আলতা_রাঙা_পা,০৫,০৬

0
698

#আলতা_রাঙা_পা,০৫,০৬
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৫)

বিয়ে শেষে বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বরের গাড়িতে উঠে বসলাম। চোখের পানি মুছাবস্থায় বেখেয়ালিতে ডান হাতটা পড়ল অমিতের বাম হাতে। আমি চমকে তাকিয়ে হাত সরিয়ে নিলে তিনি আমার দিকে চেয়ে থাকলেন। আমি ভেজা চোখদুটো নামিয়ে নিলাম। মুখ ফিরিয়ে নিলে তিনি আমার দিকে চেপে আসলেন খানিকটা। আলতো করে আমার হাত চেপে ধরে বললেন,
” ভেবে নেও, এটা কোনো পুরুষের হাত নয় ভরসার হাত। এই স্পর্শে কাম নয় নির্ভরতা আছে। ”

আমি মুখ ফেরালাম তার দিকে। ভেজা চোখদুটোতে আবারও অশ্রু জমা হলো। তবুও মন নরম হলো না। নিজের বিশ্বাসে এক বিন্দুও বদল আসল না। তার আস্থাপূর্ণ চাহনিতে চোখ রেখে বললাম,
” আর আমাকে পুতুল ভেবে নিবেন। আমার অনুভূতিকে নিয়ে খেলা করবেন। ভূত-ভবিষ্যৎকে চুরমার করে দিবেন, তাই তো? ”

অমিত বোধ হয় খানিকটা ধাক্কা খেলেন। চাহনি বদলে গেল। চুপসে গেল উদারতা। আমার হাত থেকে হাতটা সরিয়ে নিলেন স্বইচ্ছায়। দূরত্ব তৈরি করলেন পূর্বের চেয়েও অধিক। নীরবে বসে থাকলেন ওপাশটায় অনেক্ষণ। আমি চুপচাপ তার সবটায় নজর বুলাচ্ছিলাম। এক সময় আমিও দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। জালানার কাচে কপাল ঠেকাতে তিনি বললেন,
” আমাদের মোটামুটি ভালোই কথা হয়েছে। তারপরও আমার সম্পর্কে এমন ধারণা? তোমার একবারের জন্যও মনে হয়নি আমি আলাদা? তোমার চেনা-জানা পুরুষদের দলে আমি নেই? ”

আমি না ফিরেই সরাসরি বললাম,
” না। ”

অমিত আবারও চুপ হয়ে গেলেন। যেন আমার জবাবগুলো মেনে নিতে পারছেন না। কয়েক সেকেন্ড পর আমার নাম ধরে ডাকলেন,
” তায়্যিবাহ? ”

আমি চাইলাম তার দিকে। এক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি স্থির হলো তার চোখদুটিতে। সে দৃষ্টি ছুটতে চাইল না কিছুতেই। মনে মনে প্রশ্ন করলাম, এই কণ্ঠ কি তারই নাকি অন্যকারও? উচ্চারণে এত সম্মোহন! এত মাদকতা!

” আমি কি তোমার সাথে কখনও খারাপ আচরণ করেছি? খারাপ ভাষা ব্যবহার করেছি? ”

আমি চোখের পলক ফেললাম। সে অবস্থায় উত্তর দিলাম,
” না। ”
” তাহলে অন্যদের সাথে কেন জড়াচ্ছ? ”

আমি চোখ বুঝা অবস্থায় কোনো এক মেয়েকে কল্পনা করলাম। যার বিয়ে হয়েছিল ভালোবেসে। বিয়ের আগে কত-শত স্বপ্ন বুনেছিল দুজন। একজনের স্বপ্নে আরেকজন লুটোপুটি খেয়েছে হেসে হেসে। মেয়েটির পরিবার তাদের সম্পর্ক মানছিল না বলে পালিয়ে বিয়ে করল। তিন বছরের চেনা-জানা মানুষটা কয়েক দিনের মধ্যেই বদলে গেল। যে ছেলেটা কথায় কথায় নিজের প্রাণ-পাখিটা তুলে দিত মেয়েটির হাতে সেই ছেলেই রাগে বশবর্তী হয়ে মেয়েটার গলা টিপে ধরল। সাফ জানিয়ে দিল, তাদের বৈবাহিক জীবন এখানেই শেষ। মানিয়ে নিতে পারছে না। দুইজন নাকি দুই মেরুর প্রাণী! তালাকনামায় সই করার সময় ছেলেটির হাত কাঁপেনি একবারের জন্যও। মনে পড়েনি, গত তিন বছরের করা প্রতিজ্ঞার তালিকা, তার এক ডাকে মেয়েটির পরিবার ত্যাগ করার কথা, বিশ্বাস, ভরসা, নির্ভরতা নামক ভারি শব্দগুলো!

” তায়্যিবাহ? ”

অমিতের ডাকে আমি চোখ মেললাম। সাথে সাথে সেই মেয়েটির নাম মনে পড়ল। তখনই অমিতের অসহিষ্ণু গলা পেলাম,

” কিছু বলো। ”

আমি সহজ কিন্তু অটল চাহনি রেখে বললাম,
” বিয়ের আগে সব ছেলের মধ্যেই ভালোমানুষি ভাব চলে আসে। কথা-বার্তায় মধুর ফলে। আপনার কী মনে হয়? এসব মিষ্টি মিষ্টি কথায় আমার মন ভুলাবেন? অসম্ভব! তায়্যিবাহ এত সহজে ভুলার মতো মেয়ে না। ”

অমিত ভ্রূ উঁচালেন। ঠোঁটে এক ফোঁটা হাসি ছড়িয়ে পড়ল যেন অস্পষ্টভাবে। কৌতুকের মতো করে বললেন,
” তারমানে তুমি ভুলোনি? ”
” না। ”
” তাহলে বিয়ে করেছ কেন? ”

তার দ্রুত করা প্রশ্ন আমাকে অপ্রস্তুত করে ফেলল। অটল চাহনি কেঁপে পাতাজোড়া এক হলো ঘন ঘন। আমতাভাব ছড়িয়ে পড়ল কণ্ঠস্বরে। মুখ ফিরিয়ে নিতে নিতে বললাম,
” বড় আপুর কথা রাখতে। ”
” তাই? ”

আমি অমিতের দিকে না তাকিয়েও টের পেলাম সে ঘাড় কাত করে আমার দিকে ঝুকে এসেছে। ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি। যেন আমার মন পড়ে ফেলে দারুন জব্দ করেছে। তার এই গুপ্ত খুশিটুকু আর বাড়তে দিতে পারলাম না। তাই নিরুত্তর থাকলাম। মনে হলো, পরিস্থিতি স্বাভাবিকে আনার এটিই একমাত্র উপায়। অমিতও কেন জানি আর কিছু বললেন না। বাকি রাস্তাটুকু নীরবেই পার করে দিলাম দুজনে।

____________
অমিতদের বাসায় পৌঁছালাম অনেক রাতে। হাতের কাছে ঘড়ি কিংবা ফোন না থাকায় সময়টা জানা হলো না। অনুমান করে নিলাম দুইটা কী তিনটা হবে। অমিত গাড়ি থেকে নেমে পড়লেও আমাকে নামার ব্যাপারে কিছু বললেন না। এদিকটায় এলেন না একেবারেই। আমিও নামব কী নামব না বুঝতে পারলাম না। একরকম দ্বিধাচ্ছন্ন হয়ে জানালার কাচ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলাম। অমিতকে বাড়ির ভেতরে ঢোকার আগে মাঝবয়সী দুইজন মহিলার সাথে কথা বলতে দেখলাম। তাদের শরীরে রঙিন শাড়ি, গয়না ও সাজগোজ থাকলেও চোখে-মুখে ভীষণ উদ্বিগ্নতা। হাতের ইশারা বার বার গাড়ির দিকে আসলে আমি কৌতূহলী হয়ে পড়লাম। তীক্ষ্ণ চোখে তাদের শারীরিক অঙ্গভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করতে অমিত ভেতরে ঢুকে গেলেন। বেশ কয়েক মিনিট পার হওয়ার পরও যখন বাইরে এলেন না তখন আমি চিন্তায় পড়লাম। বুকের ভেতরটা হাঁসফাঁস শুরু হলো। খেয়াল করলাম আমার কর্ণপাশ বেয়ে ঘাম বেয়ে পড়ছে। নিশ্বাস দ্রুত হয়ে আসছে। সর্বাঙ্গে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়তে আমার বড় আপুর বিয়ের দিনটি আবছা আবছা ভেসে উঠল চোখের পাতায়। আপুর বিদায়বেলায় আমি কান্না করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যাই। দুলাভাই তখন পারিপার্শ্বিক চাপে বাধ্য হয়ে আমাকে তাদের সাথে গাড়িতে তুলেন। আপুর শ্বশুরবাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বারোটা পার হয়ে যায়। আমাদের অপেক্ষায় রেখে দুলাভাই বাড়িতে ঢুকেন। প্রায় ঘণ্টাখানিক পর এসে বলেন, ‘ মা তো ঘুমিয়ে পড়েছে! এখন আর উঠবে না। আর তার অনুমতি ছাড়া ভেতরেও যাওয়া যাবে না। তোমরা বাকি রাতটা গাড়িতেই কাটিয়ে দেও। আমি নাহয় ভেতর থেকে কাঁথা-বালিশ এনে দিচ্ছি। ‘ সেই রাতে দু-জোড়া চোখ এক অদ্ভুত পুরুষের দেখা পেয়েছিল, যে কিনা মায়ের কথার বাইরে এক চুলও চলে না। আমি বড় আপুর কোলের উপর ঘুমিয়ে পড়লেও সে ঘুমাল না। অসহায়ত্বে সারারাত অশ্রু ঝরাল। ফজরের আযানের সময় আপুর শাশুড়ি ঘুম ভেঙে উঠলেও বধূবরণ করলেন না। ধমকে-ধামকে রান্নাঘরে পাঠালেন। বার বার মনে করিয়ে দিলেন, এ বাড়ির সবাই সাতটা বাজে নাস্তা করে। এক মিনিটও যেন দেরি না হয়। সেই ষোড়শী বয়সের আমি বড় আপুর বানানো নাস্তা খেতে খেতে এক ভীষণ সময় হিসেবি এক নারীর দর্শন করেছিলাম।

আচমকা দরজা লাগানোর শব্দে আমি কেঁপে উঠলাম। ভীত চোখে দেখলাম গাড়ির ড্রাইভার নেমে পড়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
” আপনারে কি সারারাত বাইরেই রাখব নাকি? স্যার আসে না ক্যান? ”

আমি উত্তর দিতে পারলাম না। আমার মন আরও ভীত হয়ে পড়ল। কলিজাটা বুঝি তিল পরিমাণে নেমে আসল। সত্যিই কি সারারাত বাইরে থাকতে হবে? অমিত আমাকে নিতে আসবে না? তার মাও কি আপুর শাশুড়ির মতো সময় হিসেবি? আমি আমার পাশের জায়গাটাই তাকালাম। শূণ্য! কেউ নেই। আমাকে সঙ্গ দেওয়ার মতো কেউ নেই। সেরাতে আপুর সাথে আমি থাকলেও আমার পাশে কেউ নেই।

” মনে কয়, ডাইল যোগাইতাছে। ”

ড্রাইভার কাকার কথায় বাইরে তাকালাম। সে আগ বাড়িয়েই বলল,
” মসুর ডাল, খেসারি ডাল, মুগ ডাল, মাসকলাই ডাল সব একসাথে করতাছে। আপনারে দিয়া বাছাইয়া আলাদা করাইব আর ধৈর্য্য পরীক্ষা করবো। ”

আমি ব্যাপারটি বুঝতে না পেরে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালে তিনি আগ্রহ নিয়ে বললেন,
” বিয়া বাড়িতে এমনই হয়। শাশুড়ি বউয়ের পরীক্ষা নেয়। আপনি বাছতে পারেন তো? নাইলে কিন্তু রাত পার হইয়া যাইব। তখন দেখবেন সত্যি সত্যি রাত কাটাইছেন ঘরের বাইরে। ”

ড্রাইভার সশব্দে হেসে উঠেই থেমে গেল। নিজেকে সামলে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
” আপনার শাশুড়ি চইলা আসছে, রেডি হোন। ”

চলবে

#আলতা_রাঙা_পা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৬)

আমি গাড়ির জানালা দিয়ে আমার শাশুড়িকে দেখলাম। তিনি দু’হাতে কিছু একটা আগলে সাবধানে এদিকে আসছেন। একটু পেছনেই অমিত। যেন মায়ের পথচলা সহজ করতে সঙ্গী হয়েছে। বিয়ে বাড়ির সাজ আলোতে রাতের অন্ধকার খুব একটা কাটেনি। দুজনের মুখই আবছা, অস্পষ্ট। শাশুড়ির হাতে কী আছে সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। চারকোণা মতো একটা আকার স্পষ্ট হতে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল। মনে পড়ল ড্রাইভারের রসিকতা। তাহলে কি সত্যি সত্যি আমাকে দিয়ে ডাল আলাদা করানো হবে? ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেওয়া হবে? তবে কি আমিও সেই প্রাচীন যুগ থেকে চলে আসা শাশুড়ি ও বউমার নির্মম ও গতানুগতিক রীতিনীতির সামিল হলাম?

” বউমাকে নামাসনি এখনও? ”

শাশুড়িমার কণ্ঠে আমি ছিটকে উঠলাম। চেতনা পেয়ে ত্রস্ত হলাম। ঘোমটার আড়ালে চোখ-মুখ খিঁচে নিতে অমিতের গলা পেলাম,
” তুমি নেই, তাই আর গাড়ি থেকে নামাইনি। একা একা দাঁড়িয়ে থাকবে! ”
” এখন নামা। ”

মায়ের আদেশ পেয়ে অমিত দরজা খুলে দিল। আমার দিকে হাত বাড়াতে শাশুড়িমা হঠাৎ বললেন,
” থাক, তোকে নামাতে হবে না। আমার বউমাকে আমিই নামাব। ”

ছেলেকে সরিয়ে দিয়ে তিনি এগিয়ে আসলেন। বললেন,
” এসো, বউমা। ”

আমি কোনোরূপ আচরণ করার পূর্বেই তার কোমল হাতের স্পর্শ পেলাম আমার ডান হাতের কব্জি পাশে। নরম বাঁধন কিঞ্চিৎ শক্ত করে বললেন,
” কুঁচিগুলো ধরে নামো, নাহলে পায়ের সাথে আটকে যাবে। ”

তার কথামতো আমি শাড়ির কুঁচি ধরলাম বাম হাতে। সাবধানে নেমে আসতে তিনি বললেন,
” আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো? ”

জবাবে মাথা হালকা বাম-ডানে নাড়লে তিনি আবার বললেন,
” তোমার শ্বশুরবাড়ি কিন্তু খুব দূরে নয়। মনে হয় জ্যামে পড়েছিলে তাই রাত হলো। আমি অপেক্ষা করতে করতে একটু শুয়ে পড়েছিলাম। কখন যে চোখ লেগে আসল বুঝতেই পারিনি। তাই তোমাকে নিতে আসতে একটু দেরি হলো। রাগ করোনি তো? ”

তার সহজ স্বীকারোক্তি আমাকে লজ্জায় ফেলল বোধ হয়। বদ্ধ ঠোঁটদুটো দ্রুত নড়ে উঠল,
” না, না, রাগ করিনি। ”

তিনি মৃদু হাসলেন। আমার হাত থেকে হাত সরিয়ে নিলেন। বুকে চেপে রাখা সে জিনিসটা আমার দিকে বাড়িয়ে বললেন,
” আমি যখন মাকে ছেড়ে আমার শ্বশুরবাড়িতে রওনা দেব তখন মা আমায় এ কোরআন শরীফ আর জায়নামাজটা দিয়েছিলেন। আজ আমি তোমাকে দিয়ে বধূবরণ করলাম। সোনার গয়না, দামি শাড়ি তো এ জীবনের সঙ্গী। কিন্তু এগুলো তোমার পরজীবনের সঙ্গী হবে। ”

এক মুহূর্তের জন্য আমি বাকহারা হয়ে পড়লাম। স্তব্ধ ও বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলাম শাশুড়ি মায়ের মুখটায়। তিনি মিষ্টি হেসে বললেন,
” কী হলো, আমার দোয়া গ্রহণ করবে না? ”

আমি অসহায় কণ্ঠে বললাম,
” আমার ওযু নেই! ”

তার ঠোঁটজোড়ার হাসি মুছে গেল। আশ্চর্য হয়ে বললেন,
” কবুল পড়ার আগে ওযু করোনি? ”
” না। ”

শাশুড়ি মায়ের চোখদুটি নিষ্প্রভ হলো। মৃদু স্বরে বললেন,
” আমাদের বেলায় তো মায়েরা ওযু করাতেন। ”

তারপরেই কোরআন শরীফ আর জায়নামাজ এগিয়ে দিলেন অমিতের দিকে। সে সাদরে গ্রহণ করলে তিনি বললেন,
” আমার বউমার দোয়া তোর কাছে আমানত থাকল। আজ থেকে তার পুন্যের খাতা ভারী করার দায়িত্ব তোর। ”

অমিত আমার দিকে তাকাল। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। শাশুড়িমা আমার দিকে ঘুরে বললেন,
” ভেতরে চলো। ”

বলতে বলতে আমার হাত ধরলেন আবার। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বাড়ির বাইরের অংশ, ভেতরের অংশ পুরোটাই দেখিয়ে দেখিয়ে দিলেন। রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়াতে আমার হৃদয় ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠল। আরও একবার মনে পড়ল বড় আপুর কথা। তার বানানো সকালের নাস্তার কথা। অজান্তেই মনে প্রশ্ন জমল, ‘ আমাকেও কি এখন রান্না করতে হবে? ‘

” তোমার নিশ্চয় খুব ক্ষিধে পেয়েছে? কী খাবে বলো। তৈরি থাকলে তো ভালো নাহলে তৈরি করে দেব। ”

আমি আরেক দস্তুর অবাক হলাম। বিস্ময় ঠেলে বললাম,
” আমার ক্ষিধে লাগেনি। ”

তিনি শুনলেন না। আমাকে রান্নাঘর থেকে সরিয়ে এনে বসার রুমে বসালেন। তারপরেই ছুটে গেলেন কোথাও একটা। আমি অমিতের দিকে জিজ্ঞেসা দৃষ্টিতে তাকালে তিনি বললেন,
” আমার মা ভালোবাসতে খুব ভালোবাসেন। ”

আমি বিপরীতে কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করার সুযোগ পেলাম না। তিনি ভাত আর ডিম ভাজা নিয়ে হাজির হলেন। নিজ হাতে ভাত মাখতে মাখতে বললেন,
” বিয়ে বাড়ির খাবার খেয়ে এখন তৃপ্তি পাবে না। তাই ভাত আনলাম। ডিম ভাজা খাও তো? ”

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝাতেই তিনি মুখের সামনে লোকমা তুলে ধরলেন। তাকে খুশি করতেই হোক অথবা নিজের ক্ষিধে মেটাতে আমি সবগুলো ভাত তৃপ্তি করে খেলাম। খাবার শেষে আমাকে অমিতের রুমে আনলেন। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার পূর্বে আমার কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
” আমি তোকে মেয়ের মতো না বউমার মতোই ভালোবাসব। কারণ, আমার একটা মেয়ে আছে। আমি চাই না সে ভালোবাসায় ভাগাভাগি হোক। আমি চাই, মেয়ে তার ভালোবাসাটা পূর্ণভাবে পাক, বউমাও তার ভালোবাসাটা পূর্ণভাবে পাক। ”

অমিতের মা শুধু আমার ভাবনাকে না ড্রাইভারের ভাবনাকেও ভুল প্রমাণ করে দিয়ে চলে গেলেন।

_____________
অমিতকে খুব একটা পাত্তা না দিলেও আমি কেন জানি তার অপেক্ষায় বসে আছি। অথচ সে আসছে না। আমি আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ঘড়ির দিকে তাকালাম। প্রায় তিনটা বাজে!

আমি বসা থেকে উঠে পড়লাম। ঠিক করলাম শুয়ে পড়ব। বিছানায় ছড়িয়ে থাকা গোলাপের পাপড়িগুলো হাত দিয়ে সরালাম। বালিশ টেনে ঠিকঠাক করতে গিয়ে মেজো আপুর কথা মনে পড়ে গেল। বিয়ের পরেরদিন সকালে মাকে কল দিয়ে সে কী কান্না! শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আসার তীব্র ইচ্ছা। বার বার করে বলছিল, বাবাকে পাঠিয়ে দিতে। আপু চলে আসবে। সেসময় এই কান্না আর ফিরে আসার কারণ আমি জানতে না পারলেও পরে জেনেছিলাম। বিয়ের রাতে নাকি দুলাভাই বাইরে ছিল। সারারাত মদ পান করে ফিরেছিল আযানের আগে। এসেই নাকি পশুর মতো আক্রমণ করে বসে আপুর ঘুমন্ত শরীরটায়!

আমি শিউরে উঠলাম। বালিশটা খামচে ধরে বিড়বিড় করলাম, অমিতও কি মদ পান করতে গেছে?

” বন্ধুরা বলল, বাসররাতে নাকি বউকে কিছু একটা উপহার দিতে হয়। তাই তোমার জন্য এই উপহারটা আনলাম। ”

অমিত পেছন থেকে উপহারটা আমার সামনে এগিয়ে দিয়েছে বিধায় আমি পিছন ফিরলাম না। কাচের গোলাকৃতি বোয়ামটিতে আমার নিষ্পলক দৃষ্টি।

” তারা অবশ্য বলেছিল, সোনা বা ডায়মন্ডের কিছু পেলে নাকি বউরা বেশি খুশি হয়। আবেগপ্রবণ হয়। কিন্তু আমার বউ তো তাদের জানা সে বউদের দলের না। আলাদা কেউ। তাই উপহারও আলাদা হওয়া উচিত। তাই তোমার জন্য এক বোয়াম জোনাকি আনলাম। ”

আমি বালিশ ছেড়ে দিলাম। সব দ্বিধা হারিয়ে কাচের বোয়ামটা দুহাতে চেপে ধরলাম। চকচকে দৃষ্টি রেখে বললাম,
” সত্যি, আমার জন্য এনেছেন? ”

অমিত বিছানায় বসে বলল,
” যাক, পছন্দ হয়েছে তাহলে। আমি তো ভেবেছিলাম, বড় হতে হতে ছোট বেলার শখ, আহ্লাদ, পছন্দ হারিয়ে গেছে। ”
” মানে? ”
” তিন্নি যখন তোমার ছবি দেখাল তখনই তোমাকে খুব মনে ধরেছিল। তাই সুযোগ পেলেই তোমার সম্পর্কে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করতাম। ওর কাছ থেকেই শুনেছিলাম, জোনাকিপোকা ধরা নাকি নেশার মতো অভ্যাস ছিল। সন্ধ্যা নামলেই কাচের শিশি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে। কিন্তু একদিন বাবা ধরে ফেলে। খুব বকাঝকা করে। সম্ভবত গায়েও হাত তুলে আর সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দেয়। তুমি সে নিষেধ অমান্য করে বেশ কয়েক বার বেরুনোর চেষ্টা করে ধরা খেয়েছ আর মার খেয়েছ। একসময় বাধ্য হয়ে সেই নেশার মতো শখটাকে ভুলে গিয়েছ। ”

অমিত একটু থেমে বলল,
” আমার মনে হলো, তোমাকে খুশি করার জন্য একটা সুযোগ যখন পেলামই তাহলে ছোটবেলার খুশিটাকেই নিয়ে আসি। ”

আমিও অমিতের পাশে বসলাম। কাচের বোয়ামকে এমনভাবে আগলে ধরলাম যেন হাত ফসকে গেলেই হারিয়ে যাবে। ঠোঁটের কোণে, চোখের তারায় খুশি ঝলমলিয়ে উঠতে অমিত বলল,
” তোমার স্বরূপের সাথে তোমার পছন্দটা মানাচ্ছে না, তায়্যিবাহ। ”

অমিতের গলায় অন্যরকম স্বরে আমি চমকে তাকালাম। তিনি আমার দিকে মুখ করে বসে বললেন,
” তুমি স্বাধীনতাকে ভালোবাস। বাঁধন ছেঁড়া হতে চাও তাহলে এই জোনাকিপোকাদের বন্দিদশা তোমার পছন্দ হয় কী করে? তোমার তো উচিত এদের মুক্ত করে দেওয়া। ”

অমিতের এমন কথায় আমার খুশি হারিয়ে গেল। চোখের কোলে অশ্রু জমল। কাচের বোয়ামটাকে আরও গভীরভাবে চেপে ধরলে তিনি হেসে ফেললেন। সহাস্যে বললেন,
” আমরা পুরুষরাও এমনই। নিজেরা যতই স্বাধীনপ্রিয় হইনা কেন নিজের প্রিয় জিনিসটাকে বন্দি করতে ভালোবাসি। ভালোবাসার খাঁচায় বন্দি করে বুকে আগলে রাখতে পছন্দ করি। ভয় পাই, যদি হারিয়ে যায়? তোমার কাচের বোয়ামের মতো হয়তো ভালোবাসা ভেঙে যায় না কিন্তু দুর্বল হয়ে পড়ে। ”

অমিত নিজেকে আরও একবার প্রমাণ করল সে আলাদা। আমার ভাবনার বাইরের কেউ।
” হয় এদের মুক্ত করে নিজের স্বরূপ ধরে রাখ নাহয় নিজেও বন্দি হওয়ার প্রস্তুতি নেও। ”

আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কথাগুলো বলেই তিনি একটা বালিশ তুলে নিলেন। বারান্দার দিকে হেঁটে চললে আমি প্রশ্ন করালাম,
” কোথায় যাচ্ছেন? ”
” তোমাকে ভয় থেকে মুক্তি দিতে। ”
” কিসের ভয়? ”
” ঘুমের মধ্যে যদি তোমাকে স্পর্শ করে ফেলি? ”

তার এমন কথায় আমি বিব্রত হলাম। দৃষ্টি নিচু করলে তিনি বললেন,
” যতদিন না তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ ততদিন তোমার পাশে তো দূর, এক রুমেও শুব না। ”

কথাটা বলেই অমিত দরজা ঠেলে বারান্দায় চলে গেলেন। আমি বিছানায় বসলাম। কাচের বোয়ামের দিকে তাকিয়ে উদাস হলাম। সেই উদাসভাব কাটল একটা মেসেজ প্রবেশের শব্দে। আমি ঘাড় বাঁকিয়ে দেখলাম বিছানার পাশের ছোট টেবিলটায় আমার ফোন। আমি তো আনিনি, তাহলে কে আনল? অমিত?

ফোন হাতে নিতেই দেখলাম অমিতের নাম্বার থেকে মেসেজ,

” তোমাকে দূর থেকে দেখলেও কি তুমি রাগ করবে? উত্তর যদি হ্যাঁ হয় তাহলে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়। আমার সবকিছুকে দমিয়ে রাখলেও চোখদুটোকে পারছি না। বার বার মুগ্ধ হচ্ছে। ”

আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। আলো নেভানোর বদলে বারান্দার দিকে জানালার পর্দা টেনে দিলাম।

_____________

ভারী সাজ পাল্টে হালকা হয়ে বিছানায় শরীর মেলে দিতেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পায়ে সুড়সুড়ি অনুভব হতে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে পায়ের দিকে তাকাতে যারপরনাই বিস্মিত হলাম। চিৎকার করে বললাম,
” কী করছেন? ”

অমিত উত্তর দেওয়ার বদলে বলল,
” আরে! পা টেনে নিলে কেন? বিছানায় লাগবে তো। ”
” কী লাগবে? ”
” আলতা। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here