আয়নামতী #পর্ব_৩৩

0
712

#আয়নামতী
#পর্ব_৩৩
#পুষ্পিতা_প্রিমা

শুকনো মুখে দাওয়ায় বসা ছিলেন আয়শা বেগম। আয়ান আর আজহার সাহেব বাজার থেকে ফিরলো। চোখমুখে আতঙ্ক তাদের। বিষাদগ্রস্ত। আয়শা বেগম তাদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন। ছুটে গিয়ে বললেন

‘ আমার বাছাটার খোঁজ পেলি?

আয়ান বলল

‘ খোঁজ আসবে আম্মা। মুখ এত শুকনো কেন? এখনো কিছু খাওনি?

‘ আমি কিছু খামু না আব্বা। তোর বইনরে খুঁইজা আন আগে। কোথায় হারায় গেল? আমি এজন্যই চাইছিলাম বড় বড় মানুষের লগে সম্পর্কে না জড়াতে। ওদের বড় বড় কাজকারবার। জীবনের প্রতি মায়া দরদ নাই।

আয়ান বলল

‘ অনেক গোয়েন্দা কমিটি ও তাদের খোঁজে নেমেছে আম্মা। টুনি ফিরবে। দোয়া করো শুধু। মায়ের দোয়া বিফলে যায় না আম্মা।

‘ আমি তো সারাক্ষণ তোদের লাগি দোয়া করি আব্বা। কিন্তু এত বিপদ ক্যান আসে?

আয়ান আর কিছু বলতে পারলো না। আজহার সাহেব কোনো কথা ও বলছেন না।
রূপা কাঁদোকাঁদো চেহারায় এসে দাঁড়ালো আয়ানের সামনে। আঙুল ধরে বলল

‘ ভাই আপা এখন কোথায়? কবে আসবে?

আয়ান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বলল

‘ আসবে। কাঁদিস না। আম্মাকে দেখ

__________

আনহিতা প্রচন্ড ক্ষেপে আছে সবার উপর। তার ছেলের খোঁজখবর নেই আর এদের কোনো চিন্তাই নেই সে ব্যাপারে। অনিমা এসে বলল

‘ মা কে বলেছে কারো খোঁজ নেই। ভাই আর আয়নার অলরেডি খোঁজ চলছে। ওই বাড়িটা থেকে নাকি একটা বৃদ্ধার লাশ পাওয়া গেছে। কেউ খুন করেছে ওই বুড়িকে।

আনহিতার চোখে জল। মুখ ও কাঁপছে কথা বলতে। শরীর খারাপ লাগতে শুরু করছে। হাত পা মোচড়ামুচড়ি শুরু হতে দেখে শায়খ চৌধুরী অনিমাকে বলল

‘ তোমার মাকে ঘরে নিয়ে যাও নিমা। অসুস্থবোধ করছে।

আনহিতা বলে উঠলো

‘ নাহ। আমার সোহাগকে এনে দিন। আমি শান্তি পাচ্ছিনা কোথাও। আমার বাচ্চাটা কোথায় কে জানে? আমার কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। ওর যদি কিছু হয় সব আপনার দোষ। কে বলেছে ওসব রাজনীতিতে যুক্ত হতে? আমার সহজসরল ছেলেটা। আমি ছাড়ব না আপনাকে।

শায়খ চৌধুরী সোফায় গিয়ে বসলেন। চিন্তা হচ্ছে ভীষণ। রাশেদ এখনো ফোন করে কিছু জানালো না কেন? পুলিশ ও কিছু জানালো না। কোথায় গেল দুজন? আনহিতা মরেই যাবে ছেলের কিছু হলে।

টিভির রিমোট হাতে অমি এসে বলল

‘ নানুমণি টিভিতে বলছে মামা আর মামির উপর সন্ত্রাস হামলা হয়েছে।

অনিমা গিয়ে মুখ চেপে ধরলো অমির। টেনে নিয়ে গেল। আনহিতা মাথা চাপড়াতে থাকলো। শায়খ চৌধুরী চুপচাপ নিরুপায় বসে থাকলো। কিছুই নেই তার হাতে। তবে উপরওয়ালা অন্যায় যেন না করেন তার ছেলের সাথে। এই বাড়িটার প্রাণ সে।

_________

কালো দুটি খাবার প্লেট আর এক বোতল পানি নিয়ে হাজির হলো মুখ ঢাকা একটা লোক। কুঠুরির নিচে দিয়ে ঠেলে দিল প্লেট দুটো। বলল

‘ এগুলো খেয়ে নিতে বলেছে।

আয়না চুপচাপ দেখলো। পানির বোতলটা নিয়ে অনুরাগের কাছে গেল৷ মাথাটা তার কোলে তুলে পানি খাইয়ে দিল। অনুরাগ পানি খেয়ে আধবোজা চোখ খুললো। বলল

‘ তুমি খেয়েছ?

‘ আমার তেষ্টা পাইনি। আপনি একটু কষ্ট করে উঠুন। খাইয়ে দেই। ভালো লাগবে।

‘ কিন্তু এভাবে কতক্ষণ আয়নামতী? আমরা মুক্তি পাব কবে?

‘ আমি জানিনা প্রফেসর। কিন্তু আপনি এভাবে ভেঙে পড়বেন না দয়া করে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই আমাদের খোঁজে লেগে পড়েছে অনেকে। আপনি শক্ত হন।

অনুরাগ উঠে বসতে চেষ্টা করলো। আয়না বসালো। বলল

‘ কি দিয়ে মেরেছে আপনাকে?

‘ জানিনা। খেয়াল করিনি। বাদ দাও তো। আমার ফোনটা ও নিয়ে নিল। এরা চাচ্ছেটা কি আসলে?

‘ আপনাকে পদত্যাগ করতে বলছে স্বেচ্ছায়। করে দিন।

অনুরাগ চোখ তুলে তাকালো। বলল

‘ এটা তো গায়ের জোরে বলা কথা আয়নামতী। তুমি কি করে সমর্থন করছ?

আয়না ফিরে বসলো অনুরাগের দিকে। বলল

‘ তো কি করব? মরে যাই তাহলে। আপনি ও মরুন। প্রফেসর আমি সাধারণ পরিবারের সাধারণ একটা মেয়ে। এসব রাজনীতি আমি বুঝিনা। বুঝতে ও চাই না। ওরা আমাকে বলেছে আপনি যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্রে সাইন করেন, এবং একটা কারণ দেখাতে পারেন। তাহলে আপনাকে মুক্তি দেবে। নয়ত এভাবে থাকতে হবে। এটা গোপন আস্তানা, কেউ আমাদের খোঁজ পাবে সেটা আমি বলতে ও পারছিনা।

‘ তুমি চলে যাও।

‘ আপনি বললেই আমি যেতে পারছিনা। নাহলে চলে যেতাম।

অনুরাগ এবার সরাসরি তাকালো। বলল

‘ আমাকে ছেড়ে?

আয়না প্লেট বাড়িয়ে দিল। বলল

‘ খেয়ে নিন। খাওয়া জরুরী।

‘ খাব না আমি। শুকনো পাউরুটি খেতে পারিনা আমি। খিদে ও নেই।

‘ পারিনা বললে হবে না। খেতে হবে। অন্তত খিদে না লাগার জন্য খেতে হবে। খান।

অনুরাগ খেল না। বলল

‘ এদের আমি শেষ দেখে ছাড়ব। আমি মাথা নোয়াবো না এদের কাছে। সাহস কত এদের?আমাকে নরম গলায় কথা বলতে দেখেছে, গর্জে উঠতে দেখেনি তাই এতবড় দুঃসাহস দেখিয়েছে। একবার মুক্তি পাই শুধু।

আয়না ক্ষেপে তাকালো। বলল

‘ আপনার এই অনিশ্চিত জীবনের সাথে আমাকে জড়ালেন কেন? কেন জড়ালেন?

অনুরাগ কোনো উত্তর দিতে পারলো না। আয়না তার শার্টের কলার চেপে ধরলো। গিজগিজ করতে করতে কপাল ঠেকল অনুরাগের কাঁধে। বলল

‘ আমি আপনার জীবনসঙ্গিনী হতে পারব না। তাতে আমি একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ছাড়া কিচ্ছু পাব না। আমি পারব না প্রফেসর। পারব না। আপনি আমার সাথে কেন অন্যায় করলেন?

অনুরাগ তার দুহাতের আজলে নিল আয়নার মুখ। বৃদ্ধাঙুলি চেপে কপোল বেয়ে গড়ানো জল মুছে দিতে দিতে বলল

‘ প্রত্যেকটা মানুষের জীবনই অনিশ্চয়তা দিয়ে ঘেরা আয়নামতী। উপরওয়ালা ছাড়া কেউ জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারেনা। মৃত্যু দুয়ারে এসে দাঁড়ালে কেউ তাকে ঠেকাতে পারেনা। তবে কেউ যদি তোমাকে একটি নিশ্চিত ভবিষ্যৎ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে, খোদার কছম আমি সেদিন তোমাকে ছেড়ে দেব। আমার কাছে আর রাখব না।

আয়না বাম হাতটা দিয়ে ঠেলে দিল অনুরাগকে। রেগে বলল

‘ আমি ছাড়ব না আপনাকে।

অনুরাগ হেসে ফেলল। রুক্ষ শুষ্ক ঠোঁটের কোণার হাসিটা দেখার মতো তখন। আয়নার পাশ ঘেঁষে বসে আয়নাকে নিজের কাছে টেনে নিল সে। বলল

‘ ছেড়োনা। আমি ছাড়তে ভুলেও বলব না।

_____________

কুহেলীর কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত একটি চিঠি আসলো সন্ধ্যায়। সে মাত্রই তার বাসায় ফিরেছে। খালেকুজ্জামানের লোক তাকে আজ অনেক খাটিয়েছে। সে আর কোনোকিছু করতে পারবে না। তবে চিঠি কেম আসলো তা খুলে দেখতেই সে হতভম্ব হলো। চিঠিতে লেখা

‘ অনুরাগ চৌধুরী ও তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী নিখোঁজ হওয়ার পেছনে আপনার হাত আছে তা আমরা জেনে গিয়েছি। বিষয়টি জলঘোলা হওয়ার আগেই তাড়াতাড়ি নিজে গিয়ে আত্মসমর্পণ করুন। নইলে আপনার ক্যারিয়ার, আপনার পুরো লাইফটাই শেষ।
ইতি
আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী।

কাগজটা মোচড়ে ফেলল কুহেলী। কে হতে পারে ভেবে ভেবে পুরো ঘরময় পায়চারী করলো সে। দারোয়ানকে বলল

‘ কে দিয়েছে এটা?

‘ পিয়নের মতো একটা লোক এসে দিয়ে গেল। মুখ মাক্সে ঢাকা ছিল ম্যাডাম।

‘ ঠিক আছে। যাও এখন।

দারোয়ান চলে গেল। কুহেলী কাকে যেন একটি ক্ষুদে বার্তা পাঠালো। তারপর তৈরি হয়ে নিল বোরকা পড়ে। উদ্দেশ্য কোনোমতে গা ঢাকা দিয়ে থাকা এই শহর থেকে।

____________

নাচ থেমে গিয়েছে মিনিট দুয়েক আগে। চারপাশে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। পায়ের নুপুরের আওয়াজে ধ্যান ভাঙলো কামালউদ্দীনের। টকটকে লাল চোখজোড়া মেলতেই দেখতে পেল সামনে দাঁড়ানো একটি রমণী। আগাগোড়া ভারী লেহেঙ্গা পড়া। মুখের উপর একটি পাতলা চাউনি।

‘ আমার পাওনা হুজুর।

‘ কি নাম?

‘ জুলিয়া।

‘ খুব সুন্দর নাম। কত চাই?

‘ খুশি হয়ে যা দেন। তবে আমার একটা বিশেষ অনুরোধ আছে হুজুর। আমি ভালো রাঁধতে জানি।

‘ কি কি রাঁধতে জানো।

‘ সব রাঁধতে জানি। আমি আজকে এখানে ভোজের আয়োজন করতে চাই।

দেলোয়ার হোসেন এসে বলল

‘ একজন রাঁধুনীর আসার কথা ছিল। সেই তুমি?

‘ আজ্ঞে হুজুর।

‘ নাচতে ও জানো?

‘ সব পারি। জুতো পলিশ থেকে খুন পর্যন্ত।

বলেই খি খি করে হেসে ফেলল জুলিয়া। বাকিরা স্তব্ধ।
দেলোয়ার ঘোর কেটে বলল,

‘ স্যার ইনি বিশ্বস্ত। খালেক স্যারের ভাগিনা পাঠিয়েছে।

কামালউদ্দীন বলল,

‘ ঠিক আছে যাও। রান্নাঘরে। ওখানে আর ও মানুষ আছে। তবে সাবধান ওই ডানদিকের ঘরগুলোর দিকে এগোবে না।

‘ কেন হুজুর?

‘ প্রশ্ন করবে না। সোজা যাও।

‘ আজ্ঞে।

কামালউদ্দীন টাকা হাজার খানেক ছুঁড়ে মারলো জুলিয়ার দিকে। রাতে আবার ও নাচ দেখতে চাই। রান্না সেড়ে এসো।

জুলিয়া ঠোঁটের কোণায় রহস্য হাসি টেনে বলল

‘ অবশ্যই হুজুর।

কোমরের একগাদা ঝুমকা ঝুমুর করে আওয়াজ করে উঠলো কোমরের ভাঁজে কাপড়ে টাকা গুঁজে ফেলায়। টাকা রাখলো। তবে অন্য কিছু একটা নিয়ে এগোলো রান্নাঘরের দিকে। মুখে সুর টানলো

‘ নাচিয়া, গাহিয়া, দুলিয়া চলি জুলিয়া।

কয়েকজন বিরক্ত নিয়ে তাকালো। জুলিয়া হেসে হেসে চলে গেল। রান্নাঘরে নিজের মর্জি মতো রান্না বসালো । রসালো হাতের রসালো রান্না। ঘ্রাণে ম ম করে উঠলো চারপাশ। গরুর মাংস, মুরগীর রোস্ট, চিংড়িমাছের তরকারি।
প্রায় রাত নেমে গেল ইয়া বড় বড় পাতিলের রান্না শেষ করতে করতে। অনেকে সাহায্য করলো তাকে।

জুলিয়া রান্না শেষে সবাইকে ডেকে বলল

‘ সাহেবদের খাবারের জায়গা কোথায়?

‘ ওই আসরে খাবেন।

জুলিয়া সেখানে থাকা মেয়েগুলোকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিল। তাদের ও জোর করে খেতে বসিয়ে দিল। খিদের চোটে গপাগপ গিলতে বসে গেল সবাই। তার উপর মজার মজার রান্না।
আর যেগুলো আলাদা করে রাখা ছিল সেগুলো নিয়ে এগিয়ে গেল জুলিয়া ওই অন্ধকার কুঠুরির দিকে। তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করলো চারপাশ। অন্ধকার কুঠুরির দিকে এগোতেই দেখলো মোমবাতি জ্বলছে মিটমিট করে সেই কুঠরিতে। সাদা শার্ট গায়ে লোকটির বুকের উপর গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে একজন সাদা শাড়ি পড়া ভাগ্যবতী। জুলিয়ার দৃশ্যটি অনন্য মনে হলো। অসাধারণ মনে হলো।
হেসে ফেলল সে। বলল

‘ আসিয়াছে জুলিয়া
দেখেন চোখ মেলিয়া
আনিয়াছি মজার খাবার রান্ধিয়া।

অনুরাগ তার বন্ধ চোখ খুললো। নড়তে গিয়ে নড়তে পারলো না। আয়নামতী ঘুমিয়েছে। তবে বেশকিছুক্ষণ ডাকাডাকি করতেই আয়নার ঘুম ছুটে গেল। জুলিয়াকে দেখে অনুরাগের কাছ থেকে চট করে সরে পড়লো। দাঁড়িয়ে বলল

‘ কে আপনি?

‘ জুলিয়া।

‘ কি চাই? আমাদের মুক্তি দিন এখান থেকে।

‘ আমি ওসব কিছু জানিনা বাপু। রান্না করেছি, আপনারা খেয়ে শুকরিয়া করুন। আমি যাই।

খাবার প্লেট আর বোতল দিয়ে চলে গেল জুলিয়া। আয়না বামহাতে খাবারের প্লেট টেনে নিল। দেখলো একটি কাগজ সেখানে। অনুরাগ তুলে নিল কাগজটা। খুলে দেখলো সেখানে গুটিগুটি অক্ষরে লিখা

‘ আমি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে এসেছি। আমাকে পাঠানো হয়েছে অনেক কষ্ট করে।
আমি সবার খাবারে কড়া ঘুমের ঔষধ দিয়েছি স্যার । মনে হচ্ছেনা চব্বিশ ঘন্টায় ও জ্ঞান ফিরবে।
সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি আপনাদের পালাতে সাহায্য করব। তার আগে খাবার গুলো খেয়ে নিন। শরীরে শক্তি থাকা লাগবে।

অনুরাগ বলল

‘ খেয়ে নাও আয়নামতী। আমাদের অনেকদূর যেতে হবে।

‘ আমার গলা দিয়ে খাবার নামবেনা। আপনি খেয়ে নিন।

অনুরাগ বলল

‘ আমি খাইয়ে দেই। এদিকে এসো।

‘ যাব না। খাব না। চুপ থাকুন।

অনুরাগ চুপ থাকলো না বরং জোর করে আয়নাকে খাইয়ে দিল। সে আজকাল একটি বেশিই জোরাজোরি করে ফেলছে বোধহয়। থাক না। জোর করে হলেও তো রাখতে হবে।

জুলিয়া বাড়ির বাইরে এসে দেখলো কেউ নেই। গোপন আস্তানা হওয়ায় বাইরে দারোয়ান নেই। যারা পাহারাদার ছিল সবাই খাওয়ায় মগ্ন। ঘুমিয়ে পড়লে মোক্ষম সুযোগ। জঙ্গলের পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে যাবে তিনজন। উত্তেজনায় কাঁপলো জুলিয়া। নিজে একটু আরাম করলো একটা ঘর খুঁজে নিয়ে। কিছুক্ষণ পর দেখলো যে যেখানে পেরেছে সেখানে ঘুমিয়ে পড়েছে। কামালউদ্দীনের কাছ থেকে চাবি খুঁজে নিল জুলিয়া। এক লাতি দিয়ে চেয়ার থেকে ফেলে দিল। পরপর বারকয়েক লাতি দিয়ে বলল

‘ শালা খালেক ব্যাপারীর চামচা। ডিপার্টমেন্টে বলেনি নইলে তোর এমন হাল করতাম আমি!

_________

তালা খুলে দেওয়ার সাথে সাথে আয়নাকে নিয়ে বের হয়ে এল অনুরাগ। জুলিয়াকে বলল

‘ তোমাকে কি যে বলব।

‘ এখন এসব বলার সময় নেই স্যার। আগে এই বাড়ি ছাড়তে হবে।

অনুরাগ আয়নাকে বলল

‘ হাঁটতে পারবে?

আয়না নাকফুলিয়ে তাকালো। জুলিয়া মিটমিট করে হাসলো। অনুরাগ মাথা চুলকে বলল

‘ না ওর হাতভাঙা তো তাই বলছিলাম। আচ্ছা চলো।

জুলিয়া বলল

‘ আমি কিছু মনে করিনি স্যার। আমি আছি তাই ম্যাম লজ্জা পাচ্ছে।

আয়না বলল

‘ যাব নাকি আজকে এখানেই থাকব?

অনুরাগ বলল

‘ অনেক ঘুমিয়েছ। এখন চলো।
জুলিয়া হেসে ফেলল। নিরাপদে বের হয়ে এল বাড়িটা থেকে। জঙ্গলের পেছনে নদীর পাড়ে চলে গেল। সেখানে একটি ট্রলার দেখা গেল। অনুরাগ বলল

‘ গায়ে তো হাওয়া লাগবে।

‘ ওখানে ভেতরে থাকবেন আপনারা। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা বাড়বে স্যার।
আয়না একা একা ট্রলারে উঠে গেল।

অনুরাগ জুলিয়াকে বলল
‘ কৃতজ্ঞ থাকব সবসময়।

‘ আমি ছোট্ট বোন হিসেবে থাকি? বোন তো ভাইয়ের জন্য এটুকু করতেই পারে।

‘ ঠিক আছে।

আয়না ট্রলারে উঠে দাঁড়ালো। অনুরাগ আর জুলিয়াকে দেখে কপাল কুঞ্চন হলো।

‘ এত কিসের কথা? আর সে অসভ্য ডাকলে নাকি খারাপও লাগে।

জুলিয়া আয়নাকে ওভাবে তাকাতে দেখে বলল

‘ ম্যাম কি আমার ছোট হবে নাকি বড়?

‘ কত বয়স?

‘ ২১ চলছে।

‘ তাহলে তো ছোট। ওর উনিশ।

‘ হায়রে তাহলে তো আমি বড় আপু।

অনুরাগ হাসলো। বলল

‘ যাও রেস্ট নাও কিছুক্ষণ। অনেক রান্নাবান্না করেছ।

‘ জ্বি স্যার।

__________

শাঁ শাঁ বাতাস চারপাশে। আয়নার পড়নে সাদা শাড়িটার আঁচল উড়ছে। অনুরাগ পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বলল

‘ সাদা শাড়ি দিয়েছে কে?

‘ ইচ্ছে করে পড়েছি।

‘ এত বিধবা হওয়ার শখ কেন? আমি যাচ্ছিনা কোথাও।

‘ আমি যাব। এত যুদ্ধ করে থাকতে পারব না আমি। সরুন লোকে দেখবে।

অনুরাগ আর ও কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো। আয়না সামনে ফিরে এদিকওদিক চোখ বুলালো। বলল

‘ মেয়েটা কোথায়?

‘ঘুমানোর জায়গায় ঘুমাচ্ছে।

‘ সরুন সামনে থেকে। ভালো লাগছেনা। বাড়ি ফিরি। একমুহূর্ত ও থাকব না আপনার সাথে। এত লড়াই,যুদ্ধ করে আমি কেন কেউ থাকবেনা আপনার সাথে। কুহেলী ঠিক কাজ করেছে একদম। আমি ও চলে যাব।

‘ তোমাকে থাকতে হবে আয়নামতী। যেভাবে আজ ছিলে।

‘ পারব না।

‘ আমি জানি তুমি আমায় ঘেন্না করো না। হয়ত শ্রদ্ধা সম্মানোর জায়গাটা ফিরিয়ে দিতে পারিনি। কিন্তু ঘৃণা সরিয়ে দিতে পেরেছি।

‘ আমার সামনে থেকে যান। আমি একটু একা থাকব।

‘ থাকো।

অনুরাগ চলেই যাচ্ছিল। আয়না এদিকসেদিক তাকালো। আবার ডেকে বলল

‘ দূরে দাঁড়ান। একেবারে যাবেন না।

অনুরাগ হাসলো। পা টিপে টিপে এগিয়ে আসলো। আয়না বলল

‘ দূরে থাকতে বলেছি।

‘ দূরেই তো যাচ্ছিলাম। তুমি যেতে দিলে না।

আয়না কথা বলল না। অনুরাগ এগিয়ে গেল তার দিকে। বলল

‘ বাড়ি ফিরে তোমাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।

‘ লাগবে না।

‘ লাগবে।

আয়না বলল

‘ আমি সোজা আমাদের বাড়ি যাব। আপনাদের বাড়ি যাব না।

অনুরাগের মুখ মলিন হলো। আয়না চোখ তুলে তাকালো। বলল

‘ একদম ওইভাবে তাকাবেন না। আমি গলছিনা। মানুষ এতটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহ্য করতে পারে আমার জানা ছিল না।

‘ তুমি অকারণে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছ তাই সইতে পারছি। ইচ্ছে করে এমন করছ যাতে আমি তোমাকে দূরে সরিয়ে দিই। মন থেকে করছ না।

‘ সবজান্তা তিনি। না বুঝার ভান করে থাকেন। ইচ্ছে করে একদম,,

অনুরাগ হেসে ফেলল। আয়নার বামহাতটা ধরে টেনে আনলো নিজের কাছে। দুহাত দিয়ে ঘিরে ধরলো আয়নাকে। আয়নার চোখে তখন রাগমিশালো জল ছলছল করছে। ক্লান্ত শরীরটা আরেকটু আশ্রয় খুঁজছে।

অনুরাগ হাতটা তুলে হাতের উল্টোপিঠ ভিজিয়ে দিল। বলল,

‘ আয়নামতী আমি রণবীর হব , তুমি আমার রণরঙ্গিণী হয়ে যাও । তোমার চোখ নামিয়ে দেওয়া একটুখানি আশ্বাস আমার শক্তি,আমার অনুপ্রেরণা হয়ে যাক । শুধু জীবনসঙ্গী নয়, তুমি আমার তলোয়ার হয়ে যাও আয়নামতী । যে তলোয়ার থাকলে আমি শক্তিশালী আর না থাকলে নিঃস্ব।

আয়না চোখ বন্ধ করে নিল। চোখের পাতা ভিজলো টুপটাপ। আর চোখের কোণ, মনের শক্ত কোণ। হৃদয়গলানো মন ভোলানো কতশত কথা বলে ফেলল অনুরাগ। কতশত আকুতি, অনুরোধ, আবদার। প্রেমালাপ। সবটা লৌহমানবীর মনে একটু নিজের জায়গা করে নেওয়ার জন্য।
জুলিয়া দূর থেকে হঠাৎ দুজনকে দেখে
ভাবলো ভালোবাসা আসলেই সুন্দর। ভাগ্যবান তো তারাই যাদের খুব করে ভালোবাসার একজন মানুষ আছে। আগলে রাখার একজন আছে। শত তুচ্ছতাচ্ছিল্যর পরে ও যারা ভালোবাসা পায় তাদের কপাল সোনায় মোড়ানো। এই যে তার জীবনের এত লড়াই আর সাকসেসফুল কেসের গল্প। সেসব তার আসল সাকসেস না। তার আসল সাকসেসটা তার খোঁজ নেওয়ার মতো, পাশে থাকার মতো একজন মানুষ। আজ সে অনেককিছুই শিখলো। ধন্যবাদ অনুরাগ স্যারকে। সে তার সবটা দিয়ে তাকে ভালোবাসার মানুষটিকে আগলে রাখবে।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here