#আলতা_রাঙা_পা
#অন্তিম_পর্ব
#রোকসানা_রাহমান
বাবার বাড়ি রেখে যাওয়ার পর একদম নিভে গেলাম আমি। যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল আমাদের। বন্দি হয়ে পড়ে থাকলাম নিজের রুমটায়। নাওয়া-খাওয়াই এলো তীব্র অনীহা। বাবা-মা কিছু বলার আগেই বিরক্তে মুখ ফিরিয়ে নেই। এমন বিতৃষ্ণাময় অবস্থায় তিন্নি ছুটে এলো আমার সাথে দেখা করতে। আমি চোখ তুলে তাকাতে ঝাপটে ধরল আমায়। গভীর স্পর্শে আমার দুর্বল শরীরখানা দুমড়িয়ে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” আমার বিশ্বাস-ই হচ্ছে না, আমি এখনও সুস্থ আছি। তোদের মধ্যে বেঁচে আছি। ”
আমি খানিকটা বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” কেন? ”
তিন্নি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। নাক টেনে টেনে কাঁদল কিছুক্ষণ। আমাকে ছেড়ে পাশে বসল শান্তভাবে। চোখ মুছল দু-হাতে। ওড়না সরিয়ে কাঁধের একপাশ থেকে জামা নামিয়ে বলল,
” মানুষ যে এত হিংস্র হতে পারে, সেদিনই জেনেছিলাম। ”
তিন্নির উর্ধ্ববাহে নখের গভীর চিড়! সময়ের টানে শুকিয়ে আসলেও দাগ এখনও কালসিটে। আমি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার সময় পেলাম না। তার আগেই গলার সামনের দিক থেকে জামা টেনে নিচে নামাল। বুকের খাঁজ উন্মুক্ত করে বলল,
” নরপিশাচ একটা! ”
তিন্নির কণ্ঠস্বরে তীব্র ঘৃণাটুকু উপলব্ধি করার মধ্যেই আমার সর্বাঙ্গের লোমকূপ কন্টিকার ন্যায় দাঁড়িয়ে গেল। শীতল স্রোত বয়ে চলল রক্তকনিকায়। আমি কতক্ষণ বিমূঢ় থেকে বললাম,
” দাঁতগুলো ভেঙে দিসনি? ”
” আমার এত শক্তি আছে নাকি? ধস্তাধস্তির মধ্যে আমিও কামড়েছিলাম। নখ দাবিয়ে ছিলাম। ঘুষিও তো দিলাম। তবুও পেরে উঠিনি। এক সময় দুর্বল হয়ে পড়ি। ধরেই নিলাম আমি শেষ। এ জগৎে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার দিন ফুরিয়েছে। রিংকুর এই ভয়ানক আক্রমণ সহ্য করে বেঁচে থাকলেও আত্মহত্যা ছাড়া উপায় থাকবে না। এই দুনিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করতেই ফেরেশতার মতো আমায় রক্ষা করলেন অমিত ভাইয়া। দুজনের মধ্যে খুব মারপিট হলো। আমি আর চক্ষুদর্শন করতে পারলাম না। অজ্ঞান হয়ে গেলাম। পরে অমিত ভাইয়ার মুখে শুনেছি, তার হাতে বেদম মার খেয়ে নাকি রিংকুও অজ্ঞান হয়ে গেছিল। তাকে রুমে বন্দি করে আমাকে হোটেলের অন্য রুমে রেখে চিকিৎসা করেছে। ভাইয়া বুদ্ধি করে ডাক্তারকে হোটেলে আনল বলেই না আমার মান-সম্মান বাঁচল! রিংকুকে পুলিশে দিতে চেয়েও দেয়নি একই কারণে। ”
তিন্নির চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। মনেই হচ্ছে না একটু আগে এই মেয়েটাই কেঁদে-কেটে আমার কাঁধ ভিজিয়েছে। আমার ভীষণ মায়া হলো। মেয়েটার জামা ঠিক করে দাগগুলো ঢেকে দিয়ে বললাম,
” এবার বুঝলি তো ছেলেরা কত খারাপ হয়? বিশ্বাস করার যোগ্যই না। ”
তিন্নি মানা নত করতে গিয়েও উঁচু করে ফেলল। গর্বিতভাবে বলল,
” সবাই খারাপ হয় না। কেউ কেউ বিশ্বাসের যোগ্য হয়। আর সেই যোগ্যতা অমিত ভাইয়ার আছে। প্রমাণ তো আমি নিজে। ”
অমিতের নাম আসতে আমার বুকটা ভার হয়ে আসল। উত্তপ্ত ও দীপ্ত ছড়ানো দিনের আলোতেও সবকিছু অন্ধকার বোধ হলো। খুব দামি কিছু হারিয়ে ফেলেছি এমন অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ল মনজুড়ে।
” শ্বশুরবাড়ি কবে যাবি? ভাইয়া নিতে আসবে নিশ্চয়? আমাকে কল দিবি কিন্তু। ধন্যবাদটা ভাইয়াকে সামনাসামনি দেব। ”
অমিতের সাথে যে আমার যোগাযোগ নেই এই কথাটা বলতে পারলাম না। লজ্জায় চুপ করে থাকলাম। মেয়েটাও কিছু ধরতে পারল না। নানান কথার ছলে ভুলে বিদায় নিয়ে ফিরে গেল।
__________
অমিত নিতে না আসলেও তার বাবা-মা ছুটে এলেন সপ্তাহ পার হতেই। বসার রুমে বসে আতিথেয়তা গ্রহণের ধৈর্যটুকুও ধরতে পারলেন না। সোজা চলে এলেন আমার রুমে। আমি তখন বিকেলের অলস ঘুমে বিভোর। আমার কপাল ছুঁয়ে পাশে বসলেন গভীর স্নেহে। আমি উঠে বসতে চাইলে তিনি মানা করলেন। সস্নেহে বললেন,
” আমার উপর রাগ করেছিস? ”
আমি চুপ থাকলে তিনি আবার সুধালেন,
” আমার ভালোবাসায় কি কোনো ভুল ছিল? ”
আমার চোখ ভিজে এলো। এত মমতা! এত মায়া! এত স্নেহ! এমন আপনিবোধ কি অন্য কারও মায়ের প্রতিও জাগে? আমি তার মানা অমান্য করে উঠে বসলাম। হালকা জড়িয়ে বললাম,
” না, আম্মা। আপনার কোনো ভুল নেই। মায়েদের ভালোবাসায় কখনও ভুল থাকতে পারে না। ”
” তাহলে আমাদের ছেড়ে চলে এসেছিস কেন? ”
আমি উত্তর দিতে পারলাম না। তিনি আমাকে ছাড়িয়ে নিলেন। কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
” অমিতের বাবা বাইরে অপেক্ষা করছেন। তৈরি হয়ে নে, মা। ”
মায়ের এই নিখাদ কর্তৃত্বমাখা আদেশটুকু আমি মানতে চেয়েও পারলাম না। দুই হাঁটুর ফাঁকে মুখ গুঁজে বললাম,
” ফিরে যান, মা। ”
অমিতের বাবা অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য্য হয়ে পড়েন। আমার রুমের দরজার কাছে এসে তাগাদা দেন শাশুড়িমাকে। তিনি ব্যর্থ বদনে স্বামীর কাছে দাঁড়িয়ে বললেন,
” চলো। ”
” বউমা তৈরি? ”
” ও যাবে না। ”
শ্বশুর-শাশুড়ি চলে যাওয়ার তিনদিন বাদেই অমিতের আপুও পা রাখলেন আমাদের বাড়িতে। আমার রুমে নিশ্চুপ বসে থাকলেন প্রায় ঘণ্টাখানিক। আমার আনা নাস্তা গ্রহণ না করে চেয়ে থাকলেন আমার দিকে নিষ্পলক। পাতাজোড়া ক্লান্ত হয়ে আসলে বললেন,
” অমিত বলছে না। তুমিও না। তাহলে বুঝব কী করে তোমাদের মধ্যে কী হয়েছে? সমস্যা ধরতে না পারলে সমাধান আসবে কী করে? তোরা দুটিতে কোন মাটিতে গড়া বল তো? ”
আপুর কণ্ঠে ভারি রাগ। সমস্যা ধরতে না পারার ভীষণ আক্ষেপ। আমি কিছুটা অবাকই হলাম। ভাইয়ের মনের খবর প্রাণপ্রিয় আপু বুঝতে পারছে না। মুখ খুলাতে পারছে না। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার। অমিত একদিন বলেছিল, সে তার বন্ধুদের মতো না। ব্যক্তিগত কথা ব্যক্তিগত মানুষদের বলে দেওয়া সেই কেউ কেউ এর দলে নেই। সেটাই প্রমাণ করে ছাড়ল।
” আমি ইতালি ফিরে যাচ্ছি। ভোরেই ফ্লাইট। ”
আপুর গলা আদ্র শোনাল। চোখের কোণে কি অশ্রুজল জমেছে? আপু আমার দিক থেকে কোনো কথা না পেয়ে বললেন,
” আমার ভাইটা ভালো নেই, তায়্যিবাহ। এই দূরত্ব কি এবার মেটানো যায় না? ফিরে চলো। ”
আমি আপুর সামনে থেকে সরে এলাম। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললাম,
” সাবধানে যাবেন। ইরফান ভাইয়াকে আমার সালাম দিবেন। ”
আমার অপ্রত্যক্ষ মনোভাব বুঝে ফেললেন আপু। চট করে উঠে দাঁড়ালেন। বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে বললেন,
” তোমার সৌন্দর্য আমার ভাইয়ের কাছে। পা’দুটোকে আর অখুশি করো না। ”
আপু বেরিয়ে যেতেই আমি একদৃষ্টে চেয়ে থাকলাম আমার আলতাহীন বিবর্ণ পাদুটোতে। এত কুৎসিত লাগছে কেন? সত্যিই কি আমার সকল সৌন্দর্য কেড়ে নিয়েছে অমিত? ভাবতে ভাবতে আমার গলা বন্ধ হয়ে আসল। চোখ ঠিকরে জল গড়িয়ে পড়ল। বুকে কাঁপুনি উঠল। সাপ দংশনের মতো জ্বালা শুরু হলো অন্তরে। অভিমানের ভারী পর্দা ছিঁড়ে চাপা স্বরে চিৎকার করলাম। আপনমনে বিড়বিড় করলাম, ‘ মন পড়ানোর জন্য কি সবসময় আপনার সামনে থাকতে হবে? দূর থেকে পড়া যায় না? একবার তো চেষ্টা করুন। পড়ে নিন আমার মনের ভাষা। নাহলে জানবেন কী করে আমি অন্য কারও সাথে নয় আপনার সাথে ফিরে যেতে চাই। আপনার হাত ধরে। কেন আসছেন না? কেন? আপনার আসার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে চারপাশটা দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে। আমি তো বেঁচে থাকার জন্য নিশ্বাসটুকু নিতেও আগ্রহ পাচ্ছি না। ‘
__________
অন্যদিনের মতো আজ খেতে ডাকলেন না আমার মা। বাবাকে খায়িয়ে আমার রুমে আসলেন। আমি তখন আলো নিভিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ আমার পাশে শুয়ে বললেন,
” আমাদের উপর তোর খুব রাগ, তাই না? ”
” বাবার উপর বেশি। ”
মা একটু চুপ থাকলেন। আমার গায়ে দেওয়া কাঁথাটা টেনে নিজের গায়ে নিতে নিতে বললেন,
” তোর বাবার সবচেয়ে অপছন্দ জিনিস কী জানিস? ”
” পান খাওয়া। আর তুমি জেনেও মাঝেমাঝেই খাও। ”
মা বোধ হয় হাসলেন। আবছা অন্ধকারে আমি ঠিকঠাক বুঝতে পারলাম না। একটু সময় পর বলল,
” এই সব থেকে অপছন্দের পানটা কিন্তু তোর বাবাই আমাকে বানিয়ে দেয়। ”
আমি মায়ের দিকে ঘুরে শুলে বলল,
” বিশ্বাস হচ্ছে না তো? আর যদি বলি আমাকে পান বানিয়ে দিয়ে নিজেও একটা পান খান, তাহলে তো দেখি জ্ঞান হারাবি। ”
আমার সত্যি সত্যি জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা হলো। তন্মধ্যে মা বলল,
” আর এই কাজটা করে তোর বাবা শাস্তি গ্রহণ করে। ”
” শাস্তি! ”
” হ্যাঁ, তোদের উপর রাগ করে কিংবা আমার কোনো দোষ পেলে যখন খুব বকে ফেলে। গালি দিয়ে ফেলে তখন এই শাস্তি গ্রহণ করে। তোরা ঘুম থেকে উঠার আগেই দাঁত ব্রাশ করে ফেলে চুপিচুপি। তাই তোরা কখনও টের পাস না। ”
মায়োর বলা কথাগুলো অবিশ্বাস্য ঠেকল আমার কাছে। বিস্ময়ের অতিকে উঠায় আমার ভাষা হারিয়ে গেল। সে সুযোগে মা বলল,
” সেদিন তুই সত্যিই ভুল বুঝেছিস। উনি আমাকে আসলেই মারেনি। আমি রান্নাঘরে কাজ করার সময় উপর থেকে পাতিল এসে পড়েছিল আমার কপালে। ”
” তুমি আবার মিথ্যা বলছ, মা। ”
” একদমই না। তোর বাবা আমাকে বকার সময় তুই দেখেছিলি। তার প্রভাবেই তোর মধ্যে অমন চিন্তা এসেছিল। ভুল বুঝিয়েছিল। ”
আমি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যে পড়ে গেলে মা বললেন,
” তোর বড় আপু শ্বশুরবাড়িতে গায়েগতরে খুব খাটে আমি জানি। শাশুড়ি কিছু বললে জামাইবাবা প্রতিবাদ করে না। চুপচাপ মেনে নেয়। তারমানে এই নয় যে সে তোর আপুকে ভালোবাসে না। যদি তাই হতো তাহলে মায়ের ইচ্ছা অপূর্ণ রেখে বিদেশে যেত না। সে এইটুকু বুঝেছিল ছয়টা বছর একা মায়ের পক্ষে সন্তান লালন-পালন করা কতটা কষ্টের হবে। তাই বউকে কথা শোনার মধ্যে ফেলেই ঐ কষ্ট থেকে দূরে রেখেছে। মায়ের দিক থেকে খাটনি কমাতে না পারলেও নিজ দিক থেকে ঠিকই কমিয়ে দিয়েছে। ”
” এগুলো তোমাকে কে বলেছে? আপু? ”
মা হালকা শব্দে হাসল। বলল,
” মায়েদের সব বলতে হয় না। এমনিই বুঝতে পারে। আমি যদি ভুল হতাম তাহলে তোর আপু ঐ বাড়ি ছেড়ে আসত। আসেনি। স্বামীর ভালোবাসায় আটকে পড়েছে। একেক পুরুষের ভালোবাসা একেক রকম হয়, মা। সবাইকে এক কাঠগড়ায় দাঁড়ালে হবে না। সৃষ্টিকর্তা যেমন ওদের গড়ন আলাদা করেছে তেমন ভালোবাসার ধরনও। ছোট জামাইবাবা রেগে গেলে যেমন গায়ে হাত তুলে তেমন সূর্য ওঠার আগে আমাদের বাড়ি ছুটে আসে। কেন আসে? সে তো চাইলে অন্যত্র বিয়ে করতে পারে। কিন্তু করে না। কারণ, তার ভালোবাসার প্রকাশটাই অমন। ”
” আপু তো বাসে না। ”
মা একটু থমকাল। মুচকি হাসল বোধ হয়। চোখে অন্ধকার সয়ে আসায় মায়ের মুখ আবছা দেখা যাচ্ছে। সে অবস্থায় বলল,
” তাহলে ডিভোর্স দিচ্ছে না কেন? কেস করছে না কেন? সে তো নিজেই উকিল। ”
আপু যে ‘ ল ‘ নিয়ে পড়েছে এ কথাটা যেন আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। সত্যি তো তার যদি এতই সমস্যা হয় তাহলে ক্ষমতার ব্যবহার করছে না কেন?
মা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমিও চোখ বন্ধ করলাম সেই সময় দরজায় টোকা পড়ল। বাবা চেঁচিয়ে বলছে,
” মেয়ের রুমে ঘুমাবে ভালো কথা। মশারীটা তো টাঙিয়ে দিয়ে আসবে? কতগুলো দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ দিয়ে বাড়িটা ভর্তি! ”
আমি হেসে ফেললাম। মাকে ডাকতে গিয়ে থেমে গেলাম। বাবাকে এক নতুন শাস্তি গ্রহণের সুযোগ দিলাম।
___________
রাত তখন শেষ প্রায়। ভোরের দীপ্ত ছড়ানোর পূর্বক্ষণ। আমি নির্ঘুম সময় কাটিয়ে সবে ঘুমে আচ্ছন্ন হচ্ছিলাম তখনই ফোনটা বেজে উঠল। হাতে নিয়ে দেখি বড় আপু কল দিয়েছে। আমি তন্দ্রাঘোরে ধরলাম। আপু বলল,
” অমিত এখন কেমন আছে? ”
” জানি না। ”
” এটা আবার কেমন কথা? ”
” ঘুম পাচ্ছে আপু। ”
আমার অসহায় কণ্ঠে আপুর মায়া লাগল না। বলল,
” হাত নাড়াতে পারে এখন? ”
আমি বিরক্ত নিয়ে বললাম,
” হাতের আবার কী হয়েছে? নাড়াতে পারবে না কেন? ”
” তারমানে পুরোপুরি সুস্থ? কিন্তু ও তো আমাকে কল দিল না। বলেছিলাম কল দিয়ে জানাতে। ”
আমার ঘুম কেটে গেল। কপাল দলা পাকিয়ে বললাম,
” সুস্থ মানে কী? উনি কি অসুস্থ নাকি? ”
আমার চেয়েও দ্বিগুন আশ্চর্য হলো আপু,
“, সে কী! তুই জানিস না? অমিতের না এক্সিডেন্ট হয়েছে? এই তুই ওর সাথে নেই? ”
আমি উত্তর দিতে পারলাম না। এ বাড়ি আসার পর আপুর সাথে কথা হয়নি আমার। মা-বাবাও সহজে কল দেয় না ব্যস্ত থাকে তাই। আপু সুযোগ পেয়ে কল দিলে তবেই কথা হয়। সেক্ষেত্রে তার জানার কথাও না আমি ও বাড়ি ছেড়েছি।
আপুর সাথে প্রশ্ন-উত্তর চালিয়ে জানলাম অমিতের সাথে সপ্তাহখানেক আগে দেখা হয়েছে একটি হাসপাতালে। আপু প্রেগন্যান্সির টেস্ট করতে গিয়েছিল সেখানে। আর অমিত গিয়েছিল হাতের ব্যান্ডেজ পরিবর্তন করতে।
আপুর সাথে কল কাটার পর আমার বুকের ভেতর হাঁসফাঁস শুরু হলো। হাতে-পায়ে বল হারানোর যোগাড়। মনকে শান্ত রাখতে পুরোদস্তুর চেষ্টা করেও বার বার ব্যর্থ হচ্ছিলাম। সে ব্যর্থ মনে বিছানায় শুয়ে পড়লাম হাত-পা জমিয়ে। জোর করে চোখ বন্ধ করে অমিতকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে গিয়ে কল্পনা করে বসলাম হাতে ব্যান্ডেজওয়ালা এক আঘাতপ্রাপ্ত অমিতকে। এরপরও কি চুপচাপ বসে থাকা যায়? বাবা-মাকে না বলেই মাঝরাতে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
___________
শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছেই সূর্যের দেখা মিলল আকাশে। উত্তপ্ত ছড়ানোর আগেই আমি ঘেমে-নেয়ে একাকার। শ্বাস নিচ্ছি হাঁ করে। কাঁপছি থরথরে। কম্পিত হাতে কলিংবেল টিপে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। একহাতে বুকের একপাশে শক্তচাপে উচ্চগতির হৃদ-স্পন্দন থামানোর বৃথা চেষ্টা করছিলাম তখনই দরজা খুলে সশরীরে দরজা আগলে দাঁড়ালেন অমিত। তার দিকে ভালো করে তাকানোর সমসয়টুকুও ব্যয় করলাম না। বুকে ঝাপিয়ে পড়ে অভিমানের ভারি পর্দা ছিন্নভিন্ন করলাম। প্রায় মিনিট সময় পার হওয়ার পর কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
” বাবা-মা দেখছে। ”
আমি একটুও লজ্জা না পেয়ে বললাম,
” বিচ্ছেদ দেখতে পারলে মিলনও দেখতে পারবে। ”
তখনই দূর থেকে শাশুড়ি মায়ের গলার স্বর পেলাম,
” এতবেলা করে মসজিদে গিয়ে কাজ নেই। রুমেই নামাজ পড়বে, চলো। ”
অমিতের বুকের ধুকপুক শুনতে শুনতে দুজোড়া হেঁটে চলা পায়ের শব্দও পেলাম। মাথা তুলে কপট রাগ নিয়ে বললাম,
” আপনার এক্সিডেন্ট হয়েছে, আমাকে জানাননি কেন? ”
এই এতক্ষণ পর অমিতের হাতের বাঁধন পড়ল আমার পিঠে। দুষ্টুভঙ্গিতে বললেন,
” বললে কি এভাবে বুকে এসে পড়তে? তাও আবার শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে? ”
অমিত আমাকে হালকা বাঁধনে রেখে পায়ে পায়ে রুমের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
” কবে হলো? ”
” যেদিন কলঙ্ক লাগালে। তোমার ইচ্ছে পূরণ করতেই মনে হয় এক্সিডেন্টটা হলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় শরীর টুকরো টুকরো হয়নি। ”
” সেজন্যই বুঝি আমাকে আনতে যাননি? ”
” হ্যাঁ। প্রথম দিকে যাওয়ার মতো অবস্থায় ছিলাম না। তাই বাবা-মাকে পাঠাচ্ছিলাম। কিন্তু রাগিসাহেবার মন গলাতে পারল না কেউ। ”
” এতই যদি ফিরিয়ে আনার ইচ্ছে সেদিন ফেলে এলেন কেন? ” তখন তো বুঝতে পারিনি আমি ভুল ছিলাম। ”
” কেমন ভুল? ”
অমিত আমাকে বিছানায় বসিয়ে বললেন,
” আমি ভেবেছিলাম আগে বিশ্বাস অর্জন করব তারপর ভালোবাসা। আমার এই ভাবনাটা ভুল ছিল। বিশ্বাস থেকে ভালোবাসা নয়, ভালোবাসা থেকে বিশ্বাস তৈরি হয়। যখন বুঝতে পারলাম তখন আমি রক্তাক্ত হয়ে রাস্তায় পড়ে আছি। ”
অমিতের মুখে রক্তের কথা শুনে আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম। বসা অবস্থায় অমিতকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলাম। কান্নাপ্রায় গলায় বললাম,
” ভালোবাসা এত নিখাঁদ হলে হয়? একটু জোর থাকা লাগে। একটু শাসনও। আপনি যদি একটু শাসন করতেন, জোর দেখাতেন তাহলে এতগুলো দিন আমরা আলাদা থাকতাম না। ”
” আমি হয়তো অমন খাঁদযুক্ত ভালোবাসা বাসতে পারি না। আমার ভালোবাসা এমন নিখাঁদই। ”
আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। সব পুরুষের ভালোবাসা এক নয়। সৃষ্টিকর্তা যেমন আলাদা গড়ন দিয়েছেন তেমন আলাদা ভালোবাসার ধরনও। অমিত যে সবার থেকে আলাদা এই কথাটা বিশ্বাস করিয়েই ছাড়ল!
__________
অমিতের হাতের ব্যান্ডেজ খুলে আনলেও নাড়াচাড়া করতে একটু অসুবিধা হয়। সাবধানে না থাকতে বলা হলেও সে সাবধানে থাকতে ভুলে যায়। আর ব্যথায় চোখ-মুখ খিঁচে নেয়। আমি তাকালে হাসার চেষ্টা করলেও আমি বুঝে ফেলি। রাগ চোখে কতগুলো কথা শুনিয়ে দিই। আজও তেমন হলো। বালিশ টেনে ঠিক করতে গিয়ে ব্যথায় চোখ-মুখ খিঁচে থাকলে আমি চোখ-মুখ শক্ত করে তাকিয়ে থেকে বালিশ ঠিক করে দিলাম। সে শুয়ে পড়লে আমিও পাশে শুয়ে পড়লাম। অমিত ঘুমিয়ে পড়লেও আমার ঘুম আসছিল না। অনেক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে উঠে বসলাম। অমিতের আপুর দেওয়া সে লাল শাড়ি পরে নিলাম চট করে। আলতা নিয়ে অমিতকে ডাকলাম ধীরে ধীরে। কোনো বিপদ হয়েছে এমন ভাবনায় ভয়ে উঠে বসলেন চটপটে। আমাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে অবাক হলেন। অমিতের কাছে ফিরে আসার পর শাড়ি পরিনি একদিনও। আজই পরলাম। তিনি বিস্ময়ে কিছু বলতে চাইলে আমি আলতা বাড়িয়ে বললাম,
” পরিয়ে দিন। ”
অমিত আলতার কৌটো হাতে নিলে আমি পা তুলে বসলাম খাটে। অমিত বেশ উৎসাহ নিয়ে আলতা পরাতে গিয়ে পারছিল না। ডানহাতে ব্যথা থাকায় বামহাতে পরাচ্ছিল তাই। বাম হাত থেকে ডানহাতে নিতে গেলে আমি বাঁধা দিলাম। তার হাত চেপে ধরে পায়ে আলতা রাঙাচ্ছিলাম। অমিতের মনোযোগ আমার পায়ে নেই। দৃষ্টি গভীর হয়েছে আমার মুখটায়। তার সেই মুগ্ধতায় নেশা ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হলো আমার। তার নয়নে নয়ন রেখে বললাম,
” আপনার প্রিয় আলতা রাঙা-পায়ে চুমু খাবেন না? ”
অমিতের দৃষ্টি একটুও কাঁপল না। আমার চোখে চু্ম্বকের মতো আটকে রেখে ঠোঁট ছুঁয়াল আমার পায়ে। তার প্রথম উষ্ম ছোঁয়ায় আমি লজ্জা পেলাম। কিশোরী মেয়েদের মতো নীরব কম্পনে ছটফট করলাম! লাল হলো কপোল। বন্ধ হলো চোখজোড়া। খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো, ‘ ভালোবাসার মানুষের প্রথম ছোঁয়ায় প্রতিটি মেয়েই কিশোরী মেয়েদের মতো লজ্জায় উন্মাদ হয়। তার জন্য বয়স কোনো বিষয় না। প্রেমিক-প্রেমিকারও কোনো ব্যাপার থাকে না। শুধু ভালোবাসার মতো শ্রেষ্ঠ অনুভূতির প্রয়োজন। ‘ পর মুহূর্তেই মনে পড়ল অমিত তো আমার মন পড়ুয়া মানুষ। ঠোঁট কাঁপিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। তারচেয়ে নাহয় আজ লজ্জায় কাঁপুক!
#সমাপ্তি