#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-৪০] প্রথমাংশ
দুইতলার বিশাল লম্বা বারান্দা দিয়ে হাঁটছে দীবা। উদ্দেশ্যে আবরারের রুমে যাওয়া। তবে দীবা মোটেও ভয়ার্ত কিংবা চিন্তিত না। বরঞ্চ ফুরফুরে মনে হেলেদুলে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আবরারের রুমের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
তোমার ইচ্ছে গুলো, ইচ্ছে গুলো
তোমার ইচ্ছে গুলো ইচ্ছে হলে
আমায় দিতে পারো
আমার ভালো লাগা, ভালোবাসা
তোমায় দেবো আরো।
তুমি হাতটা শুধু ধরো,
আমি হবো না আর কারো।
তোমার স্বপ্ন গুলো আমার চোখে
হচ্ছে জড়সড়।
হঠাৎ-ই কেউ একজন দীবার হাত টেনে অন্ধকার একটা রুমে নিয়ে গেলো। আকস্মিক ঘটনায় ভড়কে গেলো দীবা। প্রকাণ্ড রকমের ভয়ের কারণে চিৎকার করে উঠতে নিলেই জানালার ঝাপসা আলোতে আবরারের মুখশ্রী দেখে ভয়ার্ত মন শান্ত হলো কিছুটা। জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। চোখ তুলে আবরারের দিকে তাকাতেই দেখলো আবরার নেশাক্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আবরার দীবার দিকে একটু এগিয়ে নিবিড় হলো। দুজনের দূরত্ব ঘুচিয়ে দীবার ঘাড়ে মুখ ডুবালো। ঘাড়ে গভীর একটা চুমু দিয়ে মৃদু কন্ঠে বললো,
‘আমার অনেক ইচ্ছে রয়েছে দীবা। আমার ইচ্ছে তোমাকে কাছে পাবার। তোমার পাশে বসে সূর্যাস্ত দেখার। তোমার হাত ধরে সারাজীবন পথ পাড়ি দেবার। সমুদ্রজলে পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটার। আমার আরো অনেক ইচ্ছে আছে দীবা। সব ইচ্ছে আমি তোমাকে দিলাম। এবার পূরণ করার দায়িত্ব তোমার।’
আবেশে চোখ বন্ধ করেছিলো দীবা। আবরারের শার্ট খামচে ধরে আলতোভাবে শুধাল, ‘নিলাম দায়িত্ব। কিন্তু গাড়ি ভাড়াটা আপনার।’
দীবার উন্মুক্ত ফরশা ঘাড়ে ঠোঁট বুলাচ্ছিলো আবরার। এমন প্রত্যুত্তর শুনে মৃদু শব্দ করে হেসে ফেললো। মাথা উঠিয়ে দীবার চোখের দিকে তাকাতেই দীবাও চোখ খোলে আবরারের দিকে তাকালো। দুইজন দুজনের চোখের মায়ায় অনন্ত কালের জন্য আটকে পরলো। অদ্ভুত মায়া, আসক্তি কাজ করলো দুজনের মনে। আবরার দীবার চোখের দিকে তাকিয়ে নেশাক্ত গলায় বলে উঠলো, ‘আই লাভ ইউ দীবা!’
দীবা চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বিরক্তিকর নিশ্বাস ফেললো। তারপর চোখমুখ শক্ত করে আবরারের বুকে ধা:ক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো। হঠাৎ এমন করায় হতভম্ব হয়ে গেলো আবরার। বিস্ময়কর চোখে দীবার দিকে তাকাতেই দীবা রেগে বলে উঠলো, ‘এতো কিপটা কেন আপনি?’
এবার যেন হতবুদ্ধি হলো আবরার। ফ্যালফ্যাল করে চোখে তাকিয়ে অমৃসণ কন্ঠে বললো, ‘কিপটামির কি করলাম?’
‘ক্যান্ডেল, ফুল, বেলুন, চকলেট আরো কতো কিছু দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে কত রোমান্টিক ভাবে মানুষ প্রপোজ করে। আর আপনি? একটা ফুল তো দূর ভাঙ্গা একটা ঘরে অন্ধকারে প্রপোজ করলেন। এটা কিপটামি না?’
হতভম্ব আবরার কোনো রকমে বললো, ‘এটা ভাঙ্গা ঘর না। আমার রুমটা।’
দীবা দ্বিগুণ রাগে ঝাঁঝালো গলায় বললো, ‘একই তো কথা। বিয়েতেও কোনো অকেশন হলো না। প্রপোজালও সুন্দর ভাবে সারপ্রাইজ দিলেন না। এতো বড় নামকরা নায়ক হয়েও কতো বড় কিপটা।’
‘তুমি তো আমার বউ-ই।’
‘বউ তো কি হয়েছে? তাই বলে একটু সারপ্রাইজ ডিজার্ভ করি না? কিপটার দল।’
রাগে, দুঃখে, মহাকষ্টে কথা গুলো বলে হনহনিয়ে রুমের বাহিরে চলে আসলো দীবা। মনে মনে ভাবলো তার কপাল টাই খারাপ। অত্যন্ত দুঃখময় চেহারায় ঠোঁট উলটে বারান্দা দিয়ে হেঁটে নিচে যাবার জন্য পা বাড়াতে লাগলো। তখুনি আকাশে মেঘেদের ডাক কানে আসলো তার। বিস্মিত হয়ে চটজলদি বারান্দার রেলিং ধরে আকাশের বুকে উঁকি দিলো। ঘন কালো মেঘদের আনাগোনা নজরে এলো তার। শীতলতর বাতাস চারপাশে সু-সু শব্দ তুললো। কিছুক্ষণ আগেও আকাশটা স্বচ্ছ ছিলো একদম। কিন্তু এখন হঠাৎ-ই এমন মেঘাচ্ছন্ন হলো কেন? আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে নিচে তাকাতেই দেখলো সবাই দৌড়ে আসছে। তাদের আসতে দেখে দীবা মিষ্টি করে হেসে তাকিয়ে রইলো।
আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস দুটোই এমন। এখুনি ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, এখুনি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন আবার ধরনি কাপিয়ে ভারি বর্ষণ। হুটহাট আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে। গত দুইদিন বৃষ্টি না হলেও আজ আগাম বার্তা ছাড়া বৃষ্টির আগমন ঘটলো। আকাশের বুক চিঁড়ে একটা দুইটা বৃষ্টির ফোটা পরতে শুরু করলো। দৌড়ে এসেও নিজেদের বাঁচাতে পারলো না কেউ। বাড়ির ভিতরে ঢোকার আগেই বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে গেলো। অল্পসল্প ভিজিয়ে দিলো সবাইকে। দৌড়ে এসে সবাই বাড়ির ভিতরে ঢুকলেও বৃষ্টির মধ্যে বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলো রাইমা। তাকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিস্মিত হলো সবাই। দীবার ঠোঁটে আমোদিত মিষ্টি হাসি ফুটে এলো। কারণটা বুঝতে পেরে মহা আনন্দে লাফিয়ে নিচে নামার জন্য দৌড় লাগালো। রাইমাকে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাবিত ডাকলো, ‘বেকুব, ওখানে দাঁড়িয়ে ভিজছিস কেন? ভিতরে আয়।’
রাইমা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মুচকি হেসে মাথা দুই পাশে দুলালো। অর্থাৎ ভিতরে যাবে না সে। বড় ভাইয়ের কথা উপেক্ষা করে ডেকে উঠলো, ‘নুরা, রিমি ভিজবি তোরা?’
রিমি ও নুরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে একে অপরের হাত ধরে চেঁচিয়ে উঠলো। এক দৌড়ে রাইমার কাছে গিয়ে বৃষ্টি ভিজতে লাগলো। সাবিত রেগে ধমকে উঠলো তিনজনকে, ‘তোরা ভিতরে আসবি?’
বোনদের প্রতি ভাইয়ের ভালোবাসা দেখে মৃদু হাসলো রাজ। হালকা ভিজে যাওয়া চুল গুলো এক হাতে ঝাড়তে ঝাড়তে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলো। তখুনি সিঁড়ি বেয়ে হাসতে হাসতে নিচে নামতে লাগলো দীবা। চোখাচোখি হলো দুজনের। রাজ মুগ্ধকর চোখে দীবার দিকে তাকিয়ে উপরে উঠতে লাগলো। দীবা স্বাভাবিক ভাবে নিচে নেমে সবার কাছে আসলো। বৃষ্টিতে ভিজতে বাহিরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই আরিয়ান দীবার বাহু ধরে আটকে ধরে বাধা দিলো। দীবা আকুতি মিনুতি করতে লাগলো। আরিয়ান দীবার এই করুণ চেহারা দেখে আর মানা করতে পারলো না। তাই হাত ছেড়ে দিলো। দীবা খুশিতে আত্মহারা হয়ে বাহিরে গিয়ে তিনজনের সাথে লাফিয়ে লাফিয়ে বৃষ্টি ভিজতে লাগলো। রাইমার ছেলেমানুষির কারণে আনমনে মৃদু হেসে ফেললো রাজিব।
মেয়েদের হাসির শব্দ কানে আসতেই আবরার রুম থেকে বেরুলো। দুতলার বারান্দার রেলিং ধরে রাজকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো আবরার। রাজের ঠোঁটের মৃদু হাসি দেখে চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করলো। রাজের থেকে চোখ ফিরিয়ে বাড়ির নিচে তাকালো। চারজন একত্রে হেলেদুলে বৃষ্টি ভিজতে দেখলো। আবরার আরেকটু খেয়াল করে দেখলো রাজ দীবার দিকে তাকিয়েই হাসছে। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। তবুও নিজেকে সংযত রেখে রাজের দিকে এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়ালো। দুই হাতে নিজের এলোমেলো চুল গুলো গুছাতে গুছাতে প্রশ্ন করলো, ‘সুন্দর লাগছে তাই না?’
রাজ এখনো মুগ্ধ হয়ে দীবাকে দেখছে। যেন কোনো ঘোরের মধ্যে আছে সে। তাই আবরারের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে আনমনে বলে উঠলো, ‘ভীষণ!’
রাগ বাড়লেও প্রকাশ করলো না আবরার। বাঁকা হাসি দিলো একটা। নিজেও রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। সামনে তাকিয়েই আবারো প্রশ্ন করলো, ‘দীবাকে কবে থেকে চিনেন?’
রাজ এবারো দীবার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আনমনে বলে ফেললো, ‘প্রায় ছয় বছর হবে।’
কথাটা বলার পরপরই মস্তিষ্ক সজাগ হলো রাজের। চকচকিয়ে আবরারের দিকে তাকালো। হুট করে কি থেকে কি বলে ফেললো সে? এতো বড় বোকামো তাকে দিয়ে কিভাবে সম্ভব? নিজেই নিজের উপর বিরক্ত হলো রাজ। আবরার নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে অল্প শব্দে হাসলো। তারপর উষ্ঠধয়ে জিভ বুলিয়ে রাজের দিকে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক থেকে তীক্ষ্ণ করলো। শান্ত কন্ঠে কাটকাট ভাবে বললো, ‘দীবার থেকে দূরে থাকবেন। আপনার জন্য এটাই ভালো। নাহলে..!’
আবরারের কথা সম্পূর্ণ হতে দিলো না রাজ। তার আগেই বলে উঠলো, ‘ভয় দেখাচ্ছেন?’
আবরার মাথা হালকা নাড়িয়ে বললো, ‘না ভয় দেখাচ্ছি না। ওয়ার্নিং করছি। এন্ড দিস ইজ মাই লাষ্ট ওয়ার্নিং।’
আবরারের কথা শুনে তাচ্ছিল্য হাসলো রাজ। ঠোঁটে হাসি রেখেই আবরারের মুখামুখি সটান হয়ে দাঁড়ালো। পকেটে দুই হাত গুঁজে বললো, ‘আমি দীবার কাছে থাকি কিংবা দূরে, তাতে আপনার কি?’
আবরার বাঁকা হেসে এক হাত উঠিয়ে রাজের কাধে রেখে বললো, ‘এতো তাড়া কিসের? সময় হলে জানতে পারবেন। আপাতত দীবার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবেন। শেষবারের জন্য সাবধান করছি।’
রাজের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো আবরার। রাজ এখনো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হঠাৎ দীবাকে নিয়ে আবরারের কথা গুলো তার তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। সন্দেহ প্রগাঢ় হলো তার। তবে বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হলো। এতো বড় সেলেব্রিটি কিনা দীবার মতো সাধারন একটা মেয়েকে পছন্দ করবে? এতোটাই সহজ? ঘাড় ঘুরিয়ে বাড়ির নিচে তাকালো রাজ। দেখলো দীবাকে বৃষ্টি ভিজতে বারণ করছে আবরার। দীবা বারণ না শুনায় আবরার দীবার বাহু টেনে ভিতরে নিয়ে গেলো। ক্রোধান্তিত হলো রাজ। চোয়াল শক্ত করে গটগট পায়ের কদম ফেলে নিজের রুমে চলে গেলো।
চলমান… (রিচেক করা হয় নি। ভুল গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)
ট্রাইফোগ্রাফি ক্রেডিট : ইফতিহার মিলি. 🦋