আড়াল_কথা,০৮,০৯

0
616

#আড়াল_কথা,০৮,০৯
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৮

আমার হাতেই শেষমেশ তর মায়ের দম গেছে বুঝলিরে আরু। তারপর তর মায়ের ঘরে যাইয়া আলমারির সব লু’ট’পা’ট কইরা আমার ভাইরে ফোন দিয়া আইনা ওর কাছে সব পাঠাইয়া দেই। আর মানুষজন ডাকতে যাই ডা’কা’তির খবর দিতে। মানুষজন ডাইকা আইনা দেহি তুই বাড়িতে আইয়া পরছস। মায়ে বাপেরে ধইরা কা’ন্দা কাটি করতাছস। তারপর তো সব জানস। তর মায়ের লা’শ পুলিশে নিয়া গেলো ত’দ’ন্ত করবার। আর তর বাপে হাসপাতালে যাইয়া প্যারা*লা*ইসিস হইয়া কতাবার্তা বন্ধ হইয়া পইরা রইলো। এই হইলো গিয়া দুই মাসের আগ পর্যন্ত কাহিনী।’

‘তার পনেরো দিন পর আরাফাত তরে দেইখা পছন্দ করলো। ভাবছিলাম তরে বিয়া দিয়া ঝামেলা মুক্ত হইমু। কিন্তু ঝা*টা মারা কপাল আমার। বিয়ার রাইতে গেলি ভাই*গা। তয়, তুই ভা’ই’গা না গেলে আমার ঘাটে ঘাটে জল ঘোলা করা মাইয়াডা পার হইতো না। আর তর বাপ…’

‘পরের টুকু না-হয় নাকের আর চোখের পানি এক করতে করতে হা’জ’তের গরম হাওয়ায় বসে শোনাবেন।’

স্যার এর আওয়াজ এলো আমার কানে। সাথে আরও কয়েকজনের কন্ঠ শুনতে পেলাম। কিন্তু তাকিয়ে দেখার ইচ্ছে শক্তি বা শরী’রে’র জোর কোনটাই সায় দিচ্ছে না। আমি দাড়িয়ে রইলাম একইভাবে। আমার মায়ের মৃ’ত্যু চাচির হাতে হলেও আসল খু’নি আমার বাবা। সেদিনের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো আমার চোখে,

সেদিন কলেজ থেকে ফিরে যখন গেট পেড়িয়ে কিছুটা ভিতরে এলাম তখন মা বাবা দুজনকে র’ক্তা’ক্ত হয়ে পড়ে থাকতে দেখে আমি ছুটে এসেছিলাম মা-বাবার কাছে। বাবা অ’জ্ঞা’ন হয়ে ছিলো। কিন্তু মা আমার গলার আওয়াজ পেয়ে গো’ঙি’য়ে ওঠে। বারবার শুধু বাবাকে ইশারা করে কিছু বলার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। কিন্তু শুধু গোঙানোর আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছিলো না। আমি ভেবেছিলাম মা হয়তো বাবাকে বাঁচানোর কথা বলতে চাইছে। মা সারাজীবন এর মতো চুপ করে যাওয়ার আগে আমার হাতটা ধরেছিলো। বাবার দিকে এগিয়ে নিয়েছিলো খানিকটা। তারপর আর কোন সারা দেয় নি মা। কিছু বলেও নি। আমার হাতটা ছেড়ে দিয়েছিলো। আর কখনো ধরবে না আমার হাত। কখনোই না।

হটাৎ মনে হলো আমি অতল অ’ন্ধ’কার গহ’ব্বরে তলিয়ে যাচ্ছি। নিয়ন্ত্রন হারাচ্ছি নিজের ওপর। চোখ যেন আপন মানুষ গুলোর মতো ধোঁ’কা দিয়ে জোর করে বুঁজে আসতে চাইছে। তখনই বোধহয় কেউ ধরে ফেললো আমায়। শুন্যে তুলে নিয়ে এগিয়ে গেলো কোথাও। আমি কিছু একটা শুনতে পাচ্ছি। ঢিপঢিপ ধ্বনি ভেসে আসছে আমার কানে। অনুভূতিরা যেন ফিশফিশ করে জানান দিচ্ছে, কেউ খুব যত্নে আগলে নিয়েছে তার বুকের ভেতর। আমাকে লুকিয়ে রাখবে বুকের পাজরে। কেউ কখনো আঘাত করতে পারবে না সেখানে। কেউ কখনো কষ্ট দিতে পারবে না। কানে এলে কারো ঝাপসা আওয়াজ,

‘ইনজেকশন পুশ করে দিয়েছি। আমি ওকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। তুমি ওদের ব্যাবস্থা করো।’

তারপর শুধু পায়ের আওয়াজ পেলাম।ধীরে ধীরে অনুভব এর প্রখরতা কমে এলো। আমি হারিয়ে গেলাম কোন এক অজানায়। মনে হলো মা হাত বাড়িয়ে অন্ধকার হতে ডাকছে আমায়।

_______________

কেমন যেন হই হট্টগোলের আওয়াজ আসছে কানে। ধীরে ধীরে আওয়াজের প্রখরতা বাড়ছে। অনেক মানুষের গলার সুখী স্বর ভাসছে যেন আমার আশেপাশে। কেউ বোধহয় আমার মাথায়ও হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তবে কি আমি মায়ের কাছে এসে গেছি। মা তো এইভাবেই আমার মাথায় বিলি কেটে দিতো।

চোখ দুটো কি ভারি লাগছে। যেন কতশত বোঝা বয়ে বেরাচ্ছে চোখের পাতা গুলো। চোখের পাতার সাথে যুদ্ধ করে তাকালাম। চোখ খুলতেই সর্বপ্রথম নজরে পরলো কারো হাত। কানে আসছে বহু কন্ঠের আনন্দ ধ্বনি। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নজরে এলো অনেকগুলো হাস্যাজ্বল মুখশ্রী। সবই অচেনা। এতো গুলো চেহারা গুনতে গেলেও বোধহয় ক্যালকুলেটর এর সাহায্য নিতে হবে। আমার শিয়রের পাশে বসা চল্লিশোর্ধ অতি সুন্দরী ভদ্রমহিলাটি আবেগমিশ্রিত গলায় হটাৎ বলে ওঠলো,

‘এখন কেমন লাগছে মা?’

আমি চকিতে নিবিড় দৃষ্টিতে তাকালাম তার চোখে। কি মায়ামাখা ডাক। মা! শব্দটিতে কি যেনো ছিলো। মাথাটা খানিক ভার লাগলেও আমি উঠে বসলাম। কতগুলো চোখের দৃষ্টি এখন আমার দিকে তা খোঁজ করার ইচ্ছা জাগলো আমার মনে। আমি চেয়ে দেখলাম সবাইকে। কি আশ্চর্য! সবার দৃষ্টি কেমন আপন আপন। সবার চোখে রয়েছে এক রাশ মায়া। প্রথম চোখ খুলে এতোগুলো অচেনা মুখ দেখে একটু অস্বস্তি হলেও এখন মনে হচ্ছে এ জায়গাটা আমার জন্য মোটেও অস্বস্তির কারন হবে না। মন এমন কেন বলছে?

সেই মহিলাটি আবারও আমায় জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে মা?’

আমি তার দিকে ফিরে চেয়ে মাথা নাড়িয়ে না করলাম। আশেপাশের সবাই এখনো একইভাবে দাড়িয়ে আছে। কেউ কোন কথা বলছে না। তবে তাদের দৃষ্টিতে কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু আমার তো আছে। অনেক প্রশ্ন আছে আমার। আমি এখানে কেনো? আমি তো..

হটাৎ মাথা চারা দিয়ে উঠলো দুপুরের ঘটনা। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। হাসফাস করে আশেপাশে তাকালাম। এতো ভীরের মাঝে চেনা কোন মুখ তো নেই। কাকে জিজ্ঞেস করবো? আমি চিৎকার করে বলে ওঠলাম,

‘চাচি কোথায়? আপনারা কারা? চাচির থেকে তো আরও অনেক কিছু জানার বাকি আছে। আরও কি যেনো একটা বলছিলো চাচি। আর আমার রেকর্ডারই বা কোথায়? ওটাতো আমি জামার ভেতরে সলোয়ার এর ভাজে রেখেছিলাম। ওটাতে চাচির সব কথা রেকর্ড করেছিলাম। তাছাড়া বাবা নামক ওই জ’ল্লা’দ টাকে তো আমি নিজ হাতে শাস্তি দিবো। ওই জ’ল্লা’দ টাই বা কোথায়?
আমাকে নিয়ে চলুন আপনারা। প্লিজ আমাকে ওদের কাছে নিয়ে চলুন। ওরা আমার মাকে মেরে ফেলেছে। আমার মায়ের বুকের ভেতর কু’পি’য়ে’ছে ওরা। ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে আমার মায়ের বুকটা। আমার মা অনেক কষ্ট পেয়েছে। অনেক কষ্ট। আমার মা! মা! মা গো! আমি পারছি না মা! আর পারছি না। তোমার কষ্ট আমি কি করে কমাবো মা। কি করে কমাবো। বলো না মা। বলো। তোমার বুকটা বুঝি জ্বলে যাচ্ছে?’

কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম আমি। সেই মহিলাটি আমায় জরিয়ে ধরে বুকে টেনে নিলো। আমি তাকে আঁকড়ে ধরে কাদঁতে কাঁদতে হটাৎ নির্জীব হয়ে এলাম। জ্ঞান হারালাম তৎক্ষনাৎ।

আড়ালের কান্নার আহাজারিতে মাহতাব ভিলার প্রতিটা কোনা যেনো কেঁপে উঠছে। ভারী হয়ে উঠছে বাতাসের গভীরতা। রুমের অবস্থানরত সবগুলো মানুষের চোখের জল বাধ ভেঙে উপচে পড়ছে। আড়াল মুর্ছা যেতেই ওয়াসিফ ভিলার বড় ছেলে আসিফ সাহেবকে ডেকে পাঠায় তার স্ত্রী আলো বেগম। তার বুকেই এখন ঠায় নিয়েছে আড়াল। আড়ালকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে ঘর খালি করতে বলেন আলো বেগম। সবাই অশ্রু চোখে এক এক করে রুম ছাড়লে রুমে প্রবেশ করে শুদ্ধ মাহতাব। শুদ্ধ রুমে প্রবেশ করে তার মাকে বলে,

‘আমি বাইরে থেকে ওর সব কথা শুনেছি আম্মু। তোমার ‘সে’ এখন বাড়ি নেই। ডাক্তার আংকেল কে এগিয়ে দিতে গেছে। মেয়েটা প্রচন্ড ট্রমার মধ্যে আছে এখন। ওকে এই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সবকিছু ভুলে নতুন করে বাঁচতে হবে। ওর আবার জ্ঞান ফিরলে এসব মনে করার যেনো কোন সুযোগ না পায় সেই দিকটা খেয়াল রাখতে হবে। তুমি এখন যাও। ওর জন্য একটু সুপ করে নিয়ে এসো। আমি ওর জ্ঞা’ন ফিরানোর ব্যাবস্থা করছি।’

আলো বেগম রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে চলে যায়। শুদ্ধ পা বাড়ায় বিছানায় মলিন চেহারা আর রু’গ্ন শ’রীর নিয়ে পড়ে থাকা মেয়েটির কাছে। আড়ালের পাশে বসে বাম সাইড থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে কিছুটা পানি ছিটিয়ে দেয় আড়ালের মুখের ওপর। আড়াল পিটপিট করে তাকায়। এবার চোখ মেলে সবার আগে নজরে আসে একটি পুরুষালী চেহারা। কেমন চেনা চেনা মনে হলো মুখটি। হটাৎ আড়ালের মনে হলো এটা তো সেই পানির বোতলধারী দানব চেহারার ছেলেটা। কলেজের ছাদেই তো আজ সকালে দেখা হলো। পানি খাইয়িয়ে চুপচাপ চলে গেছিলো ছেলেটি।

শুদ্ধ কিছুক্ষণ তাকিয়ে আড়ালের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে। আড়ালকে ভাবুক চেহারায় দেখে শুদ্ধ আর সময় না নিয়ে বলে ওঠে,

‘তুমি রোজ কি কি খাও বলো তো?

একটি অচেনা ছেলের কাছ থেকে আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে আড়াল একটু লজ্জা পায়। সাথে হয় অস্বস্তি। আড়ালকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শুদ্ধ আবারও বলে ওঠে,

‘এখন থেকে রোজ ডায়েট করে চলবে। তাতে তোমারও উপকার আর অন্যদেরও।’

আড়াল থতমত খেয়ে যায়। এ কেমন পরিস্থিতি! কেমন যেন পেট মোচড়াতে লাগলো আড়ালের। হয়তো খিদেতে অথবা অস্বস্তিতে। ঠিক ঠাওর করে ওঠতে পারলো না আড়াল। আড়াল চারপাশে চোখ বুলিয়ে কাওকে দেখতে না পেয়ে একটু চমকায়। আবারও প্রশ্নের খেলা চলে মস্তিষ্ক জুড়ে। কিন্তু তার স্থায়িত্ব খুব বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না। সামনে থাকা দানবীয় চেহারার পুরুষটি আবারও প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,

‘আচ্ছা আমি কি তোমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছি? নাকি বিয়ের? এতো চিন্তা ভাবনার রেল ছুটাচ্ছো কেনো?

আমার কান দিয়ে যেনো ধোয়া বেরোতে লাগলো। হটাৎ করে মনে হলো পেটের মোচড় টা তিন গুন বাড়লো বোধহয়। কান গরম হয়ে উঠেছে। আমি কোথায়? এই দানবের পাল্লায় কি করে পড়লাম?

#চলবে

#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৯

‘আচ্ছা আমি কি তোমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছি? নাকি বিয়ের? এতো চিন্তা ভাবনার রেল ছুটাচ্ছো কেনো?

আমার কান দিয়ে যেনো ধোয়া বেরোতে লাগলো। হটাৎ করে মনে হলো পেটের মোচড় টা তিন গুন বাড়লো বোধহয়। কান গরম হয়ে উঠেছে। আমি কোথায়? এই দানবের পাল্লায় কি করে পড়লাম?

জড়তাপূর্ণ মহাসাগরে এক রাশ অস্বস্তি নিয়ে অতলে তলিয়ে যাবার আগেই রুমে কেউ একজন প্রবেশ করলো। আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তবে এবার আরও এক ধাপ বেশি অস্বস্তির স্বীকার হলাম প্রবেশকারী ব্যাক্তির মুখদর্শন করে। আসিফ স্যার এসেছেন। সাথে সেই ভদ্রমহিলাও এসেছেন হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে। ইনিই তো আমাকে মা বলে ডেকেছিলো। ওনার গায়ে কেমন আপন আপন ঘ্রান আসে।
স্যার আসার সঙ্গে সঙ্গেই দানব ছেলেটি রুম থেকে প্রস্থান করলো। স্যারের উপস্থিতি আমায় মনে করিয়ে দিলো দুপুরের ঘটনা। দীর্ঘ এক শ্বাস নিলাম। নিজেকে যথাসাধ্য স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় যুদ্ধ করলাম আবেগ অনূভুতিদের সাথে। নিজের ব্যাক্তিগত পীড়ার জন্য অন্যের শান্তিভঙ্গ করার কি দরকার। আমার কষ্ট আমারই থাক। আর লড়াই টাও।

আমি শান্তভাবে স্যারকে বলে ওঠলাম,

আমি কোথায় আছি, আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন আমি জানি না। আমার লাইফের প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পর্কে আপনি কিভাবে জানলেন এবং এভাবে আমায় সাহায্য কেন করে যাচ্ছেন আমি সেটাও জানি না। আমার আপনার কাছে অনুরোধ চাচি আর বাবা কোথায় আছে সেটা আমাকে বলে দিন। পরবর্তী লড়াই এবার আমি একাই লড়বো। আমার আর কাউকে প্রয়োজন নেই। আমি জানি আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। তার জন্য আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।

‘খাবার টা খেয়ে নিন। তারপর আপনার সাথে কিছু কথা আছে। কথাগুলো আগে শুনে নিন তারপর আপনার কথাও আমি শুনবো। তবে তা আমার সময় অনুযায়ী।’

খাবারের প্লেট হাতে সেই ভদ্রমহিলা আমার সামনে এসে বেশ সঙ্কুচিত কন্ঠে আবদার করে বললেন,

‘তুমি কিছু মনে না করলে আমি তোমায় খাইয়ে দেই মা।’

আমি একটু অবাক হলেও ইতিবাচক উত্তর দিলাম মাথা নেড়ে। উনি নিরতিশয় যত্নের সহিত ভাত মাখিয়ে আমার মুখে তুলে দিতে লাগলেন। আমার একটু লজ্জা লাগছে। আমি এক অচেনা জায়গায় অচেনা কারো হাতে এভাবে খাচ্ছি।মানা করে দিতেও দ্বিধা হলো। তারমধ্যে আবার এতোক্ষণ যাবত স্যার ছাড়া চেনা কোন মুখের হদিস পেলাম না। আমি খেতে খেতে অনেক প্রশ্নমালার বহর সাজালাম মনের কোনায় কোনায়। আজ স্যারের কাছ থেকে সব উত্তর নিতে হবে। আমার খাওয়া শেষে আমাকে নিয়ে রুমের বাইরে যেতে বলে স্যার বেড়িয়ে গেলেন রুম থেকে।

আমি খাওয়া শেষে উঠে দাড়ালাম। ওনাকে অনুসরণ করে বড়ো বড়ো পা ফেলে এগিয়ে গেলাম রুমের বাইরে।করিডোর পেড়িয়ে বড় একটা রুমের ভেতরে পা রাখলাম। রুমের ভেতরে আসবাবপত্রের তুলনায় মানুষের সংখ্যা বেশি মনে হলো যেন। কোন সমাবেশ চলছে কি? রুম এর সাজসজ্জা দেখে বুঝলাম এইটা ড্রয়িংরুম। আমার ঠিক সামনে স্যার দাড়িয়ে। স্যার আমায় উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,

‘এখন যা বলবো মন দিয়ে শুনবেন। কোন প্রশ্ন করবেন না। আপনাকে এতোক্ষণ যিনি খাইয়ে দিলো তিনি আমার স্ত্রী। আপনি তাকে মামনি বলে ডাকতে পারেন। আর আপনার জ্ঞান ফেরার পর যে আপনার সাথে উদ্ভট কথাবার্তা বলছিলো সে আপনার মামনির ছেলে।’

স্যার কথাগুলো বলে একবার পিছনে তাকাতেই চারজন বাচ্চা ছেলেমেয়ে ও চারজন আমার সমবয়সী ছেলেমেয়ে এগিয়ে এসে স্যারের পাশে দাড়ালো। তাদেরকে দেখিয়ে স্যার আমায় আবার বলে ওঠলেন, ‘

এরা সবাই আমার ভাই বোনেদের ছেলেমেয়ে। আজ থেকে এরা সবাই আপনার কাজিন। আর এই তিনজন আমার তিন ভাই। আর এনারা তাদের স্ত্রী। আপনি ওদের আঙ্কেল বলে ডাকতে পারেন। আর ওনাদের আন্টি। আর ও হচ্ছে আমার ছোট বোন। ওকে আপনি ছোটমা বলে ডাকতে পারেন। আর ইনি হচ্ছেন আসমা খালা। অনেক বছর ধরে এবাড়িতেই থাকেন। আমরা খালা বলে ডাকি। বাচ্চারা পরি দাদি বলে ডাকে। আপনিও তাই ডাকবেন। আজ থেকে এটাই আপনার ঠিকানা। এই লোকগুলোই আপনার আপনজন। এদের সবার সাথে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করুন। সবাইকে আপন করে নিন। পৃথিবীটা সহজ হয়ে যাবে।’

কথাগুলো শেষ করে স্যার চলে গেলেন ড্রয়িংরুম থেকে। মনে হচ্ছে আমি অথৈ সাগরে নিমজ্জিত কোন প্রাণী। যার কেন মতামত দেওয়ার অধিকার নেই। আর না আছে ইচ্ছা প্রকাশ করার কোন সুযোগ। আমি এখানে থাকতে চাই না। আমার আরও অনেক কিছু জানার বাকি আছে। বাবা নামক ওই জা’নো’য়া’র, টাকে তার প্রাপ্য আমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে।

আশপাশ থেকে সবাই এগিয়ে এলো আমার দিকে। আমি নির্বাক হয়ে শুধু দেখতে লাগলাম। বাচ্চারা এসে যার যার নাম বলে নতুন করে আমার সাথে পরিচিত হলো। সবাই টুকটাক কথা বললো। সবার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম আমাকে নিয়ে সবাই বেশ খুশি। যেনো আমাকে আগে থেকেই চেনে সবাই। কারো মধ্যে কোন জড়তা নেই।

মামনি আমাকে আমার রুমে নিয়ে এসে বিশ্রাম করতে বলে চলে গেলেন। আমি কোন কথা বললাম না। নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে রইলাম। এতো প্রশ্নের শেষ কোথায়?

সন্ধ্যা হয়েছে অনেক্ক্ষণ হলো। নামাজ পড়ে রুমে বসে আছি। ঘরে ভালো লাগছে না। স্মৃতি গুলো দু’র্বি’ষ’হ করে তুলছে মন, মস্তিষ্ক। বাইরে যেতেও ইচ্ছে করছে না। কয়েকবার ছোট বাচ্চাগুলো এসে উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেছে। আমি চুপ করে না দেখার মতো ছিলাম। বাচ্চাদের সাথে তো দুর আমার মায়ের সাথেই কখনো সখ্যতা করে উঠতে পারিনি। মন খুলে কথা বলা হয়ে উঠে নি। এদের সাথে কি করে মিশবো। বাচ্চাগুলোও শুধু এসে এসে দেখে যাচ্ছে। কিছু বলছে না। হয়তো আমার ডাক দেওয়ার অপেক্ষা করছে।

আবারও বাচ্চাগুলো দরজার কাছে এসে উঁকি দিলে। আমি হাতের ইশারায় ডাক দিলাম। বাচ্চাগুলো পাল্লাপাল্লি করে দৌড়ে এসে আমাকে ঘিরে দাড়ালো। আমার কেমন যেন হটাৎ মনটা খুশি হয়ে গেলো। ওরা কি উচ্ছাস নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এইটুকু বাচ্চাগুলো কি সুন্দর বিধি নিয়ন্ত্রণ মান্য করে চলে। ডাক দেওয়ার আগপর্যন্ত কাছেই এলো না।

বাচ্চাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়মেয়েটি হয়তো আট দশ বছরের হবে। আর তিনজনের চার পাঁচ বছর বয়স হবে হয়তো।

বড়মেয়েটি আমার হাতটি ধরে বলে ওঠলো,
‘আমরা তোমাকে মিষ্টিপু বলে ডাকবো, হ্যা?’
আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম। ছোট তিনজন থেকে একজন বলে উঠলো,
‘তোমার কি এখনো পায়ে ব্যাথা করছে মিষ্টিপু?’
আমি বললাম আমার তো পায়ে ব্যাথা হয় নি। তোমাদের কে বললো আমার পায়ে ব্যাথা?
তিনজনেই একসাথে বলে ওঠলো, ‘শুদ্ধ ভাইয়া’।
আমি একটু অবাক হলাম ওদের কথা শুনে। ওদের জিজ্ঞেস করলাম,
‘শুদ্ধ ভাইয়া কে’?
‘যে তোমাকে কোলে করে নিয়ে এসেছে।’

আমি বিষম খেলাম ওদের কথা শুনে। কি বলছে এরা। কেউ আমায় কোলে করে নিয়ে এসেছে। আমি ওদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাকে যখন কোলে করে নিয়ে এসেছে তখন কি বাড়ির সবাই দেখেছে?’
‘হ্যা। আমরা সবাই দেখেছি।’
আমার গলা শুকিয়ে এলো ওদের কথা শুনে। কি লজ্জার ব্যাপার। আমি সবার সামনে যাবো কি করে? ওদের আবারও প্রশ্ন করলাম,
‘যে আমাকে কোলে করে নিয়ে এসেছে সে এখন কোথায়?’
‘ভাইয়া তো এখন ছাদে।’

হটাৎ বাইরে থেকে কারো গলার আওয়াজে দরজার দিকে তাকালাম। ‘আসবো’ বলে অনুমতির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন তরুণ ও দুজন তরুণী। তখন বাইরে পরিচয় হয়েছিলো এদের সাথে। দুজন মেয়ের নাম বৃষ্টি আর সৃষ্টি। বাকি দুজন ছেলের নাম শান্ত আর ফুয়াদ। সবাই আমার থেকে দুই এক বছর করে বড়।

আমি সৌজন্য বজায়ে একটু হেসে ভেতরে আসতে বললাম। ওরা এসে আবদার করে বললো প্রতিদিন নাকি সন্ধার পর এক ঘন্টা করে সবাই মিলে একসাথে ছাঁদে বসে আড্ডা দেওয়া হয়। আমিও যেনো ওদের সাথে যোগ দেই। এমনিতে বললে হয়তো যেতাম না। অচেনা মানুষের ভীরে নিঃশ্বাস ফেলাও কঠিন মনে হয় আমার কাছে। কিন্তু শুদ্ধ নামক ছেলেটাকে দেখার ইচ্ছেতে ছাঁদে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলাম। গলার ওড়নাটা মাথায় পেচিয়ে ওদের সবার পিছু পিছু পা বাড়ালাম ছাঁদের দিকে।

ছাঁদে এসে চোখে পড়লো বড় বড় দুটো মাদুর বিছানো। তার ওপর রাখা আছে এক গামলা মাখানো মুড়ি আর পিয়াজু। সাথে এক জগভর্তি পানি। দুইটি বাল্ব জালানো আছে তাই অন্ধকার হলেও সব দেখা যাচ্ছে। এখানে আর কাওকে চোখে পড়লো না। কিন্তু ওরা তো বললো শুদ্ধ নামের ছেলেটা ছাঁদে আছে। আমি ওদের সবার সাথে বসে পড়লাম।

তখনই বৃষ্টি আপুটা আমার পিছন দিকে তাকিয়ে কাউকে ‘ভাইয়া’ বলে ডাক দিয়ে এখানে এসে বসতে বলে। পাশ থেকে ছোট বাচ্চাগুলো চিৎকার করে ওঠে ‘শুদ্ধ ভাইয়া’ বলে। আমি তৎক্ষনাৎ পিছনে তাকাই। এটাতো সেই দানব ছেলেটা। যে ছেলেটাকে স্যার মামুনির ছেলে বলে পরিচয় দিয়েছিলো। তারমানে স্যারের ছেলে। কিছুক্ষণ ভাবুক নয়নে তাকিয়ে থেকে হটাৎ মনে হলো ছেলেটা তাহলে এজন্যই আমাকে ওজন কমানোর কথা বলছিলো। আমি ওজন কমালে নাকি আমার সাথে সাথে অন্যকারোও উপকার হবে। কি বদমাশ! কোথাথেকে কি মিন করে কথা বলে বোঝা মুশকিল।

ছেলেটি আমার সামনের দিকে বসলো। একদম আমার মুখ বরাবর। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম ছেলেটির দিকে। যেনো দৃষ্টি দিয়েই ভস্ম ভূতনাথ করে ফেলবো। হটাৎ ছেলেটার চোখও আমার চোখে পড়লো। চোখে চোখ পড়তেই আমি আমার দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ করলাম। চোখ ফেরালাম না। ছেলেটি বেশ কোতুহলী নজরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। যেন আশ্চর্যজনক কিছু দেখছে।
আমিও চোখ ফেরালাম না। কেনো ফেরাবো? আমি কিছু করেছি নাকি? করেছে তো এই দানব ছেলেটা। চোখ ফেরানোর হলে এই ছেলেটাই ফেরাবে। এবার ছেলেটা যেনো একটু নড়েচড়ে বসলো আমাকে এতোক্ষনেও চোখ না ফেরাতে দেখে। ছেলাটা হটাৎ জোর গলায় বলে উঠলো,

‘তুমি কি বাথরুম যেতে চাও?’

আমি বিহ্বলিত হয়ে গেলাম ছেলেটির কথা শুনে। আমার চাহনিতে ছেলেটার এটাই মনে হলো? আমি কি ঠিকঠাক চাইতেও পারিনা? আমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here