আয়নামতী #পর্ব_২৭,২৮

0
828

#আয়নামতী
#পর্ব_২৭,২৮
#পুষ্পিতা_প্রিমা
পর্ব_২৭

বাড়িতে পা রাখতেই আয়নাকে মুখোমুখি পড়তে হলো অনিমার। ক্রোধান্বিত চেহারা তার। আয়নাকে বলল
‘ ভাই রেগে গিয়েছে কেন? কি হয়েছে তোমাদের?
আয়না বলল
‘ সেটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার । আপনি আর কিছু জানতে না চাইলে খুশি হব।
অনিমা আর কিছু বলতে পারলো না। আসলে আয়না তাকে বলার সুযোগ না দিয়েই ঘরে চলে গেল। দেখলো গোছানো ব্যাগ থেকে এক এক করে কাপড়চোপড় বের করছে অনুরাগ। আয়না বলল
‘ আপনার না কক্সবাজার যাওয়ার কথা। আবার কাপড়চোপড় নামিয়ে রাখছেন কেন?
অনুরাগ উত্তর দিল না। চোয়াল শক্ত তার। আয়না বলল

‘ আপনি এত কম কথা বলা শুরু করেছেন কখন থেকে?

তীর্যক চোখে তাকালো অনুরাগ। হাতটা ও থেমে গেছে সাথে। রোষানলে দগ্ধ হয়ে বলল

‘ এমন না যে তুমি আমাকে চেনো না। আমার সম্বন্ধে কিছুই জানো না। তারপরও কার কাছ থেকে কি শুনে উল্টাপাল্টা মন্তব্য করে বসছো । আমি তোমাকে চিনি। যে কারো কথায় নাচার মেয়ে তুমি নও। তুমি এসব এই কারণেই করছো, কারণ তুমি সবসময় আমার দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছ। কোথায় আমার খুঁত সেটা খুঁজে বের করে খোঁচাচ্ছ আমাকে। তোমাকে অচেনা লাগছে আয়নামতী। তোমাকে মানাচ্ছ না এসব। আমার দোষত্রুটি ওই একটাই। কুহেলীকে বিয়ে করা, ওই একটাই দোষ আমার। নাহলে আমার প্রতি অভিযোগ আসার কোনো পথ আমি খোলা রাখিনি। অন্য কোনো অপবাদ তুমি আমাকে আন্দাজে দিতে পারো না।

‘ আপনাকে বিশ্বাস করিনা আমি। আপনার কোনো কথা আমার বিশ্বাস হয় না। আপনি একজন ঠক, মিথ্যেবাদী। বোকা বোকা চেহারার পেছনে চতুরচালাক, ধূর্ত একজন মানুষ। আপনাকে আমার সহ্য হয় না। আপনি আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে ঠকিয়েছেন আমাকে৷ মিথ্যে বলে বাড়ি থেকে বের করে, জোর করে বিয়ে করেছেন৷ আপনার কি মনে হচ্ছে আমি মেনে নিচ্ছি আপনাকে? অন্যায় করে আপনি পার পাবেন? আমি ঘেন্না করি আপনাকে, আপনার পরিবারকে। আপনার পরিবার আজ ভালো সাজছে, দুই বছর আগের সেই দিনটা আমার এখনো মনে আছে। টাকা ছাড়া তারা বিয়ে না পড়ানোর আদেশ দিয়েছিল কাজীকে। আমার আব্বা দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল শুধু আপনাদের জন্য। আমার পরিবারে অশান্তি, দুর্দশা নেমেছিল শুধু আপনাদের জন্য। আমার পরিবারকে লোকমুখে খোঁটা শুনতে হয়েছে শুধুই আপনাদের জন্য। কিচ্ছু ভুলিনি আমি।

‘ মনে রেখেছ কেন? শাস্তি দেবে?

‘ শাস্তি? আমার জানা নেই কোন শাস্তিটা ঠিক আপনাদের জন্য প্রযোজ্য। নাহলে আজই দিয়ে দিতাম। এক্ষুণি।

‘ চাবিটা দাও।

আয়না চমকালো। বলল

‘ কিসের চাবি?

‘ কুটিবাড়ির আর বাগানের।

‘ কি করবেন? ওনারা মাত্র কয়েকদিন থাকবেন।

অনুরাগ চাপাস্বরে বলল

‘ চাবিটা দাও। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করব শালাদের। নাটক ফাটক জাহান্নামে গিয়ে করুক। আমার কি? চাবি দাও।

আয়না সরে গেল। বলল

‘ চাবি নেই। আপনি আমার সামনে থেকে যান তো।

অনুরাগ গর্জন করলো। বলল

‘ চাবি দাও বলছি। কোথায় চাবি?

আয়না ভড়কে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল

‘ দেব না বলেছি আমি।

অনুরাগ তেড়ে গেল। শাড়ির আঁচল টেনে ধরলো। আয়না ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল

‘ কি করছেন?

অনুরাগ চাবি খুলে নিয়ে আঁচলটা ছুঁড়ে মারলো। বলল

‘ গলা ধাক্কা দিয়ে বের করব। না গেলে উত্তমমধ্যম দিয়ে বের করে দেব।

আয়না ছুটলো অনুরাগের পিছু পিছু। বেশিদূর যেতে পারলো না। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল অনুরাগ। চলে গেল বাগান বাড়িতে।

কুহেলী এখনো সেখান থেকে যায়নি। ফুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে বিছিয়ে ফেলেছে। দারোয়ান চেঁচামেচি করলে ও শুনছে না। ডিরেক্টর আজমল খয়রাত এসে মাথা চাপড়ে বলল
‘ এসব কি করেছ কুহেলী? বাগানের মালিকীন দেখলে কি বলবেন? কি করেছ তুমি?
হনহন পায়ে হেঁটে এল অনুরাগ ঠিক তখুনি। আজমল খয়রাত বলল
‘ আরেহ মিঃ চৌধুরী যে, কি সৌভাগ্য আমাদের!
বাকিটুকু বলতে না দিয়ে অনুরাগ বলল

‘ দুর্ভাগ্য তখুনি হবে, যখন আপনারা এই বাগানবাড়ি না ছাড়বেন। তাড়াতাড়ি দলবল নিয়ে এখান থেকে আউট হন। নোংরা মানুষ নিয়ে আমাদের এই বাগান বাড়িতে আসবেন না। এটা ফুলবাগান। ফুল মানেই পবিত্র। আর পবিত্র জায়গায় অপবিত্র মানুষের আনাগোনায় দেখছেন কি অবস্থা চারপাশে? এভাবে ফুল ছিঁড়েছে কে?

আজমল খয়রাত তাড়াতাড়ি স্থান ত্যাগ করলো। আয়নামতী ম্যাডামের কাছে ফোন পাঠাতে হবে। কেন বাগান বাড়ি ছাড়তে হবে? এমনটা কথা ছিল না।

আজমল খয়রাত সরতেই অনুরাগ দারোয়ানকে বলল

‘ সবাইকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করো মামা। তুমি নোংরা মানুষজনকে এখানে ঢুকতে দাও কেন? কেন দিয়েছ?

দারোয়ান ভয়ে ভয়ে বলল

‘ ম্যাডাম?

‘ কে ম্যাডাম?

কুহেলী বলল

‘ বাহ আমি তো রীতিমতো অবাক হচ্ছি, ইনি আসলেই অনুরাগ চৌধুরী তো? গলার আওয়াজ এত বড়? কখন হলো এত উন্নতি?

অনুরাগ রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো। বলল

‘ চুপ। হীন, নিচ জঘন্য মেয়েমানুষ লজ্জা করেনা? আমার অতীত নষ্ট করেছ তুমি। যার ফল আমি এখনো ভুগছি। এখনো অন্ধকার কাটছে না। আর এখন আমার বর্তমান নষ্ট করতে এসেছ? চরিত্রহীনা!

কুহেলীর চোখে আগুন। থরথর করে কেঁপে উঠলো তার পা জোড়া। আঙুল তুললো বেশ নিয়ম করে। অনুরাগের দিকে বাড়িয়ে বলল

‘ খবরদার। আমি সেই কুহেলী আর নেই, যে আপনার ধমকে কেঁদে দেবে। আজকের এই অপমানের জন্য পোহাতে হবে আপনাকে। দেখে নেব আমি।

অনুরাগ বলল

‘ দূর হও। যাও। আরেকবার আমার চোখের সামনে পড়লে খবর ছাড়া গুম করে দেব। বেয়াদব মেয়েমানুষ। নষ্টা। লোভী। ঠক।

কুহেলী একমুহূর্ত ও দাঁড়ালো না। কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লো অন্য খবর।

নাটকদলের সবাইকে নিয়ে রাতারাতি গ্রাম ছাড়তে হলো আজমল খয়রাতকে। অনুরাগ লোক লাগিয়ে দিয়েছে। বলেছে আজ রাতেই গ্রাম ছাড়তে নইলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। এত বড় ঘটনা ঘটায় কুহেলী এমনিতেও থাকতো না। কুহেলী না থাকলে শুট হবে কি করে? তাই সবাই চলে গেল। আয়নাকে তীব্র তিরস্কার করলো আজমল খয়রাত। তার মতে আয়না কথা দিয়ে কথা রাখেনি। এবং স্বামীর অমত থাকা স্বত্বে ও কেন বাগানবাড়ি ভাড়া দিল? সেসব শুনে আয়নার মেজাজ খারাপ হলো।

রাত করে ফিরলো অনুরাগ। সব চুকিয়ে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছে। ভেবেছে আয়না হয়ত ঘুম। সে আরামে ঘুমটা দিতে পারবে। কিন্তু না। সে ঘরে পা রাখতেই নাগিনী রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে এগিয়ে এল। যেন এক ছোবলে শেষ করে দেবে অনুরাগকে। রাগের চোটে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমে গেল নাক আর কপালে। রেগেমেগে বলল,

‘ আমি থাকব না আপনার সাথে। মরে যাব তবু ও এমন মানুষের সাথে থাকব না। কোনো মানুষ আমাকে কখনো এত কথা শোনায়নি৷ আপনার জন্য শোনালো।

অনুরাগের ঠোঁটের কোণায় দুষ্টু হাসি। এক হাত বাড়িয়ে কোমর টেনে নিজের কাছে আনলো আয়নাকে। দূরত্ব কমিয়ে ফেলতেই আয়না হাত দুটোর ভর প্রয়োগ করলো তার বুকে। কিন্তু বলিষ্ঠ হাতের কাছে তার শক্তি নিতান্তই তুচ্ছ। চিৎকার করতে গিয়ে ও চেঁচালো না আয়না। অনুরাগ আঙুল দিয়ে ছুঁলো তার নাক। বলল
‘ নাকটা কি দিয়ে বানাইলো আল্লাহ। বাপরে বাপ আমার বাপের জন্মে এত রাগ দেখিনি আমি। নাকের ডগায় এত রাগ কেমনে থাকে ভাই?
আয়না দাঁতে দাঁত চেপে বলল
‘ মেরে ফেলব একদম। ছাড়ুন।
অনুরাগ ছাড়বে কেন? কত মেহনত গেল এই হাতের বাঁধনে বন্দী করার পেছনে। ছাড়লো না। ধস্তাধস্তির চোটে মুখের সামনে চলে আসা এলোমেলো চুলগুলো গুঁজে দিতে দিতে বলল

‘ এই যে এত লড়াই করে এলাম, এত রাগ দেখিয়ে গেলাম সবকিছু কারণ কিন্তু তুমি আয়নামতী। আমাকে যদি একটু বুঝার চেষ্টা করতে তাহলে আমার লড়াইটা স্বার্থক হতো। কিন্তু তুমি তো আমাকে না বুঝার লড়াইয়ে নেমেছ৷ কি আর করার!

কথা বলা শেষে হুট করে ছেড়ে দিল অনুরাগ। আয়না একটু তড়াক খেয়ে গেল। বলল

‘ ছাড়লেন কেন? আশ্চর্য!

অনুরাগ চোখ কপালে তুলে বলল

‘ ধরে রাখতে বলছো?

আয়না থতমত খেয়ে বলল

‘ ওভাবে ছাড়লেন কেন বলেছি? আমি পড়ে যেতে পারতাম।

‘ আমি পড়তেই দিতাম না।

__________

সকাল সকাল আয়নার অপ্রত্যাশিত বায়নায় রাগ উঠলো অনুরাগের। বাড়ি যাবে মানে কি? কালকের জন্য কি কোনোভাবে রাগ দেখাচ্ছে? যা ভাবলো তাই। আয়না ফটাফট বলল
‘ আমি বাড়ি যাব। খবরদার আমাকে আনতে যাবেন না।
অনুরাগ কোনোকিছু বলতেই পারলো না। রহমত মিয়াকে দেখা গেল নিচে রিকশা দাঁড় করিয়েছে। অনুরাগ বলল
‘ আমি দুঃখিত কালকের জন্য। এভাবে যেওনা। আমি দিয়ে আসব তোমায়।
আয়না বলল
‘ থাকব না আমি। আপনি আমাকে ছুঁয়েছেন কালকে। দেখা৷ যাবে রোজ রোজ একটু একটু করে ছুঁবেন। আমি সহ্য করব না ওসব বেয়াদবি। আমি থাকব না আপনার সাথে।

অনুরাগ জিহ্বায় কামড় দিল। বলল
‘ তুমি এজন্যই বাচ্চা। ঠিক আছে আমি আর ছুঁবো না ভুলেও। আমি দিয়ে আসব তোমায়।

আয়নার রাগ কমলো। গেল না। অনুরাগ সন্ধ্যায় তাকে নিয়ে গেল। আয়শা বেগম আর আজহার সাহেব মেয়েকে দেখে কেঁদেই ফেললেন। নামিরা আর আয়ান খুশি হলো। আর ছোট্ট দুটো মানুষ।

আয়শা বেগম এই প্রথম অনুরাগের সাথে কথা বলল দূরে দাঁড়িয়ে আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে।

‘ শোনো চৌধুরীর ছেলে আজকে আমাদের গরিবের বাড়িতে থাকো একদিন। বিয়ের পর একদিন শ্বশুরবাড়ি থাকা লাগে।

অনুরাগ বলল

‘ অন্য একদিন। আপনাদের মেয়ে যেদিন বলবে সেদিন। আজ আসি।

আয়না মুখ ফিরিয়ে নিল৷ সে কখনোই বলবে না। সবাই চলে যেতেই অনুরাগ আয়নার কাছে এল। ফিসফিসিয়ে বলল

‘ রাগ কমলে ফিরে এসো।

‘ আমার রাগ কমবে না।

‘ রাগ না কমলেও ফিরে এসো। আমি কমিয়ে দেব।

‘ আসব না।

‘ আমি আসব, নিয়ে যেতে।

‘ আপনি আমার পিছু ছাড়েন এবার। নিজের কাজে মন দেন।

‘ ছাড়ছি না। ছাড়ব না। ভুলে ও ভেবো না তুমি আমার কাছ থেকে ছাড়া পাবে। যাওয়ার আগে একটা কথা বলি?

‘ আবার কি?

‘ পারলে আমার উপর থেকে সব অভিযোগ গুলো তুলে নিও। মনে পড়লে খোঁজ নিও আর একটু দরকার পড়লেই ডেকে নিও। কথা বলতে ইচ্ছে হলে চিঠি লিখো।

চলবে,

#আয়নামতী
#পর্ব_২৮
#পুষ্পিতা_প্রিমা

বাড়ি আসার তিনদিনের মধ্যে প্রচন্ড জ্বরে পড়লো আয়না। আয়ান শহরের চাকরিতে। বৃহস্পতিবার আসে। শনিবার চলে যায়। বোনের এমন জ্বর শুনে সে বিচলিত হলো খুব। রহমত মিয়াকে মুঠোফোনের সাহায্যে বলল যাতে ডাক্তার ডেকে আনে। গ্রামের মোড়ে রাস্তার পাশে বসা ডাক্তার ডেকে আনলো রহমত। ঔষধ দিয়ে গেল ডাক্তার। ঘনঘন জলপট্টি ও দিতে বলেছে।
জরুরী কাজে অনুরাগকে ঢাকায় যেতে হয়েছে। আয়না যেহেতু বাপের বাড়ি সেহেতু চিন্তার কোনো কারণ নেই তার। আয়না সবাইকে বলেছে যাতে তার অসুস্থতার খবর কোথাও যেন না যায়। অনুরাগ এখানে আসলে খবর আছে সবার।
আয়শা বেগম তা শুনিয়ে ঝাঁজালো গলায় বলল
‘ কাউরে বলুম না। কাউরে বলতে হইবো ক্যান? এত বছর জ্বর হইলে কি তোর জামাই জ্বর কমাইতে আসতো ? ঢং। আর কত দেখুম কে জানে? এই হারামজাদি ওইখানে গিয়া তোর এত ঠান্ডা লাগছে কেমনে?

আজহার সাহেব বলল

‘ আহা মেয়েটা অসুস্থ। তুমি কি শুরু করেছ।

‘ চুপ করেন। আপনারে সাফাই গাইতে কে কইছে? মাইয়্যা তার একার, আমি কিছু কইতে পারুম না।

আয়না নিভু নিভু চোখে মাকে দেখে হাসে। কম্পিত গলায় বলে

‘ আম্মা তোমার বকাগুলো মিস করছিলাম এতদিন। সত্যি।

‘ হ লাতি না খাইলে তো তুমি অসুস্থ হবাই। এদিকে আহো আর ও দুটো দেই। যত্তসব।

সায়ান সবার কথার মাঝে খি খি করে হাসতে শুরু করলো। আয়শা বেগম বলল

‘ ভাই তুমি আবার আমার মাথা গরম কইরোনা। দাদীর মতো ভদদরো হও। এত খি খি কইরা হাসা পোলাপানদের মানায় না।

নামিরা গাল ফুলিয়ে বলল

‘ আমার বাবু এখনো কি বুঝে আম্মা?

সায়ান আবার হাসলো। নামিরা তার গালে হাত রেখে টুপ করে চুমু বসিয়ে বলল

‘ আর না আব্বা, দাদু মারবে।

সায়ান ঠোঁট টানলো। নামিরা বলল

‘ আচ্ছা আচ্ছা হাসেন। দাদুকে আমরা মারব।

সায়ান আবার হাসলো। তার কান্ড দেখে আয়না হেসে উঠলো। আয়শা বেগম বলল

‘ ধুরর এই পোলা ও ঢং শিইখ্যা গেছে। আমার বইন আসুক, ওরে আমি আমার মতোন বানামু।

নামিরা হেসে বলল

‘ হ্যা হ্যা। আয়না আম্মার জন্য তাড়াতাড়ি একটা বোন এনে দিও তো।

আয়না মাথা চেপে ধরে বলল

‘ আল্লাহ গো মাথা ব্যাথায় মরে যাব আমি। সবাই চলে যাও এখান থেকে। আমি ঘুমাবো। ভাবি বাবুকে দিয়ে চলে যাও।

আয়শা বেগম বলল

‘ আমি গরম চা বসায়। আর মরিস না। শান্তি নাই আমার। কোথাও শান্তি নাই। বিয়া দিছি তা ও শান্তি নাই। কোথায় এহন জামাই আর শ্বাশুড়িরে জ্বালাইবো তা না আমারে জ্বালাইতে চইলা আসছে হারামজাদি। আমার বাবুটারে ও কাজের জায়গায় চিন্তায় ফালাই দিছে। আসুক তার জামাই। আসুক, বলুম তোমার বউরে কি বরফের ভেতর চুবায় রাখো? এত ঠান্ডা লাগছে ক্যান? আসুক শালার ছেলে।

আজহার সাহেব যেতে যেতে বললেন

‘ আহা কি শুরু করলে আয়েশা? তোমার চিল্লাচিল্লি শুনলে তো মেয়েটার জ্বর আর ও বাড়বে।

আয়শা বেগম নাকটেনে বললেন

‘ হ আমি তো তার সতীন। আমি তো তারে মাইরা ফেলতে চাই।

আজহার সাহেব মাথা চাপড়ালেন। এই মহিলা এত বেশি বুঝে কেন? মেয়েটা ও তো তার মতোই হয়েছে।

_______________

মুঠোফোনে অনুরাগের ফোন আসতেই নামিরা ফোনটা আয়নাকে দিল। বলল
‘ তোমার বর।
আয়না বলল
‘ রেখে দাও। কথা বলার শক্তি নাই।
নামিরা বলল
‘ কি বলে দেখো, তারপর রেখে দিও।
আয়না বলল
‘ নাহ, আমি কথা বলতে পারব না। ওনাকে বলুন ফোন রাখতে।
অনুরাগ ফোনের অপরপাশে সব শুনে ফোন রেখে দিল।
নামিরা বলল
‘ কি বলতে চাইছিলেন শুনলে কি হতো?
আয়না বলল
‘ কোনো দরকার নেই।

_____________

অনুরাগ ঢাকা থেকে ফিরলো সপ্তাহ খানেক পর। শায়লা বেগম তাকে ডেকে বললেন
‘ দাদুভাই নাতবউকে নিয়ে এসো। অনেকদিন থেকেছে বাপের বাড়ি। অতদিন থাকতে নেই।
অনুরাগ বলল
‘ ঝাড়ি খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
সশব্দে হেসে উঠলো সবাই।

অনুরাগ আসায় আয়শা বেগম রান্নাঘরে বিশাল আয়োজন করেছেন। যতই হোক মেয়ে জামাই বলে কথা। দুপুরে খেয়ে বিকেলের দিকে চলে যাবে আয়না। খাওয়া দাওয়া শেষ হলো৷ অনুরাগের সামনে আয়না একবারের জন্য ও এল না। সায়ান আর রূপার সাথে গল্পগুজব করতে করতে সময়গুলো পার হলো।

পড়ন্ত দুপুরের খটখটে রোদ। জানালা পেরিয়ে রোদের কয়েকটা সরু ফালির মতো টুকরো এসে পড়েছে আয়নার ঘরে। জানালা বরাবর এসে দাঁড়িয়েছে অনুরাগ। দেখলো আয়না ব্যাগে কাপড় গোছাচ্ছে।
জ্বর শেষে মুখে তেঁতো ধরেছিল, তাই খেতে পারেনি । স্বাস্থ্য একটু শুকিয়েছে। মুখ সরু হয়েছে। ঘুম কম হওয়ায় চোখের নিচে দাগ পড়েছে।
অনুরাগ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল
‘ এই হাল কেন? কি হয়েছিল তোমার?
আয়না তখন ব্যাগে চুপচাপ কাপড় ভরছিল। চোখে টলমলে পানি। এই বাড়িতে আসলে তার যেতে ইচ্ছে করে না। এই লোকের সাথে তো একদমই না।
অনুরাগ বলল
‘ তুমি এভাবে শুকালে কেন? রোগা দেখাচ্ছে তোমায়।
আয়নার উত্তর এল না। অনুরাগ উত্তর না পেয়ে বলল,
‘ আচ্ছা থাক। সমস্যা নেই। খাইয়ে দাইয়ে তরতাজা করে ফেলব।
আয়না কব্জি দিয়ে চোখ ঢলে বলল
‘ আপনারই তো খাবার। তরতাজা করা দরকার।
দপদপ করে কানের ভেতর জ্বলে উঠলো অনুরাগের। আর মস্তিষ্ক যেন এক কথায় ফাঁকা হয়ে গেল মুহুর্তেই । আয়নার দিকে বিস্মিত চোখে তাকালো সে। চোখে অপার বিস্ময় যেন টিকরে পড়ছে। গলার কাছে কথা আটকে গেছে আর বেরোনোর জোঁ নেই।
কোনো উত্তর না পেয়ে আঁড়চোখে তাকালো আয়না। বিস্ময়ের বদলে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে অনুরাগের চোখে। আয়না চোখ সরিয়ে নিল, অনুরাগ সরালো না।

আয়না বলল
‘ ওভাবে কি দেখছেন? মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে গিলে খাবেন। অনেকদিন তো কাছে পান নি।

‘ কাছে তো অনেকসময় পেয়েছি। তোমার সাথে জোর করেছি কখন? তুমি কি আমায় দুর্বল করতে চাইছ এসব বলে বলে? নাকি রাগাতে চাইছো? ভাবছ রেগে আমি তোমাকে মুক্ত করে দেব? যদি এমনটা ভেবে থাকো তাহলে ভুল ভাবছ। তোমার মুক্তি আমার কাছে, তোমাকে ছাড়ছিনা আমি।

‘ আপনার সাথে থাকার চাইতে মৃত্যুই শ্রেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য অত সুখ আমার কপাল নেই।

চুপচাপ বসে রইলো অনুরাগ। ভালো করেই বুঝতে পারলো এই লৌহ মানবী বড়ই পাষাণ।

_______________

আয়নাকে ফিরতে দেখে খুশি হলো আনহিতা আর শায়লা বেগম। রূপাকে আনতে দেয়নি আয়শা বেগম। সায়ানকে রূপা সামলায় যখন বউ শ্বাশুড়ি কাজে ব্যস্ত থাকে। তাছাড়া মেয়েটা না থাকলে আয়নার অভাবটা আর ও বেশি পুড়ায় আয়শা বেগমকে। তাই তিনি রূপাকে যেতে দেয়নি আয়নার সাথে। আয়নার মন খারাপ হয়েছে তিনি তা খেয়াল ও করেছেন। কিন্তু কি আর করার?

চৌধুরী বাড়ি ফিরেই ঘর থেকে বের হলো না আয়না। এক ঘুমে মাঝরাত। যখন ঘুম ভাঙলো দেখলো অনুরাগ তখন বেঘোর ঘুম। খিদে পেয়েছে ভীষণ। রিডিং টেবিলের উপর প্লেট দেখতে পেল আয়না। প্লেট তুলতেই দেখলো খাবার রাখা আছে। অনুরাগের কাজ বুঝতে পারলো। খেয়ে নিল চুপচাপ। খেয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলো রুমের ভেতর।পরক্ষণে জানালা খুলে দাঁড়িয়ে থাকলো বেশ কতক্ষণ। পরে জানালা বন্ধ করে শোয়ার জন্য এগোতেই থামলো সে। ঘুমন্ত একটা মুখ দেখে মনেই হলো না এই লোকটা এতটা জঘন্য। এতটা খারাপ।
মনে হচ্ছে যেন এক নিষ্পাপ শিশু ঘুমোচ্ছে। চোখের কোণায় জল চিকচিক করলো আয়নার।
স্বপ্নের সেই আশ্চর্যজনক দেশটাতে যখন সে পা রাখতো তখন দেখতে পেত ফুলে ফুলে ভরা একটা বাগান। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই ফুল। আর বাগানের মাঝখান থেকে তার দিকে এগিয়ে আসা একটি পুরুষ অবয়ব। একমুঠো সুগন্ধি ফুল এসে ঠেকত তার কানের পাশে৷ আর এক আশ্চর্য ভয়ংকর স্পর্শ। যা তাকে কাঁপিয়ে তুলতো, পাগলপারা করতো।
এইরকম, ঠিক এইরকম একটি স্বপ্ন সে বারবার দেখতো। মনের ভুল আর অবিশ্বাস করে তেমন ভেবে দেখেনি কখনো। যদি সত্যি ও হয় এই মানুষটা কখনোই সেই অবয়বটি নয়। হতেই পারে না।
লাইট জ্বলে থাকায় অনুরাগের ঘুম ছুটলো ধীরেধীরে। হাতটা আন্দাজে পেছনে দিতেই দেখলো শাড়ির আঁচল নেই। ঘুম পুরোপুরি ছুটে গেল তার। পাশ ফিরে দেখলো নেই আয়নামতী। তবে সামনের দিকে ফিরে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা লৌহমানবীকে দেখে ভয় দূর হওয়ার চাইতে আর ও বেড়ে গেল। উঠে দাঁড়ালো অনুরাগ। চোখ ঢলে বলল

‘ খেয়েছ? শরীর কি খারাপ লাগছে? এই তুমি কি কাঁদছ আয়নামতী?

‘ নাহ।

শক্ত কথায় আর এগোতে পারলো না অনুরাগ। বলল

‘ ওহহ। পানি খাবে?

‘ নাহ।

‘ তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো। অনেক রাত।

‘ আমাকে চিরতরে আমার বাড়িতে দিয়ে আসুন। আপনাকে আর খারাপ কথা শুনতে হবে না। কষ্ট ও পেতে হবে না।

অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত কথাটি।
অনুরাগ ঘাড় ফিরালো। বলল

‘ নাহ।

‘ তাহলে রোজ এভাবে খারাপ কথা শোনেন। মরেন। আমি আপনাকে কখনো ভালো থাকতে দেব না।

‘ খারাপ কথা বলো সমস্যা নেই। আমার খারাপ লাগে না। গালি দাও, যা ইচ্ছে বলো। সমস্যা নেই আমার। আমি কখনো রাগ দেখিয়েছি? ধমক দিয়েছি? সব তো মেনে নিচ্ছি।

আয়নার ঠোঁট জোড়া উল্টে এল। অনুরাগ অবাক হয়ে বলল

‘ আমি তোমাকে বকিনি কিন্তু।

আয়না চেপে রাখলো তার চোখদুটো। পরপর কয়েকবার হেঁচকি তুললো। অনুরাগ এগোতে গিয়ে আবার আটকে গেল। দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। বলল

‘ আয়নামতী তুমি কিন্তু বাচ্চার মতো করছো।

‘ আপনি আমাকে দিয়ে আসবেন আমার বাড়ি? বলুন? আর কখনো ফিরিয়ে আনতে যাবেন না। চিরতরে দিয়ে আসবেন। বলুন। আরেহ চুপ করে আছেন কেন? আপনি কি মরতে চান আমার হাতে?

অনুরাগ এগিয়ে এল। বলল

‘ দেখো অনেক রাত হয়েছে।

আয়না হাতটা ছুড়লো। অনুরাগকে ঠেলে দিতে চাইলো। অনুরাগ তার হাত দুটো ধরলো শক্ত করে। বাহুডোরে তাকে আবদ্ধ করতেই আয়না ধস্তাধস্তি লাগালো। বলল

‘ খারাপ লোক। আমি আপনার জায়গায় হলে ঘাড় ধরে বের করে দিতাম। বোকা, মূর্খ। আমায় ছাড়েন।

অনুরাগ ছাড়লো না তাকে। শক্ত করে ধরে রেখে দীর্ঘ চুম্বন বসালো কপালের পাশে। আয়না নড়তে চড়তে না পেরে স্থির হয়ে গেল। অনুরাগ পরক্ষণেই দুহাতের আঁজলে মুখ আগলে ধরলো তার। বলল

‘ আমি দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছি তাই এটি আমার দ্বিতীয় বিয়ে, দ্বিতীয় বার তোমাকে বিয়ে করেছি তাই তুমি আমার দ্বিতীয় স্ত্রী। কিন্তু আমি যদি প্রথমবার কারো প্রতি মুগ্ধ হই সেটা তুমি ছিলে আয়নামতী । ভালোলাগার কথা আসলে সেটা ও তুমি। আর যদি আসে ভালোবাসার প্রসঙ্গ তাহলে বলব আমি প্রথম তোমাকে ভালোবাসতে চাই। বিশ্বাস করো আমার জীবনে প্রথম স্ত্রী এসেছিল, বিয়ে ও এসেছিল কিন্তু ভালোবাসা আসেনি।
আমার জায়গায় নিজেকে ভেবে দেখো একটিবার। আমার মতো যদি তোমার সাথে হতো সেসব? কুহেলীর মতো প্রতারক তোমার জীবনে আসলে কি করতে তুমি? ভালো হলে সংসার করতে। মন দিতে। ভালোবাসার চেষ্টা করতে। আর প্রতারণা করলে ছেড়ে চলে আসতে, সে সময়ও যদি আমি তোমাকে চাইতাম সেদিন ও তুমি আমায় ফিরিয়ে দিতে। বলতে পুরুষমানুষকে বিশ্বাস করতে নেই। অথচ আমাকে দেখ, মেয়েমানুষ মানেই ঠক,প্রতারক বলতে বলতে সেই এক মেয়েমানুষের কাছে গিয়ে আমি ফেঁসে গেছি। আটকে গেছি। আমার সমস্ত মুগ্ধতা তার কাছে গিয়ে আটকে গেছে।
আমাকে ভালোবাসতো হবে না, মিষ্টি করে কথা ও বলতে হবে না। শুধু ঝগড়া করো,রাগারাগি করো, গালমন্দ করো, যা ইচ্ছে তাই বলো কিন্তু চিরতরে যাওয়ার নাম আর মুখে এনোনা।
আমি তোমার জীবনে অসহ্য নামক একটা অধ্যায় হয়ে থাকতে চাই। অপ্রিয় একজন হয়ে থাকি না? কখনো প্রয়োজন পড়লে, মনে ধরলে, ভালবাসলে ” অ ” টা বাদ দিও।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here