আষাঢ় নামে সন্ধ্যে খামে-২

0
739

আষাঢ় নামে সন্ধ্যে খামে-২

দূর্বল পায়ে হেঁটে রুমে আসে আমিরাহ।দরজা লাগিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ায়। চোখ রাখে শূন্যে।শাড়ির আঁচলটা ফ্লোর ছুঁই,ছুঁই।খুব, খুব কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। এতো চেষ্টা করেও মন শক্ত করা যায়নি।আমিরাহ দু’হাতে মুখ চেপে কেঁদে উঠলো।রওশানের হুট করে ঘুম ভেঙ্গে যায়।কেনো জানি বুকে তোলপাড় হচ্ছে।কাঁথা সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। চোখ যায় বাম পাশের দেয়ালটায়।মনে হচ্ছে আমিরাহ এই দেয়ালের অন্য পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।রওশান দেয়ালের পাশে এগিয়ে আসে।এক হাত দেয়ালের উপর রাখে।আমিরাহর নিঃশ্বাস স্পষ্ট! কাঁদছে!রওশান দেয়াল ঘেঁষে ঘুরে দাঁড়ায়।চোখ দু’টি বেয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে।চোখের জল মুছে ব্যস্ত পায়ে হেঁটে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে।আবার উঠে বসে।কাঁথা,বালিশ নিয়ে হেঁটে আসে দেয়ালের পাশে।এরপর দেয়াল ঘেঁষে শুয়ে পড়ে।

আমিরাহর ঘুম ভাঙে রাজিয়ার ডাকে।চোখ খুলে দেখে সে দেয়ালের পাশেই ফ্লোরে ঘুমিয়ে পড়েছে।গলা ব্যাথা করছে।ঠান্ডা লেগে গেছে।ফ্রেশ হয়ে সময় দেখে, দুপুর দুইটা!নিজে নিজে বিড়বিড় করে,
— “এতোটা!”
দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে আসে।এসে দেখে সব রান্না শেষ। শেষ তো হবেই।এতো বেলা অব্দি কেউ না খেয়ে থাকবে নাকি।আমিরাহ রাজিয়ার রুমে আসে।অপরাধী স্বরে বলে,
— “সরি আম্মা।আরো সকালে ডাকতে পারো নাই।”
— “ফজর বেলা ঘুমাইছোস।সকালে কোন আক্কেলে ডাকবো।”
— “তবুও আম্মা।রান্না কি চুমকি করছে?”
— “হ।”
— “চুমকির হাতের রান্না তোমার ছেলে পছন্দ করে না।”
রাজিয়া তীর্যক ভাবে তাকান।বলেন,
— “ওই হারামজাদার কথা তুই ভাবিস না।”
আমিরাহ মুচকি হাসে।রাজিয়া আমিরাহকে টেনে পাশে বসিয়ে অভিমানী কন্ঠে বললেন,
— “চইলা যাবি এই মা রে রেখে?”
আমিরাহ উঠে দাঁড়ায়।কপট রাগ নিয়ে বললো,
— “এইটাই ফাইনাল ডিসিশন। বিকেলেই বের হবো।”
রাজিয়ার মুখ চুপসে যায়।তিনি প্রশ্ন করেন,
— “রাতের ট্রেনে যাবি?”
— “না।বাসে যাবো।”
— “বমি করিস তো বাসে।সামলাবে কে? তোর আব্বারে বলবো দিয়া আসতে?”
— “আব্বারে বলার দরকার নাই।একাই পারবো।বাকী জীবন টা তো একাই পার করতে হবে।”
রাজিয়া ফোঁস করে উঠেন।
— “যা। চলে যা।পরের মেয়ে তো। কেন শুনবি আমার কথা।আপন মা হলে এমনে কথা ফেলতে পারতি না।”
— “আম্মা কতবার বলছি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল না করতে।”
কথা শেষ করে আমিরাহ নিজ রুমে চলে আসে।অতিরিক্ত ভালবাসাও মাঝে মাঝে বিরক্ত মনে হয়।খুব বেশি।রাজিয়া পিছুন, পিছুন আসেন।আমিরাহকে বলেন,
— “আমার ভালবাসার দাম নাই?”
আমিরাহ কাপড় গোছাতে গোছাতে কেঁদে কেঁদে বলে,
— “শ্বাশুড়ি হয়ে কেনো এতো ভালবাসো।কি দরকার এতো ভালবাসার।ঠেকা পড়ছে আমার ভালবাসার?আমারে কি ভালবাসার আর মানুষ নাই?”
রাজিয়া আমিরাহর কথায় খুব কষ্ট পান।চলে যেতে নিলে আমিরাহ জড়িয়ে ধরে রাজিয়াকে।ঠোঁট টিপে কাঁদে।এরপর আফসোস করে বলে,
— “কেন তুমি বরের মা হলে আম্মা।আমার মা হতে পারলানা।”

আজ আষাঢ় মাসের প্রথম।দিন।আবহাওয়া প্র‍থম দিনই চেঞ্জ।মৃদু, মৃদু বাতাস।আকাশ পরিষ্কার। তবে, বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।আমিরাহ লাগেজ নিয়ে গ্যারেজে আসে।গাড়িতে ড্রাইভার নেই।রাজিয়াকে আমিরাহ জিজ্ঞাসা করে,
— “ড্রাইভার কই?”
রাজিয়া আমতা আমতা করে বলেন,
— “ও ছুটি নিছে।”
আমিরাহ বেশ বুঝতে পারছে তার শাশুড়ীর কাজ এটা।ভাগ্যিস শ্বশুর শফিউল্লাহ জানেন না সে যে চলে যাচ্ছে।শাশুড়ীকে খুব সহজে সামলানো গেলেও শ্বশুরকে সামলানো যায় না।এমন শ্বশুর – শাশুড়ী ছেড়ে যাওয়া কঠিন পরীক্ষাও বটে। যার উছিলায় এমন শ্বশুর – শাশুড়ী পাওয়া গেছে তার সাথেই যখন আর সম্পর্কটা ভালো নেই।এই বাড়িতে থাকার তো কোনো মানে নেই।আমিরাহর জেদ বরাবরই আকাশচুম্বী।আমিরাহ রাজিয়াকে বলে,
— “আম্মা ড্রাইভারকে কই পাঠাইছেন?”

রাজিয়া কাচুমাচু হয়ে এদিক-ওদিক তাকান।রওশানকে গ্যারেজে আসতে দেখে আমিরাহর চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।রওশান ড্রাইভিং সিটে বসে আমিরাহর উদ্দেশ্যে বলে,
— “আমার বাইরে কাজ আছে।বাস ষ্টেশনের পাশেই।যদি চাও….
আমিরাহ দরজা খুলে পিছনের সিটে বসে।রওশান গাড়ি স্টার্ট দেয়।রাজিয়া ছলছল চোখ নিয়ে বিদায় জানান হাত নেড়ে।আমিরাহ আড়চোখে একবার রওশানকে দেখে।কত ফ্রেশ লাগছে রওশানকে!লাগবেই তো। আপদ বিদায় হচ্ছে যে!
রওশান গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তার কোনো কাজ নেই।তবুও মিথ্যে অজুহাত দিয়ে আমিরাহর সঙ্গে যাচ্ছে।কেনো যাচ্ছে সে জানে না।আমিরাহ যখন সেদিন বললো, ডিভোর্স চাই।তখন এক সেকেন্ড ও সময় নেয়নি রওশান।সাথে সাথে উত্তর দেয়,
— ” আমিও চাই।”

এরপর থেকে রুমটাও আলাদা হয়ে যায়।পাঁচ – ছয় মাস আগে, সপ্তাহখানেক কোম্পানিতে লসের মুখোমুখি হতে হয় রওশানকে।তাই প্রতিদিন দেরি করে বাড়ি ফিরতে হতো।মেজাজ থাকতো খিটখিটে। ফলে, আমিরাহর কোনো অভিযোগ শুনলেই মেজাজ চটে যেতো। শুনিয়ে দিতো এক, দু’টো কথা।আমিরাহ বরাবরই খুব রাগী, জেদি টাইপের। সে ও তাল মিলিয়ে তর্ক করে যায়।এভাবেই দূরত্ব বাড়তে থাকে।প্রতিদিন ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়। আঘাত করে কথা বলা, অপমান করা, অতীত নিয়ে খোটা দেওয়া, রাতের পর রাত না খেয়ে থাকা,মানসিক অশান্তিতে ভোগা সব হয় কয়টা মাসে।এরকম সম্পর্কের শুরু থেকেই হয়।কিন্তু এবার যেন বেশি।কোনো ভাবেই দুজনের মিল হচ্ছিলো না।তাই রাগে একদিন আমিরাহ বলে ফেলে, ডিভোর্সের কথা।তাতে সায় দেয় রওশান।

গাড়ি চলছে তার গতিতে।দুজনের কেউ কথা বলছেনা।নিরবতা ভেঙে রওশান আগে বলে,
— “বিয়ে করবে নিশ্চয়ই?”
— ” করবো তো অবশ্যই করবো।তুমিও তো বিয়ে করবা অন্যকেউ কে।এজন্যই তো ডিভোর্স দিচ্ছো।”
— “অন্যকেউ টা কে?”
— “মেয়ে মানুষ। হিজরা অবশ্যই বিয়া করবানা?”
— “মুখ ভালো করো।এই মুখ খারাপের জন্যই সম্পর্কটা ভেঙে যাচ্ছে।”
— “আজীবন আমাকেই দোষ দিয়ে গেলা।”
— “দোষ আছে বলেই দেই।প্রতিদিন সন্দেহ করো, যাই হয়ে যাক মেয়ে নিয়ে আসো কথার মাঝে।আমাকে তোমার এতোই খারাপ মনে হয়। ষোল বছরেও চিনতে পারোনি আমাকে।বুঝতে চাও না আমাকে।”
— “যে বুঝবে তাকেই বিয়ে করোনা।”
— “আস্তে কথা বলো।এটা বাসা না।”
আমিরাহ গলার জোর বাড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠে,
— “তোমার মতো ছেলেরে ভালবাসা আমার জীবনের বড় ভুল। সেই প্রথম থেকে আমার জীবনটা নিয়ে খেলে আসতেছো।কখনো ভালবাসনি।”
— “কখনো ভালবাসিনি?”
— “না বাসোনি।”
— “এভাবে মিথ্যে বলো না।”
— “আমিই মিথ্যাবাদী-ই।যাও না মুক্ত করে দিচ্ছি তো।সত্যবাদী খুঁজে খুঁজে বিয়ে করো।”
— “আমার আরেকটা বিয়ের শখ নেই।”
— “শখ আছে না নেই বুঝি সেটা।বুড়ি হচ্ছি তো মন ভরে না আমাকে দিয়ে। কচি মেয়ে চাই কচি! তাইনা?”
রওশান যতটুকু সম্ভব রাগ কন্ট্রোল করে চাপা স্বরে বলে,
— “শাট-আপ।ফালতু কথা আমার সাথে জড়িয়োনা।”
— “আমি ফালতু তাই আমি ফালতু কথা বলি।ফালতু বিয়া করলা কেন?সতী দেখে বিয়ে করতে পারলানা?”
— “দেখো, আমি তোমাকে ফালতু বলিনি।”
— “বুঝাই গেছে কি বলছো।’
রওশান বুক ছিড়েখুঁড়ে রাগ বের করে দেওয়ার জন্য লম্বা করে নিঃশ্বাস ফেলে।এই মেয়ের সাথে কখনো কথায় সে পারেনি। আর পারবে ও না।বুঝতে পেরেও নিজের ভুল কখনো স্বীকার করে না।নিজ ইচ্ছায় সরি কখনো বলে না। আর মুখের ভাষা বরাবরই খুব খারাপ। অথচ,বহু সংখ্যক পাঠকের সামনে এই মেয়ে নিতান্তই একজন ভদ্র, শান্ত, বুদ্ধিমান, মানুষ। মানুষের কত রূপ! ষোল বছরের সম্পর্কে ভুল যারই হোক রওশান সরি বলে এসেছে।এবার সে ধীর প্রতিজ্ঞা করেছে, ডিভোর্স হলে হউক তবুও সে আগ বাড়িয়ে পা ফেলবেনা।ইগো, জেদ ভীষণ ভাবে কাজ করছে।

চলবে….
ইলমা বেহরোজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here