আলো আঁধার,part_(12+13)
writer_Tahsina_Islam_Orsha.
এক টুকরো কাগজ যে হৃদয়ের স্পন্দন বন্ধ করে দিতে সক্ষম এই কথা শুধু সেই জানে যে ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে এমন এক টুকরো কাগজ পেয়েছে।
পৃথিবীর সকল আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেছে এই মুহুর্তে শুধু তুমুল শব্দে আওয়াজ হচ্ছে আলোর বুকের অদম্য ধুকধুক। আর কোথাও কোন শব্দ নেই আলোর মনে হচ্ছে।
আলো চিঠি খুলবে নাকি খুলবে না বুঝতে পারছে না। হাত কেন যেন কাঁপছে ৷ ভিতরে ভয় কাজ করছে। কি থাকতে পারে চিঠিতে?এমন কিছু যেটা আলো চায় নাকি এমন কিছু যেটা আলো দেখতে চায় না। আলো চিঠিটা নিয়ে বেশখানিকক্ষণ বসে রইলো। আস্তে আস্তে চিঠির ভাজ খুলতে যাবে তখনি দরজায় রাইসার আম্মু নক করলো।
আলো চিঠিটা লুকানোর জন্য দ্রুত হাতের মুঠোয় বন্দি করে ফেললো যাতে উনার চোখে না পড়ে।
রাইসার আম্মু রুমে ঢুকে
‘ মা এখনো ফ্রেশ হওনি? সবাই তোমার জন্য ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছে আঁধারও বসে আছে ফ্রেশ হয়ে তারাতাড়ি চলে আসো। নাহয় সবাই আবার চলে আসবে তোমায় নিতে।
আলো হাসির রেখা টেনে
‘ হুম আন্টি এখনি আসছি। সবার আসতে হবে না।
আলো হাতের মুঠো থেকে চিঠিটা লুকিয়ে বিছানার চাদরের নিচে রেখে রাইসার আম্মুর সামনেই ফ্রেশ হতে যায়।
আলো ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে রাইসার আম্মু নেই। আলো ড্রয়িংরুমে যাওয়ার জন্য দরজার কাছে যেতেই চিঠিটার কথা মনে পড়ে আবার দরজা লাগিয়ে চিঠিটা নিয়ে বসে। কাঁপা হাতে চিঠি খুলে ছলছল চোখে চিঠির দিকে তাকায়
খুব বেশি লিখা নেই গুটিকয়েক কথা লেখা। আলো খুব উৎসাহ নিয়ে লেখাগুলো পড়ে
” অনুভূতি থাকা অন্যায় নয়, অন্যায় নিজেকে আটকে রেখে অনুভুতি প্রকাশ না করে নিজেকে কষ্ট দেওয়া “।
এর বেশি আর কিছু লেখা নেই দেখে আলোর মনটা খারাপ হয়ে যায়। আবার তৎক্ষনাৎ আঁধারের কথা ভাবতেই আলো চমকে উঠে। তাহলে কি আঁধার তার অনুভূতি প্রকাশ করতে চায়? তবে কি আঁধার ভালোবাসতে পেরেছে আলোকে? আলোর অজানা কারনে ভীষণ রকমের আনন্দ হচ্ছে বার বার চিঠিটা উল্টেপালটে দেখছে। জীবন সত্যিই সুন্দর মনে হয় যখন ভালোবাসার মানুষটি ভালোবেসে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে নেয়।
আলো চিঠিটা আরেকদফা পড়তে যাবে তখনি দরজায় খটাখট আওয়াজ হতেই চিঠিটা বালিশের নিচে রেখে দরজা খুলে দেয়। দরজার ওপাশে রাইসা ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে।
আলো রাইসাকে দেখে কিছু হয়নি টাইপ একটা হাসি দিয়ে বেডে গিয়ে বসতে নিতেই রাইসা পিছন থেকে
‘ আজকে কি এই রুমে নিজেকে বন্দি রাখার চিন্তা ভাবনা করছো? নাকি শরীর খারাপ লাগছে কোনটা? অনেকক্ষণ যাবত সবাই বসে আছি তোমার জন্য কিন্তু তোমার কোন খবর নেই কেন?
আলো মাথাটা টেনে রাইসার মুখের দিকে তাকিয়ে ইয়ায়ায়া বড় একটা হাসি ফেরত দেয়। আলো হাসি দেখে রাইসা আবার ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে
‘ কি ব্যপার হঠাৎ এতো খুশি খুশি লাগছে কেন? আঁধার ভাইয়া কিছু বলেছে নাকি আমাদের এই খানে এসে ভালো লাগছে কোনটা?
আলো চুপ করে রাইসার উত্তেজনা দেখছে সে উত্তেজিত হয়ে আছে আলোর জবাব জানার জন্য । রাইসা আলোকে চুপ থাকতে দেখে
‘ তাহলে কি আমি চাচি হতে যাচ্ছি?? মানে কেউ এমন মিট মিটে খুশি তখন হয় যখন প্রেগন্যান্ট হয়। ( দুষ্টু হাসি দিয়ে)
আলো চোখ বড় বড় করে
‘ ধুর তুমি বেশি ফাজলামো করো। চলো এখন সবাই না অপেক্ষা করছে! আন্টি এসে একবার ডেকে গিয়েছে আমায়। পরে আবার কিনা কি ভাবে।
রাইসা আর কোন কথা না বাড়িয়ে আলোকে হাতে ধরে নিয়ে যায় ড্রয়িংরুমে। আঁধার, ফায়েজ, রাইসার দু’বোন বসে আছে। ওদের পাশেই আরেকজনের চেহারায় চোখ আটকে যায় আলোর। আলো ভীতি চোখে তাকায় সেই চেহারায়। হ্যা আলো মনে হয় ঘামছে। অস্থির হয়ে যাচ্ছে সে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জায়গা করে নিয়েছে আলোর ছোট্ট কপালে।
আলো মনে একটাই প্রশ্ন চলছে সানি এই খানে কি করছে। সানির তো এই খানে থাকার কথা নয়। আলোর ঘাম বাড়ছে। সে কি রুমে চলে যাবে আবার? কিন্তু রুমে চলে গেলে সবাই কি ভাববে?
এইদিকে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে আঁধার, আলো এমন করছে কেন বুঝতে চেষ্টা করছে সে। আঁধার বুঝতে পারছে আলো ভয় পাচ্ছে কিছুতে কিন্তু ভয় পাচ্ছে কেন বুঝতে পারছে না। এই খানে তো ভয় পাওয়ার মতো কিছু দেখছেনা সে। হ্যা আলো আঁধারে ভয় পায়। মানে অন্ধকার রুমে বা অন্ধকারে সে ভয় পায়।কিন্তু এখন তো চারদিকেই আলো ঝলমল করছে কিন্তু এমন অস্থির হয়ে আছে কেন সে?
আলোকে টেনে আঁধারের কাছে বসায় রাইসা। তারপর রাইসা সবার জন্য নাস্তা নিয়ে এসে ফায়েজের সাথে বসে। সবাই নাস্তা খাওয়া শুরু করে । সানি বার বার আলোর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিলো আর আলো সেটা বুঝতে পারছিলো। একবার বিষম খেলে রাইসা উঠে পানি খাওয়ায় আলোকে।
খাওয়া শেষে আলো উঠে চলে যেতে নিলে রাইসার দু’বোন আবার আলোকে বসায় ওদের সাথে গল্প করার জন্য । রাইসার ছোট ভাই ওর গিটারটা এনে ফায়েজের হাতে ধরিয়ে দেয় বাজানোর জন্য। ফায়েজ গিটার তেমন বাজাতে পারে না তাই আঁধারের হাতে দিয়ে দেয় কারন আঁধার খুব ভালো গিটার বাজাতে পারে।
সবাই মিলে সিধান্ত নেয় ছাদে গিয়ে গিটার বাজানো শুনবে আঁধারের। তাই ছাদে বসার আয়োজন করে রাইসার দু’বোন আর রাইসা। আলোর সব কিছুই কেন যেন এখন বিরক্ত লাগছে তাই রুমে চলে যেতে চাইলে সবাই আটকায়। আলো এর আগে অনেকবার শুনেছে আঁধারের গিটারের সুর। কখনো করুণ,কখনো বেদনার, কখনো খুশির কখনো হারানোর।এই সুরে অনেক বার হারিয়েছে আলো । আঁধার অনেক বার শেখাতে চেয়েছিলো আলোকে তবে আলো শিখতে পারেনি।
অনেকক্ষণ ধরে সবাই আঁধারের গিটারের সুর শুনছে আলো চোখ বন্ধ করে আছে সেই সুরে। সানির জন্য ভয় এতক্ষণে কেটে গেছে আলোর।
আচমকা রাইসা বলে উঠলো
‘ ভাইয়া সুরের সাথে গান গাওয়া প্রয়োজন গানও করেন। আর কত বেদনার সুর শুনবো কান্না করাতে চান নাকি আমাদের। এখন গান গেয়ে শোনান সুরের সাথে।
কিন্তু আঁধার গান করবে না আগেই বলে দিয়েছে। তাই সবাই আলোর দিকে তাকালো। আলো অনেক সুন্দর গান করে সবাই জানে। আঁধারও ভালো গান করে তবে এখন সে গাইবে না মানে গাইবেই না।
সবার কথায় আলো রাজি হয় ঠিকি কিন্তু সে বলেছে গিটারের সুরে সে গাইবে না খালি গলায় গাইবে। তাই আঁধারও গিটার রেখে দেয়।
আলো চোখ বন্ধ করে গান ধরে তার নরম সুরে
কেউ কোনদিন আমারে তো
কেউ কোনদিন আমারে তো
কথা দিল না, কথা দিলো না।
বিনিসুতার মালাখানি,
বিনিসুতার মালাখানি
গাঁথা হইলো না, গাঁথা হইলো না।
ও… এই জ্বালা যে এমন জ্বালা যায় না মুখে বলা
বুঝতে গেলে সোনার অঙ্গ (তোমার)
বুঝতে গেলে সোনার অঙ্গ
পুড়ে হবে কালা
ও… লালন মরল জল পিপাসায় থাকতে নদী মেঘনা
হাতের কাছে ভরা কলস
(আমার)
হাতের কাছে ভরা কলস তৃষ্ণা মেটে না।।
কেউ কোনদিন আমারে তো
কেউ কোনদিন আমারে তো
কথা দিল না, কথা দিলো না।
ও… ভালোবাসার অপরাধে হয়েছিল দোষী
তাই বলে কি থেমেছিল (বলো)
তাই বলে কি থেমেছিল
কদমতলার বাঁশী
ও… দংশিলে পিরিতের বিষে ওঝা মেলে নারে
এই মরণ যে সুখের মরণ দেখলাম জনম ভরে।।
কেউ কোনদিন আমারে তো
কেউ কোনদিন আমারে তো
কথা দিল না, কথা দিলো না।
গান শেষ হতেই আঁধার লক্ষ করলো তার চোখে পানি। কিন্তু পানি কেন এসেছে ওর চোখে? গান শোনে? নাকি আলোর মুখে শুনেছে বলে এই গান? এই গান তো আঁধার বহু বার অনেক আগে শুনেছে কিন্তু তার ভালো লাগতো না আগের গান বলে। বদলিয়ে দিতো সামনে আসলেই তবে এখন কেন? কেন এখন ভিতরে তীর বিধার মতো গিয়ে বিধেছে?
সবাই চুপ হয়ে আছে আলোর গান শোনে। সবাই জানে আলো কেন এই গান গেয়েছে।আলো চোখ খুলে দেখে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আলোর দিকে সবাই । সবাই কি ভাবছে আলো বেশ ভালোই বুঝতে পারছে। তাই আলো কিছু না বলে চলে আসে নিচে।
নিজেকে নিজে ইচ্ছে মতো ঝাড়ছে আলো। কি দরকার ছিলো এখন এমন একটা গান গাওয়ার। এমনিতেই আগের গান তাও আবার এমন কষ্টের সবার মুডটা খারাপ করে দিয়েছে ও। আঁধার না জানি কি ভাবছে সেই চিন্তায় আধমরা হয়ে যাচ্ছে এখন। সবাই এখনকার সময়ের আধুনিক গান বেশি পছন্দ করে এই গান গাওয়াতে হয়তো আলোকে অনেক পুরানা ভাবছে সকলে।
আলো এখন লজ্জা পাচ্ছে। ইশশ কেন যে বলতে গেলাম ইচ্ছে হচ্ছে নিজের মাথায় নিজেই হাতুড়ি মারি ( মনে মনে)
আলো টুপ করে ঘরের ভিতরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। আপাতত লুকিয়ে থাকায় শ্রেয় মনে করছে সে। বার বার এমন সব কান্ড করে ফেলে যাতে পরে আর মানুষকে মুখ দেখাতে পারেনা। আলোর হঠাৎ করে সানির কথা মনে পড়ে সানি এই খানে কি করছে? সানির কথা ভাবতেই আবার আঁধারের কথা মনে হয় আলোর, আঁধার যদি সানির কথা জানতে পারে তাহলে আঁধার কেমন রিয়েক্ট করবে বুঝতে পারছে না আলো । তার জন্যই আলো আরে বেশি ভয় পাচ্ছে।
দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছে দেখে আলো ভয় পেয়ে যায়। সানি আসেনি তো? যদি সবার সামনে সানি কোন কথা তুলে তখন কি হবে? ফ্যানের বাতাসেও যেন আলোর ঘাম মুছে দিতে পারছে না।
আবার দরজায় খটাখটের আওয়াজে আলো দরজা খুলতে যায় কাঁপা হাতে।
দরজা খুলে আলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আঁধারকে দেখে। এই মুখ কেন সব সময় সামনে থাকে না বুঝতে পারে না আলো । কি ক্ষতি হবে এমন করে সব সময় সামনে থাকলে?
গানের কথা মনে হতেই আলো নিজেই নিজের মুখ লুকিয়ে ফেলে। আঁধার বুঝতে পেরে আলোকে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে কাপড় বের করে চেঞ্জ করার জন্য । ওয়াশরুমে যেতে যেত আঁধার আলোকে বলে
‘ খুব ভালো ছিলো গানটা।
বলেই দরজা লাগিয়ে দেয় ওয়াশরুমের।
আলো নিচে তাকিয়ে নিজের এক হাত দিয়ে আরেক হাতের আঙুল ঘসছিলো, আঁধারের মুখে এই কথা শোনে তাকাতে তাকাতে আঁধার দরজা লাগিয়ে দেয়। আলো চোখ মুখ বন্ধ করে নিয়ে ভাবছে আঁধার তো এসব গান পছন্দ করেনা। এখন দুটো কথা শোনানোর কথা ছিলো এমন পুরোনো গান আর কত শোনো আর গাও কিন্তু তা না বলে আঁধার প্রশংসা করেছে বিশ্বাস হচ্ছে না আলোর।
রাতের খাওয়া- দাওয়া শেষ করে সবাই সবার মতো ব্যস্ত। আঁধার রুমেই ছিলো হঠাৎ কোথায় গেলো আলো বুঝতে পারছে না। রাইসার কাছে যাওয়ার জন্য আলো বের হতে নিলেই দেখে একটা চিরকুট পড়ে আছে দরজার সামনে।
আলো এদিক সেদিক তাকিয়ে হাতে নেয় চিরকুটটা। কে রেখেছে এটা নাকি ফেলে গিয়েছে বুঝে উঠতে পারছে না। আঁধার? আঁধার কোথায় গিয়েছে? সে রেখে যায়নি তো আবার? আলো ভিতরে গিয়ে বেডে বসে আবার চিরকুটটা খোলে, দেখার জন্য কি আছে এতে। নীল কালি দিয়ে অনেক সুন্দর করে শুধু তিনটি লাইন লেখা
” তোমার সরলতায় আমি মুগ্ধ
ছাদে এসো চাঁদকে তোমার সাথে
দেখা করিয়ে আজ করবো দগ্ধ। ”
আলো মুচকি হাসে। আঁধার কি তবে মেনে নেবে আলোকে? আলোর প্রতিক্ষা কি তাহলে শেষ হতে যাচ্ছে? আগের চিঠিতে তো এমনি কিছু লেখা ছিলো। আঁধারের অনুভূতি কি তবে আলোকে জায়গা দেবে? আলো পা বাড়ায়, ছাদে যেতে উদ্যত হলো ওড়না নিয়ে।
তবে শেষ হোক সকল অপেক্ষা, ভেঙে যাক দু’মনের দেয়াল। ভালোবাসি ভালোবাসি বলে প্রতিধ্বনি তুলুক দূর আকাশের উজ্জীবিত চাঁদ…….
চলবে……..
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।