আয়নামতী #পর্ব_২০

0
778

#আয়নামতী
#পর্ব_২০
#পুষ্পিতা_প্রিমা

সন্তান যখন কোলে ফিরে এল। চারপাশটা তখন আপনাআপনি রঙিন হয়ে উঠেছে। সকল দুঃখকষ্ট ঘুচে গেছে এক লহমায়। আজহার সাহেব নিজের চেষ্টায় হাঁটতেন। যখন থেকে হাঁটা বন্ধ করে দিলেন তখন থেকে আর ও অকেজো হয়ে গেলেন। সন্তানকে দেখে ওই অকোজো পা টা যেন বিদ্যুত গতিতে তরতরিয়ে কাঁপা শুরু করে দিয়েছিল। তিনি হেঁটে ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চাইলেন। সন্তানের মুখে আব্বা ডাকটা এতটাই মধুর তিনি হুইল চেয়ারে বসে কাঁদলেন একদম বাচ্চা ছেলেদের মতো। আয়শা বেগম তো সেই ছেলের বুকে পড়ে রয়েছেন সেই কখন থেকে। আয়না মায়ের কাছে গিয়ে বলল
‘ সব আদর কি তুমি খাবে আম্মা? আমি কতদিন ভাইয়ের আদর খাইনা। আমার অনেক গল্প জমে আছে তো।
আয়শা বেগম ছাড়লেন না। ছাড়তে চাইলেন না। ছেলের কপালে অসংখ্য স্নেহ,মমতার স্পর্শ দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখলেন বুকের সাথে। কত জমিয়ে রাখা কথা বলে ফেললেন যেন চোখের জল দিয়ে। ছেলে তো তখন নিশ্চুপ। কোমা থেকে ফিরে হাসপাতালের বেডে সে যখন পড়েছিল মাসের পর মাস। যখন চারপাশটা বিষাক্ত লাগতো তার। পাগলের মতো ব্যবহার করতো তখন বোধহয় এই এমন একটা আশ্রয় তার খুব দরকার ছিল। মায়ের হাতটা তার কপালে ঠেকালে বোধহয় সব যন্ত্রণা লাঘব হয়ে যেত। কত কষ্টের দিনগুলো!

মাকে জড়িয়ে ধরে রাখা অবস্থায় যখন আয়না এসে দাঁড়ালো সামনে তখন মুখ অস্ফুটস্বরে বের হলো
‘ টুনি!
সেই মিষ্টি ডাকটা!
পানিভর্তি টলমলে চোখে তাকিয়ে হাসলো আয়না। কান্নার সাথে হাসি। দৃশ্যটা সুন্দর নাহ?
আর কোনো দুঃখই যেন রইলো না আয়নার। ভাই যখন হাত বাড়িয়ে দিয়ে ডাকলো তখন ছোট্টবেলার সেই ছোট্ট আয়নার মতো ঝাপ দিল সে ভাইয়ের বুকে। কাঁদতে কাঁদতে যেন হাসলো। আবার হাসতে হাসতেই কাঁদলো। রূপা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে সুন্দর দৃশ্যখানি। তার নানাভাই ও কি একদিন ফিরবে? কবে ফিরবে? ভালো হয়েছে ভাইজান ফিরেছে নইলে আপার কষ্ট কখনোই মুছতো না। কিন্তু সায়ানের আব্বা এল, আম্মা যে চলে গেল। কি হবে এখন?

নিজের ঘরটাতে যখন গেল আয়ান তখন দেখলো বাচ্চার একটা ছোট্ট গাড়ি পড়ে রয়েছে। একটা সাদাটে রঙের শাড়ি। মাথার ফুল। তার বহুপুরোনো একটা শার্ট। আর কিছু নেই। মানুষটা ও নেই।
অবশ্য থাকার কথা ও নয়। এই যে সে সুস্থ স্বাভাবিক হলো আজ কতগুলো দিন। একবার ও কি তার মায়ের কাছে,বাবার কাছে,বোনের কাছে ফিরতে ইচ্ছে হয়নি? যে তার সব সুখ দুঃখের সাথী, সঙ্গী, অর্ধাঙ্গিনী ছিল তার কাছে ফিরতে ইচ্ছে হয়নি? হয়েছিল তো। সব ছেড়ে ছুঁড়ে সে ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু তার কাছে যে চিঠি গেল নাওয়াজ শেখের কাছ থেকে।

নাওয়াজ শেখ জানতো সে এখনো বেঁচে আছে সেটা আশ্চর্যের বিষয় নয়, আশ্চর্যের বিষয় তো ছিল এটা যে চিঠিতে লেখা ছিল নামিরার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তিনি ভালো পাত্র দেখে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আয়ান যাতে কখনোই আর না ফিরে নামিরার কাছে। তার একটা বাচ্চা ও হয়েছে।
যার সাথে সারাটাজীবন একসাথে পথ চলার কথা ছিল তার এতবড় প্রতারণা কি সহনীয় কিছু? নাকি বিশ্বাস ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণা? প্রচন্ড অভিমান আর জেদের বশে দেখা দিল না সে মা আর বোনকে। কি করে তারা ও এমন করতে পারলো তার সাথে? তবে চুপিচুপি একদিন শেখ বাড়ির কাছাকাছি এসেছিল সে। লাল টকটকে শাড়ি পড়া বাচ্চা কোলের সেই রমণীকে দেখে সেই যে এক বুক ভাঙা যন্ত্রণায় পিষ্ট হলো সে,, শরীরের সব শুকিয়ে আসা ক্ষত যেন তরতাজা হয়ে উঠলো নিমেষেই। ওই চিঠি যদি ভুল হয়ে থাকে তাহলে স্বামী মরে যাওয়ার পর ও গায়ে লাল শাড়ি কেন থাকবে? কোলে বাচ্চা কেন থাকবে? কার বাচ্চা?
সে বুঝেনি সেদিন তাকে হারানোর ব্যাথা ভুলে থাকার জন্যই মেয়েটা সেজেগুজে থাকার চেষ্টা করত। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে অপেক্ষা করত বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রিয় স্বামীটার জন্য। যদি কখনো ও ভুল করে হলেও সে ফিরে আসে। তাকে লাল শাড়িতে দেখলে তো খুশি হয়ে যাবে। কে জানতো সব হিতেই বিপরীত হবে। তাকে পাগলের মতো ভালোবাসার মানুষটিকে সে অবিশ্বাস করেছে। নিজের সন্তানকে সে অন্যের সন্তান ভেবে ঘৃণার চোখে চেয়েছে, সবচাইতে বড় যন্ত্রণার বিষয় তো এটিই। সে কিভাবে মিরার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? ঠিক আগের মতো করে মিরা তাকে ভালোবাসবে তো। নাকি আঘাত করেছ বলে দূরে সরে যাবে?

_______________

গোসল করার পর চুল থেকে তোয়ালেটা খোলার আর নামগন্ধ নেই নামিরার। নাজমা বেগম কত করে বলেন কিন্তু শোনেনা নামিরা। নাজমা বেগম আজ ও একদফা ঝাড়লেন নামিরাকে। বাচ্চাটা বুকের দুধ খাচ্ছে, এ সময় মায়েদের অনেক কিছু মেনে চলতে হয়। মায়ের বকবকানি শুনে সায়ানকে কোল থেকে বিছানায় শুইয়ে দিল নামিরা। তোয়ালে খুলতেই পারলোনা। সায়ান চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো। এমনভাবে কাঁদে ছেলেটা যেন তার গলা কেউ টিপে ধরেছে। আবার বুকে তুলে নিল নামিরা। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ চুপ।
ধমক পেয়ে আর ও জোরে কাঁদতে লাগলো সায়ান। হাত পা নেড়ে ধস্তাধস্তি লাগালো মায়ের সাথে। উদ্দেশ্য মায়ের কোল থেকে নেমে যাওয়া। নামিরা ধপ করে বিছানায় শুইয়ে দিল। নাজমা বেগম আসলেন। বললেন
‘ তুই কি পাগল হয়ে গেছিস নামিরা? কি করছিস ছেলেটার সাথে?
নাজমা বেগম কোলে নিতে গেলেন। নামিরা কোলে নিয়ে নিল নিজেই। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ ও আমার ছেলে৷ কারো এত দরদ দেখাতে হবে না। যাও তুমি।
নাজমা বেগম কপাল কুঁচকে মেয়ের দিকে চাইলেন। তারপর চলে গেলেন। সায়ানের কান্না খানিকটা থেমেছে। ঠোঁট জোড়া গোল গোল করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নামিরা জিজ্ঞেস করল
‘ কি হয়েছে?
সায়ান সোহাগা গলায় গোল ঠোঁটজোড়া টেনে আওয়াজ করল
‘ উঃ!
‘ উঃ আবার কি? ব্যাথা?
‘ উঃ!
নামিরা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। চুম্বন বসালো কপালে। বলল
‘ আর বকা দেব না। আর ব্যাথা পেতে হবে না।
সায়ান চুপ করে শুয়ে থাকলো মায়ের বুকে।
নামিরা তোয়ালে ছাড়ানোর জন্য বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। তিন তলার বাড়ি তাদের। দোতলায় থাকে সে। বারান্দা থেকে দেখা যায় বাগান বিলাস,আর ও কত কী ফুল!
সায়ানকে একহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখে তোয়ালে খুললো সে চুল থেকে। ভেজা চুল লাফ দিয়ে পড়লো কোমর অব্দি। সায়ানের মুখে পড়ার সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠলো সে। নামিরা সরিয়ে বলল
‘ কিছু পড়া যাবেনা তার মুখে। অসভ্য।
সায়ান বলে উঠলো
‘ উঃ।
নামিরা ধমকে বলল
‘ চুপ।
কথা বলতে বলতে চোখ গেল গেইটের কাছে। কে ঢুকছে এই দিন দুপুরে?
কোন আগন্তুক?
নামিরা ভালো করে দেখলো সেই আগন্তুককে। দারোয়ানকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলো দারোয়ান গেইট বন্ধ করো। কাউকে ঢুকতে দিওনা। কিন্তু বলা সম্ভব হলো না। ছেলেকে আর ও শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে ধরলো সে। চোখের কোণা জ্বলজ্বল করে উঠলো কেন জানি। দমবন্ধ লাগলো। হাঁসফাঁস লাগলো। বুকে ফেটে কান্নারা বেরিয়ে আসতে চাইলো। কিছুই হলোনা, শুধু নীরবে গালটা ভিজে উঠলো মুহূর্তেই। বেশ সংকোচ নিয়ে আগানো ছেলেটা সেই সময় তাকালো এদিকে। চোখাচোখি হয়ে পড়ায় চরম অস্বস্তি লাগলো দু’জনেরই। কেউ মুখ ফিরিয়ে নিল ঘৃণায়,কেউ লজ্জায়। ছেলেকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো নামিরা। এই ছেলে তার একান্ত। আর কারো না। তার ছেলের দিকে যে অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় সে কখনোই তার স্বামী নয়। সে কি চাহনী দেখে বুঝতে পারেনি তখন? দেড়টা বছরের ব্যবধানে কি মানুষ অতটা পাল্টে যেতে পারে কখনো?
একরাশ অভিযোগ নিয়ে নামিরা তার দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকালো। এই আকুতিভরা চাহনিটা তাকে দুর্বল করতে যথেষ্ট। তাই পিঠ করে দাঁড়ালো সে। বোবাকান্নার টুপটাপ নোনাজলের ফোঁটা ছেলের মুখের উপর গিয়ে পড়লো। তারপর দ্রুতপায়ে চলে এল ঘরে। সেই আদর মেশানো গলায় পরিচিত ডাকটি ভেসে এল কানে। এই প্রথমবার নামিরা অগ্রাহ্য করলো। অথচ কতগুলো প্রহর গুনেছে সে এই একটি ডাক একবার শোনার জন্য। আজ বহু প্রতীক্ষার পর শুনলো তবে ভুল সময়ে।

_____________

শুকনো মুখে ছেলেকে বাড়ি ফিরতে দেখলো আয়শা বেগম। আয়না তো পুরো ঘরটা নতুন করে সাজিয়েছে। কত রকমের রান্না করা হয়েছে। সায়ান আসবে। কত খুশির দিন!
কিন্তু ভাইকে খালি হাতে ফিরতে দেখে চোখজোড়া ছলছল করে উঠলো আয়নার। সায়ান কোথায়? ভাবি?
আয়ান এসে বসলো বারান্দায় রাখা চেয়ারে। আয়শা বেগম পানির গ্লাস হাতে ছুটে গেলেন। ছেলের মুখ কপাল ছুঁয়ে বললেন
‘ কি হয়েছে রে আব্বা? শরীর খারাপ? মাথা ঘুরছে? সেলাইয়ের জায়গায় ব্যাথা করছে। মাথা ব্যাথা করছে। ওই ডাক্তার মেয়েটাকে কি কল করব?
মায়ের দিকে হতাশ চোখে তাকালো আয়ান। বেশ খানিক্ষন চেয়ে থেকে টেনে আনলো মাকে। চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে মাথা রাখলো মায়ের কোলে। মায়ের হাত যখন তার মাথায় বিলি কাটতে ব্যস্ত তখন আয়ান বলে উঠলো

‘ সায়ানের কত বছর হলো আম্মা?

‘ বছর কোথায়? এখনো বছর হয়নি তো। নয় মাস কি আট মাস চলছে। এইদিনই তো খাবার মুখে দিলাম।

‘ আমি কি অভাগা আম্মা। নিজের ছেলের বয়স কত সেটা ও জানিনা। সেজন্যই বোধহয় মিরা আমাকে ঘৃণা করে।

আয়শা বেগম হাত বুলালেন ছেলের কপালে। চুলের উপর আদর করে বললেন

‘ এমন করে বলছিস কেন আব্বা? সব ঠিক হয়ে যাবে। বউ কি তোর সাথে কথা বলেনি? বলবেই বা কেন? আমরা তো কেউ তার কথা কানে নেইনি। ভেবেছিলাম পাগলামি করছে।

আয়ান মাথা তুললো। বলল

‘ আমি কি পাল্টে গেছি আম্মা? নাকি মিরা পাল্টে গেছে? আমার সব কেমন কেমন লাগছে।

আয়শা বেগম হাসে। বলেন

‘ আমি গিয়া নিয়া আসি বউরে। তোর সাথে রাগ করছে আর কি। তুই ওরে কত কষ্ট দিলি। এখন ও তোরে কষ্ট দিতেছে।

আয়ান বলল

‘ ও তোমার সাথে আসবে?

‘ আসবো না ক্যান? আসবো। আমি বিকালবেলা একবার যামু, নিয়া আসুম আমার বউরে।

‘ যদি না আসে?

আয়শা বেগম হেসে ফেলেন। বলেন

‘ না আসিলে আর কি? তোরে আরেকডা বিয়া করামু।

আয়ান মায়ের কোলে আবার মাথা রেখে ডেকে উঠলো

‘ আম্মা।

খলবলিয়ে হাসেন আয়শা বেগম। আয়না আর রূপা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাসে। রূপা খুশিতে বাকুমবাকুম হয়ে বলে উঠে

‘ জেম্মা আমি ও তোমার লগে যাব।

আয়না মাথায় চাটি মেরে বলল

‘ আবার ওসব কথা বলা শুরু করেছিস?

‘ আর কমু না।

আয়না আর ও জোটে চড় মারলো মাথায়। রূপা মাথা ঢলতে ঢলতে বলল

‘ আর বলব না কইছি তো।

আয়না বেত খুঁজতে গেল। দৌড়ে পালালো রূপা।

______________

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই আয়শা বেগমের উপস্থিতি দেখে ভড়কালো না নামিরা। খুশি হলোনা, বেজার ও হলো না। আয়শা বেগম সায়ানকে কোলে নিয়ে আদর করলেন। নামিরা তখন ঘর গোছার কাজে ব্যস্ত। আয়শা বেগম খাটের উপর বসে নাতির সাথে খেলতে খেলতে বললেন

‘ ভাই আমি তো তোরে নিয়া যাইতে আসিনাই। তোর বাপরে আরেকটা বিয়া করামু তার লগে দাওয়াত করতে আইছি। তুই কি যাবি তোর বাপের বিয়া খাইতে? নাহ তুই তো যাইতে পারবিনা তারজন্য তোর মায়ের যাওয়া লাগবো। কিন্তু তোর মা তো যাইবো না।

সায়ান ঠোঁট গোল করে বলল
‘ উঃ।
আয়শা বেগম চুমু খেয়ে বললেন
‘ গু। ছেহঃ।
সায়ান খিলখিলিয়ে হাসে। নামিরা কোন একটা কাজ করতে গিয়ে থেমে থাকে। আবার কাজে মনোযোগ দেয়।
আয়শা বেগম আঁড়চোখে তাকে পরখ করছে। তারপর বলল
‘ শোনো সায়ানের আম্মা তোমার জামাই আরেকডা বিয়া করবে তো তুমি যদি অনুমতি না দাও কেমনে বিয়া করবো?

‘ কে বারণ করেছে বিয়ে করতে? একশটা বিয়ে করান। আমার কি?

আয়শা বেগম শব্দহীন হাসেন। বলেন

‘ ওহ আইচ্ছা। ঠিক আছে, তো আমি আর বইসা আছি ক্যান? চইলা যাই। কত কাজ আমার।

নামিরা ধুপধাপ জিনিস রাখতে শুরু করলো। নাজমা বেগম আসলেন নাশতার প্লেট হাতে নিয়ে হাসিখুশি মুখে। বললেন

‘ জায়নামাজে বসে আমি কতবার শুকরিয়া করলাম আল্লাহর দরবারে। আল্লাহ মুখ ফিরে চাইছে। আমার কি যে খুশি লাগতেছে আপা। নামিরার আব্বা ঠিকই বলছে, ওই পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট আয়ানের ছিল না।

নামিরা বলল

‘ মা থাক ওসব কথা। আম্মাকে প্লেট তুলে দাও।

আয়শা বেগম গাল ফুলিয়ে বললেন

‘ কে আম্মা? কার আম্মা? আয়ান আর আয়না ছাড়া আমি আর কারো আম্মা না। কেউ যেন আমারে আম্মা না ডাকে।

নামিরা চোখ জ্বলে উঠলো। সায়ানকে নিয়ে নেওয়ার জন্য গেল। আয়শা বেগম সায়ানকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল

‘ আমার নাতি।

নামিরা হনহনিয়ে চলে গেল।
নাজমা বেগম বললেন

‘ এই মেয়ে আবার কি শুরু করছে কে জানে?

আয়শা বেগম মিটিমিটি হেসে বললেন

‘ বয়সটাই রাগারাগির। মান অভিমানের। এগুলা ছাড়া কি সংসার হয় নাকি? তারা ঠিক করে নেবে সব।

নাজমা বেগম হাসলেন। বললেন
‘ আচ্ছা আমি ওকে তৈরি হতে বলছি। আয়ানকে পাঠাবেন এখানে, ছেলেটাকে একটু মন ভরে দেখব।

আয়শা বেগম বলল

‘ আইচ্ছা। বউরে একটু তাড়াতাড়ি করতে কন। আমার ভাইডারে আমি রাত নামার আগে ঘরে ঢুকাই। নইলে খারাপ বাতাস টাতাস লাগবো। দিনকাল ভালা না।

_______________

মাগরিবের আযান পড়া শেষ হয়েছে। বাড়ি পৌঁছে আয়শা বেগম নামাজে বসলেন। আয়না রূপাকে সাথে নিয়ে নামাজ পড়ে উঠে ছুটলো সায়ানের কাছে। খ্যা খু আওয়াজ করে সে জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি। আয়না আদরে আদরে ভরিয়ে দিল। রূপা বলল
‘ ধুরর আমি আদর করবার পারিনা ধলা মিয়ারে। চিল্লাইতে থাকে। আমার চুলগুলা টানতে টানতে ছেঁড়ার অবস্থা।

আয়না খিলখিল করে হাসে। বলে
‘ আব্বা তুমি রূপা ফিপির সব চুল ছিঁড়ে ফেলবা। ডাব বানায় ফেলবা পুরা মাথা। কেমন?

সায়ান হেসে আওয়াজ করলো
‘ আম,মাম,মামমা।
আয়না নাকের ডগায় চুমু বসায়। নামিরার দিকে আঁড়চোখে তাকায়। তারপর জিজ্ঞেস করে
‘ আব্বার কাছে যাবে? চলো।
নামিরা বলল
‘ কোথাও যাবে না ও। আমার ছেলে।
আয়না কোলে তুলে নিল। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ আমার আব্বা,কলিজা।
বলেই নিয়ে গেল আয়না।
আজহার সাহেবকে ডেকে বলল
‘ আব্বা দেখে যাও, আমার আরেক আব্বা চলে আসছে। আমার দুইটা আব্বা।
সায়ান হাত বাড়িয়ে শক্ত করে ধরলো আয়নার চুল। আয়না চেঁচিয়ে বলে উঠলো
‘ ও আল্লাহ আমার চুল শেষ। শেষ।
এত জোরে চিল্লানোর আওয়াজ শুনে সায়ান ঠোঁট টেনে কেঁদে উঠলো।
আয়না বলল
‘ ওমা আপনাকে কে বকছে আবার? চুল ধরলেন আর আমি চিল্লাইতে পারব না?
সায়ান আর ও জোরে চুল টেনে ধরে।

বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনে বাড়ির পেছনের দিকটাই দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির তর সইলো না। কিন্তু লজ্জা আর আড়ষ্টতায় আসা হলো না। কিন্তু রাতে যখন চুপিসারে বাড়িতে ঢুকলো। তখন দাদুর কোলে হাত পা নেড়ে খেলা করা হৃষ্টপুষ্ট শিশুটিকে দেখে মনপ্রাণ প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল। পা বাড়াতে গিয়ে পা জোড়া কাঁপলো ঠকঠক করে। হাত কাঁপলো ছোঁয়ার আগে অথচ এর আগে আর ও একবার কোলে নেওয়া হয়েছিল। তখন তো আর জানতো না এই সন্তান তারই?
আয়শা বেগম বলল
‘ শক্ত করে ধর আব্বা। পড়ে যাবে।
আয়ান কোলে তুলে বলে
‘ এত নরম কেন আম্মা? আমরা ও কি এমন ছিলাম?
‘ নাহ এতবড় হয়ে দুনিয়াতে আসছ। যখন জন্ম নিলা তখন ইঁদুরের বাচ্চার মত ওই একটুখানি। কত আদরযত্ন ভালোবাসা দিয়ে এতবড় করছি।
আয়ান ছেলেকে নিয়ে বের হয়ে যায় ঘরে থেকে। ছোট্ট মুখটা ভরিয়ে দেয় অজস্র আদরে। স্নেহ,মমতার স্পর্শ পেয়ে ছেলে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। বুকের কাছে শার্ট খামচে ধরে ছোট্ট হাতটা দিয়ে। মাথার চুল টেনে ধরে মুখে দিতে চায় চুলগুলো। আয়ান হেসে ফেলে
‘ আম্মা কি খেতে দেয়নি? উপোস রেখেছে?
সায়ান ঠোঁট টানে।
আয়ান বলল
‘ আচ্ছা ঠিক আছে আর কখনো এমন বলব না। তোমার আম্মা খুব ভালো। খুব।
সায়ান ডাগর ডাগর চোখ দুটো মেলে তাকিয়ে থাকে।

___________

রাতের খাওয়া দাওয়া তখন শেষ। নামিরা নিজ হাতে সবাইকে বেড়ে খাওয়ালো। মুখে কথা নেই চুপচাপ। আজহার সাহেবের সাথে কথা বললো শুধু। আর কারো সাথে বললো না। আজহার সাহেব খেতে খেতে বললেন
‘ বউমার হাতের রান্না অনেকদিন তো খাই না। কাল তোমার হাতের রান্না খাব বউমা।
নামিরা বলল
‘ ঠিক আছে আব্বা। কাল আমি রান্না করব।
আয়শা বেগম ফিসফিস করে আয়নাকে বলেন
‘ শ্বশুরের লগে তো ভালোই কথা কয়। আমাদের লগে কয় না ক্যান?
আয়না ও ফিসফিস করে বলে
‘ আমরা তো ভাইয়ের পক্ষে তাই।

নামিরা খেল না। আয়না বলল
‘ তুমি ও বসো ভাবি।
নামিরা না করলো। সে খাবে না।
আয়না বলল
‘ আর তো কেউ নেই। তুমি একা একা কিভাবে খাবে? আরেকজন তো বাইরে খাবে। দাওয়াত পড়েছে।
নামিরা গ্লাসে পানি ঢালতে লাগলো।
আজহার সাহেব ও বললেন
‘ বউমা আমার পাশে এসে বসো। খেয়ে নাও। অনেকদিন হাসো না। এইবার একটু হেসো। মুখটা অমন দেখতে ভালা লাগেনা।
নামিরা গিয়ে বসলো শ্বশুরের পাশে। আজহার সাহেব নিজে বেড়ে দিলেন খাবার। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
‘ খাও। কিভাবে শুকিয়েছ দেখো।
এত স্নেহময়,আর আদুরে সম্বোধনে গাল ভিজে উঠলো নামিরার। সবাই দেখার আগেই নামিরা তা লুকোতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এই স্বর্গসুখ যেন আর কখনোই না হারায় তার জীবন থেকে। এই পরিবারটাকে সে ভালোবাসে। পরিবারের মানুষগুলোর সাথে তার এই অদৃশ্য বন্ধনটা খুব দৃঢ় মজবুত। ভালো থাকুক তার আপন মানুষগুলো। এরকম হাসিখুশি থাকুক সবসময়।

__________

রাত তখন দেড়টা। সামনের দরজায় ঠকঠক আওয়াজে ঘুম ছুটে গেল নামিরার। অবশ্য ঘুম তেমন নামেনি তার চোখে। তাই হয়ত অল্পতেই ছুটে গেছে। দরজা খুলে দিতে গেল সে। কে সেটা দেখার প্রয়োজনবোধ করলো না। দরজা খুলে দেওয়া মাত্র চলে এল ঘরে। সায়ানকে দোলনায় দুলাতে লাগলো হালকা হালকা।
দরজা পার হয়ে ঘরে তখুনি প্রবেশ করলো সুঠাম দেহের একটি অবয়ব। নামিরার কৌতূহল জাগলো না ফিরে দেখার। সে তো এড়িয়ে যেতে ব্যস্ত। দোলনা দুলিয়ে উঠে বসলো। সায়ানের ছোট ছোট কাপড়গুলো ব্যাগ থেকে বের করে গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। গোছাতেই পারলো না ঘরের লাইট নিভে গেল। বিরক্তিতে মেজাজ চরম খারাপ হলো নামিরার। সুইচের দিকে যাওয়া ও যাবেনা। মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করলো নামিরা। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছেনা। শুধু শোনা যাচ্ছে নিঃশ্বাসের শব্দ। মুখ খুলতে চাইলো নামিরা, খুললো না তবে। ধপাধপ আন্দাজে হেঁটে গেল সুইচ টিপার জন্য। শক্তপোক্ত হাতের বাঁধনে তখুনি বন্দী হলো সে। পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কাঁধে নাকমুখ গুঁজলো কেউ। শক্ত হয়ে জমে গেল নামিরা৷ সেই পুরোনো ছোঁয়া৷ উদরের উপর টের পেল দুহাতের শক্ত বাঁধন। শীতল হয়ে পড়লো নামিরা। হাত দুটোকে ঝেড়ে ফেলতে চেয়ে পারলো না। কোনো শব্দ ছাড়াই কেটে গেল কয়েকটা মুহূর্ত।

সুযোগ বুঝে যখন নামিরা পালাতে চাইলো তখন আর ও ভালোভাবে বক্ষমাঝে পিষ্ট হয়ে গেল সে। সেই ঘ্রান আর সেই বুকের হৃৎস্পন্দন। সেই হাতের বাঁধন। নামিরার পালানোর কোনো পথই খোলা রইলো না। ফোঁসফোঁস করতে করতে একসময় ফোঁপানি উঠলো তার। তারপর সারাশরীর ঝাঁকিয়ে কাঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো সে। সেই কান্না যেন থামার নয়। তাকে কাঁদতে দিল আয়ান। বাঁধা দিল না। আজ শেষবার কেঁদে নিক৷ নামিরা কাঁদলো ইচ্ছেমত৷ নেতিয়ে পড়লো বুকে ক্লান্ত হয়ে। আয়ান জড়িয়ে নিল তাকে।
বহুসময় পার হওয়ার পর চোখের জল মুছে দিয়ে দীর্ঘ চুম্বন বসালো সে সঙ্গিনীর কপালে, সারা মুখে। ভেজা স্পর্শে রাঙিয়ে দিয়ে আবার ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ তুমি তো বাচ্চাই রয়ে গেলে মিরা। বড় হলে কই? তবে এই বাচ্চার মা বাচ্চাটাকে আমি ভীষণরকম ভালোবাসি। আমার উপর থেকে সমস্ত অভিযোগ তুলে নাও মিরা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here