আলতা_রাঙা_পা,১৩,১৪

0
713

#আলতা_রাঙা_পা,১৩,১৪
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৩)

” আমাকে দেখার জন্য কোনো অনুমতির প্রয়োজন নেই, রাগিসাহেবা। দূর থেকে অসুবিধা হলে কাছে এসে দেখতে পার। চোখে চোখ রেখে। হাত ছুঁয়ে, কাঁধে মাথা ফেলে। এত কষ্ট করে লুকিয়ে দেখতে হবে না। ”

অমিতের এমন কথায় আমি লজ্জা পেলাম। বারান্দার পাশের জানালার পর্দা ছেড়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালাম। চোখ বন্ধ করে ঠোঁট চেপে হাসলাম।

অমিতের পাঠানো লোকটি ঠিকঠাক কাজ করতে পেরেছে মনে হয়। সেজন্য অফিস যাচ্ছে না। ছুটি কাটাচ্ছে। সুযোগ পেলেই এটা-সেটা পরিষ্কার করছে। বিকেলে দেখলাম ছাদে পানি ঢেলে ঝাড়ু দিচ্ছে। আর এখন বারান্দার গ্রিল। সব কিছুতেই তার দাগমুক্ত হওয়া চাই!

নিজেকে ধাতস্থ করতে প্রায় মিনিট পেরুল। পিলপিল পায়ে বারান্দার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম,
” কাঁধে মাথা ফেলেও দেখা যায়? ”

অমিত হাতের টুকরো কাপড়টা মগের পানিতে চুবালেন। মগটা গ্রিলের সাথে আটকে রেখে বললেন,
” অবশ্যই দেখা যায়। ”
” কিভাবে? ”
” এদিকে এসো দেখাচ্ছি। ”

তার ডাকে আমি এগিয়ে গেলাম। সামান্য দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ালে তিনি বললেন,
” এত দূর থেকে কাঁধে মাথা রাখতে পারবে? ”
” কাঁধে মাথা রাখতে হবে? ”
” হ্যাঁ, নাহলে দেখাব কিভাবে? ”

আমি এক মুহূর্ত চেয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললাম,
” দেখানো লাগবে না। ”

অমিতও আর জোর করলেন না। নিজের কাজে মন দিলেন। আমি নীরব দাঁড়িয়ে থাকলাম তার পাশে। আড়চোখে তাকালাম সময়ে সময়ে। তার ব্যস্ত হাত দুখানা ভারি লোভণীয় ঠেকল। ছুঁয়ে দেওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা! স্যান্ডো গেঞ্জি পড়ে থাকায় কাঁধটা উন্মুক্ত হয়ে আছে। সন্ধ্যার ঈষৎ অন্ধকারেও কেমন মায়া। টানছে যেন খুব। মনে হচ্ছে মাথা ফেললেই সকল ক্লান্ত, অবসাদ, দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যাবে। মেলামেশা সহজ হয়ে যাবে নিমেষেই।

” তুমি কি আরও কিছুক্ষণ থাকবে? ”

অমিতের কণ্ঠস্বরে আমার ঘোর কাটল। কোনো রকম উত্তর না দিয়ে রুমের দিকে হাঁটা ধরলাম। তিনি পিছু ধরে বললেন,
” আমার কোনো তাড়া নেই। তুমি সময় নেও। ”

আমি থেমে গেলাম। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালাম। কোন ব্যাপারে কথাগুলো বলছেন বুঝার চেষ্টা করছিলাম। তখনই বললেন,
” মানিয়ে নিতে বলব না। শুধু বলব গুছিয়ে নেও। নিজের মতো চারপাশটা সাজিয়ে নেও। পরিস্থিতি হয়তো আমাদের কাছে আনবে। কিন্তু ভালোবাসা? সে তো আধ্যাত্মিক ব্যাপার। কখন, কেন, কিভাবে হয়ে যাবে বুঝতেই পারবে না। ”
অমিত আমাকে পাশ কাটিয়ে সামনে আসলেন। রুম থেকে বের হওয়ার আগে বললেন,
” এই যেমন আমি বুঝতে পারছি না! ছবিতে দেখে মনে হয়েছিল, তোমার মায়াভরা মুখটাকে ভালোবেসে ফেলেছি। সামনাসামনি দেখে মনে হলো তোমার পা’দুটোকে ভালোবেসে ফেলেছি। আর এখন মনে হচ্ছে, তোমার দ্বিধাভরা মনটাকে ভালোবেসে ফেলেছি। ”

অমিত বেরিয়ে যেতেই আমার দ্বিধাভরা চোখদুটো বিস্ময়ে রূপ নিল। মনের সাথে মনের যুদ্ধ বাঁধল। এই যুদ্ধেই আমার মধ্যে আমূল পরিবর্তন ঘটল। দ্বিধা কাটতে লাগল ক্ষণে ক্ষণে। চারপাশটা সাজিয়ে নিতে পারছিলাম নাকি জানি না। কিন্তু কোনো বাহানা ছাড়াই তার মুখোমুখি হয়ে শুতে পারলাম। ঘুম না আসলে বলতে পারলাম। গল্প করার ইচ্ছেপোষণ করতে পারলাম। আরও কয়েক রাত্রির চেষ্টায় কফি বানানো শিখলাম। দুপুরে কী রান্না হবে, রাতে কী রান্না হবে এ বিষয়ে শাশুড়ি মায়ের সাথে আলাপ করতে পারলাম। আপুর সাথে তার পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে কতগুলো বিকেল পার করলাম। অমিতের রুম গুছিয়ে রাখার পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত জিনিসে হাত রাখলাম। বাইরে বেরুতে ইচ্ছে হলেই কল করে জানিয়ে দিলাম আজ তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে। রিকশায় করে গোধূলিতে মনোরঞ্জন করলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা ফেলাম। পার্কে বসে আইসক্রিম খেলাম। শপিংমল থেকে কেনাকাটা করলাম। পুরো পরিবার নিয়ে একবার বনভোজনও সেরে ফেললাম। এই গুছিয়ে নেওয়া, সাজিয়ে নেওয়ার মধ্যেই আমার মানিয়ে নেওয়াও হয়ে গেল। যা আমি টের পেলাম না। একদমই না। এবার আমি অপেক্ষা করছিলাম কাছে চলে আসার, ভালোবাসা হয়ে যাওয়ার। অপেক্ষারত এক বিকেলে আমি অমিতের ব্যবহৃত এটা-সেটা গুছাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটি খাম পেলাম লাল রঙের। রঙটা চোখে লাগতেই আমার বুকটা ধক করে উঠল! মনে পড়ল প্রায় এক বছর আগের একটি দিনের কথা। সেদিন তিন্নি আমায় খুব বিরক্ত করেছিল। কোন এক ছেলের খুব প্রশংসা করতে করতে জানাল, তার প্রেমে পড়েছে। মনের কথা জানাতে না পেরে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনো কিছুতে মন বসাতে পারছে না। আর এই মনের কথা সরাসরিও জানানো যাবে না। কারণ, ছেলেটি তার পরিচিত। তাই চিঠি-পত্রের সাহায্য নিতে চাচ্ছে। আর এই চিঠি লেখায় আমাকে সহায়তা করতে হবে। নাহলে বাড়ি ফিরতে দিবে না। তার জোরাজুরিতে একরকম বাধ্য হয়ে সঙ্গ দিয়েছিলাম। প্রেমপত্র লেখায় কোনো সাহায্য না করে উল্টো বুঝাতে চাচ্ছিলাম ছেলেরা কতটা খারাপ। সে বিশ্বাস করল না। আমার পরামর্শ আমলে নিল না। লাল রঙের খামে নিজের প্রেমপত্র ঢুকিয়ে জানাল, এটা সে আজই দেবে। আর উত্তর নিয়ে তারপরেই ক্যাম্পাসে আসবে। তারপর দুইদিন ক্লাসে আসেনি তিন্নি। আমি ধরে নিয়েছিলাম ছেলেটি তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু না। তিনদিনের দিন এসে জানাল, ছেলেটি নাকি আগে থেকেই তাকে পছন্দ করত। কিন্তু ভয়ে বলতে পারেনি। তিন্নির কাছ থেকে প্রেমপত্র পেয়েই দুজন আলাদাভাবে দেখা করেছে।

আমি অতীত থেকে বের হয়ে খামটি ভালো করে পরখ করলাম। তিন্নির প্রেমপত্র অমিতের কাছে এটা আমার বিশ্বাস হলো না। তাই খুলে দেখলাম। ভেতরে সেই পরিচিত লেখা দেখে আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। এক মুহূর্তের জন্য অমিতের পাশে তিন্নিকে কল্পনা করে বসলাম। উচ্চারণ করে ফেললাম, ‘ তিন্নি আর অমিত একে-অপরকে ভালোবাসে? ‘

আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। দুর্বল শরীরটাকে টেনে আনলাম বিছানায়। চাদর খামচে ধরে নিজেকে শক্ত রাখতে চেষ্টা করছিলাম। তেমন অবস্থায় অমিতকে কল করে বললাম, তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে। জরুরি কথা আছে।

__________

আমার কল পেয়েও অমিত বাসায় ফিরল রাত করে। ফেরার পর একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করল না, আমার জরুরি কথার ব্যাপারে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম তিনি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। অনেকদিন পর আমার মন দ্বিধায় পড়ল। আসলেই কি অমিত আমাকে এড়িয়ে চলছে নাকি তিন্নির চিঠি পাওয়ার পর আমার মনের সন্দেহ থেকে এমন ভাবছি? এই দ্বিধাদ্বন্দ থেকে মুক্তি পেতে সরাসরি ডাকলাম,
” শুনছেন? ”

অমিত তখন রাতের খাবার শেষ করে বিছানায় আধশোয়া হয়েছে। আমার ডাকে বন্ধ চোখ মেলে আবার বুজে নিলেন। আমি অধৈর্য হয়ে বললাম,
” আপনার সাথে কথা ছিল। ”

তিনি হ্যাঁ-না কিছু বললেন না। আমি খামের প্রসঙ্গে কথা তুলব তখনই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বালিশ হাতে নিয়ে বললেন,
” আজ খুব গরম পড়েছে মনে হয়। আমি বারান্দায় শুব। তুমি আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ো। ”

____________
অমিতের এই এড়িয়ে যাওয়া দিনকে দিন বেড়েই চলল। দূরত্ব কমিয়ে আনা মানুষটা নিজেই কেমন দূরত্ব তৈরি করছিল। তার এমন ব্যবহার আমি নিতে পারছিলাম না। দুমড়ে-মুষড়ে যাচ্ছিলাম। ভেঙে পড়ছিলাম ধীরে ধীরে। আমার গোপনে মানিয়ে নেওয়া রূপটা সামনে প্রকাশ পাচ্ছিল আস্তে আস্তে। বদলে যাওয়া আমিটা আবারও ফিরে যাচ্ছিলাম আগের রূপে। এই ফিরে যাওয়ার পথেও বার বার অমিতকে আশা করছিলাম। কোথাও না কোথাও এ মানুষটাতেই নিজের শক্তপোক্ত মনোবল বিলিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম। তেমনই একরাতে অমিতের ফোন বেজে উঠল। আমি তখনও জেগে। অমিত হয়তো বুঝতে পারেনি আমি তার কথা শুনছি। সে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছিল। স্পষ্ট শুনতে পারছিলাম না বলে আমি উঠে জানালার কাছে যেতে চাইলাম। তার আগেই অমিতের গলা থেমে গেল। হেঁটে এলেন রুমে। আমি সতর্কতায় চোখ বন্ধ করে ফেললাম। তিনি ধৌতখানায় ঢুকলে আমি উঠে বসলাম। ছুটে গেলাম বারান্দায়। যা ভেবেছিলাম তাই। ফোনটা বালিশের কাছেই পড়ে আছে। ফোনটা হাতে নিতে একটা বার্তা এলো। বার্তাটি পাঠিয়েছে তিন্নি। তাতে একটি ঠিকানা দেওয়া। আমার সন্দেহমন ধরেই নিল এতক্ষণ তিন্নির সাথেই কথা বলছিল। আর এই ঠিকানায় অমিতকে ডেকে পাঠিয়েছে। আমার অনুমান সঠিক নাকি ভুল তা জানার জন্য আমি নিজের বিছানায় ফিরে গেলাম। আগের ন্যায় চুপচাপ শুয়ে থাকলাম। তারও ঠিক কয়েক মিনিট পর অমিত ধৌতখানা থেকে বের হলেন। বারান্দা থেকে মোবাইলটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। দরজাটা খুব সাবধানে ভিড়িয়ে দিতেই আমার চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল!

___________
অমিতের আসার অপেক্ষায় ছিলাম সারারাত। একফোঁটাও ঘুমাইনি। মনকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি সারাটি সময়। তিন্নি আর অমিত প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, ভাইবোনের মতো এ কথাটি আউড়েছি লক্ষবার। কাজ হয়নি। মন মানেনি। তার প্রমাণ দরকার। তাই ভোর হতে আমিও বেরিয়ে পড়ি। তিন্নির পাঠানো সেই ঠিকানায় গিয়ে হাজির হই। সেখানে উপস্থিত হওয়ার পর জানতে পারি ওটা একটি আবাসিক হোটেলের ঠিকানা ছিল। ফ্লোর নাম্বার, রুম নাম্বার সবই এই হোটেলের, কোনো বাসার না। আমি ধুকপুক মনে সেই হোটেলে ঢুকি। রিসিপশন থেকে অনুমতি নিয়ে যখন রুমের সামনে হাজির হই তখনই তিন্নিকে দেখতে পাই। অমিতের কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীরে অমিতের শার্ট। অমিত একহাতে তিন্নিকে জড়িয়ে ধরে অন্যহাতে দরজায় তালা মারছে। তালা মারা শেষে তিন্নিকেসহ পেছন ঘুরতে আমার চোখে চোখ পড়ল। সেই চোখে চোখ রাখা আমার সাধ্যি ছিল না। দূর থেকে আমি পালিয়ে আসছিলাম। ছুটতে ছুটতে পেছন থেকে শুনলাম অমিত আমাকে ডাকছে। তার কণ্ঠে আমার নামটি আর মাদকতা লাগল না। মায়া, দরদ সব বুঝি তার কণ্ঠ থেকে কেউ শুষে নিয়েছে। এক পলকেই বিষাক্ত ঠেকল সবকিছু। এক মুহূর্তেই চুরমার হয়ে গেল আমার গুছানো ও সাজানো চারপাশ। দেখিয়ে দিল কোনো পুরুষই আলাদা নয়। আরও একবার প্রমাণ করে দিল, সব পুরুষ এক।

চলবে

#আলতা_রাঙা_পা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৪)

বাসায় ঢুকতে শাশুড়িমার মুখোমুখি হলাম। দূর থেকেই সন্দেহ করে বসলেন। কী হয়েছে জানতে চাইলেন। আমি তাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। মুখটা যথাসম্ভব লুকিয়ে রাখলাম। রুম পর্যন্ত এগুতে অমিতের আপুর ডাক পেলাম। পেছন ফিরলাম না। তাদের নানান প্রশ্ন থেকে মুক্তি পেতে রুমের ভেতরে ঢুকলাম হনহনিয়ে। দরজা আটকে রুদ্ধশ্বাসে বসে থাকলাম অনেক্ষণ। চিন্তা-ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে শুধু তাদের পাশাপাশি কল্পনা করলাম। নিজের মতো অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সাজিয়ে ঘৃণার থুতু জমালাম। সারা শরীর কেঁপে উঠলে দাঁড়িয়ে পড়লাম বসা থেকে। মনে মনে উচ্চারণ করলাম, এখানে আর এক মুহূর্তও না!

নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম দ্রুত। দরজার সিটকানি খুলতে অমিতের মুখদর্শন হলো। ভেতরে ঢুকল জোর খাটিয়ে। আমাকে ভেতরে রেখে দরজা লাগিয়ে দিচ্ছিল। আমি বাঁধা দিলে তিনি শুনলেন না। বাইরে উন্মুখ হয়ে থাকা সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,
” যার যার কাজে যাও। এখানে কেউ দাঁড়াবে না। ”

তার সেই ঠাণ্ডা শাসানিকে ভয় পেল সকলেই। এক মুহূর্তও দেরি করল না। চোখের পলকে রুমের আশপাশে ছড়িয়ে পড়ল। সেই সুযোগে দরজায় সিটকানি দিলেন অমিত। আমার দিকে ফিরেই বললেন,
” এসব কী তায়্যিবাহ? ”

আমি রক্তিম চোখে তাকালাম। ভাবভঙ্গিতে উগ্রতা। নিশ্বাসে বজ্রের মতো গর্জন।

” আমাকে কিছু বলার সুযোগ তো দেবে? ”

অমিতের কণ্ঠ করুণ শুনাল। চোখে-মুখে অসহায়ত্ব। আমার মায়া হওয়ার বদলে রাগ চড়াও হলো। চোখে চোখ রেখে দৃঢ় স্বরে বললাম,
” আমি বাড়ি যাব। ”

অমিত এক মুহূর্ত চেয়ে থাকল আমার পানে। নীরব চাহনি আগুনের মতো পুড়িয়ে দিতে চাইল আমার রূঢ়ভাব। আমি সেই সুযোগ দিলাম না। বিদ্রুপ করে বললাম,
” আলতা এত পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও বিছানায় তার দাগ মেনে নিতে পারলেন না। টি-শার্টকে টুকরো করলেন। অথচ সর্বাঙ্গে দাগ মাখিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এই কলঙ্কের দাগ কী করে পরিষ্কার করবেন? চামড়া ধুয়ে নাকি টুকরো করে? খসে ফেললেও কি দাগ মিটবে? ”

অমিত নিরুত্তর। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন আমার দিকে। আমি গুছিয়ে নেওয়া ব্যাগ বগলদাবা করতে গিয়ে থামলাম। বাসর রাতে উপহার পাওয়া কাচের বোয়ামটার দিকে তাকালাম। মুহূর্তে ঝাপসা হয়ে আসল দৃষ্টি। ঠোঁট কামড়ে নিজের দুর্বলতাকে গুপ্ত করলাম। বোয়ামের মুখ খুলে দিলাম চোখ বন্ধ করে। অমিতকে পাশ কাটিয়ে বন্ধ দরজা খুললাম। তিনি তখনও নীরবে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছেন ঝড়ো হাওয়ায় বেঁকে যাওয়া খুঁটির মতো। আমি সদর দরজা পেরিয়ে রাস্তায় পা রাখতে একটি গাড়ি এসে থামল আমার সামনে। রঙ দেখেই চিনতে পারলাম এটা অমিতের অফিসের গাড়ি। তার অফিসে যাওয়ার সময় হয়েছে তাই নিতে এসেছে। আমি গাড়িটাকে ফেলে ডানদিকে হাঁটা ধরলে অমিতের গলা পেলাম। চেঁচিয়ে বলছেন,
” রমিজ, তুমি অফিসে ফিরে যাও। আজ আমি ড্রাইভ করব। ”

তারপরেই আমার উদ্দেশ্যে বললেন,
” উঠে বসো। ”

আমি অনিচ্ছা প্রকাশ করে সামনে হেঁটে যেতে চাইলাম। তিনি তৎক্ষণাৎ সাবধান করে দিলেন,
” আমি শক্তি প্রয়োগ করলে কিন্তু পেরে উঠবে না। ”

আমি কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে তিনি নরম হয়ে বললেন,
” বাড়িতে যাবে তো? আমি সেখানেই দিয়ে আসব। উঠো। ”

আমি আর এগুনোর সাহস পেলাম না। ভয় পেতে শুরু করলাম তাকে। চুপচাপ গাড়িতে বসলাম। তিনি ড্রাইভিং সিটে বসে রমিজকে ফিরে যাওয়ার ভাড়া দিলেন। বাতাসে শোঁ-শোঁ শব্দ তুলে ছুটে চলছেন আমাকে নিয়ে। চলতে চলতে অকস্মাৎ ব্রেক কষলেন। আমি ভাবলাম বাড়িতে চলে এসেছি। চটপটে নেমে দেখি অন্য জায়গা।

“আমার সাথে এসো। ”

অমিতের আহ্বানে আমি সাড়া দিলাম না। নিজের স্থানে স্থির থেকে চারপাশে নজর রাখছিলাম। বামপাশে একটি বড় হাসপাতালে চোখ পড়তে হাতে কারও স্পর্শ পেলাম। আমি সচকিত হয়ে মানুষটির দিকে তাকাতে দেখলাম অমিত। আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে তোয়াক্কা না করে বললেন,
” চুপচাপ আমার সাথে এসো। ”

অমিত আমাকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে এগিয়ে গেলেন। কয়েক কদম এগিয়ে আমার হুঁশ এলো। মনে পড়ল, এই হাতে তিন্নিকে জড়িয়ে ছিল। খোলা কাঁধে মাথা ছুঁয়েছিল। আমি দাঁড়িয়ে পড়তে চাইলাম। তার হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত হতে চাইলাম, পারছিলাম না। পুরুষ হাত যে এত শক্ত হয় এই প্রথম উপলব্ধি করলাম। শারীরিক ক্ষমতায় তাদের এগিয়ে থাকার কারণ অনুধাবন করতে পারলাম। শারিরীক শক্তিতে ব্যর্থ হয়ে বললাম,
” ছাড়ুন। আমি কিন্তু চিৎকার করব। ”

তিনি নিরুদ্বেগে বললেন,
” করো। ”
” মানুষ জড়ো করব। ”
” আচ্ছা। ”
” আপনাকে স্বামী হিসেবে অস্বীকার করে মার খাওয়াব। ”
” হাসপাতালেই আছি, সমস্যা কী? ভাগ্যে থাকলে চিকিৎসায় বেঁচে যাব নাহয় মরে যাব। ”

অমিত আমাকে নিয়ে সিঁড়ি কাটছেন। তার পায়ের সাথে তাল মেলাচ্ছিনা দেখে বার বার হোঁচট খাচ্ছি। একবার তো পড়েই যাচ্ছিলাম, তিনি সামলালেন। সিঁড়ি শেষ করে করিডোর পার হচ্ছেন। আমি দাঁত চেপে বললাম,
” আপনি বলেছিলেন, আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসবেন। তাহলে এখানে কেন? ”

অমিত উত্তর দেওয়ার বদলে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন। একটা রুমে ঢুকে বললেন,
” তোমাকে সত্যের সামনে দাঁড় করানোর জন্য। ”

আমি ভ্রু কুঁচকে নিলে তিনি আবার বললেন,
” চোখের দেখায়ও যে ভুল থাকতে পারে সেটা প্রমাণ করার জন্য। এই মুহূর্তে আমাকে তোমার বিশ্বাস হবে না। তিন্নিকেও না। তাই আসল অপরাধীর সামনে এনে দাঁড় করেছি। আশা করছি, তাকে বিশ্বাস হবে। ”
” অপরাধী? ”

আমার কণ্ঠে কিঞ্চিৎ বিস্ময়। অমিত চোখের ইশারায় পাশে তাকাতে বললেন। আমি তাকিয়েই আশ্চর্য হলাম। অমিতের বয়সী একটি ছেলে শুয়ে আছে। মাথায় ব্যান্ডেজ। শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষতের চিহ্ন। হাতে সুই লাগানো। অমিত হেঁটে গিয়ে ছেলেটির পাশে দাঁড়ালেন। গালে থাপ্পড় মেরে ডাকলেন,
” রিংকু? ”

ছেলেটি চোখ মেলেই কেঁপে উঠল। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল চোখে-মুখে। সুইবিদ্ধ হাত তুলে ক্ষমার ভাব ধরলে তিনি বললেন,
” তিন্নির সাথে ঘটানো প্রত্যেকটা ঘটনা বিস্তারিত এনাকে শোনা। ”

অমিতের কণ্ঠে স্পষ্ট শাসানি। রিংকু আমার দিকে তাকাল ভীত দৃষ্টিতে। তন্মধ্যে অমিত ধমকে উঠলেন,
” একটু কিছু যেন বাদ না পড়ে। একদম শুরু থেকে বলবি। ”

রিংকু গল্প বলার মতো করে জবানবন্দি শুরু করল। সেই জবানবন্দি থেকেই জানতে পারলাম রিংকু অমিতের কলেজ বন্ধু। কলেজে যাওয়া-আসার পথে প্রায়ই অমিতের বাসায় ঢুকা হতো। এদিকে তিন্নিও ছুটি পেলে চাচার বাসায় বেড়াতে যেত। সময়ে সময়ে দুজনের দেখা হতো। সেখান থেকেই নাকি তিন্নিকে ভালো লাগে। কিন্তু অমিতের ভয়ে কখনও প্রকাশ করতে পারেনি। তারও বছর কয়েক পর তিন্নির কাছ থেকে একটি চিঠি পায়। সেই চিঠিতে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় তিন্নি। ততদিনে আবার রিংকু প্রেম করছে অন্য কারও সাথে। এদিকে তিন্নিকে কাছে পাওয়ার একটা লোভ জন্ম নিয়েছিল। তাই মিথ্যে বলে সেও তাকে ভালোবাসে। তাদের প্রেম শুরু হয়। ফোনে কথা, মুঠো বার্তা, বাইরে দেখা করা সবই চলছিল লুকিয়ে। তিন্নিকে বার বার সাবধান করে দিয়েছিল অমিত যেন না জানে। তবুও সে জেনে গেল। কী করে যেন তিন্নির দেওয়া সে প্রেমপত্র তার হাতে চলে গেল। বন্ধু হওয়ার সুবাদে রিংকুর অন্য গার্লফ্রেন্ডের কথা অমিত জানত। তাই সে খুব ক্ষেপে যায়। তর্কাতর্কি থেকে মারামারি পর্যায়ে পৌঁছায়। তিন্নির সাথে যোগাযোগ বন্ধ করতে বলে। রিংকু প্রথমে ভয় পেয়ে যোগাযোগ বন্ধ করতে চেয়েছিল কিন্তু তিন্নির পাগলামির জন্য পারছিল না। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মনের স্বাদ পূরণ করতে চেয়েছিল রিংকু। সে জানত অমিতের থেকে লুকিয়ে বেশিদিন যোগাযোগ রাখতে পারবে না। আবার তিন্নিকে কাছে পেয়েও ভোগ না করে ছাড়তে পারছিল না। তাই একটা নোংরা পরিকল্পনা করে। সে কল্পনা প্রকাশ করার আগেই রিংকুর অন্য প্রেমিকার ছবি পায় তিন্নি। আবার অন্য প্রেমিকাও তিন্নির কথা জেনে ফেলে সম্পর্ক শেষ করে দেয়। সেসময় তিন্নি অস্বীকার করলেও রিংকু বুঝে গিয়েছিল এটা অমিতের কাজ। তার খুব রাগ হলো। মনের ভেতর জেদ চেপে বসল। এই মেয়েকে সে বিছানায় আনবেই। আর এটাই হবে অমিতের হার। সে চিন্তাই বেশ কয়েকদিন যোগাযোগ বন্ধ রাখে রিংকু। এসময় অমিতের বিয়ের খবরও পায়। রিংকু ভেবেছিল অমিত সংসারে পুরোপুরি মনোযোগী হয়ে পড়লে তিন্নির সাথে সরাসরি দেখা করবে। হাত জোর করে ক্ষমা চাইবে, কান্নাকাটি করবে। তিন্নি গলতে শুরু করলেই মোক্ষম চাল চালবে। রিংকু তাই করেছিল। তার ভাবনাকে সত্যি করে তিন্নি ক্ষমাও করে দিয়েছিল। শর্ত দিয়েছিল, তাকে বিয়ে করতে হবে। রিংকু শর্ত মেনে নেয়। তবে অমিতকে এ ব্যাপারে এখনই জানাতে নিষেধ করে। বলেছিল, বিয়ের পর তাকেসহ দুজনের পরিবারকেই জানাবে। বোকা তিন্নি সব বিশ্বাস করে নিয়েছিল। রিংকুর কথামতো লুকিয়ে বিয়ে করার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। কাজী অফিসের পরিবর্তে যখন একটি হোটেলে এসে উঠে তখনই তিন্নির সন্দেহ হয়। টনক পড়ে। অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ টের পায়। সে তৎক্ষনাৎ অমিতকে ফোন করে সবটা জানায়। প্রথমে রিংকু জানতে না পারলেও পর মুহূর্তে বুঝে যায়। তিন্নির সাথে খারাপ ব্যবহার করে। মারধোর করে। এক পর্যায়ে ধর্ষণের মতো পাপ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তিন্নির ভাগ্য ভালো যে অমিত ঠিক সময়ে পৌঁছে তাকে বাঁচিয়ে নেয়।

” তোমার ক্যাম্পাসে তিন্নির সাথে দেখা হওয়ার পরই আমার সন্দেহ হয়েছিল। তাই বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার নামে ওর সাথে আলাদা কথা বলি। তোমার সামনেই কথা বলতে পারতাম কিন্তু বলিনি। কারণ, আমি চাইনি, তুমি আরও একটি খারাপ পুরুষকে দেখ। আর আমার থেকে দূরত্ব বাড়াও। ঠিক একই কারণে তিন্নিও তার সমস্যার কথা তোমার সাথে শেয়ার করতে পারেনি। ”

অমিত আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন। বললেন,
” যে আমি সামান্য দাগ সহ্য করতে পারি না সে আমি চরিত্রে দাগ নিয়ে বেঁচে থাকব এটা ভাবলে কী করে, তায়্যিবাহ? তিন্নিকে আমি ছোটবোনের মতো স্নেহ করি। ”

আমার মাথা ঝুকে এলো। তখনই মনে পড়ল গত কয়েকদিনে অমিতের ব্যবহারের কথা। আমি চোখ তুলে জিজ্ঞেস করলাম,
” তাহলে এ কয়দিন আমাকে এড়িয়ে চলেছেন কেন? ”
” লজ্জায়। ”
” কিসের লজ্জা? ”
” আমি কথার খেলাফ করে ফেলেছি। ”
” কোন কথা? ”
” তোমার অনুমতি ছাড়াই তোমাকে স্পর্শ করেছি। আলতা পরাতে গিয়ে তোমার পায়ে চুমু খেয়েছি। কিভাবে যে ভুলটা হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি। আমার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করছিলে যে তার প্রভাব পড়েছিল। হয়তো তুমি জানতে পারনি, কিন্তু আমি তো জানি। আর জানি বলেই এই অন্যায়টা মানতে পারছিলাম না। আমি বার বার তোমার কাছে দোষ স্বীকার করতে চেয়েছি, পারিনি। ভয় পেয়েছি যদি ভুল বুঝো? দূরে সরে যাও? আমাকেও তোমার চেনা পুরুষদলের মধ্যে ফেল? আবার না বলেও থাকতে পারছিলাম না। ভুলতে পারছিলাম না, তাই নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে রাখতে চাচ্ছিলাম। যাতে এক ভুল বার বার না করি। ”

আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। নির্বোধের মতো তাকিয়ে থাকলে তিনি বললেন,
” চলো। ”

আমি বাধ্য মেয়ের মতো তার পেছন পেছন হেঁটে চললাম। গাড়িতে বসলাম। ইঞ্জিন চালু করতে উদাস হয়ে পড়লাম। সেই উদাসভাব কাটল অমিতের গলায়,
” তোমার বাড়ি চলে এসেছি। নামো। ”

আমি অবাক হয়ে আমার বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কিছু একটা বলার জন্য ঠোঁট কেঁপে উঠতে তিনি বললেন,
” আমি একবারের জন্যও বলিনি, আমাকে ভালোবাসো। বার বার বলেছি, আমাকে বিশ্বাস করো। আর সেই বিশ্বাসটুকু জন্ম দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। নিজের উপর আস্থা ছিল বলে ভেঙে পড়িনি কখনও। হতাশ হয়নি। থমকে যাইনি। কিন্তু আজ আমি ভেঙে পড়েছি। আস্থা হারিয়েছি। মন থেকে মেনে নিচ্ছি আমি ব্যর্থ। তায়্যিবাহ, আমাকে হারিয়ে দিয়ে তুমি জিতে গেছ। স্ত্রীর জিতে স্বামীর খুশি হওয়া উচিত, তাই না? কিন্তু আমি পারছি না। আমি এখানেও ব্যর্থ। ”

অমিত আমাকে রেখে গাড়িতে উঠে বসলেন। চলে যাওয়ার আগে বললেন,
” পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। ভালো থেকো। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here