আড়াল_কথা,২২,২৩

0
769

#আড়াল_কথা,২২,২৩
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২২

শুদ্ধ তার বাবা আর সোহাগকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে উকিল কাগজগুলো দেখে কি বলেছেন? আসিফ সাহেব এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,

‘এই কাগজগুলো আড়ালের জন্য মৃ’ত্যু ফাঁ’দ। এতে যে দলিলগুলো দেখছিস সেগুলো সব আড়ালের নামে। প্রায় দু কোটি টাকার সম্পত্তির মালিকানা আছে আড়ালের নামে। একটি পাঁচতলা বাড়ি আর হাইওয়ের ধারে দুটি জমির প্লট আড়ালের নামে করা হয়েছে। আর এসব কিন্তু বেশি আগে করা হয়নি। করা হয়েছে ছয়মাস আগে। এই সম্পত্তির জন্য এখন সাত্তার আড়ালের পিছনে পড়েছে। তবে একটা ব্যাপার বুঝলাম না। এতোদিন আড়ালকে কেনো বাঁচিয়ে রেখেছিলো? এতোদিন কেনো মারার চেষ্টা করেনি ওকে? সুযোগ তো কম ছিলো না।’

‘আড়াল এতোদিন সেইফ ছিলো ওর চাচারই কারনে বাবা। ওর চাচা মি’থ্যে ভালো মানুষের মু’খো’শ পড়ে থাকলেও আড়ালের প্রতি তার ভালোবাসা মি’থ্যে ছিলো না। আড়ালকে ছোটবেলা থেকে নিজের মেয়েদের থেকে কম ভালোবাসেন নি। তাই এতোদিন আড়ালের গায়ে কোন আঁ’চ লাগতে দেননি। তিনি ভেবেছিলেন আড়ালকে বিয়ে দিয়ে দিলে অন্তত এসব থেকে দুরে থাকবে আর সেইফ ও থাকবে। নিজের সংসার নিয়ে ব্যাস্ত হলে আর অন্য কোন কিছুতে মাথা ঘামাতে আসবে না। কিন্তু আড়ালের বিয়ে থেকে পালিয়ে যাওয়াতে তিনি আর কোন রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তাই শেষমেশ আড়ালকে মে’রে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আসলে ওনারা তো প্রফেশনাল কোন অ’প’রা’ধী বা স’ন্ত্রা’সী নয়। শুধু আড়ালের বাবার বে’আ’ইনি কার্যকলাপ সম্পর্কে জেনে যাবার পর তাকে ব্ল্যা’ক’মেইল করে নিজদের অভাব ঘুচানোর চেষ্টা করেছেন। তাই খু’ন করার পর মনে ভ’য় ঢুকে গেছিলো ধ’রা পড়ে যাওয়ার। আর ফুপির খু’নে’র সময় সাত্তার কিন্তু বাড়িতে ছিলো না। গেছিলো শহরে নিজের ব্যাবসার কাজে। আর আড়ালের চাচিও স্বীকার করেছে যে এসব এর মাষ্টার প্ল্যান ছিলো তার স্বামীর। আড়ালের বাবার ওপর প্রথম সন্দেহ করেছিলো সাত্তার নিজেই। সেই তার স্ত্রীকে সামনে রেখে পেছন থেকে গুটি সাজিয়ে গেছে। শুধু ফুপির খু’নে’র দিনই সত্তার ছিলো অনুপস্থিত।’

সোহাগ হটাৎ প্রশ্ন করে বসে,

‘আচ্ছা আংকেল আর আমি তো শুধু দলিল গুলো নিয়ে আমার চাচার কাছে গেছিলাম দলিল গুলো বুঝতে। কিন্তু আরও যে কাগজগুলো ছিলো সেগুলো থেকে জানতে পারলি কিছু? ওগুলো কিসের কাগজ? আমিতো ওগুলো এখনো দেখিইনি। ওতেও কি আড়ালের কোন সম্পৃ’ক্ততা আছে?’

শুদ্ধ কিছু কাগজপত্র সোহাগ এর হাতে দিয়ে বলে,

‘এগুলোতে আড়ালের নামে কিছু নেই। এতে শুধু আড়ালের বাবার কু’কী’র্তির হিসাব আছে কয়েকটা কাগজে। মানে তার পরবর্তী কিছু কাজের হিসাব আরকি। যার দায়িত্ব আড়ালের বাবাকে দেওয়া হয়েছিলো সে অসুস্থ হবার আগে। ওনার কাজ ছিলো লোক দিয়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নে’শা’দ্রব্য চো’রাই চালান করা। কোন একটা বড় সি’ন্ডি’কেট এর সাথে জড়িত ছিলো। কিভাবে, কার দ্বারা, কবে, কোথায়, কখন মা’ল সাপ্লাই দেওয়া হবে তা ছিলো আড়ালের বাবার দায়িত্বে। আগে একজন সাধারণ সাপ্লায়ার ছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে নিজের জায়গা শক্ত করেছেন মা’দক সি’ন্ডি’কেটের কার্যক্রমে। এই কাগজগুলো ঘেটে এই তথ্যগুলো স্পষ্ট। আর এই বাকি কাগজগুলো মধ্যে কিছু হলো সাপ্লায়ার দের বায়োডাটা আর কিছু হলো তাদের কাজের হিসাব।’

‘এখন তাহলে নেক্সট কি করতে চাস?

‘আড়ালের বাবা যে কোটি টাকার স’ম্প’ত্তি করে রেখেছে এবং আড়ালের নামে সম্পত্তির মালিকানা দিয়ে রেখেছে তা শুধু জানে আড়ালের চাচা। আর কেউ নয়। আর আড়ালের চাচা এখন আমাদের কাছে আছে তাই আড়ালের কোন ক্ষ’তি হওয়ার সম্ভাবনা আর এখন নেই। তাই আড়ালকে নিয়ে এখন আমি নিশ্চিন্ত। আর আড়ালের বাবা যে একজন মা’দ’ক ব্যবসায়ী ছিলেন তার প্রমাণ এই কাগজগুলো। তাই আড়ালের বাবার কেসটা আবার রিওপেন করতে আমাকে খুব বেশি ঝ’ড় পোহাতে হবে না। আড়ালের চাচি আর ওই লোকগুলো তো আগে থেকেই জে’লে রয়েছে। নতুন করে তাদের নিয়ে কোন ঝা’মেলা পোহাতে হবে না। আশা করছি এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি চাইছি এই সম্পত্তির কথা যেনো বাইরে না আসে। তাহলে আড়ালকেও হয়রানি করা হবে। তুই এখন ঘুমিয়ে পড়। সকালে অনেক কাজ আছে। বাকি কথা কাল হবে।’

শুদ্ধ তার বাবাকে নিয়ে গেস্ট রুম থেকে বেড়িয়ে এসে একসাথে ঘুমোতে যায় তার বাবার রুমে। বিছানায় এসে শুদ্ধ তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে,

‘আচ্ছা সন্ধ্যার পর উকিলের ওখান থেকে ফোন দিয়ে বললে আলম চাচাকে আনিয়ে তৎক্ষনাৎ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আড়ালকে বিয়ে করে নিতে। তখন কারণ জিজ্ঞেস করলে বললে সময় নেই পরে বলবে। বললে না তো আর।’

‘সাত্তার আজ বিকেলে হটাৎ কোথ থেকে ফিরে এসে ওবাড়ির আশেপাশের সবাইকে বলেছে তাকে নাকি তার বউ একয়দিন লোক দিয়ে আটকে রেখেছিলো। কোনমতে পালিয়ে বেঁ’চে ফিরে এসেছে। এসেই আড়ালের খোজ করছিলো। কা’ন্নাকা’টি করে সবাইকে বলছিলো সে নাকি সব হারিয়েছে এখন আড়ালকে আর হারাতে পারবে না। আড়ালকে নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিবেন। কারো কাছে নাকি শুনেছে আড়াল তার কলেজের কোনো স্যারের বাড়িতে আছে। তাই পাড়ার কিছু প্রতিবেশীদের নিয়ে রওনা হয়েছিলো আমার বাড়ির উদ্দেশ্যে। আড়ালকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সাত্তার একা আসলে যদি আড়ালকে না দিই সেই ভ’য়ে লোকজন নিয়ে রওনা হয়েছিলো। ওদের পাশের বাড়ির সাদ্দামকে তুই ওদিকের সব খবর দিতে বলে রেখেছিলি। ও তোকেই সবার আগে ফোন করেছিলো সব জানাতে। কিন্তু তুই কোন রাজকার্যে ব্যস্ত ছিলি তা সুধু তুই জানিস। তোকে ফোনে না পেয়ে পরে আমাকে ফোন করেছিলো। আমি ঘটনা শোনার পর খানিক চি’ন্তায় পড়ে গেছিলাম। কেননা সুবর্ণা যে আমার বোন আর আমরা যে আড়াল এর আপনজন তা মুখে মুখে ওদের বললে ওরা কিছুতেই বিশ্বাস করতো না। আর প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট সময় সুযোগ দুটোই তখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিলো। উল্টে ঝা’মেলা বেড়ে যেতো। হয়তো আড়ালের চরিত্র নিয়েও কথা উঠে যেতো। যেহেতু বাড়িতে তিন তিনটে ছেলে আছে। সবাই আমাদের বি’রু’দ্ধে গিয়ে যেভাবেই হোক আড়ালকে নিয়ে যেতো। আর আড়ালকেও আটকানো যেতো না। যেহেতু আড়ালের নজরে সাত্তার এর চরিত্র একেবারে সাফসুতরা ছিলো সেই সময়। তার ওপর আবার অপহরণ হবার কথা বলে আড়ালের সহানুভূতি কুড়িয়ে নিতো। তাই আড়াল ও তার চাচার সাথে যেতেই রাজি হতো। ও রাজি হলে কোনভাবেই ওকে আটকানো যেতো না। তাই তোকে ফোন দিয়ে তখন বিয়ে করার কথা বলেছি। যাতে বিয়ের সম্পর্ক দিয়ে তুই ওকে আটকাতে পারিস। বিয়ের কথা শুনলে অন্তত পাড়ার লোকেরা নিয়ে যাবার কথা বলবে না। বুঝলাম না সাত্তার শেষমেষ একা কি ভেবে এসেছিলো। আচ্ছা আড়ালকে কি বলে বিয়েতে রাজি করিয়েছিস তুই। ও তো এতো সহজে সব মেনে নেওয়ার মেয়ে নয়।’

শুদ্ধ খানিক থেমে বলে ওঠে,

‘এখন তুমি যদি তোমার ছেলে আর ছেলের বউ এর পার্সোনাল কথোপকথন শুনতে ইচ্ছুক হও তবে আমার কোন আপত্তি নেই তোমাকে শোনাতে।’

আসিফ সাহেব খানিক বিব্রত হলেও প্রকাশ করলেন না। দাবড়ে বলে ওঠেন,

‘আমি তোর বাবা হই বন্ধু নয়। ফাজলামো বাদ দিয়ে ঘুমো এখন।’

_____________

নভস্থলের বুকে অঁজিষ্ণুর আধিপত্য বিস্তার হচ্ছে ধীরে ধীরে। তেজের ছটা বেড়ে চলেছে বাতাসের গতিতে। আড়ালের সকালের শুরুটা হলো নিস্তব্ধতা দিয়ে। চোখ খুলে আশেপাশে কাউকেই চোখে পড়লো না। জানালার পর্দাটাও দেওয়া আছে। ঘরে খুব বেশি আলোও নেই। তবুও ঘুম ভেঙে গেলো। এতো রাতে ঘুমানোর পরেও সকাল সকাল ভুম ভেঙে গেলো। ঘুম থেকে উঠে টেবিলের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে সেই চিকন চুড়ি জোড়া। অল্প আলোতেও পাথরগুলো চকচক করছে। রাতে অস্বস্তি হচ্ছিল বলে হাত থেকে খুলে ঘুমিয়েছিলো। চুড়ি জোড়া চোখে পড়তেই মনে পড়লো কাল তার বিয়ে হয়েছে। সে এখন বিবাহিত। সে লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে সেজেছিলো। আর তারপর.. তারপর আর ভাবতে পারলো না। চোখের সামনে ভেসে ওঠলো শুধু র’ক্ত আর র’ক্ত। নিজেকে অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে না দিয়ে ওঠে পড়ে আড়াল। নিজেকে সামলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে ফ্রেশ হতে। এখন থেকে সামলে ওঠা শিখতে হবে।

ঘুমে বিভোর অবস্থায় ফোনের রিংটোন বেজে ওঠলে শুদ্ধ বিরক্ত হয়ে বালিশের কাছ থেকে ফোন হাতড়ে চোখ বুলিয়ে দেখে সাফিন ফোন করছে। রিসিভ করে কানে ধরতেই কর্নপাত হয় সাফিনের চিন্তিত কন্ঠ। শুদ্ধ এক লাফে উঠে বসে। ওপাশ থেকে সাফিন এর বলা কথা শুনে শুদ্ধ ‘আমি এখনি আসছি’ বলে ফোন কেটে দেয়। কোনমতে গায়ে টিশার্ট পড়ে দৌড়ে বের হয় হসপিটালের উদ্দেশ্যে। মনে মনে বলে, ‘আবারও র’ক্তা’র’ক্তি কান্ড হলো। সকালটাই শুরু হলো র’ক্ত দিয়ে। সামনে আরও কি কি হবে কে জানে!’

#চলবে

#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২৩

শুদ্ধ কোনমতে গায়ে টিশার্ট পড়ে দৌড়ে বের হয় হসপিটালের উদ্দেশ্যে। মনে মনে বলে, ‘আবারও র’ক্তা’র’ক্তি কান্ড হলো। সকালটাই শুরু হলো র’ক্ত দিয়ে। সামনে আরও কি কি হবে কে জানে!’ আসার সময় বাবাকে খুজে না পেয়ে সোহাগ কে নিয়ে রওনা করে হসপিটালের উদ্দেশ্যে। গাড়িতে বসে বাবাকে টেক্সট করে দেয় আড়ালের খেয়াল রাখতে বলে। ত্বরিত গতিতে গাড়ি চালিয়ে উপনীত হয় হসপিটালের দোরগোড়ায়। শুদ্ধকে একজন নার্স দেখতে পেয়ে নিজে থেকে এগিয়ে এসে বলে,

‘সৌভিক স্যার আপনাকে তার কেবিনে যেতে বলেছেন। তিনি সেখানেই আছেন।’

সোহাগ আর শুদ্ধ পা চালিয়ে সৌভিক এর কেবিনে আসে। ভেতরে ঢুকে দেখে সৌভিক রাহাত এর ট্রিটমেন্ট করছে। সাফিন বসা অবস্থায় থাকলেও রাহাত শুয়ে আছে চোখটাও বন্ধ। শুদ্ধ সৌভিক এর সামনে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করে,

‘ওর সিরিয়াস কিছু হয়েছে? ও শুয়ে কেনো? ও কি জ্ঞান হারিয়েছে? কিভাবে কি হলো?’

‘তুই শান্ত হ ওর তেমন কিছুই হয়নি। তোর চাচা শ্বশুর বেশ যত্ন করেই দু’ঘা লাগিয়েছে ওকে। মাথায় মে’রে’ছে এমন ভাবে যেনো কানেও টের না পায়। সাথে হাতে খানিক কে’টে’ছে ওই। সামান্য কা’টা দাগ মাত্র। কা’টা বাদ দিয়ে শুধু দাগ ও বলতে পারিস। এক পাশে কপাল একটু ফুলেছে দেয়ালের ছোবল খেয়ে। সেখানেই বরফ লাগাচ্ছিলাম এতোখন। শুয়ে শুয়ে বরফের ঠান্ডা স্পর্শে ঘুমিয়ে পড়েছে বেচারা। একে তো গরমের দিন তারসাথে আবার তুলতুলে গদির ওপর শুয়ে শুয়ে বরফ সেবা নিচ্ছে। ঘুম না এসে যাবে কোথায় বল?’

‘আড়ালের চাচা কোথায়? কি হয়েছিলো সকালে তা কি খুলে বলবি সাফিন? নাকি চুপচাপ বসে কথা গিলবি?’

সাফিন কিছু বলতে নিবে এরই মধ্যে শুদ্ধের উচ্চবাচ্যতে রাহাত এর ঘুম ভেঙে যায়। হুড়োমুড় করে উঠে বসে। সামনে শুদ্ধকে দেখতে পেয়ে একনাগাড়ে বলতে শুরু করে,

‘আমার কোন দো’ষ নেই ইয়ার। আমি ওনার কেবিনের বাইরেই ছিলাম। অপারেশন শেষে সাফিন আর আমি মিলে একসাথেই রাতে পাহাড়া দিয়েছি। সকাল বেলায় সাফিন নিচে গিয়েছিলো চা খেতে। কথা ছিলো ও চলে এলে আবার আমি যাবো। আমি কেবিনের বাইরের চেয়ারটাতে বসে থাকতে থাকতে একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলাম। হটাৎ কারো পায়ের দুমদাম শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি বেটা পালাচ্ছে। চিন্তা করা যায়! যার কিনা কাল রাতে অপারেশন হলো সে আজ সকালে পায়ে হেটে স্বাভাবিক ভাবে চোর ছেঁচড় এর মতো দৌড়ে পালাচ্ছে। আমি দৌড়ে গিয়ে ধরতে গেলে আমায় দেয়ালের গায়ে ধাক্কা মেরে দৌড় দেয় হসপিটাল গেট এর দিকে। মাথায় ধাক্কা লাগার কারণে সাথে সাথে উঠে দৌড়াতে পারি নি আমি। চোখে অন্ধকার দিচ্ছিলো। আমি দৌড়ে গেট পর্যন্ত যেতে যেতে উনাকে আর কোথাও দেখলাম না। সাফিন এলে দুজনে মিলে চারদিকে খুজেছি কিন্তু কোথাও পাইনি। তারপরেই তোকে ফোন করেছিলো সাফিন। উনি এভাবে এমন অবস্থায় পালাবে জানলে আমি একটুও অসাবধান হতাম না। আই এম সরি শুদ্ধ।’

রাহাত কথা শেষ করে মাথা নিচু করে বসে রইলো। সৌভিক রাহাত এর কথার প্রেক্ষিতে জবাব দেয়,

‘রাহাত ওনার তো মেজর কোন অপারেশন হয়নি। যে উনি নরাচরা করতে পারবেন না। অপারেশন তো আর পায়ে হয় নি হয়েছে কানে। ওনার শরীরে ইনজেকশনের ইফেক্ট শেষ হয়ে জ্ঞান ফিরেছিলো তাই চলাচল করতে সক্ষম হয়েছে। ওনার শরীর এখন খানিক দুর্বল থাকবে। তবে কানের জায়গাতে পা’শ’বিক য’ন্ত্র’ণার অব’সাদে অবশ্যই কা’ত’রাবে। অস’হ’নীয় ব্যাথায় জ্ঞান ও হারাতে পারে যদি পেইন কিলার না নেয়। আর বেশি ছোটাছুটি করলে শেলাই ছুটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’

শুদ্ধ চিন্তায় পড়ে যায় সাত্তারকে নিয়ে। এখান থেকে কোথায় যেতে পারে? আড়ালের কাছে তো পৌছাতে পারবে না। বাড়িভর্তি মানুষ। তাদের চোখ এড়িয়ে আড়ালের কাছে যাবার দুঃ’সা’হস করবে না। শুদ্ধ সাফিন আর সোহাগ কে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে সম্ভাবনাময় জায়গাগুলো অনুসন্ধান করতে। রাহাতকে সৌভিক এর দায়িত্বে রেখে যায় হসপিটালে। তিনজন তিনদিকে বেড়িয়ে যায় সাত্তার এর খোঁজে। যেতে যেতে বাবাকে কল করে শুদ্ধ। কিন্তু ওপাশ থেকে কোন রেসপন্স পায় না।

আড়াল ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতে না আসতেই দেখে বিছানা ভর্তি হয়ে সবাই বেশ গোল হয়ে বসে আছে। বৃষ্টি, সৃষ্টি, তিন্নি, গুবলু, গুবলি, শান্ত, ফুয়াদ আর তার মামনি। আড়াল প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি ফেলে এগিয়ে এলে আলো বেগম স্নেহময় কন্ঠে বলেন,

‘চটপট খাওয়া দাওয়া করে ঝটপট রেডি হয়ে নে তো মা। সবাই মিলে আমরা শপিংয়ে যাবো। তোর মামিরা আর রিয়াদও যাবে। বৃষ্টি, সৃষ্টি বিছানা থেকে উঠে এসে দুজনে দুদিক থেকে আড়ালের হাত ধরে উত্তেজনা নিয়ে বলে,

‘আমরা কিন্তু আজ থেকে তোমাকে মিষ্টিভাবি বলে ডাকবো সবাই। ঠিক আছে? কাল তো হুড়মুড় করে তোমাদের বিয়েটা হলো। না কোন সাজগোছ না ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া। আর শপিং তো দুরে থাক। তাই আজ আমরা তোমার জন্য অনেক অনেক শপিং করবো আর সবাই মিলে একসঙ্গে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করবো। এখন চলো একসাথে ব্রেকফাস্ট করে নেই, তারপর রেডি হয়ে বের হবো শপিংয়ে।’

বাচ্চাদের নিয়ে বৃষ্টি আর সৃষ্টি ডাইনিং রুমের দিকে চলে যায়। আলো বেগম যান না। আড়ালকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে তিনিও বসে যান। আড়ালের হাত ধরে স্নেহপাণি হয়ে বলেন,

‘তোর মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি রে মা। এতোদিন ধরে নিজের আপনজন বলে চেনা মুখগুলোর থেকে পাওয়া প্রতারণায় তুই জর্জরিত হয়ে আছিস। তারওপর কাল বিয়েটাও তোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তোর পক্ষে বিয়েটা এমন হুট করে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তবে চেষ্টা তো করাই যায় বল। তুই সবসময় এবাড়ির মেয়ে হয়েই থাকবি। কখনোই তোর ওপর বাড়ির বউ এর দায়িত্ব চাপানো হবে না। শুধু ধীরে ধীরে এই বিয়েটাকে নিজের মন থেকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা কর। বিয়েটাকে মনের কোঠায় স্বীকৃতি দে। তুই যেদিন চাইবি সেদিনই এই সংসারের বউ হয়ে আমার ছেলের দায়িত্ব নিস। এতে সম্পুর্ন তোর সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে। আর কারও নয়। এখন খেয়ে নিয়ে রেডি হয়ে চল আমাদের সাথে। সবার সাথে বাইরে বেরুলে মনটা একটু ভালো হবে। মাথা থেকে সব দুশ্চিন্তাও বের হবে।’

আলো বেগমের সাথে আড়াল ডাইনিং রুমে চলে যায় খাবার খেতে। মনে চলছে তার ঝ’ড়। বিয়ে নামক শব্দটার গভীরতা গতকাল এতো ভেবে দেখা হয়নি তার। ভাবা হয়নি সে কারো জীবনের অংশীদার হতে চলেছে। নিজের জীবনের সুখ দুঃখ হাসি কান্না সবকিছুরই ভাগাভাগি করার নতুন মানুষ হতে চলেছে কেউ। নিজের জীবনের একান্ত ব্যার্থতা, প্রতারণা আর না পাওয়ার হিসেব নিকেশের খাতাটা এবার বন্ধ করতে হবে। কিছু না হয় একান্তই থাক। দেখা যাক জীবনের মোড় ঘুরে কোথায় গিয়ে দাড়ায়।

বাড়ির সবাই মিলে দশটা নাগাদ একসাথে দুটো গাড়ি করে বেড়িয়ে পড়ে শপিংমলের উদ্দেশ্যে। আসিফ সাহেবের কলেজ থেকে জরুরি কল আসায় ছুটি নেওয়া সত্বেও যেতে হয় কলেজে। কলেজে আধ ঘন্টার কাজ আছে। কাজ শেষে সরাসরি শপিংমলে যোগ দিবেন সবার সাথে। শপিং শেষে একটু ঘোরাঘুরি করে সবাই মিলে লাঞ্চ করা হবে তারপর ফিরবে বাড়ি। আড়াল নিজেকে হাসিখুশিভাবে সবার সামনে প্রদর্শন না করতে পারলেও স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাড়ি থেকে বেরুনোর সময় আড়ালের মনে হচ্ছিলো কেউ তাকে গভীর ভাবে দেখে যাচ্ছে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে গাড়িতে উঠে গেছে বেশি না ভেবে। মনে করেছে হয়তো মনের ভুল। আধ ঘন্টা পর বড় একটা শপিংমলের সামনে এসে গাড়ী থামলে সবাই মিলে নেমে পড়ে দলবেঁধে ঢুকে যায় শপিংমলের ভেতরে।

সবাই শপিংমলের ভেতরে চলে গেলে আড়ালদের গাড়ি থেকে খানিক পিছনে দাড়ানো একটি সিএনজি থেকে নেমে আসে সাত্তার। চোখ মুখের অবস্থা বি’ধ্ব’স্ত। ব্যাথায় চোখ মেলে ঠিকমতো চাইতে পারছে না। কানের পাশ দিয়ে বেয়ে নামছে ঘন লহুর ধারা। তবুও এলোমেলো পায়ে এক পা দু’পা করে এগোয় আড়ালের পিছু পিছু।

শুদ্ধ লাগাতার কল করতে করতে এক সময় আসিফ সাহেব ফোন রিসিভ করেন। কলেজের কাজ তার শেষ হয়েছে। এখন রওনা করবেন শপিংমলের উদ্দেশ্যে। রাস্তায় এসে দাড়িয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখেন ফোন সাইলেন্ট করা। শুদ্ধের নম্বর থেকে মিসড করল রয়েছে ছয়টি। এর মধ্যেই আবারও শুদ্ধের নম্বর থেকে কল এলে ঝটপট রিসিভ করেন আসিফ সাহেব। ওপাশ থেকে শুদ্ধ সাত্তার এর পালিয়ে যাওয়ার কথা সম্পুর্ণ খুলে বলে তার বাবাকে। আড়ালকে চোখে চোখে রাখতে বলে ফোন কাটতে গেলে আসিফ সাহেব জানান তিনি বাড়িতে নেই কলেজে এসেছে। আড়ালও বাড়িতে নেই সবার সাথে শপিংয়ে গেছে। আড়ালের বাইরে যাওয়ার কথা শুনে শুদ্ধের পিলে চ’ম’কে ওঠে। তবে কি শেষ রক্ষা হবে না। আসিফ সাহেব বলেন,

‘তুই রিয়াদ কে ফোন দিয়ে বল আড়ালকে এক মুহুর্তের জন্যও যেনো দৃষ্টির বাইরে না ছাড়ে। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি শপিংমলে।’

শুদ্ধ ফোন কেটে দিয়ে রিয়াদ কে ফোন দিলে রিয়াদ ফোন রিসিভ করে উদ্রি্ত কন্ঠে ঘন ঘন শ্বাস টেনে বলে আড়ালকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here