আয়নামতী #পর্ব_১

0
2121

#আয়নামতী
#পর্ব_১
#পুষ্পিতা_প্রিমা

সময়টা ২০০০ সালের দিকে।

বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে বেশ কিছুদিন হলো ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছে অনুরাগ । মা বাবার বাধ্য সন্তান৷ ইদানীং তার মা জননী তার বিয়ে নিয়ে একপ্রকার হুলস্থুল ফেলে দিয়েছেন।
তবে সে একবার ও মেয়ে দেখার ইচ্ছে পোষণ করেনি। মায়ের পছন্দ তার পছন্দ। গ্রামের বনেদী পরিবারের সন্তান সে। এক বোন আর এক ভাই । বড় বোনের বিয়ে হয়েছে কয়েক বছর হলো। বর্তমানে এক সন্তানের জননী, এখন আবার সন্তান সম্ভাবা। অনেক গুলো বছর পর আবার মা হতে যাচ্ছে সে।
নাম তার অনিমা । ব্যবসার কাজে এদেশ সেদেশ তার স্বামীকে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় বলে সে বাপের বাড়িতেই থাকে৷ তার ফারফরমাশ কাটার জন্য বুয়াকে সারাক্ষণ তার পিছু পিছু থাকতে হয়। ছোট ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে তার ও মাথাব্যাথা৷ কোথাও যোগ্য মেয়ের দেখা মিলছেনা।
তার মা আনহিতা বেগমের মতে যতগুলো মেয়ে দেখলো তাদের মধ্যে কেউ সুন্দর দেখতে হলে আবার খাটো,লম্বা হলে দেখতে ভালো না। কেউ কেউ আবার শর্ট শর্ট ড্রেস পড়ে। সভ্য নয়। কেউ কেউ একদম গাইয়্যা ভূত। ঘোমটা টেনে রাখে মুখ অব্ধি, নাকে নোলক পড়া।
তার ছেলের বউ হতে হবে সুন্দর, লম্বা,ফর্সা,শিক্ষিত কিন্তু বোকাসোকা ও হবে। যাতে তার কথায় উঠে আর তার কথায় বসে। তার উপর কথা বলবে অত শিক্ষিত মেয়ের দরকার নেই।
এমন মেয়ে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়লো পুরো গ্রামে। কোথাও এমন মেয়ে নেই। শায়খ চৌধুরী ছেলের জন্য যোগ্য পাত্রীর খোঁজে পাঁচ ছয়টা উকিল নিয়োগ করলো। যে করেই হোক তার মনের মত মেয়ে যোগাড় করে দেওয়া চায় চায়। কালো হবেনা, খাটো হবে না, চেহারায় শ্রী থাকতে হবে। লম্বা হতে হবে। ফর্সা হতে হবে। মোটামুটি শিক্ষিত হতে হবে। ঘরের সমস্ত কাজকর্ম জানা থাকা লাগবে। তার ছেলের পাশে দাঁড়ালে যাতে প্রফেসরের বউ বউ দেখতে লাগে।
মাস কয়েকটা পার হলো। ততদিনের বিয়ের কথা একটু চাপা পড়লো। স্বস্তি পেল অনুরাগ। কিন্তু তাকে অশান্তিতে ফেলার জন্য ঘোর বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে উকিল সাহেব তাদের বাড়ি এলেন। ভেজা ভেজা আধছেঁড়া একটা ছবি আনহিতা চৌধুরীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন
‘ এই একটা মেয়ের খোঁজ পাওয়া গেছে ম্যাডাম। মেয়ে দশম শ্রেণীতে পড়ছে, লম্বা আছে,চেহারায় শ্রী ও আছে।
খুশি হলেন আনহিতা। ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন
‘ বাহ।
কিন্তু পরক্ষণেই উকিল সাহেব বললেন
‘ মেয়ের গায়ের রঙ একটু চাপা ম্যাডাম। বনেদী পরিবার নাহ। মেয়ের বাবার কিন্তু যথেষ্ট টাকাপয়সা আছে।
আনহিতার মেজাজ খারাপ হলো।
‘ ফর্সা নয়?
উকিল মাথা নাড়লেন।
‘ নাহ ।
আনহিতা বললেন
‘ আর ও মেয়ে দেখুন।
উকিল সেদিন চলে গেল।
তারপরে অনেক মেয়ের খোঁজ চললো। আরেকটা মেয়ে পেল সুন্দর আছে কিন্তু লেখাপড়া নেই। মেট্রিক পাস করে আর পড়েনি। আনহিতা বারণ করে দিলেন। হবে না এই মেয়ে। আর ও একটা মেয়ের খোঁজ পাওয়া গেল বাবার টাকাপয়সা আছে কিন্তু মেয়ে খুব বেশি স্মার্ট। শোনা যাচ্ছে কিছুদিনের মধ্যে সিনেমায় ও নাকি যোগ দেবে। আনহিতা মানা করে দিলেন। দরকার নেই অমন মেয়ের। ওই মেয়ে তাকে গলায় ধরি দিয়ে বেঁধে ঘুরাবে।
মাস দুয়েক গেল এভাবে। উকিলরা ও একপ্রকার বিরক্ত হয়ে পড়লো। অনুরাগ মা বাবার এসব কার্যকলাপে নাক গলায় না। কিন্তু সে ও শেষমেশ বিরক্ত হয়ে বলল
‘ আমি বিয়ে করব না মা । তোমরা আর পাত্রী দেখবে না।
আনহিতা চোখ বড় বড় করে বললেন
‘ এ কেমন কথা সোহাগ? চিন্তা করো না, তোমার বিয়ে অতিনিকটে। তুমি এসব নিয়ে ভেবোনা। পাত্রী যোগাড় হয়ে গেছে।
অনুরাগ আর কথা বাড়ালো না।

আনহিতা এবার মহাজ্বালায় পড়ে গেল। কি হবে এখন?

কয়েকটা মাস পরে শায়খ চৌধুরীর কাছে এক পাত্রীর খোঁজ নিয়ে এলেন তারই এক পরিচিত বন্ধু। মেয়েটার ছবি দেখায় আনহিতা খুশি হয়ে গেল। এই মেয়ে তো পুরো তার মতো। ডাগর ডাগর চোখ আছে। কিন্তু ছবিতে তো সুন্দর দেখাচ্ছে। শ্রী ও আছে। বাস্তবে কালো নাকি? লেখাপড়া আছে?
শায়খ চৌধুরীর বন্ধু আশরাফ আলী বললেন
‘ কালো নাহ। তেমন ফর্সা ও না। লেখাপড়া এখনো করছে। একাদশ শ্রেণীতে উঠেছে মাত্রই।
আনহিতা মত দিল। উজ্জ্বল বর্ণের হলে হয়ছে।
মেয়েটাকে দেখতে বলল। মেয়েটার পরিবার সামান্য অবাক হলো বনেদী পরিবার থেকে তাদের মেয়ের জন্য সম্বন্ধ যাওয়ায়। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল মেয়ের বাবা ছোটখাটো পেঁয়াজ ব্যবসায়ী। বড়ভাই বেকার। আবার বউ ও আছে নাকি। আনহিতা ক্ষুব্ধ হলেন তেমন টাকাপয়সা নেই বলায়।
তার ছেলেকে ওরা কিছুই দেবেনা? ওরকম ঘরের মেয়ে তার ছেলের বউ হবে? লোভী হবে না তো?
বিয়ের কথাবার্তা এগোতেই বরপক্ষের দাবি জানা গেল দুই লাখ টাকা। বনেদি ঘরে মেয়ে বিয়ে দিচ্ছে এমনি এমনি তো নিয়ে যাওয়া যাবে না।
কন্যার বাবা রাজী হলেন। তবে সময় চেয়ে নিলেন। টাকা যোগাড় করা মাত্রই তিনি বিয়ের আয়োজন করবেন৷
আনহিতা খুশি হলেন। মনের মত ছেলের বউ এবার পেয়েছেন তিনি। অনুরাগকে কয়েকটা ছবি দিলেন তিনি। কিন্তু পুত্র সেদিকে চোখ ও দিল না। পকেটে ছবিগুলো গুঁজে রাখতে রাখতে মাকে বলে দিল
‘ সময় হলে দেখে নেব। তাছাড়া তোমার পছন্দ নিশ্চয়ই আমার অপছন্দ হবে না মা।
কিন্তু সে মাকে স্পষ্ট জানিয়ে ও দিল বিয়ে করা ছাড়া অন্য কোনো কিছুতে সে নেই। সে শুধু বিয়েটা করতে যাবে অন্যকিছুতে যাতে তাকে না জড়ানো হয়। আনহিতাও ছেলেকে আশ্বস্ত করলো। বোন অনিমা ও খুশি ছোট ভাইয়ের বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে বলে।

মাস একটা যেতে না যেতেই কনের পিতা জানালো তাদের প্রস্তুুতি নেওয়া শেষ। এবার বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হলো। অনুরাগ হঠাৎ করে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল৷ সে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, বন্ধুবান্ধব, কলিগদের না জানালে ব্যাপারটা কেমন দেখায়? বন্ধুবান্ধবদের বলতে গিয়ে লজ্জায় পড়ে গেল অনুরাগ। সে নিজের হবু স্ত্রীর নামটা ও জানেনা। কি লজ্জার কথা। বন্ধুদের সামনে মাথা কাটা গেল তার৷ প্যান্টের পকেটে থাকা ছবিগুলো মুড়িয়ে গেছে। ওগুলো ধোয়া হয়েছে, তারমানে ছবিগুলো নষ্ট। কিন্তু তারপরও অনুরাগ মেলে দেখার চেষ্টা করলো। ঝাপসা ঝাপসা ছবিটা। অনুরাগ মায়ের কাছে গিয়ে বলল
‘ মা আর ছবি আছে?
আনহিতা বললেন
‘ আর নেই সোহাগ। যেগুলো দিয়েছি ওগুলো দেখো।
‘ ওগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছে মা, আমি দেখার আগে। আর মেয়েটার নাম বলো।
আনহিতা ছেলের কথায় অবাক। ভীষণ বিস্ময় নিয়ে বললেন
‘ এটা কেমন কথা সোহাগ? তুমি তোমার হবু বউয়ের ছবি দেখোনি? নাম জানো না?
অনুরাগ স্বাভাবিক গলায় বললেন
‘ জানিনা মা। কেউ তো বলেনি। কাল রাশেদ ভাই ও ফোনে জিজ্ঞেস করছিল আমি বলতে পারিনি। জেনে নেওয়া উচিত ছিল।
আনহিতা বললেন
‘ আফসানা আহমেদ আয়না।
অনুরাগ চোখ তুলে তাকালো মায়ের দিকে। তারপর যেতে যেতে বলল
‘ ঠিক আছে মা। পারলে একটা ছবি এনে দিও।
আনহিতা বললেন
‘ আর তো নেই আব্বাজান।

গায়ে হলুদের সন্ধ্যা। বাড়িতে নিচে মেহমানের কলরব। অনুরাগ নিজের ঘরে বসা ছিল। হঠাৎ দরজায় ঠনক নেড়ে উঠতেই অনুরাগ বলল
‘ কে?
ঘরে ঢুকে এল তার খালাম্মার ছেলে ।অনুরাগের প্রিয় রাশেদ ভাই। যার কাছেই অনুরাগের যতসব ছেলেমানুষী। রাশেদকে দেখে একপ্রকার লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামলো অনুরাগ। দৌড়ে গিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ কখন এলে? আর ও তাড়াতাড়ি আসবে ভেবেছি।
রাশেদ ভাইয়ের পিঠ চাপড়ে বলল
‘ আপনার মতো কি অত ইজি আছি ইয়াং ম্যান? বউ বাচ্চা হোক তারপর বুঝবি।
রাশেদকে ছেড়ে হাসলো অনুরাগ। হেঁটে হেঁটে আয়নার সামনে গিয়ে মাথার চুল ব্রাশ করতে করতে বলল
‘ বসো। সবাই এসছে?
রাশেদ বিছানায় বসে বলল
‘ হ্যা। রাখি খুঁজছে অনুকে।
অনুরাগ হাসলো। রাশেদের পাশে বসে বলল
‘ রাখি এসেছে তারমানে আবার আমার ড্রেস নষ্ট করবে।
রাশেদ বলল
‘ সে এখন কি আর ছোট আছে?
অনুরাগ বলল
‘ বিশ্বাস নেই বাচ্চাদের।
রাশেদ কথার ফাঁকে বলল
‘ বন্ধুদের বলিসনি?
অনুরাগ বলল
‘ বলেছিলাম কাল।
‘ কাল কেন? অনুরাগ বিছানায় শুইয়ে বলল
‘ ভাবিইনি বিয়েটা এভাবে ঠিক হয়ে যাবে। ভেবেছিলাম প্রতিবারের মতো কোনো না কোনো কারণে আটকে যাবে। নাহ, এখন দেখছি করতেই হচ্ছে তাই।
রাশেদ মিঠে হাসলো। বলল
‘ বিয়ে করছিস ভালো কথা। মনে ধরেছে?
থতমত খেল অনুরাগ।
‘ মানে?
রাশেদ বলল
‘ মানে আয়না ম্যাডামকে মনে ধরেছে?
অনুরাগ মাথা নাড়ালো এলোমেলো ভাবে। যার অর্থ হ্যা ও না। না ও না। রাশেদ কিছু না বুঝে বলল
‘ কি বলছিস?মুখে বল।
অনুরাগ বলল
‘ মনে ধরবে কেমনে? দেখিইনি এখনো।
রাশেদের কপালে ভাঁজ পড়লো। বলল
‘ দেখিসনি মানে? না দেখে বিয়ে কিভাবে? কি বলছিস ভাই আমার?
অনুরাগ শোয়া থেকে উঠে বসলো। বলল
‘ ছবি দিয়েছিল মা। দেখা হয়ে উঠেনি। যা ও পরে দেখতে চেয়েছি, দেখলাম সেগুলো ভিজে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কাগজের ছবি।

রাশেদ হতাশ হলো ভীষণ। অনুরাগ তার সামনাসামনি বসে বলল
‘ কি হয়েছে? রেগে আছ মনে হচ্ছে?
রাশেদ বলল
‘ এটা কোনো কাজের কথা অনুরাগ? বিয়ে করছিস তুই? বিয়ে মানে বুঝিস? বিয়ে মানেই বন্ধন। এক দিনের জন্য না, দুই দিনের জন্য ও না। জনম জনমের বন্ধন। বিয়ে মানেই শুধু একটা চুক্তি কিংবা ফর্মালিটি নয়। তোর কথা না হয় বাদ দিলাম। মেয়েটার তোকে জানা বুঝার দরকার ছিল।
অনুরাগ অনুতাপসূচক শব্দ করলো। বলল
‘ থাক।
রাশেদ বলল
‘ কি থাক? দেখে যদি মনে হয় মেয়েটা তোর জন্য ভালো হবে না। কিংবা তোর ভালো না লাগে?
অনুরাগ বলল
‘ বাদ দাও। মা অনেকগুলো মেয়ে দেখার পর এই মেয়েকে পছন্দ করেছে। নিশ্চয়ই ভালো কিছু দেখেছে। মায়ের পছন্দের উপর আমার ভরসা আছে। তাছাড়া আমার কাছে বাহ্যিক সুন্দরটা ফার্স্ট প্রায়োরিটি না। আমার মতে সেই সুন্দর যার সুন্দর একটা মন আছে। যদি ও আজকাল সুন্দর মনের মানুষ খুব দুর্লভ।
রাশেদ ধমকালো। চুপ কর৷ দাঁড়া আমি ছবি আনছি।
অনুরাগ বলল
‘ তোমার কাছে ছবি?
রাশেদ বলল
‘ আমার কাছে না। তোর ভাবির কাছে। দাঁড়া।
অনুরাগ পায়চারী করলো ঘরময়। তার অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো যেন। রাশেদ গেল আর এল । অনুরাগ দাঁড়িয়ে পড়লো। রাশেদ তার সামনে এসে হাসলো। ছবির উল্টোপাশ দেখিয়ে বলল
‘ নে। উল্টিয়ে দেখ তোর বউকে।
অনুরাগের হাসফাঁস লাগলো। লজ্জা লাগলো ভাইয়ের সামনে। ফলসরূপ সে হেসে দিল। বলল
‘ রাখো। পরে দেখব।
ধমকালো রাশেদ।
‘ একদম চুপ। আমার সামনে দেখ। আর বল কেমন? ভাইয়ের বউ হিসেবে আমার পার্ফেক্ট লেগেছে।
অনুরাগ বলল
‘ তোমাদের সবার ভালো লেগেছে এই হয়েছে। আমি পরে দেখব।
রাশেদ ছবিটা ধরিয়ে দিল। বলল
‘ এবার চোখ নিচে নামা। এবং দেখ।
অনুরাগ অসহায় চোখে তাকালো। রাশেদ বলল
‘ আমার দিকে নয় গাদা ছবির মানুষটার দিকে তাকা।
অনুরাগ কান ধরে চুলকাতে চুলকাতে চোখ নিচে নামালো। দেখামাত্রই রাশেদের হাতে ছবিটা দিয়ে ফেলল। রাশেদ ভুরু উঁচিয়ে বলল
‘ কেমন?
অনুরাগ হাসলো। রাশেদের দুষ্টুমি বুঝতে পেরে হেসে বলল
‘ সুন্দর।
রাশেদ বলল
‘ কেমন সুন্দর?
অনুরাগ হেসে ফেলে বলল,
‘ভারী সুন্দর।
বলতে না বলতেই দুজন ফেটে পড়লো অট্টহাসিতে।

_______________

জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকে পড়ছে আয়নার ঘরের ভেতর। সে দাঁড়িয়েছে জানালার পাশে। সুন্দর করে বেঁধে দেওয়া খোঁপার ভাঁজ থেকে উটকো চুল বেরিয়ে পড়ছে সেই বাতাসের দাপটে। পড়নে কাঁচা হলুদ রঙের শাড়িটার আঁচল দুলছে। হাতে বেঁধে দেওয়া গাঁদাফুল থেকে সুবাস আসছে মৃদুমৃদু।
ভাবনার খুব গভীরে পৌঁছে গেল সে। ভাবলো, আব্বা যে খালুআব্বার কাছে টাকার জন্য গেল, এখনো তো ফিরে এল না। অথচ দেড় দুই ঘন্টার ভেতর ফিরে আসার কথা ছিল। চিন্তায় কপালে ভাঁজ দেখা দিল আয়নার।
পেছন থেকে কে যেন বলে উঠলো
‘ কি ভাবছ আয়না?
আয়না ঘাড় ঘুরিয়ে হাসিমুখে দাঁড়ানো মেয়েটিকে দেখে বলল
‘ কিছুনা ভাবি।
নামিরা হাসলো। বলল
‘ শাড়িটা তোমাকে খুব মানিয়েছে। খুব ভালো লাগছে দেখতে।
আয়না একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো। নামিরা হঠাৎ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। বলল
‘ ওভাবে কি দেখছ?
আয়নার ভাবনায় ছেদ পড়লো। হাতের উল্টো পাশ কপালে ঠেকিয়ে চুল সরানোর চেষ্টা করে বলল
‘ আমি তোমাকে দেখে অবাক হই ভাবি। কোথা থেকে এসে কোথায় থাকছ তুমি? আমার ভাই তো তোমাকে কিছুই দিতে পারেনি। ভাইয়ার প্রতি তোমার অভিযোগ নেই? তোমার কষ্ট হয় না?
নামিরা খুব সুন্দর করে হাসলো। বলল
‘ নাহ।
আয়না বলল
‘ তোমার সাথে যার বিয়ে ঠিক হয়েছিল প্রথমে,তার কাছে তুমি ভালো থাকতে। ভালো চাকরি ছিল ওনার । নামদামী মানুষ ছিলেন ওনারা। আমি বলব তোমার বিরাট ভুল হয়ে গেছে । সারাক্ষণ মায়ের প্যানপ্যানানি ও সহ্য করতে হত না।
নামিরা এমন কথায় ও হেসে ফেলল। আয়নাকে বলল
‘ যেদিন কাউকে ভালোবাসবে সেদিন এই প্রশ্নটার উত্তর পেয়ে যাবে। ভালোবাসা শব্দটার কাছে ধনদৌলত, গরিব,ধনী,গুণী,খুনি শব্দগুলো যায় না। আমি আয়ানকে ভালোবেসেছি, শুধু ওকে নয়, ওর সবকিছুকেই। আয়ান বলেছে আম্মা বকলে চুপচাপ শুনে থাকতে। আম্মা তো ভালোবাসে আমায়। আয়ানের উপর রাগ থেকে অমন করে।
আয়না হাসলো। বলল
‘ কি পেলে এসব করে? নিজের মা বাবা ভাই বোন সবাই তো মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। বেঁচে আছ নাকি মরে গেছ সেটা ও খোঁজ নেয় না।
নামিরার মুখে হঠাৎ অন্ধকার নামলো। সে বলল
‘ আমার উপর ওদের রাগ তাই এমন করছে। রাগ যেদিন কমে আসবে সেদিন মেয়েকে ঠিকই খুঁজতে আসবে। আর বাবার কথা কি বলব, আমি জানি বাবা আমাকে খুব খুব ভালোবাসে। মান অভিমান থেকে দেখা করতে আসেনা। আমি তো আয়ানের সাথে পালিয়ে আসিনি কিংবা ওদের না জানিয়ে কিছু করেছি এমন ও না। ওরা নিজে দাঁড়িয়েই বিয়ে দিল। তারপরেই এমন আচরণ। কিছু বলার নেই আমার।
আয়না লম্বা একটা শ্বাস ফেলল। নামিরাকে পিছু করে দাঁড়িয়ে বলল
‘ আব্বাটা কখন যে ফিরবে?
নামিরা সে কথার প্রত্যুত্তরে বলল
‘ আয়না একটা কথা বলি তোমায়। তোমার ভাইয়ের তো কিছু নেই। চাকরি নেই, না ধনদৌলত কিন্তু তারপরও তো তোমার ভাই আমার কাছ থেকে কিছুই চায়নি। কিন্তু তোমার বরের তো অনেক টাকাপয়সা, বাড়িগাড়ি, নামযশ, খ্যাতি,প্রতিপত্তি তারপর ও কেন এত টাকা দাবি করলো তারা ?
আয়না ফিরলো নামিরার সামনে। আনমনা হয়ে বলল
‘ আমি কিচ্ছু জানিনা। আমাকে তো কেউ কিচ্ছু বলছেনা। তুমি কিছু জানো এই ব্যাপারে? কত টাকা লাগবে?
‘ নাহ, আয়ান আমায় তেমন কিছু বলেনি। শুধু বলেছে অনেক টাকার দরকার।
আয়না বলল
‘ তোমার গয়নাগুলো আছে? কোথায়?
নামিরা হতভম্ব।
‘ হ্যা আছে।
আয়না হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠলো। বলল
‘ তোমার গয়নাগুলো দেখাও তো। চলো।
নামিরা দাঁড়িয়ে থাকলো। বলল
‘ আয়না বাড়িভর্তি মেহমান। আমার ঘরে ও বসার জায়গা নেই। কিভাবে দেখাবো? আম্মা রাগ করবে ওসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করলে। আয়ান ও।
আয়না বলল
‘ তারমানে গয়না বিক্রি?
নামিরা মাথা নাড়িয়ে ভয়ংকর মিথ্যা বলে বসলো।
‘ না না বিক্রি না। কে বলেছে?ভুল বুঝছ তুমি।
আয়না গর্জে বলল
‘ সবাই লুকোচুরি খেলছে আমার সাথে। সবাই। তোমরা কি টাকা দিয়েই বিক্রি করছ আমাকে?
নামিরা দ্রুত সরে পড়লো। সব তার দোষ। আয়ান যদি জানতে পারে আয়না এসব প্রশ্ন করছে তাহলে আয়ান তাকে ভুল বুঝবে। ভাববে তার গয়না দিয়েছে বলে সে আয়নাকে বলে দিয়েছে। নাহ সে আয়নার সামনে যাবে না কখনো।

আয়নাকে তার ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। গায়ে হলুদের আয়েজন করা হলো মাটিতে পাটি বিছিয়ে, মিষ্টান্ন খাইয়ে। সবাই আয়নার পাশে গিয়ে বসলো। মিষ্টিমুখ করিয়ে সরে পড়লো। হাতে রাখি পড়ানো জন্য আয়ানকে খুঁজে পেল না কেউ। মুঠোফোনটা খুঁজে নিয়ে নামিরা ফোন করলো আয়ানকে। আয়ান এল কিছুক্ষণ পর।
আয়শা বেগম নামিরাকে ডাকলেন
‘ বউ তুমি ও যাও। আয়ানের সাথে গিয়ে মিষ্টি তুলে দাও। তারপর এসব শেষ করো। মানুষটা এখনো ফিরলো না। আমি আর পারিনা।
আয়না চিন্তিত হয়ে বসে রইলো। আয়ান এসে ধপ করে বসলো তারপাশে। বোনের গাল টেনে দিয়ে বলল
‘ টুনি মন খারাপ? কান্না পায়? এই বনু?
আয়না রেগে তাকালো। বলল
‘ আব্বা আসেনি এখনো।
আয়ান বলল
‘ এক্ষুণি চলে আসবে। চিন্তা করিস না। দেখি হাত দে। রাখি পড়াই ।
আয়না হাত বাড়ালো। আয়ান বলল
‘ মিরা রাখিটা দাও।
নামিরা চকচকে রাখিটা নিয়ে এল। একটা আয়ানকে দিল, আরেকটা নিজের কাছে রেখে দিয়ে বলল
‘ এটা আমি পড়াই?
আয়ান মাথা নাড়ালো। নামিরা বসলো আয়নার পাশে। সে ও রাখি পড়াবে আয়নার হাতে। তার ও বোন। আয়ান বোনের হাতে রাখি পড়াতে পড়াতে বলল

‘ আয় রে আয় টিয়ে
ছোট্ট পাখির বিয়ে
বর আসবে কাল
টোপর মাথায় দিয়ে
ছোট্ট পাখি যাবে শ্বশুরবাড়ি
বর আসবে চড়ে ঘোড়ার গাড়ি

আয়না আচমকা ডুকরে কেঁদে উঠলো। হাতের মুঠি দিয়ে আঘাত করল ভাইয়ের পিঠে। কেঁদে কেঁদে বলল
‘ সবসময় মজা করো। আমার মন ভালো নেই।
নামিরা বলল
‘ মুখটা গোমড়া করে রাখলে হবে? মন ভালো থাকবে? হাসো, কথা বলো ভালো লাগবে। সব মেয়েদের এমন লাগে এই সময়।
আয়ান বলল
‘ একদম ঠিক।
বোনের গাল মুছে দিল ভাই। বুকে জড়িয়ে বলল
‘ টুনি তুই ভালো থাকবি। তোর বর খুব ভালো।
নামিরা বলল
‘ আমার বরের মতো?
আয়ান তাকালো তার দিকে । তারপর হেসে বলল
‘ নাহ। টুনির বর আর ও ভালো। টুনিকে খুব ভালো রাখবে।
নামিরা মনে মনে রাগ করে বসলো।
‘ তার বর বেশি ভালো। খুব ভালো। তাকে ভালো রাখে, ভালোবাসে।

________

বিয়ের দিন ঘনিয়ে এল। সকাল সকাল ঘুম ঘুম চোখে গায়ে হলুদের শাড়ি পড়ে আয়না মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল
‘ আম্মা আব্বা আসেনি রাতে?
আয়শা বেগম বললেন
‘ নাহ।
আয়নার চোখ টলটলে। সে মাকে বলল
‘ খালুআব্বা কত টাকা দেবে বলেছে আম্মা?
আয়শা বেগম মেয়ের দিকে ফিরে বললেন
‘ সব তোর জানা লাগবে কেন? জেনে কি করবি তুই?
আয়না বলল
‘ এই বিয়ে করব না আমি।
আয়শা বেগম তেড়ে এসে ঠাস করে চড় বসালেন। নামিরা দৌড়ে এসে এমন দৃশ্য দেখে দৌড়ে এল। আয়নাকে সরিয়ে বলল
‘ আম্মা কি করছেন?
আয়না গালে হাত দিয়ে চুপ করে থাকলো। আয়শা বেগম বললেন
‘ একদম আমাকে প্রশ্ন করবে না। কি বলেছে ও শুনতে পাওনি? বিয়ে করবে না মানে কি? তার জন্য কতবার বিয়ে ভেঙেছে তার হিসেব আছে? এইবার দিতে পারছি তা ও ভালো পাত্রে, তাতে ও তার আপত্তি? শুরু থেকেই বিয়ে করবে না করবে না লাগিয়েছে। তার সমবয়সী কেউ আছে এই পাড়ায়? সবার সেই কখন বিয়ে হয়ে গেল। আমারটার বিয়ে হয়নি শুধু।
আয়না চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলো। আয়শা বেগম বললেন
‘ তুমি নিজেকে দেখো বউ। তোমার কি অবস্থা? ভালো ছেলের হাতে না পড়ে, পড়লে গরিবের ছেলের হাতে। খাওয়াতে পারলে পড়াতে পারেনা। পড়াতে পারলে আর দশটা দিতে পারেনা। তুমি নিজেকে দেখো ভালো করে,তোমাকে এই ফ্যাকাশে শাড়িতে মানায়?
নামিরা বলল
‘ টাকা মানুষকে ভালো রাখে এটা আমি বিশ্বাস করিনা আম্মা।
‘ রাখে, রাখে। টাকাতেই সুখ। তোমরা যাও তো যাও। আমার সামনে থেকে দুইজনই দূর হও। এর মুখ দিয়ে যদি বিয়ে করব না শব্দটা আর শুনি, খোদার কছম আমি জীবন্ত কবর দেব। ওই মানুষটার দুচোখে ঘুম নেয় কতদিন, ভালো করে দুটো খেয়ে শান্তিতে ঘুমালো কখন মনে নেই আমার। আর এ আছে বিয়ে করব না, বিয়ে করব না। বাপের সুখটা কোথায় দেখিস না মুখপুরী? আর একজন তো আছে, টাকা কামাই না পয়সা কামাই না বিয়ে করে বসে আছে। পরের মেয়ের দুর্দশা আমি দেখতে পারিনা দুচোখে। আমার মাথার যন্ত্রণা ধরে।
নামিরা বলল
‘ আম্মা শান্ত হোন। সব ভালো ভালো হবে। আব্বা চলে আসবে।
আয়না চলে গেল। নামিরা তার পিছু পিছু গেল।

আয়নার কয়েকজন মামাতো বোন বউয়ের সাজে সাজালো তাকে। অন্দরমহলের ভেতর থেকে মন আকুলিবিকুলি করতে লাগলো আয়নার। আব্বা কি এখনো আসেনি? সে কতক্ষণ দেখেনা আব্বাকে। না আসলে তো বিয়ে হবে না, পণের টাকা দেবে কি করে?
আর বিয়ে না হলে আম্মা কি করবে? আব্বা ও কষ্ট পাবে। এতগুলো লোকের সামনে ভাইয়ার মাথা কাটা যাবে, আব্বার অপমান হবে। তাদের দুর্নাম হবে পাড়ায়। ভাবির বাপের বাড়ির লোকজন শুনলে কি ভাববে?

বরপক্ষের আগমন ঘটলো প্রায় দুপুর দুটো নাগাদ। বাইরে প্যান্ডেলের ভেতর লোকজনের খাওয়া দাওয়া চলছে। এখনো বাড়ি ফিরেননি আজহার সাহেব। আয়ান এইবার আর বসে থাকলো না, বাবার খোঁজে বের হলো। খালাম্মা মারা গেছে গত বছর। খালুআব্বা ও অসুস্থ। ওখানে মুঠোফোনের মাধ্যমে খবর আসলো আজহার আহমেদ টাকা নিয়ে বের হয়েছে কাল রাত দশটার দিকে। আয়ানের বুক কাঁপলো। তাহলে আব্বা এখনো ফেরেনি কেন? সে বোন আর মাকে জানালো না এই ব্যাপারে। গহনা বন্ধকের টাকাটা এসেছে শুধু। বাকিটাকাটা আব্বার হাতে।
বরের বাবার সাথে এই ব্যাপরে কথা বলে কোনোমতে বিয়েটা সাড়তে হবে। আব্বার খোঁজ পেলেও টাকাগুলো দিয়ে ফেলতে পারবে। কিন্তু শায়খ চৌধুরী একথা শুনে মানলেন না। বরের মামারা তো একেবারেই না। এ কেমন কথা? পণের টাকা না পাওয়া পর্যন্ত বরকে তারা বিয়েতে বসাবে না। মেয়ে ও নিয়ে যাবেনা। কথা তো এমন ছিল না।
একপ্রকার হুলস্থুল বেজে গেল। আয়ান বলল
‘ দেখুন টাকা আমরা আজ না হয় কাল তো দিয়েই দেব। বিয়েটা হয়ে যাক।
শায়খ চৌধুরী মানলেন না। ছেলের কানে এসব কথা যাবে বলে ভয়ে ও থাকলেন তারা। তারআগে যদি টাকা উসুল হয় আর কি? কিন্তু দেখলো কোনো উপায় নেই। তখন রাগে ফেটে পড়লো শায়খ চৌধুরী।
বরের বেশে আসা ছেলের কাছে গিয়ে বললেন
‘ অনুরাগ চলো বাড়ি ফিরে যায়।
অনুরাগের কাছে বিষয়টা ঠাট্টার মনে হলো। ফিরে যায় মানে কি? সে বিয়ে করবে না?
অনুরাগের শিক্ষিত বন্ধুবান্ধব হেসে ঠাট্টা করে বলল
‘ অনুরাগ ভয় পাস না ভাই। বিয়ে হবে। বউ আসিবে।

ইতোমধ্যে একপ্রকার গুঞ্জন শুরু হলো। অন্দরমহলে চলে গেল সেই বার্তা। বউ বেশে, বসে থাকা আয়নার কানে গিয়ে পৌঁছালো দুঃসংবাদ। শক্ত পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলো সে।
আয়শা বেগম মুখে কাঁপড় গুঁজে বসে রইলেন ঘরের কোণে। বরের মা আর মামিরা বউ দেখার জন্য অন্দরমহলে পা রাখলেন। স্থির, অচঞ্চল বসে থাকা বধূটিকে দেখে শান্তি শান্তি লাগলো আনহিতার। তার ছেলের বউ কালো কোথায়? চলবে। চৌধুরী বংশের বউ বউ ভাব আছে।
কিন্তু যখনি ওসব কথা কানে এল মাথা খারাপ হলো আনহিতা চৌধুরীর। পণের টাকা ছাড়া বিয়ে হবে কি করে?একটা দুর্নাম রটে যাবে, চৌধুরী বাড়ির ছেলে পণ না নিয়ে বিয়ে করেছে! চৌধুরী বাড়ির ছেলের শ্বশুরের টাকা নেই? কিছু দেয়নি?
নাহ এরকম হলে হবে না।

হন্তদন্ত হয়ে মায়ের খোঁজে বাড়িতে এল আয়ান। মায়ের রুমে গেল দৌড়ে। নামিরা ও দৌড়ে গেল আয়ানের পিছু পিছু। কি হয়েছে আবার?

ততক্ষণে সবখানেই জানাজানি হয়ে গেল পণের টাকা না পেলে এই বিয়ে হবেনা। ঘৃণায় গা গুলালো আয়নার। সে মায়ের খোঁজে বেরোলো। শাড়ির ভারে ধীরপায়ে হেঁটে গেল। মায়ের ঘরের কাছে যেতেই ঘর থেকে চাপা কান্নার রোল ভেসে এল। মায়ের কান্না খুব গভীরে গিয়ে লাগলো আয়নার। চারপাশটা বিষাক্ত লাগলো তার। ঘরে ঢুকার আগেই ভাইয়ের কথা কানে এল
‘ আব্বার কিচ্ছু হবে না আম্মা। আব্বা একদম সুস্থ হয়ে উঠবে। ভালো হসপিটালে ভর্তি করিয়েছি আব্বাকে। তুমি চিন্তা করোনা আম্মা। বনুর ও বিয়ে হবে। ওর বর এসব মানবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে আম্মা।
আয়না দরজা ঠেলে ঢুকে গেল ঘরের ভেতর। চেঁচিয়ে বলল
‘ কি হয়েছে আমার আব্বার? কোথায় আমার আব্বা?
আয়ান দৌড়ে এল। বলল
‘ কই? কিছু হয়নি তো। কিছু না।
আয়না ভাইকে ঠেলে দিল। বলল
‘ আমাকে পুতুল পেয়েছ তোমরা? পুতুল আমি? যেমন ইচ্ছা তেমন করছো?
আয়শা বেগম মুখ চেপে কাঁদলেন। আয়না হনহনিয়ে পা বাড়ালো। তার মামারা বরের বাবা আর মামাদের সাথে কথা বলে বলছিল। গহনা বিক্রির টাকাগুলো দিয়ে কোনোমতে বিয়েটা সেড়ে নেওয়া যাক। বরের বাবা রাজী হতেই যাচ্ছিল।

আয়না হনহনিয়ে এল তখনি। এভাবে ভরা মজলিসে মেয়েদের চলে আসা বারণ। তারউপর সে যদি কনে হয় তাহলে তো কথায় নেই। হায়হায় করে উঠলো সবাই। আয়ান বোনের পিছু পিছু দৌড়ে এল। নিয়ে যেতে চাইলে আয়না গলার আওয়াজ বড় করে বলল
‘ সবাই এক্ষুণি আমাদের বাড়ি খালি করুন। তাড়াতাড়ি করুন। আমার দমবন্ধ লাগছে। আজ এখানে কোনো বিয়ে হবে না। দয়া করুন, আমাদের বাড়িটা খালি করুন। বিদায় হোন।
অপমানে মুখ থমথমে হয়ে গেল শায়খ চৌধুরী আর অনুরাগের মামাদের। এ কেমন বেয়াদবি? এত বড় অপমান? তাও কনে?

বর বসার ঘরে অনুরাগকে আনহিতা বেগম বুঝিয়ে পারলেন না। অনুরাগের একটাই কথা সে বিয়ে করেই যাবে। টাকার জন্য বিয়ে হবেনা এটা কেমন কথা? সে কি বউ কিনছে নাকি? এসব তো সে জানেনা। তাকে নিয়ে ব্যবসা চলছে? আনহিতা মাথা চাপড়ালো। অনুরাগ মায়ের কথা না শুনে ওই ঘরের দিকে চললো। পর্দা ঠেলে বাবা আর মামাদের কাছে যেতেই তার চোখে পড়লো আগুনচোখের একটি বধূকে। মাথার লম্বা সিঁথির মাঝবরাবর পড়া টিকলিটা বাঁকা হয়ে পড়ে আছে। অনুরাগের কানে আবার ভেসে এল
‘ এমন ছোটলোকদের বাড়িতে আমি বউ হয়ে যাব না। এই বিয়ে হবে না। আমি বলছি, আপনারা এক্ষুণি বিদায় হোন।
অনুরাগের দিকে চোখ পড়ায় হয়ত শেষের দিকে মেয়েটার গলায় একটু নম্রতা দেখা দিল। কিন্তু দুচোখে যে ঘৃণা দেখা যাচ্ছে তা বিন্দুমাত্র সরলো না। অনুরাগের খারাপ লাগলো সে দোষ না করে ও দোষী হয়ে গেল। অনুরাগকে দেখে তার বাবা তাকে বলল
‘ তুমি এখান থেকে যাও অনুরাগ । আমরা সামলে নিচ্ছি।
অনুরাগ গেল না। বলল
‘ আমি যেতে পারব না বাবা। আমি যেটা করতে এসেছি সেটা করেই যাব। আপনারা ঘর খালি করুন। আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিন।
আয়না বলল
‘ কাউকে কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না। সবাই যান এখান থেকে।
অনুরাগ চোখ তুলে তাকালো। ছবিতে মেয়েটাকে মোটেও রাগী মনে হয়নি।

অনুরাগকে অবাক করে দিয়ে আয়না অনুরাগের মায়ের দেওয়া সমস্ত গহনা খুলে ছুঁড়ে মারলো। বলল
‘ এগুলো নিয়ে চলে যান। আমরা মধ্যবিত্ত কিন্তু ছোটলোক নই। আপনারা কি বিয়ে ভাঙবেন আমি নিজেই ভেঙে দিলাম।
অনুরাগ বলল
‘ আমাকে কিছু বলতে দিন।
আয়না চুপ করে গেল। মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালো। শায়খ চৌধুরী ভাবলেন
‘ এই মেয়ে এতটা বেয়াদব? এতটা? এত অপমান করলো তাদের? সে এর শেষ দেখে ছাড়বে।
আয়নার কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো অনুরাগ। শায়খ চৌধুরী তার দলবল নিয়ে চলে গেলেন বাইরে। আয়ান তাদের পিছু পিছু দৌড়ে গেল।

আয়না গুটিয়ে দাঁড়ালো। একটা পরপুরুষের সাথে তার কিসের কথা? অনুরাগ বলল
‘ লজ্জা পাবেন না। আমার কথা শুনুন।
‘ লজ্জা নেই আমার।
শক্ত কথা শুনে অনুরাগ হালকা কাশলো। বলল
‘ আমার বন্ধুবান্ধব এমনকি টিচাররা ও এসেছেন। আপনি আমার মা বাবার কথা বাদ দিন, আমার কথা ভেবে বিয়েতে মত দিন। আমি ওসব জানতাম না। ওসব আমার অগোচরে হয়েছে। বুঝার চেষ্টা করুন।
আয়না বলল
‘ হবে না। আমার আব্বার কি অবস্থা জানিনা। এমতাবস্থায় আমার পক্ষে বিয়ের পিড়িতে বসা সম্ভব না।
অনুরাগের এবার রাগ লাগলো। সে নিজেকে শান্ত করে বলল
‘ আপনি কি আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন?
‘ হ্যা।
অনুরাগ বলল
‘ আমার দোষটা?
আয়না এবার ফিরলো। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল
‘ আমি কিচ্ছু বলতে চাইনা। আমাকে জোর করবেন না। এখান থেকে আপনার পরিবার নিয়ে দয়া করে চলে যান।
অপমানে মুখ লাল হয়ে এল অনুরাগের। আয়না বলল
‘ আপনি যাচ্ছেন না কেন?
অনুরাগ বলল
‘ কিন্তু আমি তো,
আয়না গর্জে বলল
‘ কি আমি তো? যেতে বলেছি যান। নাহলে?
অনুরাগ বলল
‘ নাহলে?
আয়না গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল। অনুরাগ সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর বের হয়ে গেল সেই বাড়ি থেকে। আনহিতা ছেলের পিছু পিছু দৌড়ে যেতে যেতে ডাকল
‘ সোহাগ কই যাও? দাঁড়াও।
অনুরাগ দাঁড়ালো না। রাগ নিজের উপর লাগছে তার। সে কেন কোনোকিছু না জেনে না শুনে বিয়ে করতে এল? টাকা দিয়ে কেন তারজন্য বউ কিনতে হবে? সে পণ করলো বিয়ে যদি করতেই হয়,সে একটা কানাকড়ি ও না নিয়ে বিয়ে করবে।

গাড়ি এক্সিডেন্টে মারাত্মক ভাবে আহত হলো আজহার সাহেব। আয়শা বেগম সেই শুয়েছেন আর উঠার নামগন্ধ ও নেই। তিনি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছেন। সব কেমন যেন একমুহূর্তে শেষ হয়ে গেল।
আয়ান আজহার সাহেবের কাছে। তিনি মাথায় বেশি আঘাত পেয়েছেন। বাঁচে মরে এমন অবস্থা। টাকাগুলো নিয়ে ফেরার সময় এক্সিডেন্ট হয়েছে। এখন উনার চিকিৎসা খরচে ও টাকাগুলো হবে না। এমতাবস্থায় তিনি যদি জানতে পারেন তার মেয়ের বিয়ে ভেঙেছে তাহলে কি হবে প্রতিক্রিয়া হবে উনার?
নামিরার সাহায্যে আয়না বাবার কাছে গেল। হসপিটালের বেডে নিথর হয়ে পড়ে থাকা আজহার সাহেবকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। বাবার কাছে গিয়ে বলল
‘ আব্বা তোমার এই দশা আমার জন্য হয়েছে। আমি দোষী আব্বা।
আয়ান এসে বোনকে সরিয়ে নিল। বলল
‘ যা হয় সব ভালোর জন্য হয় আনা। কাঁদিস না।
আয়না বলল
‘ আব্বাকে এভাবে আমি দেখতে পাচ্ছিনা। সব ওইলোকগুলোর কারণে হয়েছে। আব্বার কিছু হলে আমি ছাড়ব না ওই লোকগুলোকে।
আয়ান বলল
‘ শান্ত হ। দেখ আব্বার যখন জ্ঞান ফিরবে তখন কি জবাব দেব আমি? আব্বা খুব কষ্ট পাবে।
নামিরা বলল
‘ চিন্তা করো না আয়ান। বিয়েটা হয়ত ভালোর জন্যই ভেঙেছে। বরের মাকে আমার একটু ও ভালো লাগেনি। কেমন যেন অহংকারী মনে হলো।
আয়ান বলল
‘ আমি জানিনা কি হবে? বিয়েটা হয়ে যেত আব্বা খুশি হতো।
আয়না এবার রেগেমেগে বলল
‘ তাই নাকি? ওই টাকা পাগল অমানুষগুলোর কাছে ভালো থাকতাম আমি? আমার ভালোটা চাওনা? শুধু তাড়িয়ে দিতে চাও।
নামিরা বলল
‘ আয়না তুমি ভুল বুঝছ তোমার ভাইকে।
আয়ান বলল
‘ রাগ করছিস কেন? আমি বাবা মা আমরা সবাই তো তোকে ভালো রাখার জন্যই এসব করেছি। যাতে তুই ভালো থাকিস। আর আমরা কি এমনি এমনি তোকে ওই ছেলের কাছে বিয়ে দিচ্ছি নাকি? ছেলে ভালো তাই দিচ্ছিলাম। শিক্ষিত ছেলে।
আয়না ব্যঙ্গ করে বলল
‘ হ্যা শিক্ষিত ছেলে। এতটাই শিক্ষিত, এতটাই জ্ঞানী যে নিজের বিয়ের খোঁজ খবর ও নিজের কাছে থাকেনা। বোকাসোকা পুরুষ মানুষ দেখলেই আমার বিরক্ত লাগে।
আয়ান বলল
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। যাহ। তোর বিয়ের নাম ও আর নেব না।
আয়না বলল
‘ ভাবির গয়না ভাবিকে ফিরিয়ে দাও। আর আব্বার চিকিৎসা খরচ যেগুলো খালুআব্বার কাছ থেকে এনেছে সেগুলো দিয়ে চলে যাবে।
আয়ান নামিরার দিকে তাকালো। নামিরা
চোখে আশ্বস্ত করলো আয়ানকে। সাহস যুগালো।
আয়ান বোনের মাথায় হাত দিয়ে বলল
‘ ঠিক আছে। তুই যা বলবি তাই হবে।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here