#আলতা_রাঙা_পা,০৯,১০
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৯)
” আমি এখন সাজব। আপনি বের হোন। আপনি থাকলে আমার অসুবিধা হবে। ”
আপু বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অমিতের দিকে চাইতে আমি অন্যদিকে মুখ করে আঁটসাঁট হয়ে দাঁড়ালাম। পুরো রুম থমথমে। কিছু সময় নীরব, নিশ্চুপ, নিঃশব্দে কাটল। তারপরেই আকস্মাৎ হাসির শব্দে কেঁপে উঠলাম আমি। সুরের ফোয়ারায় রুপান্তর হলো থমথমে পরিবেশ। আমি যন্ত্রের মতো ঘুরে দাঁড়ালাম ভাই-বোনের দিকে। আকাশ মাপের বিস্ময় নিয়ে তাদের শরীর দোলানো হাসি দেখলাম। হাসির শব্দ একটু কমে আসতে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন অমিতের আপু। কানের পাশে মুখ নামিয়ে আরও কিছুক্ষণ হাসলেন নিচু শব্দে। আমি বিপরীতে পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমাকে ছেড়ে এক পলক তাকালেন আমার মুখটায়। নিজের কান থেকে দুল খুলে আমার কানে পরিয়ে দিয়ে বললেন,
” সুখী হও। ”
আমি স্তব্ধ বদনে আপুকে চলে যেতে দেখছিলাম। তখনই পাশ থেকে অমিত বললেন,
” ভালো অভিনয় ছিল। ”
আমি চকিতে ঘাড় বাঁকালাম। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন,
” অভিনয় ছিল বলেই আমি এখনও চুপ আছি। নাহলে বিনা দোষে কাউকে অপমান করা আমি মেনে নিতাম না। সে যেই হোক। নিজেকে আলাদা দাবি করছি মানে এই নয়, আমার রাগ নেই, বিবেক নেই, ভালো-মন্দ আলাদা করার জ্ঞান নেই। কোনো ভালো মনের মানুষ প্রথম পরিচয়ে কারও সাথে দুর্ব্যবহার করতে পারে না। তুমিও পার না। কারণ, আমার বউও ভালো মনের অধিকারি। তায়্যিবাহ, আমাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে গিয়ে নিজেকে খারাপ প্রমাণ করো না। পরে নিজেই কষ্ট পাবে। ”
আমার মাথা আপনাআপনি নিচু হয়ে গেল। অমিত একটুখানি চুপ থেকে দূরে সরে দাঁড়ালেন। দূর থেকে বললেন,
” আপুকে দুল জোড়া আমি গিফট করেছিলাম। আমার উপার্জন থেকে আপুকে দেওয়া প্রথম উপহার! খুশি হয়ে সঙ্গে সঙ্গে কানে পরেছিল। তারপর আর কখনও খুলতে দেখিনি। বিয়ের দিনও না। ”
অমিত থেমে গেলে আমি মাথা উঁচু করলাম। দেখলাম এদিকে এগিয়ে আসছেন। আমার থেকে সামান্য দূরত্বে দাঁড়িয়ে কানের দিকে তাকালেন। বললেন,
” তুমি খুব সৌভাগ্যবতী! ”
আমি তার সামনে থেকে চলে এলাম। দরজা পেরুতেই টের পেলাম অশ্রুকণার উপস্থিতির। বুক ভারী হয়ে আসল অনুশোচনায়। ব্যাকুল চিত্তে খুঁজতে লাগলাম আপুকে। এ রুম থেকে সে রুমে ছুটে বেড়ালাম। যাকে সামনে পেলাম তার কাছেই আপুর খোঁজ চাইলাম। অবশেষে শাশুড়িমার রুমে পাওয়া গেল তাকে। খাটের উপর বসে আছেন পা তুলে। কোলের উপর মাঝারি আকারের লাগেজ। চেইন খুলে কীসব বের করছেন। আমি ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে গেলাম। কিছু বলতে হলো না আমাকে। তিনি লাগেজে চোখ রেখেই বললেন,
” বসো। ”
আমি বসলাম। কান থেকে দুল জোড়া খুলে বিছানায় রাখতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
” পছন্দ হয়নি? ”
আমি উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেলাম না তার আগেই বললেন,
” নাকি পুরোনো বলে ফিরিয়ে দিলে? ”
আমি করুণ চাহনি ফেললে তিনি ঠোঁট টেনে হাসলেন। বললেন,
” অন্যদের মতো দামী উপহার কেনার সামর্থ্য আমারও আছে। ইরফান এ ব্যাপারে কোনো কার্পন্য দেখাবে না। কিন্তু ভালোবেসে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি কাউকে উপহার দেওয়ার সামর্থ্য সবার থাকে না, একমাত্র আমারই আছে। আর তুমি সে উপহার ফিরিয়ে দিতে আসছ? ”
আমি ভীত চোখে তাকালে তিনি কান বাড়ালেন আমার দিকে। বললেন,
” ঠিক আছে, ফিরিয়ে যখন দিবেই তাহলে আমার কানে পরিয়ে দেও। এ জিনিস তো আমি আর স্পর্শই করব না। ”
আমি কানের দুল তুলে নিলাম। তার কানে পরিয়ে দেওয়ার বদলে নিজের কানে পরে নিলাম দ্রুত। তিনি ঠোঁট টিপে হেসে বললেন,
” তুমি আসলেই বুদ্ধিমতী। ”
আমি জোরপূর্বক হাসলাম। আপু দুটো পাঞ্জাবি বের করে বললেন,
” বাবা আর ভাইয়ের জন্য এনেছি। অমিতকে কোনটা দিই বলো তো। ”
আমি পাঞ্জাবি দুটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম একমনে। বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে বললাম,
” দুটো তো একই রঙের, একই ডিজাইনের। ”
আমাকে বিভ্রান্ত করতে পেরে ভারি খুশি হলেন আপু। শব্দ করে হেসে বললেন,
” একই রকম কিনলে তো একই রকম হবে। ”
” তাহলে পছন্দ করতে বললেন কেন? ”
” যখন কিনেছিলাম তখন তো জানতাম না পছন্দ করে দেওয়ার মতো এমন একজন সঙ্গী পাব! তাই একই রকম কিনে ফেলেছি যাতে দোটানায় না পড়ি। এদিকে তোমাকে পেয়ে লোভটাও সামলাতে পারলাম না। তাই নিজেকে খুশি করতে জিজ্ঞেস করলাম। ”
আমি মুগ্ধ হলাম। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে আবিষ্কার করলাম একজন হাসিখুশি, প্রাণবন্ত নারীকে। অমিত হয়তো ঠিকই বলেছে। আমি আসলেই সোভাগ্যশালী। নাহলে বহুবছর পর এমন চঞ্চল চিত্তের নারীর দেখা পাই?
” অমিতকে রাগানো এত সহজ না। অকারণে চেঁচানো একদম পছন্দ করে না। তর্কবিতর্কে জড়ানো উচ্ছৃঙ্খল মানুষজন থেকে সবসময় দূরে থাকে। তুমি যদি একান্তই তার রাগ দেখতে চাও তাহলে দাগ লাগাতে পার। ”
” দাগ? ”
” হুম। ও কোনোকিছুতে দাগ পছন্দ করে না। এই যেমন ধরো জামাকাপড়ে খাবার কিংবা অন্য কিছুর দাগ। ”
আপুর কথা ঠিকমতো বুঝলাম না। তবুও চুপ থাকলাম। ভাবখানা এমন যে সব বুঝে গেছি।
আপু লাগেজ থেকে লাল রঙের একটি সুন্দর শাড়ি আর আলতা বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন,
” যেদিন ভাইয়ের হাসি দেখতে ইচ্ছে হবে সেদিন এই শাড়িটা পরে ভাইকে বলো, আলতা পরিয়ে দিতে। কেমন? ”
আমি মাথা একপাশে কাত করে উঠে দাঁড়ালাম। আপুর কাছ থেকে চলে আসতে গিয়েও থেমে গেলাম। এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললাম,
” আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি? ”
আপু একটুও অবাক হলেন না। কোল থেকে লাগেজ সরিয়ে ফেললেন চট করে। হাত দুপাশে ছড়িয়ে বললেন,
” এজন্য অনুমতি লাগে? ”
আমি দৌড়ে আপুকে জড়িয়ে ধরলাম। কেঁদে ফেললাম অকারণেই। কান্না বিজড়িত গলায় বললাম,
” আমাকে ক্ষমা করে দেও, আপু। আমি ইচ্ছে করে কষ্ট দিতে চাইনি। ”
আপু আমার পিঠে আদুরে হাত বুলালেন। মুখে কিছু বললেন না। তেমন সময় কেউ একজন গলা খাঁকারি দিল। আপুকে ছেড়ে সোজা হতে দেখলাম অমিত, অমিতের বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছে। সকলের চোখে-মুখে হালকা হাসি। আমি লজ্জা পেলেও চোখ পাকিয়ে তাকালাম অমিতের দিকে। এই চাহনির অর্থ ধরে ফেলে বললেন,
” এটা মা-বাবার রুম। আমি তাদের কাছে এসেছি। ”
তার সরাসরি জবাবদিহিতায় আমার লজ্জা বেড়ে হলো দ্বিগুন। উঠে চলে যাব নাকি বসে থাকব বুঝতে পারছিলাম না। তখনই শ্বশুরআব্বা বললেন,
” তোমার বাড়ি থেকে কল এসেছিল। বেয়াইসাব বললেন তুমি নাকি কল ধরছ না? উনারা খুব চিন্তায় আছে। যাও, কল করে কথা বলে আসো। ”
আমি সুযোগ পেয়েই পালিয়ে এলাম। রুমে ফিরে বাবা-মাকে কল দিতে ইচ্ছে হলো না। কেন জানি তাদের জন্য মন টানছে না। তাই কল দিলাম বড় আপুকে। সে না ধরলে ছোট আপুকে দিলাম। আপু ধরল। তার কণ্ঠস্বর শুনতেই আমি মাত্র পাওয়া ভালোবাসাগুলো ভুলে গেলাম। তাকে হড়বড়িয়ে বলতে থাকলাম,
” একটা মানুষ এত ভালো হয় কী করে? অসম্ভব ব্যাপার! আমার মনে হয় অমিত ছেলেটা পুরোটাই মিথ্যায় ঢাকা। তার পরিবারও। নাহলে প্রত্যেকেই কেন আমাকে ভালোবাসবে? এমনটা কখনও হয় আপু? এই ছেলে গোপনে কোনো পরিকল্পনা করছে। পুরোদমে চেষ্টা করছে আমার মনে বিশ্বাস স্থাপন করতে। একবার বিশ্বাসে পরিণত হলেই আসল রূপ বেরিয়ে আসবে। কিন্তু আমি তো সে সুযোগ দেব না। তার আগেই তার মুখোশ খুলে ফেলব। শুধু একটা ভালো সুযোগ লাগবে। ”
আপু আমার সবটা শুনে ‘ আচ্ছা ‘ বলে ফোন কেটে দিল। তার এই জবাবে আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না তাই বড় আপুকে অমিতের ব্যাপারে আমার যে ধারণা হয়েছে সবটা লিখে বার্তা পাঠালাম।
_____________
বিকেলবেলায় আমার বাবা-মা এসেছেন আমাকে নিতে। আমি সাফ জানিয়ে দিলাম ঐ বাড়িতে আমি যাব না। তারা আমার কথা মানলেন না। জোরাজুরি শুরু করলে সকলকে ফেলে রুমে চলে আসলাম। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে বিছানায় পা উঁচিয়ে বসতে অমিতের উদয় হলো। বললেন,
” আপু বলল, তুমি নাকি আমার প্রেমে পড়েছ? ”
আমি রাগ চোখে তাকালাম। তিনি পাত্তা না দিয়ে কথাটা শেষ করলেন,
” সেজন্য নাকি মা-বাবার সাথে যেতে চাচ্ছ না? ”
আমি পা ফেললাম মেঝেতে। মেরুদণ্ড সোজা করে কঠিন গলায় বললাম,
” প্রেমে ফেলা এত সহজ নাকি? ”
” তাহলে না যাওয়ার কারণ কী? ”
আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। দুর্বল গলায় বললাম,
” এমনি। ”
সে জোর দিয়ে বলল,
” আপু ঠিকই বলেছে। তুমি আমার প্রেমেই পড়েছ। মুখে বলতে লজ্জা পাচ্ছ তো তাই ব্যবহারে বুঝাচ্ছ। ”
আমি আগুন চোখে তাকালে তিনি দরজার দিকে পা বাড়ালেন। বের হতে হতে বললেন,
” তুমি চিন্তা করো না। বাবা-মাকে আমি ম্যানেজ করে নিচ্ছি। ধরে নেও তোমার প্রেমে পড়ার উপলক্ষে ছোট্ট উপহার। ”
আমি যে অমিতের প্রেমে পড়িনি এই সত্যটা প্রমাণ করতে বাধ্য হলাম বাবা-মায়ের সাথে যেতে। বাড়িতে পৌঁছাতে বড় আপুর কল পেলাম। আমি বার্তায় পাঠানো কথাগুলো আরেকদফা মুখে আওড়ালাম। তাকে ভুল প্রমাণ করতে যে বাবা-মায়ের সাথে আসতে রাজি হয়েছি এটাও বাদ রাখলাম না। সবটা শোনার পর আপু বলল,
” অমিত যে সবার থেকে আলাদা তা আরও একবার প্রমাণ করল। ”
” কিভাবে? ”
” কথার প্যাচে ফেলে তোকে নিজ বাড়িতে আসতে বাধ্য করে। ”
আমি পুরো ব্যাপারটা বুঝে নেওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়তে বড় আপু বলল,
” অমিত তোকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে যে তুই টেরও পাচ্ছিস না। তায়্যু, ছেলেটাকে আর জ্বালাস না। ও আসলেই খুব ভালো। তোর চারপাশটা ভুলে ওর প্রতি একটু মনোযোগী হ। দেখবি, বার বার মুগ্ধ হবি আর নিজের সৌভাগ্যের জন্য কৃতজ্ঞতায় ভাসবি। ”
চলবে
#আলতা_রাঙা_পা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১০)
অমিত রুমে ঢুকেই আমার রোষানলের শিকার হলো। অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে কাবু হলেও প্রকাশ করল না। ঘাড় নেড়ে নেড়ে রুমের চারদেয়ালে তাকিয়ে বললেন,
” বারান্দা দরকার আমাদের অথচ দখল করে আছে তোমার বাবা-মা। ”
তার রসাত্মক ভাব ও বচনে আমার দৃষ্টির প্রখরতা কমল না। পলক পড়ল না। আমার দিকে এক পলক তাকালেন তিনি, চোরা চাহনি। আমি ধরে ফেলেছি বুঝতে পেরে বললেন,
” কথার খেলাফ হয়নি এখনও, তায়্যিবাহ। ভয় দেখাচ্ছ কেন? ”
আমি আগের মতোই মূর্তি হয়ে বসে থাকলে তিনি এগিয়ে এসে বললেন,
” কথা যখন দিয়েছি তখন একঘরে শুব না। একটু সময় দেও, ভেবে কিছু একটা উপায় বের করি। ”
অমিত খাটের এক কোণে বসলেন ভয়ে ভয়ে। আমার দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে মগ্ন হলেন গভীর চিন্তায়। একটুখানি ভাবার ভঙ্গি করে সহসা বললেন,
” আমার মাথায় তো কিছু আসছে না। তুমি একটা বুদ্ধি দেও না। এ বাসা তোমার। বাসার মানুষগুলোও তোমার। তুমি চাইলেই একটা ব্যবস্থা করতে পার। ”
কথাটা বলেই অসহায় চোখে তাকালেন আমার দিকে। আমার ভাবভঙ্গিতে কোনো বদল না পেয়ে হতাশ হলেন। নিরাশ গলায় বললেন,
” দেখি বাবা-মাকে বুঝিয়ে বাইরে থাকার ব্যবস্থা করা যায় নাকি। ”
অমিত উঠে দাঁড়িয়ে আবার বললেন,
” চিন্তা করো না, তোমাকে কেউ ভুল বুঝবে না। ”
আমাকে আশ্বাস বাণী শুনিয়ে বের হতে চাইলেন তিনি। আমি চোখের পলকে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একহাত শক্ত করে চেপে ধরে বললাম,
” বাইরে থাকার কোনো দরকার নেই। আমরা এখন ফিরে যাচ্ছি। ”
প্রথমবারের মতো আমার স্পর্শ পেয়ে চমকেও সামলে নিলেন পর মুহূর্তেই। বিস্ফারিত চোখে জিজ্ঞেস করলেন,
” ফিরছি মানে? ”
আমি উত্তর না দিয়ে তাকে টেনে-ধরে রুম থেকে বের করলাম। তিনি বেতালে আমার পিছু ধরে হঠাৎ থমকে গেলেন। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
” আমি তোমার কথা বুঝতে পারিনি। ”
আমি অনিচ্ছায় থেমে গেলাম। নিজের সর্বশক্তি দিয়েও একচুল নড়াতে পারলাম না তাকে। পাথরের মতো স্থির, নিশ্চল, অটল হয়ে থাকলেন। আমি নিরুপায়ে তার হাত ছেড়ে দিলাম। চোখে চোখ রেখে বললাম,
” আপনার গোপন চাল আমি ধরে ফেলেছি। আমাকে বোকা বানিয়ে যে এ বাড়িতে এনেছেন সেটাও বুঝতে পেরেছি। ”
” এসব কী বলছ? গোপন চাল আবার কী? তোমাকে বোকা বানাতে যাব কেন? ”
” আমাকে হাতের মুঠোয় করার জন্য। নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। ”
অমিত স্তব্ধ হয়ে নীরব চেয়ে থাকলেন এক মুহূর্ত। কাতর গলায় বললেন,
” তুমি আবার আমাকে ভুল বুঝছ। ”
আমি প্রতিবাদ করে বললাম,
” না, আমি ঠিক বুঝছি। বরঞ্চ আপনি আমাকে ভুল বুঝানোর চেষ্টা করেন। আর আমি বোকার মতো তাই বিশ্বাস করি বার বার। ”
অমিত করুণ চোখে তাকালেন। কিছু একটা বলতে চাইলেন, পারলেন না। মা-বাবা চলে এসেছেন। তাদের দিকে একটুখানি নজর বুলিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন। আমার দিকে একপা এগিয়ে ফিসফিসে বললেন,
” বাবা-মায়ের সামনে এমন করো না। রুমে চলো। ”
আমি তার কথা শুনলাম না। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি ফিরবেন না? ”
তিনি উত্তর দেওয়ার বদলে আমার হাত ধরতে চাইলেন। আমি দ্রুত পেছনে হটে গেলাম। দৃঢ় গলায় বললাম,
” ঠিক আছে, আমি একাই ফিরব। ”
উপস্থিত কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মূল দরজার দিকে পা বাড়ালাম আমি। একবারের জন্যও পেছনে তাকালাম না। সিটকানি খুলে বাইরে বেরিয়ে আসলাম।
___________
রাত খুব একটা গভীর না হলেও কোলাহল কমে এসেছে অনেকটা। রাস্তায় তেমন মানুষজন নেই। দুই চাকা, তিন চাকার যান নেই বললেই চলে। মিনিট পেরিয়ে হঠাৎ চার চাকা, আট চাকা ছুটে আসছে তীব্র বেগে। আমি গা ছমছম করা আঁধারে হেঁটে চলেছি একমনে। কিছুদূর এগুতে একটা সিএনজি এসে আমার পথরোধ করল। ভয়ে জমে যাওয়ার অবস্থা হতে দেখলাম অমিত নামছে সিএনজি থেকে। আমার সমুখে এসে বললেন,
” তুমি বললে ঐ বাসা কেন সমস্ত রাজ্য ছাড়তে পারি, রাগিসাহেবা। ”
আমি বিরক্ত চোখে তাকালে তিনি সিএনজি দেখিয়ে বললেন,
” উঠো। ”
আমি এক মুহূর্ত চুপ থেকে উঠে বসলাম। তিনি আমার পাশে বসে বললেন,
” এবার তো এই রণচণ্ডী রূপ ছাড়ো। আমি হার স্বীকার করেছি। ”
আমার হাব-ভাব বদলাল না। তিনি একটু চুপ থেকে বললেন,
” তোমার মতো তোমার রুমটারও আমাকে পছন্দ না। পা ফেললেই তোমাকে রাগিয়ে দেয়। আর তুমি? আমাকে রেখে বেরিয়ে আস। বিয়ে করেও ভাগ্য বদলাতে পারলাম না। হায় আফসোস! ”
অমিতের কথাগুলো আমাকে মায়ায় ফেলতে পারল না। আমি একপাশে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। তখনই তিনি ডেকে উঠলেন,
” রাগিসাহেবা? ”
তার এই অদ্ভূত ডাক আমার কর্ণ পথ দ্বারা মস্তিষ্কে পৌঁছালেও আমি প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। পুরোদস্তুর এড়িয়ে গেলাম। মনোযোগ বসালাম শরীর ছুঁয়ে দেওয়া শীতল ও শান্তিপ্রিয় বুনো হাওয়ায়। তারপর কী হলো মনে নেই। যখন চোখ মেললাম তখন ভোরের দীপ্ত ছুঁয়ে আছে জানালার কাচে। আমি হুড়মুড়ে উঠে বসলাম। নজর বুলালাম চারপাশে। অমিতের দেওয়া সেই কাচের বোয়ামটায় চোখ পড়তে বুঝলাম আমি তার রুমে আছি। কীভাবে এসেছি জানি না!
বিছানা থেকে পা নামাতে গিয়ে মেজাজ খারাপ হলো। সেই পরিচিত আলপনায় পাদুটো আলতা রঙে সজ্জিত। আমি কঠিন রাগ নিয়ে বিছানা থেকে নামলাম। একটু খুঁজতে আলতার কৌটো পেলাম। হেঁটে গেলাম বারান্দার দিকে। অমিত তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কোনো কিছু বিবেচনা না করেই আলতা ঢেলে দিলাম তার শরীরে। এক পলকেই সাদা রঙের পাতলা টি-শার্টে এলোমেলো দাগে ভরে গেল। আমি তৃপ্তি পেলাম। বিরল হাসলাম। সকালের ঠাণ্ডা হাওয়ায় কুঁকড়ে থাকা শরীরটাতে প্রতিশোধ নিয়ে রুমে ফিরে আসলাম। ঘুমের ভাব ছুটাতে ঢুকলাম গোসলখানায়। একেবারে গোসল করে বেরিয়ে এসে মোবাইল হাতে নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে একটি বার্তার প্রবেশ হলো। বার্তাটি পাঠিয়েছে অমিত। লিখেছে,
‘ আমার দুর্বল জায়গায় আঘাত করাটা কি ঠিক হলো? ‘
আমি উত্তর দিলাম না। ফোন রেখে দিতে যাব তখন আবার লিখে পাঠাল, ‘ আমার মনে হয়, তোমার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা দূরে রেখে, চারপাশটা ভুলে একবার যদি আমাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরো, চোখ বন্ধ করে মনে মনে উচ্চারণ করো, আমি তোমার স্বামী তাহলেই আমাকে ভালোবেসে ফেলবে। ‘ বার্তাটা পড়ে আমার ভেতরটা যেন কেমন করে উঠল। নিস্বাস এলোমেলো হলো। চিন্তাশক্তি লোপ পেল। অবশ হয়ে আসল শরীরখানা। স্থির দৃষ্টি কেঁপে উঠল অমিতের কণ্ঠস্বরে,
” একবার চেষ্টা করে দেখবে? ”
আমি চমকে সামনে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে চোখ আটকে গেল তার খোলা বুকে। সেই দর্শন স্থায়ী হলো না। দরজার কড়া নাড়ছে কেউ। অমিত অনাবৃত শরীর নিয়েই দরজা খুললেন। পাহাড়ের মতো বইয়ের লাইন নিয়ে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইল এক ছোকরা। অমিত দরজা থেকে সরে দাঁড়াতে সে ঢুকে পড়ল। খাটের উপর একে একে সব বই রেখে চলে গেল। আমি চোখে-মুখে প্রশ্ন জড়ো করতে সন্দেহে জড়িয়ে পড়লাম। বইয়ের কাছে ছুটে গিয়ে একটা তুলে নিলাম। তারপর আরেকটা। তেমন করে সবগুলো নাড়িয়ে-চাড়িয়ে বিস্মিত গলায় বললাম,
” এগুলো তো আমার বই! ”
অমিত টাওয়েল হাতে নিয়ে বললেন,
” চিনতে পেরেছ তাহলে। ”
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,
” আমার বই আমি চিনব না? ”
উত্তরে তিনি হাসলেন। গোসলখানায় ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
” এখানে দুটো বই নেই। আমার মানিব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে রাখ। ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় কিনে নিও। ”
আমি বই ফেলে গোসলখানার দিকে ছুটে গেলাম। অবিশ্বাস্য গলায় সুধালাম,
” আমি ভার্সিটিতে যাব? ”
অমিত সোজা উত্তর দেওয়ার বদলে বললেন,
” ইচ্ছে না থাকলে যেও না। আমার আপত্তি নেই। ”
আমি মুখ কালো করে ফেললে তিনি বললেন,
” তোমার ভার্সিটি এখান থেকে অনেকটা দূরে। রোজ গেলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই সপ্তাহে দুইদিন যেতে পারবে। তাও আমার ঠিক করে দেওয়া গাড়িতে। ”
আমি খুশি হতে গিয়েও নারাজ হলাম। বললাম,
” আবার আপনার ইচ্ছে তে আমাকে চালাতে চাচ্ছেন? ”
অমিত টাওয়ালটা গলায় প্যাঁচিয়ে বললেন,
” না, তোমার নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। ”
কথাটা বলেই ভেতরে ঢুকে গেলেন। দরজা অর্ধেক খোলা রেখে ঝরণা ছাড়লেন। ভিজতে ভিজতে বললেন,
” আমার অফিস না থাকলে আমি নিজেই নিয়ে যেতাম। সম্ভব হচ্ছে না বলে এই ব্যবস্থা। ”
আমি বাইরে দাঁড়িয়েও তার গোসল করা দেখতে পারছিলাম। খানিকটা অস্বস্তিতে পড়লেও কৌতূহল দমাতে পারলাম না। প্রশ্ন করে বসলাম,
” আপনার ছুটি শেষ? ”
তিনি সাবান মাখতে মাখতে বললেন,
” না। কিন্তু একটা জরুরি কাজে বস ডেকে পাঠিয়েছেন। মনে হয় আর ছুটি কাটানো হবে না। ”
আমি আর কিছু বললাম না। তার কাছ থেকে সরে আসলাম। বিছানায় বসতে গিয়ে খেয়াল হলো এ চাদরটা নতুন। কাল অন্যটা ছিল। কিন্তু আমি তো বদলাইনি। তাহলে কে বদলাল?
আমি ভাবনায় জড়িয়ে পড়তে অমিতের উন্মুক্ত শরীরটুকু মনে পড়ল। তার গায়ে তো টি-শার্ট ছিল। কোথায় গেল? আমি দৌড়ে বারান্দায় গেলাম। আনাচে-কানাচে খুঁজেও পেলাম না। তন্মধ্যে অমিতের আপুর বলা কথাটি মনে পড়ল, অমিত দাগ একদম পছন্দ করে না।
চলবে