#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল মিহির
[পর্ব-৪০] দ্বিতীয়াংশ
বৃষ্টি বিভিন্ন রুপ অনুভব করা যায় শ্রাবণমাসে। কখনো ঝমঝম, কখনো ইলশেগুঁড়ি, কখনো ঝড়কে সাথে করে মুষলধারের বৃষ্টি শ্রাবণকে ভরিয়ে দেয়। কখনো টিপটিপ বৃষ্টিতে নুপুরের নিক্কণ তুলে শ্রাবণ-ধারা। শ্রাবণের বৃষ্টিতে প্রকৃতির বহুমাত্রিক রূপও উদ্ভাসিত হয়। বৃষ্টি হওয়ার পূর্বের প্রকৃতির একটি রূপ থমথমে-গম্ভীর-এই বুঝি কিছু হবে। আবার ঘন কালো হয়ে আকাশ ছেয়ে বিদ্যুৎ-বজ্র সাথে পৃথক এক রূপ ধারণ করে প্রকৃতি। আবার বৃষ্টি-পরবর্তী প্রকৃতির বৃষ্টিস্নাত রূপ মনকে উতলা করে তোলে। রৌদ্রকে সাথে নিয়ে খেলায় মাতে মেঘের ভেলা। মেঘে, বৃষ্টিতে রৌদ্রছায়ায় শ্রাবণ পুরো আকাশে বিছিয়ে দেয় রঙের মহোৎসব।
প্রাতঃকালে দিবাকরের কোমল রোদ থাকলেও দুপুরের শেষভাবে মুষলধারে বৃষ্টি হলো। দুইদিনের অনাবৃষ্টির কারণে রাস্তাঘাট, চারপাশের ঝোপঝাড়, গাছপালা ও মাটি শুকিয়ে খড়খড়ে হয়েছিলো। এই শুকিয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিস্মিত করে আবারো বর্ষণ হলো। বৃষ্টির পানির তাপমান শীতল হওয়ায় গায়ের পশম কাটা দিয়ে উঠার উপক্রম। ভেজা মাটির ভ্যাঁপসা ঘ্রাণ, বর্ষাকালের অন্যতম কদমফুলের কারণে সৌরভময়ী পরিবেশ। বাহিরে ভারি বর্ষণের ঝমঝম শব্দ কান অব্দি স্পষ্ট ভেসে আসছে। জানালার পাশে বসে বাহিরের বৃষ্টিস্নাত রাত্রী দেখতে দেখতে মিষ্টি কন্ঠে সম্পূর্ণ গানটা শেষ করলো রাইমা।
তোমার খোলা হাওয়া, লাগিয়ে পালে
তোমার খোলা হাওয়া
টুকরো করে কাছি
আমি ডুবতে রাজি আছি,
আমি ডুবতে রাজি আছি
তোমার খোলা হাওয়া, লাগিয়ে পালে
তোমার খোলা হাওয়া।
সকাল আমার গেল মিছে
বিকেল যে যায় তারি পিছে গো (x2)
রেখো না আর, বেঁধো না আর
কূলের কাছাকাছি
আমি ডুবতে রাজি আছি,
আমি ডুবতে রাজি আছি
তোমার খোলা হাওয়া, লাগিয়ে পালে
তোমার খোলা হাওয়া।
রাইমার সুমধুর কন্ঠে গাওয়া রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে বিমুখিত হয়ে সবাই করতালি দিলো। তালির শব্দ কানে আসতেই চোখ মেলে তাকালো রাইমা। সবার এমন রিয়েকশন দেখে কিছুটা লজ্জাভূতি হলো সে। চোখ ঘুরিয়ে রাজিবের দিকে তাকাতেই দেখলো রাজিব গালে দিয়ে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভীষণ রকমের লজ্জা পেলো রাইমা। গাল দুটো গাল হয়ে এলো। রাজিবের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মুচকি হাসলো। রাইমার পাশেই দীবা বসে ছিলো। সে রাইমাকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কন্ঠে বললো, ‘কি মিষ্টি গান গাইতে পারো তুমি আপু।’
প্রত্যুত্তরে রাইমা মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিলো। একটু দূর থেকে রাজ বলে উঠলো, ‘আপনি কি কোথাও গান শিখেছিলেন নাকি?’
রাইমা রাজের দিকে তাকালো। বয়সে রাজের অনেক ছোট সে। কিন্তু সম্পর্কে বড় ভাবি। তাই সম্মান করে আপনি সম্মোধন করেছে রাজ। ব্যাপার টা ভালো লাগলো রাইমার। আর সাবলীল ভাবে উত্তর দিলো, ‘না। এমনি শখের বসে গাই।’
রাজ বিনিময়ে আলতো হেসে শুধাল, ‘মাশাআল্লাহ! খুব ভালো গাইতে পারেন।’
রাজিব এক হাতে মাথা চুলকে বলে উঠলো, ‘বউটা কার দেখতে হবে না?’
তার এমন কথা শুনে হেসে উঠলো সবাই। রাজিবের লাগাম ছাড়া বেফাঁস কথায় লজ্জায় নত হয়ে গেলো রাইমা। এমনিতেই রাজিবের সামনে আসতে লজ্জা লাগে ভীষণ, তার উপর আবার এসব কথাবার্তায় তাকে আরো লজ্জিত করে। লোকটা ভারি অ’সভ্য! মনে মনে এই গালিটা দিয়ে নিজেই আহাম্মক হয়ে গেলো রাইমা। আবার নিজের এমন চিন্তায় নিজেই হেসে উঠলো।
আরিয়ান কিছুটা রশিকতার ছলে রাইমাকে কূটস্থ করে বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ ভাই আপনার বউ বহু গুণে গুণান্বিত। আপনাকে কয়েকটা এডভাইজ দিয়ে রাখি। নাম্বার ওয়ান, ইমারজেন্সি ফাস্ট এন্ড এইড বক্স রাখবেন হাতের নাগালে। নাম্বার টু, এম্বুলেন্স কিনে রাখবেন। যেকোনো মুহূর্তে কাজে লাগতে পারে। নাম্বার থ্রি, মোস্ট ইম্পরট্যান্ট থিংক পাবনা ম্যান্টাল হস্পিটালের নাম্বার রাখবেন। কবে যে এই মেয়ে আপনার মাথা খেয়ে ফেলে আল্লাহ ভালো জানে। আপনাকে আমি বড় ভাই মানি। তাই আগে আগে সাবধান ও সমাধান জানিয়ে দিচ্ছি। পরে দেখবেন কোনো এক সময় এই ছোট ভাইটার কথা গুলোই মনে পরবে।’
নিজের বোনের সম্পর্কে এমন বানী শুনে হাসতে হাসতে লুটিপুটি খাওয়ার অবস্থা নুরার। হাহাহা করে শব্দ তুলে হেসে রিমির গায়ের উপর হেলান দিয়ে পরলো। আবরারও অল্প শব্দ তুলে হেসে ফেললো। অন্যরা মুখ টিপে হাসলো। এমন কি রাজিবও। রাগান্বিত হলো রাইমা। নিজের কোলে থাকা কুশন টা হাতে নিয়ে আরিয়ানের দিকে দাঁতে দাঁত পিষে ছুঁড়ে মা:র:লো। আরিয়ান কুশনটা ধরে ত্যাঁছড়া ভাবে হাসলো। রাইমা রাগে কিড়মিড় করে বললো, ‘তোমার কপালে রাক্ষস বউ জুটবে বলে দিলাম।’
আরিয়ান ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো, ‘সমস্যা নেই। রান্নাবান্না সব পারি। ভালো হোক কিংবা খারাপ দুইটাই বউয়ের উপরে চালিয়ে দিতে পারবো। অপচয় হবে না।’
রাইমা প্রত্যুত্তর করলো না। মুখ গুমরো করে বুকে দুই হাত গুঁজে বসে রইলো। সবাই আনন্দ করলো এক সাথে। অবশেষে আবরারকে গান গাওয়ার জন্য ধরা হলো। আবরার প্রথমে নাকচ করলেও পরে গান গাইবে বলে মনস্থির করলো। আরিয়ানের কাছ থেকে গিটারটা নিজের কাছে এনে আঙুর চালালো। টুংটাং শব্দ তুলে গাইতে লাগলো….
রোজ সকালে তোর মায়াবি ছবি
চোখে ভাসে তোর মিষ্টি হাসি
বেলী গাঁথা তোর চুলের বেণী
মায়াপূর্ন তোর চোখের চাহনি।
রোজ সকালে তোর মায়াবি ছবি
চোখে ভাসে তোর মিষ্টি হাসি
বেলী গাঁথা তোর চুলের বেণী
মায়াপূর্ন তোর চোখের চাহনি।
ভালোবাসি তোকে সুহাসিনী
ভালোবাসি শুধু তোকেই।
ভালোবাসি তোকে সুহাসিনী
ভালোবাসি শুধু তোকেই।
ভালোবাসি তোকে সুহাসিনী।
দীবার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকালো আবরার। দীবার বেনী করা চুলের ভাজে একটা গাজরা আটকানো। কপালে ছোট একটা কালো টিপ। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। মৃদু মুচকি হাসিতে মারাক্তক সুন্দর লাগছে তাকে। তার এই সৌন্দর্যের প্রেমে আবারো পরলো আবরার। মুগ্ধ হয়ে গানের বাকি লাইন গুলো গাইতে লাগলো…
তোর জন্য এই ভালোবাসা অসীম
অসীম আমার এই লেখা গান
প্রতিটি ছন্দে তোর রূপের আলোড়ন। (২)
তাতেই হারিয়েছি,
আমার এই প্রান।
তাতেই হারিয়েছি,
আমার এই প্রান।….
“তাতেই হারিয়েছি আমার এই প্রান!” লাইনটা শুনতেই স্মিতি হাসলো রাজ। তখনকার সময়ে নিজের পাগলামি টা আবেগ মনে হলেও এখন সেই অনুভূতি টা প্রগাঢ়। বয়সের সময়সীমা অনুযায়ী দীবা তার থেকে অনেক ছোট তবুও যেন এই পিচ্চি মেয়েটার প্রতি ভালোবাসার কমতি নেই তার। গোলগাল চেহারার মিষ্টি হাসিটার প্রেমে বারংবার তাকে ঘায়েল করে। সবার থেকে একটু পিছিয়ে বসায় অনায়াসে দীবাকে প্রথম থেকে এখন অব্দি দেখে যাচ্ছে। দীবার খিলখিলিয়ে হাসির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে নিজেও হেসে উঠছে আনমনে।
সম্পূর্ণ গানটা দীবার দিকে তাকিয়েই শেষ করলো আবরার। গান শেষে গিটারটা সরিয়ে সুন্দর একটা হাসি দিলো। সবাই প্রতিবারের মতো আজও তার গানের গলার প্রশংসা করলো। যদিও এই প্রশংসা শুনতে ইচ্ছুক ছিলো না আবরার। কিন্তু পরিবারের লোক তাই চুপচাপ শুনতে হয়েছে।
সাবিত হাত ঘড়িতে সময় দেখলো অনেক রাত। তাই সবাইকে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য তাড়া দিলো। অবশেষে আড্ডার আসর ভেঙ্গে এক এক করে সবাই যার যার রুমে চলে গেলো। শুরু রইলো রাজ আর আবরার। রাজ মোবাইলে কিছু একটা চেক করছিলো তাই আগের মতোই বসে আছে। আবরার ইচ্ছে করেই একটু দেরি করলো। সবাই যেতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গিটারটা দেখতে দেখতে অদ্ভুত ভাবে রাজকে বলে উঠলো, ‘অন্যের সম্পদের দিকে নজর দেওয়া অভদ্রতার তালিকায় পরে।’
আবরারের কথা কর্ণপাত হতেই মোবাইলে আঙ্গুল চালানো বন্ধ করলো রাজ। কিছুটা বিরক্ত, কিছুটা ক্ষুব্ধা হয়ে চোখ তুলে সামনে তাকালো। চুপচাপ মোবাইলটা পকেটে রেখে উঠে দাঁড়ালো। আবরার গিটার টা এক হাতে নিয়ে রাজের সামনে দাঁড়িয়ে কাটকাট গলায় বললো, ‘নতুন আত্মীয় হওয়ায় এখনো সম্মান দিয়ে বলছি। দীবার থেকে দূরে থাকেন। ভুলেও দীবার দিকে চোখ তুলে তাকাবেন না।’
রাজ নিশ্চুপ রইলো। তীক্ষ্ণ চোখে আবরারের চোখে চোখ রাখলো। রাগান্বিত হলেও উপরে শান্ত গলায় স্বাভাবিক ভাবে বললো, ‘এতো গুলো বছর যাকে দূর থেকে ভালোবাসলাম, আগলে রাখলাম। আর আজ শুনতে হচ্ছে তার থেকে দূরে থাকতে। আপনার কি মনে হয় এতো বছরের অনুভূতি হুট করে বদলে ফেলবো? আমাকে ভীতু লাগে আপনার?’
‘তুমি ভীতু হও কিংবা সাহসী তাতে কিছু যায় আসে না আমার। শুধুমাত্র একটা কথাই আমি বারবার রিপিট করছি আমার দীবার থেকে দূরে থাকো।’
রাজ পকেটে দুই হাত গুঁজে সটান দাঁড়িয়ে বললো, ‘আপনি বলার কে?’
আবরার কণ্ঠস্বর শক্ত করে কাটকাট গলায় বললো, ‘আমি দীবার হাসবেন্ড।’
শব্দ তুলে হেসে ফেললো রাজ। হাসিটা ছিলো তাচ্ছিল্যের হাসি। জিভ দিয়ে শুকিয়ে যাওয়া উষ্ঠধয় ভিজিয়ে নিলো রাজ। আবরারকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তাচ্ছিল্য স্বরে বলে উঠলো, ‘তিনমাস পর হাসবেন্ড দাবী করছেন। লিখিত কোনো প্রমাণ আছে?’
আবরার এমন কথা শুনে রাগে চোয়াল শক্ত করে ফেললো। কপালের রগ ফোলে নীল বর্ণ ধারণ করলো। তবুও নিজেকে সংযত রাখলো সে। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে চায় না। তাই নিশ্চুপ রইলো। তীক্ষ্ণ চোখে রাজের দিকে তাকিয়ে রইলো কেবল। তাচ্ছিল্যকর হাসি থামালো রাজ। চোখমুখ শক্ত করে আবরারের দিকে একটু এগিয়ে বললো,
‘এই এক মাসে আপনি দীবার সৌন্দর্যের প্রেমে পরেছেন। যদি দীবা সুন্দর না হতো, স্টাইলিশ না হতো তাহলে বিয়ের দিন রাতে যেভাবে ফেলে রেখে গেছেন ঠিক সেভাবেই রেখে যেতেন। দীবা যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন থেকেই আমি তাকে ভালোবাসি। ক্লাস এইটে পড়ুয়া দীবা আর বর্তমানের দীবার মাঝে অনেক তফাৎ। তখন দীবা এতো স্টাইলিশ ছিলো না। একদম সাদামাটা ছিলো। আমি সেই পিচ্চি দীবার ভালোবাসায় এখনো মেতে আছি। আপনার মতো আমি সৌন্দর্যের প্রেমে পরিনি। আমার ভালোবাসা কিভাবে আমার করতে হয় সেটা আমার খুব ভালো করেই জানা আছে। মাঝখান থেকে কাঁটা হয়ে আসবেন না।’
আবরারের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দুতলায় উঠার বিপরীত পাশের সিঁড়ি দিয়ে চলে গেলো রাজ। রাগে শরির মৃদু কাঁপছে আবরারের। দাঁতে দাঁত লেগে আসছে। দাঁড়িয়ে না থেকে গটগট পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো।
আবরারকে উপরে উঠে আসতে দেখে দ্রুত সরে গেলো নুরা। নিজেকে আড়াল করে দেয়ালের পিছনে লুকিয়ে পরলো। এতো এতো সত্য কথা নিজের কানে শুনে পর থেকে স্তব্ধ নুরা। বিশ্বাস হচ্ছে না তার। দীবা ক্লাস এইটে থাকাকালীন সময় থেকেই রাজ ভালোবাসে? এতো আগে থেকে? নুরা কিছুতেই নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। অতিরিক্ত উত্তেজনার কারণে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো। সিঁড়ি বেয়ে আবরার নিজের রুমে চলে যাবার পর দেয়ালের আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসলো নুরা। দ্রুত পা চালিয়ে নিজেদের রুমের দিকে গেলো। দরজার সামনে এসেই অস্থির হয়ে কয়েকবার টোকা দিলো। বেশ কিছুসময় পর দীবা রুমের দরজা খুললো। আড়ষ্ট চোখে দীবার দিকে তাকালো নুরা। রাজ দীবাকে ভালোবাসে। রাজের কথা গুলো পূর্ণরায় কানে বাজতেই দীবার গালে ঠাস করে একটা চ’ড় মা’র’লো নুরা।
চলমান…