আয়নামতী #পর্ব_৪৩ শেষ

0
1890

#আয়নামতী
#পর্ব_৪৩ শেষ
#পুষ্পিতা_প্রিমা

ডিসেম্বর মাস৷
সন্ধ্যা নামতেই হাঁড় কাঁপানো শীতের প্রকোপ আর ও বেড়ে গেছে। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে নকশা তোলা রঙবেরঙের ছোট্ট ছোট্ট কাঁথাগুলো একটার উপর আরেকটা ভাঁজ করতে লাগলো আয়শা বেগম। পালঙ্কে বসে থাকা গরম চা টানা আজহার সাহেবকে বললেন
‘ কাঁথাগুলো সুন্দর হয়ছে না বাবুর আব্বা?
‘ হুমম সুন্দর।
‘ মন থেইকা বলতাছেন তো?
‘ কি আশ্চর্য মহিলা তুমি আয়েশা! সুন্দর মানেই সুন্দর। তোমার সব কাজ সুন্দর।
আয়শা বেগম হেসে ফেললেন। বললেন
‘ একটা কথা বলেন তো। আমাদের বোন আসবো নাকি ভাই আসবো?
‘ আল্লাহ যেটা দেয়। তাতেই খুশি।
‘ আমার একডা বোন পাইলে আর কিছু লাগবো না। দিনকাল তো আইসা পড়ছে। আমার বাচ্চাটা কেমন আছে, ফোন দেওয়া লাগবো একটা।
‘ ফোন দাও। ফোন দাও৷ ওসব নিয়ে হেলা করো কেন বুঝিনা। ছেলেমেয়ে দুটো ছাড়া কে আছে আর আমাদের?

নামিরার ডাক শোনা গেল উঠোন থেকে। আয়শা বেগম কাঁথাগুলো পাশে রেখে হেঁটে বের হলেন ঘর থেকে। উঠোনের দিকে যেতে যেতে বললেন

‘ কি হয়ছে বউ? ডাকো ক্যান? ওইভাবে ডাকলে ডর লাগে আজকাল।

নামিরা এগিয়ে এল। স্বাভাবিক গলায় বলল

‘ আম্মা আয়নাকে পাশের হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি আয়ানকে বলেছি। ও বলছে আপনি আর আব্বাকে চলে যেতে। ও আসছে, এখানে কাজ না হলে শহরে নিয়ে যাবে।

আয়শা বেগম বলে উঠলেন

‘ আর দুইতিন সময় আছে বলছিল না?

‘ আম্মা সব কি ঠিক সময়ে হয়? ডাক্তাররা একটা আনুমানিক সময় বলে।

‘ জামাইটা ও তো নাই দেশের বাড়ি। খাগড়াছড়ি। কি হবে এখন?

‘ আপনাদের জামাই নাই তো কি হয়েছে। বাকিরা তো আছে। আয়নার শ্বশুরের অনেক চেনাপরিচিত ডাক্তার আছে। ওনি সামলে নিচ্ছে। এখন ফোনটা উনিই করেছেন। চিন্তা করিয়েন না আম্মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। চৌধুরী সাহেব বোধহয় চলে আসবেন তাড়াতাড়ি।

বকবক করতে করতে বাড়ির ভেতর পা রাখেন আয়শা বেগম। ছুটতে ছুটতে রূপা হাজির হয়। দৌড়ে এসে আয়শা বেগমকে বলে

‘ জেম্মা আপার খুব শরীর খারাপ। বড় গাড়িতে করে তুলে নিয়ে গেছে আপাকে। আমি দেখছি গাড়িটা।

আয়শা বেগম দুরুদুরু বুকে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন। রূপাকে বললেন

‘ তোর জ্যাঠাকে বলে আয় তো দেখিনি। আমি গলা ভেজায় আগে। হুন তোর আপা ভালাই ভালাই হাসপাতাল থেকে চইলা আসলে বড় মোরগটা সদকা দিয়া দিবি, গ্রামের পাগলী কানুবিবিরে তিন কেজি চাল দিবি। সবজি বাগান থেইকা কয়েকটা সবজি দিয়া দিবি সাথে।
আমার মনে থাকেনা। তোর মনে থাকবো?

‘ থাকবে জেম্মা।

‘ ভালা মাইয়্যা। তোর ভাবিরে মনে করাইয়া দিবি। বুঝছোস? এবার যাহ আলমিরা থেইকা আমার বোরকা বাইর কর। জুতোজোড়া বাইর কর। আমি চোখে কিছু দেখতেছি না। সব আন্ধার লাগতেছে।

‘ তুমি চিন্তা করিওনা জেম্মা। আপার সাথে সবাই আছে। আপার তো মিষ্টি একটা বাবু আসবে। আমাদের বাবুর একটা খেলার পুতুল আসবে।

‘ বাবু কোথায়?

‘ ঠোঁট উল্টে ঘুমোচ্ছে। সন্ধ্যাবেলা ঢুসে ঢুসে ঘুমায়। রাতে কাউকে ঘুমাতে দেয় না। তার খেলার সময় তো রাতে।

‘ আইচ্ছা আমি হাসপাতালে চইলা গেলে তুই আমার বউরে আর ভাইরে দেইখা রাখবি। সঙ্গে সঙ্গে থাকবি।

‘ আচ্ছা জেম্মা। তুমি ফোনে জানাইও আপার কি বাবু আসছে।

‘ হারামজাদি বাবু বাবু করস ক্যান? আল্লারে ক যাতে আমার সোহাগিরে ভালা রাখে।

‘ আপা আর আপার বাবু ভালা থাকবে জেম্মা।

____________

এশার আযান পড়েছে মাত্র। অনুরাগ বের হলো মসজিদের উদ্দেশ্য। জমির আর রাজীব দুজন তার সাথে মসজিদের উদ্দেশ্য পা দিয়েছে মাত্র। তখনি অনুরাগের ফোনে কল এল। রাশেদকে ফোন করতে দেখতেই অনুরাগের ঠোঁটের কোণায় হাসি এল। ফোন তুলে কানে দিতেই রাশেদের মুখে সবটা শুনে থেমে গেল সে।

‘ তুই কবে আসবি? তোর বউকে মনে নয় শহরে নিয়ে যেতে হবে। খুব দেরী হলে আসার দরকার নেই। আমরা সামলে নিচ্ছি। জানানোর প্রয়োজন ছিল তাই জানিয়েছি।

‘ কবে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে?

‘ সন্ধ্যায়।

‘ আর আমাকে এখন জানানো হচ্ছে? তখন রওনা হলে তো আমি এতক্ষণ পৌঁছে যেতাম। ওর সাথে তো আমার দুপুরেই ফোনে কথা হলো। তখনও সব ঠিকঠাক ছিল।

‘ হ্যা হঠাৎ করেই সব হলো। খালাম্মা বারণ করেছে তাই কেউ জানায়নি তোকে। দেখিস পাহাড়ি রাস্তা কিন্তু খুব ঝুঁকিপূর্ণ।

অনুরাগ ফোন রেখে দিল। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে নিল। রাজীব বলল

‘ ভাই এখন বের হবো?

‘ তো এখন না, কখন?

‘ আচ্ছা। কিন্তু আমার একজন দক্ষ ড্রাইভার দরকার।

‘ তাড়াতাড়ি খুঁজে নে। এক্ষুণি রওনা দেব।

‘ আচ্ছা ভাই।

দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামের সেই ছোট্ট গ্রামটাতে ছুটলো অনুরাগ। একরাশ চিন্তা, উদ্বিগ্নতা, আর ভয়। তার আয়নামতীটা ভালো আছে তো?
রাতের আকাশ ঝলমলে। পাহাড়ি রাস্তায় পড়েছে চাঁদের কিরণ। জোনাকি পোকারা ছোটাছুটি করে চলছে সবুজের বুকে। কি সুন্দর, মনকাড়া রাতের দৃশ্য! দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়।

________________

গ্রামের ছোট্ট হাসপাতালটি। চিকিৎসা ব্যবস্থা তেমন উন্নত না। অবশ্য কাজ চলছে। শায়খ চৌধুরী পুত্রবধূকে এই হসপিটালে রাখতে চাইলেন না। শহরের হসপিটালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করাবেন। তার বংশধরের আগমন যেখানে সেখানে হবে না। আনহিতা এতে বেজায় রেগে গেলেন। প্রসব বেদনায় কাতর মেয়েটাকে শহরে নিয়ে যাবেন, এতে কি কষ্ট কমবে নাকি বাড়বে?
আয়শা বেগম আর আজহার সাহেব পৌঁছে এক দায় মাতার খোঁজ দিলেন। ভালোই তিনি। গ্রামে এক নামে পরিচিত। এই মুহূর্তে তিনিই ভরসা। আয়শা বেগমের মুখের উপর কথা বলতে পারলেন না কেউ। আনহিতা একটু বেশিই ভয় পায় এই খিটখিটে মহিলাকে। তাই আয়নাকে নিয়ে যাওয়া হলো বাড়িতে। অনুরাগ ঠিক তখনি এসে পৌঁছোলো বাড়িতে। দূর থেকে একটুখানি আয়নাকে দেখেছিল। আহ আর্তনাদ এখনো কানে বাজছে। এত কষ্ট! আর বাচ্চাকাচ্চার দরকার নেই। একটাই যথেষ্ট। আয়নামতীর কষ্টের ভাগ তো সে নিতে পারছে না।

ছোট্ট একটা মাটির ঘর। হারিকেন জ্বালানো ঘরের এককোণে । আয়ান শহর থেকে আসামাত্র ছুটলো সেই দাত্রীর ঘরে। নিয়ে চলে আসলো চৌধুরী বাড়িতে। সব পুরুষ মানুষকে বসার ঘরে বসে থাকতে বলেছে আয়শা বেগম। আয়ান দুশ্চিন্তায় এদিকওদিক হাঁটাহাঁটি করতে লাগলো। আল্লাহ যেন তার টুনির কষ্ট কমিয়ে দেন। অনুরাগ বলল

‘ আমি কি যাব একবার?

আয়ান বলল

‘ না না ভাই। আম্মা কি বলে গেছে দেখেননি। এখন যাওয়া যাবে না।

অনুরাগ বাড়ি থেকে বের হয়ে উঠোনে দাঁড়ালো। এদিকওদিক পায়চারি করতে করতে একসময় অমি ছুটে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল

‘ মামা নানু বলেছে একটা ছোট্ট পাখি এসেছে।

অনুরাগের বুক ছিঁড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলো অনুরাগ। আয়ান এসে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপড়ে বলল

‘ অভিনন্দন ছোট্ট পাখির আব্বা।

অনুরাগ অতিরিক্ত খুশিতে বোবা হয়ে গেল। শুধু চোখ দুটো ছলছল করে জানান দিল সে এই মুহূর্তে ঠিক কতটা খুশি। তার জীবনে আয়নামতী সবচাইতে বড় পাওয়া। তার আদুরে বউ ছাড়া এখন মেয়েটির আর ও একটি পরিচয়। সে এখন কারো আদুরে মমতাময়ী মা।

দূর থেকে শুধু কন্যার কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। অনুরাগ ধারেকাছেও যেতে পারলো না। আয়শা বেগম এসে বললেন

‘ জামাই তুমি এখন ওইদিকে যাবা না ভুলে ও। দাত্রীকে খুশি করে আসো।

অনুরাগ পকেটের ওয়ালেটে যে কয়টা হাজার টাকা ছিল সব বের করে দাত্রীকে দিয়ে দিল। বলল

‘ হসপিটালে আর ও বেশি দিতে হতো। আপনি খুশি হয়েছেন তো? কাপড়চোপড় আমি পাঠিয়ে দেব।

দাত্রী বেশ খুশি হলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল

‘ অনেক বছর বেঁচে থাকো বাপ।

‘ আমার কন্যার জন্য ও দোয়া করে দেন।

হেসে ফেলল বৃদ্ধা।

‘ দোয়া দিলাম।

‘ আমার কন্যার মায়ের জন্য ও দোয়া করে দেন।

‘ দিলাম দিলাম। অনেক অনেক দোয়া। অনেক সুখী হও বাছা । মানুষের ভালা করো।

অনুরাগ একগাল হাসলো। আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া সবটা ভালো ভালোই হয়েছে বলে।

______________

নরম তুলতুলে তুলোর মতো শরীর। খ্যাঁচখ্যাঁচ কান্নার আওয়াজে ভারী পরিবেশ। বন্ধ চোখে হাত পা নেড়ে চেঁচিয়ে কেঁদে সবাইকে নাজেহাল করে ছেড়েছে ছোট্ট মেহমানটা। দূর থেকে অনুরাগের কান্নার আওয়াজটা শুনতে বেশ সুন্দর লাগছে। কি মধুর!
আনহিতা আয়শা বেগমের আড়ালে নাতনিকে নিয়ে চলে আসলেন নিচে। অনুরাগকে ডাকলেন। ছুটে আসলো অনুরাগ। তরতরিয়ে কাঁপতে লাগলো তার হাত। বলল

‘ কেন ডেকেছ মা?

‘ এটাকে দেখো।

অনুরাগ সন্তর্পণে তাকালো। দূরে গিয়ে বলল

‘ না না আমি নেব না। খুব নরম। পড়েটরে যাবে। আয়নামতী আবার রেগে বুম হয়ে থাকবে। এই মেয়ে ও রাগ করা শিখে যাবে। আমি কয়জনকে সামলাবো মা?

খিক করে হেসে ফেললেন আনহিতা। বললেন

‘ কি বোকা ছেলে আমার? যার জন্য এত অপেক্ষা তাকে কোলে নেবে না? নাও নাও। তোমার শ্বাশুড়ি চলে আসলে আর নিতে পারবে না কিন্তু।

‘ আচ্ছা দাও। তুমি ও ধরে রাখবে কেমন?

‘ আচ্ছা।

অনুরাগ তার দুহাতের উপর নিয়ে নিল তুলতুলে শরীরটাকে। বলল

‘ খুব নরম মা। এত নরম কেন? গলে যাচ্ছে যেন।

‘ এখন ওরকম হয়। মাত্রই দুদিন হয়েছে। ছোট্ট নরম গালটাতে ঠোঁট ছুঁয়ালো অনুরাগ। শায়লা বেগম আসতেই আনহিতা চলে গেল। অনুরাগ মেয়েকে নিয়ে বসলো সোফায়। শায়লা বেগম পাশে গিয়ে বসলো। বলল

‘ দাদুভাই বউয়ের সাথে দেখা হয়ছে।

‘ কেউ যেতে দেয় না তো।

‘ আহারে কি দুঃখ আমার ভাইয়ের। আমি যদি সাহায্য করি।

‘ পারবে না ওখানে শ্বাশুড়ি মা আছে। একটা কথা বলো আমায়। আমার বউ আর আমি গেলে নাকি সমস্যা। সব কুসংস্কার।

‘ আমি বুঝতে পারছি আমার ভাইয়ের দুঃখ।

‘ আর শোক না ফেলে আমাকে আমার বউয়ের কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও।

‘ আচ্ছা তুমি আমার পিছন পিছন আসো।

‘ শ্বাশুড়ি যদি কিছু বলে?

‘ আসো আসো। আমি সামলে নেব।

অনুরাগ দাদীর পিছু পিছু গেল। কোলে তার ছোট্ট মা টা। চোখ একটু একটু খোলা। অনুরাগ নাকের ডগায় আদর দিল। বলল

‘ তোমার আম্মাজান এখন আমার কাছে দুর্লভ আম্মাজান।

বলেই হেসে ফেলল অনুরাগ। শায়লা বেগম পিছু ফিরে বলল

‘ দাদুভাই একটু করে দেখে চলে আসবে আবার। তোমার শ্বাশুড়িকে আমার ও ভয় হয়।

‘ আচ্ছা আচ্ছা সে পরে দেখা যাবে।

আয়শা বেগম নাকি রান্নাঘরের দিকে গিয়েছে। গরম পানি আনার জন্য। সে সুযোগে শায়লা বেগম অনুরাগকে ঘরে ঢুকিয়ে দিল। চামেলি এসে বলল

‘ আমি খালাম্মারে গিয়ে বলে আচি । ছুটোচাহেব বৌরাণির কাছে গেছে গা।

অনুরাগ এসে বলল

‘ আরেহ না না, এদিকে আসো। তোমার যা চায় তাই দেব। বলিওনা প্লিজ।

‘ তাহলে আমার একটা লিপিস্টিক আর ফর্চা হওয়ার কিরিম লাগবো। বৌরাণি যেগুলো মুখে মাজে সেগুলো।

‘ আরেহ আমি তো দেখিনা কি মাজে? কিছু দেয় না। আমার বউ এমনিতে সুন্দর।

‘ নয়। আমি জানি। কিচু তো মাজে।

‘ আচ্ছা আচ্ছা ওগুলো তুমি ওর কাছ থেকে নিয়ে নিও। আমি এনে দেব। ঠিক আছে। কছম করো, শ্বাশুড়ি মাকে বলে দেবে না।

‘ কছম করচি।

ঘুমন্ত সদ্য নতুন এক মা জননী। বাচ্চার কিচমিচ আওয়াজ শুনে চোখ মেললো। ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটলো যখন দেখলো এক পিতার কোলে সন্তান। তারই সন্তান। আহ কি সুন্দর!
অনুরাগ মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে মেয়েকে চট করে আয়নার পাশে শুইয়ে দিল। বউকে এক হাতে টেনে এনে বলল

‘ আয়নামতী কেউ আসতে দেয় না এখানে। কি জ্বালারে ভাই? আমি আমার বউয়ের কাছে আসতে পারিনা! এটা কোনো কথা?

আয়না মিটমিটিয়ে হেসে ফেলল। দুর্বল গলায় বলল

‘ আপনি তো বাবা হয়ে গেছেন। বোকাসোকা রূপটা এবার পাল্টে যাক না?

‘ কি দরকার? আমার বউ আমাকে বোকাসোকাই পছন্দ করে। মেয়ে ও করবে। বোকা আব্বা, বুদ্ধিমতী আম্মা।

বলেই হেসে ফেলল অনুরাগ। আয়না ও।

‘ কেমন মানুষ আপনি? আমি কালকেই আপনাকে খুঁজছিলাম জ্ঞান ফেরার পর। কোথায় ছিলেন?

‘ কেউ আসতে দিলেই তো। তোমার মা জননী তো একেবারে আসতেই দিচ্ছে না। আমি তোমার কাছে আসলে নাকি তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে না। এটা কোনো কথার কথা?

আয়না হেসে ফেলল। বলল

‘ ওনারা কত নিয়মকানুন মানে, সে যাইহোক সব ঠিকঠাক আছে তো? কুহেলী,,,

‘ তোমার আর কোনো কথা নেই? কুহেলী ফুহেলী যা করার করুক। ভেড়া সবসময় ভ্যা ভ্যা করবেই । সিংহ গর্জন একবারই করে আর সব কাঁপিয়ে দেয়। যতদিন অনুরাগ চৌধুরী থাকবে ততদিন ওই কুহেলী আর খালেকুজ্জামানের মতো অমানুষ ও থাকবে। যেখানে শুভ কিছু থাকে সেখানে অশুভ কিছু ও থাকে। শত্রু একেবারেরই নির্মূল হয় না আয়নামতী। শুধু তুমি পাশে থাকো, হাতটা ধরে রাখো, আর বুকটা ঠাঁই হিসেবে নাও। বাকি সবকিছুকে আমি তুচ্ছ ঘোষণা করে দিলাম। আমার পরিবার আর আপনজনগুলোকে আমি দুর্বল জায়গা হিসেবে দেখতে চাই না। শক্তি হিসেবে দেখতে চাই।

আয়না অশ্রুচোখে হাসলো। বলল

‘ আমি জীবনের শেষ অব্দি আপনার হাতটা ধরে রাখব। এক মুহূর্তের জন্য ও ছাড়ব না। আমি আপনার রণরঙ্গিণী হবো রণবীর। আপনাকে সাজিয়ে দেব রণসজ্জায়। আর আপনি বারবার ফিরবেন যুদ্ধে জয়ী হয়ে। আমি থাকব এক সুন্দর অপেক্ষায়।

অনুরাগ মাথা নামিয়ে প্রানমোহিনীর
কপালে প্রলেপ আঁকলো ভালোবাসার । মেয়ের কপালে দিল স্নেহ, মমতার স্পর্শ । অতঃপর বলল

‘ আমার মেয়ে জ্যোৎস্না নিয়ে এসেছে আয়নামতী। ওর নাম হবে জ্যোৎস্নারাণী। নামটা সুন্দর না। আমি ওকে এই নামেই ডাকব। বাকিরা যা বলার বলুক গে। আমার কি? আমার মেয়ের নাম আমি দিয়ে দিলাম। আমার মেয়ে।

আয়না ভিজে গলায় বলল

‘ নামটা সুন্দর প্রফেসর। কিন্তু মেয়েটা আমাদের।

অনুরাগ বলল

‘ হিংসুটে মহিলা।

_________

পরিশিষ্ট ;;;;;;

সায়ানের কান্নার আওয়াজে ফোন রাখতে হলো আয়ানকে। উঠোন থেকে বাড়িতে পা রাখলো। মিরা কোথায় গেল? রূপা ও বা কোথায়?
রুমে পা রাখতেই দেখলো মিরা ঘুমাচ্ছে। বুকের উপর সায়ান শুয়ে শুয়ে কাঁদছে। রাতে একদম ঘুমাতে চাই না এই ছেলে।

আয়ান এগিয়ে গেল। ছেলেকে কোলে তুলে আদর করলো সারামুখে। বলল

‘ কেন কাঁদে আব্বা?

‘ আমমমা,,

‘ আম্মা ঘুম? পাজি আম্মাটা।

মিরা চোখ মেলে চেয়ে থাকলো। কম্বল টেনে গায়ে দিয়ে বলল
‘ তোমরা বাপ ছেলে আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছ না কেন?
‘ তুমি আমার ছেলেকে কাঁদিয়ে ঘুমাচ্ছ মিরা। খুব খারাপ।

আয়ান ছেলেকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো। বলল
‘ আমরা আজ থেকে কথা বলব না মিরার সাথে। ঠিক আছে?
‘ থিহ।
‘ হুম থিক।
বলেই আবার আদর করলো ছেলেকে। নামিরা চোখ মেললো আবার। সায়ানকে নিয়ে নিল। বুকে টেনে শক্ত করে ধরলো। মাথায় চুমু আঁকতে আঁকতে বলল

‘ ও আমার ছেলে। তুমি, ও হওয়ার সময় ছিলে না।

মন খারাপ হয়ে গেল আয়ানের। কম্বল গায়ে টেনে পাশ ফিরে শুয়ে বলল

‘ আচ্ছা ঘুমাও।

সায়ান ডাকল

‘ আবববা।

আয়ান ফিরলো না। নামিরা হেসে ফেলল। সায়ানকে তার পাশে রাখলো। হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো আয়ানকে। পিঠে মুখ ঘষে বলল

‘ এই শ্বশুরের ছেলে? রাগ কেন? মজা করলাম তো।
আয়ান হাতটা ধরলো। বলল
‘ রাগ করিনি মিরা।
‘ তাহলে আমার দিকে ফিরো। ফিরো বলছি।
‘ ফিরলাম।
নামিরা হাসলো। ছেলের দিকে ফিরল। বুকে টেনে নিল ছেলেকে। আয়ানের এক হাত নিয়ে বলল
‘ জড়িয়ে ধরো না। সব বলতে হয়।
আয়ান হেসে ফেলল। জড়িয়ে ধরে মা ছেলেকে টেনে নিল। মনমাধবীর কানে নাক ঘষতে ঘষতে চুমু খেল। বলল

‘ মিরা আমি তোমার কাছে কেমন স্বামী?

নামিরা তার হাতটা নিয়ে চুমু খেল। ফিরে তাকালো। বলল

‘ সত্যি বলব? নাকি মিথ্যে?

‘ অবশ্যই সত্যিটা মিরা।

‘ তাহলে বলতে হয় তুমি আমার তেমন স্বামী, যেমনটা চেয়েছিলেন অন্তর যামী।

গালভরা তৃপ্তির হাসি দেখা দিল আয়ানের মুখে।

সায়ান উঠে বসলো। নামিরা আর আয়ানের মাঝখানে এসে খিকখিক করে হেসে দিল। বলল

‘ মাইন।

‘ মাইর? কাকে মাইর দেবেন?

‘ আমমমো আবববো।

নামিরা আর আয়ান দুজনই হেসে উঠলো। দু’জন দুজনের ঠোঁটের স্নেহমাখা স্পর্শ বসালো ছেলের কপালে।

________________

আরেহ কি করছেন? আশেপাশে সবাই মানুষ। আপনি কি পাগল?

অনুরাগ বাগানের আশেপাশে তাকালো। কয়েকজন ফুল তুলতে তুলতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অনুরাগ ধমকের সুরে বলল

‘ ওই এদিকে কি? কাজ কর ভাই আমার।

তারপর মিনমিন করে বলল

‘ শালা এদের প্রেমপিরিতি দেখার এত শখ! কোথাও শান্তি নাই।

আয়না হেসে ফেলল। অনুরাগ হাত দিয়ে একটি রজনীগন্ধার স্টিক ছিঁড়ে নিয়ে বলল

‘ নাও রজনীগন্ধা, এটা দিলাম আমার জীবনটা রজনীর মতো সুগন্ধ করে দেওয়ার জন্য।

আয়না হাতে নিল। বলল

‘ ধন্যবাদ।

অনুরাগ জারবেরার একটি ফুল ছিঁড়ে কানের কাছে গুঁজে দিল। বলল

‘ জারবেরা দিলাম প্রাণবন্তা। আমার জীবনটা রাঙিয়ে দেওয়ার জন্য।

আয়না ফুলটা ছুঁয়ে হাসলো। অনুরাগ গ্লাডিওলাস নিয়ে হাতের মুঠোয় দিল। বলল

‘ এটা দিলাম আমাকে একটি রাজকন্যার পিতা হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।

আয়না আবার ও হাসলো। অনুরাগ লাল কমলা হলুদ রঙের একমুঠো গাঁদা ফুল এনে মাথার কাঁপড় সরিয়ে খোঁপায় গুঁজে দিল। বলল

‘ সব দিলাম আমাকে ভালোবাসার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।

‘ আর ও দেবেন?

অনুরাগ কোমর টেনে তার কাছে নিয়ে এল আয়নাকে।

‘ কেউ যদি দেখে ফেলে?

অনুরাগ জবাব দিল না। কপালে দীর্ঘ চুম্বন এঁকে তাকালো। বলল

‘ এই চুম্বন সারাজীবন তোমার পাওনা মনোহারিণী আমাকে ভালোবাসার জন্য।

আয়না তার দুহাতে বন্ধনে আগলে নিল পুরুষালী মুখটা। নিজের কাছে নামিয়ে এনে পরপর চুম্বন এঁকে দিল খুব ব্যাক্তিগত জায়গায়। অতঃপর বলল

‘ আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসার জন্য, বিশ্বাস করার জন্য, সবকিছুর জন্য আপনাকে একটা পৃথিবী সমান ভালোবাসা দিলাম। যদি কখনো মনে হয় ফুরিয়ে আসছে আমাক বলবেন। আমি দিতে কুণ্ঠাবোধ করব না প্রাণপুরুষ।

অনুরাগের ঠোঁটের কোণায় চমৎকার হাসি। সে আরও একটি স্পর্শ আঁকলো কপালে। তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল

‘ এই আমার তুমিটা সবচাইতে অনন্য। আমি হাজারবছর তোমাকে ভালোবেসে গেলে ও ক্লান্ত হবো না #আয়নামতী।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here