#আড়াল_কথা,১০,১১
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১০
‘তুমি কি বাথরুম যেতে চাও?’
আমি বিহ্বলিত হয়ে গেলাম ছেলেটির কথা শুনে। আমার চাহনিতে ছেলেটার এটাই মনে হলো? আমি কি ঠিকঠাক চাইতেও পারিনা? আমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। ওনার কথা শুনে সবাই মুড়ি খাওয়া বাদ দিয়ে আমার দিকে কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকালো। আমি একটু গুটিয়ে গেলাম। কি একটা পরিস্থিতি।
বৃষ্টি আর সৃষ্টি আমায় বললো, ‘তুমি লজ্জা কেনো পাচ্ছো আড়াল? তুমি নিচে যাও। তোমার রুমের সাথেই তো এটাচড বাথরুম আছে। তুমি কি একা যেতে ভয় পাচ্ছো। তাহলে টুবলু টাকে সাথে নিয়ে যাও। এই টুবলু যাতো তোর মিষ্টিপু কে একটু নিচে নিয়ে যা।’
ওদের সাথে শান্ত আর ফুয়াদ ও বলে ওঠলো, হ্যা হ্যা! তুমি কিন্তু একদম লজ্জা পাবে না আড়াল। আমাদের সাথে সবসময় সবকিছু শেয়ার করবে। আমরা কিন্তু লজ্জা টজ্জা একদম পাই না।’
‘ঠিকি বলেছিস রে! তুই তো একটা গাধা। গাধার আবার লজ্জা কিসের।’
‘আর তোরা তো একেক টা বদের হাড্ডি।’
আমি পড়লাম মহাজ্বালায়। ওই দানবটা কি আর কোন টপিক পেলো না? এটাই বুঝতে হলো? এখন এমনভাবে বসে আছে যেন কোন নিরিহ ছোট্ট বাবু। এই দানবটার দিকে তাকালেও রাগে গা রি রি করছে। আমি নজর ঘুরিয়ে ওদের বললাম, ‘তোমরা ভুল বুঝছো। আমি তেমন কিছু তো বলিনি। আমি ঠিক আছি। তোমরা থাকো আমি রুমে যাচ্ছি। আমার ভালো লাগছে না।’
আমি উঠে চলে এলাম ওখান থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হটাৎ টুবলুর কথা শুনে কৌতূহলবশত আমি একটু দাড়ালাম। ওই দানব টাকে বলছে, ‘শুদ্ধ ভাইয়া, আমি যে জন্য বাথরুমে একা যেতে ভয় পাই মিষ্টিপু ও কি সেইজন্যই একা যেতে ভয় পাচ্ছে? আমি তো বাথরুমে গেলে একা একা চেন লাগাতেই পারি না। শুধু আটকে যায়। তুমি তো আমাকে হেল্প করো। তাহলে মিষ্টিপুকেও হেল্প করো না ভাইয়া। যাও।’
আমার মাথাটা নাগরদোলার মতো ঘুরতে লাগলো। কোন থামাথামি নেই। লজ্জায় চোখ মুখ খিঁচে কোনমতে দৌড়ে নিচে নেমে এলাম। মনে হচ্ছে সিঁড়িগুলোও যেনো আমাকে দেখে হাসছে। ওই দানবটাকে তো আমি দেখে নিবো। কোন চোখের চাওনির অর্থ কি তা বুঝিয়ে ছাড়বো।
সিঁড়ি পার হয়ে নিচে নামতেই মুখোমুখি হলাম স্যারের সাথে। স্যারকে দেখে কিছুক্ষণ আগের লজ্জা, অস্বস্তি সব ভুলে গেলাম। মনে রইলো শুধু হাজারো প্রশ্ন। যার উত্তর শুধু এই লোকটার কাছেই আছে। স্যার আমাকে দেখে ইউ টার্ন মেরে রাস্তা বদলে অন্যদিকে যেতে লাগলো। আমি হটাৎ বলে ওঠলাম,
‘প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার ভয়ে পালাচ্ছেন। স্যার?’
আমার সহজ গলার কঠিন উক্তি। কন্ঠে কিছুটা উপহাস। স্যার আমার মুখে এমন বাক্য শুনে কিছুটা থেমে আবার যেতে লাগলে আমি আবারও প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম,
‘যেখানে আমার সবথথেকে আপন মানুষগুলো ভরসাযোগ্য নয়। সেখানে আপনাকে বিশ্বাস করি কি করে স্যার?’
স্যার এবার ঘুরে দাড়িয়ে আমার সম্মুখীন হলো।
‘আপনি সব জানেন। চাচির বলা না বলা সব কিছুই আপনি জানেন। তাই তখন চাচিকে আর কিছু বলতে দেননি। চাচি আর বাবা এখন কোথায়?’
‘যেখানে তাদের থাকা উচিত।’
‘আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নেবেন না স্যার। আমার কারো সাথেই সখ্যতা গড়ে নেওয়ার যোগ্যতা নেই। তাই ধৈর্যের সাথেও আমার কোন সখ্যতা নেই। আমি না চাইলে আপনি আমায় জোর করে এখানে রাখতে পারবেন না। এখানে আমি আছি শুধুমাত্র আমার প্রশ্নের উত্তর এর খোঁজে। যা শুধুমাত্র আপনার কাছেই আছে। সেই উত্তর গুলোই যদি আমি আপনার থেকে না পাই তবে এখানে আমি থাকবো কেনো?’
স্যার এর মুখভঙ্গিতে চুল পরিমাণ তারতম্য ঘটলো না। একিভাবে দাড়িয়ে আছেন। ক্ষনিক সময় পেরোতেই স্যার বললেন আমায় আমার রুমে যেতে। আমি গেলাম না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাকে একইভঙ্গিতে দাড়িয়ে থাকতে দেখে এবার মুখ খুললেন,
‘আপনার বাবা হসপিটালে আছেন। আর আপনার চাচি জেলে। এটুকু আপাতত জেনে রাখুন। আর কিছু জানার কোন প্রয়োজন আপনার নেই। তাদের কর্মের যোগ্য শাস্তি তারা পাবে।’
স্যারের কথা শুনে এবার আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। আমি রাগে দুঃখে চিৎকার করে বলে উঠলাম,
‘আমি কেন শুধু এটুকু জানবো? আমার সবটা জানার সর্বাঙ্গীণ অধিকার আছে। প্রতারণার শিকার হয়েছে আমার মা আর আমি। নৃ’শং’স ভাবে হ’ত্যা হয়েছে আমার মা, এতিম হয়েছি আমি। তাতে আপনার তো কোন ক্ষতি হয়নি। তাই আপনার কিছু যায় আসে না। তাহলে আপনি কি করে বুঝবেন আমার যন্ত্রনা। আপনি কে হন আমাকে এসব বলার? আপনি প্রথম থেকে আমাকে সাহায্য করে যাচ্ছেন আমি না চাইতেও। তার মানে এই নয় আপনি সবকিছু থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন। নাকি আপনিও তাদের দলে অন্তর্ভুক্ত। নাম লিখিয়েছেন বুঝি তাদের দলে। এবার কি তবে আমার খু’ন আপনার হাতে? নাকি মায়ের খু’নে’ও আপনার হাত ছিলো? তাই আমাকে সত্য জানতে এগোতে দিচ্ছেন ন….
কথা শেষ করার আগেই আমার গালে সপাটে ভারী চড়ের আঘাত হানলো কেউ। আমার মাথা ঝিমিয়ে উঠেছে পুরুষালি হাতের থাবায়। চোখের কোনা বেয়ে গড়িয়ে গেলো এক ফোঁটা দুঃখ ধারা। তবে সর্বাধিক ঝটকা খেলাম সামনে চোখ তুলে চেয়ে। আমার সামনে স্যার নয় দাড়িয়ে আছে শুদ্ধ ভাইয়া। রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার চোখে। স্যার শুদ্ধ ভাইয়ার নাম নিয়ে ধমকে ওঠলেন। তাতে শুদ্ধ ভাইয়া তিল পরিমাণ নড়লেন না। হটাৎ বজ্রের মতো গর্জে উঠে বলে ওঠলেন,
যার ওপর তোমার মায়ের খুনের অভিযোগ করছো সেই মানুষটা তোমার মায়ের ভাই। তার সবথেকে ভরসার জায়গা। যাকে তোমার মা সবথেকে বেশি ভরসা করতো তাকেই তোমার মায়ের খুনি বানিয়ে দিচ্ছো। বাহ! তোমাকে তোমার প্রশ্নের জবাব না দেওয়ার কারন তোমার মায়ের শেষ ইচ্ছা। কারন তোমার মা চান নি তুমি এসবের কোন কিছু জানো। আর এসবে নিজেকে জরিয়ে ফেলো।
বাড়ির সবাই এখন আমাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে। আমি হতবাক হয়ে দাড়িয়ে আছি। শুদ্ধ ভাইয়াকে থামিয়ে দিয়েছেন স্যার। আর কিছু বলতে দিলেন না। আমি স্যারের চোখে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। এই মানুষটা আমার মামা হয়। এই বাড়ির প্রতিটি মানুষ আমার আপনজন। তাহলে এতোদিন কেনো গোপন ছিলো সব?
শুদ্ধ ভাইয়া আমার হাত ধরে কোথাও নিয়ে গেলেন। একটা বন্ধ রুমের তালা খুলে আমায় নিয়ে ঢুকলেন। রুমে ঢুকতেই সবার আগে নজরে পড়লো দেয়ালে ঝুলানো একটি ফ্রেমে হাস্যজ্বল আটটি মুখ। চেয়ারে দুজন অর্ধবয়স্ক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা বসা। তাদের পিছনে দাড়ানো ছয়টি স্পষ্ট চেহারা। যার মধ্যে আমার মা ও একজন।
‘চেয়ারে বসা দুজন তোমার মায়ের পিতামাতা। তারা এখন এই দুনিয়ায় নেই। আর পিছনে দাড়ানো সবাইকে নিশ্চয়ই চিনতে পারছো?
ফুপি কোনো এক ছেলেকে ভালোবাসে এমন কথা জানার পর দাদা ফুপিকে জবরদস্তি বিয়ে দিতে চাইলে ফুপি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছিলো আজ থেকে উনিশ বছর আগে।
বাবা যে তোমার কলেজের টিচার তা ফুপি জেনে শুনেই তোমাকে সেই কলেজে ভর্তি করিয়েছিলো। ফুপি সবসময় আমাদের সব খবর রেখে গেছে। আমরাই ব্যার্থ হয়েছি ফুপির খোঁ’জ নিতে। তোমার বাবার অ’বৈ’ধ কার্য সম্পর্কে অনেক আগেই ফুপির সন্দেহ হয়েছিলো। ধীরে ধীরে খোঁজ নিয়ে সেই স’ন্দে’হ’ই সঠিক হয়ে সামনে আসে ফুপির। তখন তোমার বাবার বি’রু’দ্ধে সব প্রমাণ হাতে রেখে তারপর তোমার বাবাকে অ’বৈ’ধ কাজ থেকে দুরে সরে আসতে বলে কিন্তু তোমার বাবা তাতে নারাজ ছিলো। সে উল্টো ফুপিকে খু’নে’র হুমকি দেয়। ফুপি তার আসন্ন বিপদ সম্পর্কে খানিকটা আঁচ করতে পারছিলো। ফুপির মনে হয়েছিলে তার কিছু হয়ে গেলে তুমি একা হয়ে যাবে। তোমার বাবার কালো ছায়া তোমায় অন্ধকারে ঠেলে দিবে। তাই তোমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ফুপির খুনের ঠিক আগের দিন বাবার সাথে দেখা করতে কলেজে এসেছিলো ফুপি। সেদিন আমিও ছিলাম বাবার সাথে। ফুপিকে দেখে আমরা অনেক খুশি হই। অনেক কথা হয় আমাদের মধ্যে। ফুপির সব কথা ছিলো শুধু তোমায় নিয়ে। তুমি ছোট থাকতে কেমন ছিলে, কি কি দুষ্টুমি করতে, কিভাবে বড় হয়েছো সবটা খুব আনন্দের সাথে বলছিলে ফুপি। তেমায় নিয়ে ফুপি কি কি স্বপ্ন দেখে তাও বলেছিলো। তারপর এক পর্যায়ে তোমার বাবার সম্পর্কে সবটা খুলে বলে। ফুপির মুখে এসব কিছু শুনে রাগে রক্তের বেগ বেড়ে যাচ্ছিলো আমার আর বাবার। আমরা কিছু করতে চাইলে ফুপি বলেছিলো ফুপির কাছে নাকি তোমার বাবার বি’রু’দ্ধে সমস্ত প্রমাণ আছে। প্রমানগুলো আমাদের হাতে দিয়ে বলেছিলো পরের দিন তোমায় নিয়ে চলে আসবে ওই জাহান্নাম ছেড়ে। কিন্তু তার আগেই ওরা সবকিছু শেষ করে দিলো। ফুপিকে হ’ত্যা করে ফেললো। বাঁ’চ’তে দিলো না ওরা ফুপিকে।
খু’নে’র এক ঘন্টা আগেও ফুপির সাথে আমার কথা হয়েছিলো। ফুপি বারবার বলছিলো তোমাকে এই অ’ন্ধ’কার গহ’ব্ব’রের কা’লো সত্য কোনদিন জানতে দিবে না। ফুপি চায়নি তুমি কখনো রাগের বসে হলেও কোন অ’ন্যা’য়ের ভাগিদার হও।
ফুপির খু’নে’র পর তোমার চাচি সবার কাছে এমন রটনা রটিয়েছিল যে বাড়িতে নাকি ডা’কা’ত পড়েছিলো। তারা সবকিছু লু’ট’পা’ট করে নিয়ে যাওয়ার সময় ফুপি আর তোমার বাবা বাধা দিলে তাদের নাকি হ’ত্যা’র চেষ্টা করা হয়। তোমার চাচা চাচি নাকি তখন বাড়িতে ছিলো না। আর তুমি ও তোমার চাচাতো বোনেরাও যে যার কলেজে ছিলে। তার বলা মি’থ্যে কাহিনী সবাই বিশ্বাস করে নেয়। এমনকি পুলিশের তদ’ন্তেও এমনটাই বেরিয়ে আসে। পুলিশও অন্যকিছুর হদিস করতে পারে নি। আমাদের কাছে ফুপির দেওয়া তোমার বাবার বি’রু’দ্ধে সব প্রমাণ থাকলেও ফুপির খু’নে’র সম্পর্কে কিছু জানতাম না। কোন প্রমাণ তো দূরে থাক। কিছুই বুঝে ওঠতে পারছিলাম না আমরা কি করবো। তখন আমি আর বাবা টুসুর সাথে যোগাযোগ করি। ওকে ফুপি আমাদের সম্পর্কে সবটা বলেছিলো। ওর ও আসার কথা ছিলো তোমাদের সাথে আমাদের বাড়িতে। তোমাদের বাড়ির পাশে বাসা ভাড়া নিয়ে তোমার চাচা চাচির গতিবিধির ওপর নজর রাখতে শুরু করি আমরা। টুসু রোজ ও বাড়ির খবর দিয়ে যেতো। হটাৎ একদিন…
#চলবে
#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১১
তখন আমি আর বাবা টুসুর সাথে যোগাযোগ করি। ওকে ফুপি আমাদের সম্পর্কে সবটা বলেছিলো। ওর ও আসার কথা ছিলো তোমাদের সাথে আমাদের বাড়িতে। তোমাদের বাড়ির পাশে বাসা ভাড়া নিয়ে তোমার চাচা চাচির গতিবিধির ওপর নজর রাখতে শুরু করি আমরা। আমি বেশিরভাগ সময় ওই বাসায় থাকতাম। মাঝে মাঝে বাবাও আসতো। টুসু রোজ ও বাড়ির খবর দিয়ে যেতো। হটাৎ একদিন নাবিলার বিয়ের সম্বন্ধ এলো। সেদিন তোমাকেও তারা তাদের ছোট ছেলের জন্য পছন্দ করলো। তোমার চাচি কে হাত করে বিয়ে ঠিক করা হলো। তুমি রাজি ছিলে না জানতাম। কিন্তু তোমার বাবার জন্য কোন স্টেপ নিতে পারছিলে না। তোমার চাচি তোমাকে তোমার বাবার কথা বলে ভয় দেখিয়ে বিয়ে করতে রাজি করায়। সে সময় আমি তোমার চাচির গতিবিধির ওপর নজর রাখতে রাখতে এটুকু জেনে গেছিলাম যে ফুপির খু’নে’ তোমার চাচিরও হাত ছিলো। আর এটা জানতে পেরেছিলাম তোমার চাচি আর তার ভাইয়ের কথোপকথন থেকে। তোমার চাচির ভাই মাঝে মাঝে এটা সেটা নিয়ে আসতো লুটপাট করা জিনিসগুলো থেকে। আর তোমার চাচি সেগুলো সংগ্রহ করতে যেতো আমি যে বাসায় ভাড়া থাকি সেই বাসার পিছনের জংগলে। আর তাদের টুকটাক বিশেষ কথার দরুন অনেক কিছুই খোলাসা হয়ে যায় আমার কাছে। কিছু রহস্যের ওপর থেকে পর্দা উন্মোচিত হয়। যা আমার রাস্তা বহুগুণ সহজ করে তোলে।
তোমার মায়ের মৃত্যুর পিছনে তোমার চাচির যে হাত আছে সেই খবরটা আমি টুসুকে দিয়ে তোমার কানে পৌছে দেই বিয়ের দিন। আর তুমিও সমস্ত ভয় এর বাঁধ ছিন্ন করতে সক্ষম হও। আর বিয়ে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নাও। তবে তোমার পালিয়ে আসার কথা ছিলো আমার বলা ঠিকানায়। কিন্তু তুমি অন্য কোথাও চলে যাও। ওইদিন রাতে তোমাকে অনেক খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি। ট্রাস্ট মি আড়াল, ওই দিন যদি তোমাকে পেয়ে যেতাম তাহলে হাত পা বেঁধে হলেও তোমায় নিয়ে আসতাম। কিন্তু তুমি তো যেন কর্পুরের মতো উবে গেছিলে। তোমার বাবার মায়ায় ওই জাহান্নামে আবার ফিরে এলে পরের দিন দুপুরের আগে। আমি খবর পেয়ে টুসুকে পাঠিয়েছিলাম তোমার কাছে। তোমায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু তুমি পিঁপড়ের মহান লাইফ হিস্ট্রি শুনিয়ে ওকে পাঠিয়ে দিলে আমার কাছে।
তারপরের দিনই তোমার চাচিকে তার ভাই ও দুইজন লোকসহ জংগলে যেতে দেখে তাদের পিছু নেই আমি। তাদের কথোপকথন শুনে বুঝতে পারি বাড়ি ফাঁকা হলে তারা তোমায় আর তোমার বাবাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছে। আর সৌভাগ্যক্রমে সেদিনই তুমি মেসেজ করে জানালে যে পরের দিন তুমি কলেজে আসছো। আর আমার সাথে দেখা করতে চাও। আর আমিও তখন প্ল্যান করে ফেলি ওইদিনই কলেজ থেকে সোজা তোমাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসবো। বাবাকে দিয়ে তোমায় তা জানালাম। কিন্তু তুমি তোমার নিজের সেফটি নিয়ে না ভেবে সো কল্ড বাবার দশা চিন্তা করে পালিয়ে চলে গেলে ওই বাড়ি। আমি কলেজ ছুটির পর তোমায় অনেক খুঁজেছি। কিন্তু পাই নি। তোমায় কল করেছি মেসেজ করেছি। কিন্তু কোন সাড়া পাই নি। আমি বাবার এক পুলিশ বন্ধুর সাহায্যে কিছু পুলিশ নিয়ে তোমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হই। আর তখনই তোমাকে একটা লাস্ট মেসেজ করি আর তুমি সেই মেসেজটির রিপ্লাই করো। আর আমিও সিওর হইযে তুমি বাড়ি আছো এবং তখনও অবদি সেইফ আছো। কিন্তু বিপদ তোমার খুব নিকটেই। আর তারপর তো সব টা জানোই। তারপর ওইবাড়ি পৌছিয়ে তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেই আর তোমাকে এই বাড়ি নিয়ে আসি। দ্যাটস ইট।
আমি প্রাণহীন হিমশীতল বরফ খন্ডের ন্যায় অনুভূতিহীন হয়ে দাড়িয়ে আছি। সবটা শুনে নিজের মনে মজুদ করা সব প্রশ্নের হিসেব মিলানোর চেষ্টা করছি। সবটা মিলে গিয়েও কোথাও একটা ‘কিন্তু’ থেকে যাচ্ছে। তবে তা আমি ঠিক পাকড়াও করে ওঠতে পারছি না। কিছু প্রশ্ন যেনো এখনো কোথাও না কোথাও ধোয়াশা রয়ে গেছে। তবে সেই প্রশ্নের হদিস মিলছে না হিসেবের খাতায়। আমার মনে হচ্ছে অনেক কিছু আমি জানি না। তবে আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া কথাগুলো প্রশ্ন আকাড়ে সাজিয়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছি না। কোথা থেকে কিভাবে কি দিয়ে শুরু করবো বুঝে ওঠতে পারছি না।
‘কি? ব্রেন হাতড়িয়ে আর কোন প্রশ্ন খুঁজে পাচ্ছ না? এখন রুমে গিয়ে বিশ্রাম করো। তারপর না হয় ঠান্ডা মাথায় প্রশ্নের খোঁজ করতে পারবে। ব্যাপারটা তোমার জন্য ইজি হবে আরকি।’
আচমকা শুদ্ধ ভাইয়ার কথায় আমার হুশ ফেরে। কন্ঠে তার উপহাসের সুর। আমার গায়ে যেন জ্বালা ধরলো তার ঠোঁটের কোনার হাসি দর্শন করে। আমার মনে যে এখনো ‘কিন্তু’ রয়ে গেছে তাতে যেন এই দানবটা খুব মজা পাচ্ছে। সত্যিই কি এখনো আমার জানার বাইরে কিছু রয়ে গেলো? নাকি এ শুধুমাত্র আমার মনের ভুল।
আমি আমার রুমে ফিরে যাবার উদ্দেশ্যে পিছনে ঘুড়ে দাঁড়ালে চোখে পড়ে এক কোনায় দাড়ানো স্যারকে। চোখে চোখ পড়ার সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলাম। যদিও স্যার এর দৃষ্টি দেয়ালে টাঙানো ছবিটির দিকে আমার দিকে নয়। তবুও তাকাতে পারলাম না। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছিল। মা ও কি আমার উপর রেগে আছে? আমি যে তার ভাইয়ের ওপর তারই খু’নে’র দায়ে আঙ্গুল তুলেছি। নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। বেরিয়ে পরলাম রুম থেকে। কারো সামনাসামনি হতে বিবেকে বাঁধছে।
‘এতোকিছু বলার কি কোন প্রয়োজন ছিলো?’
বাবার কথায় ঈষৎ হাসলো শুদ্ধ। হাসি মুখেই জবাব দিলো,
‘তোমার ভাগ্নি সম্পর্কে তোমার ধারণা খুবই অল্প। তাই এই কথা বলছো।’
আমি আমার বোনকে কথা দিয়েছিলাম ওকে কখনো এসবে জরাতে দেবো না। কোন অন্ধকারের ভীড়ে হারাতে দেবো না। এতোকিছু জানার পর কি ও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? নিশ্চই না। ও চেষ্টায় থাকবে ওর মায়ের মৃ’ত্যু’র প্রতিশোধ নিতে। হিংস্র মনোভাব পোষণ করবে। এটাইতো ভয় ছিলো আমার বোনটার। ও চেয়েছিলো মেয়েটা যেনো কখনো কোন অন্যায়ের পথে পা না বাড়ায়। তুই তো ওকে সেই পথেই ঠেলে দিলি। কোন সন্তানই এসব জানার পর চুপ করে বসে থাকতে পারবে না। ও কি করে পারবে?’
‘সরাসরি হোক বা ঘুরিয়ে পেচিয়ে হোক, ও ঠিক যতোটা জানে ওকে আমি ততটাই জানিয়েছি। আমরা পৌছানোর আগেই ও ওর চাচির মুখ থেকে কৌশলে সবটা জেনে নিয়েছিলো। ওর কাছে রেকর্ডার ছিলো। তাতে সবটা রেকর্ড করা ছিলো। আমি শুনেছি সেটা। আর সেই রেকর্ড অনুযায়ী ও যা জানে আমিও ওকে তাই বলেছি। ওর চাচির কথার ফাক ফোকরে যে আরও অনেক সত্য লুকিয়ে আছে তা ও জানে না। আর জানবেও না। শুধু ফুপির সাথে আমাদের দেখা হওয়ার বিষয়টা আর আমাদের সাথে ওর সম্পর্কের ব্যাপারটা ওকে বলেছি নিজে থেকে। এতে ওর ভালোই হবে। খারাপ হবে না। বাড়িটাকে আপন করে নিতে ওর সুবিধা হবে। মায়ের শেষ ইচ্ছে ভেবে আকড়ে ধরতে চাইবে এই নীড়টাকে। ওকে এখানেই থাকতে হবে। এটাই হবে ওর আপন আবাস।’
কথা শেষ করে বাবার দিকে দৃষ্টি দিলে দেখতে পায়, তার বাবার চেহারায় ফুটে ওঠেছে রুষ্টতা। এই রুষ্ট দৃষ্টিতেও যেন হেয়ালি। তাতে শুদ্ধ যেন বেশ মজা পেলো। অন্যদিকে তাকিয়ে আশেপাশে নজর বোলাতে বোলাতে বেড়িয়ে এলো রুম থেকে। এখন এখানে থাকলে হুটহাট বিস্ফোরণের সামনা হতে পারে।
সাদা রঙের দেয়ালটিতে বেশ সুন্দর গাছের আকৃতির একটা দেয়াল ঘড়ি ঝুলানো। তাতে এখন প্রায় নয়টা বাজে। সেই যে তখন রুমে এসেছি তারপর আর বের হইনি। কেউ ডাকতেও আসেনি। হয়তো বা আমার ভয়ে। অথবা অস্বস্তিতে। তখন সবার সামনে যা রুপ দেখিয়েছি। স্যারকে যা নয় তাই বলেছি। সবাই হয়তো আমার ওপর অনেক রেগে আছে। কেউ হয়তো আমার সাথে আর ঠিক করে কথাও বলবে না। আমার সবার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। বিশেষ করে স্যার এর কাছে। আমার মা আজ বেঁচে থাকলে পরিস্থিতি কত ভিন্ন হতো। আমাকে এমন করতেই দিতো না। মা সবসময় বলতো আমাকে যেনো কখনো কোন পাপ ছুঁতে না পারে। আমার দ্বারা কেউ কখনো মনে দুঃখ না পাক। আর আমি কিনা তারই সবথেকে বেশি বিশ্বাস এর জায়গায় আঙ্গুল তুলেছি।
হটাৎ দরজায় কেউ নক করলো। আমি ভিতরে আসতে বললে মামনি ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। তাকে দেখে তৎক্ষনাৎ আমি নজর ঝুকিয়ে দাড়িয়ে পড়ি। মামনি আমাকে আদুরে গলায় বললো,
‘বাইরে সবার সাথে বসে খাবার খেলে সবাই খুশি হতো। তুমি কি আসবে?তোমার যদি আপত্তি থাকে তাহলে আমি খাবার ঘরে নিয়ে আসছি। কোন সমস্যা নেই। তুমি না চাইলে কোন জোর নেই।’
এতো কিছুর পরেও মামনির আদুরে গলায় এমন কথা শুনে আমার চোখ টা জ্বলে ওঠলো। চোখ ফেটে কষ্ট আর অনুতাপ এর স্রোত বেড়িয়ে আসতে চাইলো। আমি নজর লুকিয়ে মাথা নেড়ে সায় জানালাম। মামনির সাথে এগিয়ে গেলাম ডাইনিং রুমের দিকে।
ডাইনিং রুমে পৌছে চোখে পড়লো বাড়ির সবাই টেবিলে খাবার নিয়ে বসে আছে। হয়তো আমার জন্যই অপেক্ষা করছে। মনটা হটাৎ ফুরফুরে হয়ে ওঠলো। এখন আমারও আপনজন আছে। আমার জন্যেও কেউ খাবার সামনে বসে অপেক্ষা করে। হটাৎ চোখে পড়লো শুদ্ধ ভাইয়ার দিকে। টেবিলের সবার নজর আমার দিকে হলেও ওই দানবটা নিজের মতো বসে আছে। খাবারের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন প্লেটে খাবার নয় প্রেমিকা আছে। দানব একটা।
আচমকা সবার দৃষ্টি পাল্টে গেলো। সবাই একসাথে আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ছোটরা একটু হেসেও ওঠলো। আমি খানিক ভড়কে গেলাম। সবাই আমার দিকে এমন করে কেনো তাকিয়ে আছে? আমি কি শেষের কথাটা জোরে বলে ফেললাম। হায় খোদা। ওই দানবটাও তো দেখছি এখন আমার দিকেই বিহ্বলিত হয়ে তাকিয়ে আছে। এবার আমি শিওর হয়ে গেলাম। শেষের কথাটা মনে মনে না। মুখেই বলেছি। এবং যথেষ্ট উচ্চ স্বরেই বলেছি। কোনভাবে কি মাটি ফাঁক হয়ে যেতে পারে না। আমি একটু ঠাঁই নিতাম।
#চলবে