#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-২০]
হতভম্ব হয়ে দুতলার ঘরে আসলো রোহানা! চেহারায় তার স্পষ্ট রাগের ছাপ। ঘরে এসে দেখলো দীবা বিছানায় বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছে। তাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত্বনা দিচ্ছে রাইমা। সামনেই বসে আছে রিমি ও নুরা। রোহানাকে আটকাতে পিছু পিছু আসলো নিশিতা। কিন্তু পিছু ডাক শুনলো না রোহানা। মেয়ের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে রইলো। মাকে এভাবে ঘরে আসতে দেখে দীবা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। কান্নাকাটি করার কারণে চোখমুখ তার অসম্ভব লাল হয়ে আছে। সেসবে তোয়াক্কা করলো না রোহানা। মেয়ের দিকে তেড়ে এসে গালে স্বজোড়ে একটা থা প্প ড় বসালো। আঘাতের পরিমান এতোটাই প্রগাঢ় ছিলো যে দীবা পিছিয়ে পরে যাওয়ার উপক্রম হলে রাইমা ধরে সামলে নিলো। রোহানা দীবাকে রাগি গলায় বলে উঠলো, ‘তোকে আমরা এই শিক্ষা দিয়েছিলাম?’
দীবা গালে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। নিশিতা এগিয়ে এসে দীবাকে আঁকড়ে ধরে রোহানাকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বললো, ‘কি হচ্ছে টা কি রোহানা? এতো বড় মেয়ের গায়ে কেউ হাত তুলে? আগে সত্যি টা তো জেনে নিবে নাকি।’
রোহানা মেয়ের দিকে তাকিয়ে ক্রোধান্তিত কন্ঠে বললো, ‘সত্যি করে বল। তোর উপরে আমার বিশ্বাস আছে। আমি জামি তুই আমার বিশ্বাস ভাঙ্গবি না। সত্যিটা বল।’
দীবা কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি মুছলো। কান্না ভাঙ্গা গলায় প্রত্যুত্তর করলো, ‘আমি জানালা দিয়ে বাড়ির পিছনে একটা বিড়াল দেখেছিলাম। সেটা আনতে বাহিরে গিয়েছি। বিড়াল টা ওই ঘরে ঢুকেছিল তাই আমিও তার পিছু সেখানে ঢুকি। ঘরে গিয়ে দেখি উনি ওখানে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্বাস করো আম্মু! আমি তখুনি ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছি। উনার সাথে আমার খারাপ সম্পর্ক নেই। আমাদের কখনো কথাও হয়নি। সত্যি বলছি।’
রোহানার বিশ্বাস ছিলো যে তার মেয়ে কখনো এমন নোং-রা কাজকারবার করবে না! এবং তার বিশ্বাস অনুযায়ী তাই হলো। তবুও মেয়ের নামে এমন কুৎ-সিত কথাবার্তা শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না। ল-জ্জা, অপমান ও দ্বিধায় গ্রাস করলো তার মন। অসাড় হয়ে বসে পরলো বিছানায়। নিশিতা তাকে বুঝানোর জন্য বলে উঠলো, ‘আমাদের ছেলে মেয়ের উপর আমাদের বিশ্বাস আছে। ওরা এমন জ-ঘন্য কাজ কখনোই করবে না। তাছাড়া আবরার বাড়িতে এসেছেই বারো বছর পর। এর মধ্যে এমন সম্পর্কের কোনো প্রশ্নই আসে না। গ্রামের কিছু মানুষের ম্যা ন্টা লি অনেক খারা-প থাকে। সেটাই আজ প্রমান হলো। টেনশন নিও না রোহানা। তোমার মেয়েকে কেউ কখনো অসম্মান করবে না।’
রোহানা প্রত্যুত্তর করলো না। নিরবে বসে রইলো শুধু। নিচে থেকে আবরারের কন্ঠ শুনে নিশিতা ঘর থেকে বের হলো। দ্রুত পায়ে নিচে এসে হোসেনের কাছ থেকে জানতে চাইলো বাকি ঘটনা। হোসেন সব খুলে বললে নিশিতা দ্বিরুক্তি করেনি। রোশানের কথামতো আবরারকে অন্য ঘরে নিয়ে বুঝাতে লাগলো। কিন্তু আবরার মানতে নারাজ। যার সাথে আজ অব্ধি দেখা তো দূর কথাও বলেনি, তাকে কি না গ্রামের কয়েকটা মানুষের কথায় বিয়ে করতে হবে? কখনোই না! তবুও থামলো না নিশিতা। নিজের মতো আবরারকে বুঝাতে লাগলোই। বাহিরে গ্রামপ্রধান ও রোশানের মতামতের ভিত্তিতে কাজি ডেকে আনা হলো। বসার ঘরে বয়স্ক কয়েকজন উপস্থিত কেবল। দীবার পরনে লাল কুর্তি ছিলো বিধায় শাড়ি পরানোর ব্যবস্থা করা হয়নি। ওড়না টেনে ভালো করে ঘোমটা টেনে দিলো এক বৃদ্ধা! দরজার সামনে পর্দা টেনে দিয়ে দুইজনকে দুই ঘরে বসানো হলো। পর্দা টাঙ্গানো থাকায় কেউ কাউকে দেখেনি। কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করলো। আবরারকে কবুল বলতে বেশ কয়েকবার বলা হলো। কিন্তু আবরার চোয়াল শক্ত করে বসে রইলো। আরো কয়েকবার বলার পরেও যখন আবরার কবুল বললো না তখন গ্রামপ্রধান ক্ষেপে গেলেন। পরিস্থিতি হাতের বাহিরে যাবার আগে নিশিতা ছেলের পাশে বসে বুঝাতে লাগলেন। অতঃপর আবরার মায়ের কথা রাখতে কবুল বলে ফেললো।
আবরারের কবুল বলা শুনে ঘরের অপর পাশে থাকা দীবার কলিজা ধক করে উঠলো। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝাড়তে লাগলো তার। এখন তাকেও কবুল বলতে বলা হলো। অনেকক্ষণ পর দীবাও বাধ্য হয়ে কবুল বললো। বিয়ে হলো দুজনের। যারা আজ অব্ধি কেউ কারোর সম্পর্কে জানে না! চিনেও না!
বিয়ের এই সম্পূর্ণ ঘটনায় কেবল অল্পসংখ্যক বয়স্ত জ্ঞানী লোক উপস্থিত ছিলো। রোশানের কাছে আবরারের ক্যারিয়ার সম্পর্কে কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিলো একটা। সেটা হচ্ছে এই বিয়ের ব্যাপার তারা ব্যতিত অন্য কেউ যেন ভুলেও জানতে না পারে। বিশেষ করে মিডিয়ার লোকজন। উপস্থিত সকলে এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। নিশ্চিন্ত হলো রোশান। অতঃপর বিয়ের পর রোশান এখানে এক মুহূর্তও দেরি করে নি। খালা ও খালাতো ভাইয়ের কাছে বিদায় নিয়ে আগ্রাবাদ যাবার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরলো। পুরোটা রাস্তা দীবা কাঁদতে কাঁদতে পার করেছে। আবরারও কোনো প্রকার শব্দ করেনি। তার এই নিরবতা বলে দিয়েছে সে ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড রাগান্বিত! শান্তিনিবাস আসার পর গাড়ি থেকে নেমেই নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে কাঁদতে লাগলো দীবা। বেশ কিছুক্ষণ কান্না করার পর ড্রয়িংরুম থেকে চেঁচামিচির শব্দ কানে আসলো তার। দেখার জন্য রুম থেকে বেড়িয়ে সিঁড়ির উপরে রেলিং ধরে দাঁড়ালো। তখন-ই কানে আসলো রোশানের রাগি কণ্ঠস্বর,
‘তুমি কিন্তু এবার একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছো আবরার।’
রোশানের কথায় আবরার কিছুটা তুচ্ছজ্ঞান করে বলল, ‘ওহহো সিরিয়াসলি? আমি বাড়াবাড়ি করছি? আপনারা কি করলেন? থার্ডক্লাস লোকদের কথা শুনে এমন একটা কাজ করলেন। অথচ যেখানে মেয়েটাকে আমি ভালো করে দেখিনি অব্ধি। জানিও না মেয়েটা কে।’
রোশান দুই হাত পিছনে নিয়ে গম্ভীর চোখেমুখে বলল, ‘আজ নয়তো কাল দীবার সাথে তোমার বিয়ে দিতাম আমি। যেহেতু পরিস্থিতি পালটে বিয়ে হয়েই গেছে। সেহেতু মেনে নাও। তোমার জন্যই ভালো হবে।’
আবরার রাগে ড্রয়িংরুমে সোফার সামনে থাকা কাচের টি-টেবিলে স্বজোড়ে লা থি দিলো একটা। টি-টেবিল টা উলটে কাচটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কাচ ভাঙ্গায় কেঁপে উঠলো দীবা। সঙ্গে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সবাই বিস্মিত হলো। আবরার রেগে দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘কি পেয়েছেন টা আপনি আমাকে? যা ইচ্ছে হবে তাই আমার উপর চাপিয়ে দিবেন? ছোট থেকেই এমন হয়ে এসেছে। আমি আগের সেই ছোট আবরার নই বুঝতে হবে মিঃ রোশান।’
ভাইয়ের নাম নেওয়ায় ধমকে উঠলো হোসেন, ‘আবরার? বাবার সাথে এটা কেমন ব্যবহার? তখন যা ঘটার ঘটে গেছেই। এতে ভাইয়ের দোষ নেই। যা হয়েছিল তা তোদের ভুলের কারণেই।’
হোসেনের শেষ কথাটা শুনে যেন আবরারের রাগ আরো দ্বিগুণ হলো। বলল, ‘এখানে আমার কোনো দোষ নেই। ওই মেয়েটা কোথায়? নাম কি জানি তার? সব দোষ তার। মেয়েটা ইচ্ছে ওই ঘরে গিয়েছে আমি জানি। মেয়েটা জানতো আমি সেখানে আছি। কি ভেবেছে হ্যাঁ? প্ল্যান করে এমন করবে আর আমি মেনে নিবো? ইম্পসিবল। এই বিয়ে আমি মানি না। কিছুতেই না।’ বলেই পাশের ফ্লাওয়ার বেজ ছুঁড়ে ফেললো।
দীবাকে নিয়ে কথা বলায় রোশান রাগলো এবার। কন্ঠে ক্রোধ প্রকাশ করে গলার আওয়াজ উঁচু করে বললো, ‘এখানে তুমি যেমন নির্দোষ, তেমন দীবাও নির্দোষ। একার উপর দোষ চাপাবে না আবরার।’
আবরারের সাথে কথা কাটাকাটি হতে লাগলো রোশানের। আবরার রাগে আশেপাশে বেশ কিছু জিনিস ভাঙ্গচুর করলো। তাকে এভাবে রাগারাগি করতে দেখে ভয়ে রুমে চলে আসলো দীবা। সহ দোষ তার উপর দিল? সে তো কিছুই জানতো না। কান্না পেলো ভীষণ। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। অপরদিকে রাগে আবরার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবে বলে মনস্থির করলো। বের হবার আগে অভ্রকে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি নিয়ে যাবার জন্য বলে গেলো।
আবিরারের এই ভয়ংকর রাগ আজও দীবার মনে ভয় গভীর ভাবে পরেছে। তখন দীবাকে দোষারোপ করার কারণে একরাশ রাগ, বিতৃষ্ণা ও অশ্রদ্ধা আসে আবরারের প্রতি। মনে পরলে কান্না পায়। এতোদিন পর আজকেও সব মনে পরলো। কান্না পেল ভীষণ। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেল কখন টেরও পেলো না।
_______________
রোহানার ডাকে নিদ্রা ভেঙ্গে জাগ্রত হলো দীবা। ফোলা ফোলা চোখ মেলে পিট পিট করে তাকালো মায়ের দিকে। দীবার চোখ দুটো দেখে রোহানার বুঝতে বাকি নেই মেয়ে তার কেঁদে ঘুমিয়েছে। কারণ জানতে চাইলেন, ‘কান্না করেছিস? কি হয়েছে? মাথা ব্যাথ্যা করছে আবার?’
এতোক্ষণ কান্না করার ফলে মাথা প্রচন্ড ব্যাথ্যা করছে দীবার। কিন্তু স্বীকার করলো না। পক্ষান্তরে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রয়াস করলো। বিছানা থেকে নেমে চুল গুলো হাত খোঁপা করতে করতে বলল, ‘এখানে এসেছ কেন? কোনো দরকারে?’
রোহানা বললো, ‘নিচে আয় খেতে।’
‘ঠিক আছে। তুমি যাও আমি আসছি।’ ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথাটা বলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো দীবা। মেয়ের এমন কান্ডে বিস্মিত হলো রোহানা। কারণ বুঝতে না পেরে নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলো।
দীবা ভীতিগ্রস্ত হয়ে আছে। বিকেলে লোকটার মুখের উপর যা নয় তা বলে দিয়েছে। এখন লোকটার মুখোমুখি দাঁড়াবে কিভাবে? বহু কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে নিচে আসলো। ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে দেখলো আবরার সেখানে অনুপস্থিত। প্রথমে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও পরে চিন্তিত হলো। লোকটার যা ভয়ানক রাগ; এখন যদি দীবার উপর রেগে বাড়ি থেকে চলে যায়? ভয়ে জমে এলো দীবার শরির। হাজারটা চিন্তা নিয়ে খাবার শেষ হলো। ঘুমানোর সময় হলো। কিন্তু আবরারের দেখা এখনো মিললো না। ঠোঁট কামড়ে রুমে পায়চারি করতে করতে ভাবতে লাগলো দীবা। ভয়ে ঘেমে গেলো দীবা। লোকটা কি সত্যি সত্যি চলে গেলো?
চলমান…