#আড়াল_কথা,১২,১৩
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১২
আমি কি শেষের কথাটা জোরে বলে ফেললাম। হায় খোদা। ওই দানবটাও তো দেখছি এখন আমার দিকেই বিহ্বলিত হয়ে তাকিয়ে আছে। এবার আমি শিওর হয়ে গেলাম। শেষের কথাটা মনে মনে না। মুখেই বলেছি। এবং যথেষ্ট উচ্চ স্বরেই বলেছি। কোনভাবে কি মাটি ফাঁক হয়ে যেতে পারে না। আমি একটু ঠাঁই নিতাম।
একি! উনি উঠে আসছে কেনো? আমার দিকেই তো আসছে মনে হচ্ছে। এবার কি আমায় মা’রবে টারবে নাকি। তখন যে চড়টা মেরেছিলো। এখনে গালে হাত দিলে ব্যা’থা লাগে। এখন আবার দিলে আমি শেষ। আমি দুই হাতে আমার ছোট্ট গাল দুটো চেপে ধরে দাড়িয়ে রইলাম। অন্য কোথাও দিক। গালে না। বাহুতে একটা দিয়ে দিক। বেশি ব্যাথা পাবো না। একি, উনি তো আমার ঘারের দিকে হাত বারাচ্ছে। হায়হায়! এতোগুলো মানুষের সামনে কি আমায় ঘাড়ে চেপে ধরবে। নাকি তুলে আছাড় মারবে। কেউ কিছু বলছে না কেনো।
আমি চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললাম। কিন্তু কিছুই বুঝে ওঠতে পারলাম না। এখনো তো কোন কিছুরই আভাস পাচ্ছি না। ভয়ে ভয়ে চোখটা সামান্য খুললাম পরিবেশ বুঝতে। কিন্তু সামনে তো উনি নেই। উনি তো চলে যাচ্ছেন। এটা কি হলো! উনি আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসে প্লেট পর্যক্ষনে মনোনিবেশ করলেন। আমি বিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলাম।
মামনি হটাৎ আমায় আশ্বাস দিয়ে বললো,
‘তুমি ভয় পেয়ো না। টিকটিকি দুটোকে তোমার কাঁধ থেকে শুদ্ধ সরিয়ে দিয়েছে। টিকটিকি দেখে এতো ভয় পাও তুমি? একেবারে চোখমুখ খিঁচে দাড়িয়ে ছিলে।’
আমি মামনির কথায় হতবাক হয়ে গেলাম। আমার কাঁধে টিকটিকি পড়েছিলো! তাই সবাই এমন করে তাকিয়ে ছিলো। আর ছোটরা হাসছিলো। আর আমি কি না কি ভেবে বসেছিলাম। যাক, তখনকার কথাটা জোরে বলিনি তাহলে।
বুক ভরে শ্বাস নিলাম। গলা টা শুকিয়ে গেছে। পানি পেলে ভালো হতো। মামনির সাথে টেবিলে গিয়ে বসলাম। মামনি আর সেই পরি দাদী সবাইকে খাবার বেড়ে দিতে লাগলেন। আমার ডান দিকে বৃষ্টি বেসেছে আর বাম দিকে শান্ত। আর ঠিক সামন বরাবর বসেছে দানবটা। সবাই চুপচাপ খাচ্ছে। আমিও খাওয়া শুরু করলাম। এতোগুলো অচেনা মানুষের সামনে বসে খেতে একটু অস্বস্তি
লাগছে। ঠিকমতো খেতে পারলাম না। অল্প কয়েকবার খাবার মুখে দিয়ে উঠে পরলাম। মামনি আরও কিছুটা খেতে বললো। আমি না করায় আর বেশি জোরাজোরি করলো না কেউই। আমি চলে এলাম আমার রুমে।
আধঘন্টা পর হটাৎ ছোট মা আর মামনি এলো আমার ঘরে। হাতে দেখছি খাবারের প্লেট। ছোট মায়ের মুখের দিকে তাকালে মায়ের চেহারার বেশ মিল পাওয়া যায়। যদিও খুব বেশি নয়। কিন্তু বোঝা যায়।
দুজনে আমার সামনে এসে বিছানায় বসে বললেন, ‘তখন নিশ্চয় এতো মানুষের সামনে বসে খেতে পারনি। অচেনা জায়গা। অচেনা মানুষ। মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে মা। আমরা তা বুঝি। এবার খাবারটা খেয়ে নাও। নিশ্চই পেটে খিদে আছে। আরেকটা কথা বলি মা।
আমার মাথায় হাত রেখে মামনি স্নেহভরা কণ্ঠে বললো,
‘আমরা তোমার আপনজন। আমাদের পর মনে করো না। বাড়ির সবাইকে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করো।’
‘হ্যা মা। এই বাড়ি টাকে নিজের বাড়ি মনে করো। আর বাড়ির মানুষগুলোকে নিজের আপনজন। দেখবে সবাই তোমাকে কতোটা ভালোবাসে।’
‘তুমি কিছু মনে না করলে আমি একটা আবদার করতে পারি তোমার কাছে?’
ছোট মা আর মামনির কথা শুনে আমার অদ্ভুত ভালো লাগা সৃষ্টি হচ্ছে। বড্ড আপন মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে একবার জরিয়ে ধরতে। মামনির কথায় আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে মামনি এক গাল হেসে দিয়ে আমার হাত টা ধরে বলে,
‘আমরা সবাই তোমাকে তুই করে বললে কি তুমি রাগ করবে মা? তুমি করে বললে পর পর মনে হয়। আমার তিন জা মানে তোমার আরও তিন মামিরাও কিন্তু বাইরে দাড়িয়ে আছে। যদিও ওরা বলতে মানা করেছিলো। কিন্তু বলে দিলাম। ওরাও চায় তোমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতে। কাছে টেনে নিতে।’
মামনির কথা শেষ হতে না হতেই ভেতরে প্রবেশ করলো তিন মামি। সাথে পরি দাদী। সবাই আমাকে ঘিরে দাঁড়ালো। সবার চেহারায় মুখভর্তি হাসির ঝলকানি।
আমি এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। মনের সুপ্ত আবেগ গুচ্ছ অশ্রু হয়ে নির্দ্বিধায় বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পড়লো। ছুঁয়ে দিলো আমার গাল, থুতনি, গলা। আমার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কেন সেদিন সবটা ওলট-পালট হয়ে গেলো। আজকের এই মুহুর্তে তো মায়েরও আমার সাথে থাকার কথা ছিলো। সব ঠিক থাকলে আজ মা ও এই খুশির ভাগীদার হতো।
আমার অঝোরে কান্নার বহর দেখে সবাই উত্তেজিত হয়ে পড়লো। সবাই আমায় এমনভাবে শান্তনা দিতে লাগলো যেন আমি কোন ছোট বাচ্চা। মামনি প্লেট তুলে নিয়ে নিজে হাতে আমার মুখে খাবার তুলে দিতে লাগলেন। খাওয়া শেষে সবাই হাসি মুখে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। আমি প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম। সব শুন্যতা এভাবে চোখের পলকে গায়েব হয়ে যাবে ভাবি নি।
ঘুমানোর প্রস্তুতিতে বিছানায় শুতে গেলে ওমনি কেউ দরজায় নক করে। বালিশের কাছ থেকে ওরনা গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে অনুমু দিয়ে ভিতরে আসতে বলি।
দরজাটা খুলে ভিতরে আসে শুদ্ধ ভাইয়া। তাকে এখন এই সময়ে মোটেও আশা করি নি। একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম উনাকে দেখে। উনি খানিকটা এগিয়ে এসে আমায় জিজ্ঞেস করে,
‘দরজাটা খোলা ছিলো যে? লক করো নি কেনো?’
‘এখনি লক করতাম। ঘুমানোর প্রস্তুতিই নিচ্ছিলাম। ওমনি আপনি চলে এলেন।’
‘তখন ছাঁদে ওমন করে তাকিয়ে ছিলে কেনো? যেনো আমাকে একা পেলে একেবারে কাঁচা চিবিয়ে খেতে।’
‘আমি যে তখন আপনার দিকে রেগে তাকিয়ে ছিলাম তা আপনি বুঝেছিলেন? তাহলে তখন ওমন একটা কথা কেনো বললেন?’
‘যাতে আর কখনো আমার দিকে ওমন রেগে না তাকাও তাই।’
‘একশো বার তাকাবো। আমিও দেখি আপনি কি করেন?’
‘ভারী নির্লজ্জ মেয়ে তো তুমি। অন্যের বরের চোখে ওমন করে সময় জ্ঞান ভুলে চেয়ে থাকতে লজ্জা লাগে না?’
‘আপনি বিবাহিত?’
‘কেন? অবিবাহিত হলে বুঝি তাকিয়ে থাকার লাইসেন্স পেয়ে যাবে।’
‘আমি কি তাই বলেছি নাকি? আপনার বউ তো দেখলাম না। তাই জিজ্ঞেস করেছি।’
‘তাও তাকানো ছাড়বে না তাই না?’
আচ্ছা আমি এই হাত জোর করে বলছি আমি আপনার দিকে তাকাবো না। এবার খুশি?’
‘তুমি আমার দিকে তাকাবে না কেনো? আমায় দেখলে বুঝি নিজেকে কনট্রোল করতে পারো না?’
‘আচ্ছা আজব মানুষ তো আপনি। আপনিই তো বললেন, আমি যেন রেগে তাকিয়ে না থাকি আপনার দিকে। তখন রেগে তাকিয়ে ছিলাম বলেই নাকি ওমন কথা বলেছেন।’
‘এইতো এবার পথে এসেছো। এটাই বোঝাতে চাচ্ছিলাম। এইটা যেনো মাথায় থাকে। ভুলেও আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাবে না। ফের যদি এমন করেছো তাহলে এমন নাকানিচুবানি রোজ খাওয়াবো।’
আমার মাথা ভো ভো করে ঘুরছে। সামনে দাড়ানো লোকটাকে জ্বলন্ত উনুন এর চেয়ে কোন অংশে কম মনে হচ্ছে না। একেবারে ভাজা ভাজা করে ছাড়লো। মন চাচ্ছে হাত পা বেঁধে বসিয়ে রেখে সারাদিন আগুন চোখে চেয়ে থাকি দানবটার চোখে।
‘কি হলো তোমাকে দেখে আবারও রাগী মনে হচ্ছে যেনো?’
আমি অসহায় কন্ঠে মিনতি করে বললাম,
‘আপনি ঠিক করে দেখুন। রাগ নয় ঘুম দেখতে পাবেন আমার চোখে।’
‘ঘুম দেখার জিনিস নয়। দেখাদেখি বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আর মনে যেনো থাকে, ভুলেও আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাবে না। এবার দরজাটা লক করে ঘুমিয়ে পড়ো। গুড নাইট।
দরজাটা লক করে দিয়ে বিছানায় এসে ধপ করে বসে পড়লাম। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। বাড়ির সবাগুলো মানুষ এতো ভালো। আর এই লোকটা আস্ত এক দানব। প্রথম দেখায়ই লোকটাকে দেখে মনে মনে দানব
নামের উপাধি দিয়েছিলাম। আজ মনে হচ্ছে নামটা সার্থক হলো। এসেছি পর থেকে জ্বালিয়ে মারছে। কি ঘারত্যারা। ওফ্ফ!
___________
সকালে সূর্যের মিঠে আলো গায়ে মেখে ঘুম ভাঙলো আমার। চোখ খুলে দেখি রাতে জানালার গ্লাস না টেনেই ঘুমিয়ে পড়েছি। তাই রোদের অবাধ বিচরণ এখন আমার ওপর। যেনো দখল করে নিয়েছে আমায়। উঠে বসে ঘরির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল আটটা বাজে। ইশ একটু বেলা হয়ে গেলো। আরেকটু আগে উঠতে পারলে ভালো হতো। বাথরুমে ঢুকে কোনমতে ফ্রেশ হয়ে বাইরে চলে এলাম। রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে দেখি সবাই মিলে কিছু না কিছু করে যাচ্ছে। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠি,
‘কোন হেল্প লাগলে আমায় বলনা তোমরা। আমি একটু আধটু কাজ জানি কিন্তু। আমাকে..
সবাই হটাৎ এমন ভয়ংকর চাহনি দিলো যে মুখের কথাটা আর শেষ করতে পারলাম না। কোনমতে ওখান থেকে চলে এলাম। ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসে পরলাম। আমি বসতেই বৃষ্টি আর সৃষ্টি চলে এলো। ওরা এসেই এমন করে গল্প জুড়ে দিলো যেনো আমি ওদের কত আগের চেনা কেউ। হটাৎ ডাইনিং রুমে আগমন ঘটলো শুদ্ধ ভাইয়ার। এসেই আমার সামনের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো। বৃষ্টি আর সৃষ্টির সাথে টুকটাক কথা বলে আমার দিকে তাকিয়ে আচমকা বলে ওঠলো,
‘খাওয়া শেষ করে রেডি হয়ে থেকো। ওদের রোজ আমি কলেজ নিয়ে যাই। আজ থেকে তুমিও ওদের সাথে কলেজ যাবে।’
‘কিন্তু ওদের কলেজ তো আলাদা।’
‘তাতে কি? এক রাস্তা দিয়েই তো যেতে হবে। একসাথে যেতে তোমার সমস্যা কোথায়?’
‘তার কোনো দরকার নেই। আড়াল রোজ আমার সাথে কলেজ যাবেন। আবার আমার সাথেই বাড়ি ফিরে আসবেন।’
হটাৎ স্যারের গলা শুনে পিছনে ফিরে দেখি স্যার গম্ভীর মুখ নিয়ে দাড়িয়ে আছেন। আমি স্যারকে দেখে মাথা নিচু করে বসে রইলাম। ওনার দিকে তাকানোর সাহস হলো না। অপরাধ বোধে ঝুঁকে এলো আমার দৃষ্টি।
বাবার কথা শুনে শুদ্ধ ঠোট বাকিয়ে খানিকটা হাসলো। তারপর বৃষ্টি আর সৃষ্টিকে কিছু একটা ইশারা করতেই ওরা দুজন আাসিফ সাহেবকে চেপে ধরে রাজি করানোর জন্য। ওদের যেনো একসাথে যেতে দেওয়া হয় এটাই ওদের দাবী।
আসিফ সাহেব কখনো বাড়ির মেয়েদের কোন আবদার অবহেলা করেন না। ইচ্ছে না থাকলেও রাজি হয়ে গেলেন। বৃষ্টি আর সৃষ্টি লাফিয়ে ওঠে আড়ালকে জরিয়ে ধরে। এদিকে বাবা ছেলের মধ্যে চোখে চোখে চলতে থাকে বাক্য বিনিময়। শুদ্ধ বাঁকা হেসে আসিফ সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন,
‘তাহলে তোমার কোন আপত্তি নেই তো বাবা? আমি আড়াল কে নিয়ে যাবো তো?’
আসিফ সাহেব উত্তর না দিয়ে খবরের কাগজ নিয়ে বসে পড়লেন। তার মুখভঙ্গিতে মনের অবস্থা বোঝা দায়।
#চলবে
#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১৩
‘তাহলে তোমার কোন আপত্তি নেই তো বাবা? আমি আড়াল কে নিয়ে যাবো তো?’
আসিফ সাহেব উত্তর না দিয়ে খবরের কাগজ নিয়ে বসে পড়লেন। তার মুখভঙ্গিতে মনের অবস্থা বোঝা দায়।
_______
সকালের খাবার পর্ব শেষ করে আমি রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে চলে আসি। এসে দেখি শুদ্ধ ভাইয়া ড্রয়িংরুমে দাড়িয়ে বিক্ষোভ পূর্ণ চেহারা নিয়ে বারবার হাতের কালো ঘরিটাকে দেখছে। আমি নিজের হাত ঘড়ির দিকে নেত্রপাত করে দেখি কলেজ শুরু হতে এখনো এক ঘন্টা বাকি। এখান থেকে গাড়ি করে যেতে আধঘন্টার বেশি সময় লাগার কথা নয়। শুদ্ধ ভাইয়ার এমন অযথা বিরক্তি দেখে একটু অস্বস্তি হলো। মনে হলো হয়তো আমার জন্যই এমন বিরক্ত হচ্ছেন।
আমি এগিয়ে গিয়ে শুদ্ধ ভাইয়ার সামনে দাড়ালে উনি আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে বেরিয়ে পড়েন বাইরের উদ্দেশ্য। আমিও পিছু পিছু এগিয়ে গেলাম। গাড়ির সামনে গিয়ে দেখি বৃষ্টি, সৃষ্টি, শান্ত আর ফুয়াদ সবাই গাড়ির পিছনে বসে আছে। শুদ্ধ ভাইয়া অলরেডি
ড্রাইভিং সিট এ বসে পড়েছে। আমি সামনের সিটে বসার জন্য সামনের সিটের দরজা খুলে বসতে গেলে শুদ্ধ ভাইয়া শান্তকে ডেকে বলে ওঠে,
‘শান্ত তুই সামনে এসে বোস। আর ওকে পিছনের সিটে বৃষ্টির সাথে বসতে দে।’
শুদ্ধ ভাইয়ার এমন কথায় অপমানে আমার মনটা তমসাবৃত হয়ে এলো। তবে মুখে তা প্রকাশ না করে পিছনে গিয়ে বসে পড়লাম বৃষ্টির সাথে। একটু লজ্জা লাগলো সবার দিকে তাকাতে। কারো দিকে না তাকিয়ে মেঘমেদুর মুখ নিয়ে জানালার দিকে মুখ করে বসে রইলাম। গাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে। কিছুক্ষণ পর একটা কলেজের সামনে এসে গাড়ি থামে। ওরা সবাই নেমে গেলে শুদ্ধ ভাইয়া হটাৎ আমায় উদ্দেশ্য করে বলে,
‘আড়াল সামনে এসে বসো।’
আমার এবার বেশ রাগ হলো। একটু আগে সামনে বসছিলাম তখন বসতে দিলো না। আর এখন আবার বলছে সামনে বসতে। ইচ্ছে হলো মুখের ওপর বলে দিতে যে, ‘আমি বসবো না। আপনার যা খুশি করুন।’
কিন্তু যতই হোক, ওনাদের জন্য আমি আজ সসম্মানে বেঁচে আছি। বিশেষ করে ওনার জন্য। তাই রাগ হলেও, রাগে মাটি চাপা দিয়ে বেরিয়ে এলাম পিছন থেকে। সামনের সিটে গিয়ে বসলাম। আমি বসতেই উনি গাড়ি স্টার্ট দিলেন। কিছুদুর যেতেই হটাৎ একটা ক্লিনিকের সামনে গিয়ে গাড়ি থামালেন। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার অবকাশ পেলাম না। উনি এসে দরজা খুলে আমায় বের হতে বললেন। আমি বেরতেই উনি, ‘আমার সাথে এসো’ বলে হসপিটালের ভেতরের দিকে যেতে লাগলেন। মনে মনে ভাবলাম হয়তো চেনা পরিচিত কেউ ভর্তি আছে। তাই কিছু না বলে উনার পিছু নিলাম।
ভেতরে গিয়ে উনি তিন তলায় উঠে আমাকে একপাশে দাঁড় করিয়ে বললেন,
‘তুমি পাঁচ মিনিট এখানে একটু দাঁড়াও। আমার ফ্রেন্ড রিয়াদ এখানে ভর্তি আছে। একটা এক্সিডেন্ট করেছে গতকাল। আমি একটু দেখা করে আসছি।’
আমাকে দাড়াতে বলে উনি চলে গেলেন। ওনার প্রতি যতটুকু সম্মান ও কৃতজ্ঞতা বোধ ছিলো তা যেন সবটা মন থেকে ইস্তফা দিয়ে উবে যাচ্ছে। এতোটা কেয়ারলেস কেউ কি করে হতে পারে! আাসার সময় সিটিং এরিয়া দেখলাম। ওখানেও তো আমায় বসিয়ে রেখে আসতে পারতো। এখানে এভাবে একা একা কতক্ষণ দাড়িয়ে থাকবো। হয় গাড়িতে বসিয়ে রেখে আসতো নয়তো আমায় কলেজে নামিয়ে দিয়ে তারপর এখানে আসতো। আশেপাশে কত লোক। কিভাবে তাকিয়ে আছে! যেনো চোখ দিয়ে গিলে খাবে।
হটাৎ আঠারো নাম্বার কেবিনের দিকে নজর আটকে গেলো। একজন মহিলা মোবাইলে কথা বলতে বলতে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসছে। আমি বরফের ন্যায় জমে গেলাম। মন বলছে দৌড়ে পালিয়ে যেতে। কিন্তু পা যেন জমে গেছে। মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো, ‘তাহেরা খালা’ নামটি। চোখের সামনে ভেসে ওঠলো একটি আমাবস্যার ন্যায় কালো রাতের প্রতিচ্ছবি।
আচমকা অনুভব হলো, কেউ যেন আমার বাহু ধরে ঝাঁকি দিলো। কালো অন্ধকারচ্ছন্ন স্মৃতি মিলিয়ে গিয়ে স্পষ্ট হলো তাহেরা খালার চেহারা। আমার চোখে চেয়ে আছে হাসিমাখা ঝলমলে চেহারা নিয়ে। যেম হারানো কিছু ফিরে পেয়েছে। বিনিময়ে আমারও বোধহয় হাসি ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু মনের বিরুদ্ধে গিয়ে হাসি মুখে খালার চোখে চাইতে পারলাম না। আমি এখানে কেনো, এখন কোথায় আছি, মায়ের সাথে কি করে কি হলো সব একে একে জিজ্ঞেস করতে লাগলো। আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। তাহেরা খালা আমার উত্তর না পেয়ে হতাস না হয়ে নিজের কথা শুরু করলেন,
‘তোর মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি রে মা। আমার অবস্থাও ভালো নয়। বড্ড বিপদে আছি। উপরওয়ালা জানেন কপালে কি আছে।’
খালার কথাগুলো এতোক্ষণ কানে এলেও যেনো আমায় ছুতে পারছিলনা। কিন্তু হটাৎ কথা বলতে বলতেই অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। ওনার কান্নায় যেনো আমার হুশ এলো। নিজেকে ধাতস্ত করে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। খালাকে কি বলে সান্ত্বনা দেবো চট করে মাথায় এলো না। খালা কাঁদতে কাঁদতে আবার বলতে লাগলেন,
‘গতকাল বিকেলে তোর খালু হটাৎ বাসায় এসে বলে দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হতে। কোন এক বিশেষ কাজে নাকি গ্রামে যাবে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলেও কোন উত্তর দেয় নি। কোনমতে আমাকে আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যার পর এসে গ্রামে পৌছাই আমরা। আমাদের বাড়িতে রেখে তোর খালু হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যেনো বেরিয়ে যায়। আমি পাশের বাড়ির ভাবির কাছে গেলে শুনতে পাই তোদের কথা। খুব কষ্ট লাগছিলো শুনে। তোর খোঁজ চাইলে কেউ দিতে পারলো না। কেউই জানে না তুই কোথায়। ঘন্টা দুয়েক পর হটাৎ আমার ফোনে হাসপাতাল থেকে কল আসে। জানায়, তোর খালুকে নাকি কারা মেরে হাসপাতালের সামনে ফেলে গেছে। এসে দেখি তোর খালুর অবস্থা খুব খারাপ। সারা শরীরে ক্ষতের চিহ্ন। ডান হাত একেবারে ভেঙে গেছে। ওই হাত নাকি ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। আর..’
খালা কথা থামিয়ে হটাৎ আবারও কেঁদে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে। কেনভাবে কান্না থামিয়ে খালা বলে ওঠে,
‘আমি আর বলতে পারছিনা রে আড়াল। আমি এখন কি করবো বুঝতে পারছি না। এখানে আমায় সাহায্য করার মতো কেউ নেই। গ্রাম ছেড়েছি নয় বছর হলো। বছরে একবার এসে ভিটে মাটি চোখের দেখা দেখে যেতাম। কারো সাথে তেমন সম্পর্ক নেই।’
খালা কান্নার কারনে ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। হটাৎ কল আসে খালার ফোনে। খালা কথা বলায় ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। আমি এগিয়ে যাই কেবিনের দিকে। দরজা খুলে ভিতরে গেলে চোখে পড়ে সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো একটি নেতানো শরীর। আমার বুকে এক ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। হটাৎ যেন বুকের ভেতর নয় বছরের পুরোনো গেড়ে বসা পাথরটি আলগা হয়ে এলো। তাকিয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। হটাৎ কেবিনে প্রবেশ করে একজন ডক্টর ও দুইজন নার্স। সাথে খালাও চলে আসে। ডক্টর নার্সের হাত থেকে ফাইল নিয়ে উল্টে পাল্টে কিছুক্ষণ দেখে নেয়। ফাইলে চোখ রেখেই খালাকে বলতে শুরু করে,
‘ওনার যা অবস্থা দেখছি তাতে এখানে রাখা ঠিক হবে না। ওনাকে ঢাকায় নিয়ে যান আপনারা। সাথে আর কেউ আসে নি? আপনারাই ওনার গার্জেন? ওনাকে যেভাবে মারা হয়েছে তাতে তো এটা পুলিশ কেস। কিন্তু পুলিশকে জানানো হয়নি। হাসপাতাল কতৃপক্ষ কেনো এটা মেনে নিলো জানি না। তাদের যখন টাকা খাইয়িয়ে পুলিশের থেকে ছুটকারা পেয়ে গেছেন, তাহলে টাকা পয়সার নিশ্চয়ই কোন অভাব নেই। ঢাকা নিয়ে গিয়ে ভালো চিকিৎসা করান। ওনাকে যেভাবে মারা হয়েছে তাতে আমার মনে হচ্ছে এটি মেয়েঘটিত কোনে বিষয়। ওনার পুরো শরীরে অজস্র ক্ষত রয়েছে। ডান হাত একেবারে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আর পু’রু’ষা’ঙ্গ কেটে একেবারে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। কেউ এমনি এমনি নিশ্চয়ই এমনভাবে মারবে না। জানি না আমার আন্দাজ কতোটা সঠিক। তবে ওনি কতোটা সুস্থ হবেন তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বাকিটা আপনারা বুঝুন।’
ডক্টরের কথা শেষ হতেই আমি দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম কেবিন থেকে। চারপাশের লোকলজ্জা আমায় ছুতে পারলো না। এক দৌড়ে গাড়ির কাছে এসে থেমে গেলাম। গাড়ি লক করা দেখে গাড়ির পিছন দিকে এসে দাড়ালাম।
ওই লোকটা শাস্তি পেয়েছে। সর্বোচ্চ শাস্তি ভোগ করছে লোকটা। আমার মন তো এমন কিছুই চেয়েছিলো। তবে সেই চাওয়া ছিলো নিজের হাতে লোকটাকে শাস্তি দেওয়ার। ইচ্ছে হতো নিজ হাতে শেষ করে ফেলি ওই জানোয়ারকে। আজ নিজেকে বড্ড হালকা লাগছে। তবে কেন জানি ভেতর থেকে ঠেলে কান্না আসছে। কেন হচ্ছে এমন। হটাৎ কেউ ‘আড়াল’ বলে ডেকে ওঠে। চোখ মুছে পিছন ঘুরে দেখি শুদ্ধ ভাইয়া দাড়ানো।
কলেজে ব্রেক টাইমে ক্লাসে বসে আছি। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো প্রশ্ন। লোকটাকে ওভাবে কে মারলো? আমার মতো আরও কোন মেয়ে কি ওই জানোয়ারের নজরে পড়েছিলো? তার কাছের কেউ কি এমন অবস্থা করেছে? প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। সেই রাতের কথা বার বার মনে হচ্ছে। কোনভাবে ভুলে ওঠতে পারছি না। মাথা মনে হচ্ছে ফেটে যাবে। প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে মাথার ভেতর।
শুদ্ধ ভাইয়া আজ কলেজ আসতে কেনো জানি মানা করছিলো। হয়তো আমার চোখ মুখ দেখে বুঝেছিলো আমার কিছু হয়েছে। তাই দয়া দেখাতে বাড়ি যেতে বলছিলো। এখন মনে হচ্ছে বাড়ি যাওয়াই ঠিক ছিলো।
হটাৎ পিয়ন এসে বলে গেলো আমার বাড়ির লোক নাকি এসেছে আমায় নিতে। গেটের সামনে গিয়ে দেখি শুদ্ধ ভাইয়া গাড়ি নিয়ে এসেছে। আমি সামনে যেতেই সামনের সিটের দরজা খুলে আমাকে ভেতরে বসতে বলে। আমার নিজেরও যাওয়ার ইচ্ছে আছে তাই কথা না বাড়িয়ে বসে পড়ি গাড়িতে। জানতে ইচ্ছা হলো এখানে কেনো এসেছেন উনি। আমাকে কেনো নিয়ে যাচ্ছেন? কিন্তু কেন জানি কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো না। মনে হলো যেন মুখটা নাড়িয়ে কথা বললেও বড্ড কষ্ট হয়ে যাবে। মাথা এলিয়ে দিলাম গাড়ির সিটে। চোখটা বুঁজে আসছে। জোর করে খুলতে ইচ্ছে হলো না। ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলাম গভীর তন্দ্রায়।
হটাৎ কারো ডাকে চোখ টেনে খুললাম। চোখের পাতা বড্ড ভারী লাগছে। কিন্তু আশেপাশে চেয়ে সব ঘুম উবে গেলো। মনের সমস্ত কালো মেঘ কেটে গিয়ে উদয় হলো আনন্দের সূর্য। ফুটে ওঠলো গাল ভরা হাসি। যে হাসিটা মায়ের খুব পছন্দ ছিলো।
#চলবে