#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-১৬+১৭]
‘কি যেন নাম বললি? লা-মি-য়া…!’
নামটা সুরালো কন্ঠে টান দিয়ে বললো নুরা। দীবা একটু আগে ক্যান্টিনে বসে লামিয়ার সম্পর্কে আবরারের বলা কথা গুলো বলেছে। সম্পূর্ণ কথা শুনে ভাবুক হলো দুজন। রিমি চিন্তিত কন্ঠে বললো, ‘কিন্তু এই নাম কখনো ভাইয়ার কাছে শুনি নি।’
দীবা গালে দুই হাত বসে আছে। চেহারা তার বিবর্ণ। রাগে শরির রিরি করছে। রিমির কথার প্রতিত্তুরে বলে উঠলো, ‘তোমার ভাই প্রেম করে সেটাকে ঢাক ঢোল পাঠিয়ে বলবে? আশ্চর্য!’
নুরা মাথা ঝাকিয়ে বললো, ‘তাও ঠিক। কিন্তু মেয়েটা কে? আর বড়ো কথা হলো মেয়েটা দেখতে কেমন?’
শেষের কথাটা কিছুটা উৎসাহিত হয়ে বললো নুরা। রাগে দীবার গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। বিড়বিড় করে বললো, ‘নিশ্চয় শাঁকচুন্নির মতো দেখতে হবে।’
কথাটা কর্ণগোচর হলো রিমির। দীবার জেলাসি দেখে হাল্কা গলা ঝেড়ে মুচকি হেসে নড়েচড়ে বসলো। দীবাকে কুনই দিয়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ভ্রুঁ নাচালো। দীবা বিরক্তিবোধ করে মুখ দিয়ে ‘চ’ জাতিয় উচ্চারণ করলো একবার। ক্যান্টিনে বসে আছে তিনজন। চারপাশে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। কলাহলপূর্ণ পুরো আগ্রাবাদ কলেজ। নুরা পেপসি তে চুমুক দিয়ে বললো, ‘আই থিংক লামিয়া আরব ভাইয়ার গফ হতে পারে।’
তাৎক্ষনাৎ রিমি ধমকে উঠলো, ‘পাগল তুই? ভাইয়ার কোনো গফ টফ নাই।’
নুরা ফাজলামোর স্বরে বললো, ‘গফ না হলে কি লামিয়া কে নিয়ে ড্রাইভে যাবে? ডিটেইলসে বুঝাতে হবে তোমাকে?’
ক্ষুন্ন হলো দীবার মন। ক্রোধ তার তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। দাঁতে দাঁত পিষে নুরার দিকে কটমট চোখে তাকালো। দীবার এমন চাহনীতে ভরকে গেলো নুরা। আড় চোখে দীবার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত ভাবে বললো, ‘এভাবে ডাইনীর মতো তাকাবি না। আমার হার্ট বেচারা ভয় পায়।’
রাগ বহিঃপ্রকাশ করতে দীবা টেবিলের সামনে থাকা পানির বোতলে তুলে শব্দ করে টেবিলে রাখলো। রাগান্বিত কন্ঠে হাল্কা আওয়াজে চেঁচিয়ে বললো, ‘লামিয়া সামিয়া জামিয়া যেই হোক। তাতে আমার কি? যার সাথে ইচ্ছে নাচুক, ঘুরুক, মরুক। আমার কিছু না।’
রিমি নাকের কাছে অনামিকা আঙুল এনে বাতাসের গন্ধ শুঁকে বললো, ‘কোথাও একটা পুড়া পুড়া গন্ধ পাচ্ছি নুরা। তুইও কি পাচ্ছিস?’
নুরাও রিমির সাথে তালে তাল মিলিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ পুড়ছে পুড়ছে। কোথাও কাঠ পাতা কাগজ পুড়ছে। কোথাও কারোর হৃদয় পুড়ছে।’
দীবা নুরার বাহুতে চিমটি কাটলো। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে উঠলো, ‘অতিরিক্ত কথা না বললে হয় না তোদের?’
রিমি আফসোস সহিত কন্ঠে বললো, ‘আজকালকার দিকে তো আবার সত্যি কথার ভাত নেই। ব্যাপার না।’
হতাশ হলো দীবা। বিষন্ন মনে সামনে থাকা স্নেকের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকালো। ভালো লাগছে না তার। বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেন আবরার তো তার স্বামী। প্রথমে মন না মানলেও পরোক্ষনে আবরার কে নিয়ে সে ভেবেছে। মনের সুপ্ত কোণে অনুভূতি নামক জিনিসটার জায়গা দিয়েছে। আবরারের জন্য এই কয়েকদিনে সফট কর্ণার তৈরি হয়েছে তার। কিন্তু এই লামিয়া কে? উনার গফ? এইজন্যই কি তাহলে বিয়েটা মানে নি তখন? তবে তার অনুভূতি গুলো ফিকে হয়ে গেলো? বিষন্নতায় ভার হয়ে এলো দীবার মন। নিস্থব্ধতায় ধুকধুকানি শুরু হলো বুকে। ঠোঁট কামড়ে আশেপাশে তাকালো। তীব্র গতিতে তোলপাড় ঝড় ভয়ছে মনে। কান্না গুলো গলায় দলা পাকিয়ে এলো তার। হঠাৎ-ই দীবাকে এভাবে চুপ হয়ে যেতে দেখে আড়ষ্ট হলো রিমি ও নুরা। দীবার ক্ষুন্ন মনের কারণ জানে তারা। এবার একটু সিরিয়াস হলো দুজন। রিমি দীবার কাধে এক হাত রেখ্র চোখের ইশারায় আশ্বাস দিলো এমন কিছুই হবে না। প্রতিত্তুরে দীবা স্মিতি হাসলেও মনকে মানাতে পারছে না। অস্থিরতায় নিয়েই নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো।
____________________
তিমিরাচ্ছন্ন পরিবেশ গোমট বেধে আছে। অম্বরে কালো কাদম্বরীর আনাগোনা। শীতল হাওয়ায় বৃক্ষপত্র নড়বড়ে। বিশাল বারান্দার দরজার সামনে ঝুলানো সাদা পর্দা গুলো বাতাসের তালে তাল মিলিয়ে উড়ছে। কক্ষে থাকা কাঙ্ক্ষিত এসি অফ করে বারান্দার দরজা, জানালা খোলে বিছানায় আসন পেতে বসে আছে অভ্র। বাহির থেকে ভেসে আসা শীতল হাওয়ায় তার সিল্কি চুল উড়ছে। পরনে তার সাদা শার্ট যার হাতা কুনই পর্যন্ত গোটানো। ক্লিন সেভ করা গালে ডান হাতের তর্জুনী দিয়ে চুলকে ল্যাপটপের স্কিনের দিকে তাকিয়ে আছে। কপালে তার সূক্ষ্ম ভাজ বিদ্যমান। ল্যাপটপের সাদা কি-বোর্ডে আঙুল চালানোর সময় তার কান সজাগ হয় দরজা খোলার আওয়াজে। বিচলিত না হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজায় দৃষ্টি মেলে তাকালো। আগন্তুক ব্যক্তিটিকে দেখে প্রসন্ন হেসে বললো, ‘আসেন স্যার। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’
আবরার স্বাভাবিক মুখভঙ্গিতে এগিয়ে অভ্রের সামনে বসলো। মৃদু হেসে বললো, ‘কেন? কোনো জরুরী কাজে?’
‘তেমন কিছু না। একটা আর্টিকেল তৈরি করছিলাম।’
আবরার ব্যস্ততার সাথে ঘাড় বাকিয়ে ডান থেকে বামে কাত করলো। তারপর বললো, ‘এখানে আসার পর থেকে তোমার তেমন খেয়াল করতে পারি নি। আসলে অনেক দিন পর বাড়িতে এসেছি তো..’
প্রতি উত্তরে নিশব্দে হাসলো অভ্র। আবরারকে থামিয়ে সন্তুষ্টিসাধক কন্ঠস্বরে বললো, ‘ব্যাপার না ভাই। আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আপনার পরিবারের সবাই মাশাআল্লাহ অনেক ভালো। আমাকে তো নিজের ছেলের মতোই আদর যত্নে রেখেছে। সত্যি বল্পতে স্যার, আমার তো এখন মনে হচ্ছে এখানে আরো আগে আসা উচিত ছিলো আমার।’
সুপ্রসন্ন হলো আবরারের মন। মুখের হাসি ধরে রেখে শুধাল, ‘এটাকে নিজের বাড়ি ভাবতে পারো। কোনো সমস্যা হলে আমাকে অবশ্যই জানাবে।’
অভ্র সম্মতি সহকারে মাথা দুলালো। অতঃপর অফিসিয়ালি ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে লাগলো দুজন। অভ্র তার তৈরি করা আর্টিকেল আবরারের দিকে এগিয়ে দিলো। আবরার ব্যস্তভঙিতে সব কিছু রি-চেক করতে লাগলো। খুবই মনোযোগ সহকারে প্রখর করে কি-বোর্ডে নিজের আঙ্গুল চালাচ্ছে আবরার। পরনে থাকা কালো টি-শার্ট বাহিরের হাওয়ায় নড়ছে তার। কিছুসময় পর আকাশের কালো মেঘ বর্ষণ রূপে আচঁড়ে পরলো ধরনীতে। অম্বর থেকে তীব্র আওয়াজে বর্জ্রপাতের ধ্বনি ভেসে আসছে। কম্পিত হতে থাকে পরিবেশ। তখন বাহির থেকে বর্জপাতের সাথে সাথে বাড়ির মেয়েদের চিৎকারের শব্দও কানে আসলো দুজনের। যান্ত্রিক বস্তুতে ব্যস্ততার সাথে চালিত আঙুল তাৎক্ষনাৎ থেমে গেলো আবরারের। অভ্র তার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। মেয়েরা এভাবে চেঁচাচ্ছে কেন? হঠাৎ কি হলো? অতঃপর দুজন বিচলিত হয়ে ঘটনা জানতে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো দ্রুত পায়ে। রেলিংয়ের কাছাকাছি এসে বাড়ির সামনের বাগানের দৃশ্যপট দেখে অবাক হওয়ার পাশাপাশি মুগ্ধ হলো আবরার অভ্র দুজনই। দীবা, রিমি ও নুরা তিনজন হাতে হাত রেখে বৃষ্টিবিলাশ করছে। আনন্দের সাথে খিলখিল করছে হাসছে তিনজন। বর্জ্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠছে তারা। কলেজ থেকে যে মাত্রই ফিরেছে সেটা তাদের পরনের ইউনিফর্মই জানান দিচ্ছে। অভ্র ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েদের চি’ৎকারের আওয়াজের প্রতিযোগিতা হলে সেখানে এই মেয়ে তিনজনই সেরা হবে ভেবে নিলো সে। নির্ধিদায় এদের অস্কার দেওয়া উচিত। এদের চিৎকার বর্জপাতের চেয়েও কঠিন শব্দ যা মানতে বাধ্য হলো অভ্র। কপালে সূক্ষ্ম বিরক্তির ভাজ ফেলে আবরারের দিকে তাকালো। বৃষ্টির ছিটেফোঁটা এসে দুজনকে ভিজিয়ে দিয়েছে প্রায়। আবরারকে দীবার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হাসতে দেখে অভ্রও নিশব্দে হাসলো। সে নিজেও মন থেকে চায় আবরার যেনো এই সম্পর্ক টা মেনে নেয়। তখন নিশিতা ও রোহানার চেঁ’চা’নোর শব্দে নিচে তাকালো অভ্র। নিশিতা ও রোহানা দুজন ছাতা নিয়ে মেয়ে তিনজনকে আচ্ছা মতো বকাঝকা শুনাচ্ছে। কান মলাই দিয়ে তিনজন কে বাড়িতে নিয়ে গেলো তারা। মায়েদের শাসন, আদর ও ভালোবাসা বুঝি এমনি হয়? হয়তো বা! তপ্ত শ্বাস ফেলে রুমে চলে আসলো অভ্র। গায়ের শার্ট হাত দিয়ে ঝেড়ে পানি সরালো। তারপর ল্যাপটপের সামনে বসে আর্টিকেল টা বের করলো। তখুনি চুল ঝাড়তে ঝাড়তে আবরার রুমে আসলো। বললো, ‘ওদের চেঁ*চানো শুনে ভয় পেয়েছিলাম আমি।’
অভ্র ভাবলেশহীন ভাবে বলল, ‘নিঃসন্দেহে ওদের অস্কার দেওয়া যাবে।’ হেসে উঠলো দুজন। আবরার এগিয়ে অভ্রের সামনে বসে আর্টিকেল গুলো দেখতে লাগলো। অফিসিয়াল আলাপে ব্যস্ত হলো দুজন।
____________________
ফায়ারপ্লেসের সামনে তিনজন জড়সড় হয়ে বসে আছে। দুই হাত একত্রে তালুতে তালু ঘর্ষণের মাধ্যমে তাপ তৈরি করে হাত দুটো গালে লাগাচ্ছে। বিকেলের দিকে বৃষ্টিতে ভিজার কারণে তাদের শরিরের তাপমাত্রা শীতল। বৃষ্টির পানি টাও ছিলো ঠান্ডা। তাই এখন শীত লাগছে তাদের। এই অসহনীয় শীত থেকে বাঁচতে গায়ে পাতলা শাল পেঁচিয়ে বসে আছে ফায়ারপ্লেসের সামনে। নুরা কাঁপাকাঁপা থুতনি প্রসারিত করে বললো, ‘ভাইরে ভাই এইগুলা কি? একটুই তো ভিজলাম তাই এতো শীত লাগার কি আছে?’
রিমি সোফায় হেলান থাকা অবস্থাতেই বললো, ‘আরে অসময়ের বৃষ্টি তাই।’
রিমিকে থামিয়ে নুরা কথা পিঠে বলে উঠলো, ‘আজাইরা মার্কা কথা কই পাস তুই? বর্ষাকালে অসময়ের বৃষ্টি পাবি কোথায় থেকে?’
নিজের বোকা বোকা কথাতে নিজেই আহাম্মক হলো রিমি। হেসে উঠলো সে। সাথে হাসলো দীবাও। কমলা তাদের তিন জনের জন্য কফি নিয়ে এলো। কফির কাপ এগিয়ে দিয়ে শুধাল, ‘বিস্টিত কিল্লাই বিজন ফরেদ্দে? এহন জ্বর উডিলে ক্যান গরিবিদি?’ (বৃষ্টিতে ভিজার কি দরকার ছিলো? এখন যদি জ্বর উঠে?)
দীবা সোফাতে হেলান অবস্থা ছেঁড়ে সোজা হয়ে বসলো। কফিতে চুমুক দিয়ে উত্তর দিলো, ‘কিছু হবে না দাদি।’
কমলা অসন্তুষ্টির সাথে চেহারার অবস্থা বিবর্ণ করে বললো, ‘আইচ্যে সাইয়্যুম, জ্বর উডিলে তোরার গরত্তুন বাইর অম বন্ধ।’ (আচ্ছা দেখবো। জ্বর উঠলে তোমাদের ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ।)
রিমি নুরা উচ্চ হাসিতে মেতে উঠে কমলার কথায়। কমলাকে তারা সবাই সম্মান করে। কমলার স্বামী এই বাড়ির কাজেই নিয়োজিত ছিলো। সদ্য বিবাহিত জীবনের মাত্র কয়েক মাস পেরুলেই তার স্বামী যক্ষা রুগে মা*রা যায়। কমলা এতিম ছিলো তাই স্বামী বাড়িতে তার জায়গা হয়নি। তখন আবরারের দাদা তাকে এই বাড়িতে আশ্রয় দেয়েছিলো। তখন থেকেই কমলা এই বাড়ি কে তার নিজের বাড়ি মনে করে আগলে রেখেছে। নিজের কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে বাড়ির সন্তান দের। যেমন আদর যত্ন করেছে ঠিক তেমনি বাড়ির ছেলে-মেয়েরাও তাকে সম্মান করে। রিমি তার মুখের হাসি বিরাজমান রেখে বললো, ‘দাদি আমাদের ধরে বেধে আটকে রাখতে পারবে তুমি? বুড়ি হয়ে গেছো না!’
দীবা রিমির প্রতিত্তুরে বলে উঠলো, ‘কে বলছে বুড়ি হয়েছে? দাদিকে দেখছোস মাশা’আল্লাহ দিন দিন রুপ গজায় খালি। এখন তো দেখতেছি একটা হ্যান্ডসাম পাত্র খুঁজতে হবে।’
পান খাওয়ার ফলে লাল হয়ে যাওয়া উষ্ঠ জোড়া প্রসারিত করে হাসলো কমলা। খয়েরের রঙে দন্ত তার লাল বর্ণ ধারন করেছে। বয়স পঁয়তাল্লিশ ছুঁই ছুঁই। চেহারায় তার বয়সের ছাপ স্পষ্ট। শরিরের চামড়া কুঁচকে গেছে প্রায়। গায়ের রঙ ফর্সা হওয়ায় কুঁচকানো চামড়াতে যেনো তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কমলা মুখের হাসি ধরে রেখে বললো, ‘শতানী জীবনত ন’জাইবু তোরার? বালা অই যাগুই হইদ্দি।’ (শয়তানী জীবনেও যাবে না তোমাদের? ভালো হয়ে যাও বলছি।)
বলেই হাসতে হাসতে চলে গেলো কমলা। তখন আরিয়ান আর অভ্র আসলো সেখানে। আরিয়ান সোফায় ধপাস করে বসে সামনের টি-টেবিলে রাখা প্লেট থেকে টোস্ট হাতে নিয়ে কামড় বসালো। অভ্র এগিয়ে হাসি মুখে আরিয়ানের পাশে বসতে বসতে বললো, ‘বৃষ্টিবিলাশী কন্যারা! কি খবর আপনাদের?’
‘বৃষ্টিবিলাশী কন্যা’ সম্মোধন শুনে মুচকি হাসলো দীবা ও নুরা। দুইজনই সাবলীল ভাবে উত্তর দিলো, ‘এইতো ভালো।’
রিমি সোফায় হেলান দিয়ে বসে অন্য দিকে তাকিয়ে বিরক্তিসহিত বিড়বিড় করে বললো, ‘আপনার অনুপস্থিতিতে এতোক্ষণ তো অনেক ভালো ছিলাম।’
বিড়বিড় করে বললেও কথাটা সবার কান অব্ধি পৌঁছেছে। রিমির এমন প্রত্যুত্তর শুনে কপাল কুঁচকালো অভ্র। জায়গা মতো খোঁচাটা ছুঁড়ে বলে উঠলো, ‘তোমার কাছে কে জানতে চেয়েছে?’
রিমি অবাক হয়ে বললো, ‘এই মাত্র না জানতে চাইলেন?’
অভ্র ভাবলেশহীন গলায় বললো, ‘ভাবি আর নুরাকে বৃষ্টিবিলাশী কন্যা বলেছি। তোমার সাথে এই নামটা যায় না।’
নুরা বলল, ‘তাহলে কোন নামটা যায় ভাইয়া?’
অভ্র জড়তাহীন গলায় বললো, ‘তোমার বোন অতিরিক্ত ঝগড়া জানে। তাই ঝগড়াটে নামটা তার সাথে পারফেক্ট।’
আরিয়ান নুরা উচ্চস্বরে হেসে ফেললো অভ্রের কথায়। নুরা ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল উঠিয়ে গ্রেট শুধালো অভ্রের কথাটাকে। অপমানে তেঁতে উঠলো রিমি। গলার কন্ঠস্বরে ঝাঁঝ মিশিয়ে বললো, ‘ঝগড়াটে কাকে বলছেন আপনি?’
অভ্র নির্বিকার ভাবে উত্তরে বললো, ‘এখানে রিমি নামে দ্বিতীয় কেউ আছে বলে মনে হয় না।’
রিমি প্রত্যত্তরে কিছু বলতে যাবে এমন সময় আবরার আর সাবিত সেখানে উপস্থিত হলো। তাদের কে দেখে রিমি নিরব হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত পিষে অভ্রের দীকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো কেবল। আবরার এগিয়ে অভ্রের পাশে সিঙ্গেল সোফায় বসলো। অতঃপর তারা নিজেদের মতো আড্ডায় মশগুল হলো। পুরোটা সময় আবরার দীবাকে প্রখর করেছে। আড় চোখে বারংবার তাকিয়েছে কিন্তু দীবা ভুলবশত একবারো আবরারের দিকে তাকায়নি। চোখ মুখ শক্ত করে নিরব থেকেছে শুধু। মনে মনে অস্থির হয়ে আছে আবরার। দীবার জেলাসি দেখে তখন মজা পেলেও এখন কেমন উষ্কখুষ্ক লাগছে তার। রাতে খাবার খাওয়ার সময়ও দীবা নিরব ছিলো। অন্যান্য সময় সবার সাথে হেসে কথা বললেও আজ নিস্থব্ধ ছিলো সে। মাঝে মাঝে চোখ পাকিয়ে আবরারের দিকে রাগি লুক দিয়েছিলো। দীবার রাগান্বিত চোখের তীক্ষ্ণ চাহনি আবরারের মন পুলকিত হচ্ছে না। মিথ্যে টা ধরে না রেখে ভাবছে সত্যি টা বলে দেওয়াই ভালো।
____________________
নিস্থব্ধ রাত, স্নিগ্ধ বাতাস। অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতে চাঁদের আলোতে আলোকিত পরিবেশ। সোডিয়ামের কৃতিম আলো নিভিয়ে ছাদের এক পাশে বসে আছে আবরার। অপেক্ষা করছে সে দীবার। রাতে খাবারের পর দীবাকে আর দেখেনি সে। মনের ব্যাকুলতা কমেনি। সেই মায়াবী মুখশ্রী দেখার প্রবল ইচ্ছা পুষণ করছিলো তার মন। এবার রাগ ভাঙ্গাতে হবে। রাত যখন প্রায় এগারোটা ছুঁই ছুঁই। আবরার দীবার রুমের সামনে নখ কামড়ে পায়চারী করছে আর ভাবছে সে কি দীবাকে একবার ডাক দিবে? বলবে তার সাথে কথা আছে? ভাবতে ভাবতে একসময় নজর গেলো রিমির উপর। রিমি তখন পানি খেতে রুম থেকে বের হয়েছিলো। সে আবরারকে দেখে প্রশ্ন ছুড়লো তাৎক্ষনাৎ, ‘এখানে কি করছো ভাইয়া?’
আবরার বেশ অস্বস্তিতে পরে গেলো। ইতস্ততবোধ করে বললো, ‘কিছু না। তুই যা।’
রিমির সন্দেহপ্রবন দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সে খেয়াল করে দেখলো আবরার দীবার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সন্দেহ তার আরো গাঢ় হলো। মনে মনে হেসে ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললো, ‘দীবার রুমের সামনে কি করছো?’
আবরার এক হাতে মাথা চুলকে ভাবছে কি বলা যায়। সরাসরি যদি দীবাকে দেখতে চাই বলে তাহলে নিশ্চয় তাকে নিয়ে হাসবে। মনে মনে বুদ্ধি এটে বলে উঠলো, ‘আসলে দীবাকে আরিয়ান ছাদে যেতে বলছে। কি জরুরী কথা নাকি আছে।’
রিমি বললো, ‘কিন্তু আরু ভাইকে তো একটু আগে অভ্র ভাইয়ার রুমে দেখলাম।’
‘ওহ আচ্ছা।’ বলে আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না আবরার। রিমি সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভ্রুঁ নাচায়। আবরার নিজেকে কেমন আহাম্মকের মতো লাগছে। তার এতো বছর জীবনে এমন বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পরেনি। জিভ দিয়ে উষ্ঠধয় ভিজিয়ে বললো, ‘আরিয়ান একটু আগে আমাকে বলেছে। তুই গিয়ে দীবাকে জানিয়ে দে ব্যাস।’
রিমি ভ্রুঁ উঁচিয়ে ‘আচ্ছা আমি পানি খেয়ে আসি তারপর বলবো।’ বলে নিচে গেলো। আবরার যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে ছাদে চলে আসলো। এখন দীবার আসার অপেক্ষা।
রিমি পানি খেয়ে উপরে দীবার রুমের দিকে যাচ্ছে আর হিসেব মিলাচ্ছে। সে রুম থেকে বের হবার সময় সাবিত আরিয়ান কে অভ্রের রুমে হাসাহাসি করতে শুনেছে। এই কিছু সময়ের মাঝে দীবাকে কেন ছাদে যেতে বলবে? জরুরী কিছু হলে তো রুমেই আসতে পারে। না মিলাতে পারছে না সে।
‘কিরে পুচকি। কি ভাবছিস?’
রিমির মাথায় গাট্টা দিয়ে বললো আরিয়ান। রিমি মাথা চুলকে বললো, ‘তুমি দীবাকে ছাদে যেতে বলে এখানে কি করছো? দীবার রুমে গিয়েই তো কথা বলতে পারো। ছাদে যাবার কি আছে?’
রিমির কথা আরিয়ান কিছু বুঝতে না পেরে পাল্টা প্রশ্ন করলো, ‘ওয়েট, দীবাকে কখন ছাদে যেতে বললাম?’
‘ওমা, আরব ভাই যে বললো তুমি নাকি ছাদে ওয়েট করছো। দীবাকে যেতে বলতে বলছে আমাকে।’
আরিয়ান কিছুক্ষণ ভাবনায় মশগুল হয়। আরিয়ানের কথা বলে আবরার নিজে দীবার সাথে দেখা করবে। বুঝতে বাকি নেই আরিয়ানের। তাই শয়তানী হাসি দিয়ে বলল, ‘তুই রুমে যা। আমি কথা বলছি।’
‘ঠিক আছে।’
আরিয়ান দীবার রুমে না গিয়ে ছাদে চলে আসলো। পুরো ছাদে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখলো আবরার রেলিং’য়ের কার্নিশ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। সেও নিঃশব্দে গিয়ে পাশে দাঁড়ালো। আবরার তার পাশে আরিয়ানকে দেখে বিস্মিত হলো। বললো, ‘তুই এখানে?’
আরিয়ান অবাক হওয়ার ভান ধরে বললো, ‘ওমা আমি না দীবাকে ছাদে আসতে বললাম? তাহলে আমি থাকবো না তো কে থাকবে?’
আবরার দাঁতে দাঁত চিবিয়ে ‘ড্যাম’ বলে রেলিংয়ে হাল্কা থা*প্পড় মা*রলো একটা। আরিয়ান এবার উচ্চস্বরে হেসে ফেললো। মুখের হাসি ধরে রেখে বললো, ‘চিল ব্রো চিল!
চলমান..
★ ফটো ক্যাডিট – পূজা পিহু ❤️