বাস এসে পড়ল ন/গ্ন কাঁধে। শীতল অভিমান নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকালও না।
তখন এক মোহনীয় কন্ঠস্বর তার হৃদয়টা এফোঁড় ওফোঁড়
করে দিতে বলতে লাগল,

-”আরো একটি বসন্ত চাই যে, বসন্তে তুমি এসেছিলে আমার জীবনে। হৃদয়খানাকে হরণ করে লিখে ছিলে তোমার নাম।”

শুদ্ধর কথা শুনে শীতলের অভিমান নিমিষেই গলে গেল। সে
একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইল তার প্রেমিক পুরুষটার দিকে। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুদ্ধ হাসল। সে বুঝে না মেয়েটা কী দেখে এভাবে। মাঝেমধ্যে তাকিয়ে থাকে মুগ্ধতার দৃষ্টিতে। যে দৃষ্টিতে ছড়াছড়ি থাকে দৃঢ় ভালোবাসা, আর অটুট বিশ্বাস। তখন শীতল শুদ্ধর গলা জড়িয়ে ধরে
বলল,

-”আমিও এমন আরো অনেক বসন্ত কাটাতে চাই, প্রিয় শুদ্ধ পুরুষ। সেইসব বসন্তের রেশ কখনো না কাটুক, কখনো না।”

শীতলের কথা শুনে শুদ্ধ সন্তুষ্টির হাসি হাসল। তারপর তাকে একটানে জড়িয়ে নিলো তার প্রশ্বস্ত বুকে। যেখানে স্বযত্নে জমায়িত করা শীতলের জন্য ভালোবাসার প্রাচুর্যতা।

.সমাপ্ত.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here