#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_২,০৩
✍️ দিজা মজুমদার
০২
—আ… আমি…
রাত্রির কথা গলায় আটকে যাচ্ছে। ভয়ে তার হৃৎপিণ্ডে ছন্দের পতন হচ্ছে। অস্থিরতায় ক্রমশ নিজেকে অগোছালো লাগলেও রাত্রি চাইছে আদীকে কিছু বলে শান্ত করতে। কারণ রাত্রিসহ তার পরিবারের সবাই জানে, আদী বদমেজাজী ও উগ্র এবং তার উগ্রতা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।
রাত্রি ও আদী ছোটো থেকে একসাথে বড়ো হয়েছে। একই গ্রামের হাওয়া পানিতে বেড়ে উঠতে গিয়ে দু’জন দু’জনকে জেনেছে। কিন্তু ছয় মাস আগে রাত্রি বুঝতে পেরেছে, আদীকে নিয়ে তার জানাশোনার মাঝে যথেষ্ট কমতি আছে। আদীর ব্যাপারে সে অনেক কিছুই জানে না।
ছয় মাস আগের ঘটনা, তখন দিনের চতুর্থ প্রহর চলছে। কিন্তু গরম কমার নাম নেই বলে পাখার তলায় বালিশ পেতে রাত্রি শুয়েছিল। হঠাৎ হনহন করে আদী এসে ঘরে ঢুকে বলল,
—এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো। গরমে খুব অস্থির লাগছে। এত রোদ পড়ে রোজ! এমন হলে ব্লাডপ্রেশার কস্মিনকালেও আমার কন্ট্রোলে থাকবে না।
কথা শেষ করে আদী বিছানায় বসে পড়ল। এরপর দ্রুত হাতে তার শার্টের প্রথম বোতাম খুলে দিলো। ঘাড় থেকে শার্টের কলার নামিয়ে দিলো যেন পাখার বাতাস সরাসরি ঘাড়ে এসে পড়ে এবং তাকে শীতল করে দেয়। রাত্রি বসেছিল আদীর ঠিক পিছনে। হঠাৎ আদীকে দেখে চমকে গিয়েছে ফলে সে চট করে কোনো উত্তর দিতে পারল না। রাত্রির এখনো নামার কোনো নাম নেই। সে পিছন থেকে তাকিয়ে আছে আদীর দিকে। আদীর ভেজা পিঠের দিকে এক দৃষ্টিতে অর্থহীন তাকিয়ে রইল রাত্রি; সাদা শার্ট ঘামে ঝপঝপ হয়ে পিঠের সাথে লেগে আছে। এরপর সন্তপর্ণে নেমে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে বলল,
—ব্লাডপ্রেসারের পেশেন্ট হয়ে ভরদুপুরে বাড়ি থেকে বের হও কেন? রোদ পড়লে বের হতে পারো। এতে তো কোনো সমস্যা নেই।
আদী কোনো উত্তর দিলো না। ঢকঢক করে পানি পান করে গ্লাস ফিরিয়ে দিলো। এখন তার অনেকটা স্বস্তি লাগছে, কিন্তু রাত্রি এখনো উত্তরের প্রতীক্ষায় গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আদী ফোনে মেসেজিং করতে গিয়ে রাত্রিকে বলল,
—আম্মা পিঠা বানিয়েছেন। আমাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। তাই নিয়ে এসেছি। ব্লাডপ্রেশারই তো হয়েছে, কিন্তু তোমাদের সকলের ভাবখানা দেখে মনে হচ্ছে আমার ব্লাড ক্যানসার হয়ে গেছে। ক্যানসার হলে অবশ্য খারাপ হতো না।
এ কথা বলে আদী হেসে ওঠল; বিষাদের হাসি। রাত্রির এতে ভীষণ রাগ হচ্ছিল। ইচ্ছে করছিল আদীকে কোনো কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু সে কথা বলা তো দূর, ভাবার পূর্বেই আদী তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেল। একদম রেগে একাকার হয়ে নিম্ন শ্রেণির এক চতুষ্পদ জন্তুর বাচ্চার সাথে তুলনা করে একটি গালি দিলো। রাত্রি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখল, আদী ফোনে কাউকে গালি দিচ্ছে। দুই মিনিট আগেও মানুষটি শান্ত ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে কেমন উগ্র হয়ে গেল। রাত্রির সবকিছু এলোমেলো লাগলেও সে অযাচিত চিন্তা করতে লাগল। সে ভেবে পাচ্ছে না মানুষ রেগে গেলে কেন কুকুরের কথা মনে করে আর প্রশংসা করার সময় বাঘ/ সিংহের কথা। দুটিই তো চতুষ্পদ প্রাণী আর মাংস কামড়াকামড়ি করে দিনাতিপাত করে। একটি বনে থাকে তো অন্যটি লোকালয়ে। এখন বাঘ বনে থাকে বলেই সে বাহাদুর তাই মানুষের প্রশংসা করার সময় বলে, তুমি তো বাঘের বাচ্চা। তাহলে মানুষ পাগল হয়ে যখন বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, তখন তাকে বাহাদুর আখ্যায়িত করা হয় না কেন?
—কই আছস তুই? স্কুল মাঠে? দাঁড়া তুই। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আইতাছি।
আদী রেগে কথা বলে যাচ্ছে। ওপাশের মানুষটির কথা শুনে আবার বলে ওঠল,
—হ্যাঁ শালা, একাই আসমু। কোনো মায়ের পোলারে আমি ডরাই না।
অনেকে রেগে গিয়ে খুব ইংরেজি ঝারে, কিন্তু আদীর কথাবার্তা চট করে আঞ্চলিক ভাষায় নেমে আসে। আদী কল কেটে দিয়েছে। ঘামে ঝপঝপ করা শার্ট এখন কিঞ্চিৎ শুকিয়ে এসেছে। গৌর মুখে ঘামের জলরাশি এসেছিল তাও কিঞ্চিৎ মিলিয়ে গেছে। কিন্তু কপালের দিকের চুল এখনো ভিজে আছে। সে চুলে হাত চালিয়ে দ্রুত বের হওয়ার প্রস্তুত নিলো আদী। কিন্তু রাত্রি তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল,
—হঠাৎ কী হয়েছে তোমার? এমন উত্তেজিত হয়ে কোথায় যাচ্ছ? ভরদুপুরে বের হইয়ো না। তোমার গায়ের ঘাম এখনো শুকাইনি। অসুস্থ হয়ে পড়বে। একটু…
আদী দাঁত কিড়মিড় করে বলে ওঠল,
—সামনে থেকে সরে যাও। হারামজাদার কত্ত বড়ো সাহস আমাকে তুই করে বলে। আমাকে বলে দেখে নিবে।
নোংরা একটি গালি আদী আবার বলে ওঠল,
—এর যদি আমি বিহিত না করতে পারি। তবে আমি এক বাপের পোলা না। তুমি আমার সামনে থেকে সরে যাও।
রাত্রির ভয় করলেও সে সাহস করে আদীকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, কিন্তু তার কথা শোনার চেয়ে আদীর মাথায় স্কুল মাঠে গিয়ে কী কী করবে সে পরিকল্পনা বীজ বুনছে। রাত্রি কিছুতেই সামনে থেকে সরছে না। ফলে গর্জে উঠে আদী রাত্রিকে চড় দিতে উদ্ধত হলো। এতে রাত্রি হতভম্ব হয়ে গেল। একটি কথাও তার মুখ দিয়ে বের হলো না কেবল ছলছল নয়নে আদীর দিকে তাকিয়ে রইল। আদী চলে গেল আর তার পথপানে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না সংবরণ করল রাত্রি। অজস্র অভিমান এবং দুঃখ তাকে গ্রাস করলেও সে মনে মনে প্রার্থনা করল,
—হে আল্লাহ, আদীর যেন কিছু না হয়। তুমি ওকে দেখে রেখো, দেখে রেখো।
রাত্রির কথা আল্লাহ শুনেছেন। আদীর কিছু হয়নি, কিন্তু যাকে নিজের যোগ্যতা দেখাতে আদী ছুটে গিয়েছিল, তার অবস্থা খুবই করুণ করে আদী ছেড়েছিল সেদিন। এ ঘটনার পর রাত্রি জেনেছিল, তাদের গ্রামেরই কোনো এক ছেলেকে আদী কুকুরের মতো পি””টিয়ে ক্ষান্ত হয়েছিল। ও ছেলের অবস্থা এমন ভয়াবহ হয়েছিল যে তার পরিবার মনে করেছিল সে আর বাঁচবে না। ছেলেটির নাম ছিল ফুয়াদ। রাত্রি ছেলেটিকে কয়েকবার দেখেছিল ইউনিভার্সিটি যাওয়ার পথে। দেখে তেমন কিছুই মনে হয়নি, কিন্তু আদী তাকে মেরেছিল বলে ওর বড়ো মায়া হয়েছিল। ফুয়াদের পরিবার থেকে আদীর বিরুদ্ধে মামলা করার কথা ওঠেছিল। কিন্তু আদীর বাবা ফুয়াদের চিকিৎসার সমস্ত দায় মাথা পেতে নিয়েছিল এমনকি থানার বড়ো অফিসারকে পর্যাপ্ত উপহার দিয়ে মুখ বন্ধ করিয়েছে। এ ঘটনার পূর্বে রাত্রি শুনেছিল, আদী মারামারি করে। কিন্তু আদী অন্যের জীবনের মায়া না করেই মারপিট করে তা রাত্রির জানা ছিল না। তবে এ ঘটনার মাধ্যমেই সে জেনে গেছে এবং বুঝে গেছে, আদীকে তার জানা হয়নি; চেনা হয়নি।
—আমার সময় নষ্ট কইরো না, রাত্রি।
আদী দাঁতে দাঁত চেপে আবারও আঞ্চলিক ভাষায় বলছে, কিন্তু রাত্রি কিছুই যেন বলতে পারছে না। তবুও চেষ্টাচরিত্র করে বলল,
—আমাকে তুমি অবিশ্বাস করছ। আমার রাগ হচ্ছিল। তাই কল কেটে দিয়েছিলাম।
—চুপ। একটা কথাও আমি শুনতে চাই না। বুশরা এসব কইছে—এটা তুমি কইলেই আমার বিশ্বাস করা লাগবে? ওর মতো একটা ইনোসেন্ট মাইয়া যে তোমারে চিনেই না, সে তোমার ইউনিভার্সিটির খবর ক্যামনে পাইব?
—তাহলে তুমি বলতে চাইছ আমি মিথ্যা কথা বলছি?
রাত্রি বাকরুদ্ধ হয়ে গেল কারণ আদী তার কথা অবিশ্বাস করে ওই বুশরা নামক মেয়েটির কথা বিশ্বাস করছে। আদী শুধালো,
—কী কইতাছ তুমি?
রাত্রি কান্না চাপছে প্রাণপণে। কিন্তু কণ্ঠ ভিজে আসছে কথা বলতে গিয়ে,
—আমি কিছুই বলছি না। কিন্তু পুরো পৃথিবীর এত এত মানুষের মাঝে আমাকেই সবার মিথ্যাবাদী কেন মনে হয়? আমি তো কোনোদিন সজ্ঞানে মিথ্যা কথা বলি না, কারো অমঙ্গলও চাই না। তাহলে আমার সাথেই…
রাত্রিকে থামিয়ে দিয়ে আদী বলে ওঠল,
—রাতবিরেতে এমন আজাইরা কান্না আমার ভালো লাগতাছে না। তোমার যদি মনে হয় সবাই তোমারে মিথ্যাবাদী মনে করে। যদি মনে হয় তোমার কথাই ঠিক আর বুশরা ভুল। তাহলে আমার সাথে সম্পর্ক রাইখো না। তোমাকে কেউ জোর করতাছে না সম্পর্ক রাখার জন্য। ফোন রাখলাম আমি। এসব আলগা পিরীতি মার্কা কথা শোনার খায়েশ এখন আর নাই। প্রেশারের ওষুধ খেয়ে ঘুম দিতে হইব। রাখলাম।
(চলবে)
#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_৩
✍️ দিজা মজুমদার
আদী ফোন রেখে দিয়েছিল। রাত্রি অবশ্য কোনো বাঁধা দেয়নি কারণ সে অবস্থা তার ছিল না। মেয়েটি নিঃশব্দে কেঁদে ওঠেছিল এবং মনে মনে একটি কথাই ভেবেছিল,
—এ পৃথিবী দিনের পর দিন আমাকে পর করে দিচ্ছে কেন?
দুপুরের দিকে রাত্রি গোসল সেরে বের হতেই ফোনের রিংটোন শুনেছিল এবং ফোন না দেখেই বুঝতে পেরেছিল, এটি আদীর কল। রাত্রি খুশি হয়নি; চিন্তায় আঁতকে ওঠেছিল,
—এখনো কি ঝগড়া করতে তুমি ফোন করলে আমায়?
এমন ভাবনা মনে পুষে রেখে রাত্রি কল রিসিভ করেছিল এবং তার মনের ভাবনাই বাস্তবে রূপ নিয়েছিল। আদী তার কণ্ঠে হ্যালো শুনেই গর্জে ওঠেছিল,
—এতক্ষণ লাগে তোমার কল রিসিভ করতে? থাকা হয় কোথায়?
এমনই কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে অসহ্য হয়ে রাত্রি শক্ত গলায় আদীকে জানিয়ে দিয়েছিল, সে আর তার মুখোমুখি হতে চায় না। কিন্তু এ কথা বলে সে একটুও শান্তি পাচ্ছে না। তাই তো সবার চোখের আড়ালে এ ভরদুপুরে অঝোরে কাঁদছে।
*
দোতলা বাড়ি। প্রধান ফটক পেরিয়ে এলেই বাড়িটি সবার প্রথমে নজরে আসে। বাড়ির রঙটা কেমন মেড়মেড়ে। অবশ্য রঙের নামটি আন্দাজ করতে পারছে না ইব্রাহিম। রঙ নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই, কিন্তু বাড়িটি বিয়ের পর তার ভাগ্যে কতটুকু জুটবে সেটিই হলো চিন্তার বিষয়।
পাত্রী পছন্দ না হওয়া সত্ত্বেও গ্রামে বিয়ে করতে হচ্ছে তাকে স্রেফ সম্পত্তির জন্য। রাত্রি তার আম্মা আব্বার একমাত্র সন্তান হলেও তার চাচাতো ভাইবোন আছে দু’টি এবং এ বাড়িটি তার আব্বার একার তৈরি নয়। দুই ভাই মিলে এ বাড়ি দাঁড় করিয়েছে এমনকি নয়াবাজারে রাত্রির আব্বার যে কাপড় তৈরির কারখানা আছে সেটিও তার চাচার সাথে শরিক হয়ে চালানো হচ্ছে। এসব তথ্য অবশ্য মকবুল ঘটক তাকে এবং তার বাবাকে দেয়নি। ফলে তিন দিন আগে ঘটককে বাড়ি ডেকে নিয়ে মনের সুখে কথা শুনিয়ে দিয়েছিল তার বাবা।
ইব্রাহিমের পারিবারিক অবস্থা তেমন সুবিধার নয়। বহুকষ্টে ডাক্তারি পাশ করে কেবলই চেম্বার নিয়ে বসেছে। তবে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন কারণ কোনো এক জাদুর ছোঁয়ায় সে বড়ো হাসপাতালেই নিজের গদি বুঝে নিতে পেরেছে। এখানে অবশ্য তাকে একজন খুব সাহায্য করেছে, কিন্তু এখন ভাবী শ্বশুর বাড়িতে বসে ইব্রাহিম সেই মানুষটিকে মনে করতে চায় না, ভাবতেও চায় না।
চা-নাস্তা ধীরেসুস্থে টেবিলের ওপর রেখে ময়না বেগম শুধালেন,
—তোমার বাড়ির সবাই ভালো আছে?
প্রশ্ন করেই চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন। ইব্রাহিমের মনমেজাজ ভালো না থাকা সত্ত্বেও সে চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
—হুঁ।
এমন ছোট্ট উত্তরে ময়না বেগম খুশি না হলেও সেটি অপ্রকাশিত রেখে ইব্রাহিমের মুখোমুখি বসলেন। নিজেই আবার কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে বললেন,
—রাত্রির আব্বা বাড়ি নেই। নয়াবাজারে গেছেন। মেশিন না কি একটা নষ্ট হয়ে গেছে। লোক দিয়া ঠিক করতে হবে। রাত্রির চাচাও বাড়ি নাই নয়তো সে সব করতো।
ইব্রাহিম কিছু বলছে না। চোখ নামিয়ে এক মনে চা শেষ করে যাচ্ছে। সে এসেছিল মোশাররফ হোসেনের সাথে বোঝাপড়া করতে। পাত্র হলেও তার চক্ষুলজ্জা আর আট দশটা ছেলের চেয়ে কম। আর এখানে সে লজ্জা কেন পাবে? পাত্রীর রূপ মোটেও রাজকন্যার মতো নয় আর তার আব্বার যা অবস্থা। এতে সমাজে ইব্রাহিম মাথা তুলে চলতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। অথচ বিরাট ধনী পরিবার থেকে তার জন্যে বিয়ের সম্বন্ধ আসছে। এই তো সেদিন, এক পরিবার থেকে তার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব এলো। পাত্রীর বাবার দুইটা তিনতলা বাড়ি আছে। কারখানার সংখ্যা ইব্রাহিম জানে না। তবে পাত্রী না কি নিজের গাড়ি ছাড়া কোথাও যায় না। তাই ইব্রাহিমকে বলেছে বিয়েতে একটি সাদা রঙের গাড়ি উপঢৌকন হিসেবে দেওয়া হবে। মোশাররফ হোসেন অবশ্য মোটরসাইকেল দেওয়ার কথা বলেছেন। তবে সেটিও ইব্রাহিমের বাবা অনেক করে বলেছেন বলে রাজি হতে বাধ্য হয়েছেন।
—আমি রাত্রিকে ডেকে দিই? তুমি ওর সাথে কথা বলো। এরমধ্যে ওর বাবা নিশ্চয়ই এসে পড়বে।
ইব্রাহিম এবারও পূর্বেকার সেই ভঙ্গিতে চা পান করছে আর মুখে তালা সেঁটে বসে আছে। ময়না বেগম এবার বেশ হতাশ হলেন এবং সেটি প্রকাশও করলেন ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেলে। তবে সময়ের খরচ না করে রাত্রির ঘরে চলে এলেন।
রাত্রি একমাত্র মেয়ে বলে ময়না তার মেয়েকে নিয়ে বড়ো বেশি চিন্তিত। মেয়েটি চাপা স্বভাবের। ময়নার কাছে মাঝেমাঝে মনে হয়, তার মেয়ের হয়তো কথা বলার শক্তিটিই নেই। কারণ বিয়ে ঠিক হওয়ার পরও সে মুখ ফুটে একটি কথাও বলেনি। মেয়েটি আগে এমন ছিল না। ছোট্টবেলার একটি ঘটনা তাকে এমন করে দিয়েছে— এ নিয়ে তিনি মেয়েকে অনেক বুঝিয়েছেন। কিন্তু তাতে মেয়ের মাঝে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
আজকে সারা দুপুর মেয়ের নিশ্বাসও তিনি টের পাননি। খাওয়ার সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর তিনি ঘরে এসে দেখেন, মেয়েটি বালিশের ওপর চিৎ হয়ে আছে। ডাক দেওয়ার কথা চিন্তা করেও ডাকতে পারেননি। একটি অদৃশ্য দূরত্ব তার আর তার মেয়ের মাঝে কবে সৃষ্টি হয়ে গেছে তা ময়না বেগম নিজেও জানেন না।
—রাত্রি?
রাত্রি ঝিম মেরে বিছানায় বসেছিল। ইব্রাহিম এসেছে সেজন্যে তার মনে এখন হাজার চিন্তা আসাযাওয়া করছে। কিন্তু সেটি তার আম্মাকে বোঝাতে চায় না। তাই দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে তাকাল সে।
—ইব্রাহিম এসেছে। তোমার আব্বা তো বাড়ি নেই। তুমি গিয়ে গল্পগুজব করো। ছেলেটা একা বসে থাকবে— এটা কেমন দেখায় না?
রাত্রি কিছু বলল না। চাপা অভিমানে চোখ নামিয়ে নিলো। মেয়ের নরম মুখ দেখে ময়না বেগমের কী যেন হলো। মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বললেন,
—আমার ক্ষমতা থাকলে আমি তোমার আশা অপূর্ণ রাখতাম না, মা। তোমার আব্বার শরীরও ভালো যাচ্ছে না; ব্যবসায় মন্দ। এখন তোমার চাচা আমাদের পাশে না দাঁড়ালে আমাদের কী হতো একবার চিন্তা করো। আমরা মেয়ে হয়ে জন্মেছি দাসীবাঁদী হতে। আমারও কি কম সাধ ছিল? কিন্তু আম্মা আব্বা আমাকে…
ময়না বেগম আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে কেঁদে ওঠলেন। এতেও রাত্রির মাঝে নড়নচড়ন হলো না। মাথা নিচু করে সে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। আম্মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই। অন্যের চোখের জল নিজের চোখেও জল আনে। কিন্তু যার চোখের জল আগেই ফুরিয়ে গেছে তার চোখে জল নয়, না পাওয়ার হাজারো বেদনা লাল হয়ে ভাসে।
*
চা শেষ। এখন বেলের শরবত খাচ্ছে ইব্রাহিম আর আঁড়চোখে রাত্রিকে দেখছে। সমুখে ঘোমটা মাথায় বসে অহেতুক হাত কচলাতে ব্যস্ত রাত্রি। রাজকন্যা নয় বলে যাকে বিয়ে করতে চায় না। এখন সমুখে তাকে দেখেই ইব্রাহিমের চোখ ছোটো হচ্ছে। ডাক্তার হওয়ার আগে এবং পরে অসংখ্য মেয়েকে সে কাছ থেকে দেখেছে। কত ফরসা মেয়েকে দেখে তার চোখ টাটিয়েছ, কিন্তু এ শ্যামলা মেয়ে রাত্রিকে দেখে তার অন্য রকম কেন লাগছে? তার মন কেবল একটি কথা জানতে চাইছে,
—কী আছে এর মাঝে? চাপা রঙের মেয়েদের সৌন্দর্য বলতে কিছু আছে!
ছিমছাম সুন্দর শারীরিক গঠন রাত্রির। গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও তাকে শ্যামলা বলা চলে না। মাঝেমধ্যে বেশ ফরসা দেখায় তাকে বিশেষ করে নীল অথবা খয়েরী রঙের পোশাকে। একবার তো আদী তাকে বেশ গাঢ় গলায় বলেছিল,
—তোমায় খয়েরী শাড়ি কিনে দেওয়া উচিত নতুবা নীল শাড়ি।
রাত্রি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল,
—কেন?
—রঙ দু’টি যে তোমার জন্যে সৃষ্টি। পরলে দেখবে সবার মাথা ঘুরে গেছে। সামান্য থ্রিপিস পরলেই অন্য রকম লাগে।
রাত্রি সেদিন কিছু বলেনি। স্বভাবতই চুপচাপ ছিল। ফলে আদী নিজেই বিষয়টি এড়িয়ে গেছে।
—তখন থেকে মোচড়ামুচড়ি করছ কেন?
ইব্রাহিম বেশ ঝাঁঝ নিয়ে প্রশ্ন করল। কারণ রাত্রি যে এখানে বসে থাকতে চাইছে না সেটি তার মুখে স্পষ্ট হয়ে ভাসছে। রাত্রির মুখের বিরক্তি ভাবের ফলে ইব্রাহিম মনোযোগ দিয়ে রাত্রিকে অবলোকন করতে পারছে না। ফলে তার ভেতরে রাগ হচ্ছে এবং ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে কষিয়ে একটি থা””প্পড় দিতে। কিন্তু ইব্রাহিম নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানে। তাই তো উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞাসা করল,
—তোমার কি আমার সমানে বসে থাকতে অসুবিধা হচ্ছে?
রাত্রি এবারও চুপ। ফলে শরবতের গ্লাস রেখে ইব্রাহিম বলে ওঠল,
—নীল জামায় তোমায় সুন্দর লাগছে। আমার যদিও নীল রঙ পছন্দ না, কিন্তু তোমাকে দেখে চোখে নেশা…
ইব্রাহিম থেমে গেল কারণ তার চোখে চোখ রেখেছে রাত্রি। আর চোখাচোখি হতেই ইব্রাহিম হেসে ওঠল। তার হাসি দেখে রাত্রির কেমন যেন মনে হলো। এ হাসিতে স্নিগ্ধতা নেই; নেই কোনো প্রশান্তির ছোঁয়া। তার কেবলই মনে হচ্ছে এমন নোংরা হাসি সে আগে কখনো দেখিনি। এ হাসিতে অন্য কিছুর ইঙ্গিত আছে যা রাত্রির মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি করছে। এখান থেকে ওঠে যাওয়ার ইচ্ছে হলেও সে চোখ নামিয়ে চুপ করে রইল। ইব্রাহিম রাত্রির অপদস্ত মুখ দেখে পৈশাচিক আনন্দ পেয়ে এ প্রসঙ্গেই কথা বাড়াল,
—ছয় মাসে তোমাদের বাড়ি কতবার এলাম। একবারও শাড়ি পরে এলে না। তোমার কি উচিত না নিজের ভাবী স্বামীর সামনে সেজেগুজে আসা, তার মনের অতৃপ্ত বাসনা পূরণের চেষ্টা করা? না কি অন্য কারোর জন্য সব আঁচলের তলায় লুকিয়ে রেখেছ?
(চলবে)