আলতা_রাঙা_পা,০৩,০৪

0
821

#আলতা_রাঙা_পা,০৩,০৪
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩)

অমিত জুতা ফেরত নিয়েও আমার পিছু ছাড়ল না। আমার সাথেই বাসায় ঢুকল। বসার রুমে পৌঁছে বাঁক বদলাল। আমি ছুটলাম নিজের রুমে আর সে অংশ নিল বড়দের আলোচনায়। তারা কখন ফিরে গেল আমি বুঝতে পারিনি। তিন্নি বার কয়েক দরজার কড়া নেড়েছিল, কাজ হয়নি। আমি নিশ্চুপ বসে ছিলাম বিছানার ঠিক মাঝখানটায়। একসময় মোবাইল হাতে নিয়ে কল দিলাম আপুকে। সে রিসিভ করতেই একছুটে নালিশ করলাম বাবা-মায়ের নামে। তারপর শক্ত আঁটে জানিয়ে দিলাম, আমি বিয়ে করব না। যদি জোরাজুরি করে তাহলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। তাদের সম্মান রক্ষা করতে চাইলে বিয়ের আলাপ-আলোচনা যেন বন্ধ করে দেয়। বিপরীতে আপু তেমন কিছু বলল না। কোনো রকম উদ্বিগ্নতা দেখাল না। ছোট্ট করে ‘ আচ্ছা ‘ বলে কল কেটে দিল। আমিও মোবাইলটাকে দূরে ফেলে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ঝিমাতে থাকলাম। কিছু মিনিট অতিবাহিত হতেই বড় আপুকে কল লাগালাম। সর্বসময়ের মতো এবারও সে কল ধরতে পারল না। আমার কলের পর কলে বিরক্ত হয়ে বার্তা পাঠাল, ‘ তোর এত জেদ কেন, তায়্যু? একটু অপেক্ষা কর, ফ্রি হয়ে কলব্যাক করছি। ‘ আমার শরীর জ্বলে উঠল। তীব্র বিদ্রুপ করে বলতে ইচ্ছে হলো, ‘ এই জীবনে কি কলব্যাক করেছ? অপেক্ষা করাতে করাতে আমি ষোল থেকে বাইশে পা দিয়েছি, তাও তুমি ফ্রি হও না৷ তোমার শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ-স্বামী কয় জীবনের খাবার এ জীবনে খাচ্ছে যে তুমি রান্নাঘর থেকেই নিস্তার পাচ্ছ না? ‘ বলতে পারলাম না। বলার মতো অবস্থায় নেইও তো। তাই রা’গকে সংযত করে লিখলাম, ‘ আমি কিন্তু বিয়ে করব না, আপু। বাবাকে বলো এসব বন্ধ করতে নাহলে কিন্তু পালিয়ে যাব। ‘ আপু সে মেসেজের প্রতিউত্তর করল মাঝরাতে, ‘ যার সাথে পালাবি তার নাম-ঠিকানা দে। আমি বাবার সাথে কথা বলে দেখি কোনো সুবিধা করতে পারি নাকি। ‘ আমার ইচ্ছে হলো ফোনটা আছাড় মারি। নিজেকে শেষ করে দিই। এই অসহ্য রকম অবস্থা থেকে মুক্তির পথ কী? তাহলে কি সত্যি সত্যিই আমাকে পালাতে হবে? কিন্তু পালিয়ে যাব কোথায়? কার কাছে থাকব? কার কাছে নিজেকে আমানত করব? মুহূর্তে আমার চিন্তার দুনিয়া আঁধার হয়ে উঠল। সারা দিন-রাত উপোস থাকায় শরীরও দুর্বল হয়ে পড়ল। মস্তিষ্ক হলো অচল। আমি রা’গ-অভিমান ভুলে দরজার কপাট মেললাম। খাবারের খোঁজে রান্নাঘরের দিকে এগুতে বাবার রা’গা’ন্বি’ত কণ্ঠস্বর পেলাম। কোনো একটা ব্যাপারে মাকে শা’সা’চ্ছে খুব। আমার কর্ণপাত একটু মনোযোগী হতেই নিজের নামটা বাবার কণ্ঠস্বরে বেজে উঠল। সাথে সাথে আমি না জানা ব্যাপারটি বুঝে গেলাম। তাদের থেকে মনোযোগ সরিয়ে ফেলতেও মায়ের কথাটা অস্পষ্ট শুনতে পেলাম। তিনি বলছেন, ‘ শান্ত হও। আমি তায়্যিবাহর সাথে কথা বলব। ও বুদ্ধিমতী। বুঝিয়ে বললেই বুঝবে। ‘

আমি হেসে ফেললাম। ভাত বাড়ার জন্য প্লেট নিলাম। হাড়িতে চামচ ঢুকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বললাম, ‘ বুদ্ধিমতী বলেই বুঝাতে পারবে না, মা। ‘

___________
পরের দিন সকালে মায়ের সাথে দেখা হতেই আমার বুক কেঁ’পে উঠল। আঁ’ত’কে উঠে বললাম,
” বাবা তোমাকে মে’রে’ছে? ”

মা যেন আমার থেকেও বেশি চমকাল! বিস্ফারিত চোখে বলল,
” কী বলছিস? মাথা ঠিক আছে? ”

আমি তার কপালের ডানপাশের ফোলা জায়গায় আলতো হাত রেখে বললাম,
” আমি আর ছোট নেই, মা। মিথ্যা বলা বন্ধ করো। ”

মা কিছু একটা বলতে চেয়েও পারল না। আমি পা’গ’লা ষাড়ের মতো বাবার কাছে ছুটে গেলাম। সে ঘুম থেকে উঠেছে মাত্র। চোখে-মুখে শ্রান্ত ভাব।
” মাকে মে’রে’ছ কেন? ”

বাবার শরীরে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেল। বজ্রাহতের মতো চেয়ে থাকল কয়েক সেকেন্ড। তারপর বিস্ময় ঝরে পড়ল কণ্ঠস্বরে,
” আমি তোর মাকে মে’রে’ছি? ”
” হ্যাঁ, মে’রে’ছ। ”
” তুই দেখেছিস? ”

আমি সরাসরি হ্যাঁ বলতে পারলাম না। খানিকটা দুর্বল গলায় বললাম,
” আমি শুনেছি, মাঝরাতে মাকে ব’ক’ছিলে। ”

বাবা বিছানা থেকে নেমে এসে বললেন,
” তো ব’ক’ব না? তার আদরেই তো তুই বে’য়া’দ’ব হয়েছিস। ”

আমার চোখজোড়া ধপ করে জ্বলে উঠল। মান্য করা ভঙ্গি ছুটে গেল। বাবার চোখে চোখ রাখতে একটুও সময় নিল না। প্র’তি’বাদ করে উঠলাম,
” আমি যদি বে’য়া’দ’ব হয়ে থাকি তাহলে তোমার জন্য। সব দায় তোমার। তাহলে মাকে কেন ব’ক’বে? ”

বাবার শক্ত মুখ আরও শক্ত হয়ে উঠল। অনেকটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার পূর্বক্ষণ! আমি একটুও দমলাম না। বললাম,
” কিছু একটা হলেই মাকে দো’ষী মনে হয় কেন, বাবা? আমরা কি শুধু তার সন্তান নাকি আমাদের লালন-পালন দায় একমাত্র তার? যদি তাই হয় তাহলে তোমাকে বাবা ডাকা ছেড়ে দিই। এতে করে মা এবং আমরা সকলেই তোমার শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার থেকে মুক্তি পাব। তুমি যদি আমাদের খারাপ গুণগুলোকে গ্রহণ করতে না পার তাহলে ভালো গুণকেও গ্রহণ করবে না। ”
” তায়্যিবাহ! ”

বাবা প্রচণ্ড হুং’কার ছাড়লেও আমাকে টলাতে পারল না। ক্রো’ধে কম্পিত চোয়ালে চেয়ে থেকে বললাম,
” যার দো’ষ তাকে শা’স’ন করো অন্যকে নয়। ”

____________

বাবাকে ভ’য়া’নক রা’গি’য়ে আমি বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। টিকেট কেটে, বাসে চেপে সোজা হাজির হলাম বড় আপুর শ্বশুরবাড়ি। বসার রুমে ঘণ্টাখানেক বসে থাকার পর আপুর মুখদর্শন করতে পারলাম। সে আমার সামনে নাস্তা-পানি রেখে ব্যস্ত গলায় বলল,
” আসার আগে ফোন দিবি না? আমার বড় ননদ জামাই নিয়ে এসেছে। সেবা-যত্ন না করলে হয়? ”
” বাবা মাকে মে’রে’ছে। ”

বড় আপু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। সেকেন্ড কয়েক পর বলল,
” ফাজলামো করতে এসেছিস? ”
” আমি সত্যি বলছি, আপু। ”

বড় আপু শরবতের গ্লাস আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
” তুই দেখেছিস? ”
” না। ”
” তাহলে জানলি কী করে? ”
” কাল রাতে মাকে ব’ক’ছি’ল। ”
” বাবা তো প্রায়শই মাকে ব’কে। ”
” তারপর মা’রে। ”

বড় আপু আমার দিকে সন্দেহি চোখে তাকাল। বলল,
” আমি তো কখনও দেখিনি। ”
” মা দেখায়নি তাই। ”
” তোকে দেখিয়েছি? ”
” না, আমি নিজেই দেখেছি। কপালের একপাশ অনেকটাই ফোলা ছিল। ”

বড় আপু একটু চুপ থেকে বলল,
” ফোলা দেখেই ভেবে নিলি বাবা মে’রে’ছে? তোর ভাবনায় তো ভুলও হতে পারে? ”

শেষ কথাটায় আমার অমিতের কথা মনে পড়ল। সেও তো এমনটায় বলেছিল! তার আস্থাভরা মুখটা মনে পড়তেই আমার শিরদাঁড়া শক্ত হয়ে গেল। মেজাজ খারাপ হলো খুব। ক্ষ্যাপে গিয়ে বললাম,
” আমার কোনো ভুল নেই। আমি সঠিক। তুমি বিশ্বাস না করলেই আমি ভুল হয়ে যাব না। সব এক। সবাই মেয়েদের দুর্বলতাটাকেই মোক্ষম অস্ত্র বানায়। আমার বাবাও তাই করেছে। যার ফল তোমরা ভোগ করছ। ”

বড় আপুর চোখে-মুখে অসন্তুষ্ট ফুটে উঠল। আমার প্রতিবাদী চেতনাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল,
” বাবা-মাকে দেখি না বছর হবে। বাড়ি যাই না প্রায় তিন বছর ধরে। বিয়ের পর তো তিনবোনে একসাথে বসতেই পারলাম না! তায়্যু শোন না বোন, এসব পাগলামি বাদ দিয়ে বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যা। এই উপলক্ষে আমার একটু ছুটি হোক। এক, দুইটা রাত নির্ঘুমে কাটুক। আমরা সবাই মিলে খুব আনন্দ করব। খুশির স্মৃতি তৈরি করব। কে জানে, হয় তো এরপরে আর কখনও এমন সুযোগ আসবে না! ”

আমার প্রতিবাদী মনটা শান্ত হয়ে গেল নিমিষে। রা’গ ঝরে গেল আষাঢ়ের বৃষ্টির মতো। মনে পড়ে গেল ছোটবেলার সেই আনন্দ ঘন মুহূর্ত গুলো। প্রকৃতি কাঁপা হাসিগুলো। আকাশ রাঙিয়ে দেওয়া খুশিগুলো।

” আমি খবর নিয়েছি। অমিত ছেলেটা খুব ভালো। তোর দুলাভাইদের মতো না। ”

আমি মনখারাপের গলায় বললাম,
” এমন করে তো বাবাও তোমাদের বলেছিল। ”

বড় আপু থেমে গেল। চোখ সরিয়ে নিল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে ঘড়ির দিকে তাকাল। উঠে পড়ার ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,
” একবার ভাগ্যের সাথে লড়ে দেখ। ”

চলবে

#আলতা_রাঙা_পা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৪)

বড় আপুর হেঁয়ালি আবদারে আমার মন ও মস্তিষ্ক সাঁঝের মতো বিষণ্ণতায় ছেয়ে এলো। কেমন এক অদ্ভুত খারাপ লাগা ছড়িয়ে পড়ল দেহের চলনে-বলনে! অসারতায় তলিয়ে গেল বাস্তব-অবাস্তব চিন্তাকুল। আমার মত-অমতের তোয়াক্কা না করেই বিবাহকার্যের প্রাথমিক কাণ্ডগুলো ঘটে চললেও চুপচাপ রইলাম। উদাস চোখে রাতের আকাশ দেখায় সময় গড়িয়ে চলছিল যখন, আমার ফোনটা বেজে উঠল ঠিক তখনই। দূর থেকেই দেখলাম অচেনা নাম্বার। আমার উন্মনা মন সে কল রিসিভ করার কোনো আগ্রহ দেখাল না। অবহেলায় ঘাড় বাঁকিয়ে আকাশে দৃষ্টি স্থির করতে আবারও ফোনটা বেজে উঠল। আমি রেগে গেলাম। বিরক্তে ঠোঁট দুটো শক্তভাবে চেপে ধরে নাক ফোলালাম। গাল ছোঁয়া চুলের গোছা কানে ঢুকিয়ে বিছানার দিকে অগ্রসর হতে হতে কল কেটে গেল। আমি আরেক দফা বিরক্তে তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লাম। ফোন হাতে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারলাম। তারও প্রায় এক মিনিট পর আবারও কল এলো। আমি ভয়ানক কয়েকটা কথা শোনানোর জন্য ফোন হাতে নিতে দেখলাম তিন্নি কল করেছে। রিসিভ করতে সে বলল,
” অমিত ভাইয়ার কল ধরছিস না কেন? ”

আমার ভ্রূ আপনাআপনি কুঁচকে এলো। বুঝতে পারলাম ঐ অচেনা নাম্বারটা অমিতের। ঝাড়ি দিয়ে বললাম,
” তাকে আমার নাম্বার দিলি কেন? ”
” চেয়েছে তাই। ”
” চাইলেই দিতে হবে? ভার্সিটির এক ভাইয়াও তো তোর নাম্বার চেয়েছিল, আমি দেইনি। কারণ, তোর অনুমতি ছিল না। অথচ তুই আমার নাম্বার বিলিয়ে বেড়াচ্ছিস। কেন? আমার সাথে কিসের এত শত্রুতা? ”

তিন্নি বোধ হয় ভয় পেল। তবুও কথা ভাঙাল,
” অমিত ভাইয়া কোনো ভার্সিটির ভাইয়া নয়। তোর হবু বর। তাছাড়া এমনি এমনিই নেয়নি। জরুরি কথা আছে তাই নিয়েছে। ”

আমি আবার খেঁকিয়ে উঠলাম,
” কিসের জরুরি কথা? জরুরি কথা বলার মতোও একটা সম্পর্ক থাকা লাগে। উনার সাথে আমার সে সম্পর্ক নেই। বলে দে, আমাকে যেন আর কল না দেয়। ”

তিন্নির কণ্ঠস্বর বদলে গেল। অনুরোধের সুরে বলল,
” এভাবে বলছিস কেন? একটু কথা বল না৷ মনে হয়, অনেক জরুরি। নাহলে আমাকে দিয়ে অনুরোধ করাত? আমি তো উনাকে চিনি। উনি এমন ধরনের মানুষ না। ”
” তুই উনাকে চিনিস আর আমি সব পুরুষকে চিনি। ”

তিন্নি চুপ হয়ে গেলে আমি বললাম,
” আর কিছু বলবি? ”

তিন্নি অনেকটা কান্নাভাবে বলল,
” কথা বললেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। একবার কথা বল, শুনে দেখ কী বলছে। তোর কাছে যদি জরুরি না লাগে কেটে দিস। তায়্যু, প্লিজ। আর না করিস না! ”

আমি বিপরীতে কিছু বললাম না। তিন্নির কলে থাকা অবস্থায় সেই অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসে কেটে গেল। হয়তো বুঝতে পেরেছে আমি কারও সাথে কলে আছি। তিন্নির কল কাটার দুই মিনিট পর আবার কল দিল। আমি ধরব না ভেবেও ধরলাম। সে সরাসরি বলল,

” আপনি কি সত্যিই বিয়েটা করতে চাচ্ছেন না? ”

তার হঠাৎ প্রশ্নে আমি চমকালাম। উত্তর দিলাম না। অমিত আবার বললেন,
” আপনার পরিবার চায় আমার সাথে আপনার বিয়ে হোক, আমার পরিবারও। সেজন্যই হয়তো আপনার মতামতকে গুরুত্বে আনছে না, আপনার পছন্দকে মূল্য দিচ্ছে না।। কিন্তু তায়্যিবাহ, আমি যে চাই আমার জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে আপনার মতামত থাকুক। গুছানো সংসারে আপনার ইচ্ছে-অনিচ্ছারও ঠাঁই হোক। তাই সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে আমি আপনার মত শুনতে চাই। আমি যদি আপনার পছন্দ না হই তাহলে এ বিয়ে হবে না। আমি নিজে ভেঙে দেব। কারও আপত্তি শুনব না৷ ”

আমি চুপ করে তার কথা শুনছিলাম দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
” তায়্যিবাহ? আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? ”

আমি ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে পারলাম না। হালকা সুর করে বললাম,
” হুম। ”

তার সন্দেহ কেটে যেতেই বললেন,
” এবার বলেন আপনি কি বিয়েতে রাজি? ”

প্রশ্নটা করেই সাথে সাথে বললেন,
” আপনার উত্তর যদি ‘ না ‘ হয় তাহলে মুখে বলতে হবে না। কলটা কেটে দিবেন, আমি বুঝে নেব। ”

আমি উত্তর নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে মায়ের গলা পেলাম। চিৎকার করে আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি ভয়ে কল কেটে ফোন ফেলে দিলাম বিছানায়। তখনই মা রুমে ঢুকল। আনন্দিত গলায় বলল,
” তোর বড় আপু এসেছে! কত দিন পরে এলো বল তো? যা, দেখা করে আয়। এসেই তোর খোঁজ করল প্রথমে। ”

আমি এক মুহূর্তও দেরি করলাম না। এক দৌড়ে ছুটে গেলাম আপুর কাছে৷ বিনাবাক্যে জড়িয়ে ধরলাম নিবিড়ভাবে। কয়েক সেকেন্ড চোখ বুঝে থেকে বললাম,
” তুমি তাহলে এ বাড়িতে এলে! ”

বড় আপু আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে হেসে ফেলল। বাচ্চাদের মতো পিঠে আদুরে হাত বুলিয়ে বলল,
” তোর বিয়ে আর আমি আসব না, তা হয় নাকি? ”

আমি মুখ উঠিয়ে নিলাম আপুর কাঁধ থেকে। ধীরে ধীরে ছেড়ে দিলাম তার কোমল শরীরটাকে। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকলে সে বলল,
” আমি জানতাম তুই আমার কথা ফেলবি না। ছোট থেকে নিজের প্লেট থেকে খায়িয়ে খায়িয়ে বড় করেছি না? ”

আপুর চোখে-মুখে বিজয়ের হাসি। গর্বিত উত্তাপ। আমার গালে হাত রেখে বলল,
” আমার পাগলিটা! ”

তারপরেই জিজ্ঞেস করল,
” আরেক পাগলি কখন আসবে বলেছে কিছু? ”

আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না৷ মাথা নিচু করে দুপাশে মাথা নেড়ে না বুঝালাম। বড় আপু বুঝে নিয়ে বলল,
” চিন্তা করিস না। আমি কল দিচ্ছি, কাল সকালের মধ্যেই চলে আসবে দেখবি। ”

আমি ঘাড় একপাশে কাত করে চলে আসতে গিয়েও থামলাম। আপুর মলিন মুখটায় আনন্দের রঙের ছড়াছড়ি। আশপাশটা খুঁটে খুঁটে দেখে বলল,
” তিন বছরেই অনেক কিছু বদলে গেছে। এই বদলটা দেখার সৌভাগ্য করে দেওয়ার জন্য এক ঝুলি ধন্যবাদ বোন। কাছে আয়, আরেকটু আদর করে দিই। ”

আমি বাচ্চাদের মতোই আদরের লোভে পড়ে গেলাম। তার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আদর নিতে নিতে বললাম,
” কতদিন থাকবে, আপু? ”
” তুই যতদিন আছিস। ”
” তাহলে সারাজীবন থেকে যাই। বিয়েটা ভেঙে দিই? ”

আপু চোখ বড় করে তাকিয়ে হেসে ফেলল। সহাস্যে বলল,
” যার নাম করে ছুটি নিলাম তাই যদি মিথ্যে হয় তাহলে কি চাকরি থাকবে, বোকা মেয়ে? ”

আপু চাকরি বলতে যে শ্বশুরবাড়ি বুঝিয়েছে তা বুঝতে আমার একটুও সময় লাগল না। আমি ছলছল চোখে আপুর কাঁধে মাথা ফেললাম সেসময় মা চিৎকার করে বলল,
” তায়্যিবাহ, তোর বাবাকে পাঠিয়ে দে তো। অমিত কল করেছে। ”

আমি চকিতে আপুর কাছ থেকে সরে দাঁড়ালাম। মনে পড়ল, তাকে কিছু না বলেই কল কেটে দিছিলাম। এই কেটে দেওয়া যে আমার উত্তরের কেটে দেওয়া নয় সেটা তো তিনি জানেন না! আমি বাবাকে না ডেকেই মায়ের রুমে গেলাম। একরকম ছিনিয়ে নেওয়ার ভঙ্গিতে ফোন তুলে নিলাম। মা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” মোবাইল নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস? ”

আমি মিথ্যে বললাম,
” বাবাকে দিতে। ”

মায়ের চোখের আড়াল হতেই অমিত আবার কল দিলেন। আমি সাথে সাথে রিসিভ করলাম। রুদ্ধশ্বাসে বললাম,
” এখানে কল দিয়েছেন কেন? ”

অমিত বোধ হয় বুঝতে পারলেন না। ভাবল ভুল করে আমার ফোনে কল দিয়েছে। অত্যন্ত দুঃখিত গলায় বললেন,
” সরি, আংকেলকে কল দিতে গিয়ে আপনাকে দিয়ে ফেলেছি। ক্ষমা করবেন। ”

আমি তাড়াহুড়ায় শুধরে দিলাম,
” আরে না, আপনি বাবাকেই কল দিয়েছেন। ”

আমি বাবার মোবাইলটা কানে চেপেই আমার রুমের দিকে হাঁটা ধরলাম। চাপা স্বরে সবটা বুঝিয়ে দিলে তিনি বললেন,
” মায়ের ভয়ে কল কেটে দিয়েছিলেন? এমন ভয় তো লুকিয়ে প্রেম করার সময় হয়। আমরা কি প্রেম করছিলাম? ”

এই প্রথম আমি লজ্জা পেলাম। আড়ষ্টতার দানা বাঁধল গলার ভেতর। অমিত প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললেন। জরুরি গলায় বললেন,
” এখন তো মা নেই, ভয় নেই। তাহলে উত্তরটা দিয়ে ফেলুন। ”

আমি একটু ভেবে বললাম,
” বিয়েটা আমি করব কিন্তু শর্ত আছে। ”

অমিত খুশি হলো নাকি বুঝা গেল না। চটপটে বললেন,
” সরি, তায়্যিবাহ। আমি কোনো শর্ত মেনে বিয়ে করতে পারব না। ”

তার সরাসরি নাকচতায় আমার আঁতে আঘাত হানল। দাম্ভিকতায় টান পড়ল। নিজেকে ছোট ও অযোগ্য মনে হলো। রাগে কল কেটে দেওয়ার জন্য ফোন কান থেকে সরাতেই তিনি বললেন,
” কিন্তু আপনাকে কথা দিতে পারি, আমি সবসময় আপনার মন পড়ার চেষ্টা করব, না বলা কথাগুলো বুঝার চেষ্টা করব। কোনো কিছুতে জোর করব না। অধিকার ফলাতে যাব না। আপনি কষ্ট পান এমন আচরণ করব না। আর যদি ভুল করে করেও ফেলি তাহলে ক্ষমা চাইব আর নিজেকে শুধরে নেব। ”

আমার উত্তপ্ত হৃদয়টা শান্ত হয়ে গেল নিমিষেই। গভীর রাতের সাগরের ঢেউয়ের মতো দুলতে দুলতে হারিয়ে গেল অহংভাব। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো মনটাকে আমানত রেখে মুক্তি পাওয়ার মতো কাউকে পেলাম।

” আমার বিশ্বাস, শুনতে না চাওয়া আপনার শর্তগুলোও অজান্তেই পালন হয়ে যাবে। তায়্যিবাহ, দয়া করে কোনো শর্ত টেনে আমাদের হতে যাওয়া সম্পর্কটাকে ছোট করবেন না। আমি মানতে পারব না। ”

আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। মানুষটার থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত শান্তিটুকুও সহ্য করতে পারলাম না। অস্থিরতা থেকে মুক্ত পেতে দ্রুত বললাম,
” ঠিক আছে। ”

তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে সুধালেন,
” কী ঠিক আছে? ”

আমি চোখদুটো বন্ধ করে নিশ্বাস থামিয়ে বললাম,
” শর্ত ছাড়াই বিয়েটা হোক। ”

অমিত অত্যাশ্চর্য হয়ে পুনরায় সুধালেন,
” তারমানে আপনি রাজি? ”

আমি উত্তর দিতে পারলাম না। তাকে কলে রেখেই ফোন জানালার ফাঁকা ধাপে রেখে পালিয়ে গেলাম।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here