আয়নামতী #পর্ব_৩৭,৩৮

0
866

#আয়নামতী
#পর্ব_৩৭,৩৮
#পুষ্পিতা_প্রিমা
পর্ব_৩৭

চৌধুরী বাড়ির চারদিকে মেহমান। অথিতিরা এখনো আসছে। বাড়ির বিশাল উঠোনের প্যান্ডেলের নিচে খাওয়া দাওয়া চলছে বিস্তর।
আয়শা বেগম আর নামিরা পুরো চৌধুরী বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখছে। সায়ান অমির সাথে। অনেক্ষণ অনিমার কোলে ও ঘুরেছে। মেজবানে আসা অনেক অচেনা মানুষের কোল চড়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। নামিরা খুঁজলে ও পাচ্ছে না তাকে। রূপা ও আছে যে সায়ানকে কোলে নিচ্ছে তাদের পিছুপিছু। আয়ান কিছুক্ষণ পরপর এসে দেখে যাচ্ছে ছেলে কার কোলে।
আয়না পরিবারের সবাইকে পেয়ে গল্পে বসেছিল। শায়লা বেগম এসে বললেন

‘ নাতবৌ শাড়ি টারি পড়ে সেজেগুজে নাও। তোমাকে আমার বাপের বাড়ি থেকে অনেকে এই প্রথম দেখবে।

আয়না সেই থেকে গোসল নিল। চুল শুকালো। চুল আঁচড়ালো। তারপর অনুরাগের দেওয়া সেই ব্যাগটা হাতে নিল। এত জিনিস আনা লাগে। পাগল মানুষের কাজকাম।

সোনালি রঙের কারুকাজ শাড়ি কালো পাড়টাই। লাল শাড়ি। বেশ ভারী। সুন্দর। দেখে মনে হচ্ছিল তেমন ভার হবে না। কিন্তু গায়ে দিতেই মনে হলো রাজ্যের ভার যেন।
নেয়েঘেমে অনুরাগ ঘরে এল। কপালের ঘামে চুল ভিজে গেছে। ডোরাকাটা সাদা কালো শার্টটা পিঠে লেগে গিয়েছে।
বাড়ির ভেতরে মেহমান ঢিপঢিপ করছে। এদিকওদিক যাওয়া যায় না। কাজের চাপে বেহুশ হবার পালা। শাড়ি পড়া আয়নাকে দেখে আঁড়চোখে কপাল কুঁচকে তাকালো অনুরাগ। বিড়বিড় করে বলল

‘ মহারাণীকে লালকালো শাড়িতে জম্পেশ লাগছে। স্যালুট মাই পছন্দ।

পরক্ষণেই নিজেই নিজের মাথা চাপড়ে বলল

‘ এই প্রফেসর বউ দেখলেই তোর মাথা ঢিলা হয় ক্যান ভাই? তোরে এসব মানায় না। ইয়াকক। উহুম উহুম।

মুখে হাত দিয়ে আওয়াজ করলো অনুরাগ।

‘ চামেলি আপাকে পাঠাবো নাকি? শাড়ি পড়ায় অসুবিধা হচ্ছে বোধহয়।

আয়না কুঁচি ঠিক করে নিচু হয়ে পিন করছিল। বলল

‘ দরকার নেই। বকবক করতে করতে মাথা খায়।

‘ তাইলে আমি একটু শুয়ে থাকি কিছুক্ষণ। কেউ আসলে বলবে আমি নেই।

‘ মিথ্যে বলব?

‘ জামাইর জন্য বলবে।

‘ আশ্চর্য!

‘ চুপ থাকো। আমি ঘুমাই। তোমার হাতটা কম নাড়াও। ঝনঝন আওয়াজ চুড়ির। উফফ জ্বালা।

‘ এনেছেন কেন?

‘ একশ বার আনব।

উল্টো শুয়ে থাকলো অনুরাগ। ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে।

‘ কতগুলো মানুষ রেখেছে৷ আপনি কি কাজ করে উল্টিয়ে দিয়েছেন? যে এভাবে নেয়েঘেমে এসেছেন। শার্টটা পাল্টান।

‘ আর বলো না। আমি হাঁটতে হাঁটতেই ক্লান্ত। কোনো কাম কাজ করার আগেই ক্লান্ত।

‘ নবাব সাহেব।

‘ নবাব সাহেবা।

মুখ মোচড়ালো আয়না। বলল

‘ তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে যান। শার্টটা পাল্টান। কি হলো?

অনুরাগ উঠে গেল। হনহনিয়ে শার্ট নিয়ে যেতে যেতে বলল

‘ প্রফেসর! তোর বউ আস্ত একটা অজগর।

আয়না শব্দহীন হেসে ফেলল। এত পাগলছাগল মানুষ নিয়ে সংসার করা যায়?

কালো একটি শার্ট গায়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো অনুরাগ। মুখ ভেজা, চুল ভেজা। আয়না তাকে দেখে ভাবলো,এভাবে চুল ধুতে হয় আশ্চর্য তো!

ধপাস করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো অনুরাগ। বলল

‘ শান্তি।

‘ মাথা না মুছে শুয়েছেন কেন? আমার বিছানা ভিজিয়ে ফেলছেন। উঠুন। আরেহ উঠুন না। মাথা মুছুন আগে। প্রফেসর?

অনুরাগ বেডশীট মাথা মুছতে মুছতে বলল

‘ আমাকে ভয়াবহ এক রোগে ধরেছে আয়নামতী । আমি কখনোই এরকম ছিল না। আমার আজকাল অগোছালো থাকতে ভালো লাগে। বউকে জ্বালাতে ভালো লাগে। বউয়ের কাজকাম বাড়ায় দিতে ভালো লাগে।

আয়না বলল

‘ শয়তানে পেয়েছে।

খিক খিক করে হাসা শুরু করলো অনুরাগ। বেডশিটটা পুরো কুঁকড়ে গেল। আয়না বিরক্ত হয়ে বলল,

‘ আমার কুঁচিটা হচ্ছেনা ঠিকঠাক। আপনার এসব ভালো লাগছে না আমার।

অনুরাগ মাথা তুলে আয়নার দিকে তাকালো। আয়না শাড়ির আঁচলটা ফেলে ঝাঁপিয়ে দিল নিজেকে। বলল

‘ ওভাবে কি দেখেন?

‘ আমার বিয়ে করা বউকে দেখি ভাই। তোমার কি তাতে?

‘ পারলে আমার কুঁচিটা ঠিক করে দিন। আমাকে যেতে হবে।

‘ বললাম না। যেই শুয়েছি সেখানে ও জ্বালা। কেউ দেখতে পারেনা আমার ভালা।

‘ বেশি কথা বলেন কেন?

বিছানা থেকে নেমে এল অনুরাগ। ঢিলে পায়ে হেঁটে গিয়ে হাঁটুমুড়ে বসলো আয়নার সামনে। কুঁচি গুলো সুন্দর করে গুছিয়ে পিনআপ করে দিল। বলল

‘ এবার ঠিক আছে?

আয়না মাথা নাড়িয়ে হাসলো। বলল

‘ কুহেলীর শাড়ি ও এভাবে ঠিক করে দিতেন নাকি?

অনুরাগের চেহারায় কালো ছায়া পড়লো । আয়না হেসে ফেলল। বলল

‘ করেননি বললেই তো হয়। আমি কষ্ট পাওয়ার মতো কিছু বলিনি।

‘ দিয়েছি অনেক বার। কোমরে ও গুঁজে দিয়েছি। গয়না পড়িয়ে দিয়েছি। নূপুর পড়িয়ে দিয়েছি। বিয়ের দিন আংটি পড়িয়ে দিয়েছি। কতবার চুল আঁচড়ে দিয়েছি। আরেহ সে কত রঙ লীলা প্রেম লীলার কাহিনী। সব তোমাকে বলতেই লজ্জা করে।

‘ হয়েছে হয়েছে।

আয়নার গলা আধভাঙা।

‘ কেমন বেয়াদব ছিলেন সেটা বুঝতে পারছি আমি। আর বিবরণ দিতে হবে না।

‘ আমার বিয়ে করা বউ ছিল। যা ইচ্ছা তাই,,

‘ বললাম তো ভালো কাজ করেছেন। আশ্চর্য আমি ওসব শুনে কি করব?

‘ তুমিই তো জিজ্ঞেস করলে।

এক এক করে চুড়ি খুলতে শুরু করলো আয়না। অনুরাগ বলল

‘ আবার কি হলো?

‘ আমি পড়িনা এসব চুড়ি। লাল কালো চুড়ি কেউ পড়ে নাকি? ওসব কুহেলী পড়তো। আপনি জিজ্ঞেস করেছেন কখনো আমি কেমন চুড়ি পছন্দ করি?

‘ আরেহ মাথা খারাপ নাকি? খুলবে না আয়নামতী। খবরদার। আমি জানি এসব তোমার পছন্দ হয়েছে। আয়নামতী?

আয়না সবটা খুলতেই থাকলো। নাকের ডগায় টসটসে রাগ। চেপেচুপে থাকা তীব্র অভিমান। ক্রোধ, আক্রোশ।
অনুরাগ এগিয়ে গিয়ে হাতটা ধরে ফেলল চট করে। টেনে হাতটা তার পিঠের কাছে নিয়ে গিয়ে দাঁত চেপে বলল

‘ সমস্যা কি? হাহ?

আয়না সেই হাতটা দিয়ে অনুরাগের পিঠের শার্ট খামচে ধরলো। বলল

‘ শার্টটা ছিড়ে ফেলব একদম। ছাড়ুন।

অনুরাগ কথা দিল না। হাতটা ছাড়লো না। সামনে এনে উপর করে ধরলো। খুলে ফেলা চুড়িগুলো আবার পড়িয়ে দিতে দিতে বলল

‘ হায়রে মেয়ে মানুষ! এদের মন বুঝা দায়। আমি কই যাই ভাই? কোথাও শান্তি নাই।

‘ হাতটা ছাড়তে বলেছি। প্রফেসর?

‘ ডাকটা সুন্দর। ভালো লাগে শুনতে। বারবার ডেকো।

‘ আপনি ছুঁবেন না বলে এখানে এনেছেন আমায়৷ এখন আর ও বেশি বেশি,,

আর কিছু বলতেই দিল না অনুরাগ। বলে বসলো

‘ আরেহ আমি তো প্রতিজ্ঞা করেছি এইবার আর ও বেশি বেশি করে ছুঁবো। আমার বউ, আমি ছুঁবো না তো কে ছুঁবে? আমি ছুঁবো, ছুঁবো,ছুঁবো। বেশি বেশি করে। অনেক বেশি।

‘ আমার হাতে লাগছে।

‘ তুমি চুড়ি না পড়লে আমার আর ও বেশি লাগবে। আমি পছন্দ করে এনেছি। শুধু কুহেলী কুহেলী করো কেন সবসময়? একটা নষ্টা কীটের সাথে নিজের তুলনা করতে বাঁধে না?

উত্তর এল না আয়নার কাছ থেকে।

‘ চেইন আর আংটিটা বানাতে দিয়েছি বিয়ের পরদিন। পছন্দ হয়েছে তোমার? ইউনিক ডিজাইন দিয়েছি।

‘ পছন্দ হয়নি।

অনুরাগ আর জবাব দিল না। ড্রেসিংটেবিলের সামনে থেকে চেইন আর আংটিটা নিল। আয়না শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বলল

‘ আপনি এখান থেকে চলে যান তো। মাথা খারাপ করতে এসেছেন।

কাঁধে বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়া লাগলো ঠিক তখনি। কেঁপে উঠে আয়না বলল

‘ কি করছেন?

অনুরাগ চেইনের হুক লাগিয়ে দিতে দিতে বলল

‘ একদম চুপ। বাঁচাল মেয়ে মানুষ। বউ হয়েছ নইলে এক চড় দিয়ে সোজা করে ফেলতাম। তোমার মতো পুঁচকি মেয়েকে এক ধমকে সোজা করার মতো রেকর্ড আছে ভার্সিটিতে। খোঁজ নিও।

রাগে ফোঁসফোঁস করলো আয়না। চলে যেতে চেয়ে ও যেতে পারল না। অনুরাগ চেইনটা ধরে আছে এখনো। পালাতে গেলেই গলায় ব্যাথা পাবে।

‘ হয়েছে আপনার? যেতে তো দিন।

তখনি উদরে বলিষ্ঠ আঙুলের কিলবিল বিচরণে, গায়ে শিহরণ জাগলো আয়নার। চোখ হলো স্বাভাবিকের চাইতে বড়। শুকনো ঢোক নেমে গেল কন্ঠনালি বেয়ে।
ঝামটি মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো আয়না। অনুরাগের হাতের উপর নিজের দুহাতের বল প্রয়োগ করে বলল

‘ আমি ছাড়তে বলেছি। উফফ জ্বালাতে এসেছেন আমায়।

অনুরাগ হাতটা তুলে ধরলো তার। কাঁধে থুঁতনি ঠেকিয়ে আঙুলে আংটি পড়িয়ে দিল। কানের কাছে আলগা চুলগুলো বেরিয়ে পড়লো তার তপ্ত নিঃশ্বাসে। গন্ধরাজের তীব্র ঘ্রাণ এসে নাক বন্ধ করে দিল আয়নার। হাতটার উপর বেশ দীর্ঘ এক ভেঁজা চুম্বন বসলো ঠিক তখনি। চট করে হাত নামিয়ে নিল আয়না।

‘ আমাকে যেতে দিন।

অনুরাগ যেতে দিল না। ঝুমকো কানের দুলটা ফুঁ দিয়ে নাড়িয়ে দিল। দুলতে লাগলো সেটি। পানি মুড়ে থাকা চুলগুলো ঘাঁড়ে ছোঁয়া পেল। ভেজা চুলের পানি, আর উষ্ণ অধরের প্রতিটি ছোঁয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠলো আয়না। ডান গালে পাশটায় এসে ঠেকলো একটি হাতের তালু। বাম পাশটায় কাঁটাতারের মতো বিঁধে গেল কিছু। নরম গালটাতে মৃদুভাবে নিজের সদ্য ছোটছোট করে রাখা দাঁড়ি দিয়ে ঘষে দিল অনুরাগ। চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল আয়নামতী। কি যেন বিড়বিড় করলো। নিঃশব্দ হাসলো অনুরাগ। নিজের দিকে চট করে ফিরিয়ে নিল আয়নাকে। দু’হাতে কোমড় টেনে এনে নাক ঠোঁট ডুবালো গলায়।

‘ আমি ভিজে যাচ্ছি। চুল ভেজা আপনার। সরুন।

‘ মুছবার দরকার পড়বেনা।

হাত পা জমে গেল আয়নার। যে স্পর্শগুলো, ছোঁয়াগুলো, বাকশক্তি কেড়ে নেয়, যে চাহনি এলোমেলো করে দেয় সবটা, যে উষ্ণ সোহাগে পাথর মনে ভাঙন ধরে, আর যে বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে থাকলে নিজেকে সুরক্ষিত মনে হয়, আর শক্ত বুকে মাথা ঠেকলেই শান্তি অনুভব হয় সেসবকেই ভালোবাসা বলে বুঝি?
ভালোবাসা পাওয়া মানুষগুলো নয়, বরং নিঃস্বার্থে ভালোবাসতে জানা মানুষগুলো খুব সুন্দর হয়।
ভাবনার রেশ কাটতেই আয়না বন্ধ চোখের পাতায় পেল কোমল ছোঁয়া। গন্ধরাজের ঘ্রাণ তখন তীব্র। একেবারে ভেতর কাঁপিয়ে দেওয়া। আয়নার ঠোঁটের কোণায় আলতো হাসির দেখা মিললো। চট করে চোখ মেলে অনুরাগকে দেখে বলল

‘ পাগলরা নিঃস্বার্থ ভালোবাসে। আপনি সুস্থ একজন মানুষ৷

‘ একটা কথা বলি। কান দাও, চুপিসারে বলি।

আয়না কান দিল। অনুরাগ ফিসফিস করে বলে গেল,

‘ অনুরাগ চৌধুরী আয়নামতী ছাড়া পুরো পৃথিবীর সামনে সুস্থ স্বাভাবিক একজন মানুষ।

কানে ঠান্ডা ছোঁয়া না মেখেই নিজেকে সরিয়ে নিল আয়না। অনুরাগের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বলল

‘ আপনাকে আমি ওসব ভালো টালো বাসি ন…..

বাকিটা কি বলতে চাইলো কে জানে? তবে বলতে পারলো না অনুরাগের কারণে। কারণটা ও ভীষণ ব্যক্তিগত।

চলবে ??

#আয়নামতী
#পর্ব_৩৮
#পুষ্পিতা_প্রিমা

বাড়ির ভেতরে অনুরাগকে প্রবেশ করতে দেখা গেল। বসার ঘরে সবাই ছিল। আয়না ছিল না শুধু। শায়লা বেগম আদা দিয়ে গরম চা করে দিতে বলেছিল চামেলিকে। আয়না সেটি নিয়ে আসতেই অনুরাগের মুখোমুখি পড়লো। চোখাচোখি হলো। অনুরাগের নির্বিকার চাহনি। চলে গেল সে। আয়নার কপাল কুঞ্চিত হলো। প্রফেসর তার দিকে ওভাবে তাকালো কেন?
আয়না শায়লা বেগমকে চা দিয়ে ঘরের দিকে যেতেই অনুরাগকে আবার বসার ঘরে আসতে দেখলো। তাই চুপচাপ এককোণায় দাঁড়িয়ে রইলো। অনুরাগ পকেট থেকে একটি মুড়িয়ে থাকা সংবাদপত্রের খানিকটা অংশ বের করলো। টি টেবিলে রেখে দিল সেটি। তারপর শায়লা বেগমের পাশে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলো। শায়লা বেগম বলল

‘ এটা কিসের খবর দাদুভাই? আমি তো চোখে দেখিনা। পড়ে শোনাও।

‘ পারব না।

‘ রাগ কেন? আচ্ছা আমি নাতবউকে ডাকি।

আয়নাকে ডাকতেই পা টিপে টিপে এল আয়না। অনুরাগের চোখ নিচে নিবদ্ধ। কোনো দিক তাকালো না সে।

‘ পাশে এসে বসো নাতবৌ। এদিকে আসো আমার পাশে।
আয়না শায়লা বেগমের ডান পাশটায় গিয়ে বসলো। ছেঁড়া সংবাদপত্রের অংশটা হাতে নিতেই দেখলো একটা অংশে অনুরাগের ছবি, অন্য অংশে কুহেলীর অর্ধনগ্ন ছবি। হেডলাইনটা পড়েই চমকে অনুরাগের দিকে তাকালো আয়না। চক্ষুকোটরে অবিশ্বাস্য কৌতূহল। মেঝের দিকে এখনো চোখ নিবদ্ধ অনুরাগের। শায়লা বেগম বলল

‘ কি লিখা আছে নাতিবৌ? পড়ে শোনালে না কেন?

আয়না বলল

‘ আপনি চা টা খেয়ে নিন না। ঠান্ডা হয়ে গেছে বোধহয়।

শায়লা বেগম অনুরাগকে বলল

‘ তুমি পড়ে শোনাও। এখানে কুহেলীর ছবি কেন?

অনুরাগ ধপধপ্ হেঁটে চলে গেল। আয়না গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। রান্নাঘরে চলে গেল। চামেলির বকবকানি ভেসে আসছে। আয়না তার বাকি কাজগুলোর দিকে হাত বাড়ালো। পেঁয়াজ, মরিচ আর ধনেপাতা কুঁচি করা দরকার। চামেলি মাছগুলো পানি দিয়ে ধুতে ধুতে বলল
‘বৌরাণির মন খারাপ ক্যা? কোনো চমচ্যা?
‘ নাহ।
আর কোনো কথা বাড়ালো না চামেলি। অন্যসময় আয়না নিজ থেকেই এটা ওটা বলে। এখন বলছে না। যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তারা। মরিচ আর ধনেপাতা কুঁচি করে সবুজ রঙের বাটিতে রাখলো । পেঁয়াজ কুঁচি করার সময় অসাবধানতায় আঙুলের মাথা কেটে গেল। চামেলি বলল

‘ বৌরাণি তোমার জামাই মানে ছোটচাহেবের জন্য মাছ ভাজা রান্না করতে বলছে। গলায় নাকি কি ইফিকচন,,

জমিলা ঝামটি মেরে বলল

‘ ইনফেকশন গাদী। বৌরাণি মাছ কম ঝাল করতে বলছে বড়মা। ঝোল ছাড়া। ছোট সাহেবের খেতে কষ্ট হবে।

আয়না দাঁড়ালো। শাড়ির আঁচলে আঙুলটা চেপে ধরে চলে গেল। জমিলা বলল

‘ কি হয়ছে রে?

চামেলি চপিং বোর্ডে তাকালো। কাটারে রক্ত লেগে আছে। বলল

‘ বৌরাণির কি হাত কাটলো নাকি? ওমা রক্ত কেন?

জমিলা বলল

‘ শীগগির যাহ। বড় মাকে বল। নইলে পরে আমাদের সাথে খ্যাকখ্যাক করবে।

‘ আইচ্ছা যাইতাছি।

______________

দশটার দিকে পাহাড়তলীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল অনুরাগ । মুখটা থমথমে ছিল যতক্ষণ বাড়িতে ছিল। আনহিতা এটা ওটা বললেন মুখ দিয়ে কথা বের হলো না তার। খেতে বললে ও খেল না।
আয়নাকে কিছু বললে ও কিছু বলল না সে। সারাদিন বিষণ্ণতায় কাটলো আয়নার। কুহেলী ছাড়া পেয়ে এত জঘন্য কাজ করবে ভাবতে ও পারছেনা আয়না।

তখন রাত সাড়ে নয়টা। বিছানা তুলে ঝেড়ে ফেলল আয়না। বেডশীট বিছিয়ে দিল । পুরো ঘরের আনাচকানাচ ঝেড়ে ফেলল। ঝাড়ু দিয়ে ঝাড় দিতেই তিনটি ছেড়া ছবির টুকরো পেল সে। তারই ছবির অংশ। ছবিটা দুইবছর আগের সেই হাসি-হাসি মুখের ছবিটা। যেটা অনুরাগকে দেখানোর জন্য দিয়েছিল। এতদিন পর ছবিটা! তাও ছেঁড়া। অনুরাগ তার ছবিটা ছিঁড়ে ফেলেছিল? দপদপ করে জ্বলে উঠলো আয়না। আজ আসুক। এত সুন্দর সূক্ষ্ম অপমানে মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে উঠলো আয়নার। সে এতটা তুচ্ছ! বলতে না বলতেই ঘন্টাখানেক পরে অনুরাগ বাড়ি ফিরলো। চেহারা শুষ্ক, রুক্ষ। আয়না ঘরে থম মেরে বসে রইলো। অনুরাগ রাতের খাবার খেতে বসে চামেলিকে ডেকে নিল। বলল

‘ ডেকে নিয়ে আসো। বাবা খেয়ে নিয়েছে। ও এখানে খেতে পারবে।

‘ খাবে না বলচে।

‘ কেন খাবে না? কে কি বলেছে?

‘ কেউ কিচ্ছু বলেনাই। আঙুল কাটছিল রান্নাঘরে। দুপুরে চামচ দিয়ে খাইছে। এখন নাকি খাবে না।

‘ আমি ডেকেছি বলো। যাও।

‘ যাইতাছি বাপু। চবচময় জ্বালায়।

চামেলি ডাকলো আয়নাকে। আয়না মুখের উপর বলল

‘ খাব না আমি। অত দরদ দেখাতে হবে না কারো। আপনি যান।

চামেলি চলে গেল গাল ফুলিয়ে। অনুরাগকে গিয়ে বলল

‘ দরদ না দেখাতে বলছে।

অনুরাগ আর কথা বাড়ালো না। আনহিতাকে বলল

‘ না খেলে না খাক। মা তুমি বসো।

‘ না। আরেকবার ডেকে দেখি না?

‘ দরকার নেই। এটা ওর বাপের বাড়ি নয়।

‘ অনু?

‘ ঠিক কথায় বলেছি।

আনহিতা কথা বাড়ালো না। চুপচাপ খেয়ে নিল। অন্য প্লেটে খাবার বেড়ে অনুরাগকে দিল। বলল

‘ মাঝরাতে খেয়ে নিতে বলো। তখন খিদে আসবে।

অনুরাগ বলল

‘ আমি পারব না। চামেলি আপাকে দিয়ে পাঠিয়ে দাও।

আনহিতা ভারী অবাক হলেন ছেলের ব্যবহারে। আর না পেরে বললেন

‘ কি হয়েছে অনু? তোমার ব্যবহার ভালো ঠেকছে না আমার।

‘ তোমার বৌমার কাছ থেকে জেনে নিও। আমি কি বলব মা?

দাঁড়ালো না অনুরাগ। সোজা ঘরে গেল। ধাক্কা দিল দরজা৷ খুললো না। আয়না বিছানায় বসা ছিল। পড়ছিল বই নিয়ে। সামনে তার পরীক্ষা কলেজে। বাড়িতেই পড়া দরকার। কলেজে যাওয়া হয় না। অনুরাগের দরজা ধাক্কানো খুলতেই ইচ্ছা হলো না। খুললো না। বসেই থাকলো৷ খুলতে বললে খুলবে।
অনুরাগ প্রায় চার পাঁচ মিনিটের মতো দরজা ধাক্কা দিয়ে গেল৷ আয়না ও খুললো না। শেষমেশ গুরুগম্ভীর গলা ভেসে এল

‘ আমাকে কি আজকে বাইরে ঘুমাতে হবে?

বিছানা থেকে নামলো আয়না৷ ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে দরজা খুললো৷ কোনোদিক না দেখে আবার বিছানায় উঠে বসলো। অনুরাগ হেঁটে গিয়ে টেবিলের কাছটাই গেল দেখলো তিনটা টুকরো। তাও একটা ছবির। সাজিয়ে রাখা। মানে জোড়া দেওয়া। ছবিটা কোথা থেকে এতদিন পর। এত খুঁজে ও পেল না সে। আজ কোথা থেকে?

‘ এইটা এখানে কি করে?

বই থেকে মুখ সরালো আয়না। মুখ দিয়ে অনেককিছুই বের হলো তবে বলল না। শুধু বলল

‘ কুড়িয়ে পেয়েছি। উচ্ছিষ্ট নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কি দরকার?

‘ উচ্ছিষ্টই যখন টেবিলে কেন রাখা হলো?

প্রচন্ডরকম আহত হলো আয়না। এক লাফে বিছানা থেকে নামলো। ছবির টুকরো গুলো কুঁচি কুঁচি করলো তারপর ফেলে দিল। অনুরাগ ভুরু কুঁচকে তাকালো। বলল

‘ সমস্যা কি?

রক্তচোখে তাকালো আয়না। বলল

‘ আমার ছবি ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন তখন। আবার আমার প্রতি এত দরদ কোথা থেকে আসলো?

‘ আমি ছিড়িনি৷ না জেনে মিথ্যে অপবাদ দেবে না খবরদার। গলার আওয়াজ তো বেশ উঁচু। নিজে ভুল করো আবার শাসাও আমাকে। কি পেয়েছ তুমি?

কে যেন এগিয়ে আসছে তাদের ঘরের দিকে। অনুরাগ সোজা দরজা বন্ধ করে দিয়ে আসলো। বলল

‘ কে ছিঁড়েছে তোমার ছবি? কে?

‘ আপনি। কে ছিঁড়বে আর? আলমিরার কোণায় ঝাড়ু দিতেই বেরিয়ে এল।

‘ আমি করিনি। কুহেলীর কাজ৷

আয়না চুপসে গেল। চোখ নামিয়ে নিল। চুপ করে থাকলো। অনুরাগ বলল

‘ চুপ কেন? কুহেলী তো বন্ধু হয় তোমার। তাই চুপসে গেলে? আর আমি তো শত্রু।

‘ কুহেলী কেন আমার ছবি ছিঁড়বে? আর কুহেলী যখন আপনার বউ তখন আমার ছবি এই ঘরে কি করছিল?

‘ জানিনা। কুহেলীর নাম ধরেছি বলে খারাপ লাগছে?

‘ আমি চাই না কথা বাড়ুক।

‘ এখন তো কিছুই চাইবে না তুমি। কুহেলী আমার শত্রু, কিন্তু তোমার বন্ধু। সে কি বলল তার ভক্তদের! অনুরাগ চৌধুরী তার উপর দুর্বল। তার সৌন্দর্যে মাতোয়ারা। আবার তাকে ফিরাতে চাইছে নিজের কাছে। ভুলের ক্ষমা চেয়েছে। সে নিজে কোনো ভুল করেনি বরঞ্চ অনুরাগ চৌধুরী নিজের ভুল স্বীকার করে সমস্ত অভিযোগ তুলে নিয়েছে তার উপর থেকে। ছাড়াছাড়ির বছর না পেরোতেই যেই লোক দ্বিতীয় বিবাহ করে সেই লোকের কাছে ফেরার কথা ভাবতে ও পারেনা কুহেলী।

কি সুন্দর বিবৃতি দিল কুহেলী।

আমার সব মানসম্মান ধুুলোয় মিশে গেল। তারপর ও সে তোমার বন্ধু। আমি মুখ খুলিনি এখনো। এড়িয়ে গেছি, যাচ্ছি সাংবাদিকদের প্রশ্ন। কারণ কুহেলী সরকার আয়নামতীর বন্ধু হয়।

আয়না একটু করে তাকালো তার চোখের দিকে। আবার চোখ নামিয়ে দিল।

‘ আমাকে আর কতভাবে তুমি অপমান করবে আয়নামতী? আমি তোমাকে আমার শক্তি, অনুপ্রেরণা ভাবি। আর তুমি জেনেশুনে কলঙ্কিত করছ আমায়। শাস্তি কি এখন ও শেষ হয়নি? আর বাকি থাকলে দিয়ে দাও। কারণ আমি মনে করে ফেলছি হয়ত থাকতে থাকতে তুমি এই সম্পর্কটার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছো। কিন্তু নাহ। তুমি ঠিক আগের মতোই আছ। যে আমার কষ্ট বুঝা তো দূরে থাক, কষ্ট দিতেই পছন্দ করে। আমার অপরাধ আমি তাকে জোর করে বিয়ে করেছি। আর কি কি শাস্তি বাকি রেখেছ আয়নামতী? বুকে ছুরি চালানো?

‘ আপনি বাড়াবাড়ি করছেন।

হাতের বাহু খামচে ধরে তার সামনে আয়নাকে এনে দাঁড় করালো অনুরাগ। বলল

‘ দ্বিতীয় বিয়ে করে প্রাক্তনের উপর কেন দুর্বলতা!
হাজার হাজার লোকের সামনে এই প্রশ্ন তোমাকে করা হলে তুমি কি বলতে আয়নামতী?

‘ লাগছে আমার।

চট করে ঠেলে দিল অনুরাগ। বলল

‘ আরেহ কাকে কি বুঝাই আমি? এই মেয়ে কে হয় আমার? ওই বিয়ে নামক শব্দটা ছাড়া তো কিছুই নেই তোমার আমার মাঝে। ভালোবাসা টালোবাসা তো বহুদূর, সামান্য মায়া ও হয় না তোমার? রাস্তার কুকুর বিড়ালেরা ও তো তোমার সহানুভূতি পায়। ওই রূপা ও তো পরের মেয়ে। তাকে আপন করতে তো কষ্ট হয়নি। আমিই কেন সবকিছু থেকে অতটা ব্যাতিক্রম? আমার অপমানগুলো তোমার অপমান হওয়া উচিত ছিল। আর আমার সুনামে তোমার গর্ব। এটাই স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক আয়নামতী। ভেবেছিলাম আমি এসব কথা তুলবই না তোমার সামনে। সব ভুলে থাকব। সয়ে যাব। তুমি নিজ থেকে এসে কথা বলবে আমার সাথে । তোমার ভুল ভাঙবে। আমার সেই ছোট্ট বিন্দুকণার মতো রাগগুলো তোমার কথায় চট করে সরে যাবে। তুমি রাগ ভাঙাবে। একটুখানি অনুতাপ নিয়ে তাকাবে।
কিন্তু তুমি ওই ছোটখাটো ইস্যু নিয়ে যার কারণ ও কুহেলী, সেটার দায় চাপিয়ে দিয়ে যাচ্ছ আমার ঘাড়ে। দিয়েই যাচ্ছ যখনও তোমার সামনেই সত্যিটা। দেখে ও দেখো না তুমি। কারণ আমার ওই একটাই দোষ। আমি ভালোবাসি তোমায়। একটু বেশিই যত্নে রাখি তোমায়।

এতক্ষনে আয়নার গাল ভিজে উঠেছে। হাতের মুঠোয় শাড়ি। ডুকরে উঠছে কিছুক্ষণ পরপর।

‘ কুহেলীর মাকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়েছে। ফিরলে একবার দেখে এসো। আর কুহেলীকে বলে এসো তার নাম জপে জপে আমি ঘুমাতে যাই। তাকে ভেবে ভেবে দিনরাত পার হয় আমার। কুহেলীকে নয়, পারলে পুরো দুনিয়াটাকেই জানিয়ে দিও। পারলে সাথে এটা ও জানিয়ে দিও, কুহেলী নয় বরং তুমিই আমার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল।

চোখের কোণায় তীব্র বিতৃষ্ণা অনুরাগের।

আয়না চুপচাপ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো। আওয়াজ অনুরাগের কান পর্যন্ত গিয়ে ঠেকল শুধু।

‘ আমি তোমাকে আঘাত করে কথা বলতে চাইনি। নিজের জায়গাটা বুঝে নিয়েছি। খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আর আঙুলে মলম লাগাও। আমি বাইরে গেলাম।

‘ আপনার ঘরে আপনি থাকুন। আমি যাই।

চোখভর্তি, গালে লেপ্টে থাকা জল নিয়ে কথাটা বলল আয়না। সশব্দে হেসে ফেলল অনুরাগ।

‘ আমার ঘর, আমার বাড়ি, আমার রাজত্ব। কিন্তু ক্ষমতা তো তোমার হাতে।

চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অনুরাগ। আয়না বিছানায় বসে থাকলো। অনেক্ক্ষণ বসে বসে ইচ্ছেমত কাঁদলো। চামেলি খাবার এনে দিল। আয়নার চোখ ফোলা দেখে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলো৷ কিন্তু করলো না। শায়লা বেগম এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেল কোনো কথা ছাড়া । আনহিতা এসে মলমের কৌটো দিয়ে গেল। বলে গেল

‘ মনে করে লাগিয়ে দিও বৌমা । তুমি না পারলে অনুকে বলো। ও লাগিয়ে দেবে।

আয়না ভাত খেয়ে নিল । তারপর মলমের কৌটো নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তিন তলার সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে অনেক কষ্ট করে ছাদে উঠলো। ছাদে বড় সাইজের বাল্ব লাগানো। বিশাল ছাদটাতে এত বড় বাল্বটা ও পোষাতে পারলো না। আবছা আবছা অন্ধকারে ছাদের আনাচকানাচে ছেয়ে আছে। তবে রাতের আকাশ ঝলমলে তাই আয়নার ভূতভয় বেশি জমতে পারলো না। ভয় আর ও কেটে গেল যখন দেখলো ছাদের কোণায় দাঁড়ানো একটি লম্বাটে সৌষ্ঠব দেহা অবয়ব। মাথা নিচু করে কি যেন করছে। একটিবার থমকালো আয়নামতী।

অনুরাগের হাতে সিগারেটের প্যাকেট। সিগারেট। সিগারেটের প্যাকেটে আগুন লাগিয়ে দিল। দাউদাউ করে সেটি জ্বলে গেল। তারপর ধরালো সিগারেটের মুখে। হঠাৎ পেছনে নরম পায়ের আওয়াজ, আর ফোঁপানির শব্দে সম্ভিৎ ফিরলো তার।

‘ আপনি সিগারেট খান প্রফেসর?

ফোঁসফোঁস করে কথাটা বলল আয়না।

গায়ে হালকা গোলাপি রঙের শাড়িটাতে রঙ খুলে গেছে তার। কান্নায় চোখমুখ ফুলে টুইটুম্বুর। লম্বা বেণুনী কোমরে পড়ে আছে। লম্বা সিঁথিকাটা মাথায়। মাথায় কাপড় দেওয়া নেই।

অনুরাগ বলল,

‘ প্রফেসর মানুষ সিগারেট খায় না। খেলে ও বিরাট সমস্যা হবে এমন ও না।

‘ আমি জানিনা আপনি সিগারেট খান।

আলতো বাঁকা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখলো অনুরাগ। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল

‘ এতরাতে এখানে কি? ঘরে যাও।

আয়না এগিয়ে এল। জ্বলন্ত সিগারেট কেড়ে নিল অনুরাগের কাছ থেকে। ফেলে দিল। পায়ের দু ফিতার জুতোর তলায় পিষে ফেলল সেটি। তারপর নাক টানতে টানতে বলল “গন্ধ”।

অনুরাগ অন্যদিকে তাকানো। আয়না নাক দিয়ে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে মুখ নিয়ে গেল অনুরাগের মুখের কাছে। মুখোমুখি নাক টেনে গন্ধ শুঁকে বলল

‘ গন্ধরাজের গন্ধ , সিগারেট নয়।

মুখে হাসি আয়নার। মলমটা বাড়িয়ে দিল অনুরাগের দিকে। আঙুল ও বাড়িয়ে দিল। মলমটা নিল অনুরাগ। কৌটো খুলতে খুলতে অন্যদিকে তাকিয়ে জবাব দিল,

‘ আগেই বলেছি সিগারেট খাই না আমি।

‘ তাহলে হাতে সিগারেট কেন?

‘ আমাকে দেখামাত্র তড়িঘড়ি করে চলে গেল বাবা। ফেলে গেল প্যাকেট।

‘ ওহহ।
আহহ একটু ধীরেধীরে লাগান। অনেকটা কেটেছে।

‘ মন কোথায় ছিল?

‘ সত্যি বলি?

চোখ তুলে তাকালো অনুরাগ।

‘ সত্য শুনতেই মজা। যদিও হয় বিষাক্ত।

‘ আপনার বকা খাওয়ার ভয়ে অন্যমনস্ক ছিলাম। বাঁচতে পারলাম কই?

‘ বকা? বকা কোথায় দিলাম? ওগুলো আমার ভুলের বিবরণ।

‘ আমি কি জানতাম নাকি কু,,

‘ থাক ওসব কথা। ভালো লাগছে না।

আয়না মলমের কৌটো নিয়ে ফেলল। দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো অনুরাগের বুক। চওড়া বুকটাতে নিজের জায়গা করে নিয়ে গুটিসুটি মেরে পড়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর বলে উঠলো

‘ আপনি আমায় ধরছেন না কেন? আশ্চর্য! কত বকেছেন আমায়। তারপর ও তো কাছে এসেছি। অভদ্র মানুষ। অনেক তো জ্ঞান দিলেন। আমি খারাপ সেটা জানি আমি। ভালো সাজতে যাই না। যাচ্ছি ও না।

অনুরাগ দুহাত বাড়িয়ে কোমল শরীরটা নিজের দুহাতের বাঁধনে নিল। মাথাটা বুকে চেপে বলল,

‘ আর কত রাগারাগি? মান অভিমান জমিয়ে রাখা আর দূরে থাকা। সবকিছুর হিসাব এবার চুকিয়ে ফেলা দরকার। একেবারে চলে যাও নয়ত, পরিপূর্ণ আমার আয়নামতী হয়ে যাও। তুমি কি বলো?

‘ আমাকে আজকাল আয়না নামে কেউ চেনেনা প্রফেসর। আপনি আমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন। আপনার আর ও শাস্তি বাকি।

‘ শাস্তি হিসেবে তোমার হাতের নখগুলো এভাবে পিঠে বিঁধে থাক তাহলে।

‘ থাক। মলম তো আছে।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here