#আয়নামতী
#পর্ব_২৯,৩০
#পুষ্পিতা_প্রিমা
পর্ব_২৯
নর্তকীদের পায়ের নূপুরের আওয়াজ আর বাদ্যযন্ত্রের শব্দে রঙ্গমহল মুখোরিত। ওই দূরে মঞ্চে নাক অব্দি ঘোমটা টানা নর্তকী নাচছে।
তার চারপাশে তাকে অনুসরণ করে নাচ করছে আরও অনেক মেয়ে। সারি সারি গোল গোল টেবিলগুলোর চারপাশে বসা মদের বোতল হাতে কয়েকজন। বেশিরভাগই দূর দূরান্ত থেকে আসা এবং বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। দেশ মানুষের কাছে বিশিষ্ট আসনে থাকা বিশিষ্ট মানুষজন। কেউ গ্রাম্য থানার প্রধান পুলিশ অফিসার, মিডিয়ার থেকে আগত কয়েকজন কিংবা বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। বাইরে তাদের নীতিবান হিসেবেই মানুষ চেনে।
ঝুমঝুম নূপুর আর বাদ্যযন্ত্রের সাথে অদ্ভুত গানটা ও থেমে গেল। সাথে সাথে মদের বোতল থেকে মুখ সরিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে হুংকার ছাড়লো খালেক নামের লোকটি। ছুটে আসলো অনেকেই।
‘ কেন শব্দ বন্ধ হলো?
‘ তারা ক্লান্ত।
‘ টাকা বাড়িয়ে দেব। শুরু করতে বল তাড়াতাড়ি।
হ্যাংলা পাতলা ছেলেটি পা বাড়ানোর আগেই আবার মুখোরিত হয়ে উঠলো পরিবেশ। এবার আগের মেয়েটির বদলে অন্য একটি মেয়ে। তার সারা অঙ্গ নড়ানোচড়ানোর ভঙ্গিতে এবার বেশ মত্ত নারীসঙ্গ পাগল পুরুষদল। ঠোঁটের কোণায় চড়ে বসলো তৃপ্তির হাসি। শেষ হতে লাগলো মদের বোতল পরপর। খালেকুজ্জামান বেশ আয়েশ করে গা এলিয়ে বসলো। নৃত্যরত মেয়েটির দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল
‘ এইটা কে? আগে তো দেখিনি মনে হচ্ছে। কে এই রমণী?
মাতাল গলার আওয়াজে তার কথা শুনে কেউ একজন কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল
‘ নতুন। খয়রাত সাহেব এনেছেন। বেশ কাজে লাগবে।
উৎসুক চোখে সামনের দিকে তাকালো খালেকুজ্জামান। বলল
‘ আমার বেশ কাজে লাগবে বলে মনে হচ্ছে। সবার প্রস্তুতি নেওয়া শেষ হলো?
‘ না স্যার। সবাইতো মনে হচ্ছে কথা বলার অবস্থায় নেই। ঢলে পড়ছে।
‘ ঢলে পড়লেই কুপিয়ে গুম কর শালাদের। ঢলার জন্য ডাকিনি এখানে।
শব্দ আবার থেমে গেল। খালেকুজ্জামান সামনে তাকালো বিরক্তি চোখে। ঝাপসা ঝাপসা চোখে তাকালো তার দিকেই এগিয়ে আসছে একটি নর্তকী। মদের বোতলে আরেক চুমু বসালো সে। বলল
‘ স্বাগতম। কি নাম?
বেশ রসালো কন্ঠে ভেসে আসলো।
‘ সরকার। কুহেলী সরকার।
চোখ বন্ধ করে নিল খালেকুজ্জামান। চারপাশে কেন এত মিষ্টি ঘ্রাণ?
‘ আমাকে কেন ডেকে আনা হয়েছে। লাখ চাই আমার। নাহলে,,,,,,
‘ লাশ হয়ে যাবে নয়তো, লাখপতি হয়ে ।
গাল এলিয়ে হাসলো কুহেলী । হাতে হাত রেখে দু পা হেঁটে বলল
‘ কুহেলী সরকার এত কাঁচা কাজ করেনা এমপি সাহেব। আমার নিজের ঘরেই চিঠি লিখে এসেছি আমি এমপি সাহেবের গোপন আস্তানার যাচ্ছি। আমার কিছু হলে আপনি বাঁচতে পারবেন তো?
বেশ চালাক এই মেয়ে বুঝে ফেলেছে খালেকুজ্জামান। এই মেয়েই তাহলে চৌধুরীর প্রাক্তন স্ত্রী? শত্রু? কাজে লাগাতে হবে। ব্যবহার শেষ হলেই ভোগ, তারপরই লাশ। মনে মনে ভীষণরকম ভাবে আনন্দিত হলো খালেকুজ্জামান। পরপর তিনজন মেয়ে গুপ্তচরের এই হালই হয়েছে। বেচারিরা কত রূপবতীই না ছিল? গড়গড়িয়ে বমি করলো খালেকুজ্জামান। টক পানি দেওয়া হলো তাকে। কয়েক ঘন্টা চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিল। তারপর যখন মজলিসে চলে এল দেখলো সবাই তার অপেক্ষায় ছিল। আশেপাশে চোখ বুলালো খালেক। ভুড়িওয়ালা একজনকে ডেকে বলল
‘ কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুর হদিস পেয়েছিস?
‘ ওই চৌধুরী শালা বোকা স্যার। সে মানবসেবা করতে জানে শুধু, অতটা চালাক নয় যে গুপ্তচর রাখবে। এখানে সবাই আমাদের নিজের লোক। আপনি চিন্তামুক্ত থাকুন।
খালেকুজ্জামান সামনেই তাকালেন ধারালো দৃষ্টিতে। শুরুতেই ডাকলেন কানুয়া গ্রামের পুলিশ অফিসারকে। কালো একটি ব্যাগ দেখিয়ে বললেন
‘ এটাতে অর্ধেক। যদি শুনেছি ঠিকঠাক কাজ করতে পারছিস না তাহলে তোকে সাইজ করতে দুবার ভাববো না।
পুলিশ অফিসার বলল
‘ না না কোনো সমস্যা হবে না। আমার সব মনে থাকবে।
‘ ঠিক আছে। এই ডিরেক্টর?
আজমল খয়রাত উঠে এল।
‘ ওই মেয়েটা কোথায়?
‘ ও বিশ্রাম নিচ্ছে। ওর কাজ আমাকে বুঝিয়ে দিতে বলেছে৷
‘ বেশ দাম দেখাচ্ছে ওই মেয়ে। বের করে দেব দাম। ওই বোকাগাঁদার বউ ছিল আগে, এবার বুঝতে পারছি কেন ঠেকেনি। সে যাইহোক আসল কাজটা ওই মেয়েকেই করতে হবে।
‘ আপনি যেভাবে বলেন। তবে ও মনে হয় না গ্রামে আর যাবে। একবার অপমানিত হয়ে এসেছে।
‘ দেখাই যাক৷
_____________
ভারী আয়রনটা রাখা টেবিলের উপর। আয়না বারবার হাত দিচ্ছে সরিয়ে নিচ্ছে। আয়রনটা কি গরম হলো?
অনুরাগ ঘরে ঢুকতেই দেখলো আয়না ইস্ত্রি নিয়ে টানাটানি করছে। দুহাত দিয়ে তুললো আয়রনটা। অনুরাগের হাসি পেল খুব। বলল
‘ মুরগির মতো খাও, গরুম মতো হাল চাষ করতে নামো কেন?
আয়না চট করে ফিরলো। হাত শাড়িতে মুছে চলে গেল বেডের কাছে। বালিশগুলো ঠিকঠাক বসাতে বসাতে বলল
‘ এমনি দেখছিলাম। কে আপনার পাঞ্জাবি ইস্ত্রি করাতে যাচ্ছে? আপনার কাজ আমি কেন করব?
‘ করতেই বা কে বলেছে? তুমি আমার কোন কাজটা করে দিয়ে উদ্ধার করে দাও জানি আমি।
আয়না গরম চোখে তাকালো। বলল
‘ এখন ঝগড়া কে করছে? আপনি না আমি? দোষ তো সবসময় আমারই হয়। আর আপনার কাজ আমি করিনি? এই যে খান, বেশিরভাগ সময় তো আমিই রান্না করি।
‘ ওগুলো শখের বশে করো। আমি বলিনি কাজ করতে। আমার বাড়ির মানুষের সাথে ভালো করে কথাই বলো না, রান্না করে খাইয়ে কি হবে? তাদের আপন ভাবো আগে, অতটা ও খারাপ না তারা , আর রান্না না করলে ও চলবে।
আয়না কথা বললো না।
‘ এখন চুপ কেন? মেনে নিচ্ছ আমার কথা?
‘ বলব না। আপন ভাববো না। পর কখনো আপন হয় না। আপনি যেমন কখনো আমার আপন হবেন না তেমনি তারাও। আপন ভাবতে পারব না আমি।
অনুরাগ পাঞ্জাবিটা রেখে দিল। বলল
‘ পর আপন হয় না? আমি কিভাবে আপন করে নিলাম তাহলে?
আয়না পরাজিত দৃষ্টিতে তাকালো অনুরাগের দিকে। বালিশটা ধপ করে রেখে দিয়ে বের হয়ে গেল রুম থেকে।
অনুরাগ বিড়বিড় করলো
‘ সঠিক কথা বললেই রাগ। ওরেহ আমার রাগিনী!
______________
নিস্তব্ধ, নির্জন চারপাশে । মধ্যরাত। অনুরাগ বাড়ি ফেরেনি এখন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির মাত্রা তেমন ভারী নয়। গুঁড়িগুঁড়ি। তারপর ও চিন্তা হচ্ছে আনহিতার। ফোন ও তুলছেনা ছেলেটা। অনিমা ও ঘুমোয়নি। অনুরাগ এত রাত করে বাড়ি ফেরেনা কখনো। বারান্দায় পায়চারি করতে করতে মাকে বলল
‘ ওই মেয়ে দেখেছ মা ? নিজের স্বামী এখনো বাড়ি ফেরেনি অথচ সে দিব্যি ঘুমোচ্ছে। বাহ। আর এই মেয়ের জন্যই আমার ভাই এত দিওয়ানা।
আনহিতা কিছু বলল না। তার ভীষণ চিন্তা। ছাতা হাতে শায়খ চৌধুরী বাড়িতে ঢুকে পড়লেন। আনহিতা বলল
‘ খোঁজ পেয়েছেন?
‘ হ্যা। ওই মতিউর রহমানের বাড়িতে গিয়েছে। করিম দোকানদারের ছেলে ও নাকি তার সাথে গিয়েছে। ফিরবে চিন্তা করোনা।
আনহিতা বলল
‘ আমার চিন্তা হয় সেটা একবার ভাববে না? আশ্চর্য ছেলে আমার। সন্তানের বাবা হোক তারপর বুঝবে।
আয়না ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে নিচে নেমে এল। অনুরাগ এখনো ফেরেনি বুঝতে পেরেছে। এত সাজগোছ করে কোথায় গেল কে জানে? একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দেয় না। আনহিতা এসে বলল
‘ বৌমা সোহাগ ফিরবে। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমরা আছি।
আয়না গেল না। দাঁড়িয়েই রইলো।
আনহিতা বলল,
‘ ঠিক আছে। যেওনা। তোমার চোখে তো ঘুম। দাঁড়িয়ে না থেকে সোফায় বসো।
আয়না চুপচাপ গিয়ে বসলো। বসতে বসতে ঝিমুনি এল আবার। ধীরে ধীরে কুশনে মাথা রাখলো। অনিমা বলল
‘ মনে হচ্ছে কয়েকবছর ঘুমায়নি। যত্তসব।
প্রায় অনেক্ক্ষণ পর কাঙ্ক্ষিত মুখটা দেখে আনহিতার প্রাণ ফিরে এল যেন। ছেলের মুখে ঘনঘন হাত বুলাতে বুলাতে কপালে আদর দিল। বলল
‘ চিন্তা হয় আব্বা। মাকে বলে যাবে না কোথায় যাচ্ছ?
‘ আমি কি ছোট আছি মা? তোমরা ও পারো। এত রাত জেগে আছ কেন? অসুস্থ হলে সে আমারই কষ্ট হবে।
আনহিতা বলল
‘ আচ্ছা আচ্ছা যাচ্ছি। খেয়ে এসেছ তো?
‘ হ্যা হ্যা।
অনিমা বলল
‘ এক ভাই আছে আমার। আর কার কার এমন ভাই আছে আল্লায় জানে।
অনুরাগ হেসে ফেলল। বলল
‘ তোরই একটা।
মুখ মোচড়ে চলে গেল অনিমা। বলে গেল
‘ সোফায় দেখ। হুহহ।
অনুরাগ তার কথামতো সোফায় তাকালো। দেখলো গুটিসুটি করে ঘুমে ঢলে পড়া একটি মেয়ে। এই মেয়ে এত ঘুম কাতুরে কেন? আশ্চর্য তো?
আনহিতা আর শায়খ চৌধুরী চলে গেল। অনুরাগ পেছনে দুহাত রেখে বেশ আয়েশ করে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। দেখলো আয়নার ঘুম ছুটার নয়। আবার ছুঁলেই চিল্লিয়ে উঠতে পারে৷ অনুরাগ একটু এগিয়ে গেল। বসলো আয়নার মুখোমুখি। ফিসফিসিয়ে ডাকল,
‘ নাগিনী, রাগিনী, মনোহারিণী।
আয়নার চোখ খুলার জন্য সম্ভাবণা নেই। অনুরাগ বলল
‘ বউ হওয়ায় এদের এক সুবিধা। এরা এত বড় হয়েও কোলে চড়তে পারে। শালার সুবিধা শুধু আমাদের পুরুষসমাজের জন্য নাই। কপাল কপাল। সবই কপাল।
অতঃপর বউকে কোলেই চড়াতে হলো অনুরাগকে৷ কোলে তুলতে তুলতে বলল
‘ আল্লাহুআকবর। মেয়ে তো ছোট, ভার তো কম না। বাপরে বাপ।
ঘরে আসতেই আয়নার নড়াচড়া অনুভব হলো। অনুরাগ তাড়াতাড়ি তাকে রেখে দিল। বেশ দূরে সরে পড়ে নিজে নিজেই বলল
‘ তো আমি কি আমার বউকে ওই নিচে রেখে এসে এখানে ঘুমাবো? কোলে এজন্যই নিলাম। এখন রাগলে আমার কি করার? যখন তখন রাগ দেখানো মানায় না।
আয়না নড়েচড়ে উঠে আবার ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল। অনুরাগ হাঁফ ছাড়লো। পাঞ্জাবি পাল্টে নিয়ে মুখ হাত ধুঁয়ে নিল। তারপর মশারি টাঙিয়ে দিয়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো।
আয়নার মুখখানা দেখে মনে হলো এই মেয়ের আসল রূপ এটাই। আর যেটা মেয়েটা দেখানোর চেষ্টা করে সেটা সাজানো। এটুকুনি একটা মেয়ে এত সুন্দর করে কিভাবে এতটা পাথর সেজে থাকতে পারে। তার সামনে আসল চেহারাটা উন্মুক্ত হবে কবে? কবে এই মেয়ে তার কাছে এসে ধরা দেবে? কবে হাতে হাত রেখে ভরসা দেবে? চোখে চোখ রেখে আশ্বাস দেবে? কবে ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে বলবে
‘ আমার প্রাণপুরুষ, প্রাণসখা, প্রিয় স্বামীটা, শুনুন আমি আপনার প্রাণবন্তা।
দীর্ঘশ্বাস মাখামাখি অনুরাগের চোখে ঘুম নামতে শুরু করলো। আয়নাকে পিঠ করে শুয়ে পড়লো সে। ঘুমের দেশে হারিয়ে যাওয়ার শুক্ষণে যেন মনে হলো পিঠের কাছে উষ্ণ কিছু একটা গিয়ে ঠেকে গেল। পিছু ফিরতে গিয়ে আটকে গেল অনুরাগ। একটা হাত এসে ঠেকল তার বুকের কাছে। ঘুমঘুম মস্তিষ্ক জানান দিল তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে একটি হাত। যদিও বাঁধনটা খুব হালকা তারপরও অনুরাগের ভীষণ ভালো লাগলো। হাতটা এভাবে থেকে যাক না। ইচ্ছে করে একবার ধরুক না।
অনুরাগ ধীরেধীরে ফিরলো আয়নার দিকে। ঘুমন্ত মুখটাতে যেন বিরক্তি ফুটে উঠলো কেন এত নড়াচড়া হচ্ছে দেখে। ভালো লাগার সাথে সাথে ভয় কাজ করলো অনুরাগের। যদি চোখ মেলে এই মেয়ে তাকে দেখে? এতটা দূরত্ব কমানো মধ্যিখানে তা যদি দেখে? চরিত্রহীন উপাধি দেবে না তো? ছুটে যেতে চাইলো অনুরাগ। হাতটা যেতে দিল না। বরঞ্চ আদুরে বিড়ালের মতো ঠান্ডা থেকে বাঁচতে উষ্ণতা খুঁজতে খুঁজতে মুখটা এসে হাজির হলো একেবারে বুকের কাছটাই। যেখানে সে সজ্ঞানে মাথা রাখলে নিজেকে শুনতে পাবে। নিজেকে অনুভব করতে পারবে। অনুরাগ ফাঁকা ঢোক গিললো। আয়নার মাথার পেছনে হাত দিয়ে আরও ভালোভাবে দূরত্ব কমিয়ে এনে কপালে আদুরে প্রলেপ দিল বেশ ঘন করে। অনুরাগের চোখে আর ঘুম নামলো না। টান,মায়া, ভালোবাসাগুলো এমন কেন? ভাবতে আর অনুভব করতেই যেন হাজার বছর চলে যায় । তাহলে ভালোবাসাবাসি হয় কখন? আর ভালোবাসা ফুরোয় কখন? যারা বলে ভালোবাসা ফুরোয় তারা আসলে ভালোবাসা কাহাকে কয় সেটাই জানেনা। অনুরাগের বড্ড গর্ব হয় সে একজন বেকুব পুরুষ মানুষ হয়েও ভালোবাসা বুঝে, অনুভব করে, আর একজন লৌহমানবীকে ভালোও বাসে।
আয়নার ঘুমের ঘোর ছুটলো তখন মাত্রই অনুরাগের চোখে ঘুম নেমেছে। বাহুডোরে নিজেকে বন্দী পেয়ে দমবন্ধ হয়ে এল আয়নার। মুখতুলে ঘুমন্ত মুখটার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকালো৷ কি অপবাদ দেবে সে এখন? বিয়ে করা বউ বক্ষবন্ধনী হয়ে থাকতেই পারে, তাকে চরিত্রহীন উপাধি দেওয়া যায় না৷ অসভ্য, অভদ্র ও বলা যায় না। তাহলে কি বলবে এখন আয়না। নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা ছাড়া মুখ দিয়ে কিছু বের হলো না তার।
ধস্তাধস্তি করায় অনুরাগ চোখ খুলে ফেলল৷ চারটা চোখ একত্রিত হয়েও ভাষা নেই যেন। বুঝার চেষ্টা না করলে কি করার থাকে?
‘ মেরে ফেলব আপনাকে। অনেক অনেক বড় শাস্তি দেব৷ ছাড়ুন।
কথাটা শুনে ভীষণ হাসি পেল অনুরাগের। এই যে এত শক্ত শক্ত কথা বলে সেসব কি শাস্তি নয়? এত কাছে থেকে যে এতটা দূরে সরে থাকে সেসব শাস্তি নয়? চোখে চোখে দুটো কথা না বলে, চোখ সরিয়ে নেওয়াটাই কি শাস্তি নয়? ভালোবাসা তো দূর, ভালোবাসতে না দেওয়াটাই তো অনেক বড় শাস্তি। আর ও বড় ধরনের শাস্তি আছে নাকি?
অনুরাগের বলতে ইচ্ছে হলো এর চাইতে বড় শাস্তিটা আমি মাথা পেতে নেব, কিন্তু এসব নয়। আমাকে আর শাস্তি দিও না।
কিন্তু এই মেয়ে তো সেসব শুনে বলবে,
শাস্তি এখনও দিলাম কই?
নিজের উপর রাগে ফোঁসফোঁস করলো আয়না। সে কেন এই লোকটার পাশে এলোমেলো ঘুমোতে যায়?
‘ আপনি কেন আমায় ছাড়ছেন না?
‘ তুমি নিজেই এসেছ। আর আমি শুধু ধরে রেখেছি।
‘ ছেড়ে দিন।
‘ নাহ।
‘ কেন? আপনি তো,,
তাকে বলতে দিল না অনুরাগ। নাকের ডগায় আলতো করে চুমু বসিয়ে বলল
‘ ” মেরে ফেলব ” বলতে বলতে তুমি যেদিন ক্লান্ত হয়ে ” মেরে ফেলব ” বলা ছেড়ে দেবে দেখবে সেদিনই আমি মরে যাব।
আয়না ধস্তাধস্তি করা ছেড়ে দিল। অবাকচোখে তাকিয়ে বলল,
‘ আমি তো ওইকথা এমনিই বলি।
‘ এমনি এমনি, মিছিমিছি ভালো ও তো বাসতে পারো। সত্যি তো বাসবে না।
চলবে,,,,,
#আয়নামতী
#পর্ব_৩০
#পুষ্পিতা_প্রিমা
সকাল দশটার দিকে রূপাকে চৌধুরী বাড়িতে দেখে আয়না চমকিত হলো। গাঢ় নীল রঙের কুঁচি দেওয়া ফ্রক গায়ে দেওয়া রূপার। মাথার দুপাশে ঘন কালো চুলগুলো বেণুনি বাঁধানো। উজ্জ্বল টকটকে মুখটা আয়নাকে দেখে আর ও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে গালভরে হাসলো। ডাকল
‘ আমার আপা।
আয়না হাত বাড়িয়ে দিয়ে ডাকল
‘ আয় আয়।
রূপা দৌড়ে এল অনুরাগের পাশ থেকে। ঝাপটে জড়িয়ে ধরে রাখলো আয়নাকে। বলল
‘ তোমার জন্য আমার মন পুড়ছে খুব।
‘ তাই নাকি? আমার ও। বাড়ির সবাই কেমন আছে। বাবু?
‘ সব্বাই ভালো আছে। আমি আসার সময় বাবু তো খুব কান্না করছিল। আমার সাথে চলে আসার জন্য।
আয়না বলল
‘ তাই নাকি? এখন বসা শিখছে?
‘ ওই একটু বসে। আবার ঢলে পড়ে। তারপর কান্না করে।
আয়না বলল
‘ আমি গিয়ে দেখো আসব। চল ঘরে যাই।
রূপা ও আয়নার সাথে তাল মিলালো। পেছন ফিরে অনুরাগকে দেখে হাসলো। চোখ টিপলো। অনুরাগ ও হেসে দিল।
‘ ধুরর পেছনে কি দেখিস?
‘ শোনো আপা, জেম্মা বলছে তোমাকে সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে। এইটাই নাকি তোমার বাড়ি।
‘ মেয়েদের বাড়ি বলতে কি কিছু হয় নাকি? ওই বাড়িতে গেলে বলবে বাপের বাড়ি, এই বাড়িতে এলে শ্বশুরবাড়ি। অথচ সেই মেয়েদের ছাড়াই দুই বাড়িই অসম্পূর্ণ।
রূপা বলল
‘ এত জটিল করে কথা বলো। আমি কি বুঝি?
‘ তোকে বুঝতে হবে কেন? তুই তো এখনো খুব ছোট। ভালো করে পড়ছিস তো? তোকে ইংলিশ স্কুলে পড়াবো আমি। পারবি?
রূপা ভাবতে সময় নিল। বলল
‘ ইংলিশ?
‘ ভয় পাচ্ছিস কেন? পারবি না?
‘ পারব।
‘ এই তো ভালো মেয়ে।
রূপা হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেল। মুখ ফুলিয়ে বলল
‘ তুমি আমাকে ভালো করে দেখোনি কেন?
আয়না বলল
‘ কি দেখব? দেখেছি তো।
‘ আমি তোমার কিনে দেওয়া ফ্রকটা পড়ছি না? কেমন লাগছে বলোনাই।
আয়না হেসে দিল। গালটা টেনে দিয়ে বলল
‘ সুন্দরী বনুটা।
চকচকে দৃষ্টিতে তাকালো রূপা। ঠোঁটের সাথে হাসছে চোখ। আয়নার গাল টেনে দিয়ে বলল
‘ আমার সুন্দরী আপা।
আয়না রুমের দরজা খুলে ঘরে পা রাখলো। রূপা ও পা রেখে বলল,
‘ একটা কথা বলব তোমাকে?
‘ বল।
‘ ছোট সাহেব কালো বলে তুমি অপছন্দ করো?
আয়না চমকে উঠলো। অপছন্দের কারণ কালো রঙ ও হতে পারে? ভেবে বলল
‘ হয়ত,
রূপা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। নাক ফুলিয়ে বলল
‘ কিন্তু ছোটসাহেব তো কালো নয়। বিস্কিট কালার।
আয়না চট করে তাকালো রূপার দিকে।
‘ বিস্কিট কালার?
‘ হ্যা।
আয়না হাসতে হাসতে ঢলে পড়লো বিছানায়। রূপা অবাক হয়ে বলল
‘ ওমা ?
অনুরাগ এসে দাঁড়ালো দরজার কাছটায়। এত হাসাহাসি কিসের আশ্চর্য ?
আয়নার হাসি থামার নয়। তার নাকি বিস্কিট কালার জামাই!
___________
রূপা এসেছে শুনে অমি খুব খুশি হলো৷ স্কুল থেকে ফিরে সোজা আয়নার ঘরে চলে গেল। রূপা তার সাথে কথা বলতে ও প্রস্তুত নয়। আয়নার পেছনে লুকিয়েই থাকলো। রেগে গেল অমি। অনিমা আসলো হনহনিয়ে। অমিকে ধরে নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ এক চড় দিয়ে বসিয়ে রাখব বেয়াদব ছেলে। কে রূপা? রূপার সাথে তোর কি? কোথাকার মেয়েছেলে?
রূপার মন খারাপ হয়ে গেল। আয়নাকে বলল
‘ আমার পরিচয় নেই আপা?
আয়না মুখটা আগলে ধরলো তার। বলল
‘ তুই আমার পরিচয়ে বড় হবি। আমিই তোর অভিভাবক। তোর সব। বুঝলি? মন খারাপের কিচ্ছু নেই। যারা অবুঝ তারাই বলে তোর কেউ নেই।
রূপা ছলছলে চোখে হাসলো।
সন্ধ্যার দিকে চলে গেল অনুরাগের সাথে। আয়না অনেক করে থাকতে বলেছে। কিন্তু রূপা থাকার পাত্র নয়। সায়ানকে ছেড়ে কোথাও থাকতে তার ভালো লাগে না।
______________
অনুরাগ স্যুটকেসে তার কাপড় চোপড় ভরার সময় আয়নার কয়েকটা শাড়ি নিয়ে নিল। আয়না আঁড়চোখে তাকাতেই দেখলো। তেড়ে এসে বলল
‘ আজব! কি হচ্ছে এসব? আমার শাড়ি কেন? আপনি কোথায় যাচ্ছেন যান আমার শাড়ি কেন নিচ্ছেন সাথে?
‘ তুমি ও যাচ্ছ তাই।
‘ কোথাও যাব না আমি৷ পাগল হয়ে গেছেন আপনি?
‘ তুমি যাবে। দূরে কোথাও না। আগ্রাবাদে থাকব। একা বাসায় তুমি থাকলে ভালো লাগবে।
‘ আমি যাব না কোথাও।
অনুরাগ তীর্যক চোখে তাকালো। হেঁটে আয়নার সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ালো। বলল
‘ বেশিদিন থাকব না। খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। তোমার বাগান রহমত দেখবে। চিন্তার কারণ নেই।
‘ আমি যাচ্ছেন যান। আমাকে নিয়ে যাওয়ার কি দরকার?
অনুরাগ ঘর থেকে সোজা বের হয়ে গেল। এই মেয়ের সাথে কথা বলে কোনো লাভ নেই। শায়লা বেগমকে পাঠালো অনুরাগ। তিনি পারবেন।
শায়লা বেগম অনুরাগের কথায় এল। আয়নাকে বলল
‘ নাতবৌ বিয়ের পর কোথাও বেড়াতে যেতে হয়। মেয়ে এত বেরসিক কেন? জায়গা বদলের দরকার পড়ে মাঝেমধ্যে। যাও বেড়িয়ে এসো। না শুনব না আমি।
আয়না চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
অনুরাগ এসে হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে বলল
‘ তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। দেরী হলে সমস্যা।
আয়না বলল
‘ নিজে না পেরে নিজের দাদীকে পাঠালেন না? দেখে নেব আপনাকে।
‘ অত দেখার কি আছে? তোমার স্বামী সুদর্শন না হলে কি দুটো বিয়ে করতে পেরেছে?
‘ বিয়ে করতে হলে সুদর্শন হতে হয় না। চরিত্রহীন হলেই যথেষ্ট।
অনুরাগ হেসে ফেলল উচ্চস্বরে। আয়নামতী তাকে এত সুন্দর সুন্দর উপাধি দেয়,, না হেসে থাকা যায় না। অবশ্য তার দেওয়া উপাধি গুলোই বেশি সুন্দর।
___________
হালকা গোলাপি রঙের একটি শাড়ি পড়া আয়নার গায়ে। সদ্য গোসল সেড়েছে তাই চুল ভেজা। নাকে পড়া স্বর্ণের ফুলটি জ্বলজ্বল করছে। শাড়ির অবিন্যস্ত আঁচলটা কোনোমতো কাঁধের সাথে আটকানো।
আগে একটু নিজেকে সামলে রাখতো এই মেয়ে। অনুরাগের সামনে পর্দা করতো। গুটিয়ে সুটিয়ে থাকতো। আজকাল একদম বেসামাল চলাফেরা করে। কোনকিছুর পাত্তা নেই। তার আশেপাশে যে একজন পুরুষ মানুষ সর্বদা ঘুরঘুর ঘুরঘুর করে এটা বোধহয় মাথায় থাকেনা। অনুরাগ ভালো করে বুঝতে পেরেছে আয়নার ছাল। সে যাতে না তাকায় সেজন্য মেয়েটা এমন করছে। যদি তাকায় তাহলে তো চরিত্রহীন উপাধি দিয়ে দিতে পারবে। আবার এদিকে নিজের বউকে না দেখলে অনুরাগেরই লস। যাবে কোথায় সে? এই মেয়ে তাকে চতুর্দিকে জ্বালাচ্ছে। উফফ কি জ্বালা। এই জ্বালা সহনের চাইতে মরণ ও ভালা।
______________
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই অনুরাগ বের হলো আয়নাকে নিয়ে। আনহিতা বেরোনোর আগ আয়নাকে বলেছে, ভালো থেকো। দু’জন দু’জনকে দেখে রেখো। নিজের মধ্যকার ঝামেলা কখনোই বাইরের কারো সামনে প্রকাশ করবেনা। সম্পর্কের মধ্যকার দুর্বলতা যদি কেউ জানতে পারে তাহলে সেখানেই আঘাত করবে। কেউ কাউকে ভালো নাই বাসলে, কিন্তু আঘাত করো না। হুটহাট কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারেনা। ভালোবাসার জন্য অপর মানুষটাকে চিনতে হয়, জানতে হয়, বাহ্যিকতার প্রেমে না পড়লেও একসাথে থাকতে থাকতে মানুষ অপর মানুষের ভেতরের স্বত্বাটাকে ঠিকই ভালোবেসে ফেলে। আমাদের উপর তোমার অনেক অভিযোগ সেটা জানি আমরা। সেসবের জন্য রাগ,অভিমান আমাদের জন্য না হয় জমা থাক। অনুরাগের উপর নয়। আমরা ভুল করি তাই আমরা মানুষ নইলে তো ফেরেশতা হতাম। ভুল ক্ষমা করা যায়। আর যে ক্ষমা করে সে কখনো ছোট হয় না। আমাদের না করো, অনুরাগকে তো করা যায়।
আয়না কথাগুলো চুপচাপ শুনলো। শায়লা বেগম চুপিসারে বলল
‘ নাতবৌউ আমার দাদুভাই কিন্তু তোমাকে ভালোবাসে। তাকে ও বেসো। নাহলে তোমার ঋণ আর ও বেড়ে যাবে তার কাছে। তুমি ও একটু পুষিয়ে দাও না। দেখবে আসলেই সবটা সুন্দর। ভালোবাসা খুব সুন্দর। একদিন ঠিকই বুঝবে।
আয়না মাথা নাড়ালো শুধু। অনুরাগ ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে থেকে ভাবলো
‘ এই বুড়ি কি শলাপরামর্শ দিচ্ছে কে জানে? ভালো হয় নাকি উল্টো আমার পেছনে লাগে এই মেয়ে। কবে আমায় একটু দেখতে পারবে আমার বউটা? জ্বালারে জ্বালা। এই বউ হয় না ভালা।
শায়লা বেগম চোখ টিপে দিল। তা দেখে অনুরাগ খুকখুক করে কেশে উঠলো। বাড়ির বাইরে চলে গেল।
___________
গ্রামের সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি এগোচ্ছে। আয়না তার পাশে বসা লোকটাকে সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করে ড্রাইভারকে বলল
” মামা ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?
ছোটসাহেব যেইখানে বলছে সেইখানে।
‘ আমাদের বাড়ি?
‘ হ্যা।
আয়নার মুখখানা খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো। অনুরাগ আঁড়চোখে তাকালো। আবার চোখ সরিয়ে নিল। কালো বোরকায় তার বউকে বেশ মানায়।
আয়না বলল
‘ একটা ভালো কাজ করেছেন বহুদিন পর। ধন্যবাদ।
‘ ধন্যবাদ তো তোমার চোখকে দেওয়া উচিত। বহুদিন পর একটা ভালো কাজ চোখে পড়লো বলে। নাহলে এতদিন অনেক ভালো কাজ করেছি, তোমার চোখে পড়েনি। বজ্জাত চোখ।
আয়না হেসে ফেলল। বলল
‘ চোখ আবার বজ্জাত হয় নাকি?
‘ হয় হয়। তুমি আস্ত একটা বজ্জাত।
সাথে অনুরাগের হাতে জোরে খামচে দিল যেন কেউ। অনুরাগ হাত সরিয়ে নিয়ে বলল
‘ রাক্ষসী।
‘ আপনি রাক্ষস।
খুশি হলো অনুরাগ। হাতটার চিনচিনে ব্যাথা ও চলে গেল। বউ রাক্ষসী হলে জামাই তো রাক্ষস হবেই।
উঠোনের সামনে গাড়ি থামতেই রূপা বের হয়ে এল। পিছুপিছু বাড়ির সবাই। আয়শা বেগম বলল
‘ ওমা কি সুন্দর হইয়া গেছে আয়নামতী। নজর না লাগুক।
আয়না ভুরু কুঁচকে বলল
‘ এসব কি ডাকো আম্মা?
আয়শা বেগম ফিসফিসিয়ে বলে
‘ চৌধুরীর পোলা ভালো নাম দিছে। আমার পছন্দ হইছে।
নামিরা হাসলো। অনুরাগের কোলে সায়ান। সায়ান ও হাসলো। সাথে সাথে অনুরাগ ও হাসলো। আয়না সায়ানকে কোলে নিয়ে নিল। আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে বলল
‘ কেমন আছে আমার আব্বাটা?
সায়ান খিকখিক করে হাসতে লাগলো। আয়না বলল
‘ কি সুন্দর হাসি? আব্বা আবদার করা শিখবে কখন থেকে?
নামিরা বলল
‘ আবদার করলে আর আবদার পূরণ করতে করতে কাহিল হয়ে যাবে।
‘ করুক। আমারই তো আব্বা।
আজহার সাহেব মেয়ে জামাইকে পেয়ে দারুণ খুশি। বললেন
‘ আজ থাক। আমি বাজারে যাই। তোর মায়ের হাতে ইলিশ খেয়ে যাবি।
আয়না বলল
‘ অন্য একদিন আব্বা। আজ তো অন্য কোথাও যাচ্ছি। খুব ভালো থেকো আব্বা।
আজহার সাহেবের চোখে জল। জিজ্ঞাসা করেন
‘ তুই ভালো আছিস মা?
‘ তোমরা ভালো থাকলে আমি ও ভালো থাকি আব্বা। আমার জন্য দোয়া করো।
‘ মা বাপের মোনাজাতের শুরুতেই সবসময় সন্তানরাই থাকে। যেদিন মা হবি সেদিন বুঝবি।
আয়না আঁখিজলে হাসলো। মায়ের কাছে গিয়ে বলল
‘ আম্মা শরীরের যত্ন নিও। আব্বাকে দেখে রেখো। আমি আসব এরকম মাঝেমাঝে।
আবেগে গলে গেল মায়ের মন। বললেন
‘ তুই ভালো থাক আমার বাছা। সুখে থাক। স্বামী সংসার ওগুলোরে হেলাফেলা করিস না। যে তোরে ভালোবাসে তারে ভালোবাসবি। যতখানি পাবি ততখানিই দিবি। কম দিবি না আবার বেশি ও দিবি না। কম দিলে ঋণী হবি, বেশি দিলে নিজেরে হারায় ফেলবি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বি আর জামাইর লগে ভালো ব্যবহার করবি। সবসময় চোখকান খোলা রেখে চলবি। মনে থাকবো?
আয়না দুপাশে মাথা দুলালো।
‘ মন থাকবে আম্মা।
‘চৌধুরীর পোলা কোথায়?
আছে বারান্দায়। আয়শা বেগম সেদিকে পা বাড়ালো। আজহার সাহেব আয়নাকে বলল
‘ তোর মা আবার কি বলে ফেলে কে জানে?
আয়না বলল
‘ বলুক।
আয়শা বেগমকে দেখে অনুরাগ দাঁড়িয়ে পড়লো। কোলে সায়ান। খেলছে অনুরাগের পকেট থেকে কলম নিয়ে। আয়শা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বলল
‘ হুনো চৌধুরীর পোলা তোমারে কিছু কথা কয়।
‘জ্বি বলুন।
‘ আমার মাইয়্যারে আমি আদর যত্ন কইরা মানুষ করছি। সে বাবা ভাইয়ের সোহাগে সোহাগে বড় হয়ছে। অভাব দেখছে ঠিক, কিন্তু আদর ভালোবাসার অভাব কখনো দেখেনি সে। আল্লাহ তোমার জন্য তারে লিখে রাখছে, তাই তোমার লগে ওর বিয়া হইছে। তারে ভালো রাখবা। জ্বর হইলে নিজের হাতে খাইয়ে দিবা। কিছুক্ষণ পরপর গরম চা দিবা। রাগ করলে রাগ ভাঙাবা। মাথা ব্যাথা করলে মাথা টিপে দিবা। বুঝছ?
‘ জ্বি আম্মা।
ভেতর ঘরে নামিরা আয়নাকে বলল
‘ আয়না দেখো তোমার বরকে সব শিখিয়ে দিচ্ছে আম্মা।
আয়না বলল
‘ তো আমি কি করব?
নামিরা হাসলো গাল চেপে।
আয়শা বেগম শেষমেশ অনুরাগকে বলল
‘ যা তোমারে বলছি তা আমারটারেও বলছি। মানে তোমার বউরে। বুঝছ চৌধুরীর পোলা? তোমার যদি সেবা না করে আমারে কইবা, ওর বিচার আমি করুম।
অনুরাগ চমৎকার করে হেসে ফেলল। চকচকে দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
‘ তাহলে তো অভিযোগের খাতা অনেক বড় আম্মা। ঠিক আছে আজ থেকে নতুন করে আবার লিখা শুরু করব।
‘ ক্যান তোমার লগে কি ত্যাড়ামো করে নাকি?
‘ করে তো। অনেককিছুই করে। আচ্ছা পরের বার আসি। সব একদম লিখে নিয়ে আসব। ঠিক আছে।
‘ ঠিক ঠিক। ঠিক আছে।
‘ আচ্ছা তাহলে আজ আসি। গ্রামে ফিরলে আবার আসব।
‘ ঠিক আছে। ফি আমানিল্লাহ। সাবধানে যাইয়ো বাপ। ভালা থাইকো।
________________
আগ্রাবাদের একটি বাড়িতে গিয়ে উঠলো অনুরাগ। বাড়িটি সদ্য তোলা হয়েছে। চারপাশে সুনসান নীরবতা। একা একটা প্রকান্ড বাড়ি। বাাড়িটার প্রবেশ পথে একটি হা করা সিংহের মূর্তি। আয়নার কপাল কুঁচকে এল। গাড়ি থেকে নেমে অনুরাগকে বলল
‘ কোথায় নিয়ে এসেছেন আমাকে? আমি এখানে একা থাকতে পারব না।
‘ তোমাকে একা ছাড়ছে কে?
‘ আপনি বাইরে যাবেন না?
‘ যাব।
‘ তাহলে? আমি থাকব না এখানে। ভয় লাগে।
‘ এখানে একটা বুড়িমা আছে। ওনার সাথে থাকবে। এটাই আমাদের জন্য নিরাপদ একটা বাড়ি। বাড়িটার চারপাশে সুরক্ষা বাহিনী আছে। চিন্তা কিসের? আয়নামতী ভয়ও পায় নাকি?
‘ মশকরা করবেন না।
অনুরাগ হাসলো। বলল
‘ ভেতরে আসুন মহারাণী।
আয়না পা টিপে টিপে বাড়িটার ভেতরে পা রাখলো। সাদা ধবধবে চুলওয়ালী কালো বর্ণের একজন বুড়ি লাঠি ঠকঠক করে এসে হাজির হলো। সোজাসুজি বলল
‘ এসেছ তোমরা বউ জামাই? কিছুক্ষণ বিশ্রাম করো। আমি নাশতা পানি পাঠাচ্ছি। রাতের ভাতের আয়োজন হচ্ছে।
অনুরাগ আয়নার হাতটা ধরলো এক হাতে। অন্য হাতে স্যুটকেস ধরে নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ ভয় পাচ্ছ নাকি? আরেহ এখানে আর ও অনেকে আছে। রান্নাঘরে। অন্যান্য কাজে। বাইরে একটা বাগান ও আছে। কাল দেখো।
আয়না বলল
‘ ভুতুড়ে বাড়ি। আলো থাকলে ও কেমন যেন। গুমোট গুমোট ভাব। আমি থাকব না এখানে।
‘ একদম চুপ। সোজা চলো। নাহলে বুড়িমাকে ডাকছি।
‘ নাহ।
হেসে ফেলল অনুরাগ।
_____________
খানিকক্ষণ ঘুমালো আয়না। রাজকীয় বেশভূষা বাড়িটার মধ্যে। কেমন আজব আজব কয়েকটা তৈলচিত্র দেয়ালে টানানো । অনুরাগ মাত্রই ঘরে ঢুকছিল। আয়নাকে ভয়ার্ত চোখে তাকাতে দেখলো তৈলচিত্রের দিকে। হেঁটে গিয়ে তৈলচিত্রটি নিয়ে ফেলল অনুরাগ। ঘরের একপাশে রেখে দিয়ে বলল
‘ ভয়ের কিছু নেই। খাবার চলে আসছে। খেয়ে নাও।
আয়না খাট থেকে নেমে বলল
‘ আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? দেখুন হুটহাট কোথাও চলে যাবেন না। আমার ভয় হয়। কোথায় নিয়ে এসেছেন আমায়?
‘ আরেহ চিন্তা নেই।
দুইজন পরিচারিকার দরজার করাঘাত শোনা গেল।
‘ ভেতরে এসো।
বলল অনুরাগ। ভেতরে এল তারা। খাবার রেখে চলে গেল। আয়না স্পষ্ট দেখলো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সাদা শাড়ি আর সাদা চুলওয়ালা কুচকুচে কালো বুড়িটা। দেখতে ভয়ংকর। শুকনো ঢোক গিললো আয়না। অনুরাগ দরজা বন্ধ করে দিল। আয়নার মতিভ্রম হলো। চুপচাপ খেয়ে নিল অনুরাগের কথায়। অনুরাগ বলল
‘ বিছানা তৈরি আছে। তুমি ঘুমাও। আমি বারান্দায় আছি। কিছু ফোনকল সেড়ে নেওয়া বাকি আছে।
আয়না দুপাশে মাথা নাড়ালো। আবার মনে হলো বুড়িটা কোথাও যেন দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। অনুরাগ বের হয়ে গেল ঘর থেকে। আয়না গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো। গায়ে কাঁথা টেনে নিল।
তার কিছুক্ষণ পরেই মিটমিট করে আলো জ্বলতে নিভতে লাইট বন্ধ হয়ে গেল ঘরের। আয়না জোরে চেঁচিয়ে উঠলো। ডাকল
‘ প্রফেসর? আপনি কোথায়? আল্লাহ আমার ভয় করছে। প্রফেসর?
কারো কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না । শুধু ঘড়ির কাঁটার শব্দ ছাড়া। আয়না স্পষ্ট দেখলো ঘরের দরজা খুলে গিয়েছে। সামান্য আলো এসে পড়েছে সেখানে। ঢুকছে শাড়ি পড়া একটি অবয়ব। আয়না যেন চেঁচাতে চেয়ে ও চেঁচাতে পারলো না। গলা ছুঁলো দুহাত দিয়ে। ডাকল
‘ প্রফেসর? প্রফেসর?
শেষেরটিতে আওয়াজ হলো বেশ। তরতর করে ঘেমে উঠলো আয়না। বেশ ভালো করে অনুভব করলো পেছন থেকে তাকে আষ্টেপৃষ্টে ধরে রেখেছে কিছু একটা। আয়না কাঁপতে কাঁপতে হাল্কা হাল্কা কান্নায় ভাসলো। কম্পিত গলায় বলল
‘ কে?
‘ আমি।
আয়না নেতিয়ে গেল। সর্বস্বান্ত হয়ে গেল৷ উন্মুক্ত ঘাড়ের কাছে নরম শীতল স্পর্শ টের পেল। নিজের সকল আক্রোশ থেকে তেজগলায় বলল
‘ আপনি খারাপ। শত্রু আমার। কেউ কখনো আমাকে এতটা ভয় দেখায়নি।
‘ আমি ভয় দেখাইনি। তুমি আমাকে ঠিকই দেখেছ ঘরে আসতে। আমি ছাড়া আর কে আসবে? রিল্যাক্স আয়নামতী।
আয়নার কপালে ঘাম ছুটলো। আলোঅন্ধকারে অনুরাগ টের পেল ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যাওয়া আয়নার ঠান্ডা হাত। হাতের আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে আঙুল নিয়ে তার গালে লাগিয়ে রেখে বলল,
‘ আরেহ হাত এত ঠান্ডা কেন? তুমি তো সাহসী মেয়ে। এত সামান্য ব্যাপারে কেউ ভয় পায়? লোডশেডিং হতেই পারে।
আয়না তাড়াতাড়ি সামনে ফিরলো। গুটিসুটি মেরে অনুরাগের বক্ষে শায়িত হয়ে বলল
‘ খোদার কছম আপনি যদি আর ভয় দেখান আমি একমুহূর্ত ও এই বাড়িতে থাকব না। ওই বুড়িটাকে আমার ভীষণ ভয় লাগে। আমি একা থাকব না এই বাড়িতে।
‘ এভাবে যদি স্বইচ্ছায় আসতে তাহলে কথা দিতে পারতাম তোমাকে ছাড়া কোথাও যাব না। কিন্তু তুমি তো কারণে এসেছ।
‘ আপনি অকারণে ধরে রাখুন।
অনুরাগের ঠোঁটের কোণায় তখন বিশ্বজয়ের হাসি। বুকে থাকা রমণী কাঁপতে কাঁপতে স্থবির হয়ে পড়লো। কারণে হোক কিংবা অকারণে অনুরাগের পিঠের শার্ট খামচে ধরে জানান দিল
‘ যাবেন না। ওই বুড়িটা আমাকে মেরে ফেলবে।
চলবে,