আষাঢ়ি_পূর্ণিমা #পর্ব_২০,২১ শেষ

0
1336

#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_২০,২১ শেষ
✍️ দিজা মজুমদার
২০

রাত্রি আচমকা নির্জীব হয়ে গেল। থমথমে বদনে সে মেঝেতে তাকিয়ে আছে। সাজ্জাদের সাথে কথা শেষ করেও ইব্রাহিম রাত্রির দিকে তাকিয়ে আছে। না, এ চেহারায় কোনো আগুন নেই যা পুরুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারে; ঝলসানো রূপের অধিকারীও রাত্রি নয়। তাহলে কী এমন আছে রাত্রির মাঝে? ইব্রাহিম হয়তো রাত্রির ভালোর জন্য তাকে নোংরা কথা শোনাত, কিন্তু এ মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে সত্যি নেশা হয়ে যায়। ইব্রাহিম গল্প-উপন্যাসে কখনো বিভোর হওয়ার লোক নয়। তবে জীবনানন্দ দাশের সেই বনলতা সেনের কথা সে শুনেছে যার চোখ না কি পাখির নীড়ের মতো। ইব্রাহিমের কানে জীবনানন্দ দাশের সে কবিতার লাইন প্রায়শই বেজে ওঠে,

পাখির নীড়ের মতো চোখ দু’টি তোমার— এ লাইন খুব বেশি মনে পড়ে, যখন রাত্রি তার চোখের চাহনিতে ইব্রাহিমের বুকে তোলপাড় সৃষ্টি করে। সত্যি তখন ইব্রাহিমের মনে হয়,

—আমি জীবনানন্দের বনলতা সেনকে দেখিনি, দেখিনি পাখির নীড়ের মতো চোখের অধিকারী কোনো রমণীকে। কিন্তু আমি তোমাকে দেখেছি রাত্রি যার চোখের তারা আমার বুকের ভেতর ভাঙচুর করে সারাবেলা।

এতক্ষণ ধরে ইব্রাহিম রাত্রির দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু এ মেয়ে একটিবারও চোখ তুলে দেখল না; দেখল না সুদর্শন এক যুবকের চোখে তাকে দেখার ব্যাকুলতা। হঠাৎ আদীর কথা মনে পড়তেই ইব্রাহিম নিঃশব্দে হেসে ওঠল। বিষাদের হাসিতে তার মুখের আকাশ বদলে যেতেই সে রাত্রির থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। ভাবল,

—শালা! আমার চেয়ে হ্যান্ডসাম নয়। না আছে ভালো চাকরি আর না আছে শিক্ষাগত যোগ্যতা অথচ…

ইব্রাহিম হঠাৎ তার ভাবনা থামিয়ে দিলো। সে বুঝতে পারছে সে আদীকে হিংসা করছে তাও রাত্রির মতো একটি মেয়ের জন্য যার না আছে বাপের টাকা আর না বিশ্বসেরা রূপ।

—ইব্রাহিম?

নিজের নাম শুনতে পেয়ে ফিরে তাকাল ইব্রাহিম। আদীর বন্ধু সাজ্জাদ এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি হতেই ইব্রাহিম হ্যান্ডশেক করে বলল,

—এবার একে বুঝিয়ে বলুন। আদীর মতো এ-ও আমার সাথে মারপিট করছে।

ইব্রাহিমের কথা শুনে সাজ্জাদ অবাক হাসি হেসে রাত্রিকে জিজ্ঞাসা করল,

—এটি কি সত্যি রাত্রি?

রাত্রি সাজ্জাদকে চেনে, কিন্তু সাজ্জাদের সাথে ইব্রাহিমের কবে সম্পর্ক হলো সেটিই সে ভাবছে। আর ভাবছে বলে কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। রাত্রির নীরবতা দেখে সাজ্জাদ এগিয়ে এসে রাত্রিকে বোঝাতে শুরু করল,

—রাত্রি, আমিই ইব্রাহিমকে বলেছিলাম তোমাকে সব খুলে বলতে। কিন্তু তুমি মনে হচ্ছে শুনতে চাচ্ছ না। তাই আমি…

রাত্রি হঠাৎ সাজ্জাদকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

—আপনি তো আদীর বন্ধু। আপনার বন্ধু আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে লড়ছে আর আপনিও আমাকে আটকে রেখেছেন? আপনারা কি চাইছেন বড়ো অঘটন ঘটার আগে আমি যেন আদীকে দেখতে না পারি?

—রাত্রি তুমি ভুল…

সাজ্জাদ কিছু বলতে চাইল, কিন্তু এবারও বাঁধা প্রাপ্ত হলো। ইব্রাহিম তাকে বলল,

—সাজ্জাদ স্যার, একে আদীর কাছেই বরং নিয়ে যান। লা””শ দেখে যদি এর হুঁশ ফেরে।

—লা””শ মানে?

হতভম্ব হয়ে গেল রাত্রি। কিন্তু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সাজ্জাদ পা বাড়িয়ে বলল,

—এসে আমাদের সাথে।

—লা””শ কেন? কী হয়েছে আদীর? আপনারা…

রাত্রি কেঁদে দিলো প্রায় আর এসব দেখে ইব্রাহিম বিরক্ত হয়ে বলল,

—ধ্যাৎ! কিছু হলেই কান্নাকাটি। এসব কাঁদাকাটি একদম সহ্য হয় না। চুপচাপ চলো নয়তো…

রাত্রি আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপই সাজ্জাদ এবং ইব্রাহিমকে অনুসরণ করতে লাগল। প্রায় পাঁচ মিনিট আকাশ সমান কান্না চেপে যখন একটি রুমে এসে সবাই থামল, তখন বিছানা থাকা আদীর নিথর দেহের কাছে ছুটে গিয়ে রাত্রি মরাকান্না জুড়ে দিলো। রুমে যে নিজের আব্বা আম্মা এবং আদীর আব্বা আম্মা আছে তা রাত্রি তোয়াক্কা করল না। সবাই হঠাৎ রাত্রিকে দেখে চমকে গেলেও পিছন থেকে সাজ্জাদের করা ইশারা কিচ্ছুটি বলল। সাজ্জাদ আবারও ইশারা করতে আদীর এবং রাত্রির আব্বা আম্মা রুম ছেড়ে চলে গেল। এদিকে রাত্রি কেঁদে চলেছে আর আদী লা””শ হয়ে পড়ে আছে। হঠাৎ সাজ্জাদ চলে এলো আদীর বিছানার কাছে তারপর বলল,

—আদী ওঠ। সবাই বাইরে চলে গেছে।

সাজ্জাদের এমন কথা শুনে রাত্রির কান্না আচম্বিতে থেমে। রাত্রি মেঝেতে বসে সাদা বিছানায় মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। এখন অশ্রুভেজা চোখে সাজ্জাদকে দেখছে আর তার কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছে। এরমধ্যে আদীকে ওঠে বসতে দেখে রাত্রি সমস্ত ভাবনা ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে আদীকে জড়িয়ে ধরল। আবারও সে মরাকান্না জুড়ে দিয়ে বলতে লাগল,

—আদী! আমি… আমি…

রাত্রি প্রাণপণে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু কান্নার বেগ এত বাড়ছে যে কিছুই মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। আদী রাত্রিকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিয়েছিল। এখন হাতের বাঁধন শক্ত করে রাত্রির সুরেই বলল,

—আমি তোমাকে ভালোবাসি।

মাত্র তিনটি শব্দের জাদুকরী ছোঁয়া রাত্রির কান্না যেন রোধ করল। আদীকে হারানোর যে যন্ত্রণা রাত্রি এতক্ষণ ধরে অনুভব করছিল তা এখন সরে যাচ্ছে একটু একটু করে। সমস্ত ব্যাকুলতা মনের আকাশ থেকে সরে গিয়ে সেথায় লজ্জার বৃষ্টি নামছে আর এতেই রাত্রি গুটিয়ে যাচ্ছে।

—রাত্রি?

আদীর ডাকে রাত্রি সাড়া দিলো না। লজ্জার অদৃশ্য জালে আবদ্ধ হয়ে থাকলে কি আর উত্তর দেওয়া যায়? আদীও বুঝতে পারছে আর দেখতে পারছে পাশে দাঁড়িয়ে সাজ্জাদ মিটমিট করে হাসছে। এতে আদীও নিজের মাঝে লজ্জা অনুভব করছে। কিন্তু বহু প্রত্যাশিত ব্যক্তিটি যখন নিজের বুকেই মাথা গুঁজে দেওয়ার ঠাঁই খুঁজে নেয়, তখন কী লজ্জাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায়?

—রাত্রি, কেমন আছ?

আবারও আদী প্রশ্ন করল। এ প্রশ্নের উত্তরে রাত্রি আবারও নীরব হয়ে রইল, কিন্তু আদী ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসল। লজ্জা জড়ানো চোখ নামিয়ে রাখল। এদিকে তাদের এসব কাণ্ড দেখে ইব্রাহিম অস্থিরতা প্রকাশ করে বলল,

—আদী, আগে আমার বিষয়টি রাত্রিকে ক্লিয়ার করে বলুন। আমি ঠিক শান্তি পাচ্ছি না। তাছাড়া ও আমাকে চড়ও মেরেছে। আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের এমন সাহস হয়নি। আমি ঠিক নিতে পারছি না বিষয়টি।

ইব্রাহিমের কথা শুনে আদী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,

—সত্যিই চড় মেরেছে?

—ভাই, এত অবাক হবেন না। এ হলো ধানিলঙ্কা। এমনিতে চুপচাপ, কিন্তু ক্ষেপে গেলে যাচ্ছেতাই করে বসে।

আদীর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। তবে সেটি প্রকাশ করে সে ইব্রাহিমকে বলল,

—ওর হয়ে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। আমিও তো আপনাকে মেরে…

—না না, ক্ষমা চাইতে হবে না। আপনি শুধু আমার বিষয়টি ক্লিয়ার করুন। আমাকে একটু পরেই যেতে হবে।

—ঠিক আছে। আমি বলছি।

এ বলে আদী এবার রাত্রিকে বোঝাতে শুরু করল,

—রাত্রি, আমি যা বলছি মন দিয়ে শোনো। স্বর্ণালির আত্ম””হ””ত্যা পিছনে জড়িত ব্যক্তিদের ধরা হয়েছে। এমনকি তাদের বিচার কাজ চলছে।

—আমি পত্রিকায় দেখেছি। ঢাকা মেডিক্যালের এবং স্কয়ারের দু’জন বড়ো ডাক্তারের নোংরামি স্বীকার হয়েছে স্বর্ণালি আর তাদের সাথে জড়িত ছিল তোমার বন্ধু জহিরও। তোমার বাড়ির পাশের যে মেয়েটি আত্ম””হ””ত্যা করেছে তার পিছনে জহিরের হাত ছিল।

—হ্যাঁ, মূলত জহির বিভিন্ন ছেলেদের ছবি ব্যবহার করে ফেসবুকে প্রেম করত। এরপর কোনো মেয়ে অসুস্থ হলে তাকে চিকিৎসার জন্য হয় ঢাকা মেডিক্যালে নয়তো স্কয়ারে যাওয়ার কথা বলত। এরপর তারা সেখানে চেক-আপ করতে গেলে অজ্ঞান করে তাদের ভিডিয়ো তৈরি করা হতো। ভিডিয়ো দেখিয়ে যখন ব্ল্যাকমেইল করত, তখন মেয়েগুলো আত্মসম্মানের ভয়ে আত্ম””হ””ত্যা করত। তবে এমন ঘটনা বেশি ঘটত বিভিন্ন লেডিস্ বোডিঙে। সেই বোডিঙের সাথে জহির সহ অন্য দুই ডাক্তারের যোগাযোগ ছিল। ফলে মেয়েগুলো মারা গেলেই তাদের হাতে লা””শ তুলে দিতো আর তারা ভোগ করে…
(চলবে)

#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_শেষ
✍️ দিজা মজুমদার

আদী ঘৃণায় আর কথা বাড়াতে পারল না। ওকে আচমকা থেমে যেতে দেখে সাজ্জাদ এবার বলতে শুরু করল,

—এরপর পালা করে দুই ডাক্তার যথাক্রমে রফিক আর সাইফুল ভোগ করত আর সঙ্গী হতো জহির। জীবিত অবস্থায় জহির ভোগ করত আর মৃত লা””শকে ভোগ করত সাইফুল। এদিকে রফিকের এসবে নেশা নেই। সে মানুষের মগজ খেতে ভালোবাসত। ফলে তিনজনে চুক্তি করে এসব কাজ করত৷ এদের তিনজনের কীভাবে সাক্ষাৎ হলো সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এদের রহস্য উদঘাটন করা সহজ হতো না যদি ইব্রাহিম সাহায্য করত।

ইব্রাহিমের নাম শুনে চমকে তাকাল রাত্রি। তার চোখে অবিশ্বাসের ছায়া দেখে সাজ্জাদ মাথা নাড়িয়ে বলল,

—হ্যাঁ, ইব্রাহিমের সাহায্যে আমরা এদের ধরতে পেরেছি। ইব্রাহিমের শিক্ষক ছিল রফিক। ছাত্র অবস্থায় স্যারকে সন্দেহ করার কারণে ওকে কঠিন শাস্তি পেতে হয়েছিল। এমনকি ডাক্তার হিসাবে যখন হাসপাতালে যোগ দিলো, তখন নিজের প্রেমিকাকে তাদের হাতে বলী হতে দেখল।

এমন করুণ কাহিনি শুনে রাত্রির মন যেন নিজের অজান্তেই কেঁদে ওঠল। এ প্রথম রাত্রি ইব্রাহিমের দিকে মায়ার দৃষ্টি দিলো। ইব্রাহিম মুগ্ধ হয়ে সে দৃষ্টি নিজের অন্তরে সঁপে নিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। এদিকে সাজ্জাদ বলে গেল,

—ছন্দার সাথে ইব্রাহিমের পরিচয় হয় কলেজ জীবনে। একে অপরকে কবে ভালোবাসতে শুরু করে তা তারাও জানত না। তবে ইব্রাহিমকে ডাক্তার হিসাবে দেখার জন্য মেয়েটি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছিল। কিন্তু ভাগ্য মেয়েটির সাথে কেমন প্রতারণা করল। মৃত্যু আগে এবং পরে তাকে…

—সাজ্জাদ স্যার, ওর কথা আর নাই বা বললেন। আশা করি সব শোনার পর রাত্রি আর আমাকে ঘৃণা করবে না। আমি ছন্দাকে আজও ভালোবাসি। তাই অন্য মেয়েকে বউ করতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু এ কথা আমার বাপকে বোঝাতে পারিনি। ব্যর্থ হয়ে এ পথ অবলম্বন করেছিলাম। জানি এমন নোংরা পথ বেছে নিয়ে আমিও ছোটো মনের পরিচয় দিয়েছি। কিন্তু এতদিনে যে শাস্তি আমি তাদের দিতে পারিনি। আজ তারা তা পাচ্ছে বলে আমার বুকের ওপর থেকে সমস্ত বোঝা হালকা হয়ে গেছে। ছন্দার সাথে এমন হওয়ার পর আমি সবটুকুই জেনে ফেলেছিলাম, কিন্তু তারা বলেছিল পুলিশের কাছে মুখ খুললে ছন্দার লা””শ আমার হাতে দিবে না৷ তাই আমি বিবেক বিক্রি করেছিলাম তাদের কাছে। আমার বিবেকের বিনিময়ে তারা ছন্দার লা””শ তুলে দিয়েছিল আর আমি সেখান থেকে চলে এসেছিলাম। পত্রিকায় একের পর এক ঘটনা দেখেও চুপ করেছিলাম। কিন্তু জহির শেষ যে মেয়েটির সাথে কাণ্ড করল সেটি আমি আর নিতে পারিনি। তাছাড়া স্বর্ণালির ব্যাপারে জেনেও ভাবলাম, ছন্দা তো এখন আর নেই। আমার হারানোর মতোও কিছু নেই। তাহলে চুপ করে থেকে আর কী হবে? এরপর সাজ্জাদ স্যারের সাথে দেখা করে সব বলি। তার সাথে দেখা করে ফেরার পথেই আদীর সাথে দেখা হয় আর আদী…

আদী এতক্ষণ চুপ ছিল এবার ইব্রাহিমের মুখ থেকে কথা কেঁড়ে নিয়ে বলল,

—ভুল বুঝে মারপিট করি এবং আপনাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিই। আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি। আসলে রাত্রির হঠাৎ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া আবার সে চিঠি…

—কিন্তু তোমার তো আইসিইউতে থাকার কথা।

হঠাৎ রাত্রির এমন কথায় আদী ভড়কে গেল আর ইব্রাহিম হালকা হেসে বলল,

—নিন আদী। এবার ধানিলঙ্কাকে সামলান। আমি আর সাজ্জাদ স্যার বরং আসি৷

এ বলে ইব্রাহিম সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

—চলুন।

—আদী, ধরে রাখিস।

সাজ্জাদ আদীর কাঁধে হাত রেখে রাত্রিকে ইঙ্গিত করে কথাগুলো বলল। এরপর ইব্রাহিমকে নিয়ে রুম ছেড়ে দিলো। ইব্রাহিম রুম ছাড়ার আগে রাত্রিকে মন ভরে একবার দেখে নিলো; দেখো নিলো এমন এক রমণীকে যে কিনা তার থমকে যাওয়া বুকে ক্ষণিকের জন্য তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল।

—কী হয়েছিল তোমার? আর এসব কী?

সবাই চলে যেতে রাত্রি আবার প্রশ্ন করল। আদী অপরাধী মুখ করে মিটমিট হাসছে আর ধীরে ধীরে রাত্রির ডান হাত দুই হাতে চেপে ধরে বুকের বাঁ পাশে রেখে দিলো। এরপর গাঢ় গলায় জিজ্ঞাসা করল,

—কিছু অনুভব করছ?

—তোমার হৃৎস্পন্দন।

বিনা প্রতিক্রিয়ায় রাত্রি উত্তর দিয়েছে বলে আদী সন্তুষ্ট হতে পারল না। ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে বলল,

—তুমি চলে যাওয়ার পর এখানে বড়ো ব্যথা হতো। ব্যথায় রাতে ঘুম হতো না। প্রতি মুহূর্তে তোমাকে হারানোর বেদনায় আমি জিন্দা লা””শ হয়ে দিনাতিপাত করতাম। এমন করে চলে গেলে যে তোমাকে খুঁজে বের করার পথও আমি…

আদী থেমে গেল। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে যখন আবার বলতে চাইল, তখন রাত্রি বলল,

—তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না।

—বাসি না কে বলল?

—তুমি বলেছ, বুশরা বলেছে আর…

—আর?

—আর আমার মন বলেছে।

—তোমার মন ভুল বলেছে রাত্রি। এই শোনো না, আজ না তোমাকে সব বলব। তুমি কি শুনবে?

হঠাৎ আদী কেমন বাচ্চাদের সুরে কথা বলে ওঠল৷ এতে রাত্রি হালকা হেসে ওঠলেও মিষ্টি স্বরে জবাব দিলো,

—শুনব।

—আমি হয়তো ছোট্টবেলা থেকেই তোমাকে ভালোবাসি। তবে ছোট্টবেলায় তো এসবের মানেই জানতাম না। কিন্তু স্কুল কলেজ পেরিয়ে এসে কিছু কিছু বুঝতাম। যখন ইউনিভার্সিটি শেষ হলো, তখনো তোমাকে মনের কথা জানাইনি। আমি তোমার আব্বাকে জানাই আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং বিয়ে করতে চাই। তিনি হালকা রাজি ছিলেন, কিন্তু তার ছোটো ভাই এ বিষয়ে দ্বিমত করল আর বলল, গুণ্ডার হাতে মেয়ে তুলে দিবে। ব্যাস! তোমার জীবন থেকে সরে যেতে লাগলাম। কিন্তু যাকে ভালোবাসি তাকে কি আর বন্ধু করে রাখা যায়? তাই তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করতে শুরু করলাম যেন তুমি আমাকে ঘৃণা করো। কিন্তু তুমি তো উলটো আমাকে ভালোবেসে ফেললে।

এ বলে আদী হেসে ওঠল আর রাত্রি লজ্জায় যেন গুটিয়ে গেল। এতক্ষণ ধরে রাখা রাত্রি হাত এবার ধীরে ধীরে মুখের সামনে এনে আদী জিজ্ঞাসা করল,

—রাত্রি, আজ যদি তোমার হাতের উলটো পিঠে প্রেম এঁকে দিই। তবে কি আপত্তি করবে?

রাত্রি জবাব দিলো না। লজ্জা মাখা বদনে নিঃশব্দে হেসে ওঠল৷ এ হাসিতে আপত্তি নেই তা আদী বুঝতে পারল। কিন্তু চট করে কিছু করার দুঃসাহস তার হলো না। হঠাৎ কালকে রাতের কথা মনে পড়তেই বলল,

—কালকে তোমার মেসেজ পেয়ে এত কষ্ট লাগল মনে যে সইতে পারিনি। এদিকে অনিয়ম করে প্রেশারের যাচ্ছেতাই অবস্থা। প্রেশার অনেক বেড়েছিল আর কালকে রাতে হঠাৎ সাজ্জাদ আমার বাসায় গেল। এসব অবস্থা দেখে ও নিজেই ইব্রাহিমের সাথে এসব পরিকল্পনা করল। তোমাকে খুঁজে বের করার চেয়ে তুমি যদি ছুটে আসো তাহলে ভালো হয় না?

প্রশ্ন করে আদী তাকাল রাত্রির দিকে। এদিকে রাত্রি এসব শুনে রেগে আছে। বাঁকা চাহনিতে সে জিজ্ঞাসা করল,

—এমন দুইনম্বরি কাজ তুমি করতে পারলে?

—আমি তো কিচ্ছু করিনি গো। আর এসব যদি না করতাম তবে তোমাকে কি পেতাম?

—আবার যে আষাঢ়ি পূর্ণিমা হবো না সেটি কেন ভাবছ?

—এবার আষাঢ়ি পূর্ণিমা হতে দিবো না আর যদি হতেও চাও তাহলে আমায় নিয়ে হবে। তোমার বাপ চাচাকেও সাজ্জাদ পটিয়ে ফেলেছে। সামনের সপ্তাহে বিয়ে আর…

হঠাৎ আদীকে থামিয়ে রাত্রি গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করল,

—আমাকে কখনো কেন বললে না তোমার মনে কথা? সরাসরি আব্বাকেই কেন জানালে? আমি যদি না বলতাম তবে কী…

—তোমার আমার সম্পর্কে আমি কখনো চাইনি ত্রিকোণমিতির ছোঁয়া লাগুল, চাইনি সম্পাদ্য আর উপপাদ্যের ন্যায় মেপে ঝেঁপে সম্পর্কের স্থায়ীত্ব আঁকতে, আমি সত্যিই চাইনি আমাদের অনুভূতিগুলোর পরিসংখ্যান করতে, চাইনি বীজগণিতের মতো বারংবার আমার অব্যক্ত অনুভূতি তোমার সম্মুখে প্রমাণ করতে। আমি তো চেয়েছিলাম সরল বাংলায় তোমার জীবনের সাথে মিশে যেতে; একাকার হতে কিংবা তোমার তরে মরে যেতে।

একটু থেমে আদী আবার বলল,

—রাত্রি, আমি তোমায় ভালোবেসে আষাঢ়ি পূর্ণিমা হতে চাই। সম্মতি দিবে?

শান্ত স্বভাবের রাত্রি আজও শান্ত রইল তার ভালোবাসার মানুষের সম্মুখে। তবে লজ্জায় রক্তিম মুখ নিয়ে বসে থাকা যে দায়। তাই সমস্ত লজ্জা পুঁজি করে জায়গা নিলো সে মানুষের বুকে, যে তার কথার জাদুতে ঘায়েল করছে অবিরত।

মনের আকাশে আষাঢ়ের ঘনঘটায় আজ ভেসে উঠল পূর্ণিমার একফালি চাঁদ। কত সহস্র আশঙ্কার ভিড়ে প্রেমের জয় হলো। জিতে গেল দু’টি মনের অব্যক্ত আর নিশ্চুপ ভালোবাসা।
(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here