আসক্তি?Mr_Arrogant_4 #পর্ব_২৫

0
1400

#আসক্তি?Mr_Arrogant_4
#পর্ব_২৫
#Writer_Sanjana_Shabnam_Fahmid

আট বছর আগে,

ক্লাস শেষ হতেই কলেজ থেকে বের হয় রওশন। ডান হাত দিয়ে কাঁধে ব্যাগ বুঝিয়ে বাম হাত দিয়ে ফোন টিপতে টিপতে হাঁটছে ও। গাড়ির সামনে এসেই ফোনটা পকেটে রেখে দিয়ে গাড়ির দরজা খোলে রওশন। ব্যাগটা নামিয়ে সিটে রাখতেই হঠাৎ কেউ পেছন থেকে ওর কাঁধ জড়িয়ে ধরে।

রওশন কিঞ্চিত পরিমাণও বিচলিত হলো না কারণ ও জানে মানুষটি কে হতে পারে। এই পুরো কলেজে রওশনের এক মাত্র বন্ধু, আয়ুশ। হ্যাঁ একমাত্রই, কারন আয়ুশকে ছাড়া বন্ধু বলতে কেউই নেই রওশনের জীবনে।

এমন না যে কেউ রওশনের সাথে বন্ধুত্ব করতে চায় না, বরং এজন্য কারন রওশন কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়না।‌

রওশন নিতান্তই চুপচাপ স্বভাবের। কারো সাথে বাড়তি কথা বলা ওর একদমই পছন্দ না। সামনের মানুষদের একশোটা কথার উত্তরে রওশনের মুখ থেকে “ হু হা হুম না ” এই চারটা শব্দ বাদে অন্য কিছুই বের হয় না।

সবসময় ক্লাসের একদম শেষের জানলার পাশের সিটে একান্ত ভাবে বসে রওশন। ক্লাস শেষ হতেই কানে হেডফোন লাগিয়ে চুপচাপ জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে। আর ভুলেও কেউ কখনো রওশনকে ডিস্টার্ব করার চেষ্টাও করে না।

কিন্তু এতো গুলো মানুষের মধ্যে একজন আছে যে রওশনের নীরবতা ভঙ্গ করার সাহস রাখে। আর সেটা হচ্ছে আয়ুশ।

রওশন যতটা চাঁপা স্বভাবের আয়ুশ ততটাই খোলা মেজাজের। কিন্তু তবুও ওদের বন্ধুত্ব এতোটা গভীর যে মাঝে মধ্যে ওরাও অবাক হয় ভেবে, যে ওরা দুজন একে অপরের বিপরীত হয়েও এতটা গভীর বন্ডিং কিভাবে তৈরি করল।

আয়ুশ সবসময় ছায়ার মতো রওশনের পাশে থাকতে পছন্দ করে। আর একমাত্র আয়ুশই আছে যার সাথে রওশন মন খোলে কথা বলে।

রওশনের কাঁধ জড়িয়ে ধরে আয়ুশ, তারপর বলতে শুরু করে

“ ব্রো ডু মি আ ফেভর। বাবা আমাকে কিছু জিনিসপত্র আর টাকা ডেলিভার করার কাজ দিয়েছে। বাট আমার ডেট আছে, ক্যান্সেল করলে ব্রেকআপ নিশ্চিত।”

গাড়ির দরজা লাগাতে লাগাতে বলে রওশন, “ তো?”

“ তোকে আমার বদলে যেতে হবে এক জায়গায়।”

“কোথায়?” পেছনে ঘুরে প্রশ্ন করলো রওশন আয়ুশকে।

“ অর্ফ্যান’এজ”

নামটা শুনেই কপাল কুঁচকালো রওশন। এই জায়গাটা ওর একদম পছন্দ নয়। ওখানে গেলে ও যে স্মৃতি গুলো ভুলে যেতে চায় সেগুলো একদম তাজা হয়ে উঠে‌। হুম স্মৃতি, ওর বাবা মায়ের স্মৃতি। ওখানের বাচ্চাদের মধ্যে ও নিজেকে দেখতে পায়।

তারা যেমন অনাথ আজ রওশনও তেমনি পরিস্থিতিতে আছে। এই অনুভূতিটা অসহ্যকর লাগে রওশনের। ওর মেনে নিতে কষ্ট হয়।

“আমি যাচ্ছি না কোথাও। ” কথাটা বলেই রওশন ঘুরে গাড়ির ড্রাইভিং সিটের দিকে যায় কিন্তু আয়ুশ দ্রুত কদমে ওর সামনে এসে পথ আঁটকায়।

“ ব্রো তুই রিজেক্ট করছিস? তাও আমাকে? আমি তোর ওয়ান এন্ড অনলি বেস্টফ্রেন্ড, আর ভুলিস না আমি সবসময় তোর পাশে থাকি তোকে সব কিছুতে হেল্প করি। সব প্রয়োজনে তোর কাজে আসি।”

আয়ুশের কথা শুনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় রওশন তার দিকে। “ রিয়েলি? তাহলে আমাকে এটা বল, এখন অবধি তুই কোন কাজে এসেছিস আমার?”

রওশনের কথায় হচকিয়ে যায় আয়ুশ। কিছুক্ষণ নিরব থেকে ভাবে, তারপর ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি টেনে বলতে শুরু করে, “ হ্যাঁ তো এখনো কোনো কাজে আসিনি কিন্তু, একদিন অবশ্যই আসবো। ফিউচারে একবার হলেও তোর আমাকে প্রয়োজন হবে, আর সেদিন জীবন দিয়ে হলেও তোর হেল্প করবে এই আয়ুশ‌ কথা দিলাম। কিন্তু এবারের মতো তুই আমার হেল্প করে দে ”

অনুরোধ স্বরে কথা গুলো বলল আয়ুশ তারপর উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে রওশনের উত্তরের অপেক্ষা করে ও।

রওশন কিছুক্ষণ চুল থাকলো তারপর গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল “ অ্যাড্রেস বল।”

রওশনের কথা শুনে আয়ুশ ঝট করে ওকে জড়িয়ে ধরে, “ লাভ ইউ ব্রো! আমি জানতাম তুই কখনো আমাকে কোনো কিছুর জন্য না করতেই পারিস না।”

আয়ুশ রওশনকে ছেড়ে পকেট থেকে একটা চেক বের করে ওকে ধরিয়ে দেয়। “ এইযে চেক, আর জিনিসপত্র আমি আগেই তোর গাড়ির পেছনের সিটে রেখে দিয়েছি।”

“হোয়াট?” অবাক হয় রওশন। দ্রুত গাড়ির পেছনের দরজা খুলে দেখে ও। সত্যিই পেছনের সিট ভর্তি বড় বড় বাক্স।

রেগে দরজা লাগিয়ে দেয় রওশন, আয়ুশকে কিছু বলার জন্য ফিরে তাকাতেই ও দেখে আয়ুশ গায়েব। ওর রাগ থেকে বাঁচার ভয়ে যে আয়ু্শ পালিয়েছে সেটা আর বুঝতে বাকি রইল না রওশনের।

এমন সময় ফোনে ম্যাসেজ টোন বাজে। রওশন পকেট থেকে ফোন বের করে চেক করতেই দেখে আয়ুশ অ্যাড্রেস ম্যাসেজ করে পাঠিয়েছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রওশন তারপর গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল ও।

প্রায় চল্লিশ মিনিট লম্বা সফরের পর অনাথ আশ্রমে পৌঁছায় রওশন। গাড়ি সাইডে পার্ক করে নেমে ভিতরে চলে যায় ও।

আশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক এর সাথে কথা বলে তাকে চেক দিয়ে দেয় ও। কয়েকজন খাদিম গাড়ি থেকে জিনিস গুলো নামিয়ে ভেতরে নিচ্ছে। ওয়ারডন ম্যাডাম অনেকক্ষণ সময় নিয়ে রওশনের সাথে কথা বললেন। ওকে পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখতে বললেন।

কিন্তু রওশন জায়গাটার প্রতি ততটা রুচিশীল না। ও কতক্ষণে এখান থেকে যাবে সে চিন্তায় আছে।

গাড়ি থেকে জিনিস নামানো শেষ হলেও কাজ এখনো শেষ হয়নি। কিছু কাগজ পত্র দেওয়া বাকি। ওয়ারডন ম্যাডাম রওশনকে অপেক্ষা করতে বলে কাগজ পত্র আনতে ভিতরে চলে যান।

রওশন ওর গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দু হাত বুকে ভাঁজ করে এদিক সেদিন চোখ বুলাচ্ছে ও।

হঠাৎ গাড়ির সামনের মিররে চোখ পরে রওশনের। সেকেন্ডেই যেন ওর চারপাশটা একদম স্তব্ধ হয়ে যায়।

বুকে ভাঁজ করা হাত দু’টো ধীরে ধীরে নিচে নেমে যায়। হেলান দেওয়া থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ায় ও। চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে গভীর দৃষ্টি নিয়ে আয়নায় দেখা মানুষটির প্রতিবিম্বটির দিকে তাকায় ও।

একটা সাধারণ দেখতে মেয়ে কিন্তু সাদা রঙের ফুল স্লিভ কামিজে অসাধারণ লাগছে তাকে রওশনের কাছে।

হাতে পানির পাইপ আর সেই পাইপ দিয়ে গাছ গুলোতে পানি দিচ্ছে সে। ঠোঁটে লেগে আছে অমায়িক সুন্দর মুচকি হাসি। এই হাসি যেন বরফকেও গলতে বাধ্য করবে। যেমন এখন রওশনের বরফের মতো জমে থাকা হৃদয়টা গলতে শুরু করেছে।

খোলা চুল গুলো অবাধ্য হয়ে উড়াউড়ি করছে আর মেয়েটি সেই অবাধ্য চুল গুলো খুব যত্নে কানের পেছনে গুঁজে নিচ্ছে।

হৃদস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা অনুভব করছে রওশন। বিশ বছর বয়সে এই প্রথমবার এমন একটা অদ্ভুত অনুভুতির সম্মুখীন হয়েছে ও। এমন একটা অনুভূতি যেটা সম্পুর্ণ নতুন ওর কাছে।

পাইপের ছিদ্র গুলো থেকে পানি আসছে, আর সেই পানি গুলো বৃষ্টির কাজ করছে। মনে হচ্ছে ফুলের রাজ্যে ছিটে বৃষ্টি হচ্ছে আর সেই বৃষ্টিতে কোনো রাজকন্যা দাঁড়িয়ে আছে।

প্রায় কতক্ষণ রওশন এভাবে আয়নার দিকে তাকিয়ে ছিল ওর নিজেরও খেয়াল নেই। কিন্তু ওর মনে হচ্ছিল যেন পৃথিবীটা এখানে থেমে গেলেও ক্ষতি নেই। সময়ের কাঁটা এই মুহূর্তের মধ্যে আঁটকে গেলেও ক্ষতি নেই। অনুভূতিটুকু সারাজীবন ওর বুকের মধ্যে বন্দি থাকলেও ক্ষতি নেই। একবারের জন্য হলেও ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেও ক্ষতি নেই।

এভাবেই জীবনের সবচেয়ে অপ্রিয় জায়গাটা সবচেয়ে প্রিয় হয়ে উঠে রওশনের। প্রতিদিন এখানে এসে মায়াবী মুখটা দেখা যেন অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় ওর।

কিন্তু এই অভ্যাসটা কখন আসক্তিতে পরিনত হয়ে যায় ও বুঝতেই পারে না। তীব্র রোদ হোক কী প্রচন্ড বৃষ্টি অথবা গাঁ কাঁপানো শীত হোক, এমনকি অসুস্থতাও যেন রওশনকে একদিনের জন্যেও এখানে আসতে বাঁধা দিতে পারে নি।

এখানে এসে দূরে দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে তাকে দেখাও অন্য রকম একটা অনুভূতি সৃষ্টি করত মনে। এর মধ্যেই তার নাম জানতে পারে রওশন, ‘সুবহা’। যেন রওশনের জীবনের অন্ধকার রাতের এক নতুন সকালের উদয়।

বর্তমানে,,

বেডে শুয়ে আছে সুবহা। ডাক্তার কিছুক্ষণ আগেই ইনজেকশন দিয়ে গেছেন, এখন ঘুমাচ্ছে ও।

কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রওশন। ওখানে দাঁড়িয়ে সুবহার দিকে তাকিয়ে পুরোনো কিছু স্মৃতি মনে করল ও।

ও কখনো সুবহার সামনে যায়নি। আর না কখনো সুবহাকে বুঝতে দিয়েছে যে আড়াল থেকে কেউ ওকে এতটা ভালোবেসে এসেছে।

রওশনের কাছে যেন সুবহাকে লুকিয়ে দেখার অনুভূতিটাই অন্যরকম ছিল। আর ও এই অনুভূতিটাকে দীর্ঘ সময় অনুভব করতে চেয়েছিল। এজন্যই হয়ত আজও ও সুবহাকে আড়াল থেকে লুকিয়ে ভালোবেসে এসেছে।

সুবহার দিকে তাকিয়ে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে রওশন, ঠোঁটে এক চিলতে হাসির রেখা দেখা যায় ওর। সুবহার ঘুমন্ত মুখের দিকে গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আনমনে বলে ও,

”তোকে একার দেখার লুকিয়ে কি মজা
সে তো আমি ছাড়া কেউ জানে না,
তোকে চাওয়ারা পাওয়ারা নয় রে সোজা
সে তো আমি ছাড়া কেউ জানে না!”

To be continued…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here