#আয়নামতী
#পর্ব_৩১
#পুষ্পিতা_প্রিমা
ফজরের নামাজ পড়ে আয়না ঘর থেকে বের হলো। উদ্দেশ্য নিচে যাওয়া। বাগান দেখবে। কিন্তু দোতলার সিড়ি বেয়ে নিচ ঘরে নামতেই অদ্ভুত এক আওয়াজ ভেসে এল কোথা থেকে। উমউম কারো গলার আওয়াজ। যেন কে কারো মুখ চেপে ধরেছে। দোয়া দরূদ পড়ে নিল আয়না। শাড়ির আঁচলটা টেনে ভালো করে মাথায় দিল। এদিকসেদিক তাকাতেই আওয়াজটা আর ও ভারী হতে লাগলো। আয়না আবার দোতলায় উঠে গেল। কোন ঘর থেকে এই আওয়াজ আসছে? আয়না ভয়ে ভয়ে পা বাড়ালো। কেউ বোধহয় বিপদে পড়েছে। কাউকে তো দেখা ও যাচ্ছে না। এখনো ভালো করে ভোরের আলো ফুটেনি। অনুরাগকে ঠেলেঠুলে মসজিদে পাঠিয়ে দিয়েছে আয়না। লোকটা ইদানীং ভীষণ পাজি হয়েছে। মাঝরাত অব্দি ফোন গুতাগুতি করবে, হ্যালো, ট্যালো করবে। তারপর সকালে ঘুম থেকে উঠতে চাইবে না। কত নাম গায় তার মা দাদী। তাদের ছেলে, নাতি নামাজ পড়া ছাড়া ভাত মুখে নেয় না। আগে তো সব ঠিকঠাক ছিল। এখন কি হলো? লোকে শুনলে কি বলবে? বলবে বিয়া করার পর নামাজ পড়ায় আলসেমি এসে গেছে। পিটিয়ে পিটিয়ে মসজিদে পাঠাবে আয়না। তার উপর কোনোরকমে অপবাদ আসতে দেবে না সে। কি পেয়েছে ওই লোকটা?
এলোমেলো ভাবনার সুঁতো ছিড়লো বেশ অনেক পথ আসার পর। এই বাড়িটা সত্যিই অদ্ভুত। আওয়াজ আর ও ঘন হয়ে এল। আয়না। কালো কাঠের একটি দরজা দেখতে পেল। অন্য ঘরের দরজাগুলো বাদামী রঙের। এটির রঙ কালো কেন? আয়না হেঁটে গেল সেদিকে। আওয়াজ এই ঘর থেকেই আসছে। কিছু নড়াচড়ার আওয়াজ। মনের ভুল ও হতে পারে।
কারো গর্জনে বুক কেঁপে উঠলো আয়নার। মনে পড়ে গেল বুড়িটার কথা। পেছনে ফিরলো সে ভয়ার্ত চোখে। বুক কাঁপছে। হাত পা ঠান্ডা হওয়ার মতো অবস্থা। সাদা শাড়ি আর সাদা চুল। অথচ মুখটা বিচ্ছিরি রকমের কালো এবং কুৎসিত। মনে হচ্ছে ইচ্ছে করে এরকম সেজেছে বুড়িটা। কালকের চাইতে ও আজকে ভীষণ ভয়ংকর দেখাচ্ছে বুড়িটাকে।
আয়না মনে সাহস আনলো। শুকনো ঢোক গিলে কিছু বলার আগেই ভেসে আসলো
‘ কি চাই ওখানে? তুমি ওখানে কি করছ মেয়ে?
‘ আমি? আমি আসলে?
‘ কি আসলে আসলে করছ? সোজা ঘরে যাও। এদিকে আরেকবার দেখলে হাত পা কেটে ঘরে বসিয়ে রাখব।
এত বড় ধমক শুনে আয়নার চোখ ছলছল করে উঠলো। নীরব হয়ে তাকিয়ে রইলো সে। এক পা ও নড়লো না।
বুড়িটার চোখ স্বাভাবিকের চাইতে বড় হলো। আয়না বুড়িটাকে আগাগোড়া দেখল। লাঠি ধরলে ও এখনো অনেক তরতাজা বুড়িটা। মনে হচ্ছেনা লাঠিতে ভর দিয়ে চলতে হচ্ছে বুড়িকে। তবে বুড়ির চোখের দিকে চোখ ফেলতেই দুপা পিছিয়ে গেল আয়না। চোখ বড় বড় করে হিংস্র দৃষ্টিতে বুড়ি তাকিয়ে রয়েছে তারদিকে। আয়না আর ও কয়েক পা পিছিয়ে গেল। বুড়ি এগিয়ে আসতেই আয়না দৌড় লাগালো। এক পা ও এগোতে পারলো না। খেয়ালই ছিল না তার পেছনে দেয়াল। কপালে আঘাত পেয়ে সেখানেই ছিটকে পড়লো। উপর থেকে নিচে মেঝেতে পড়ে যাওয়ায় সাথেসাথে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল আয়না । বুুড়িটা হায়হায় করে উঠলো। কপাল অব্দি থাকা শাড়ির আঁচলটা নাক অব্ধি টেনে নিয়ে হাঁটা ধরলো অনুরাগের ঘরের দিকে। বউ রেখে এই পোলা গেল কই?
_________________
নামাজ পড়ে এসে অনুরাগ তার ঘরের বাইরে কয়েকজন পুরুষ মহিলাকে দেখতে পেল। তাদের পেছনে গিয়ে বলল
‘ কি সমস্যা। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কেন?
ভয়ার্ত চোখে তাকালো লোকগুলো। মহিলাগুলো মুখ ঢাকা পড়েছে ওড়নার আঁচলের নিচে। বজ্রগম্ভীর স্বরে অনুরাগ বলল
‘ আরেহ কি হয়েছে? আয়নামতী কোথায়? ওর কিছু,,,
উৎকন্ঠিত শোনা গেল কথাগুলো। সরতে না বলেই এগিয়ে গেল অনুরাগ। সরে পড়লো সবাই। দেখলো আয়না বিছানায় শায়িত। চোখের নিচে কালো দাগ জমে গেছে এই অল্পসময়ে। পাশে বসা দুজন মহিলা। বুড়ি মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা দেখা যাচ্ছেনা ভালো করে। অনুরাগ এগিয়ে গেল। সে বেরোনোর সময় ও তো আয়নামতী ঠিক ছিল। একদম সুস্থ সবল। এখন হঠাৎ করে কি হলো? অনুরাগ আসতেই মহিলা দুজন সরে গেল। অনুরাগ পাশে বসে মুখটা ধরে ফিরাতেই ভড়কে গেল কপালে চোখ পড়তেই। আলতোহাতে ফুলে রক্তজমাট বেঁধে থাকা কপালটাতে হাত ছুঁয়ে বলল
‘ এসব কি করে হলো? তোমরা কোথায় ছিলে সবাই? কি করে হলো?
‘ সাহেব আমরা তো ঘুম থেকে মাত্রই উঠলাম। বুড়িমার চেঁচামেচি শুনে গিয়ে দেখলাম বৌরাণি মেঝেতে পড়ে আছে অজ্ঞান হয়ে।
রাগান্বিত চোখে বুড়িটার দিকে তাকালো অনুরাগ। বুড়ি ঘোমটার আড়ালে থেকে বলল
‘ বাছা তোমার বউটারে আগে ডাক্তার দেখাও। বেশি আঘাত পেয়েছে বেচারি। বললাম এভাবে দৌড়াইও না। শুনল না মাইয়্যাটা। আমি কি বাঘ না ভাল্লুক?
অনুরাগ বলল
‘ ও আপনাকে ভয় পায় যখন আপনি ওর সামনে না পড়লেই তো হয়। কাল রাতে খাবার টেবিলে ও ও খেতে যায়নি আপনার জন্য। চিনতে, মিশতে তো সময় লাগবে।
‘ তুমি আমার উপর পড়ে দেখাও বাছা। আগে বউ বাঁচাও।
অনুরাগ পাঁজা খোলা করে তুলে নিল আয়নাকে। বলল
‘ ড্রাইভারকে ঘুম থেকে ডেকে তুলো কেউ। সোজা ডাক্তার বাড়ি যাব। তাড়াতাড়ি।
ড্রাইভার তাড়াতাড়ি ছুটে এল। গাড়ি ছাড়লো দ্রুত। অনুরাগের পরিচিত ডাক্তার বাড়ি পৌঁছে গেল অতিশীঘ্রই। পরিচিতির সুবিধার্থে ডাক্তার তাড়াতাড়ির ব্যাথার ইনজেকশন পিশ করে জ্ঞান ফিরানোর চেষ্টা করলো আয়নার। অনুরাগকে বলল
‘ মারাত্মকভাবে ফুলে গিয়েছে। রক্ত জমাই বেঁধে গিয়েছে। ফেটে রক্ত পড়ে গেলে আর ও ভালো হতো।
অনুরাগ উদ্বিগ্ন গলায় বলল
‘ এখন? পড়ে কি কোনো মারাত্মক ক্ষতি হবে?
‘ রক্ত জমাই বাঁধার স্থানে থেকে জমাট রক্ত সরিয়ে ফেলার জন্য ঔষধ দেব। চিন্তা নেই। তবে সাড়তে একটু সময় লাগবে। এই আর কি।
আয়না চোখ খুললো প্রায় আর ও দশ বারো মিনিট পরে। ব্যাথার কারণে চোখ ও ভালো করে খুলতে পারলো না। অনুরাগ গিয়ে ধরলো তাকে। বলল
‘ আয়নামতী তুমি কি হাঁটতে পারবে? নাকি আমি,,
আয়না নিজেকে সরিয়ে নিল। মিনমিনে গলায় বলল
‘ দরকার নেই আপনাকে।
ডাক্তার হেসে ফেলল। ছোট্ট করে বলল
‘ রাগ করেছে আপনার মিসেস।
অনুরাগ বিড়বিড় করে বলল
‘ সে তো আজন্ম রাগ আমার উপর।
_______
গাড়িতে চেপে বসতেই অনুরাগ বলল
‘ বলেছিলাম আমি না আসা অব্ধি ঘর থেকে বের না হতে। বলিনি? আমার কথা শুনোনি কেন?
আয়নার চোখ ব্যাথায় ভেজা এমনিতে। তার উপর অনুরাগের ধমকাধমকি। বুড়ির কথা বললেও বিশ্বাস করবে না। আয়না শুধু বলল
‘ আমাকে মেরে ফেলার জন্য এখানে এনেছেন। আমি বুঝতে পারছি। আপনার তো কিচ্ছু হবেনা আমি মরে গেলে। দু-একদিন আফসোস থাকবে তারপর নেচেনেচে আবার বিয়ে করতে যাবেন আরেকটা। সুন্দর দেখে, লম্বা দেখে, দশ লাখ টাকা পণ নিয়ে। ক্ষতি সব আমার পরিবারের হবে আমার স্বপ্ন গুলো স্বপ্নই থেকে যাবে।
‘ কষ্ট হচ্ছে তারপর ও এত কথা বলতে যাচ্ছ কেন আমি বুঝতে পারছিনা আয়নামতী।
‘ আমার কষ্ট হচ্ছে আপনাকে বলেছি আমি? এত বেশি বুঝতে যান কেন?
‘ আমি বুঝতে পারি।
‘ সেজন্যই ওই জাহান্নামে নিয়ে যাচ্ছেন আবার।
‘ চলে যাব শীঘ্রই। তোমাকে এই অবস্থায় দেখলে মা বকবে আমায়।
‘ আপনার কাজ তো কিছুই হলো না। পরে তো আমার দোষই দিবেন। আমার জন্য সব শেষ, হ্যানত্যান।
কপালে হাত দিল আয়না।
‘ বারবার করে বলছি কথা না বলতে। কতটুকু আঘাত পেলে মানুষ অত সময় ধরে অজ্ঞান থাকে। কাজের গুলি মার।
‘ রাগগুলো তো আমার উপরেই দেখাচ্ছেন। বুঝতে পারছি আমি। সহানুভূতি দেখাবেন না আমায়। আমার সহ্য হয়না দয়া, সহানুভূতি।
‘ আমার সবকিছুই তোমার দয়া আর সহানুভূতি মনে হয়। ভালো চোখে দেখেছটা কি? আমার দোষগুলোই তোমার চোখে পড়ে। শালা আমি ও বেকুব। এসব ভীতুটিতু নিয়ে এইখানে উঠেছি।
কপালে হাত চেপে গাড়ির সিটে হেলান দিল আয়না। গাড়ি একটু উপরনিচ হওয়ায় লাগলো কপালে। উহ শব্দ করে উঠলো। অনুরাগ দাঁত চেপে বলল
‘ বলেছি এদিকে আসতে।
‘ যাব না।
______________
বাড়িটাতে ফিরতেই আবার বুড়ি মুখোমুখি আয়নার। তবে বুড়ির মুখটা ঢাকা। আয়না অনুরাগের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। অনুরাগ বলল
‘ সবটা তোমার মনের ভয় আয়নামতী। কিচ্ছু হবে না। আমি আজকেই গ্রামে ফিরব।
‘ আমি ফিরব না।
‘ আগে ঘরে চলো।
বুড়ি বলল,
‘ বাছা তোমার বউ কি খাবে বলল ডাক্তার?
‘ চাপ দিয়ে খেতে হয় এমন খাবার দিবেন না। নরম খাবার দিবেন।
‘ ঠিক আছে।
আয়নার হাত ধরে নিয়ে গেল অনুরাগ। যেতে যেতে আয়না বলল
‘ আপনি আমার হাত ধরেন কেন হুটহাট? আমি আপনাকে এখনো মানতে পারিনি। ভাববেন না সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
অনুরাগ তাকালো না। হাতটা ছেড়ে দেওয়ায় ঝড়ে পড়লো। তারপর গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল৷ পায়ের আওয়াজে রাগের আভাস স্পষ্ট। আয়না আর এগোলো না। শরীর খারাপ লাগছে। তবে টেরই হলো না বুড়ি এসে দাঁড়িয়েছে তার পেছনে।
____________
দুপুরের খাবার খাওয়া শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরপরই নিচের ঘরে অনেকগুলো লোকজনের গলার আওয়াজ শোনা গেল। অনুরাগের সাথে কথা বলতে এসেছে। আয়না তাই নিচে গেল না৷ সকালে যে ঘরটার দিকে গিয়েছিল সেদিকেই পা বাড়ালো। প্রফেসর এখন বাড়িতে আছে। সমস্যা নেই। বুড়িকে ও কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছেনা৷ আয়না দ্রুত পা বাড়ালো। ঘরটার সামনো গিয়ে মৃদুস্বরে আওয়াজ করে ডাকল
‘ কেউ আছেন ওখানে?
সাথে সাথে কিছু অচেনা শব্দ বের হলো। নড়াচড়ার শব্দ পাওয়া গেল। মাথা ব্যাথা বেড়ে গেল আয়নার। দেখলো দরজায় তালা দেওয়া। বেশ পুরোনো একটি তালা ঝুলছে। দুইজন মহিলা এসে দাঁড়ালো আয়নার পেছনে। আয়না পিছু ফিরে তাদের দেখে ভড়কে গেল।
‘ কি খুঁজছেন আপনি?
আয়না আমতাআমতা করে বলল
‘ চাবি। এই ঘরের চাবি।
মহিলা দুটো চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। আয়না আর কিছুদূর চোখ দিতেই বুড়িকে দেখতে পেল। অনুরাগের সামনে একদম নাক অব্ধি ঘোমটা টেনে রাখে এরা। আয়না বলল
‘ আমাকে এই ঘরের চাবি দিন।
‘ চাবি নেই।
গর্জন ভেসে এল। একজন বৃদ্ধার গলার আওয়াজ এত ঠনঠনে? আয়না বলল
‘ আমি প্রফেসরকে ডেকে আনছি। এই ঘরের দরজা আমি খুলবই। কি লুকিয়ে রেখেছেন এখানে?
‘ শোনো মেয়ে এই বাড়ির সবকিছু জানবে এমন কোনো কথা নেই। এটা তোমার স্বামীর বাড়ি নয়।
‘ বাড়ি হবে। এই বাড়ি ওনি কিনে নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। আর বাড়ির মালিক বিগত তিনবছর ধরে ইন্ডিয়ায় বসবাসরত। এখানে তেমন কিছু থাকার কথা নয়। আপনি তো ওনার সামনে আমার সাথে শক্ত গলায় কথা বলেন না।
বুড়ি অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আয়না শুকনো ঢোক গিললো। তারপর দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল ঘরে। অনুরাগ তখনি ঘরে এল। আয়না বলল
‘ ওই কালো দরজার ঘরের চাবিটা আমায় এনে দিন।
অনুরাগ গেল। আর বুড়ির কাছ থেকে চাবিটা এনে দিল। আয়না চাবি পেয়ে খুশি হলো।
অনুরাগ অন্যদিকে তাকিয়ে বলল
‘ আমাকে বেরোতে হবে। আমার সাথে চাইলেই যেতে পারে। নাহলে এখানে থাকতে হবে।
‘ যাব না কোথাও। ভয় পাইনা আমি।
‘ ঠিক আছে। না বললে তো আবার আমারি দোষ। আমি রাতেই ফিরব।
‘ আমি আপনার ফেরার অপেক্ষায় থাকি না।
‘ ভুলে গিয়েছি। দুঃখিত।
বলেই চলে গেল অনুরাগ। আর যেতে যেতে ভাবলো, এমন একটা দিন আসুক যেদিন আয়নামতী তার জন্য খুব অপেক্ষায় থাকবে, আর সে সেদিন ভুলে ও ফিরবে না। দিনটা হয়ত তার দেখার সুযোগ হবেনা কিন্তু আসুক এমন একটা দিন। খুব ভয়ংকর ভাবে আয়নামতী অনুভব করুক তার অনুপস্থিতি।
আয়না অনুরাগের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ধুর আমি ওভাবে বলতে চাইনি।
অনুরাগ যেতেই আয়না চাবি নিয়ে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। দৌড়ে উপস্থিত হলো ওই ঘরের সামনে। দুইজন মহিলাকে চুপিসারে ডেকে বলল
‘ বুড়ি আসলে বলবেন আমাকে।
মহিলা দুটো আওয়াজ করলো না। আয়না চাবি লাগালো তালায়। বেশ খানিকক্ষন মোচড়ামুচড়ি করার পর যখন তালা খোলার সময় হয়ে এল তখনি চোখে অন্ধকার নামলো আয়নার। মাথার পেছনে শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। ঢলে পড়লো আয়না। বুড়ি এসে লাঠি দিয়ে আয়নাকে ঠেলল। অতঃপর সবাইকে ডেকে বলল
‘ এই মেয়ের এমন হাল কর যেন ওই চৌধুরীর ঢাল না হতে পারে। এই মেয়ে সবকিছুতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাড়াতাড়ি কর নাহলে মরবি।
একজন মহিলা বলে উঠলো
‘ সগিরের উপর দিয়ে ফেলেন। ও সামলাবে।
বুড়ি বলল
‘ না না ওগুলো দিয়ে কোনো কাম হবে না। ওসব করার সময় নেই। ওই চৌধুরী টের পেলে জীবন্ত কবর দেবে। হাত পা ভেঙে যায় এমন কিছু কর। যাতে হাঁটতে না পারে, হাত নড়াতে না পারে।
মহিলা দুটো বলল
‘ বাড়িতো তো আমরা ছাড়া কেউ নেই। দোতলার সিঁড়ি থেকে লাতি মেরে ফেলে দিই?
‘ তাই কর।
__________
ভয় যখন পায় তখন একা ফেলে আসলি কেন? ওকে গ্রামের বাড়ি রেখে না হয় রেখল আসতি।
‘ যাবে না বলেছে রাশেদ ভাই। ত্যাড়া ওই মেয়ে।
‘ তোর ওভাবে একা রেখে আসা উচিত হয়নি। ছোট মেয়ে এখনো। ওখানে কাউকে চেনেনা, জানেনা।
‘ ওরা সবাই আমার বিশ্বস্ত লোক। আমি যতবারই এখানে আসি ততবারই এই বাড়িতে উঠেছি। মা ও কতবার থেকে গেছে। বুড়িমা খুব ভালো মানুষ। আমি সবাইকেই চিনি।
‘ তারপরও।
‘ তুই মিটিংটা শান্তিতে সাড়তে পারবি? পারলে যাহ।
রাশেদের কথায় চিন্তা আরও বাড়লো অনুরাগের। বলল
‘ আমি একবার বাড়ির ফোনে ফোন লাগায়।
‘ কর।
অনুরাগ ফোন দিল। কয়েকবা রিং হলেও কেউ ধরলো না। শেষমেশ বুড়ি ধরলো।
‘ আয়নামতী কোথায় বুড়িমা?
‘ তোমার বউ ঘুমাইতেছে বাছা।
‘ আচ্ছা একটু দেখে রাখবেন।
‘ আচ্ছা। চিন্তার কিছু নেই।
তারপরও চিন্তা কমলো না অনুরাগের। দু’ঘন্টার বৈঠক আধঘন্টায় শেষ করে ফেলল। তারপর পরই রওনা দিল। তবে বাড়ি ফিরতেই দোতলার সিঁড়ির নিচে শাড়ি পড়া একটি রমণীর নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখলো সে। আশেপাশে অনেকেই দাঁড়ানো।
পা দুটো যেন মুহূর্তেই অচল হয়ে পড়লো অনুরাগের । টলমলে পায়ে হেঁটে গেল সে। বসে নিজের বাহুডোরে তুলে নিল আয়নাকে। গাল ছুঁয়ে কোমল স্বরে ডাকল
‘ আয়নামতী? তুমি আমার সাথে এইবার বেশি অন্যায় করে ফেলছ। আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। চোখ খোলো। আয়নামতী?
বাকিরা সবাই ছুটে এল দলেদলে। বলল
‘ আমাদের কথা না শুনেই দৌড়ে নামছিল। পড়ে গিয়েছে সাহেব। বৌরাণির এমনিতেও মাথায় চোট পেয়েছিল। মাথা ঘুরেছিল হয়ত। কারো কথা শোনেনা আপনার বউ।
অনুরাগ বলল
‘ ওকে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। হাত পা ভীষণ ঠান্ডা। আমি আসি, খুন করে ফেলব সবাইকে।
ড্রাইভারকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো অনুরাগ। মুখে ঘষা লেগে ছিঁড়ে গিয়েছে। হাতটা আলগা দেখাচ্ছে। অনুরাগের বুক কাঁপলো দুরুদুরু। কি উত্তর দেবে সে আয়ানকে, আজহার সাহেবকে, আয়শা বেগমকে? সে কেন এই মেয়েকে একা ছাড়তে গেল?
ডাক্তার জানালো। হাতের পেশিতে আঘাত পেয়েছে ভীষণ। কপালে যেখানে চোট পেয়েছিল সেখান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। আর কোমরে আর বুকে ও আঘাত পেয়েছে। পায়ের দুটো আঙুলে জখম হয়েছে।
‘ একদম সুস্থ হয়ে যাবে তো ডক্টর?
‘ এত আঘাত দিচ্ছেন কেন বলুন তো? কপালের ব্যান্ডেজ তো এখনো নতুন।
‘ আমার ভুল হয়ে গেছে ডক্টর।
____________
আয়না চোখ খুললো প্রায় মাঝরাতে। অনুরাগ কাউকে জানায়নি। আয়নাকে নিয়ে চলে যাবে গ্রামে৷ আয়না চোখ খুলে অনুরাগকে দেখে হু হু করে কেঁদে দিল। অনুরাগ বলল
‘ ভীষণ জেদি তুমি। ভালো না এতটা। আমার ভুলটা শোধরানোর একটা সুযোগ তুমি ইচ্ছে করেই দিচ্ছ না।
আয়না নিভু নিভু চোখ বন্ধ করে বলল
‘ আমাকে ওরা মেরেছে প্রফেসর। আপনাকেও মারবে। ওরা আপনার শত্রু। আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র,,,,
অনুরাগ বলল
‘ এখন কোনো কথা নয়। তুমি সুস্থ হও বাকিটা পরে দেখব।
আয়না চোখ খুললো। বলল
‘ আপনাকে ওরা মেরে ফেলবে প্রফেসর।
‘ তুমি তো খুশি হবে৷
‘ নাহ। আমি চাই না এমনটা৷ অন্যায় সমর্থন করিনা আমি।
‘ আমার সাথে তো রোজ রোজ অন্যায় করছ, তার বেলা?
‘ আমি করব, আর কাউকে করতে দেব না৷
‘ অধিকার?
‘ নাহ। আমি অনধিকার চর্চা করতে যাই না।
‘ হৃদয়হীন৷ পাথর।
চলবে,,,,