আড়াল_কথা,১৪,১৫

0
513

#আড়াল_কথা,১৪,১৫
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১৪

হটাৎ কারো ডাকে চোখ টেনে খুললাম। চোখের পাতা বড্ড ভারী লাগছে। কিন্তু আশেপাশে চেয়ে সব ঘুম উবে গেলো। মনের সমস্ত কালো মেঘ কেটে গিয়ে উদয় হলো আনন্দের সূর্য। ফুটে ওঠলো গাল ভরা হাসি। যে হাসিটা মায়ের খুব পছন্দ ছিলো। সকালের ঘটনা বেমালুম ভুলে গেলাম। কোন বিষাক্ত স্মৃতির বিষাদ এখন মন মস্তিষ্কের আঙিনায় নেই।

রাস্তার পাশে গাড়ি দাড় করানো। এখান থেকে স্পষ্ট দেয়ালের ওপারে মায়ের কবর দেখতে পাচ্ছি। তবে শেষ যে দেখে গেলাম তখন আর এখনকার মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। মায়ের কবরের চারপাশে এখন নানা রঙের ফুলেদের রাজত্ব চলছে। যেন মাকে পাহারা দিচ্ছে ওরা। দৃশ্যটি দেখামাত্র মনে হচ্ছে মা বোধহয় এখন হাসছে। ফুলের সৌরভে মুখরিত হচ্ছে মায়ের মন। মা আমার ফুলের সঙ্গ কি যে ভালোবাসতো। নিজে হাতে কতশত ফুলের গাছ লাগাতো নিজে হাতে।

পাশে তাকিয়ে দেখি শুদ্ধ ভাইয়া অপলক তাকিয়ে আছে আমার দিকে। একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। নিজের অপ্রস্তুত মনোভাব পাত্তা না দিয়ে ওনাকে ডেকে ওঠে বললাম,

‘শুদ্ধ ভাইয়া! ফুল গাছগুলো মনে হচ্ছে আজই লাগানো হয়েছে। আমার না খুব ইচ্ছে ছিলো লাগানোর। কিন্তু হয়ে ওঠে নি। এগুলো বোধহয় স্যার লাগিয়েছে তাই না? আর তো কেউ নেই আমার মায়ের কথা মনে রাখার মতোন। নিশ্চয়ই স্যারই লাগিয়েছেন।’

আড়ালের সদ্য ঘুম ভাঙা কৌতুহলী মুখমন্ডলে ভেসে ওঠা মায়া, বিশদভাবে এতোক্ষণ লক্ষ্য করছিলো শুদ্ধ। কিন্তু আড়ালের মুখে এমন কথা শুনে মেজাজ নামক ঘুড়ির সুতো যেন কাটা পড়লো তার। চেহারাতে বিক্ষোভ এর স্পষ্ট আভাস। তবে আড়ালের কথার কোন জবাব দিলো না শুদ্ধ। গাড়ি ঘুরিয়ে চললো বাড়ির উদ্দেশ্যে। গাড়িতে আর কথা হলো না কোনো।

শুদ্ধের এমন হটাৎ চেহারার পরিবর্তন দেখে আড়ালও আর কিছু বললো না। তবে শুদ্ধর চেহারার এমন আচমকা ভঙ্গি বৈচিত্র্যতা দেখে আড়াল খানিক ভয় পেলো। কাল রাত থেকে শুধু মনে হচ্ছে এই বুঝি গালে পড়লো এক চড়।

বাড়ির গেটে গাড়ি থামিয়ে আড়ালকে ভেতর যেতে বলে শুদ্ধ। বলে তার কোন কাজ আছে। কিছুক্ষণ পর চলে আসবে। আড়াল বিনা বাক্য ব্যায় করে গাড়ি থেকে নেমে ঢুকে যায় বাড়ির ভেতর। পিছনে আর ফিরে তাকায় না। পিছনে একবার ফিরে তাকালে হয়তো আবিষ্কার করতো অদেখা অজানা কিছু। যা রয়ে গেলো আড়ালে।

আড়াল ড্রয়িংরুম এ এসে দেখে রুম পুরো ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। কোন শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। ভাবে, বাড়ির বড়রা হয়তো রান্না ঘরে আছে। সেদিকে এগিয়ে গেলে দেখা যায় মামিরা একসাথে রান্নার কাজ করছে। ছোট মামি সবজি কাটছে, মেজো মামি মসলা ব্লেন্ড করছে, মেজো মামি মাছ ধুচ্ছে আর বড় মামি মানে মামনি রান্না করছে। দেখতে কি ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে সবাই মিলে একসাথে থাকতে কি সুখ কি প্রশান্তি তা এই বাড়ি না এলে কখনো অনুভব হতো না, আর না জানা হতো। সবাই যেনো সারাজীবন এইভাবেই থাকে।

আড়াল কে হটাৎ রান্নাঘরের দরজায় দাড়িয়ে থাকতে দেখেন শুদ্ধর মা। চুলোর আঁচ খানিক কমিয়ে দিয়ে আড়ালের কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেন,

‘কিরে মা, এতো গরমে রান্নাঘরের সামনে কি করছিস। রান্নার ঝাঁঝে টেকা যাচ্ছে না। তুই রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে বোস আমি লেবুর সরবত নিয়ে আসছি। তারপর গোসল করে নিবি, যা মা।

মামনির কথা শেষ না হতেই আরও তিন মামি একই কথা বলে ওঠলো। কি বলবো বুঝতে না পেরে শুধু মাথা নেড়ে সায় জানালাম। রুমে চলে আসলাম চেঞ্জ করতে। রুমে এসে দেখি বাচ্চাগুলো সব লাইন ধরে আমার বিছানায় বসে কিছু বলাবলি করছে। আর খালামনি বিছানায় কিছু জামা কাপড় নেড়েচেড়ে দেখছে। আমাকে দেখামাত্র টুবলু সবার আগে দৌড়ে এসে আমায় জাপটে ধরে। ওর দেখাদেখি বাকি তিনজনেও এসে আমায় চারপাশ থেকে জাপটে ধরে। আমি তাল না সামলাতে পেরে শক্ত করে দরজার হাতল ধরে ফেলি। হেসে দেই ওদের কান্ড দেখে। আমার হৃদয়ে প্রশান্তির ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যায় ওদের খুশি আর উল্লাস দেখে। এক রাতের ব্যাবধানে এরা কতটা আপন করে নিয়েছে আমায়। যেন আমি কত আগের চেনা ওদের।

আমাকে এভাবে ধরতে দেখে খালামনি ওদের চোখ পাকিয়ে বলে,

‘আরে আরে! ওকে তোরা চারজনে মিলে ওভাবে কেনো ধরছিস? এই গরমে ও বাইরে থেকে এসেছে। ওকে আগে ফ্রেশ হতে দে। তারপর চারজনে মিলে ভাগাভাগি করিস তোদের মিষ্টিপুকে।’

খালামনির কথায় সবাই গোমড়া মুখ করে আমায় ছেড়ে আবার আগের জায়গায় গিয়ে সারি সারি বসে পড়ে। আমি একটু হেসে এগিয়ে ওদের সামনে গিয়ে বলি, ‘তোমরা বসো আমি এক্ষুনি চেঞ্জ করে আসছি।’

খালামনি আমার হাতে এক সেট চুড়িদার ধরিয়ে দিয়ে বললো ওটা পড়ে আসতে। আমি কিছু বলতে চাইলে আমায় চুপচাপ ওয়াশরুম থেকে ওটা পড়ে আসতে বলে। সাথে আরও কিছু মার্জিত রুচিসম্মত ড্রেস দেখিয়ে বলে সব আমার জন্য। খালামনি বাকি ড্রেসগুলো গুছিয়ে আলমারিতে তুলে রাখে। আমি কোন কথা না বলে খালামনির কথামতো জামাটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে গেলে তখন আবার ছোট মামি আসে শরবত নিয়ে। শরবত পান করে ছুট লাগাই ওয়াশরুম এর দিকে। ভেতরে এসে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকি। হটাৎ করে সবার এতো মনোযোগ, ভালোবাসা, যত্ন নিতে কেমন যেন অস্বচ্ছন্দ বোধ হচ্ছে। এমন কেন হচ্ছে। আমার তো উচিত সবার সাথে মিশে সবাইকে ভালোবাসা। সবার যত্নের মুল্য দেওয়া। কিন্তু মামনি ছাড়া আর কারো সাথে কেনো জানি না স্বচ্ছন্দতা আসে না। নিজেকে বুঝ দিলাম, ‘সবার সাথে মিশতে হবে। সবাই যেমন আমাকে ভালোবাসে আমাকেও সবাইকে ভালোবাসতে হবে।’

দুপুরের খাবার শেষ করে রুমে বসে আছি। মনে চলছে একান্ত কিছু অভিপ্রায়।ভাবছি যতক্ষণ এবাড়ির কেউ না কেউ আমার সাথে থাকে, ততক্ষণ মন থেকে সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, আর ভয়ের সাথে যেনো সাময়িক বিচ্ছেদ ঘটে যায়। কুটুম্বিতা হয় প্রশান্তি আর সুখানুভূতির সাথে। নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছা হয় সবার ভালোবাসা নিয়ে। আবার যখন একা হয়ে যাই, তখন আবার স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে মিলিত হই হতাসা আর কষ্টের স্মৃতিগুলোর সাথে।

‘মা’ আমার একান্ত সুখের স্মৃতি হয়ে রয়ে গেলো গহীন অন্ত:করণে। শুধু কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ হয়ে রইলো মা। আর কখনো পাবো না মা’কে। কখনো না। আর বাবা! সে তো তার জন্য আক্রোশ আর এক বুক ঘৃণার হেতু ছাড়া কিছুই রাখেনি। এই লোকটার জন্য কোন একদিন মনে মনে কথার বহর সাজিয়ে রাখতাম। বিদেশ থেকে ফিরলে সব বলবো করে। কতশত আবদার গচ্ছিত রাখতাম বাবা নামক সুখ পায়রাকে বলবো করে। আজ আমার সমস্ত সুখের ইতি টেনেছে সেই বাবা নামক অমানুষটাই। তার শাস্তি নিজ হাতে দিতে না পারি। দেখতে তো পারি। উপরওয়ালার কাছে এটাই চাওয়া রইলো। ওই লোকটার শাস্তি যেন আমি নিজ চোখে দেখতে পারি। আর তার জন্য কোন মায়া যেন আমার মনে অবশিষ্ট না থাকে। থাকুক শুধু আক্রোশ আর ঘৃণা।

হটাৎ চোখে আলোর প্রখর দীপ্তি অনুভব হলো। যেন ভরদুপুরে আমায় রোদের নিচে কেউ ফেলে রেখে গেছে। অতিশয় বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে উঠে বসলাম। চোখ আমার এখনোও বন্ধ। তাকাতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু কে এমন ভরদুপুরে আমার চোখে রোদ ঢেলে দিলো তা তো দেখতেই হচ্ছে। চূড়ান্ত পরিশ্রমের পর চোখ খুলে তাকিয়ে কোন রোদের দেখা পেলাম না। ঘরে তো শুধু বাল্বের আলো শোভা পাচ্ছে। কিন্তু আমি ঘুমালাম কখন? আর বিছানায় কখন এলাম? আমি তো দুপুরের খাবারের পর জানালার পাশে দাড়িয়ে ছিলাম। অনেক কিছু ভাবছিলাম। বিছানা থেকে জানালার দুরত্ব কম করে হলেও সাত আট হাত হবে। এতটুকু এলাম কি করে! আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না। হ্যা একবার বসেছিলাম হয়তো দেয়াল ঘেঁষে। কিন্তু তারপর?

হটাৎ আমি আর আমার চিন্তা ভাবনার মাঝে তৃতীয় কারো উপস্থিতি পেলাম। দরজার কাছে সুইচবোর্ডের পাশে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে শুদ্ধ ভাইয়া। তাকে দেখে হুড়মুড়িয়ে ঠিকঠাক হয়ে বসি। নিজের দিকে পর্যোবেক্ষন করে দেখি গায়ে ওরনাটাও ঠিক মতো রাখা। যা কোনদিনই ঠিক থাকার কথা নয়। কোনোদিন থাকেও না।
আমাকে এমন অপ্রস্তুত হতে দেখে শুদ্ধ ভাইয়া হটাৎ বিদ্রুপ করে বলে ওঠে,

‘জায়গার জিনিস জায়গাতেই আছে। যার জিনিস সে ঠিক গুছিয়ে রেখেছে। এবার সময়ের কাজটা সময়ে করো। ওঠো। কটা বাজে খেয়াল আছে। উঠে অজু সেরে নামাজ পড়ো। ঘুমোলে হুস থাকে না। নিজেকে আবার পিঁপড়ের সাথে তুলনা করে। পিঁপড়ে দিনে কয় ঘন্টা ঘুমায় জানো? তা জানবে কি করে? গাধী একটা!’

কি বললো, কেনো বললো কিছুই বুঝলাম না। গাধী বলে মুখ লটকিয়ে চলে গেলো। ঘুম নিয়ে বোধহয় কিছু বললো। কেনো? হটাৎ দেয়াল ঘড়িতে চোখ গেলে লাফিয়ে ওঠে ওয়াশরুমে দৌড়ালাম। ইশ কত দেরি হয়ে গেছে। অজু করবো কখন?

#চলবে

#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১৫

কি বললো, কেনো বললো কিছুই বুঝলাম না। গাধী বলে মুখ লটকিয়ে চলে গেলো। ঘুম নিয়ে বোধহয় কিছু বললো। কেনো? হটাৎ দেয়াল ঘড়িতে চোখ গেলে লাফিয়ে ওঠে ওয়াশরুমে দৌড়ালাম। ইশ কত দেরি হয়ে গেছে। অজু করবো কখন?

নামাজ পড়ে উঠতে না উঠতেই বৃষ্টি আর সৃষ্টি এলো ডাকতে। ছাঁদে আড্ডা দেওয়ার সময় হয়েছে। দরকারি জিনিসপত্র সব উপরে নেওয়া হয়েছে। এখন সবাই গেলেই হয়। কথা শেষ করে দুজনে একটুও দাঁড়ায়নি। ছুট লাগিয়েছে রান্নাঘরের দিকে। এখনো তো জল নেওয়া বাকি।

মাথায় ওরনা দিয়ে একটা পিন আপ করে নিলাম। কাল ছাঁদে হাওয়ার বেশ তোরজোর লক্ষ্য করেছিলাম। বারবার মাথা থেকে ওরনা পড়ে যাচ্ছিলো। তাই আজ প্রস্তুতি নিয়েই রওনা হলাম ছাঁদে। ছাদে পৌছিয়ে মাদুর বিছিয়ে রাখা জায়গায় বসে পড়লাম। সবার উপস্থিতি বিদ্যমান। ছোটদের মধ্যে টুবলু, গুবলু, তিন্নি আর গুবলি আছে। আর আছে বৃষ্টি, সৃষ্টি, শান্ত ও ফুয়াদ। কেউই বাকি নেই। শুধু আমাকে তাড়া করা মানুষটা অনুপস্থিত। চারপাশে এখনো পুরোপুরি কৃষ্ণাভ হয় নি। আকাশের পশ্চিম বুকে তুলনারহিত সৌষ্ঠব এর বৈচিত্র্যতা চলছে। আঁধার হয়েও যেনো হয়নি। সমারোহ হচ্ছে রাঙা মেঘের প্রচ্ছদ। মনটা কি ফুরফুরে লাগছে।

সিঁড়ি ভেঙে দুমদাম আওয়াজ করে কেউ উঠে আসছে। এতো আওয়াজ করে আসার কোন মানে হয়। শুদ্ধ ভাইয়া তো এমন করে চলাফেরা করে না তাহলে কে? উপস্থিত হলো নতুন মুখ। ছাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁটুতে হাত রেখে হাঁপাচ্ছে। কি অদ্ভুত। মাত্র দুই তলা সিঁড়ি ভেঙে এমন চূর্ণন অবস্থা। যা আওয়াজ তুলে এলো, দৌড়ে এসেছে বোধহয়। পাশ থেকে সবাই হটাৎ রিয়াদ ভাইয়া বলে চিল্লিয়ে ওঠলো। ছোটরা সবাই দৌড়ে গিয়ে জাপ্টে ধরলো লোকটাকে। আমার মাথায় অন্য চিন্তা বাসা বাঁধলো। এই লোকটার নাম রিয়াদ। উনিই কি আজ হসপিটালে ভর্তি ছিলো? যাকে শুদ্ধ ভাইয়া দেখতে গিয়েছিলো। কিন্তু কাল এক্সিডেন্ট করে আজ এমন সুস্থ অবস্থায় সশরীরে কিভাবে আসতে পারে?

ছেলেটাকে সবার মধ্যে এনে বসিয়ে দিলো বাচ্চারা। সবার মধ্যেই অনেক কৌতুহল দেখা গেলো। একেকজনের একেক রকমের প্রশ্নপর্ব চলছে। ছেলেটি এখনো বেশ হাপাচ্ছে। তবে সবার এতো গা মাখামাখি প্রশ্নতে একটুও বিরক্ত হচ্ছে না। উল্টো যখন যে যা প্রশ্ন করছে তখন তার দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে প্রশ্নগুলো শুনে যাচ্ছে। হটাৎ চিৎকার দিয়ে সবাইকে চুপ করতে বলে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে নেয়। আর বলতে শুরু করে,

‘তোদের সবার প্রশ্নের এক এক করে উত্তর দিতে গেলে আমার জীবন যৌবন এর ডেট এক্সপায়ার হয়ে যাবে। আমি আমার মতো করে বলছি, তোরা শোন। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে আজ সকালে পৌঁছিয়েছি। জানিস তো, ফ্লাইটে এক ঘন্টা ও ঘুমোতে পারি না। তাই বাসায় গিয়েই একটা জম্পেশ ঘুম ডাউনলোড করে তাতে ইনস্টল হয়ে গেছি। ঘুমের ডেটা স্পিড এতো হাই লেভেলের ছিলো যে ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সকাল পেরিয়ে দুপুর আর দুপুর পেড়িয়ে বিকেল গড়িয়ে গেছে অথচ আমার ঘুমের ডেটা কানেকশন লস হয়নি। শেষমেশ কিছুক্ষণ আগে উঠে দেখি প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। এদিকে খিদের চোটে পেটের ভেতর ইঁদুরেরা সব ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাবি তাকে ছোঁ শুরু করেছে’। মনে হচ্ছে সামনে যা পড়ছে সব খেয়ে ফেলি। কোনমতে শার্ট প্যান্ট চেঞ্জ করে এবাড়ির দিকে রওনা হয়েছি পেট পুজো করতে। কপাল গুনে চৌরাস্তার মোরে আসতেই দেখা হলো সেই ডাইনিটার সাথে। টফিকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে। আর ওই টফি হারামজাদা আমায় দেখে এই দৌড় কি সেই দৌড়। যেনো ও একটা পুলিশ আর আমি হলাম চোর। এক দৌড়ে চৌরাস্তা থেকে বাসার ছাঁদে চলে এসেছি। আর একটু হলেই বার্গার মনে করে কামড় বসাতো আমার গায়ে। ওফ্ফ! খুব বাঁচা বেঁচেছি আজ।

রিয়াদ ভাইয়ার কথা শেষ হতেই সবাই হাসতে হাসতে কলা গাছের মতো ধপাস করে একে অপরের গায়ে পড়া শুরু করে। আমি নিজেও হা করে আছি ওনার কথা শুনে। সবার এতো হাসাহাসিতে ওনার যে কোন হেলদোল নেই তা ওনার নিতান্ত মনদ পূর্ণ চেহারায় স্পষ্ট। কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে সবাই তাকিয়ে দেখি শুদ্ধ ভাইয়া উপরে আসছে। ওই ছেলেটা শুদ্ধ ভাইয়াকে দেখে দৌড়ে গিয়ে জরিয়ে ধরে। এতক্ষণের এতো বিষন্নতা সবকিছু নিমিষেই হারিয়ে গেলো ছেলেটার মুখ থেকে। কিন্তু শুদ্ধ ভাইয়ার মুখটা হটাৎ চুপসে গেছে। উপরে উঠে আসার পর প্রথম তো এমন ছিলো না। স্বাভাবিক ছিলো। হটাৎ এমন পরিবর্তন এর কারন কি?

‘হেই ব্রো, কেমন লাগলো সারপ্রাইজ? বলেছিলাম একসপ্তাহ পর আসবো। এক সপ্তাহ আগেই আসবো ভাবিসনি তো? সবসময় তুই সবাইকে যখন তখন চমকে দিস। আজ কিন্তু আমি দিলাম। বাট প্রচুর খিদে পেয়েছে ইয়ার। চল তো নিচে। ওদের এসব মুড়ি আর চপ,বেগুনি খেলে আমার চলবে না। আমার তো চাই শাশুমাদের হাতের গরম ভাত আর মাছের ঝোল। সাথে এক পিস গন্ধরাজ লেবু। আহা! জীবনটা ধন্য হয়ে যাবে। চলতো যেতে যেতে আমার কষ্টের প্যারাগ্রাফ পড়ে শোনাচ্ছি তোকে।

ছেলেটা গুবলি কে বউ বলে ডেকে গালে একটা চুমু খেয়ে কোলে তুলে নিয়ে শুদ্ধ ভাইয়াকে নিচে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। উনি যেতে যেতে একবার ফিরে তাকালেন আমার দিকে। আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে দাড়িয়ে রইলাম। মনের প্রশ্নের ছাপ চেহারায় পড়তে দিলাম না। ওনারা চলে গেলে আমি সৃষ্টি কে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আচ্ছা এই ভাইয়া টা কে? কিছু মনে না করলে ওনার ব্যাপারে কি কিছু জানতে পারি?’

‘রিয়াদ ভাইয়া তো শুদ্ধ ভাইয়ার বন্ধু। ভাইয়ার বাবা-মা নেই। গতবছর মারা গেছেন। বাকি আত্মীয় সবাই আমেরিকাতে সেটেল্ড। ভাইয়াও সামনে বছর আমেরিকা চলে যাবে। এখানে ভাইয়ার আপন বলতে কেউ নেই। ভাইয়া আমাদের এখানেই প্রতিদিন খাওয়া দাওয়া করে। রাতে বাসায় চলে যায়। এখানে অবশ্য জেঠু থাকতে বলেছিলো যতদিন না আমেরিকা যাচ্ছে। বাড়ির সবাই-ই বলেছিলো। কিন্তু রিয়াদ ভাইয়া বলে, ‘বাবা-মায়ের স্মৃতির নীড় ছেড়ে তো চলেই যাবো। যতদিন আছি এই নীড়েই থাকবো।’ তাই কেউ আর বেশি জোরাজোরি করেনি। সারাদিন শুদ্ধ ভাইয়ার সাথেই থাকে। এখানেই খাওয়া দাওয়া করে। শুধু রাত হলে তার বাসায় চলে যায়। পনেরো দিন আগে আমেরিকা গিয়েছিলো তার চাচাকে দেখতে। হার্ট অ্যাটাক করেছিলো ভাইয়ার চাচা। এখন কিছুটা সুস্থ হয়েছে তাই হয়তো ব্যাক করেছে।’

‘আচ্ছা শুদ্ধ ভাইয়ার ক’জন ফ্রেন্ড? এই একজনই বুঝি?’

ভাইয়ার ফ্রেন্ড তো আরও তিনজন আছে। সাফিন ভাইয়া, রাহাত ভাইয়া আর সোহাগ ভাইয়া। তবে রিয়াদ ভাইয়ার মতো এতোটা ক্লোস নয়।’

‘তুমি সিওর ওনার আর কোন ফ্রেন্ড নেই?’

‘হ্যা আড়াল। থাকলে চিনবো না?’

আড়াল মনে মনে প্রাক্কলন করে কিছু পুরোনো ঘটনা। নতুন আরও অনেক প্রশ্ন যোগ হয়ে সন্দেহের দানা বাঁধে মনে।

সৃষ্টিদের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আড়াল নিচে নেমে নিজের ঘরে চলে যায়। কিছু হিসেব এর খাতা খুলতে হবে।

‘আরে বড় শাশুমা, আর পারছিনা গো খেতে। আর দিও না। আমি এখন উঠছি।’

হাত ধুয়ে উঠতে গিয়ে শুদ্ধের দিকে চোখ ফেরালে দেখতে পায় উল্টোদিকের চেয়ারে বসে শুদ্ধ এমন করে তার দিকে তাকিয়ে আছে যেনো চান্স পেলে এক্ষুনি গিলে খাবে। রিয়াদ একটু ভয়ে ভয়ে শুদ্ধকে জিজ্ঞেস করে,

‘ব্রো তুই কি বাই এনি চান্স আমার ওপর রেগে আছিস? আমি তো এলামই আজ। আসার পর তো তেমন কিছু করিনি, উল্টো ওই ডাইনির কুকুর টার দৌড়ানি খেয়ে এসেছি। তাহলে এমন আগুন চোখে কেনো তাকিয়ে আছিস?’

শুদ্ধর মা রান্নাঘরে যাওয়ার পর রুম ফাকা হলে রিয়াদ কে দাঁত কিরমিরিয়ে বলে,

‘রুমে আয়, তারপর তোর জামাই আদরের শেষ আপ্যায়ন টা আমি নিজ হাতে করছি।’

শুদ্ধ কথা শেষ করে নিজের রুমে চলে যায়। রিয়াদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় শুদ্ধর কথা শুনে। শুদ্ধের পিছু পিছু এগিয়ে যায় রুমে, বিষয়টা বুঝতে।

পাঁচ মিনিট পর,

‘ভাই সরি সরি! আর কখনো তোকে না জানিয়ে সারপ্রাইজ দেবো না। তুই ফোন করার আগে ফোন রিসিভ করবো। তাও ওই ডাইনি না না সরি ডায়না কে আমার গলায় ঝুলাস না। ও একটা আস্ত পিত্তরসের ডিব্বা। আমাকে হজম করে ছাড়বে। মানুষ মাছ খেলে তাও কাটা বেছে খায়, ওই ডাইনি আমার এক গাছ চুলও ছাড়বে না। ছেড়ে দে ভাই কেঁদে বাচি।’

শুদ্ধ কোন কথা না বলে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। তখন যদি ফোন রিসিভ করতো তাহলে বলে দিতো আড়ালের কথা। এখন আড়ালের সামনে পড়া মানে গুচ্ছ গুচ্ছ প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া। এই একটা নতুন তৈরি হওয়া প্রশ্ন থেকে যে আরও কত প্রশ্ন নিয়ে সামনে দাঁড়াবে মেয়েটা, কে জানে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here