#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-৪০] তৃতীয়াংশ
আকস্মিক ঘটনায় বিস্মিত হলো দীবা। হতভম্ব হয়ে বিছানায় বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো রিমি। দীবা এক হাতে গাল ধরে আশ্চর্যান্বিত হয়ে নুরার দিকে তাকালো। থা’প্প’ড়ে মাত্রা এতোটাই গভীর ছিলো যে দীবার ফরশা গাল লাল হয়ে গেছে। জ্বলছে প্রচুর। দীবা গালে হাত বুলাতে বুলাতে কাদুকাদু গলায় বললো, ‘মা’র’লি কেন?’
রাগে শরির কাঁপছে নুরার। দীবার দিকে ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে ঝাঁঝালো গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘আমার প্রিয় জিনিস গুলোই কেন অন্যের হয়? কেন বলবি আমায়?’
নুরার প্রত্যুত্তর শুনে রিমি হকচকিয়ে গেলো। চোখ বড় বড় করে তাকালো নুরার দিকে। এতো তাড়াতাড়ি ধরা খাবে কল্পনাও করে নি সে। নুরাকে এভাবে রেগে থাকতে দেখে ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো। মনে মনে ভাবতে লাগলো দীবা যেন স্বীকার না করে। কিন্তু তা আর হলো না। দীবা গালে হাত রেখেই নুরার ভয়ে অস্থির হয়ে বলে উঠলো, ‘বিশ্বাস কর তোর ব্রেসলেট আমি না রিমি নিয়েছে। আমি কিছু জানি না। আমাকে মারবি না। আমি বারণ করেছিলাম। যা বলার রিমিকে বল।
দীবার সহজসরল স্বীকারুক্তি শুনে আশ্চর্যরকম ভাবে তাকালো নুরা। প্রথমের রাগি চেহারা পালটে দিয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে দীবার দিকে তাকিয়ে রইলো। স্তম্ভিত হয়ে অবাক কন্ঠে বলে উঠলো, ‘আমার ব্রেসলেট চুরি করেছিস?’
ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে বললো রিমি, ‘তুই টের পাসনি?’
নুরা চোখেমুখে চকম রেখে বললো, ‘না। কোনটা নিয়েছিস? আর কবে?’
দাঁতে দাঁত পিষলো রিমি। চটজলদি পা চালিয়ে এসেই দীবার মাথায় ঠাস করে একটা থা’প্প’ড় মা:র:লো। পরপর দুই বার মা/র খাওয়ায় দীবার অবস্থা নাজেহাল। কাদুকাদু চেহারা এবার কান্না করার উপক্রম। রিমি কপাট রাগ দেখিয়ে বললো, ‘আগে আগে এতো কথা বলিস কেন?’
দীবা রাগে, দুঃখে, ব্যাথায়, অপমানে মৃদু আর্ত’নাদ করে উঠলো, ‘তোরা শুধু আমাকে মা’ড়’ছি’স কেন?”
মা’রার কথা মনে পরতেই নুরার দিকে তাকালো রিমি। অত্যন্ত সিরিয়াস হয়ে নুরাকে বললো, ‘তুই দীবাকে মা’র’লি কেন? কি হয়েছে?’
প্রত্যুত্তর করলো না নুরা। চুপচাপ রুমের ভিতরে ঢুকে বিছানায় বসলো। চোখ দুটো তার অসম্ভব লাল হয়ে আছে। চোখে জমে এসেছে বিন্দু বিন্দু জলের কণা। নুরার এমন অবস্থা দেখে রিমি ও দীবা দুইজন হতবাক হয়ে গেলো। মামলা একটু বেশি সিরিয়াস তাই দুইজনে সিরিয়াস ভঙ্গিতে আসলো। অস্থির হয়ে নুরার কাছে এসে জানতে চাইলো সে কাঁদছে কেন? নুরা এতোক্ষণ নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেও এখন কান্নায় ভেঙ্গে পরলো। রিমিকে ঝাপটে ধরে অঝোরে কেঁদে ফেললো। হতভম্ব হয়ে গেলো দীবা ও রিমি। বিস্মিত হয়ে একে অপরের দিকে তাকালো। নুরা কান্নায় ভেঙ্গে বলে উঠলো, ‘আমার সাথেই কেন এমন হলো? আমি যেটাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছি সেটাই কেন হারিয়ে গেলো? আমার কি দোষ বল? আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে রিমি। এতো কষ্ট আগে কখনো পাই নি।’
রিমি নুরার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মলিন কন্ঠে বললো, ‘নুরা? বোন আমার কি হয়েছে? আমাকে বল।’
নুরা কাঁদছেই। থামছে না একদম। অতিরিক্ত কান্নার কারণে কথা বলতে পারছে না সে। তাকে এভাবে কাঁদতে দেখে দীবার চোখেও পানি এসে পরেছে। কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সে এমন কিছুই করে নি যে নুরা কষ্ট পেয়ে এভাবে কাঁদবে। রিমিও কিছু বুঝছে না। তার মাথায় একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু। নুরার এমন প্রিয় কোন জিনিস হারালো যার জন্য দীবা দায়ী? চিন্তিত চোখে দীবার দিকে রাকালো রিমি। তারপর নুরাকে শান্ত করে আবারো বললো, ‘বোইন আমার কাঁদিস না প্লিজ। কি হয়েছে?’
কান্নার কারণে খিচঁকি উঠছে নুরার। চোখমুখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক করার প্রয়াস করলো নুরা। কোনো রকমে কান্না থামিয়ে চোখের পানি মুছলো। উঠে দাঁড়িয়ে দীবা ও রিমির হাত ধরে রুম থেকে বের করে দিলো। নুরার কান্ডে অবাকের পর অবাক হচ্ছে দুইজন। নুরা দুইজন কে রুমের বাহিরে রেখেই দরজা লাগিয়ে দিলো। হতবুদ্ধি হয়ে গেলো রিমি। বিস্মিত চোখে দীবার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দরজা দিল কেন?’
দীবা অবুঝের মতো মাথা নাড়িয়ে বুঝালো সে জানে না। রিমি ডাকলো, ‘দরজা লাগালি কেন?’
ভিতর থেকে নুরার কাটকাট রাগান্বিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, ‘বিরক্ত করবি না। যা এখান থেকে।’
দীবা দরজায় ধা’ক্কা দিয়ে বললো, ‘এতো রাতে কোথায় যাবো?’
‘জাহান্নামে যা।’
নুরার এমন অদ্ভুত ব্যবহারের কারণে আশ্চর্যান্বিত হলো দুইজন। হঠাৎ হলোটা কি এই মেয়ের? ভাবান্তর আসলো দুজনের মাঝে। দীবা আবারো দরজা ধা’ক্কা দিতে গেলে রিমি বাধা দিলো। ভাবলো নুরার মন ভালো থাকার জন্য এবার একটু একা ছাড়া যাক। তাই বিরক্ত করলো না দুইজন। কিন্তু এখন তারা থাকবে কোথায়? কিছুক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে আশাহত হলো। না! নুরা এই জন্মে আজ রাতে আর দরজা খুলবে না। অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করতে হবে দুজনকে। তাই সিদ্ধান্ত নিলো রিমি থাকব্ব রাইমার রুমে আর দীবা যাবে আবরারের রুমে। যেই ভাবা সেই কাজ। দুইজন কথানুযায়ী দুই রুমে গেলো।
_____________________
রুমের এক পাশে থাকা কর্ণার টেবিলের উপর থেকে ফুলের টব হাতে নিয়েই মেঝেতে আ’ছা’ড় দিলো রাজ। কাচের টব টা ভেঙ্গে গুরুগুরু হয়ে মেঝের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরলো। তবুও শরিরের রাগ কমলো না রাজের। অতিরিক্ত রাগের কারণে শরির মৃদু কাঁপছে তার। কপালের রগ নীল বর্ন ধারণ করেছে। এই মুহূর্তে তার মা/র্ডা/র করতে ইচ্ছে করছে। শুধুমাত্র আবরারকে মে’রে গুম করতে ইচ্ছে করছে। দীবার পাশে কিছুতেই আবরারকে মানতে পারছে না সে। দীবা ও আবরারের বিয়ের কথাটা জানার পর থেকেই মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে তার। কথাটা জেনে রাতে খাবারের টেবিলে। যেদিন রাইমার বিয়ের গয়না অর্ডার দিতে গিয়েছিলো সেদিন-ই। মার্কেট থেকে রাজ ও তার মা বাড়ি ফেরার পরেই ডিনার করতে সবাই এক সাথে বসেছিল। তখন রাজের মা তার বাবা আফজালের উদ্দেশ্যে বলেছিল,
‘জানো আজ দীবাও এসেছিলো। মেয়েটা অনেক মিশুক। হাসিটাও সুন্দর। আমার কিন্তু ভীষণ পছন্দ হয়েছে দীবাকে। যদি না ছোট হতো রাজিবের সাথেই দুজনের বিয়ের কথা ফাইনাল করে ফেলতাম। ভালো হতো না? দুই ছেলের এক সাথে বিয়ে হতো।’
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে বিস্মিত চোখে একবার মায়ের দিকে তাকালো রাজ। তাকাতেই তার মা প্রশ্ন করে উঠলো, ‘দীবাকে চিনো তুমি?’
রাজ চুপচাপ খাবার খেতে খেতে উত্তর দিলো, ‘হুম, আমার স্টুডেন্ট।’
রাজের মা প্রাণবন্তর হাসি দিলো একটা। কিন্তু আফজাল গম্ভীর মুখে রইলো। চেহারায় গাম্ভীর্য বজায় রেখে হতাশ কন্ঠে বললো, ‘তা আর হবে না। মেয়েটা বিবাহিত।’
আফজালের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো রাজ। মুখে খাবার দিতে গিয়েও থেমে গেলো। তবে প্রতিক্রিয়া দেখালো না একদম। রাজিব বাবার কথা শুনে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘বিবাহিত মানে? এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিলো?’
আফজাল আবারো বললো, ‘রোশানের বড় ছেলে আবরারের সাথে নাকি তিন মাস আগেই বিয়ে হয়ে গেছে দীবার। আজ জানলাম রোশানের থেকে।’
রাজিব এবার আরো বিস্মিত কন্ঠে বললো, ‘আবরার তো নামকরা গায়ক। বিয়ের ব্যাপার টা লুকালো কেন তাহলে?’
রাজ নিশ্চুপ থেকে প্লেটে চামচ ঘুরাচ্ছে শুধু। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে তার। দীবা বিবাহিত তা মানতে পারছে না কিছুতেই। মনে মনে এই ভাবছে যেন এইসব তার স্বপ্ন হয়। বাস্তবে মানতে পারবে না সে।
আফজাল দীবা ও আবরারের বিয়ের সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বললো। দীবা কে, আগে কোথায় থাকতো। কিভাবে গ্রামে গিয়ে বিয়েটা হলো। আবরার যে দীবাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, ফিরে এসে সব মেনে নিয়েছে। সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে রাজিব ও তার মা অবাক হলো বেশ। তবে রাজিবের মা একটু আফসোস করলো। দীবাকে তার বড্ড মনে ধরেছিল। কিন্তু কি আর করার। তবে যাইহোক, মেয়েটা যেন সুখি হয় সেই দোয়া করলো।
রাজ চুপচাপ বসে থাকলেও নিরবে নিরবে অধৈর্য হয়ে উঠেছে সে। এতো এতো ঘটনা তার অগোচরে হয়ে গেলো অথচ সে বিন্দুমাত্র টের পেলো না? যাকে দূর থেকে আগলে রেখেছে তার সম্পর্কে এতোটাই অজানা তথ্য রয়েছে। আর বসে থাকলো না। ‘আমার খাওয়া শেষ।’ এইটুকু কথা বলেই উঠে দাঁড়ালো। নিজের রুমের দিকে অগ্রসর না হয়ে সোজা বাসা থেকে বেড়িয়ে যেতে লাগলো। তাকে বেরুতে দেখে তার মা পিছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কোথায় যাচ্ছো এতো রাতে? একটু আগেই তো বাহির থেকে আসলাম। এখন বিশ্রাম নাও। রাজ?’
কে শুনে কার কথা। রাজ বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। তবে অন্য কোথায় যায় নি। লিফট ধরে সোজা ছাদে চলে এসেছে। ছাদের রেলিংয়ের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। চুপচাপ বাবার বলা কথা গুলো ভাবতে লাগলো। প্রচন্ড রকমের রাগ হলো তার। রাগের কারণে ছাদে থাকা বেশ কয়েকটা ফুল গাছের টব ভেঙ্গে ফেললো। চুল খামচে ধরে চেঁচিয়ে উঠলো। দীবা অন্য কারোর তা কিছুতেই মানতে পারছে না। এডাল্ট হয়েও আজ ছেলেমানুষি করছে সে। নিজের অজান্তেই চোখ লাল হয়ে এসেছে। শেষ কান্না সে ছোট বেলায় কেঁদেছিল সাইকেল এনে দেবার জন্য। আজ আবারো কান্না করছে তার ভালোবাসার জন্য। এতো কষ্ট তার সহ্য হয় নি।
সেদিন একের পর গাছসহ গাছের টব ভেঙ্গে ফেলেছিলো সে। আজও রুমে এসে একটা কাচের টব ভাঙ্গলো। সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছে সে। রাগ কন্ট্রোল হচ্ছে না কিছুতেই। আজ আবরার যখন দীবার দিকে তাকিয়ে গান গাচ্ছিলো তখন তার রাগ হয়েছিলো। হিংসে হয়েছিল প্রচুর। সে জানে দীবা আবরারের স্ত্রী। তবুও মানতে কষ্ট হচ্ছে। দীবাকে কি সে কেড়ে নিবে? নাকি চুপচাপ মেনে নিবে সব? কিন্তু দীবাকে ছাড়া সে অসহায়। কিভাবে বেঁচে থাকবে সে? কিভাবে?
চলমান…